আল্লাহর মনোনীত এসকল মানুষকে ইসলামের পরিভাষায় নবী বা রাসূল বলা হয়। পবিত্র কুরআনে ও হাদীসে বিভিন্ন স্থানে এই দুইটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তবে এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে কুরআন বা হাদীসে সুস্পষ্ট কিছু বলা হয় নি।
‘নবী’ (النبيّ) শব্দটি ‘নূন, বা ও হামযা’ তিন বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত আরবী (نَبَأ) ক্রিয়ামূল থেকে গৃহীত। ‘নাবা’ (النَّبَأُ) অর্থ সংবাদ, খবর ইত্যাদি। ক্রিয়া হিসেবে আন্বাআ (أَنْبَأَ) ও নাব্বাআ (نَبَّأ) অর্থ সংবাদ প্রদান, বলা বা জানানো। শব্দটির শেষ অক্ষর হামযা। এজন্য ‘আন-নাবিইউ’ (النبيُّ) শব্দটি মূলে ছিল ‘আন-নাবী-উ (النبيء)। অত্যধিক ব্যবহারের ফলে হামযাটি পরিবর্তিত হয়ে ইয়া-তে রূপান্তরিত হয়েছে। ‘আন-নাবিইউ’ শব্দটির অর্থ সংবাদদাতা।
আরবীতে ‘নূন’, ‘বা’ ও ‘ওয়াও’ তিন বর্ণের সমন্বয়ে আরেকটি শব্দ রয়েছে, যার অর্থ উচ্চ হওয়া। কোনো কোনো ভাষাবিদ মত প্রকাশ করেছেন যে, ‘নবী’ শব্দটি এই ধাতু থেকে গৃহীত। সেক্ষেত্রে শব্দটির অর্থ হয় ‘সুউচ্চ, ‘উচ্চীকৃত’ বা ‘মর্যাদাময়’। তবে কুরআন কারীমের বিভিন্ন ব্যবহার ও কুরআনের বিভিন্ন কিরাআতের আলোকে স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষদেরকে ‘সংবাদ’ প্রদানের অর্থেই ‘নবী’ বলা হয়।
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, রাসূল (الرسول) শব্দটির আভিধানিক অর্থ প্রেরিত, দূত ইত্যাদি। আরবী ‘আরসালা’ (أرسل) অর্থ প্রেরণ করা। অন্যের পক্ষ থেকে কোনো সংবাদ, তথ্য বা বাণী নিয়ে যিনি আগমন করেন তাকে রাসূল বলা হয়।
ধর্মীয় পরিভাষায় নবী অর্থ যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রাপ্ত কল্যাণ অকল্যাণ, শুভ-অশুভ বিভিন্ন কর্মের পথ ও পরিণতি সম্পর্কে সকল সংবাদ মানুষকে জানান, পরকাল, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষদেরক সংবাদ দান করেন। আর (রাসূল) যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ওহীর মাধ্যমে, প্রাপ্ত বার্তা বা শিক্ষা আল্লাহর প্রেরিত দূত হিসেবে মানুষদের কাছে পৌঁছে দেন।
এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, অর্থের দিক থেকে দুইটি শব্দই প্রায়ই সমার্থক। ব্যবহারের দিক থেকেও শব্দ দুটি প্রায়ই সমার্থক। সকল নবী রাসূলই আল্লাহর মনোনীত মানুষ যাদেরকে আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে তাঁর বাণী শিক্ষা দান করেছেন, যে শিক্ষা সাধারণ কোনো মানুষ মানবীয় জ্ঞান বা কোনো সাধনা প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্জন করতে পারেনা।
শব্দদ্বয়ের মধ্যে শরীয়তের পরিভাষায় কোনো পার্থক্য আছে কি না সে বিষয়ে আলিমগণ মতভেদ করেছেন। মতভেদের কারণ এ বিষয়ে কুরআন কারীমের বা হাদীস শরীফে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এজন্য আলিমগণ কুরআন ও হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশনার আলোকে ইজতিহাদ করেছেন। কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন যে, উভয় পরিভাষার মধ্যে ব্যবহারিক কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই সকল নবীই রাসূল এবং সকল রাসূলই নবী।
অধিকাংশ আলিম মতপ্রকাশ করেছেন যে, শব্দদুটির মধ্যে পারিভাষিক ও ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে। তাঁরা আরো একমত প্রকাশ করেছেন যে, রিসালাত (الرسالة) বা রাসূলের দায়িত্বর চেয়ে নুবুওয়াত (النبوة) বা নবীর দায়িত্ব সাধারণতর। এ জন্য সকল রাসূলই নবী, কিন্তু সকল নবীই রাসূল নন। যে কোনো ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে দীন বা শরীয়ত বিষয়ক কোনো নির্দেশনা লাভ করেন তিনিই নবী। আর রাসূল অতিরিক্ত কিছু দায়িত্ব লাভ করেন।
রাসূলের অতিরিক্ত দায়িত্বের প্রকৃতি ও স্বরূপ নির্ধারণে তাঁরা খুটিনাটি মতভেদ করেছেন। এ বিষয়ে ইবনু আবিল ইয্য হানাফী বলেন:
وَقَدْ ذَكَرُوا فُرُوقًا بَيْنَ النَّبِيِّ وَالرَّسُولِ، وَأَحْسَنُهَا أَنَّ مَنْ نَبَّأَهُ اللَّهُ بِخَبَرِ السَّمَاءِ، إِنْ أَمَرَهُ أَنْ يُبَلِّغَ غَيْرَهُ فَهُوَ نَبِيٌّ رَسُولٌ ، وَإِنْ لَمْ يَأْمُرْهُ أَنْ يُبَلِّغَ غَيْرَهُ فَهُوَ نَبِيٌّ وَلَيْسَ بِرَسُولٍ.
‘‘নবী ও রাসূলের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে সুন্দর মত যে, যাকে আল্লাহ আসমানী সংবাদ প্রদান করেন যদি তাকে আল্লাহ সেই সংবাদ অন্যকে প্রদানের দায়িত্ব প্রদান করেন তবে তিনি নবী ও রাসূল। আর যদি তাকে এরূপ প্রচারের দায়িত্ব না দেওয়া হয় তবে তিনি নবী মাত্র, রাসূল নন।’’[1]
মোল্লা আলী কারী বলেন:
الرسول من أُمِر بالتبليغ، والنبي من أُوْحِي إليه، أعم من أن يُؤمَرَ بالتبليغ أم لا. قال القاضي عياض: والصحيح الذي عليه الجمهور أن كل رسول نبي من غير عكس. وهو أقرب من نقل غيره الإجماع عليه، لنقل غير واحد الخلاف فيه، فقيل: النبي مختص بمن لا يؤمر، وقيل هما مترادفان، واختاره ابن الهمام، والأظهر أنهما متغايران لقوله تعالى: (وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ وَلا نَبِيٍّ) الآية
‘‘যাকে প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তিনি রাসূল। আর যাকে ওহী দেওয়া হয়েছে তিনিই নবী, তাকে প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হোক বা না হোক। কাযি ইয়ায বলেন: অধিকাংশ আলিম একমত যে, সকল রাসূলই নবী, তবে সকল নবী রাসূল নন। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন যে, আলিমগণ এ বিষয়ে ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কাযি ইয়াযের বর্ণনাটিই সঠিক, অর্থাৎ এ বিষয়ে সকল আলিম একমত পোষণ করেন নি, বরং অধিকাংশ আলিম একমত পোষণ করেছেন। কারণ একাধিক আলিম এ বিষয়ে মতভেদ উল্লেখ করেছেন। কেউ বলেছেন, যাকে প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয় নি তাঁকেই শুধু নবী বলা হয়। কেউ বলেছেন: নবী ও রাসূল দুটি একার্থবোধক শব্দ; উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ইবনুল হুমাম এই মতটি গ্রহণ করেছেন। সঠিকতর মত যে, উভয় শব্দের মধ্যে পার্থক্য আছে। কারণ মহান আল্লাহ বলেছেন[2]: আমি আপনার পূর্বে যে কোনো রাসূল অথবা যে কোনো নবী পাঠিয়েছি...।’’[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী প্রাপ্ত প্রত্যেক মানুষকেই নবী বলা হয়। যদি কোনো ওহী প্রাপ্ত মানুষকে আল্লাহর নতুন বিধানাবলী দান করে তা প্রচারের নির্দেশ দান করেন তাহলে তাঁকে রাসূল বলা হয়। আর যদি তাঁকে শুধু ওহীর মাধ্যমে, আল্লাহর বাণী দান করা হয়, নতুন কোনো বিধান প্রচারের দায়িত্ব্ দেওয়া না হয় তাহলে তিনি রাসূল নন, কেবলমাত্র নবী বলে আখ্যায়িত হন, যেমন ইহুদীদের মধ্যে আল্লাহ অনেক নবী প্রেরণ করেছেন, যাঁদেরকে নতুন কোনো বিধানাবলী দান করেন নি তাঁরা পূর্ববর্তী রাসূল মুসা (আ)-এর শরীয়ত অনুসারে তাঁদের জাতিকে পরিচালিত করতেন। আসমানী দায়িত্ব লাভের প্রথম পর্যায় নবীর দায়িত্ব লাভ এবং চূড়ান্ত পর্যায় রাসূলের দয়িত্ব লাভ।
[2] সূরা (২২) হাজ্জ: ৫২ আয়াত।
[3] মোল্লা আলী ক্বারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১০৬।