যৌবন এমন একটা কাল, যে কালে মানুষের মাঝে প্রায় সর্ববিষয়ে এক প্রকার জোশ থাকে; যে জোশে অনেকে হুঁশও হারিয়ে বসে। অতি আবেগে আপ্লুত হয়ে প্রায় সকল ব্যাপারে অতিরঞ্জন করে থাকে। দ্বীনী-চেতনায় চৈতন্যপ্রাপ্ত যুবকের মাঝেও অনুরূপ অতিরঞ্জন আসা অস্বাভাবিক নয়। তাই দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ যুবকও কোন কোন ক্ষেত্রে কোন কিছুকে প্রয়োজনের অধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করে থাকে, যা সত্যই ক্ষতিকর দ্বীনের জন্য এবং তার নিজের জন্যও।
মহান আল্লাহ তার দ্বীনের ব্যাপারে অতিরঞ্জন পছন্দ করেন না। তাই পূর্ববর্তী ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তার নির্দেশ ছিল, “হে কিতাবধারিগণ! তোমরা স্বীয় ধর্মের ব্যাপারে। বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ সম্বন্ধে সত্যই বল---।” (সূরা নিসা ১৭১ আয়াত) “হে আহলে-কিতাবগণ! তোমরা ধর্ম সম্বন্ধে সীমা অতিক্রম করো না এবং সেই সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা পূর্বে বিপথগামী হয়েছিল, ফলে তারা অনেককেই পথভ্রষ্ট করেছিল। আর তারা নিজেরাও ছিল সরল পথ হতে বিভ্রান্ত। (সূরা মাইদাহ ৭৭ আয়াত)
মহানবী (সা.) বলেন, “সাবধান! তোমরা ধর্ম-বিষয়ে অতিরঞ্জন করো না। কারণ, এই অতিরঞ্জনের ফলে তোমাদের পূর্ববর্তীগণ ধ্বংস হয়েছে।” (আহমাদ ১/২১৫, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ৩০২৯৭)
সুতরাং কোন বিষয় বা ব্যক্তিত্বের প্রশংসা অথবা নিন্দায় অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি করা ইসলামে নিষিদ্ধ। যার যথা মান তাকে তথাস্থানে রাখাই হল মধ্যম-পন্থা। চরমপন্থা ইসলামে আদৌ স্বীকৃত নয়।
মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে বলেছিলেন, “তোমাদেরকে যে উপজীবিকা দান করেছি, তা হতে পবিত্র বস্তু আহার কর এবং এ বিষয়ে সীমালংঘন করো না, করলে তোমাদের উপর আমার গযব (ক্রোধ) নেমে আসবে। আর যার উপরে আমার গযব নেমে আসে, সে তো ধ্বংস হয়ে যায়।” (সূরা ত্বাহা ৮১ আয়াত)
তিনি মহানবী (সা.) তার অনুসারীদেরকে সম্বোধন করে বলেন, “সুতরাং তুমি ও তোমার সাথে যারা তওবা করেছে তারা সবাই সরল পথে স্থির থাক -যেমন তোমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর সীমালংঘন করো না। তোমরা যা কর, নিশ্চয় তিনি তার প্রতি দৃষ্টি রাখেন।” (সূরা হূদ ১১২ আয়াত)
কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে শরীয়ত আমাদের সর্ববিষয়কে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। সে সীমা অতিক্রম করাই হল শরীয়তের উপর বাড়াবাড়ি করা। মহান আল্লাহ বলেন, “ওদের জন্য এ কি যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার (নবীর) উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছি; যা ওদের নিকট পাঠ করা হয়? এতে অবশ্যই বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য অনুগ্রহ ও উপদেশ আছে।” (সূরা আনকাবুত ৫১ আয়াত)।
শরীয়তের নির্ধারিত সীমারেখার ভিতরেই রয়েছে মানুষের সার্বিক মঙ্গল। অবশ্য যারা এর উপদেশ গ্রহণ করে না অথবা তাতে বাড়াবাড়ি করে, তারা সে মঙ্গল ও আল্লাহর অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত থেকে যায়।
আমাদের দয়ার নবীও কোন বিষয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। তিনি নিজের ব্যাপারে বলতেন, “তোমরা আমাকে নিয়ে (আমার তা'যীমে) বাড়াবাড়ি করো না, যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা বিন মারয়্যামকে নিয়ে করেছে। আমি তো আল্লার দাস মাত্র। অতএব তোমরা আমাকে আল্লাহর দাস ও তাঁর রসূলই বলো।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৪৮৯৭ নং)
একদা তিনি খুতবা দিচ্ছিলেন। এমন সময় দেখলেন, এক ব্যক্তি রোদে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি তার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে লোকেরা বলল, 'আবু ইসরাঈল, সে এই নযর মেনেছে যে, দাঁড়িয়ে থাকবে এবং বসবে না, ছায়া গ্রহণ করবে না, কথা বলবে না এবং রোযা পালন করবে!’ এ কথা শুনে নবী ও বললেন, “ওকে আদেশ কর, যেন ও কথা বলে, ছায়া গ্রহণ করে, বসে যায় এবং রোযা পূরণ করে।” (বুখারী, মিশকাত ৩৪৩০ নং)
একদা তিনি দেখলেন, এক বৃদ্ধ তার দুই ছেলের কাধে ভর করে (মক্কার দিকে) হেঁটে যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলেন, “ওর ব্যাপার কি?” বলল, পায়ে হেঁটে কাবাঘর যাওয়ার নিয়ত করেছে।' তিনি বললেন, “আল্লাহ তাআলার এমন প্রাণকে কষ্ট দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ওহে বৃদ্ধ! তুমি সওয়ার হয়েই মক্কা যাও। কারণ, আল্লাহ তুমি ও তোমার নযরের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৩৪৩১-৩৪৩২ নং)
মক্কা বিজয়ের দিনে এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমি আল্লাহর কাছে এই নযর মেনেছি যে, তিনি যদি আপনার হাতে মক্কার বিজয় দান করেন, তাহলে আমি বাইতুল মাকদিস (জেরুজালেমের মসজিদে) ২ রাকআত নামায আদায় করব।' এ কথা শুনে নবী (সা.) তাকে ২ বার বললেন, “তুমি এখানেই (কা’বার মসজিদেই) নামায পড়ে নাও।” (আবু দাউদ, দারেমী, মিশকাত ৩৪৪০ নং)
একদা তিন ব্যক্তি মহানবী (সা.) এর ইবাদত সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর বিবিদের নিকট উপস্থিত হল। যখন তার ইবাদতের কথা তাদেরকে বলা হল, তখন তারা তা কম মনে করল এবং বলল, নবী (সা.) এর সাথে আমাদের তুলনা কোথায়? তাঁর তো পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন। অতঃপর একজন বলল, 'আমি সর্বদা সারা রাত্রি নামায পড়তে থাকব, দ্বিতীয়জন বলল, আমি সর্বদা রোযা রাখতে থাকব; কখনও রোযা ত্যাগ করব না, তৃতীয়জন বলল, আমি সর্বদা স্ত্রী থেকে দূরে থাকব; কখনো বিবাহ করব না।
মহানবী (সা.) এর নিকট এ খবর পৌছলে তিনি তাদেরকে বললেন, “তোমরা কি সেই সকল লোক, যারা এই এই কথা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের থেকে অধিকরূপে ভয় করে থাকি এবং তার জন্য অধিক সংযম অবলম্বন করে থাকি। এতদসত্ত্বেও আমি কোন দিন রোযা রাখি এবং কোন দিন রোযা ছেড়েও দিই। (রাত্রে) নামাযও পড়ি, আবার ঘুমিয়েও থাকি এবং স্ত্রী-মিলনও করি। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার তরীকা থেকে বিমুখতা প্রকাশ করে, সে আমার দলভুক্ত নয়।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৪৫নং)
মহানবী (সা.) এর সাহাবাগণও দ্বীনের ব্যাপারে কোন প্রকার বাড়াবাড়ি পছন্দ করতেন না। একদা হজ্জে গিয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) আহমাস গোত্রের যয়নাব নামক এক মহিলাকে লক্ষ্য করলেন, সে মোটেই কথা বলে না। তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার, ও কথা বলে না কেন? লোকেরা বলল, 'ও নীরব থেকে হজ্জ পালন করার নিয়ত করেছে। তিনি সেই মহিলাকে সরাসরি বললেন, 'তুমি কথা বল। এমন কর্ম বৈধ নয়। এমন কর্ম জাহেলিয়াত যুগের!' এ কথা শুনে মহিলা কথা বলতে শুরু করল। (বুখারী -৩৪ নং)
চরমপন্থা কোন বিষয়েই ভালো নয়, যেমন ভালো নয় একেবারে নরম, ঢিলে ও এলো পন্থা। প্রত্যেক ব্যাপারে মধ্যমপন্থাই হল একজন পূর্ণ আদর্শবান মুসলিমের অনুসরণীয় পথ। পক্ষান্তরে চরম ও নরমপন্থীরাই হল ক্ষতিগ্রস্ত। আলী (রাঃ) বলেন, 'আমার ব্যাপারে দুই ব্যক্তি ধ্বংস হবে। প্রথম হল, আমার ভক্তিতে সীমা অতিক্রমকারী ভক্ত এবং দ্বিতীয় হল, আমার বিদ্বেষে সীমা অতিক্রমকারী বিদ্বেষী।' (শাইবানীর কিতাবুস সুন্নাহ ৯৭৪নং) মহানবী (সা.) বলেন, “আমার উম্মতের দুই শ্রেণীর লোক আমার সুপারিশ লাভ করতে পারবে না; বিবেকহীন অত্যাচারী রাষ্ট্রনেতা এবং প্রত্যেক সত্যত্যাগী অতিরঞ্জনকারী।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে' ৩৭৯৮ নং)। তিনি আরো বলেন, “অতিরঞ্জনকারীরা ধ্বংস হয়েছে।” (আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, সহীহুল জামে ৭০৩৯ নং)
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন করার নাম হল গোড়ামি। যার জন্য গোড়া’ কথার অর্থই হল, কঠোর অন্ধভক্ত, অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাসী, অত্যধিক পক্ষপাতী, অতিভক্তি বা অন্ধভক্তির আবেগে আপ্লুত ব্যক্তি। আর এ জন্যই অতিরিক্ত টকজাতীয় এক প্রকার লেবুকে ‘গোড়া লেবু’ বলা হয়। এই অর্থেই অনেকে বলেছেন যে, ধর্ম নিয়ে যারা গোড়ামি করে, ধর্মের মর্ম তারা বোঝে না। নামাযে দাঁড়িয়ে সাজু তার পাশের নামাযী মাজুর পায়ে পা লাগিয়ে দিল। মাজু চট করে তার পা সরিয়ে নিল। পুনরায় সাজু তার পা বাড়িয়ে মাজুর পায়ে লাগিয়ে দিল। মাজু আবারও পা সরিয়ে নিল। এবারে সাজু, মাজুর পা ধরে টেনে এনে তার পায়ের সঙ্গে লাগিয়ে দিল! কিন্তু মাজু আবারও তার পা সরিয়ে নিয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়াল।
তুমি নিশ্চয়ই বলতে বাধ্য হবে যে, এখানে সাজু ও মাজু উভয়েই গোড়া। কারণ, মহব্বতের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে কাতার বেঁধে দাঁড়ানো সুন্নত। মহানবী (সা.) এর পশ্চাতে সাহাবাগণ অনুরূপই দাঁড়াতেন। কিন্তু কেউ বেআদবী মনে করে অথবা ঘৃণা বা অহংকারবশে সেই সুন্নতকে পছন্দ না করলে জোরপূর্বক তার পায়ে বারবার পা লাগিয়ে নামাযের ভিতরে পা-লড়াই অবশ্যই সুন্নত নয়; বরং অতিরঞ্জন অবশ্য সাজুর প্রথমবার পা লাগানোটা সুন্নত ছিল। বাকী মাজুর সবটাই ছিল গোড়ামি।
অনুরূপভাবে অনেক মানুষ আছে যাদের বিবির মাথায় কাপড় না থাকলেও নিজেদের মাথায় টুপি রাখার জন্য বাড়াবাড়ি করে থাকে। মুস্তাহাবকে ফরজের দর্জা দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ফরয ছেড়ে সুন্নত নিয়ে টানাটানি করে থাকে। এরা একদিকে যেমন নরমপন্থী, তেমনি অপরদিকে চরমপন্থীও।
প্রত্যেক বিষয়েই তিন অবস্থা হতে পারে; অবজ্ঞা, স্বাভাবিকতা ও অতিরঞ্জন। অথবা নরমপন্থা, মধ্যমপন্থা ও চরমপন্থা। এখন অবজ্ঞা ও অতিরঞ্জন তথা নরম ও চরমপন্থা কি - তা জানতে ও নির্ণয় করতে হলে পুর্বে অবশ্যই উভয়ের মাঝামাঝি পথ স্বাভাবিকতা ও মধ্যমপন্থাকে চিনতে হবে। নচেৎ এমনও হতে পারে যে, যে আসলে চরমপন্থী ও গোড়া নয় তাকে চরমপন্থী ও গোড়া’ বলে গালি দেওয়া হবে। সাধারণ এই চায়ের মজলিসে চা খাওয়ার কথাই ধর। একই কেটলির চা খেতে খেতে কেউ বলে, মিষ্টি হাল্কা হয়েছে। কেউ বলে, 'কড়া মিষ্টি আবার কেউ বলে, 'আরে না-না, ঠিকই তো হয়েছে!’ এখন চায়ের এই মিষ্টি-বিচারে এমনও হতে পারে যে, যার মিষ্টি হাল্কা খাওয়া অভ্যাস, সে ঐ চা-কে কড়া মিষ্টি’ বলে আখ্যায়িত করছে। আর যার কড়া মিষ্টি খাওয়া অভ্যাস, সে বলছে ‘হাল্কা মিষ্টি। সুতরাং এমন এক সালিস লোকের বিচার মানতে হবে, যে খায় স্বাভাবিক মিষ্টি। কিন্তু ধর্মীয় ব্যাপারে ঐ স্বাভাবিকতা বা মধ্যমপন্থা বিচারের মাপকাঠি কি? ধর্মীয় কোন ব্যাপারে স্বাভাবিকতা অথবা বাড়াবাড়ি, নাকি ঢিলেমি -এ কথা কে বলতে পারে? যারা ধর্মের ধার ধারে না এবং ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান রাখে না তারা, নাকি এর বিপরীত? নিঃসন্দেহে এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, যে যে বিষয়ে জ্ঞান রাখে না, তার সে বিষয়ে ঐ শ্রেণীর কোন মন্তব্য বা উক্তি করা মুর্খামি। যেমন হাল্কা মিষ্টি খায় বা ডায়োবেটিস আছে এমন রোগীর স্বাভাবিক মিষ্টির চা-কে কড়া মিষ্টি বলা বোকামি।
উদাহরণ স্বরূপ, পরিবেশের স্বাভাবিকতা হল পর্দাহীনতা। কিন্তু যারা কুরআনী আইন মানেন তারা নিজেদের মহিলাদেরকে বোরকা পরান এবং পর্দার সাথে বাসে-ট্রেনে চড়ে শিক্ষা। বা চাকুরীস্থলে যেতে দেন। কিন্তু আরো কিছু ধার্মিক লোক আছেন, যারা মহিলাদের বাসেট্রেনে চড়া হারাম মনে করেন। পর্দার সাথে তারা যে বাইরে যেতে পারে –এ কথা মানতে চান না। এখন ধর্মের মর্ম যারা বোঝেন, তারা যদি ধর্মের স্বাভাবিকতা ও নির্দেশ অনুযায়ী বিচার করেন, তাহলে নিশ্চয় তারা পর্দাহীনতাকে ঢিলে ও নরমপন্থা বলবেন। যারা বোরকা ব্যবহার করে পর্দার আদেশ পালন করেন, তাদেরকে মধ্যমপন্থী বলবেন এবং গোড়া’ বলতে পারবেন না। অবশ্য যারা অবরোধ’-প্রথায় বিশ্বাসী তাদেরকে গোড়া’ বলতে দ্বিধা থাকবে না।
কারণ, যা হারাম নয়, তা হারাম করা হল, অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি। অতএব নিঃসন্দেহে তা গোড়ামি। পক্ষান্তরে শরীয়তের স্বাভাবিক নির্দেশ পালন করাকে গোড়ামি বলাও বোকামি। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, যারা এ বিচারের যোগ্য নয়, তারাই এ বিচারভার গ্রহণ করে আগা জিভে যাকে তাকে গোড়া’ বলে গালি পেড়ে মুখের পরিচয় দিয়ে থাকে। যাদের সংরক্ষণে রয়েছে সমস্ত প্রচারমাধ্যম, তারা গোড়া ও মৌলবাদী এবং উদার ও সংস্কারপন্থী আখ্যায়ন করে মুসলিম সমাজকে দু'ভাগে ভাগ করে রেখেছে। প্রশংসা করেছে। তথাকথিত উদারপন্থীদের এবং উপহাস ও কটাক্ষ করেছে মৌলবাদী নিয়ে। উদারপন্থী হল
তারা, যারা মোটেই বা সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলা জরুরী মনে করে না। যে স্বামী তার স্ত্রীকে বন্ধুদের সাথে অবাধ মিলামিশা করতে দেয়, সে স্বামী উদারপন্থী। যে দেয় না সে গোড়া মৌলবাদী। আর যে নৈতিকতা মানে না এবং ফ্রি-সেক্স’-এ বিশ্বাসী সে হল উদারপন্থী। আর যে তা মানে সে হল গোড়া রক্ষণশীল। যে পশুর মত জীবন-যাপন করে সে উদারপন্থী এবং যে আল্লার দেওয়া জীবন-ব্যবস্থা অনুযায়ী সুন্দর জীবন-যাপন করে সে ওদের নজরে রক্ষণশীল!
পক্ষান্তরে ওরাও এক শ্রেণীর একগুয়ে রক্ষণশীল গোড়া। ওরাও বাতিল পথে থেকে একগুয়েমির সাথে কুফরী-জিন্দেগীকে প্রাধান্য দেয়। ধর্মহীন জীবন গড়তে ওরাও বেশ বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন প্রদর্শন করে থাকে। মাতালকে তার অমাতাল বন্ধু বারবার মদ খাওয়া ছাড়তে বললে মাতাল তাকে গোড়া বলে ব্যঙ্গ করে। অথচ মাতাল নিজেও মাতলামিতে সেই একই পর্যায়ের গোড়ামি ও রক্ষণশীলতা প্রদর্শন করে, তা হয়তো সে বুঝেও বুঝে না। তাহলে আসল গোড়া ও রক্ষণশীলটা কে? বাহুবলে বলিয়ান নও-জোয়ান বন্ধু আমার! ইসলামের জন্য তোমার প্রাণ উৎসর্গ হোক, এটা তোমার মন অবশ্যই চাইবে। কিন্তু জেনে রেখো, ত্রাস ও ভীতি সৃষ্টি করে ধর্মপ্রচার ইসলামে নেই। নেই ভীতিমুলক রাজদ্রোহবাদ বা সন্ত্রাসবাদ। ইসলাম পছন্দ করে উদারতা, সরলতা, নম্রতা ও কোমলতাকে এবং পছন্দ করে না গরম ও চরম কিছুকে। দ্বীনের নবী দয়ার সাগর (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি সহজ-সরল ও কোমল হবে, সে ব্যক্তির জন্য আল্লাহ দোযখ হারাম করে দেবেন।” (সহীহুল জামে’ ৬৪৮৪নং)
“যে ব্যক্তি নম্রতা থেকে বঞ্চিত, সে ব্যক্তি সর্বপ্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।” (আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ সহীহুল জামে’ ৬৬০৬ নং)
“অবশ্যই আল্লাহ কৃপাময়। তিনি কোমলতা পছন্দ করেন। আর কোমলতার উপর যা প্রদান করেন, তা কঠোরতার উপর, বরং এ ব্যতীত অন্য কিছুর উপর প্রদান করেন না।” (মুসলিম ২৫৯৩ নং)
“নম্রতা যে বিষয়ে থাকে সে বিষয়কে তা সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে। আর যে বিষয়কে নম্রতা থেকে খালি করা হয়, সে বিষয় সৌন্দর্যহীন হয়ে যায়।” (আহমাদ, মুসলিম, সহীহুল জামে' ৫৬৫৪ নং)
একদা মা আয়েশা এক ব্যক্তিকে কঠোরতার সাথে কিছু বললে তিনি বললেন, “থামো হে আয়েশা! কোমলতা অবলম্বন কর এবং কঠোরতা ও অশ্লীলতা হতে দূরে থাক---।” (বুখারী, সহীহুল জামে ৬৬২৭ নং)
“হে মানব সকল! আমি যে কর্মের আদেশ করি, তার প্রত্যেকটাই পালন করতে তোমরা কক্ষণই সক্ষম হবে না। তবে তোমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর এবং সুসংবাদ নাও।” (আহমাদ, আবু দাউদ, সহীহুল জামে ৭৮৭১ নং)
“(দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে) তোমরা সরলতা ব্যবহার কর, কঠোরতা ব্যবহার করো না, মানুষের মনকে খোশ কর এবং তাদের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করো না।” (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, নাসাঈ, সহীহুল জামে’ ৮০৮৬ নং) “ঈমান হল সহিষ্ণতা ও উদারতার নামান্তর।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে’ ২ ৭৯৫ নং)
দ্বীন-দরদী জোয়ান বন্ধু আমার! দ্বীনের ব্যাপারে তোমার মন কষ্ট পাবে, তা পাওয়া ভালো। দ্বীনের দুশমনদের প্রতি তোমার মন বিষময় হবে, তা হওয়া ভালো। কিন্তু তোমার মনে সহিংসতা স্থান পাবে, এমন ভালো নয়। দাওয়াতের যে পদ্ধতি আমাদের মহানবী (সা.) অবলম্বন করে গেছেন, কেবল সেই সেই পদ্ধতিই তোমার দ্বীন মানা ও প্রচার করার ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ, তাতেই আছে সার্বিক কল্যাণ। নচেৎ আবেগবশে খেয়াল-খুশীর অনুসারী হয়ে যথেচ্ছাচারিতা প্রয়োগ করাতে কোন প্রকার কল্যাণ নেই। বরং অকল্যাণ আছে।
তাছাড়া সে প্রয়োগে তোমার অধিকারও নেই। ঐ দেখ না, নবীর প্রতি মহান আল্লাহর কি নির্দেশ। তিনি তাঁকে সম্বোধন করে বলেন, “তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে সমস্ত মানুষকে এক জাতি করতে পারতেন, কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে। তবে ওরা নয়, যাদের প্রতি তোমার প্রতিপালক দয়া করেন এবং তিনি ওদেরকে এ জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আমি জ্বিন ও মানুষ উভয় দ্বারা দোযখ পূর্ণ করবই, তোমার প্রতিপালকের এই কথা পূর্ণ হবেই।” (সূরা হুদ ১১৮ আয়াত) “তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে পৃথিবীতে যারা আছে, তারা সমবেতভাবে সকলেই ঈমান আনত; তবে কি ঈমান আনার জন্য তুমি মানুষের উপর জবরদস্তী করবে?” (সূরা ইউনুস ৯৯ আয়াত)
“তোমরা আহলে কিতাবদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে, কিন্তু সৌজন্যের সাথে। তবে তাদের সাথে নয়, যারা ওদের মধ্যে সীমালংঘনকারী।” (সূরা আনকাবুত ৪৬ আয়াত)।
“তুমি মানুষকে জ্ঞান ও সদুপদেশ দ্বারা তোমার প্রতিপালকের দিকে আহ্বান কর এবং ওদের সাথে সদ্ভাবে বিতর্ক কর। তোমার প্রতিপালক জ্ঞাত আছেন -কে তার পথ ছেড়ে বিপথগামী হয় এবং এও জ্ঞাত আছেন -কে সুপথগামী। যদি তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণই করো, তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দেবে, যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে।
তবে তোমরা ধৈর্য ধারণ করলে ধৈর্যশীলদের জন্য তাই তো উত্তম। ধৈর্য ধারণ কর, তোমার ধৈর্য তো আল্লাহরই সাহায্যে হবে, ওদের আচরণে দুঃখ করো না এবং ওদের ষড়যন্ত্রে তুমি মনঃক্ষুন্ন হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সংযমীদের সাথে আছেন এবং তাদের সাথে যারা সৎকর্মপরায়ণ।” (সূরা নাহল ১২৫-১২৮ আয়াত) “ভালো এবং মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা, এর ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হয়ে যাবে।” (সূরা ফুসসিলাত ৩৪ আয়াত)
আশা করি এ কয়টি আয়াত অনুধাবন করে তোমার মনের উগ্রভাব সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে যাবে এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমার মন খুব সান্ত্বনা পাবে। তবে আরো একটি মহাবাণী শোন, তিনি মহানবী (সা.) কে বলেন, “আল্লাহর রহমতে তুমি তাদের প্রতি কোমল-চিত্ত হয়েছিলে, অন্যথা যদি তুমি রূঢ় ও কঠোর-হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমার আশপাশ হতে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর, কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। আর তুমি কোন সংকল্প করলে আল্লাহর উপর নির্ভর করো; আল্লাহ তার উপর নির্ভরকারী বান্দাগণকে ভালোবাসেন।” (সূরা আলি ইমরান ১৫৯ আয়াত) দুঃসাহসী বন্ধু আমার! সন্ত্রাসী তৎপরতার মাঝে নিরপরাধ মানুষদেরকে খুন করার অধিকার তোমার নেই। এমন কি জিহাদেও নারী-বৃদ্ধ-শিশু প্রভৃতি বেসামরিক মানুষকে হত্যা করার অনুমতি ইসলামে নেই।
একজন পাপ বা অপরাধ করলে, তার শাস্তি অপরে কেন ভোগ করবে? মহান আল্লাহ তো বলেন, “যে ব্যক্তি কোন পাপ করে, তা তারই দায়িত্বে থাকে। (তার জন্য সেই দায়ী) এবং কেউ অপরের পাপভার বহন করবে না।” (সূরা আনআম ১৬৪ আয়াত) অতএব ওয়াজেদ মিঞার বোনকে যদি সাজেদ মিঞা (নিজের স্ত্রীকে মারধর করে, তবে ওয়াজেদ মিঞার উচিত নয়, নিজের স্ত্রী) সাজেদ মিঞার বোনকে মারধর করা। বিবেকও বলে না, অপরাধীদের পরিবর্তে নিরপরাধ মানুষদেরকে খুন করতে। কোন জাতির কিছু লোক অথবা গ্রামের কিছু লোক তোমার রক্ত-পিপাসু শত্রু হলেও তুমি ঐ জাতির বা ঐ গ্রামের সকল লোককে তোমার রক্ত-পিপাসু ধারণা করে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করতে পার না। আর শোন মহান আল্লাহ কি বলেন, “এ কারণেই বানী ইসরাঈলকে এ বিধান দিয়েছিলাম যে, যে কেউ প্রাণের বদলে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজের বদলা নেওয়া ছাড়া কাউকে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করে এবং যে কারো প্রাণ রক্ষা করে সে যেন (পৃথিবীর) সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করে।” (সূরা মায়েদাহ ৩২ আয়াত)
“আর যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম, সেখানেই সে চিরকাল থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রাখবেন।” (সূরা নিসা ৯৩ আয়াত)।
অস্ত্র নিয়ে মানুষের মনে-প্রাণে ত্রাস সৃষ্টি করা মুসলিমের কাজ নয়। এমন কি অস্ত্র উঁচিয়ে কাউকে ভয় দেখানোও বৈধ নয় ইসলামে। কথায় কথায় খুন করে দেব, কেটে দেব, শুট করে দেব, মেরে ফেলব’ ইত্যাদি উগ্র হুমকিও কোন মুসলিম দিতে পারে না।