ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম কিতাবুল হজ্জ শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ)
প্রশ্ন: (৪৮০) ইহরাম অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করা হারাম এ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে কেউ যদি স্ত্রী সহবাস করে ফেলে, তবে তার হজের বিধান কী?

উত্তর: একথা সুবিদিত যে, স্ত্রী সহবাস ইহরামের নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম; বরং তা ইহরামের সর্বাধিক কঠিন ও বড় নিষেধাজ্ঞা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱلۡحَجُّ أَشۡهُرٞ مَّعۡلُومَٰتٞۚ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي ٱلۡحَجِّ﴾ [البقرة: ١٩٧]

“হজের মাসসমূহ নির্দিষ্ট সুবিদিত। এসব মাসে যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছা করবে, তার পক্ষে স্ত্রীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হওয়া জায়েয নয়। জায়েয নয় কোনো অশোভন কাজ করা, না কোনো ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়া।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৯৭]

الرفث এর অর্থ হচ্ছে, সহবাস ও তার পূর্বের কাজসমূহ। অতএব, ইহরামের সর্বাধিক কঠিন নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে সহবাসে লিপ্ত হওয়া। হজের ইহরামে থেকে কোনো লোক যদি স্ত্রী সহবাস করে, তবে হয় তা প্রথম হালালের পূর্বে হবে অথবা প্রথম হালালের পর হবে। (অর্থাৎ ১০ তারিখে বড় জামরায় কংকর মেরে মাথা মুণ্ডন করার পূর্বে) যদি প্রথম হালালের পূর্বে সহবাস হয়, তবে তার ওপর নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আবশ্যক হবে:

প্রথমতঃ তার ঐ হজ বাতিল হয়ে যাবে। চাই তা ফরয হজ হোক বা নফল হজ হোক।

দ্বিতীয়তঃ সে গুনাহগার হবে।

তৃতীয়তঃ হজের অবশিষ্ট কাজ তাকে পূর্ণ করতে হবে। অর্থাৎ হজ নষ্ট হওয়া সত্বেও হজের অবশিষ্ট কাজগুলো পরিপূর্ণরূপে আদায় করতে হবে।

চতুর্থতঃ পরবর্তী বছর অবশ্যই তাকে উক্ত হজের কাযা আদায় করতে হবে। চাই তা ফরয হজ হোক বা নফল হজ হোক। হজ ফরয হলে তো কাযা আদায় করার বিষয়টি সুস্পষ্ট। কেননা সহবাসে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে সে হজের ফরযিয়াতের যিম্মা মুক্ত হতে পারে নি।

কিন্তু নফল হজ হলেও তাকে কাযা আদায় করতে হবে। কেননা হজ আরম্ভ করলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَتِمُّواْ ٱلۡحَجَّ وَٱلۡعُمۡرَةَ لِلَّهِۚ﴾ [البقرة: ١٩٦]

“তোমরা আল্লাহর জন্য হজ ও উমরাকে পূর্ণ কর।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৯৬]

তাছাড়া হজের কাজ শুরু করলে তা ফরয হয়ে যায়। যেমনটি পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন। “হজের মাসসমূহ নির্দিষ্ট সুবিদিত। এসব মাসে যে ব্যক্তি হজ ফরয করবে...।” এ জন্য আমরা বলব, হজ নফল হোক বা ফরয হোক, যে কোনো কারণে তা বিনষ্ট করে ফেললে তার কাযা আদায় করতে হবে।

পঞ্চমতঃ কাফফারাস্বরূপ তাকে জরিমানা আদায় করতে হবে। আর তা হচ্ছে একটি উট যবেহ করে হারাম এলাকার ফকীরদের মাঝে বন্টন করে দেওয়া। উটের পরিবর্তে যদি সাতটি ছাগল যবেহ করে তাও জায়েয আছে।

এই বিধান হচ্ছে প্রথম হালালের পূর্বে হলে। (অর্থাৎ ১০ তারিখে বড় জামরায় কংকর মেরে মাথা মুণ্ডন করার পূর্বে) কিন্তু প্রথম হালালের পর সহবাস করলে তার ওপর নিম্নলিখিত বিষয়গুলো আবশ্যক হবেঃ

প্রথমতঃ সে গুনাহগার হবে।

দ্বিতীয়তঃ ইহরাম বিনষ্ট হয়ে যাবে।

তৃতীয়তঃ কাফফারা হিসেবে নিম্নলিখিত তিনটি বিষয়ের কোনো একটি করবে:

ক) একটি ছাগল যবেহ করে হারাম এলাকার ফকীরদের মাঝে বন্টন করে দিবে। অথবা

খ) ছয়জন মিসকীনকে খাদ্য দিবে। প্রত্যেককে অর্ধ ছা’ পরিমাণ খাদ্য দিবে। অথবা

গ) তিন দিন সাওম রাখবে।

এ তিনটির যে কোনো একটি জরিমানাস্বরূপ আদায় করবে।

চতুর্থতঃ নতুন করে ইহরামে প্রবেশ করবে। মক্কার হারাম সীমানার বাইরে নিকটতম কোনো স্থানে গমণ করে সেখান থেকে ইহরাম বেঁধে আসবে এরপর তাওয়াফে ইফাদ্বা বা হজের তাওয়াফ সম্পন্ন করবে। এভাবেই ফিকাহবিদগণ বলেছেন।

যদি প্রশ্ন করা হয়: প্রথম হালাল হওয়ার অর্থ কী?

জবাবঃ হাজী সাহেব যখন ঈদের দিন (যিলহজের দশ তারিখে) বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করে মাথা মুণ্ডন বা চুল খাটো করে তখন সে প্রথম হালাল হয়ে যায়। তখন স্ত্রী সহবাস ব্যতীত ইহরামের যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে যায়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইহরাম বাঁধার পূর্বে এবং হালাল হওয়ার পর বায়তুল্লাহর তাওয়াফের পূর্বে আমি তাঁকে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম।’[1] এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, হালাল হওয়ার পরেই আছে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ। যেমনটি পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ঈদের দিন বড় জামরায় কঙ্কর মারার পর মাথা মুণ্ডন বা চুল খাটো করার মাধ্যমে প্রথম হালাল হবে। এ হালালের পূর্বে সহবাস হলে উল্লিখিত পাঁচটি বিষয় আবশ্যক হবে। আর এ হালালের পর সহবাস হলে, উল্লিখিত চারটি বিষয় আবশ্যক হবে।

কোনো লোক যদি মূর্খতাবশতঃ এ কাজ করে অর্থাৎ ইহরাম অবস্থায় সহবাস করা হারাম একথা তার জানা নেই, তবে তার কোনো ক্ষতি হবে না। কোনো কাফফারা দিতে হবে না। চাই প্রথম হালালের পূর্বে হোক বা পরে হোক। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذۡنَآ إِن نَّسِينَآ أَوۡ أَخۡطَأۡنَا﴾ [البقرة: ٢٨٦]

“হে আমাদের রব আমরা যদি ভুলক্রমে কোনো কিছু করে ফেলি অথবা ভুলে যাই তবে আমাদেরকে পাকড়াও করো না।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৮৬]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَلَيۡسَ عَلَيۡكُمۡ جُنَاحٞ فِيمَآ أَخۡطَأۡتُم بِهِۦ وَلَٰكِن مَّا تَعَمَّدَتۡ قُلُوبُكُمۡ﴾ [الاحزاب: ٥]

“ভুলক্রমে তোমরা যা করে ফেল সে সম্পর্কে তোমাদের কোনো গুনাহ্ নেই। কিন্তু তোমাদের অন্তর যার ইচ্ছা করে তার কথা ভিন্ন।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫]

যদি প্রশ্ন করা হয়: ইহরাম অবস্থায় সহবাস করা হারাম এ লোক যদি একথা জানে কিন্তু এটা জানে না যে, সহবাস করলে এত কিছু আবশ্যক হবে বা এ জরিমানা দিতে হবে, জানলে হয়তো সে একাজে লিপ্ত হতো না। তবে এর বিধান কী? তার এ অজ্ঞতার ওযর কি গ্রহণযোগ্য হবে?

জবাব: তার এ ওযর গ্রহণযোগ্য হবে না। কেননা ওযর হচ্ছে, বিষয়টি সম্পর্কে সম্পর্ণরূপে অজ্ঞ থাকা। বিষয়টি যে হারাম সে ব্যাপারে তার কোনই জ্ঞান না থাকা। কিন্তু বিষয়টি হালাল না হারাম এ বিধান জানার পর, করলে কি লাভ বা না করলে কি ক্ষতি তা জানা আবশ্যক নয়। এ ধরনের না জানা ওযর হিসেবে গণ্য হবে না।

যেমন, জনৈক বিবাহিত ব্যক্তি যদি জ্ঞান রাখে যে, ব্যভিচার হারাম। সে বিবেকবান ও প্রাপ্তবয়স্ক। সে যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তবে অবশ্যই তাকে রজম (প্রস্তরাঘাতে হত্যা) করতে হবে। সে যদি বলে যে, ব্যভিচার করলে যে রজমের শাস্তি আছে আমি তা জানতাম না। জানলে এ অন্যায় আমি করতাম না, তার এ কথা গ্রহণ করা হবে না। তাকে রজম করতেই হবে।এ কারণে জনৈক ব্যক্তি রামাযানে দিনের বেলায় স্ত্রী সহবাস করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে তার করণীয় কি জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে কাফফারা আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন। অথচ সহবাস করার সময় সে কাফফারা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। এথেকে বুঝা যায়, কোনো মানুষ যদি অন্যায়ে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহর নিষিদ্ধ সীমা লঙ্ঘন করে, তখন উক্ত অপরাধের শাস্তি তাকে পেতে হবে। যদিও এর শাস্তি সম্পর্কে সে অজ্ঞ থাকে।

>
[1] সহীহ বুখারী, অধ্যায়: হজ, অনুচ্ছেদ: ইহরামের সময় সুগন্ধি ব্যবহার করা; সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: হজ, অনুচ্ছেদ: ইহরামকারীর ইহরামের সময় সুগন্ধি ব্যবহার করা।