১৪. আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপর ভরসা করা:
ইহ-পরকালীন যে কোনো বিষয় অর্জিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত কর্ম করার পর তা অর্জিত হওয়ার জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করা হচ্ছে অন্তরের একটি অন্যতম উপাসনা। কোনো কর্ম করা বা উদ্দেশ্য অর্জিত হওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ মানুষের সাহায্যকারী হতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই কেউ কারো ভরসা হতে পারে না, কেননা কোনো কাজ আরম্ভ করা এবং সফলভাবে তা সম্পন্ন করা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। কোনো মানুষ কাউকে সাহায্যের জন্য ইচ্ছা করলে তার ইচ্ছা ও কর্ম বাস্তবে কেবল তখনই রূপ নিতে পারে যখন এর সাথে আল্লাহর ইচ্ছার সংমিশ্রণ ঘটে, অন্যথায় নয়। তাই আল্লাহই হলেন আমাদের যাবতীয় কর্মের একক ভরসা। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো কোন কর্মের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষদের মুখে এমন কথা বলতে শুনা যায় যে, ‘একাজে আপনিই আমার একমাত্র ভরসা’, ‘আপনার উপর আমি ভরসা করেছি’, আবার অনেককে আখেরাতে মুক্তির জন্য সঠিক ঈমান ও সৎকর্ম করে আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা না করে ওলি ও পীরদের শাফা‘আতের উপর ভরসা করতে দেখা যায়।
১৫. আল্লাহ ও রাসূল ব্যতীত কোনো মানুষের মত ও পথের অন্ধ আনুগত্য ও অনুসরণ করা :
কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত যাবতীয় বিধানের যথাসাধ্য অনুসরণ ও আনুগত্য করা হচ্ছে আল্লাহর বিধানের আনুগত্যের উপাসনা। এ উপাসনার প্রতি নির্দেশ করে মহান আল্লাহ বলেছেন:
﴿ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ﴾ [الاعراف: ٣]
‘‘তোমাদের প্রতি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তোমরা তা অনুসরণ কর এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো অভিভাবকদের অনুসরণ করো না।’’[16]
আল্লাহর বিধানের অনুসরণ ও আনুগত্যের এ উপাসনা মানুষের যাবতীয় চিন্তা, চেতনা, কাজ-কর্ম ও কথার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হবে। আর সে-জন্যে জ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে সবাইকে তাকলীদ বা অনুসরণের যে সঠিক পদ্ধতির কথা প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে তা অনুসরণ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এক্ষেত্রেও দেশের সাধারণ লোকদের মত অনেক জ্ঞানী লোকেরাও অনেকটা নিজেদের অজান্তেই অনুসরণের বৈধ নীতিমালা লঙ্ঘন করে চলেছেন। সাধারণ লোকজন অন্ধভাবে তাদের পীরদের আনুগত্য ও অনুসরণ করে থাকেন। কুরআন ও সহীহ হাদীস দ্বারা তাদের কোনো কর্মের ত্রুটি প্রমাণ করে দিলেও তারা তাদের পীর সাহেবের নির্দেশ ব্যতীত তা পরিত্যাগ করেন না।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে জ্ঞানী অধিকাংশ আলেমগণ নিজ মাযহাবের নিঃশর্ত ও নির্বিচারে অনুসরণ করেন। কোনো বিষয়ে নিজের ইমাম বা মাযহাবে প্রচলিত আমলের বিপরীতে সহীহ হাদীসের সন্ধান পেলেও বিভিন্ন অনর্থক যুক্তি ও তর্ক দাঁড় করিয়ে তারা নিজের ইমামের মত বা মাযহাবের অনুসরণ করেন এবং সহীহ হাদীসকে আমলের অযোগ্য বা তা শাফিঈ মাযহাবের অনুসারীদের জন্য প্রযোজ্য বলে পরিত্যাগ করেন। এভাবে তারা নিজ মাযহাবে প্রচলিত যাবতীয় আমলকেই নির্বিচারে ও অন্ধভাবে অনুসরণ করে থাকেন। যদিও মাযহাবের কিতাবাদির ব্যাখ্যা গ্রন্থে বা টীকা-টিপ্পনীতে অনেক সত্যানুরাগী আলেমগণ নিজ মাযহাবে প্রচলিত কিছু কিছু আমলের বিপরীতে অবস্থিত সহীহ হাদীসসমূহের উপর আমল করাকেই সঠিক বলে মত প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা সুন‘উল্লাহিল হালাবী আল-হানাফী (মৃত ১০৫০হি:) তাঁর ‘আল-কাউলুস সদীদ ফী মাসাইলিত তাকলীদ’ নামক রিসালায় বলেন :
"لا علينا أن لا نأخذ بما ظهر لنا صواب خلافه إذ أنعم الله علينا بحصول ضرب من النظر ، يمكن الوقوف به على الصواب ، هذا ونحن مع ذلك لا نخرج عن درجة التقليد لإمامنا الأعظم أبي حنيفة المقدم"
‘‘নিজ ইমামের মতের বিপরীত কোনো সঠিক বিষয় আমাদের নিকট প্রমাণিত হলে তা গ্রহণ করাতে আমাদের কোনো দোষ নেই কারণ, আল্লাহ আমাদেরকে কিছু চিন্তা-ভাবনা করার নেয়ামত দান করেছেন, যদদ্বারা আমাদের পক্ষেও সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব। ইমামের মতের বিপরীতে সঠিক কথা গ্রহণ করলেও এতে আমরা আমাদের অগ্রবর্তী ইমামে আ‘যম আবু হানীফা (রহ.)-এর তাকলীদ করা থেকে মুক্ত হবো না।’’[17]
এমনকি তাঁরা সে সব হাদীসের উপর মাযহাবের অতীতের বহু মীষীগণের আমল থাকার কথাও অকপটে স্বীকার করেছেন। সহীহ হাদীস নিজ ইমামের ফতোয়ার বিপরীতে পাওয়া গেলে তা পরিত্যাগ করে হাদীসের উপর আমল না করলে নিজ ইমামকে নিজের প্রতিপালক বানিয়ে নেয়া হবে বলেও ক্বাযী মাওলানা সানাউল্লাহ পানিপথী হানাফী নিজ মাযহাবের অনুসারীদের সতর্ক করেছেন।[18] নির্দিষ্ট কোনো এক মাযহাবের অন্ধ তাকলীদ ও একচ্ছত্র অনুসরণ করা জরুরী বলে কেউ কেউ মত পোষণ করে থাকলেও আসলে যাঁরা তা জরুরী নয় বলে মত দিয়েছেন, তাঁদের কথাই অধিক সঠিক।’’[19] হানাফী মাযহাবের উসূলে ফিকহের গ্রন্থ ‘আত-তাহরীর’ এর ব্যাখ্যা ‘আত-তায়সীর’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে : ‘‘কেউ কেউ বলেছেন: সকল বিষয়ে নির্দিষ্ট এক মাযহাব অনুসরণ করা জরুরী নয়। তাঁদের কথাই অধিক সঠিক; কেননা, আল্লাহ তা‘আলা যা ওয়াজিব করেছেন তা ব্যতীত ওয়াজিব বলতে আর কিছু নেই।’’[20] যারা নির্দিষ্ট মাযহাবের নির্বিচারে অনুসরণ করার কথা বলেন এবং কেউ নিজ ইমামের মাযহাব ত্যাগ করলে তাকে শাস্তি দেয়ার কথা বলেন, তাদের ব্যাপারে মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌভী হানাফী বলেন :
"والحق أنه تعصب لا دليل عليه أصلا.و إنما هو تشريع من عند نفسه"
‘‘সঠিক কথা হচ্ছে- নির্দিষ্ট কোনো মাযহাবের অনুসরণ করা একটি গোঁড়ামি বিশেষ। প্রকৃতপক্ষে এর যথার্থতার কোনো দলীল নেই। এটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজস্ব বানানো শরী‘আত বৈ আর কিছুই নয়।’’[21]
নির্দিষ্ট মাযহাব অনুসরণের সম্ভাব্য স্থান :
কোথাও যদি এমন কোনো স্থান পাওয়া যায় যেখানে একটি মাত্র মাযহাবের প্রচলন থাকে, আর অপর মাযহাবসমূহে কী রয়েছে তা অবগত হওয়ার ব্যাপারে সেখানকার আলেম বা সাধারণ মানুষদের কোনো সুযোগ না থাকে, তা হলে সে স্থানের লোকদের উপর নিজ এলাকায় প্রচলিত মাযহাবের অনুসরণ করাই জরুরী হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেখানে যদি অন্য মাযহাবের প্রচলন কমবেশী থাকে, বা অন্য মাযহাব সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকে, তা হলে তা জরুরী হবে না। এ-সম্পর্কে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী বলেন :
‘‘একজন মানুষ যদি ভারত অথবা ফুরাত নদীর ওপারের (মধ্য এশিয়ার) দেশসমূহে বসবাস করে, সেখানে কোনো শাফিঈ, মালিকী ও হাম্বলী মাযহাবের কোনো অনুসারী না থাকে, এ সব মাযহাবের কোনো কিতাবাদিও সেখানে না থাকে, তা হলে সে লোকের উপর ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মাযহাব অনুসরণ করা ওয়াজিব হবে এবং ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মাযহাব থেকে তার বের হওয়া হারাম হবে; পক্ষান্তরে সে লোকটি যদি মক্কা ও মদিনার দেশে থাকে তা হলে তার উপর ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মাযহাবের তাকলীদ করা ওয়াজিব হবে না। কেননা, সেখানে সকল মাযহাব সম্পর্কে অবহিত হওয়া সহজ।’’[22]
শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ.) যে সময়ে এ কথাগুলো বলেছেন তখন উপর্যুক্ত অঞ্চলের অবস্থা এরকমই ছিল। এখানে যেমন হানাফী মাযহাব ব্যতীত অপর কোনো মাযহাবের প্রচলন ছিল না, তেমনি সেখানে থেকে মাযহাব সম্পর্কে জানারও কোনো সুযোগ ছিল না। তাই তখনকার মানুষের জন্য এককভাবে হানাফী মাযহাব অনুসরণ করা ছাড়া কোনো উপায়ান্তর ছিল না। তবে আল্লাহর রহমতে বর্তমানে অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট সুবিধার মাধ্যমে বিশ্ব এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। হাদীস ও অন্যান্য মাযহাব সম্পর্কে জানার কোনো সুযোগই এখন আর আমাদের নাগালের বাইরে নয়। ইচ্ছা করলেই যেমন আমরা পবিত্র মক্কা ও মদীনায় যেতে পারি, তেমনি দেশে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে হাদীসের গ্রন্থ সমূহ এবং অন্য মাযহাবের কিতাবাদির কোথায় কী আছে তাও দেখে নিতে পারছি। এ-ছাড়া হাদীসের গ্রন্থসমূহ এবং অন্য মাযহাবের কিতাবাদি বর্তমানে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান থাকায় প্রয়োজনে আমরা যখন ইচ্ছা তা দেখে নিতে পারি। এক কথায় মতবিরোধপূর্ণ বিষয়াদিতে কার দলীল অধিক সঠিক ও যুক্তিযুক্ত তা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখে নেয়া এখন খুবই সহজ। ইচ্ছা করলেই তা করা যায়। তাই আমাদের দেশের আলেমগণের পূর্বের ন্যায় নিজ মাযহাবের যাবতীয় বিষয়াদি অন্ধভাবে মেনে চলার কোনই সুযোগ নেই; কেননা, এমনটি করা চোখ থাকতে অন্ধ হওয়ার শামিল।
সকল বিষয়ে নির্দিষ্ট করে এক মাযহাব পালন করা জরুরী না হওয়ার কারণ:
নির্দিষ্ট কোনো এক মাযহাবের নির্বিচারে অনুসরণ করা ঠিক না হওয়ার কারণ হলো : মানুষ মাত্রেরই ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। সে-জন্য ইজতেহাদী বিষয়াদিতে কোনো মাযহাবই এককভাবে সকল ক্ষেত্রে সঠিক মত ও পথের উপর হতে পারে না। তাই মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সত্য যেখানে বা যে মাযহাবেই থাকুক না কেন সঠিক ও সবল দলীল এবং গ্রহণযোগ্য যুক্তির ভিত্তিতে তা খোঁজ করে নিয়ে এর অনুসরণ করা এবং সাধারণ জনগণকেও তা পালন করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে আলিম সমাজের দায়িত্ব। কেননা, চোখ থাকতে অন্ধ না হয়ে দেখে শুনে ও বুঝে সুঝে কিছু অনুসরণ করার মধ্যেই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণের পাশাপাশি নিজ মাযহাবের ইমামেরও অনুসরণ নিহিত রয়েছে। কোনো কিছু অনুসরণ করার পূর্বে তা বুঝে সুঝে অনুসরণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী জনগণকে সেদিকে আহ্বান করতে হবে, এটিই হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক অনুসরণের নির্দেশিত সরল ও সঠিক পন্থা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا۠ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِيۖ وَسُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ وَمَآ أَنَا۠ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٠٨ ﴾ [يوسف: ١٠٨]
‘‘বলুন : এ হচ্ছে আমার পথ। আমি আল্লাহর দিকে বুঝে সুঝে দাওয়াত দেই- আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ পবিত্র। আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই।’’[23]
আরবের মুশরিকরা না বুঝে বাপ দাদার অন্ধ অনুসরণ করতো বলেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এ মর্মে ঘোষণা করতে বলেন যে, না বুঝে কিছু অনুসরণ করা আমার ও আমার অনুসারীদের পথ নয়। যারা এমনটি করে তারা মুশরিক। সুতরাং আমি মুশরিকদের অন্তর্গত নই। এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যারা বিভিন্ন অসার যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করে অন্ধভাবে কারো মত ও পথের অনুসরণ করতে গিয়ে কুরআন ও বিশুদ্ধ হাদীসের কথার উপরে নিজের ইমাম বা মাযহাবের কথাকে গুরুত্ব দান করেন, তারা নিজেদেরকে আল্লাহর অনুসরণের উপাসনায় নিজ ইমাম বা মাযহাবকে শরীক করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
অন্ধ তাকলীদের সমালোচনা প্রসঙ্গে দারুল উলূম দেওবন্দের প্রখ্যাত শিক্ষক সাঈদ আহমদ বলেন : যিনি ভুল-ত্রুটির উর্ধে নন এমন কারো অন্ধ তাকলীদ করা শির্কের শামিল। এ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন :
‘‘যিনি ভুল-ত্রুটির উর্ধে নন সাধারণ মানুষের মাঝে তাঁর অন্ধ তাকলীদ করার প্রকৃতি ও স্বরূপ এমন যে, কোনো বিষয়ে মুসলিম উম্মাহের কোনো একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ইজতেহাদ করে থাকবেন। তাঁর অনুসারীগণ তাঁর ইজতেহাদের ব্যাপারে এ-ধারণা পোষণ করে বসবেন যে, তাঁর যাবতীয় ইজতেহাদই একশ’ভাগ সঠিক অথবা অধিকাংশই সঠিক। এ ধারণার ভিত্তিতে তারা তাঁর ইজতেহাদী সিদ্ধান্তের দ্বারা কোনো সহীহ হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করবেন। অথচ রহমাতপ্রাপ্ত এ উম্মতে যে তাকলীদের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন[24], উপর্যুক্ত ধরনের তাকলীদটি সে তাকলীদের অন্তর্গত নয়। কেননা; তারাতো এ বিষয়টি জানার ভিত্তিতে মুজতাহিদগণের তাকলীদ করা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন যে, ইজতেহাদকৃত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো ‘নাস’ আছে কী না, তা জানার ব্যাপারে মুজতাহিদগণের অন্তরে অধীর আগ্রহ থাকার পাশাপাশি সে বিষয়ে ইজতেহাদ করতে গিয়ে তাঁরা ভুল ও শুদ্ধ উভয়ই করে থাকবেন এবং এ সংকল্পের ভিত্তিতে তাঁদের তাকলীদ করা হবে যে, যখন কোনো বিষয়ে তাকলীদ করার পর এর বিপরীতে কোনো সহীহ হাদীস প্রমাণিত হবে, তখন তাকলীদকে বর্জন করা হবে এবং হাদীসের অনুসরণ করা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম {اتخذوا أحبارهم ورهبانهم ...الآية} এর ব্যাখ্যায় বলেছেন : ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানী ও ধর্মযাজকদের উপাসনা করতো না, কিন্তু তারা যখন তাদের জন্য কিছু হালাল বলতো তারা তা হালাল মনে করতো, আর যখন কিছু হারাম বলতো তখন তারা তা হারাম মনে করতো ।’’[25]
ইমাম আবু হানীফা (রহ.) বা তাঁর নামে প্রচলিত মাযহাবের অন্ধ তাকলীদের মাঝে যে আমাদের পরকালীন মুক্তি নয় তা স্বয়ং ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর একটি স্বপ্নের দ্বারাও আমরা অবগত হতে পারি। কথিত আছে যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) একদা আল্লাহ তা‘আলাকে স্বপ্নে দেখেন। তাতে আল্লাহ তাঁকে বলেন: ‘‘আমি তোমাকে এবং কেয়ামত পর্যন্ত যারা তোমার মাযহাবের অনুসরণ করে তাদেরকেও ক্ষমা করলাম’’। ইমাম ইবনে আবিদীন আল-হানাফী (ولمن اتبعك) এ কথার ব্যাখ্যায় বলেন : এর অর্থ হচ্ছে- দ্বীনের খেদমত ও তা জানার ক্ষেত্রে অথবা তোমার ইজতেহাদ দ্বারা তুমি যে সব আদেশ ও নিষেধ অবগত হয়ে থাকবে, সে সব ক্ষেত্রে যারা তোমার অনুসরণ করবে, এত্থেকে বিচ্যুত হবে না, তোমার অনুসরণ স্রেফ (অন্ধ) তাকলীদের মাধ্যমে করবে না, (বরং যারা বুঝে শুনে তোমার তাকলীদ করবে) আমি তাদেরকেও ক্ষমা করলাম।[26]
বিশুদ্ধ দলীলের ভিত্তিতে কারো মত ও পথের অনুসরণ ও তাকলীদের চর্চা অনেক আলেমগণের দ্বারা স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে, অনুসরণ ও আনুগত্য সম্পর্কে আমাদের প্রতি আল্লাহর যে নির্দেশ রয়েছে, তা তাদের দ্বারা অগ্রাহ্য হওয়ার পাশাপাশি, অনুসরণ সম্পর্কে তাদের প্রতি নিজ ইমামেরও যে নির্দেশ রয়েছে, তাও তারা অসতর্কতা হেতু অমান্য করে চলেছেন; কেননা ইমাম আবু হানীফা (রহ.) নিজেই তাঁর অনুসারীদের লক্ষ্য করে বলেছেন:
إذا صح الحديث فهو مذهبي
‘‘হাদীস যখন সহীহ পাওয়া যাবে তখন সেটাই আমার মাযহাব হিসেবে গণ্য হবে।’’[27] অনুসরণ সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর এত সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের অনেক আলেমগণ তা পালন করেন না। তবে আশার কথা হলো : অতীতের কিছু সংখ্যক জ্ঞানীদের ন্যায় অধুনা দেশের প্রখ্যাত কিছু আলেমগণকে সাধারণ আলেমদের চেয়ে কিছু ব্যতিক্রম করতে দেখা যাচ্ছে। তাঁরা বেসরকারী কোনো কোনো প্রচার মাধ্যমের প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠানে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে নিজ মাযহাবে প্রচলিত কোনো কোনো আমল পরিত্যাগ করে এর বিপরীতে সহীহ অথবা অধিক সহীহ হাদীসের দ্বারা প্রমাণিত কিছু আমল করার প্রতি দেশের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন। فلله الحمد و المنة
বিশুদ্ধ হাদীসের বিপরীতে অন্ধভাবে মাযহাব পালনের বাস্তব উদাহরণ:
কোন বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বিশুদ্ধ হাদীস থাকলে এ জাতীয় হাদীসের ব্যাপারে আমাদের করণীয় কী, সে ব্যাপারে হাদীসবিদগণ বলেন :
১. যদি উক্ত ধরনের উভয় হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা যায়, তা হলে তা করে উভয় হাদীসের উপর ‘আমল করতে হবে।
২. আর যদি উভয়ের মাঝে কোনো সামঞ্জস্য বিধান করা না যায়, তা হলে দেখতে হবে যে, এর মধ্যকার কোনো একটি অপরটির জন্য নাসিখ তথা রহিতকারী কি না। তা জানা গেলে রহিতকারী হাদীসকে অগ্রাধিকার দিয়ে সেটির উপর ‘আমল করতে হবে এবং মানসূখ তথা রহিতকৃত হাদীসকে বাদ দিতে হবে।
৩. তা জানা সম্ভব না হলে একটিকে অপরটির উপর অগ্রাধিকার দানের নিয়মানুযায়ী একটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
৪) তাও যদি সম্ভব না হয়, তা হলে কোনো একটিকে অগ্রাধিকার দেয়ার মত কোনো কারণ না পাওয়া পর্যন্ত উভয় হাদীসের উপর ‘আমল করা থেকে বিরত থাকতে হবে।[28]
কোন বিষয়ে যদি পরস্পর বিপরীতমুখী বিশুদ্ধ হাদীস থাকে অথবা একটি হাদীস থেকে দু’রকমের অর্থ গ্রহণের সম্ভাব্যতা থাকে, আর সে কারণে যদি তা নিয়ে ইমামগণের ইজতেহাদের মাঝেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এবং পরবর্তী আলেমগণও যদি কোনোভাবেই সে ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে দু’রকম ‘আমল করেন, আর তাঁদের অনুসরণে আমরাও সে রকম করি, তা হলে আশা করি এতে তাঁরা এবং আমরা সবাই আল্লাহর কাছে উপযুক্ত উজরখাহী করতে পারবো। কিন্তু যে বিশুদ্ধ হাদীসের বিপরীতে অপর কোনো বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া যায় না এবং এর বাহ্যিক অর্থেরও ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা করা যায় না, এমন হাদীসের উপর ‘আমল করার ক্ষেত্রে কারো ভিন্ন মত পোষণ করার কোনই এখতিয়ার থাকে না। অনুরূপভাবে একটি কর্ম যদি সাহাবীদের যুগ থেকে দু’ভাবে করা জায়েয হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলে এর একটিকে গ্রহণ করে অপরটিকে না জায়েয বা মকরূহ বলারও কারো কোনো অধিকার নেই। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মাযহাবের অন্ধ অনুসরণের কারণে আমাদের সমাজে এমনও কিছু ‘আমলের প্রচলন রয়েছে যার মধ্যে বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ‘আমলের বিরোধিতা রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। পাঠক সমাজের বুঝার সুবিধার্থে নিমেণ এর তিনটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো :
এক. এক মিছলের পর দ্বিতীয় মিছলের শুরু থেকেই আসর নামাযের ওয়াক্ত আরম্ভ হয় :
ইবনে ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা বর্ণিত হয়েছে যে, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নামাযের সময় শিক্ষাদান উপলক্ষে দু’দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে ইমামত করেছিলেন। প্রথম দিনে আসরের নামায প্রত্যেক বস্তুর ছায়া এক মিছিল[29] পূর্ণ হওয়ার সময় অথবা পূর্ণ হওয়ার পর অর্থাৎ দ্বিতীয় মিছিলের প্রারম্ভে আদায় করেছিলেন এবং দ্বিতীয় দিনে তা প্রত্যেক বস্তুর ছায়া দুই মিছিল হওয়ার পর অর্থাৎ তৃতীয় মিছিলের প্রারম্ভে আদায় করেছিলেন। এর পর তিনি বলেছিলেন : নামাযের ওয়াক্ত এ দুই ওয়াক্তের মধ্যে।[30] এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আসরের নামাযের ওয়াক্ত প্রত্যেক বস্তুর ছায়া দুই মিছল হওয়ার পর তৃতীয় মিছলের প্রারম্ভে আরম্ভ না হয়ে দ্বিতীয় মিছিলের প্রারম্ভ থেকেই হয়ে যায়। অথচ আমাদের মাযহাবে বিষয়টি এর সম্পূর্ণ বিপরীত রয়েছে। দ্বিতীয় মিছলের প্রারম্ভ থেকে আসরের নামাযের ওয়াক্ত আরম্ভ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি হাদীস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও আমরা মাযহাবের কথানুযায়ী তা স্বীকার করি না।
ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) তাঁর মুওয়াত্ত্বা গ্রন্থে আসরের নামাযের ওয়াক্ত বর্ণনা প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদীস পেশ করেছেন। তাতে রয়েছে: ‘আব্দুল্লাহ ইবনে রাফে‘ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নামাযের ওয়াক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। এতে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : যখন তোমার নিজের ছায়া এক মিছল হয় তখন তুমি যোহরের নামায পড় এবং যখন তোমার ছায়া দু’ মিছল হয় তখন আসরের নামায পড় ...।’’[31] এরপর ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) বলেন : এটিই হচ্ছে ‘আসরের নামাযের ওয়াক্তের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মত।
‘আসরের নামাযের ওয়াক্তের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর উপর্যুক্ত মত হলেও তাঁর এ মতের সাথে তাঁর কোনো শিষ্যই ঐকমত্য পোষণ করেন নি। সে জন্য ইমাম মুহাম্মদ ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মত বর্ণনা করার পর বলেন :
‘‘আমরা বলি : যখন ছায়া এক মিছলের চেয়ে একটু বেশী হয় তখন পশ্চিম দিকে সূর্য ঢলা থেকে যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া এক মিছলের চেয়ে একটু বেশী হয়, তখনই ‘আসরের ওয়াক্ত এসে যায়’’।[32]
ইমাম মুহাম্মদের উক্ত কথার উপর টীকা লিখতে গিয়ে মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌভী বলেন :
“আসরের ওয়াক্ত আগমন সম্পর্কে ইমাম মুহাম্মদ যা বলেছেন সে-কথাটি ইমাম আবু ইউসুফ, হাসান, যুফার, ইমাম শাফিঈ, আহমদ, ত্বহাবী ও অন্যান্যরাও বলেছেন। এমনকি সাধারণ কিতাবাদির বর্ণনানুযায়ী এটি ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর দ্বিতীয় মত হিসেবে তাঁর শিষ্য হাসান কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। আল-মাবসূত্ব গ্রন্থের বর্ণনানুযায়ী ইমাম মুহাম্মদও ইমাম আবু হানীফা (রহ.) থেকে এ মতটি বর্ণনা করেছেন। এ-কথাগুলো মুহাম্মদ ইবন আমীর আল-হাজ্জ আল-হালাবী কর্তৃক রচিত ‘মুনইয়াতুল মুসল্লী’ নামক গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘হিলয়াতুল মুহাল্লা’ নামক গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে। হানাফী মাযহাবের বিভিন্ন ফিকহের কিতাবসমূহেও এ মতের অগ্রগণ্যতার স্বীকৃতি পাওয়া যায়।
যেমন ‘গারারাতুল আযকার’ নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে :
"هو المأخوذ به"
‘আসরের ওয়াক্তের ব্যাপারে ইমাম মুহাম্মদ ও অন্যান্যরা যা বলেছেন সেটাই গৃহীত হয়েছে। ‘আল-বুরহান’ নামক গন্থে রয়েছে:
"هو الأظهر لبيان جبريل"
জিবরাঈল (আ.) এর বর্ণনার কারণে এটাই সবচেয়ে বেশী সুস্পষ্ট কথা। কীরকি কর্তৃক লিখিত ‘ফয়েয’ নামক গ্রন্থে রয়েছে :
"وعليه عمل الناس اليوم وبه يفتى كذا في الدر المختار ".
‘‘এ মতের উপরেই বর্তমান সময়ের লোকজনের ‘আমল রয়েছে, এ মতের দ্বারাই ফতোয়া প্রদান করা হয়ে থেকে। অনুরূপ কথা ‘দুররে মুখতার’ গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে’’।[33]এ-সব উদ্ধৃতির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অতীতে হানাফী মাযহাবের গণ্যমান্য মনীষীগণ আছরের নামায দুই মিছলের পরে আদায় না করে এক মিছলের পরেই আদায় করতেন।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর উপর্যুক্ত হাদীস নিয়ে একটু চিন্তা করলে দেখা যায় যে, তিনি তাঁর এ বক্তব্যের দ্বারা মূলত যোহর বা ‘আসরের নামাযের প্রারম্ভিক সময়ের কথা বলতে চান নি, বরং এর দ্বারা তিনি নামাযের মুস্তাহাব ওয়াক্তের শেষ সময়সীমার বর্ণনা দিতে চেয়েছিলেন। সে-জন্যে ইমাম ত্বাহবী হানাফী বলেন:
“আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ কথা বলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাঁর ইমামতে দ্বিতীয় দিনে নামাযের মুস্তাহাব ওয়াক্তের সর্বশেষ সীমা পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য যে যে সময়ে নামায আদায় করেছিলেন, তা বর্ণনা করা। কেননা, বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, জিব্রাঈল (আ.) দু’দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামাযের ইমামত করেছিলেন ...তখন তিনি প্রথম দিনে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলার পর যোহরের নামায পড়েছিলেন এবং প্রত্যেক বস্তুর ছায়া এক মিছিল হওয়ার পর ‘আসরের নামায আদায় করেছিলেন ...অতঃপর দ্বিতীয় দিনে তিনি তাঁর সাথে প্রত্যেক বস্তুর ছায়া এক মিছল পূর্ণ হওয়ার সময়ে যোহরের নামায আদায় করেছিলেন এবং প্রত্যেক বস্তুর ছায়া দু’ মিছল হওয়ার সময় ‘আসরের নামায আদায় করেছিলেন। ...আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর উক্ত কথার দ্বারা এদিকেই ইঙ্গিত করেছেন।’’[34]
আব্দুল হাই লক্ষ্ণৌভী তাঁর টীকাতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মতের সহায়ক দু’টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। যার একটি সুনানে আবী দাউদ ও ইবনে মা-জাঃতে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে ‘আলী ইবনে শায়বান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন : আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট মদীনায় আগমন করলাম এবং তাঁকে ‘আসরের নামায উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকা পর্যন্ত বিলম্ব করতে দেখলাম’’। অপরটি মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাঃতে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে দু’মিছিল হওয়ার পর নামায আদায় করেন’’। এর পর বলেন: ইমাম ‘আইনী তাঁর ‘উমদাতুল ক্বারী’ গ্রন্থে এ’ দুটি হাদীস প্রসঙ্গে বলেছেন: এ দু’টি হাদীস দু’ মিছলের সময় নামায আদায় করা জায়েয হওয়ার কথা প্রমাণ করে, এ-সময়ের পূর্বে ‘আসরের ওয়াক্ত হয় না-এ-কথাটি প্রমাণ করে না’’।[35]
[17]. দেখুন : মাওলানা আবুল হাসানাত আব্দুল হাই হানাফী, ফতাওয়া আব্দুল হাই; (মাকতাবাহ থানবী : দেওবন্দ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৯ খ্রি.), পৃ. ১৫৭।
[18] তিনি তাঁর তাফছীরে মাযহারী গ্রন্থে وَ لاَ يَتَّخِذّ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ الله ‘‘আমরা আল্লাহকে ব্যতীত পরস্পরকে অসংখ্য রব বানিয়ে না নেই’’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
ومن هنا يظهر أنه إذا صح عند أحد حديث مرفوع من النبي صلى الله علية وسلم سالما من المعارضة، ولم يظهر له ناسخ و كان فتوى أبي حنيفة رحمه الله مثلا خلافه، وقد ذهب على وفق الحديث أحد من الآئمة الأربعة، يجب عليه اتباع الحديث الثابت، و لا يمنعه الجمود على مذهبه من ذلك ، لئلا يلزم اتخاذ بعضنا بعضا أربابا من دون الله
অর্থাৎ এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, যখন কারো নিকট কোনো প্রকার বিরোধ ছাড়াই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এমন কোনো মারফু‘ হাদীস প্রমাণিত হয়, যা মানসূখ হয়ে গেছে বলে তার নিকট কোনো প্রমাণ থাকে না থাকে, কিন্তু ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর কোনো ফতোয়া উদাহরণত সে হাদীসের বিপরীত প্রমাণিত হয়, আর চার ইমামের কোনো ইমাম এ হাদীসটি গ্রহণ করে থাকেন। তবে উক্ত প্রমাণিত হাদীসের অনুসরণ করা সে ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হয়ে যাবে। তার মাযহাবকে কঠিনভাবে অনুসরণ করা যেন তাকে এ হাদীসের উপর আমল করা থেকে বিরত না রাখে। কেননা; এতে পরস্পরকে অসংখ্য রব বানানোর শামিল হবে।’’ দেখুন: মাওলানা সানাউল্লাহ পানিপতী, তাফসীরে মাযহারী; (এদারাতু এশা‘আতিল ইসলাম : দিল্লী, সংস্করণ ও সন বিহীন), ২/৬৩-৬৪।
[19]. যেমন ইবনে আবিদীন তাঁর হাশিয়াতু রদ্দিল মুহতার গ্রন্থে বলেছেন :
أنه لو التزم مذهبا معينا كأبي حنيفة و الشافعي، فقيل: يلزمه، وقيل : لا، وهو الأصح.
‘‘কেউ যদি ইমাম আবু হানীফা অথবা ইমাম শাফি‘ঈ এর মাযহাব অনুসরণ করে, তা হলে সে ব্যক্তির উপর সকল ক্ষেত্রে সে মাযহাবই অনুসরণ করা কি জরুরী হয়ে যাবে? কারো কারো মতে তা জরুরী হয়ে যাবে, আবার কারো কারো মতে তা জরুরী হবে না এবং জরুরী না হওয়ার মতই অধিক সঠিক।’’ তদেব; পৃ.১৪৪; অন্ধ তাকলিদের সমালোচনা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী বলেন :
وفيمن لا يجوز أن يستفتي الحنفي مثلا فقيها شافعيا و بالعكس، ولا يجوز أن يقتدي الحنفي بإمام شافعي مثلا فإن هذا قد خالف إجماع القرون الأولى و ناقض الصحابة والتابعين.
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যিনি কোনো হানাফী ব্যক্তিকে কোনো শাফিঈ ফকীহ এর নিকট এবং কোন শাফিঈ ব্যাক্তিকে কোনো হানাফী ফকীহ এর নিকট ফতোয়া জিজ্ঞাসা করাকে জায়েয মনে না করেন, কোনো হানাফীকে কোনো শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী ইমামের পিছনে নামায পড়াকে জায়েয মনে না করেন, তিনি উম্মতের প্রথম যুগে অনুষ্ঠিত ইজমা‘ এর বিরুদ্ধাচরণ করে থাকবেন এবং সাহাবা ও তাবেঈনদের অনুসৃত রীতির বিরোধিতা করবেন। দেখুন : শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ; ১/১৫৪-১৫৬।
[20]. আবুল হাসানাত আব্দুল হাই আল-লক্ষ্ণৌভী আল-হানাফী, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৫০।
[21]. আবুল হাসানাত আব্দুল হাই লক্ষ্ণেীভী আল-হানাফী , প্রাগুক্ত; পৃ. ১৫০।
[22].এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
"فإذا كان إنسان جاهل في بلاد الهند و ماوراء النهر و ليس هناك عالم شافعي و لا مالكي و لاحنبلي و لا كتاب من كتب هذه المذاهب وجب عليه أن يقلد بمذهب أبي حنيفة ويحرم عليه أن يخرج من مذهبه...، بخلاف ما إذا كان في الحرمين فإنه يتيسر له هناك معرفة جميع المذاهب".
দেখুন : শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, আল-ইনসাফ ফী মাসাইলিল খিলাফ; (দিল্লী : মাত্ববা‘ মুজতবাঈ, ১৯৩৫ইং), পৃ. ৭০; মাওলানা আবুল হাসানাত আব্দুল হাই, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৫১।
[23]. আল-কুরআন, সূরা ইউসুফ : ১০৮।
[24] সম্ভবত লেখক এখানে যার বক্তব্য বর্ণনা করছেন তার মত তুলে ধরেছেন, নতুবা তাকলীদের ব্যাপারে ঐকমত্য হওয়ার বিষয়টি প্রসিদ্ধ কথা নয়। [সম্পাদক]
[25]. মূল আরবী হচ্ছে,
أن يجتهد واحد من علماء الأمة في مسئلة فيظن متبعوه أنه على الإصابة قطعا أو غالبا، فيردوا به حديثا صحيحا. و هذا التقليد غير ما اتفق عليه الأمة المرحومة؛ فإنهم اتفقوا على جواز التقليد للمجتهدين، مع العلم بأن المجتهد يخطئ و يصيب، مع الاستشراف لنص النبي صلى الله عليه وسلم في المسئلة، والعزم على أنه إذا ظهر حديث صحيح خلاف ما قلد فيه ، ترك التقليد و اتبع الحديث، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم :اتخذوا أحبارهم ورهبانهم أربابا من دون الله) أنهم لم يكونوا يعبدونهم ولكنهم إذا أحلوا لهم شيئا استتحلوه و إذا حرموا عليهم شيئا حرموه.
দেখুন: সাঈদ আহমদ বালনপুরী, আল-আউনুল কবীর ফিল ফাওযিল কবীর্; (দেওবন্দ : মাকতাবাতু হেজায, সংস্করণ বিহিন, সন বিহীন), পৃ. ৮৩।
[26] ঘটনাটির মূল ভাষ্য হচ্ছে,
و نقل قصة رأى أبو حنيفة في المنام ، وفيه قال الله له: قد غفرنا لك و لمن اتبعك من كان على مذهبك إلى يوم القيامة. قوله : ولمن اتبعك أى في الخدمة و المعرفة أو فيما أدى إليه اجتهادك من الأوامر و النواهي و لم يزغ عنها ، لا بمجرد التقليد
দেখুন : ইবন ‘আবিদীন, রাদ্দুল মুহতার; (পাকিস্তান : এইচ. এম. সাঈদ কোম্পানী, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ১/৫২।
(তবে এ ধরণের কিসসা-কাহিনী ও স্বপ্ন দ্বারা দলীল পেশ করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমদের সঠিক পদ্ধতি নয়। [সম্পাদক])
[27]. ক্বাযী সানাউল্লাহ পানিপথী, প্রাগুক্ত; ২/৬৫।
[28]. ড. মাহমূদ ত্বহ্হান, তাইছীরু মুসত্বলাহিল হাদীস; (করাচী : ক্বদীমী কুতুবখানা, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), পৃ. ৫৭।
[29] মিছল বলতে বুঝায়, অনুরুপ হওয়াকে। অর্থাৎ যে কোনো বস্তুর ছায়া তার অনুরূপ দৈঘ্যে লম্বা হয়ে মাটিতে পড়া। [সম্পাদক]
[30]. ইমাম তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুস সালাত ‘আন রাসূলিল্লাহ, বাব নং ১১৩, হাদীস নং ১৪৯, ১/২৭৯; ইবনে হিববাস, প্রগুক্ত; কিতাবুস সালাত, বাব নং ২, হাদীস নং ১৪৭২, ৪/৩৩৫।
[31]. আশ-শায়বানী, ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান, মুওয়াত্ত্বা; (দেওবন্দ : আশরাফী বুক ডিপো, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন) পৃ. ৪২।
[32]. তদেব; পৃ. ৪৪।
[33].আবুল হাসানাত আব্দুল হাই, আত-তা‘লীকুল মুমাজ্জদ আলা মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মদ;পৃ.৪৪। টীকা নং (১); শরহুল বেক্বায়াঃ; পৃ.৩০।
[34]. তদেব;পৃ.৪২। ৭ নং টীকা দ্রষ্টব্য।
[35]. তদেব; টীকা নং ২।