হজের সাথে সংশ্লিষ্ট আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তিসমূহ ইসলামহাউজ.কম ১৯ টি
হজের সাথে সংশ্লিষ্ট আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তিসমূহ ইসলামহাউজ.কম ১৯ টি

নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি, আর আমাদের প্রবৃত্তির যাবতীয় ক্ষতি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। সুতরাং আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই, আর যাকে তিনি পথহারা করেন, তাকে পথ প্রদর্শনকারীও কেউ নেই। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِۦ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٠٢﴾ [ال عمران: ١٠٢]

“হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোনোভাবেই মারা যেও না।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০২]

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا ٗا كَثِيرٗا وَنِسَآءٗۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِۦ وَٱلۡأَرۡحَامَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيۡكُمۡ رَقِيبٗا ١ ﴾ [النساء: ١]

“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের দু’জন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন, আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে নিজ নিজ হক দাবী কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারেও। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর পর্যবেক্ষক।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১]

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَقُولُواْ قَوۡلٗا سَدِيدٗا ٧٠ يُصۡلِحۡ لَكُمۡ أَعۡمَٰلَكُمۡ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۗ وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدۡ فَازَ فَوۡزًا عَظِيمًا ٧١﴾ [الاحزاب: ٧٠، ٧١]

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সঠিক কথা বল; তাহলে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের কাজ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৭০, ৭১]

অতঃপর.......

হজ ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম একটি রুকন, আর তাতে রয়েছে সকল শ্রেণির ইবাদতের সমাবেশ- আন্তরিক ইবাদত, শারীরিক ইবাদত ও আর্থিক ইবাদত।

আর তা হলো ইসলামী মহাসমাবেশ, তাতে মুসলিমগণের পারস্পরিক সংঘবদ্ধতা ও ঐক্যের বিষয়টি ফুটে উঠে, আরও ফুটে উঠে অন্যদের ওপর তাদের গৌরবের দিকটি এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রতি তাদের বিনয় ও নম্রতার বিষয়টি।

আর মুসলিম সম্প্রদায়ের আলিম সমাজ হজের মতো এ মহান রুকনটির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন এবং তারা এ বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। যাঁরা ‘মক্কা’, মদীনা মুনাওয়ারা এবং ‘মানাসিক বা হজ’ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে[1] গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত। যেমন,

প্রথমত: এমন গ্রন্থপঞ্জি, যা ফিকহী বিধিবিধানের সাথে সম্পর্কিত; আর তার সংখ্যা অনেক এবং এগুলো এত বেশি প্রসিদ্ধ যে, তার দৃষ্টান্ত পেশ করার কোনো প্রয়োজন নেই।

দ্বিতীয়ত: এমন গ্রন্থপঞ্জি, যা (হজের প্রতি) উৎসাহ দান ও তার ফযীলতের সাথে সম্পর্কিত এবং তার সংখ্যাও অনেক। যেমন,

১. ‘মুছীরুল ‘আযম আস-সাকিন ইলা আশরাফিল আমাকেন’ (مثير العزم الساكن إلى أشرف الأماكن ), ইমাম আবদুর রাহমান ইবন ‘আলী ইবন আল-জাওযী (৫১০-৫৯৭ হি.)।

২. আল-ইতহাফ ফী ফাদলিত তাওয়াফ (الإتحاف في فضل الطواف), আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ‘ইল্লান সিদ্দিকী (৯৯৬-১০৫৭ হি.)।

৩. ‘আল-আহাদীস আল-ওয়ারেদা ফী ফাদায়েলিল মাদীনা জাম‘আন ওয়া দিরাসাতান’ (الأحاديث الواردة في فضائل المدينة جمعاً و دراسة), ড. সালেহ ইবন হামিদ আর-রেফা‘য়ী।

তৃতীয়ত: এমন গ্রন্থপঞ্জি, যা ভ্রমণ, হাজীদের পথ ও হারামাইনের ভৌগলিক বিবরণের সাথে সম্পর্কিত, আর এ জাতীয় গ্রন্থের সংখ্যা সীমিত। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

১. ‘কিতাবুল মানাসিক ওয়া আমাকিনু তুরুকিল হজ ও মা‘আলিমুল জাযীরাহ’ (كتاب المناسك وأماكن طرق الحج ومعالم الجزيرة), ইমাম ইবরাহীম ইবন ইসহাক আল-হারবী (১৯৮-২৮৫ হি.)।

২. ‘আদ-দুরার আল-ফারায়েদ আল-মুনায্যামা ফী আখবার আলহজ ওয়া ত্বরিকু মাক্কাতা আল-মু‘আয্যামা’ (الدرر الفرائد المنظمة في أخبار الحاج وطريق مكةَ المعظمة ), ‘আল্লামা আবদুল কাদের ইবন মুহাম্মাদ আল-জাযায়েরী (৯১১-৯৭৭ হি.)।

৩. গবেষক প্রফেসর ‘আতেক ইবন গিয়াছ আল-বিলাদী’র গ্রন্থসমূহ এবং এ গ্রন্থগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ‘আওদিয়াতু মাক্কা’ (أودية مكة ), ‘‘আলা ত্বরিক আল-হিজরাত’ (على طريق الهجرة), ‘মা‘আলেম মাক্কাতা আত-তারিখিয়্যা ওয়াল আছারিয়্যা’ (معالم مكة التاريخية والأثرية), ‘মু‘জাম আল-মা‘আলিম আল-জুগরাফিয়্যা ফিস্ সীরাত আন-নবওয়িয়্যাহ’ (معجم المعالم الجغرافية في السيرة النبويَّة )।

চতুর্থত: এমন গ্রন্থপঞ্জি, যা ‘হারামাইন শরীফাইন’-এর ইতিহাস সম্পর্কিত, এ জাতীয় গ্রন্থের সংখ্যা অনেক। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুই একটি নিম্নরূপ:

১. ‘তারিখ আল-মাদীনা’ (تاريخ المدينة), ইমাম উমার ইবন শাব্বাহ (১৭৩-২৬২ হি.)।

২. ‘ইতহাফুল ওয়ারা বি আখবারে উম্মিল কুরা’ (إتحاف الورى بأخبار أم القرى ), ইমাম আন-নাজম উমার ইবন ফাহাদ আল-কুরাশী (৮১২-৮৮৫ হি.)।

আর ইসলামে এ রুকনটির এত গুরুত্ব সত্ত্বেও আমরা মুসলিমদের মধ্যে এমন ব্যক্তিকে দেখতে পাই যে এ বিধিবিধানগুলো জানা ও বুঝার ব্যাপারে চেষ্টা করে না, আর চেষ্টা করে না হজের পবিত্র ভূমিতে, মক্কায় ও মদীনায় কোন কোন কাজ করা বৈধ সে ব্যাপারে ব্যাপকভাবে জানতে ও বুঝতে, যাতে সে হজের কাজসমূহ পালনে শরী‘আত বিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত না হয়ে যায়; আর শরী‘আত পরিপন্থী বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো আকীদা-বিশ্বাসগত ভুল-ভ্রান্তি, যা ঈমানে ঘাটতি সৃষ্টি করে অথবা তাকে বিলকুল ঈমানহারা করে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ ঐ ব্যক্তির কথা বলা যায়, যে ব্যক্তি সম্মানিত বাইতুল্লাহতে হজ করার ইচ্ছা করে, অথচ সে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের নিকট সাহায্য চায় অথবা প্রার্থনা (দো‘আ) করে।

আর এ বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য করেই আমি অত্যন্ত জরুরি মনে করেছি যে, আমি এ ভুল-ভ্রান্তিগুলো পর্যবেক্ষণ করব এবং তার শরী‘আতসম্মত বিধান বর্ণনা করব। হাজীগণ এবং তাদের পরিচালনা ও তত্ত্ববধানের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারী বা বেসরকারী এজেন্সী বা কর্তৃপক্ষকে তা অবহিত ও সতর্ক করার উদ্দেশ্যে, যাতে সেসব কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা যায়, যা তাদের হজকে ত্রুটিপূর্ণ বা বাতিল করার মত অবস্থায় নিপতিত করে কিংবা তাতে আঘাত করে, আর এটাই হলো এ গবেষণা-কর্মটি সম্পাদনের মূল লক্ষ্য।

তারপর আমার জানা মতে, ইসলামী গ্রন্থাগারসমূহ বিশেষ করে হজ সংশ্লিষ্ট আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তি প্রসঙ্গে লিখিত স্বতন্ত্র গ্রন্থশূণ্যতার দুর্বলতায় আক্রান্ত, যদিও তা ফিকহ শাস্ত্রের বৃহদাকার গ্রন্থসমূহ ও আকায়েদ বিষয়ক গ্রন্থসমূহের কোনো কোনো গ্রন্থে এবং কোনো কোনো ছোট্ট প্রবন্ধে বিক্ষিপ্ত আকারে আলোচিত হয়েছে; আর আমি এমন কাউকে দেখিনি, যিনি তা পৃথকভাবে স্বতন্ত্র আলোচনায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

এ গবেষণার চিন্তাকে আমার কাছে যে বিষয়টি জোরদার করেছে, তা আমি তার মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ! আর তা হলো- এমন কিছু বিষয় সংকলন করা, যা বিশেষভাবে হজের সাথে আকীদাগত বিরোধের সাথে সুনির্দিষ্ট, আর পাশাপাশি তার বিধান বর্ণনা করা এবং সাথে সাথে এ আকীদাগত বিরোধের সাথে কার্যত জড়িত ব্যক্তির বিধান বর্ণনা করা।

আর আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট আবেদন করছি, যাতে আমি এ বিষয়টিকে সাজাতে, তার বিক্ষিপ্ত বিষয়গুলোকে একত্র করতে এবং তার মাসয়ালাসমূহকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হই এমন এক পদ্ধতিতে, যা ইনশাআল্লাহ আকীদা-বিশ্বাসকে পরিশুদ্ধ করার কাজে অংশগ্রহণ করবে, যে আকীদা-বিশ্বাসের সাথে অনেক দোষত্রুটি ও ভেজাল মিশে একাকার হয়ে গেছে।

والحمدُ لله رب العالمين

(আর সকল প্রশংসা জগতসমূহের রব আল্লাহ তা‘আলার জন্য নিবেদিত)!!

>
[1] অর্থাৎ ঐসব মাসআলা থেকে যা তার (হজের) সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে সম্পর্কিত, যেসব মাসআলা হজ বিষয়ে আলোচনার সময় আলোচিত হয়। যেমন, উমরা আদায়ের জন্য মক্কা যিয়ারত, ‘মসজিদে নববী’ যিয়ারত, যমযমের পানি পান, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর যিয়ারত ইত্যাদি ধরণের আলোচনা বা পরিচ্ছেদ, যা হজ অধ্যায়ের মধ্যে আলোচনা করা হয়, তার জায়গা মত আমি তার বিবরণ পেশ করব ইনশাআল্লাহ।

যখনই আমি চিন্তা করলাম এ বিষয়টি নিয়ে লেখার ব্যাপারে, তখন আমি ভাবলাম এ ভুল-ভ্রান্তিসমূহের বর্ণনা-পদ্ধতি নিয়ে, অতঃপর সিদ্ধান্ত নিলাম যে, গবেষণাটি দু’টি পদ্ধতির বাইরে না যাওয়াটাই উচিৎ হবে।

প্রথম পদ্ধতি:

হাজী সাহেব সংশ্লিষ্ট, তার দেশ থেকে শুরু করে আবার ফিরে আসা পর্যন্ত। সুতরাং আমি শুরু করব হাজী সাহেব কর্তৃক তার শহরে অবস্থান করা থেকে এবং তাতে বিদ্যমান বিদ‘আতসমূহ দ্বারা তার প্রভাবিত হওয়া নিয়ে।

অতঃপর ‘হারামাইন’-এর দেশের উদ্দেশ্যে তার সফর এবং তার শহর থেকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর যিয়ারত করার নিয়ত করা...

অতঃপর তার মক্কায় প্রবেশ, তার হজ আদায়ের পদ্ধতি এবং তাতে যেসব বিদ‘আত রয়েছে; আর কা‘বার গেলাফ, তার পাথরসমূহ, মাকামে ইবরাহীম ও হারামের যমীনের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং এসব ব্যাপারে তার আকীদা-বিশ্বাস।

অতঃপর তার দ্বারা হজের পবিত্র স্থানসমূহ ভ্রমণ এবং সেখানকার মাটি, পাথর ও গাছসমূহ দ্বারা বরকত হাসিল করা।

অতঃপর হজ শেষ করার পর তার দ্বারা কিছু ঐতিহাসিক স্থানের উদ্দেশ্যে গমন করা। যেমন, বরকত অর্জনের উদ্দেশ্যে হেরা গুহা ও সাওর গুহায় গমন।

অতঃপর তার ‘মাদীনায়ে নববী’-তে গমন করা, কবর শরীফ যিয়ারত করা এবং এ ক্ষেত্রে যেসব বিদ‘আত ও বিভ্রান্তি চলছে।

অতঃপর কিছু হাদিয়া নিয়ে অথবা ব্যাগভর্তি মক্কার বা মদীনার মাটি নিয়ে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করা...

তবে এখানে এমন কিছু আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তিও আলোচিত হয়েছে, যা কোনো নির্ধারিত স্থানের সাথে সুনির্দিষ্ট নয়। যেমন, তাবিজ-কবচ পরিধান করা, ওলীগণের নিকট প্রার্থনা করা এবং বিদ‘আতপূর্ণ দো‘আ বা অযীফা পাঠ করা...

আর এভাবে আমি হাজী সাহেবের সাথে এক পা এক পা করে চলতে থাকব তার হজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে তাকে আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তিগুলোর ব্যাপারে সতর্ক ও সাবধান করতে করতে।

দ্বিতীয় পদ্ধতি:

এক জাতীয় বিষয়গুলো একটি জায়গায় একত্রিত করা। সুতরাং উদাহরণস্বরূপ আমি কবরসমূহ (নবীসাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর, বাকী কবরাস্থান এবং ওহুদের শহীদগণের কবরাস্থান) যিয়ারত করার উদ্দেশ্য সংক্রান্ত বিষয়টি একটি অধ্যায়ে একত্রিত করব, বিভিন্ন প্রকার প্রতীক ও নিদর্শনের দ্বারা বরকত হাসিল সম্পর্কিত বিষয়গুলো এক জায়গায় একত্রিত করব, আর প্রভাবশালী বিশেষ মসজিদসমূহের (মাসজিদুল কিবলাতাইন, তথাকথিত বিশেষ সাত মসজিদ ও মসজিদে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু ইত্যাদির) আলোচনা করব এক জায়গায়, আর এ ভাবেই... গবেষণাকর্মটি চলবে।

আর আমি দেখছি অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রথম পদ্ধতির অনুসরণে তাতে কিছু বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটবে, যাতে এ গ্রন্থটি আল্লাহ তাওফীক দিলে গবেষক ও ছাত্রদের জন্য হাজী সাহেবের হজ যাত্রার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আকীদাগত ভুল-ত্রুটিগুলো জানার জন্য একটা দলীল হতে পারে; ফলে এর দ্বারা তাদের জন্য সহজ হবে এ বিষয়গুলো এক পা এক পা করে অনুসরণ করা, আর এ পথ ধরে তা সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করা এবং তাতে পতিত হওয়ার আগেই তার ব্যাপারে সতর্ক করা।

অচিরেই এসব ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা হবে ধারাবাহিক অধ্যায় অনুসারে, প্রত্যেকটি ভুল-ভ্রান্তি একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ের মধ্যে; আর যখন কোনো বিরোধের সম্পর্ক থাকবে পূর্বের বক্তব্যের সাথে, তখন আমি প্রথমটির আলোচনা করব বিস্তারিতভাবে এবং পরবর্তীটিকে সংক্ষেপ করব প্রথমটির বরাতসহ ইঙ্গিত করে।

গবেষণার শব্দ-তালিকার পরিচয়:

১. ‘আল-মুখালিফাত’ (المخالفات): শব্দটি مخالفة শব্দের বহুবচন, আর ‘ইখতিলাফ’ (الاختلاف) শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ইত্তিফাক’ (الاتفاق) তথা ঐকমত্যের বিপরীত, অর্থাৎ অনৈক্য বা মতবিরোধ, আর কোনো কোনো আলিম ‘খিলাফ’ (الخلاف) ও ‘ইখতিলাফ’ (الاختلاف)-এর মধ্যে পার্থক্য করেন। তারা বলেন, ‘ইখতিলাফ’ (الاختلاف) শব্দটি এমন কথা বা মতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যা দলীল-প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে ‘খিলাফ’ (الخلاف) শব্দটি ব্যবহৃত এমন ক্ষেত্রে, যার ব্যাপারে কোনো দলীল-প্রমাণ নেই; আর তাতে বিরোধিতাকারীর পক্ষে দুর্বলতার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়।[1]

আর তার ওপর ভিত্তি করে বলা যায়- যে ব্যক্তি এসব ‘মুখালিফাত’ তথা বিরোধকে পালন বা প্রতিষ্ঠিত করবে, তার সাথে তার কাজের ব্যাপারে আস্থা স্থাপন করার মত কোনো দলীল-প্রমাণ নেই; বরং তাকে শুধু ‘মুখালিফ’ (مخالف) তথা বিরোধিতাকারী বলে গণ্য করা হবে। আর যে ব্যক্তি দুর্বল অথবা বানোয়াট দলীলের ওপর নির্ভর করবে, সে ব্যক্তি হলো এমন ব্যক্তির ন্যায়, যার কাছে কোনো দলীল-প্রমাণ নেই।

আর মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক সঠিক বিষয়ের বিপরীত মত পোষণ করার বিষয়টি জানা যাবে দলীল-প্রমাণ সম্পর্কে জানার মাধ্যমে এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন-চরিত, কথা ও কাজ সম্পর্কে অবহিত হওয়ার মাধ্যমে।

২. আল-‘আকদিয়্যা (العقدية): এ শব্দটি ইঙ্গিত করে এমন সব মাসায়েলের দিকে, যা আকীদাগত মাসায়েলের সাথে সুনির্দিষ্ট[2], আর এটা এমন এক শর্ত, যার কারণে ইবাদত সংক্রান্ত মাসয়ালাগুলো এ গবেষণার আওতামুক্ত হয়ে যায়, ফলে গবেষণাটি সে দিকে প্রবেশ করবে না। যেমন, পাথর ব্যতীত জুতা ও অনুরূপ কিছুর মত কোনো বস্তু জামারায় নিক্ষেপ করা; এর ফলে ঐসব সাধারণ শরী‘আতী ভুল-ভ্রান্তিসমূহ এ গবেষণার আওতামুক্ত হয়ে যায়, যা পারিভাষিক দৃষ্টকোণ থেকে ‘আকিদার অন্তর্ভুক্ত হয় না। যেমন, দাড়ি মুণ্ডন করা, কাপড় ঝুলিয়ে পরিধান করা, নারীগণ কর্তৃক মাহরাম পুরুষ সঙ্গী ব্যতীত সফর করা ইত্যাদি।

৩. হজ(الحج): হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা, আর পরিভাষায় হজ মানে: সুনির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কতগুলো কাজ করার জন্য মক্কায় গমনের ইচ্ছা করা।[3] আর এর মাধ্যমে ঐসব আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তিসমূহ আমাদের গবেষণার আওতামুক্ত হয়ে যায়, যেগুলো হজের মৌসুম ব্যতীত অন্য সময়ে হয়ে থাকে, যার কিছু উদাহরণ একটু পরেই আমাদের সামনে আসছে।

গবেষণার লক্ষ্য:

এ গবেষণার মধ্য থেকে গবেষকের লক্ষ্য হলো, জনগণকে ঐসব আকীদাগত বিরোধের সাথে পরিচিত করা, যা হজের মৌসুমে কোনো কোনো হাজী সাহেবের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে; আর শরী‘আতের ভাষ্য এবং আলেমগণের বক্তব্যের মাধ্যমে দীনের সাথে সেসব আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তিপূর্ণ বিষয়গুলো উপস্থাপন করা।

বস্তুত ভুল-ভ্রান্তির প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে তা জনগণের কাছে বর্ণনা করে দেওয়া একটি মহৎ উদ্যোগ; আর তাই দেখা যায় আমাদের আলিম সমাজ বিদ‘আত ও তার বর্ণনা এবং তা থেকে সতর্ককরণ বিষয়ে প্রাচীন ও আধুনিক সময়ে অনেক লেখালেখি করেছেন।

আর যে ব্যক্তি ভুলটা জানতে পারবে, সে তাতে পতিত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকবে, হুযায়ফা ইবনল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,

«كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُونَ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْخَيْرِ، وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ ؛ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِي» .

“জনগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করত ভালো সম্পর্কে, আর আমি তাঁর নিকট প্রশ্ন করতাম মন্দ বিষয় সম্পর্কে- এ আশঙ্কায় যে, তা (মন্দ) আমাকে পেয়ে বসবে।”[4]

তিনি আরও বলেন,

«كَانَ أَصْحَابُ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْأَلُونَهُ عَنْ الْخَيْرِ، وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنْ الشَّرِّ، قِيلَ : لِمَ فَعَلْتَ ذَلِكَ ؟ قَالَ : مَنْ اتَّقَى الشَّرَّ ؛ وَقَعَ فِي الْخَيْرِ».

“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করতেন ভালো সম্পর্কে; আর আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করতাম মন্দ বিষয় সম্পর্কে; বলা হলো, কেন আপনি এরূপ করতেন? তিনি বলেন, যে ব্যক্তি মন্দ পরিহার করে চলবে, সে ভালো ও কল্যাণের মধ্যে থাকবে।”[5]

গবেষণার পরিধি:

গবেষণাটি নির্ধারিত সময় ও স্থানের সাথে সম্পর্কযুক্ত; আর গবেষণাটি এমন সব আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তিকে অন্তর্ভুক্ত করবে, যা হজের সময়ে ও হজের স্থানে হাজীগণের একটি গোষ্ঠীর মাঝে সংঘটিত হয়। সুতরাং হাজীগণের কেউ কেউ হজের মাসসমূহে, মক্কায় এবং হজের পবিত্র স্থানসমূহের মধ্যে যে কাজ করবেন, তা গবেষণার পরিধির আওতাভুক্ত হবে।

আর এর অনুষঙ্গ হিসেবে যা তাদের হজের পথে এবং হজের পরে মদীনায়ে নববীতে তাদের পক্ষ থেকে ঘটবে, তাও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।

আর তার ওপর ভিত্তি করে আকীদাগত বিরোধেসমূহের মধ্য থেকে যা হজের মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে প্রকাশ পায়, তার সাথে গবেষণার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। যেমন, ঐসব আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তি, যা সংঘটিত হয় মহররম মাসের দশম দিনে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখে, অথবা রজব মাসের ২৭ তারিখে অথবা শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে এবং অনুরূপ আরো কোনো সময়ে।অনুরূপভাবে আমি গবেষণার মধ্যে ঐসব আকীদাগত ভুল-ভ্রান্তি পরিহার করেছি, যা ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আলহামদু লিল্লাহ। যেমন, আরাফার রজনীতে ‘জাবালে ‘আরাফা’ (আরাফার পাহাড়)-এর ওপরে আগুন ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত করার বিদ‘আত[6] এবং আরাফার পাহাড়ে অবস্থিত ‘কুব্বাতু আদাম’ (আদমের তাঁবু)-এর চতুষ্পার্শ্বে তাওয়াফ করার বিদ‘আত[7], আর এগুলো ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আলহামদু লিল্লাহ।

>
[1] দেখুন: ‘লিসানুল আরব’: (৯/৯০); ‘তাজুল ‘আরুস মিন জাওয়াহেরিল কামূস’: (১২/১৮৯, ১৯৯); ‘কাশ্শাফু ইস্তিলাহাত আল-ফুনূন ওয়াল ‘উলূম’: (১/১১৬-১১৭)।

[2] ‘আল-মু‘জাম আল-ওয়াসীত’: (২/৬১৪) নামক অভিধানের মধ্যে এসেছে: (‘আকিদা: এমন হুকুম বা সিদ্ধান্ত, যার ব্যাপারে তার বিশ্বাসী ব্যক্তির নিকট কোনো প্রকার সন্দেহ-সংশয় গ্রহণযোগ্য নয়)।

[3] দেখুন: ‘আন-নাযম আল-মুসতা‘যাব ফী শরহে গারীব ‘আল-মুহায্যাব’: (১/১৮১); ‘আদ-দুর্রুন নাকী ফী শরহে আলফায আল-খিরাকী’: (২/৩৭৬); ‘মুন্তাহাল ইরাদাত ফী জাম‘য়ে ‘আল-মুকনি‘য়ে’ মা‘আ ‘ আত-তানকীহ’ ওয়া যিয়াদাত’: (২/৫৭)।

[4] সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ৩৪১১; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৮৪৭; আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ২৩৪২৫; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ৪২৪৪।

[5] আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ২৩৩৯০।

[6] ইমাম নববী রহ. তা আলোচনা করেছেন, তিনি বলেছেন: সাধারণ জনগণের একটি অংশ ‘জাবালে ‘আরাফা’ (‘আরাফার পাহাড়)-এ জিলহজ মাসের নবম রজনীতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত করে, আর তিনি উল্লেখ করেন যে, এটা নিকৃষ্টতর বিদ‘আতসমূহের অন্তর্ভুক্ত এবং তা কদর্যতাপূর্ণ ভ্রষ্টতা, যা কয়েক প্রকারের মন্দকে একত্রিত করে। যেমন, আগুনের প্রতি বিশেষ মনোযোগের মধ্য দিয়ে অগ্নিপূজকদের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে প্রকাশ করা। [‘আল-মাজমূ‘উ শরহু ‘আল-মুহায্যাব’: (৮/১৪০); আরও দেখুন: ‘আল-ইবদা‘উ ফী মাদারিল ইবতিদা‘য়ে’: (পৃ. ৩০৫)]

[7] শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. তা আলোচনা করেছেন, তিনি বলেছেন: “আরাফাতের সবটুকুই অবস্থান করার জায়গা; আর বতনে ‘উরানাতে অবস্থান করবে না; আর সেখানকার পাহাড়ে আরোহণ করাটা সুন্নাহ’র অন্তর্ভুক্ত নয়; আর সে পাহাড়টিকে ‘জাবালে রহমত’ (রহমতের পাহাড়) বলা হয়, আর তাকে এর ওজনে ‘ইলাল’ -ও বলা হয়; অনুরূপভাবে তার ওপরে অবস্থিত তাঁবুর বিষয়টিও, যাকে ‘কুব্বাতু আদাম’ (আদমের তাঁবু) বলা হয়; তাতে প্রবেশ করা এবং তার মধ্যে সালাত আদায় করাটা মুস্তাহাব কিছু নয়; আর তার চতুর্দিকে তাওয়াফ করাটা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত।” [‘মানসাকু শাইখুল ইসলাম’, সাউদী ধর্ম মন্ত্রণালয় এর আওতায় মুদ্রিত: (২৬/১৩৩)]।

হজ ফরয হয় নবম অথবা দশম হিজরীতে[1], আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ করেন দশম হিজরীতে এবং তিনি চেয়েছেন তাঁর এ হজে তিনি হবেন শিক্ষক ও প্রশিক্ষক। সুতরাং তাঁর থেকে হজ বিষয়ে অনেকগুলো কাওলী (উক্তিবাচক) ও ফে‘লী (কর্মবাচক) হাদীস বর্ণিত হয়েছে; এ বিষয়ে যা বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে ব্যাপক অর্থবোধক হাদীস হলো সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমকে লক্ষ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, যেখানে তিনি বলেছেন:

«لِتَأْخُذُوا مَنَاسِكَكُمْ، فَإِنِّى لاَ أَدْرِى لَعَلِّى لاَ أَحُجُّ بَعْدَ حَجَّتِى هَذِهِ»

“যাতে তোমরা তোমাদের হজের নিয়ম-কানুন শিখে নিতে পার; কারণ, আমি জানি না, সম্ভবত আমার এ হজের পর আমি আর হজ করতে পারব না।”[2]

সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্দেশনাকে অনুসরণ করেছেন। সুতরাং তারা যখনই হজ করতেন, তখন তারা এ হাদীসকে তাদের চোখের সামনে রাখতেন; ফলে তারা এমন কোনো কাজ করতেন না, যা শিক্ষাগুরু মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নি, আর এ নীতিতে মুসলিমগণ চলেছেন আবহমান কাল ধরে, এমনকি ইসলামী দেশের আয়তন ও পরিধি সম্প্রসারিত হলো এবং জনগণ আল্লাহর দীনে শামিল হলো সকল দিক থেকে; অতঃপর তারাও প্রতি বছর হজ করতেন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কাজ থেকে নেয়া হজের নিয়ম-কানূনকে গ্রহণ ও অনুসরণ করে।

কিন্তু বিষয়টি শিথিল ও প্রশমিত হয়ে গেল কিছু কিছু সময়ে এবং কোনো কোনো স্থানে; ফলে আল্লাহ তা‘আলার দীনের মধ্যে এমন কিছু বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটল, যা তার দীনের অন্তর্ভুক্ত কিছু নয়, আর এ দীনের মধ্যে যা অনুপ্রবেশ করেছে, তা দুই প্রকারের:

এক প্রকার, আকীদা-বিশ্বাসগত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত, আরেক প্রকার, আমল বা কর্মগত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। এখানে আমাদের প্রত্যাশিত আলোচ্য বিষয় হলো প্রথম প্রকার, যা আকীদা-বিশ্বাসগত মাসায়েলের সাথে নির্দিষ্ট; তন্মধ্যে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হয়- আমরা ঐসব মাসয়ালার আলোচনা করব, যার সাথে হাজী সাহেব জড়িত, তার হজ আদায়কালীন সময়ে অথবা তার পূর্বে অথবা তার পরে, যা হজের সাথে সম্পর্কিত।

আর দ্বিতীয় প্রকার: আমল বা কর্ম সংক্রান্ত মাসআলার সাথে নির্দিষ্ট। যা আলোচনার জন্য অপর জায়গা রয়েছে, এটা তার জন্য নির্দিষ্ট স্থান নয়, তার অনেকগুলো দৃষ্টান্ত রয়েছে। তন্মধ্যে দু’একটি নিম্নরূপ:

১. হজের উদ্দেশ্যে নারীগণ কর্তৃক মাহরাম পুরুষ সঙ্গী ব্যতীত সফর করা; অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহরাম পুরুষ সঙ্গী ব্যতীত সফর করতে নিষেধ করেছেন; তিনি বলেন,

«لاَ يَحِلُّ لاِمْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ تُسَافِرُ مَسِيرَةَ يَوْمٍ إِلاَّ مَعَ ذِى مَحْرَمٍ»

“আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে এমন নারীর জন্য মাহরাম পুরুষ সঙ্গী ব্যতীত একদিনের দূরত্বের পথ ভ্রমণ করা বৈধ নয়।”[3]

২. হাজী সাহেব কর্তৃক ‘তালবিয়্যা’ পাঠ করার পর, এর সাথে ‘তাকবীর’ (আল্লাহু আকবার) এবং ‘তাহলীল’ (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) যোগ করে বলা।[4]বস্তুত এটা সুন্নাতের বিপরীত। কারণ, হাজী সাহেবের জন্য সুন্নাত হলো ‘তালবিয়্যা’ পাঠ করা। তালবিয়ার সাথে ‘তাকবীর’ (আল্লাহু আকবার) ও ‘তাহলীল’ (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ) পাঠ করা নয়। এ ‘তালবিয়্যা’ পাঠ অব্যাহত থাকবে জামারাতুল আকাবা তথা বড় জামরায় পাথর নিক্ষেপ করা পর্যন্ত; এর বিপরীত কাজকে ‘বিদ‘আত’ বলে গণ্য করা হবে।[5]

>
[1] সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে অনুরূপ বলা হয়ে থাকে। আরও দেখুন: ‘যাদুল মা‘আদ’: (২/৯৬)।

[2] হাদীসটি আবূ যুবায়ের আল-মাক্কী ‘মারফু’ সনদে জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১২৯৭; আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ১৪৪১৯; ইবন মাজাহ, আস-সুনান, হাদীস নং ৩০২৩; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ৪২৪৪; নাসাঈ, আস-সুনান, হাদীস নং ৩০৬২)।

[3] হাদীসটি ‘মারফু’ সনদে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১০৩৮; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৩৩৯; হাদীসের শব্দগুলো ইমাম সহীহ মুসলিম রহ.-এর।

[4] মানাসিক আল-হাজ ওয়াল ‘উমরা: (পৃ. ৪৭)।

[5] দেখুন: ফিকহুল ‘ইবাদাত: (পৃ. ৩৫০, ৩৬২)। আরও দেখুন: বিদা‘উল হজ ওয়াল ‘উমরা: (পৃ. ৩৫০, ৩৬২)।

আর হজ ও উমরার আকিদাগত বিদ‘আত ও অন্যান্য বিষয়গুলো দেখুন নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহে:

আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ আল-খাল্লাল, ‘আল-হাছ্ছু ‘আলাত্ তিজারাত’: (পৃ. ৬৭-৮০)।
আবদুর রাহমান ইবন আলী ইবনুল জাওযী, ‘তালবীসু ইবলিস’ (২/৮৩০-৮৩২)।
মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী, ‘মানাসিক আল-হাজ ওয়াল ‘উমরা’: (পৃ. ৪৫ ও তার পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহ)।
মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-‘উসাইমীন, ‘ফিকহুল ‘ইবাদাত’: (পৃ. ৩৩৫-৪০৭)।
হামুদ ইবন আবদিল্লাহ আল-মাত্বার, ‘আল-বিদ‘উ ওয়াল মুহদাছাত ওমা লা আসলা লাহু’: (পৃ. ৩৭৭-৪১৪)।
রায়েদ ইবন সাবরী ইবন আবি ‘আলফা, ‘মু‘জাম আল-বিদ‘য়ে’: (পৃ. ১৭২-১৯৭)।
আবদুল ‘আযীয ইবন মুহাম্মাদ আস-সাদহান, ‘মুখালিফাতুল হজ ওয়াল ‘উমরা’।
আবদুল মাজীদ আল-হাদিসী, ‘তানবীহুল আনাম ইলাল মুখালিফাত আল-ওয়ারেদা ফিল মাসজিদাইন আন-নববী ওয়াল হারাম’ ।

আর এর বাইরে আরও আপনি অনেক নির্দেশনা পাবেন, যা ছড়িয়ে আছে ফিকহ’র কিতাবসমূহের আওতাধীন হজের অধ্যায়ে।
প্রথম অধ্যায় - পাথেয় ছাড়া হজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার মাধ্যমে তাওয়াক্কুল করার মত ভুল ধারণা পোষণ করা

ইবন জারীর আত-ত্ববারী রহ. বলেন, “তাওয়াক্কুল’ -এর সঠিক মানে হলো: বান্দাকে তার দীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে চেষ্টা-তদবির করার যে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ চেষ্টা-সাধনা করার পর তার কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি দৃঢ় আস্থা পোষণ করা, কাজ-কারবারে তাঁর ওপর ভরসা করা এবং এর সবকিছু তাঁর প্রতি ন্যস্ত করা।”[1]

আর ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “তাওয়াক্কুল’ হলো বান্দাকে তার দীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে যা উপকৃত করে তা অর্জন করার ক্ষেত্রে এবং তার দীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে যা ক্ষতি করে তা প্রতিরোধ করার ব্যাপারে আল্লাহর ওপর হৃদয়-মন দিয়ে নির্ভর করা, আর এ নির্ভরতার সাথে সরাসরি উপায়-উপকরণের অবলম্বনও জরুরি।”[2]

সুতরাং ‘তাওয়াক্কুল’ হলো আল্লাহর ওপর ভরসা, তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর শরণাপন্ন হয়ে এবং তাঁর ওপর সবকিছু ন্যস্ত করার মধ্য দিয়ে অন্তরের কাজ ও ইবাদত করার নাম। আরও থাকবে বান্দা কর্তৃক ঐ বিষয়ের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দক্ষতাপূর্ণ জ্ঞানে ও সুন্দর পছন্দে তাঁর বান্দার জন্য যা ফয়সালা করেছেন; যখন সে তার বিষয়টি তাঁর ওপর ন্যস্ত করে, তবে সাথে সাথে তাকে নির্দেশিত উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে হবে এবং তা অর্জনের ব্যাপারে তার চেষ্টা-সাধনা থাকতে হবে।

‘তাওয়াক্কুল’ -এর স্বরূপ হচ্ছে: উপায়-উপকরণের ব্যবহার এবং অন্তর দ্বারা উপায়-উপকরণের মালিক আল্লাহর ওপর নির্ভর করা।[3]

‘তাওয়াক্কুল’ -এর গুরুত্বের পক্ষে দলীল হলো: আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর নবীকে সুস্পষ্টভাবে তাঁর ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করার নির্দেশ প্রদান করা, যেখানে তিনি বলেছেন:

فَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۖ إِنَّكَ عَلَى ٱلۡحَقِّ ٱلۡمُبِينِ

“সুতরাং আল্লাহর ওপর নির্ভর করুন; আপনি তো স্পষ্ট সত্যে প্রতিষ্ঠিত।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৭৯] আর এ একই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে আল-কুরআনুল কারীমের আরও নয়টি জায়গায়; আর এর মধ্যে তিনি তাঁর মুমিন বান্দাগণকে তা অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন; আর এটাই হলো শরী‘আতসম্মত ‘তাওয়াক্কুল’, আর এটা এমন ‘তাওয়াক্কুল’, যা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার বিষয়টিকে দাবি করে এবং আরও দাবি করে উপায়-উপকরণের মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ওপর হৃদয়-মনের নির্ভরতা। এ মাসয়ালাতে এটাই হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মত। আর এটাই সঠিক ও বাস্তব, যার পক্ষে প্রমাণ পেশ করে শরী‘আতের বক্তব্যগুলো এবং যুক্তিভিত্তিক দলীলসমূহ। সুতরাং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ‘মুতাওয়াক্কিল’ (আল্লাহর ওপর ভারসাকারী) ব্যক্তি (শুধু) উপায়-উপকরণের প্রতি মনোযোগ দেয় না, অর্থাৎ সে শুধু উপায়-উপকরণে নিশ্চিন্ত থাকে না, তার আশায় বসে থাকে না এবং তার ভয়ও করে না; ঠিক যেমনিভাবে সে উপায়-উপকরণ থেকে বিরতও থাকে না, ফলে সে তাকে ফেলে দেয় না, অবহেলা করে না এবং তাকে বাদ দেয় না; বরং সে মনোযোগ দিয়ে তা অবলম্বন করে, দৃষ্টি রাখে তার (উপায়-উপকরণের) স্রষ্টা ও পরিচালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার প্রতি[4]।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم

“আর তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য প্রস্তুতি রাখ।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬০]

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«اعْقِلْهَا وَتَوَكَّلْ»

“তাকে (উটটিকে) বেঁধে নাও এবং (আল্লাহর ওপর) ভরসা করা।”[5] আর এটাই ছিল ‘তাওয়াক্কুল’-এর ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের হিদায়াত বা নির্দেশনা, তারা ছিলেন ‘তাওয়াক্কুল’ -এর দিক থেকে সবচেয়ে বেশি পরিপূর্ণ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, আর তাঁদের হিদায়াত ও নির্দেশনার ওপরই জীবন চালিয়েছেন তাঁদের পরে আগত প্রজন্মসমূহ।

শরী‘আতসম্মত এ ‘তাওয়াক্কুল’ -এর বিপরীতে রয়েছে আরেক প্রকার ‘তাওয়াক্কুল’, যা শরী‘আতসম্মত নয়, আর তা হলো আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ (ভরসা) করা। আর তা দুই প্রকার:

১. এমন বিষয় বা কাজে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ (ভরসা) করা, যা সমাধানের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ছাড়া অন্যের কোনো ক্ষমতা নেই। যেমন, ঐসব ব্যক্তিবর্গ, যারা তাদের সাহায্য, রিযিক ও শাফা‘আতের দাবি পূরণের ব্যাপারে মৃতব্যক্তি ও ‘তাগুত’ (শয়তান)-এর ওপর ভরসা করে। বস্তুত এটা হলো বড় মাপের শির্ক, শির্কে আকবার।[6] এ প্রকারের ‘তাওয়াক্কুল’-কে ‘তাওয়াক্কুল আস-সির’ বা ‘গোপন তাওয়াক্কুল’ নামে অভিহিত করা হয়। কারণ, এ জাতীয় ‘তাওয়াক্কুল’ শুধু এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, সৃষ্টিজগতের মধ্যে এ মৃতব্যক্তির কোনো গোপন ক্ষমতা রয়েছে।[7]

২. এমন বিষয় বা কাজে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করা, যা সমাধানের ব্যাপারে তার ধারণা অনুযায়ী ভরসাকৃত ব্যক্তি ক্ষমতা রাখে। বস্তুত এটা ছোট শির্ক[8]। এর দৃষ্টান্ত হলো: “দৃশ্যমান স্বাভাবিক উপায়-উপকরণে ‘তাওয়াক্কুল’ করা। যেমন, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো নেতা বা শাসকের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করা, যার হাতে আল্লাহ ‘রিযিক’ সরবরাহ অথবা দুঃখ-কষ্ট বা অসুবিধা দূর করার অথবা এর মত কোনো ক্ষমতা দিয়েছেন। তখন এটা হালকা বা ছোট মানের শির্ক বলে গণ্য হবে।”[9]

হজের পাথেয় বর্জন করা তথা উপায়-উপকরণ পুরোপুরি বর্জন করাটা শরী‘আতসম্মত ‘তাওয়াক্কুল’-এর অন্তর্ভুক্ত নয়, আর আলিমগণের ঐক্যবদ্ধ রায় হলো; মুসলিম ব্যক্তির ওপর (শারীরিক ও আর্থিক) সামর্থ্য ছাড়া হজ আবশ্যক হয় না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ

“আর মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭]

ইবনু কুদামা রহ. বলেন, (পাঁচটি শর্ত পূরণের মাধ্যমে হজ আবশ্যক হয়, তারপর তিনি তা উল্লেখ করেছেন তন্মধ্যে) অন্যতম একটি শর্ত হলো সামর্থ্য।[10] এ শর্তে বর্ণিত সামর্থ্য দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: পাথেয় ও যাতায়াত ব্যবস্থা অবলম্বন করা।

ইবন কুদামা রহ. বলেন, ‘আর সামর্থ্য হলো: পাথেয় ও যানবাহনের মালিক হওয়া।’[11]

সামর্থ্য এর উক্ত ব্যাখ্যার দলীল হলো, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত জবাব, যখন তাঁর নিকট জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল:

«مَا يُوجِبُ الحَجَّ ؟ قال : الزادُ والراحلةُ»

“কিসে হজকে আবশ্যক করবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘পাথেয় ও যাতায়াত ব্যবস্থা’।”[12]

এসব ভাষ্য থেকে আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হজ আবশ্যক হওয়ার জন্য অন্যতম একটি শর্ত হলো ‘রসদপত্র’; আর হাজী সাহেবের জন্য তার সফরের মধ্যে ও আবাসিক অবস্থানে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর আলিম সমাজ হাজীদেরকে সর্কতার জন্য বেশি বেশি পাথেয় ও রসদপত্র সাথে রাখার উপদেশ দিয়ে থাকেন, যাতে তাকে জনগণের দ্বারস্থ হতে না হয়, এমনকি সে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে না দেয়।

আল্লামা ইবন উসাইমীন রহ. বলেন,

‘যিনি হজ অথবা উমরা করার ইচ্ছা করেন, তার জন্য উচিৎ হলো বেশি বেশি করে খরচপাতি ও সফরের সম্বল কাছে রাখা এবং সতর্কতার জন্য তার প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত অর্থ সঙ্গে রাখা, যাতে তাৎক্ষণিক জরুরি প্রয়োজন পূরণ করতে পারে’।[13]

অদ্ভুত ব্যাপার হলো যে, একটি গোষ্ঠী বিশ্বাস পোষণ করে যে, পাথেয় ও সহায়-সম্বল নিয়ে হজের উদ্দেশ্যে সফর করাটা আল্লাহর ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ (ভরসা) করার পরিপন্থী। ফলে তারা সহায়-সম্বল ছাড়া সফরে বের হয়ে যায় এবং তারা তাদের নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়; তাদের ধারণা যে, এ সবকিছুই তারা করছে ‘তাওয়াক্কুল’-কে পরিশুদ্ধ করার নিমিত্তে।[14]

বস্তুত তাদের এ ধরনের কুধারণা ও মন্দ বিশ্বাস অনেক আগ থেকেই চালু ছিল। এর প্রমাণ হলো:

১. আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র উক্তি, তিনি বলেন,

«كَانَ أَهْلُ الْيَمَنِ يَحُجُّونَ، وَلَا يَتَزَوَّدُونَ، وَيَقُولُونَ : نَحْنُ الْمُتَوَكِّلُونَ، فَإِذَا قَدِمُوا مَكَّةَ سَأَلُوا النَّاسَ، فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى: ﴿ وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ ﴾ [البقرة: ١٩٧] » .

“ইয়ামানের অধিবাসীগণ হজে গমনকালে পাথেয় সঙ্গে নিতো না এবং তারা বলত: আমরা আল্লাহর ওপর ভরসাকারী; কিন্তু যখন তারা মক্কায় আগমন করত, তখন তারা জনগণের কাছে সাহায্যের আবেদন করে বেড়াতো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা আয়াত অবতীর্ণ করেন:

وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ

“আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। নিশ্চয় সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৭]”[15]

ইমাম ইবন জারীর ত্ববারী রহ. বলেন, “বর্ণিত আছে যে, এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে এমন এক সম্প্রদায়ের ব্যাপারে, যারা পাথেয় ছাড়া হজ করত, আর তাদের কেউ কেউ যখন ইহরাম বাঁধতো, তখন তাদের সাথে থাকা পাথেয় ছুড়ে ফেলে দিত এবং অন্যের নিকট পাথেয় চেয়ে আবেদন করত। তারপর তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সঙ্গে পাথেয় না নিত, আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার সফরের জন্য পাথেয় নেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন, আর তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি পাথেয়ের মালিক ছিল, তিনি তাকে তার পাথেয়কে সংরক্ষণ করতে এবং তা ছুড়ে ফেলে না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন”।[16]

২. সা‘ঈদ ইবন নাসীর বলেন,

«سألت سفيان بن عيينة رحمه الله _ فقلت : يا أبا محمد ! عندنا قوم يلبسون الشعر، ويحجون ولا يتزودون، ويزعمون أن من حمل الزاد فليس بمؤمن . فقال: كذبوا ؛ هؤلاء أعداء السنة، لا تجالسوهم ولا تحدثوهم»

“আমি সুফিয়ান ইবন ‘উয়ায়ানা রহ. কে প্রশ্ন করে বললাম: হে আবূ মুহাম্মাদ! আমাদের সমাজে এক সম্প্রদায় রয়েছে, যারা পশমের পোশাক পরিধান করে, আর তারা হজ করে এবং সঙ্গে পাথেয় নিয়ে যায় না, আর তারা বিশ্বাস করে যে, যে ব্যক্তি পাথেয় নিয়ে (হজে) যায়, সে ব্যক্তি মুমিন নয়। এ কথা শুনে তিনি বললেন: ‘তারা মিথ্যা বলেছে; এসব লোক সুন্নাহ’র শত্রু, তোমরা তাদের সাথে উঠা-বসা করবে না এবং তাদের সাথে কোনো কথা বলবে না।”[17]

৩. জনৈক ব্যক্তি ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. এর কাছে এসে বলল:

«أُرِيد أَنْ أَخْرُجَ إلى مكَّةَ على التوكُّلِ بِغَير زادٍ، فقال له أَحْمَدُ : اخرج في غير القَافِلَةِ . فقال : لا ؛ إِلاَّ معهُم، فقال : على جراب النَّاسِ تَوكلتَ» .

“আমি আল্লাহর ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ (ভরসা) করে কোনো রকম পাথেয় ছাড়াই মক্কার উদ্দেশ্যে বের হতে চাই, তখন আহমাদ রহ. তাকে লক্ষ্য করে বললেন: তাহলে তুমি কাফেলার সাথে না গিয়ে একা একা বের হও। তখন সে বলল: না, বরং আমি তাদের সাথেই বের হব। তখন তিনি বললেন: তাহলো তো তুমি জনগণের ভাণ্ডারের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করেছ।”[18]

আর কোনো সন্দেহ নেই যে, এর কারণ হলো ‘তাওয়াক্কুল’-এর প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে ঐসব লোকজনের অজ্ঞতা ও মূর্খতা; আরও একটি কারণ হলো, তাদের ওপর ইবলিস শয়তানের আছর বা প্রভাব।

ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন,

«وقد لَبَّسَ إِبْلِيسُ على أقوامٍ يَدعُون التوكُّل؛ فخرجوا بِلاَ زادٍ، وظنُّوا أن هذا هو التوكُّلُ وهُم على غاية الخطأَ» .

“আর ইবলিস কর্তৃক প্রতারণার শিকার হয়েছে এমন কতগুলো গোষ্ঠী, যারা তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর ওপর ভরসা করার দাবি করে। ফলে তারা পাথেয় ছাড়া (হজের উদ্দেশ্যে) বের হয়ে যায়, আর বিশ্বাস করে যে, এটাই হলো ‘তাওয়াক্কুল’ অথচ তারা চরম ভুল ও বিভ্রান্তির মধ্যে ডুবে আছে”।[19]

ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. এর জবাব ও যুক্তি খণ্ডনের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যে ব্যক্তি পাথেয় ছাড়া হজ করবে, সে ব্যক্তি হবে জনগণের ওপর তাওয়াক্কুলকারী ও নির্ভরশীল, আর এ কথা বলা সঠিক হবে না যে, সে আল্লাহর ওপর ভরসাকারী।বস্তুত আল্লাহর তা‘আলার ওপর ভরসা করা হচ্ছে, মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, আর তা হলো উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা এবং সাথে আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া। ‘তাওয়াক্কুল’ মানে এমনটি নয় যেমনটি রূপরেখা পেশ করে ইবলিস তার অনুসারীদের জন্য।

>
[1] ইবন বাত্তাল, শরহু সহীহ আল-বুখারী: (৯/৪০৮)।

[2] ইবনুল কাইয়্যেম, যাদ আল-মা‘আদ: (৪/১৫)।

[3] ইবন রজব, ‘জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম’: (২/৪৯৭); আল-কারাফী, ‘আয-যাখীরা’: (১৩/২৪৭); ইবনুল কায়্যিম, ‘মাদারেজ আস-সালেকীন’: (৩/৫২৩)।

[4] ‘মাদারেজ আস-সালেকীন’: (৩/৫০০)।

[5] ইমামা তিরমিযী রহ. কিয়ামতের বর্ণনা প্রসঙ্গে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, বাব নং ৬০, হাদীস নং ৫৩৭, (৪/৬৬৮); ইবন হিব্বান, আস-সহীহ, হাদীস নং ২৫৪৯।

[6] ‘তাইসীরুল ‘আযীয আল-হামীদ ফী শরহি কিতাব আত-তাওহীদ’: (৪৯৮)।

[7] ‘মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল আশ-শাইখ ইবন ‘উসাইমীন’: (৬/৫৪)।

[8] ‘তাইসীরুল ‘আযীয আল-হামীদ ফী শরহি কিতাব আত-তাওহীদ’: (৪০)।

[9] ‘তাইসীরুল ‘আযীয আল-হামীদ ফী শরহি কিতাব আত-তাওহীদ’: (৪৯৮)।

[10] ‘আল-মুগনী’: (৫/৬)।

[11] ‘আল-মুগনী’: (৫/৮)।

[12] হাদীসটি ‘মারফু’ সনদে আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবন মাজাহ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৮৯৬; তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীস নং ৮১৩।

[13] ‘আল-মানহাজ লে-মুরীদ আল-হাজ ওয়াল ‘উমরা’: (পৃ. ১০৫)।

[14] ‘দেখুন: ‘তালবীসু ইবলিস’: (২/৮৩২); ‘আস-সুনান ওয়াল মুবতাদা‘আত আল-মুতা‘আল্লাকা বিল আযকার ওয়াস সালাওয়াত’: (পৃ. ১৫২); ‘মানাসিক আল-হাজ ওয়াল ‘উমরা’: (পৃ. ৪৬)।

[15] সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৪৫১; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ১৭৩০; নাসাঈ, ‘আস-সুনান আল-কুবরা’ (৮৭৩৯)।

[16] ‘জামে‘উল বায়ান ‘আন তা’বীল আয়িল কুরআন’: (২/২৭৮)।

[17] দেখুন: ‘আস-ছিকাত: (৮/২৬৯)।

[18] এ কাহিনীটি ইমাম আহমাদ রহ. থেকে ইবনুল জাওযী রহ. বর্ণনা করেছেন ‘তালবীসু ইবলিস’: (২/৮৩২) গ্রন্থে।

আর তিনি তা সনদসহ এর চেয়ে আরও পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করেছেন, তাঁর নিকট বর্ণনাটি এসেছে: (তাহলে তুমি কি একা একা মরুভূমিতে প্রবেশ করবে, নাকি জনগণের সাথে? জবাবে সে বলল: না, জনগণের সাথে প্রবেশ করব; তখন ইমাম আহমাদ রহ. বললেন: তুমি মিথ্যা বলছ; তুমি আল্লাহর ওপর ভরসাকারী নও; সুতরাং তুমি একা একা প্রবেশ কর, আর তা না হলে তুমি জনগণের ভাণ্ডারের ওপর ভরসাকারী) ‘আল-হাছ্ছু ‘আলাত তিজারাত ওয়াস সানা‘আত...’: (পৃ. ৯৪)।

[19] ‘তালবীসু ইবলিস’: (২/৮৩২); আর এ অদ্ভুত ‘তাওয়াক্কুল’-এর উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত দেখুন আল-কুশাইরীর ‘আর-রিসালা’ নামক গ্রন্থে: (পৃ. ১০৬-১০৮)।
দ্বিতীয় অধ্যায় - লোক দেখানোর জন্য ও সুনামের উদ্দেশ্যে হজ করা

‘রিয়া’ (الرياء) শব্দটি الرؤية (দেখা) শব্দ থেকে নির্গত, আর তার মানে হলো: মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদতকে প্রকাশ করা, ফলে তারা ইবাদত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রশংসা করে।[1]

‘রিয়া’ ও ‘সুম‘আ’ -এর মধ্যে পার্থক্য:

‘রিয়া’ হলো জনগণকে দেখানোর জন্য আমল করা, আর ‘সুম‘আ’ হলো তাদেরকে শুনানোর জন্য আমল করা। সুতরাং ‘রিয়া’ -এর সম্পর্ক দৃষ্টিশক্তির অনুভূতির সাথে; আর সুম‘আ’ -এর সম্পর্ক হলো শ্রবণশক্তির অনুভূতির সাথে। আর তার মধ্যে শামিল হবে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার আমলকে গোপন করা, অতঃপর তা জনগণের নিকট বর্ণনা বা প্রচার করা। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো আমল করা থেকে সতর্ক করেছেন; নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللَّهُ بِهِ

“যে ব্যক্তি স্বীয় খ্যাতি অর্জনের চিন্তায় ইবাদত করবে, আল্লাহ তার বিনিময়ে জনমনে তার আসল চেহারা উন্মোচন করে দেবেন; আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করবে, আল্লাহ তার বিনিময়ে জনগণকে তার প্রকৃত অবস্থা দেখিয়ে দেবেন।”[2]

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,

«إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ، قَالُوا : وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ : الرِّيَاءُ، يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ : إِذَا جَازَى النَّاسَ بِأَعْمَالِهِمْ : اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا، فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ مِنْ جَزَاءٍ ؟»

“আমি তোমাদের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে ভয় করি, তন্মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টি হলো ‘ছোট্ট শির্ক’। সহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! ‘ছোট্ট শির্ক’ কী? জবাবে তিনি বললেন: লোক দেখানো আমল। কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান দিবেন, তখন তিনি এ জাতীয় লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বলবেন: তোমরা ঐসব লোকের কাছে যাও, যাদেরকে দেখানোর জন্য তোমরা দুনিয়াতে আমল করতে; তারপর দেখ- তাদের নিকট তোমরা কোনো প্রতিদান পাও কিনা?।”[3]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো‘আ করেছেন, যাতে তিনি তাঁর হজকে একান্তভাবে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট করে নেন, লোক দেখানো ও সুখ্যাতি অর্জনের কারণ না বানান; আর সে দো‘আর একটি হলো:

«اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا حَجَّةً غَيْرَ رِيَاءٍ وَلاَ مُهابَةٍ وَلاَ سُمْعَةٍ» .

“হে আল্লাহ! আপনি এটাকে এমন হজে পরিণত করুন, যাতে (আপনার উদ্দেশ্য ছাড়া) কোনো রকম ‘রিয়া’ (প্রদর্শনী), প্রতিপত্তি ও সুনামের উদ্দেশ্য না থাকে।”[4]

আর এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, হজের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় লোক দেখানোর জন্য, তাহলে হজটি বাতিল বলে গণ্য হবে; আর হজের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, তারপর হঠাৎ করে তার ওপর ‘রিয়া’ বা লোক দেখানোর নিয়ত এসে আপতিত হয়, অতঃপর তা যদি মনে মনে থাকে এবং তা মন থেকে দূর করে দেয়, তাহলে তা তার জন্য ক্ষতিকর হবে না; আর যদি সে লোক দেখানোর নিয়তটি তার সাথে স্থায়ী হয়ে পড়ে, তাহলে তা তার পুরো হজটাকে নষ্ট করে ফেলবে। কারণ, হজ এমন ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, যার শেষটা প্রথম অংশের সাথে সংযুক্ত।[5]

বস্তুত হজ হলো একসাথে আর্থিক ও শারীরিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত একটি ইবাদত, আর মুসলিমগণকে তা পালন করার সময় অনেক কষ্ট ও ক্লান্তির শিকার হতে হয়; কিন্তু তারা এসব কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করেন আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের আশায় ও তাঁর জান্নাত পাওয়ার দাবিতে।

আর যে জিনিসটি তাদেরকে এসব কষ্ট ও ক্লান্তিকে ভুলিয়ে রাখে, তা হলো নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে বর্ণিত ঐসব হাদীস, যা হজের ফযীলত ও হাজী সাহেবের সাওয়াব প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।

আর এসব হাদীসের মধ্য থেকে অন্যতম একটি হলো, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, যেখানে তিনি বলেছেন:

«الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا, والْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ»

“এক উমরা থেকে আরেক উমরা- উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের জন্য কাফ্ফারা, আর মাকবূল (কবুল) হজের একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত।”[6]

কিন্তু সেখানে কোনো কোনো হাজী সাহেবকে দেখা যায়- তারা হজের নিয়ত করেন এবং কতবার হজ করেছেন তাকে সংখ্যায় প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, আর তাদের কেউ কেউ চিন্তা করেন হজ থেকে ফিরে আসার সময় তাকে বলা হবে: ‘আল-হজ অমুক’। আবার কেউ চিন্তা করেন: সে যখন কোনো মাজলিসে কথা বলবে, তখন সে বলবে: ‘আমি সাতবার হজ করেছি’ অথবা সে বলবে: ‘আমি ‘আরাফাতে পনের বার অবস্থান করেছি’।

ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন, ‘হাজীগণের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যিনি চান- সাক্ষাতের সময় তাকে ‘আলহাজ্জ’ বলা হবে। আর হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমনকারীগণের মধ্য থেকে এমন অনেক আছেন, যার চিন্তা হলো তার হজের সংখ্যাতথ্য প্রকাশ করা, ফলে তিনি বলেন, ‘আমি আরাফার ময়দানে বিশ বার অবস্থান করেছি’।[7] আর অনেক আশ্রয়দানকারী আছেন, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে মক্কায় অবস্থান করছেন, অথচ তিনি এখনও তার ভিতরকে পবিত্র করার কাজটি শুরু করেন নি, আর কখনও কখনও তার চিন্তার সম্পর্ক থাকে এমন সব অবদানের সাথে, যে অবদান তিনি তার কাছে থাকা কারও জন্য রেখেছেন। আবার কখনও কখনও তিনি বলেন, আশ্রয়দানকারী ও সেবক হিসেবে আজকে আমার বিশ বছর পূর্ণ হলো। আর একটা গোষ্ঠীর ওপর শয়তান ভর করেছে, তাদের কেউ কেউ হজ আদায়ের পদ্ধতির মধ্যে এমন কিছু নতুন বিষয় চালু করেছে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে আমি একদল লোককে দেখি- তারা তাদের ইহরামের মধ্যে কৃত্রিম ভান করে, যার ফলে তারা একটি কাঁধকে খোলা রাখে এবং কয়েক দিন এভাবে সূর্যের তাপের মধ্যে অবস্থান করে, তারপর তাদের চামড়া খসে পড়ে এবং তাদের মাথা ফুলে যায়, আর এর দ্বারা মানুষের মাঝে নিজের ভাব বা সৌন্দর্য প্রকাশ করে’।[8] আর এ ধরণের আকীদা পরিপন্থী কাজ এ যুগের মানুষের মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে।

>
[1] ‘ফাতহুল বারী বি-শরহে ‘সহীহ আল-বুখারী’: (১১/৩৪৪); ‘ই‘লামুল মূওয়াক্কি‘ঈন’: (২/১৭০) তাফসীরে কুরতুবী: (২০/১২); আশ-শাতেবী, ‘আল-ই‘তিসাম’: (২/৩১২)।

[2] সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ৬৪৯৯; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ২৯৮৬)।

[3] আহমাদ, আল-মুসনাদ: (২৩১৯)

[4] বায়হাকী, আস-সুনান (৪/৩৩২, ৩৩৩), কিতাবুল হজ।

[5] ‘জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম’: (১/৮১-৮৪); ‘তাইসীরুল ‘আযীয আল-হামীদ ফী শরহি কিতাব আত-তাওহীদ’: (পৃ. ৫৩০-৫৩৪)।

[6] হাদীসটি ‘মারফু’ সনদে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৬৮৩; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৩৪৯; ইবন মাজাহ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৮৮৮; তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীস নং ৯৩৩; নাসাঈ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৬২৮।

আর হজের ফযীলত সম্পর্কে একগুচ্ছ হাদীস দেখুন: আত-তারগীব ওয়া আত-তারহীব: (২/১৬২-১৮৩); ‘মাজমা‘উ আয-যাওয়ায়েদ’: (৩/২০৬-২১০); ‘ইতহাফ আল-খায়রাত’: (৩/১৩৮-১৪১); ‘আল-মাতালেব আল-‘আলীয়া’: (৬/২৬২-২৯০)।

[7] অর্থাৎ আমি বিশবার হজ করেছি।

[8] ‘তালবীসু ইবলিস’: (২/৮৩০-৮৩১) সংক্ষেপ করে উদ্ধৃত; আরও দেখুন: ‘আস-সুনান ওয়াল মুবতাদা‘আত আল-মুতা‘আল্লাকা বিল আযকার ওয়াস সালাওয়াত’: (পৃ. ১৫১-১৫২)।
তৃতীয় অধ্যায় - তাবিজ বা মাদুলি নিয়ে কোনো কোনো হজ পালনকারীর আগমন*

তাবিজ হলো: “এমন কতগুলো পুঁতি বা গুটিকা, যা লোকেরা তাদের সন্তানদের শরীরের ঝুলিয়ে রাখত, যাতে তার দ্বারা তারা নজর লাগা থেকে বাঁচতে পারে।”[1]

আর তাবিজ-কবচ ও অনুরূপ কিছু ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টি এক প্রকারের মহামারী, যা ব্যাপকভাবে অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রে প্রচলিত, আর তা ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এ বিষয়টি চতুষ্পদ জন্তু ও যানবাহন পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে, আর এ বিষয়টি একেবারে দৃশ্যমান একটি বিষয়। আর এটাকে ‘তাওহীদ’ তথা আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা বলে গণ্য করা হয়, যে তাওহীদসহ আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। অনুরূপভাবে তাওহীদের বিপরীত শির্কের ব্যাপারে মানুষের অজ্ঞতাও এ ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছে।[2]

আর তাবিজ-কবচ এর বিষয় নিয়ে আলোচনাটি কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে হতে পারে:

তাবিজের মধ্যে যা কিছু লেখা হয়, সেসব দিক বিবেচনায় তা কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে:

প্রথম প্রকার: এমন সব তাবিজ, যাতে কুরআনের আয়াত ও হাদীসে নববী লিপিবদ্ধ করা হয়।

দ্বিতীয় প্রকার: এমন সব তাবিজ, যাতে সুনির্দিষ্ট কোনো বাক্য লিপিবদ্ধ করা হয়; আর তাতে সুস্পষ্ট শির্কী কথা লেখা থাকে।

তন্মধ্যে প্রথম প্রকারের তাবিজের বিষয়টি নিয়ে আলিম সমাজের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তবে বিশুদ্ধ মতে তা হারাম; কারণ হারামের উপায় ও উপলক্ষ্য বন্ধ করা জরুরী। আর যেসব আলিম তাকে বৈধ বলেছেন, তারাও কারও ওপর বালা-মুসিবত নাযিলের পরে এ ধরনের তাবিজ ব্যবহার করার শর্ত করেছেন, তার পূর্বে নয়।[3]

আর দ্বিতীয় প্রকার তাবিজ-কবচ হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করার অন্তর্ভুক্ত।

আর তাবিজের সাথে মানুষের অন্তর সম্পৃক্ত হওয়ার বিবেচনায় তা দু’ভাগে বিভক্ত:

প্রথম প্রকার: যিনি তাকে উপকার লাভ বা ক্ষতি নিরোধের কারণ হিসেবে গ্রহণ করেন, আর তিনি জানেন যে, তা প্রকৃতপক্ষে কোনো উপকারও করতে পারে না এবং কোনো ক্ষতিও করতে পারে না; এ অবস্থায় তা ‘ছোট্ট শির্ক’ বলে বিবেচিত হবে।

দ্বিতীয় প্রকার: যিনি তাকে গ্রহণ করেন এমন আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে- যে, তাতে উপকার ও অপকার নিহিত রয়েছে; সে মনে করে যে এ তাবিজ তার থেকে অকল্যাণ দূর করতে পারে এবং তার জন্য কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে; এ অবস্থায় এটা (না‘উযু বিল্লাহ) এমন বড় শির্ক হিসেবে গণ্য হবে যা ব্যক্তিকে দীনের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়।

আর এ অধ্যায়ে আমার আলোচনাটি তাবিজ-কবচের প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় প্রকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

আর এ অধ্যায়ের মধ্যে আমি তাকে আকীদাগত বিরোধের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেছি, তা বহনকারীর অবস্থার দিকে লক্ষ্য না করেই, তারা কি সেটার জ্ঞান রাখে নাকি সেটা সম্পর্কে অজ্ঞ সেটার কথা বিবেচনায় না এনেই। কারণ, মুসলিমগণের কেউ কেউ বেড়ে উঠেছেন এমন সব স্থানে, যেখানে অজ্ঞতা ও মূর্খতা ছড়িয়ে গেছে এবং সঠিক জ্ঞান হারিয়ে গেছে, আর ‘অজ্ঞতার কারণে ক্ষমা’ ও এতদসংক্রান্ত মাসয়ালা নিয়ে ‘ইলম’ বিষয়ক গ্রন্থসমূহে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে।[4]

বস্তুত তাবিজ-কবচের বিষয়টি অনেক আগ থেকেই পরিচিত বিষয়; বরং তা জাহেলি যুগের কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। আর এ কারণে তা তাওহীদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে এবং তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরকে তা দোদুল্যমান রাখে, আর তাকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়তে বিরত রাখে। ইসলাম তাবিজের ব্যাপারে সতর্কবার্তা নিয়ে এসেছে; এ প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, আর এর মধ্যে কিছু হাদীস নিম্নরূপ:

১. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إن الرُّقَى والتَّمَائِمَ والتِّوَلَةَ شِرْك»

“নিশ্চয় ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবচ ও বশীকরণ বিদ্যা শির্ক।”[5]

২. ‘উকবা ইবন ‘আমের আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْبَلَ إِلَيْهِ رَهْطٌ، فَبَايَعَ تِسْعَةً، وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ، فَقَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ! بَايَعْتَ تِسْعَةً، وَتَرَكْتَ هَذَا ؟ قَالَ : «إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيمَةً»، فَأَدْخَلَ يَدَهُ فَقَطَعَهَا، فَبَايَعَهُ، وَقَالَ : « مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ».

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একটি দল আগমন করল। অতঃপর তিনি নয় জনের বাই‘আত তথা (আনুগত্যের) শপথ গ্রহণ করলেন; কিন্তু একজনকে বাই‘আত করানো থেকে বিরত থাকলেন। উপস্থিত সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নয় জনকে শপথ করালেন, আর একে বাদ দিলেন? জবাবে তিনি বললেন: ‘তার সাথে তাবিজ রয়েছে’। অতঃপর তিনি তাঁর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তা কেটে ফেললেন এবং তাকে বাই‘আত করালেন অতঃপর বললেন: ‘যে ব্যক্তি তাবিজ লটকালো, সে শির্ক করল।”[6] সুতরাং এসব হাদীসের মধ্যে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে, বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসের অন্যতম একটি বিপরীত কাজ হলো হাজীগণ কর্তৃক তাবিজ-কবচ ও অনুরূপ কোনো কিছু ব্যবহার করে মক্কায় আগমন করা।

[*] দেখুন: ‘শরহু মা‘আনিল আছার’: (৪/৩২৪-৩২৯); আত-তামহীদ: (১৭/১৬০-১৬৫); আল-বায়ান ওয়া আত-তাহসীল: (১/৪৩৮-৪৪০); আল-জামে‘ লি আহকামিল কুরআন: (১০/৩১৬-৩২০); যাদ আল-মা‘আদ: (৪/১৪৯ ও তার পর) এবং (৪/৩২৬-৩২৯); আল-আদাব আশ-শর‘ইয়্যা: (২/৪৪০-৪৪৪); মা‘আরিজুল কবুল: (২/৫১০-৫১২); আল-ইবদা‘উ ফী মাদারিল ইবতিদা‘য়ে: (পৃ. ৪২৪-৪৩৭); ফাতাওয়া ইবন ইবরাহীম: (১/৯৫-৯৯); সিলসিলাতুল আহাদীস আস-সাহীহা: (১/৩৪৪-৩৪৫), (১/৬৪৯-৬৫০), (১/৮৪৩-৮৪৪) ও (১/৮৮৯-৮৯১); আহকামুর রুকা ওয়াত তামায়েম: (পৃ. ২০১) এবং তার পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহ।
---------------------

[1] ‘আত-তা‘রিফাত আল-ই‘তিকাদিয়্যা’: (পৃ. ১২১)।

[2] দেখুন: ‘আহকামুর রুকা ওয়াত তামায়েম’: (পৃ. ২২৯)।

[3] দেখুন: আত-তামহীদ: (১৭/১৬০); আল-জামে‘ লি আহকামিল কুরআন: (১০/৩১৯); আর তাঁদের প্রত্যেকই ইবন আবদিল বার্র ও কুরতুবী রহ.-এর সূত্রে বক্তব্য দিয়েছেন যে, এ শর্তটি একদল আলেম সমাজের। আরও দেখুন: ‘শরহু মা‘আনিল আছার’: (৪/৩২৫); আল-বায়ান ওয়া আত-তাহসীল: (১/৪৩৯); যাদ আল-মা‘আদ: (৪/৩২৭); আহকামুর রুকা ওয়াত তামায়েম: (পৃ. ২৪৫) ।

[4] আর এ মাসয়ালাটি স্বতন্ত্রভাবে কয়েকটি গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম একটি গ্রন্থ হলো ড. আবদুর রাযযাক ইবন তাহেরের ‘আল-জাহলু বে-মাসায়েল আল-ই‘তিকাদ ওয়া হুকমুহু’ ।

[5] হাদীসটি যয়নব আছ-ছাকাফিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি তার স্বামী আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন; আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ৩৬১৫; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ৩৮৮৩; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৫৩০।

[6] আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ১৭৪২২ এবং হাদীসের শব্দগুলো তার; ত্ববারানী, আল-মু‘জাম আল-কাবীর (৮৮৫), (১৭/৩১৯-৩২০); হাকেম, আল-মুস্তাদরাক (৪/২১৯)।

চতুর্থ অধ্যায় - শির্ক মিশ্রিত অযীফা নিয়ে কোনো কোনো হজ পালনকারীর আগমন

সহীহ আকীদা-বিশ্বাসের ঘোর বিরোধী অন্যতম একটি কাজ হলো কিছু সংখ্যক হাজী সাহেব কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদের ঘোষণা দেওয়ার জন্য ‘মক্কা’-য় আগমন করে এমতাবস্থায় যে, তারা তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, ফলে আমরা তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিকে দেখতে পাই, যিনি হজ করার জন্য আসেন বিশেষ কতগুলো (বানানো) দো‘আ নিয়ে, যা লেখা থাকে কতগুলো পাতার উপর, যা তারা অধিক হারে ব্যবহার করে, তার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা, আবেদন ও নিবেদন। যেমন, তাদের কেউ কেউ দো‘আ করে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট, অথবা হাসান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট অথবা শি‘আদের বারো ইমামের নিকট।[1]
আর এসব গ্রন্থে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে যেসব দো‘আ ও সাহায্য প্রার্থনা করা হয়, তার বর্ণনা খুব শীঘ্রই সামনের অধ্যায়ে আসছে এবং সেখানে তাদের যুক্তিও খণ্ডন করা হয়েছে।

>
[1] দেখুন: ‘আব্বাস আল-কুম্মী’র ‘মাফাতীহুল জিনান’, আর তা এমন এক তথ্যভাণ্ডার, যাতে শি‘য়াদের দো‘আ ও যিকির রয়েছে এবং যা ভরপুর শির্ক মিশ্রিত দো‘আ ও ফরীয়াদ দ্বারা; ‘মাযাহেরুল ইনহিরাফাত আল-‘আকদিয়্যা ‘ইন্দাস সূফিয়্যা’: (২/৭২৯-৭৫২)।
প্রথম অধ্যায় - কোনো কোনো হজ পালনকারী কর্তৃক আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট দো‘আ ও সাহায্য প্রার্থনা করা এবং শির্ক মিশ্রিত অযীফা বা দো‘আর ওপর নির্ভর করা

মানুষ যেসব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, বিশেষকরে হাজী সাহেবগণ, তন্মধ্যে উপরোক্ত কাজসমূহ খুবই মারাত্মক ও বিপজ্জনক। বিশেষ করে যখন তা সংঘটিত হয়ে থাকে হারামাইন শরীফাইন ও হজের পবিত্র স্থানসমূহে; চাই তা হউক তাদের হজের কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত কোনো পাঠ এবং তাদের সাথে বহন করা তাদের শির্ক মিশ্রিত দো‘আ বা অযীফাসমূহ, যেমনটি পূর্বের অধ্যায়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে, অথবা হউক এগুলো ছাড়া এ জাতীয় অন্য কোনো দো‘আ; কারণ, তা বড় শির্কের অন্তর্ভুক্ত, কারণ তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দীন ইসলাম থেকে খারিজ (বহিষ্কার) করে দেয়।

বস্তুত দো‘আ দুই প্রকার: ইবাদত হিসেবে দো‘আ এবং চাওয়া-পাওয়ার জন্য দো‘আ।

কুরআনে কারীমে দো‘আ দ্বারা কখনও এটাকে বুঝানো হয়েছে, আবার কখনো ঐটাকে বুঝানো হয়েছে। আর তার (দো‘আ) উভয় প্রকারকেই বুঝানো হয়।

সুতরাং চাওয়া-পাওয়ার জন্য দো‘আ (دعاء المسألة) মানে: এমন কিছু তলব করা, যা দা‘ঈ বা প্রার্থনাকারী ব্যক্তির কাজে লাগবে- উপকার লাভের মাধ্যমে হোক অথবা ক্ষতি দূরিকরণের মাধ্যমে হোক, আর এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তির নিন্দা বা সমালোচনা করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কারো কাছে প্রার্থনা করে, যে নাকি কোনো ক্ষতি ও উপকার করার ক্ষমতা রাখে না। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلۡ أَتَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَمۡلِكُ لَكُمۡ ضَرّٗا وَلَا نَفۡعٗاۚ وَٱللَّهُ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٧٦﴾ [المائ‍دة: ٧٦]

“বলুন, তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদাত কর, যার কোনো ক্ষমতা নেই তোমাদের ক্ষতি বা উপকার করার? আর আল্লাহ্ তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ৭৬]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَلَا تَدۡعُ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَنفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَۖ فَإِن فَعَلۡتَ فَإِنَّكَ إِذٗا مِّنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٠٦﴾ [يونس: ١٠٦]

“আর আপনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকবেন না, যা আপনার উপকারও করে না, অপকারও করে না। কারণ, এটা করলে তখন আপনি অবশ্যই যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” [সূরা ইউনূস, আয়াত: ১০৬]

আর ‘ইস্তিগাছা’ (الاستغاثة) মানে: উদ্ধার কামনা করা; আর তা (সাহায্য) হলো কষ্ট বা অসুবিধা দূর করার জন্য কারও দ্বারস্থ হওয়া।[1]

আর উভয় বিষয়, অর্থাৎ মৃত ব্যক্তি অথবা কোনো সৃষ্টির কাছে এমন কোনো ব্যাপারে দো‘আ ও সাহায্যের আবেদন করা, যে ব্যাপারে সাহায্য করার ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নেই, তা বড় শির্ক -এর অন্তর্ভুক্ত, যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দীন ইসলাম থেকে খারিজ (বহিষ্কার) করে দেয়।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, “শরী‘আত নিষিদ্ধ ‘ইস্তিগাছা’ বা বিপদে সাহায্যের ফরিয়াদ দুই প্রকার:

প্রথম প্রকার: প্রত্যেক ব্যাপারে সাধারণভাবে মৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা।

দ্বিতীয় প্রকার: সৃষ্টির কাছে এমন কোনো ব্যাপারে সাহায্যের আবেদন করা, যে ব্যাপারে স্রষ্টা ব্যতীত সাহায্য করার ক্ষমতা অন্য কারও নেই। সুতরাং কারও জন্য কোনো অধিকার নেই আল্লাহ ছাড়া অন্যের নিকট এমন কিছু চাওয়া, যা দেওয়ার ক্ষমতা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নেই, সে চাওয়াটা নবীর কাছেও নয় এবং অন্যের কাছেও নয়, আর কোনো সৃষ্টির নিকট সাহায্যের ফরিয়াদ করবে না এমন কোনো বিষয়ে, যে ব্যাপারে স্রষ্টা ব্যতীত সাহায্য করার ক্ষমতা অন্য কারও নেই। আর কারও জন্য কোনো অধিকার নেই মৃত ব্যক্তির নিকট কোনো কিছুর ব্যাপারে আবেদন করা অথবা তার কাছে কোনো বিষয়ে সাহায্যের ফরিয়াদ করা, চাই তিনি নবী হউন অথবা অন্য কেউ”।[2] আর এ জাতীয় কবীরা গুনাহ, এমনকি দীন থেকে খারিজ করে দেওয়ার মত এ শির্কের ভয়াবহতা সত্ত্বেও হজের উদ্দেশ্যে সম্মানিত বাইতুল্লাহতে গমনে ইচ্ছুকদের কারও কারও নিকট থেকে তাদের হজের কর্মসূচীতে এমন সব অযীফা, দো‘আ ও যিকিরের ওপর নির্ভর করতে দেখা যায়, যাতে নবীগণ ও সৎব্যক্তিবর্গের মতো সম্মানিত ব্যক্তিগণের নিকট দো‘আ ও সাহায্য প্রার্থনা করার মত বিষয় রয়েছে, বিশেষ করে যে ব্যক্তির সাথে শি‘আ ও সুফী সম্প্রদায়ের সম্পর্ক রয়েছে, তাদের এমন সব দো‘আ ও ফরিয়াদ রয়েছে, যার সবগুলোই মহান আল্লাহর সাথে শির্কের নামান্তর। কারণ, তার কিছু অংশের মধ্যে রয়েছে ইমাম ও সৎকর্মশীল শাইখগণের নিকট এমন সব প্রয়োজন পূরণের আবেদন, যা পূরণের ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারও নেই। যেমন, উপকার লাভ ও ক্ষতি দূর করার আবেদন, রোগমুক্ত করার আবেদন, রিযিক বৃদ্ধির আবেদন এবং সমস্যা ও অসুবিধা দূর করার আবেদন ইত্যাদি। আর এ কথা সবার জানা যে, এ বিষয়গুলো আরও বেশি প্রকট আকার ধারণ করে বিশেষ কোনো সময় ও স্থানে, যেমন, সম্মানিত হজের মাসে এবং মক্কার হারাম বা ক্যাম্পাসে (আল্লাহ তাকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করুন)।[3]

>
[1] দেখুন: ‘ফাতহুল মাজীদ’’: (পৃ. ১৭০-১৭১)।

[2] ‘আল-ইসতিগাছাতু ওয়ার রাদ্দু ‘আলাল বাকরী’: (১/৩৫৯-৩৬০)। ‘শিফা আস-সুদুর ফী যিয়ারাত আল-মাশাহেদ ওয়াল কুবূর’: (১২৩-১৩৭)।

[3] দেখুন: ‘আদ-দো‘আ ওয়া মানযিলাতুহু ফিল ‘আকীদা আল-ইসলামিয়্যা’: (২/৫১৭-৫২৭); ‘উসূলু মাযহাব আশ-শী‘আ’: (২/৪৪১-৪৫৩), (৩/১১৪৪-১১৪৮); ‘মাযাহেরুল ইনহিরাফাত আল-‘আকদিয়্যা ‘ইন্দাস্ সূফিয়্যা’: (১/১৪৮ -১৭২, ৪২৪-৪৪৫)।
দ্বিতীয় অধ্যায় - কা‘বার গেলাফ ও দৃশ্যমান পাথরসমূহ স্পর্শ করার দ্বারা স্বীয় শরীর মোছা

কা‘বা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ঘর, আর তা হচ্ছে দুনিয়ার মধ্যকার সর্বশ্রেষ্ঠ ঘর, আল্লাহ তা‘আলা তাকে মর্যাদাবান ও সম্মানিত করেছেন তা নির্মিত হওয়ার দিন থেকেই। আর মুসলিমগণের মনে-প্রাণে পৃথিবীর সকল আশা-আকাঙ্খার মধ্যে সবচেয়ে তীব্র আকাঙ্খা ও কামনা হলো তাকে দেখা।

কিন্তু কোনো বস্তুর প্রতি আমাদের ঝোঁক ও ভালোবাসাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ‘কুরআন’ ও ‘সুন্নাহ’-এর মানদণ্ডে, যাতে কোনো রকম অতিরঞ্জন ও অবহেলার আশঙ্কা না থাকে।

একদল লোক অনেক বেশি অতিরঞ্জন করে ফেলেছে, ফলে তারা ‘কাবা’-এর ব্যাপারে অনেক বেশি বাড়াবাড়ি করে; যার কারণে আমরা তাদেরকে তার গেলাফ ও দৃশ্যমান পাথরসমূহকে স্পর্শ করে স্বীয় শরীর মাসেহ করতে দেখি, তারা এ কাজটি করে বরকত হাসিলের আশায় এবং কল্যাণের ধারায় সিক্ত হওয়ার জন্য।[1]

এমনকি হাজীদের অজ্ঞতার কারণে বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা এমন কিছু ছেঁড়া-কাটা কাপড়ের টুকরা নিয়ে মক্কায় আগমন করে, যা তারা তাদের দেশের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে এবং তারা তাদেরকে শক্তভাবে বলে দিয়েছে যে, তারা যেন তা ‘কা‘বা’ ঘরের দেওয়ালের সাথে স্পর্শ করে, অতঃপর তাদের নিকট তা হাযির করে দেয়।[2]

আর এ কাজটি নিঃসন্দেহে দলীল-প্রমাণবিহীন উদ্ভাবিত এক নতুন বিদ‘আত। কারণ, এ কাজের পক্ষে কোনো দলীল বর্ণিত হয়নি; আর ‘কা‘বা’ ঘরের পাথর ও গেলাফের আলাদা কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হয়নি; আর যদি এ কাজটির মধ্যে কোনো বিশেষ কল্যাণ থাকতো, তাহলে আমাদের পূর্বে সাহাবীগণ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তার দিকে এগিয়ে যেতেন।

এ সব কিছু হলো (বিদ‘আত), যদি এ কাজের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিশ্বাস না করে যে, এসব পাথর ও গেলাফের নিজস্ব কোনো প্রভাব রয়েছে, কিন্তু যদি সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া এসব পাথর ও গেলাফ উপকার ও ক্ষতি করতে পারে, তার কাজটি আল্লাহর নিকট পৌঁছিয়ে দিতে পারে অথবা ‘কা‘বা’ তার জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে, তাহলে নিশ্চিত সে আল্লাহর সাথে শির্ক করলো- একেবারে বড় ধরণের শির্ক, যা তাকে দীন থেকে খারিজ (বহিষ্কার) করে দেবে (না‘উযুবিল্লাহ)।

আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম রহ. বর্ণনা করেন: “বরকত লাভের আশায় ‘মাসজিদে হারাম’-এর সীমানা প্রাচীর অথবা ‘কা‘বা ঘর’ অথবা ‘মাকামে ইবরাহীম’ ইত্যাদি স্পর্শ করাটা বড় শির্ক -এর উপলক্ষসমূহের অন্যতম একটি উপলক্ষ বলে বিবেচিত হবে, বরং তা ছোট শির্ক তো বটেই)।[3]

আর এ অধ্যায়টি আমি শেষ করব আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ‘উসাইমীন রহ. এর দু’টি ফতোয়ার উদ্ধৃতি দেওয়ার মাধ্যমে; আর এ ফতোয়া দু’টি হলো এ বিষয়ে তাঁর নিকট উত্থাপিত দু’টি প্রশ্নের দু’টি জবাব।

[প্রথম ফতোয়া]: প্রশ্নের ভাষ্য:

তাওয়াফের মধ্যে কোনো কোনো মানুষকে কা‘বার দেওয়াল ও গেলাফ, মাকামে ইবরাহীম ও সাধারণ পাথর স্পর্শ করতে দেখা যায়; সুতরাং এ জাতীয় আমল বা কাজের বিধান কী হবে?

উত্তর: “মানুষ এ জাতীয় কাজ করে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল ও তাঁর ইবাদত করার উদ্দেশ্যে; আর এমন প্রতিটি আমল, যা আপনি আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল ও তাঁর ইবাদত করার উদ্দেশ্যে করবেন, অথচ তার সমর্থনে শরী‘আতের কোনো দলীল বা ভিত্তি নেই; তাহলে সে কাজটি বিদ‘আত বলে গণ্য হবে, যার থেকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক ও সাবধান করে বলেছেন:

«إِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ ؛ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ » .

“তোমরা দীনের মধ্যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা থেকে দূরে থাকবে। কারণ, প্রত্যেকটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।”[4]

আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এমন কোনো হাদীস বর্ণিত হয়নি যে, তিনি ‘আল-হাজার আল-আসওয়াদ’ (الحجر الأسود) ও ‘আর-রুকন আল-ইয়ামানী (الركن اليماني) ছাড়া অন্য কোনো কিছু স্পর্শ করেছেন।

আর তার ওপর ভিত্তি করে মানুষ যখন ‘আল-হাজার আল-আসওয়াদ’ (الحجر الأسود) ও ‘আর-রুকন আল-ইয়ামানী (الركن اليماني) ব্যতীত কা‘বার যে কোনো রুকন অথবা পার্শ্ব স্পর্শ করবে, তখন সে বিদ‘আতকারী বলে বিবেচিত হবে।

তাছাড়া আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা যখন মু‘আবিয়া ইবন আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে কা‘বার উত্তরের রুকনদ্বয়কে স্পর্শ করতে দেখলেন, তখন তিনি তাকে নিষেধ করলেন; তারপর মু‘য়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন: বায়তুল্লাহর কোনো কিছুই তো ফেলনা নয়। জবাবে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন আল্লাহর বাণীর কথা:

﴿لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ﴾ [الاحزاب: ٢١]

“অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১] আর আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘ইমানিয়্যাইন রুকনদ্বয়’ (الركنين اليمانيين) তথা ‘রুকনে ইয়ামানী’ ও ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে স্পর্শ করতে দেখেছি, তারপর মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার কথার দিকে ফিরে আসলেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ لَّقَدۡ كَانَ لَكُمۡ فِي رَسُولِ ٱللَّهِ أُسۡوَةٌ حَسَنَةٞ﴾ [الاحزاب: ٢١]

“অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম আদর্শ।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ২১]

আর কোনো কোনো মানুষ কর্তৃক ‘মাকামে ইবরাহীম’-কে স্পর্শ করার মত কাজটি তো আরও উত্তমভাবেই বিদ‘আত বলে গণ্য হবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ জাতীয় কোনো কিছু বর্ণিত হয় নি যে, তিনি ‘মাকামে ইবরাহীম’-এর কোনো অঞ্চল স্পর্শ করেছেন, আর অনুরূপভাবে একই বিধান প্রযোজ্য হবে ‘যমযম কূপ’ স্পর্শ করা এবং কা‘বার বারান্দা বা উন্মুক্ত গ্যালারীর খুঁটিগুলো স্পর্শ করার ব্যাপারে।

আর এমন প্রত্যেক কাজই বিদ‘আত বলে গণ্য হবে, যা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্ণিত পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত নয়, আর প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা ও বিপথগামীতা বলে বিবেচিত”।[5]

[দ্বিতীয় ফতোয়া]: প্রশ্নের ভাষ্য:

যারা কা‘বা’র গেলাফ স্পর্শ করে এবং লম্বা দো‘আ করে, তাদের বিধান কী হবে?

উত্তর: “ঐ সব ব্যক্তিবর্গের কর্মকাণ্ডেরও সুন্নাতসম্মত কোনো ভিত্তি নেই এবং তা বিদ‘আত হিসেবে গণ্য, জ্ঞান পিপাসুদের জন্য আবশ্যক হলো তাদেরকে এ বিষয়টি পরিষ্কার করে দেওয়া এবং এ কথা বলে দেওয়া যে, এটা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াত ও নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত নয়”।[6]

আর পাথরসমূহকে সম্মান করতে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, আর স্পর্শ করার ব্যাপারে কোনো দলীল বর্ণিত হয় নি, আর যদি তাকে কোনো কল্যাণ থাকতো, তাহলে সাহাবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম তা করতেন।

এ অধ্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আরও দু’টি মাসআলা রয়েছে:

প্রথম মাসআলা: কা‘বা’র (আল্লাহ তাঁর মর্যাদা বাড়িয়ে দিন) গেলাফ খুলে ফেলার পর তার দ্বারা জনগণ কর্তৃক বরকত হাসিল করা: শাইখ মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম কা‘বা’র গেলাফ দ্বারা বরকত অর্জন করার বিষয়টিকে হারাম বলে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর ফতোয়ার সারকথা হলো এই:

১. যাবতীয় দলীল ও প্রাচীন আসারসূহ প্রমাণ করে যে, কা‘বার পুরাতন গেলাফ খুলে ফেলা হয় এবং তা মক্কাবাসীর মাঝে বণ্টন করে দেওয়া হয় পোশাক বা এ জাতীয় কোনো কিছু বানানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য, আর তা খুলে ফেলার পর তার জন্য পবিত্রতা ও গৌরবের কোনো কিছু নেই এবং তার দ্বারা বরকত হাসিলেরও কোনো ব্যাপার নেই, আর আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার উপস্থিতিতে তা খুলে ফেলা হলো এবং তা বণ্টন করে দেওয়া হল, অথচ তিনি তার প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেন নি।[7]

২. পূর্ববর্তী সৎব্যক্তিগণের কোনো একজন ব্যক্তিও কা‘বার পুরাতন গেলাফের দ্বারা বরকত অর্জনের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন নি।

৩. আর যারা তা বণ্টনের দায়িত্ব পালন করেন, তারা শুধু তার দ্বারা অভাবীগণের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য এটা করে থাকেন।

৪. পরবর্তী যুগে তার টুকরাগুলো বিদেশি হাজীগণের নিকট মোটা অংকের টাকায় বিক্রি হতে থাকে তার দ্বারা বরকত হাসিলের জন্য, আর এটা জায়েয নয় এবং এর কারণে তাদেরকে সম্মান করা বৈধ নয়। কেননা তা পাপ ও সীমালংঘনের কাজে সহযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।

৫. আর পুরাতন গেলাফের দ্বারা বরকত অর্জনের জন্য তা কেনা-বেচার মধ্যে শির্কের উপলক্ষ্য বিদ্যমান রয়েছে।

দ্বিতীয় মাসআলা: বৃষ্টির সময়ে কা‘বার পাইপ থেকে পড়া পানি পান করা। আর এ বিষয়টি দৃষ্টিগোচরীভূত ও সর্বজন পরিচিত, আর তা মানুষের অজ্ঞতার কারণে; সুতরাং আমরা সাধারণ জনগণকে বৃষ্টির বর্ষণের সময়ে কা‘বার পাইপ থেকে পড়া পানি পান করার জন্য দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখতে পাই, এমনকি আমি এমন ব্যক্তিকেও দেখেছি, যিনি বৃষ্টির পানি মাটিতে পড়ার পর তার দিকে আসে, অতঃপর তা সংগ্রহ করে, তারপর তা পান করে; আর তাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে আমরা তাদেরকে এমন অবস্থায় পাই যে, তারা বিশ্বাস করে- এ পানিতে বরকত রয়েছে, আর এটা তাদের এ আকীদা-বিশ্বাসের কারণে যে, যে বস্তু কা‘বাকে স্পর্শ করবে, তার মধ্যে বরকত পাওয়া যাবে। আর আমি যদি বরকত অর্জনের আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে কা‘বা’র (আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত ও মর্যাদাবান করুন) দেওয়াল চুম্বন করা শরী‘আত সম্মত না হওয়ার কথা বলি, তাহলে আরও উত্তমভাবেই বলার কথা- কাপড়, গেলাফ ও পনির মত যেসব বস্তু তাকে স্পর্শ করে, তার দ্বারা বরকত অর্জনের চিন্তা করা শরী‘আতসম্মত নয়।

>
[1] দেখুন: ‘আল-বিদ‘উ ওয়াল মুহদাছাত ওমা লা আসলা লাহু’: (পৃ. ৩৯৬-৩৯৮); ‘শিফা আস-সুদুর ফী যিয়ারাত আল-মাশাহেদ ওয়াল কুবূর’: (পৃ. ১২৩); ‘আত-তামহীদ লি-শরহে কিতাব আত-তাওহীদ’: (পৃ. ৬০৯)।

[2] আর এ কাজটি খুবই পরিচিত ও স্বচক্ষে দেখা।

[3] এ তথ্যটি মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম রহ. এর নাতি তার থেকে ‘আত-তামহীদ লি-শরহে কিতাব আত-তাওহীদ’ নামক গ্রন্থে (পৃ. ৬১০) বর্ণনা করেছেন, আরও দেখুন: ফাতাওয়া ইবন ইবরাহীম: (১/১০১-১০৩)।

[4] হাদীসটি ‘মারফু’ সনদে ‘ইরবাদ ইবন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ১৭১৪৪; ইবন মাজাহ, আস-সুনান, হাদীস নং ৪২; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ৪৬০৭; তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীস নং ২৬৭৬।

[5] দেখুন: ‘আল-বিদ‘উ ওয়াল মুহদাছাত ওমা লা আসলা লাহু’: (পৃ. ৩৯৬-৩৯৭)।

[6] দেখুন: ‘আল-বিদ‘উ ওয়াল মুহদাছাত ওমা লা আসলা লাহু’: (পৃ. ৩৯৭-৩৯৮)।

[7] দেখুন: আযরাকী, ‘আখবারু মাক্কা’: (১/২৫৮-২৬২)।
তৃতীয় অধ্যায় - আনুগত্যের উদ্দেশ্য ব্যতীত বরকত মনে করে হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করা

একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করেছেন[1]। তিনি তাঁর হাত মুবারক দ্বারা তা স্পর্শ (استلام)[2] করেছেন, অতঃপর তাঁর হাত চুম্বন করেছেন।[3]

আরও প্রমাণিত আছে যে, নবী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে (হাজরে আসওয়াদকে) ‘মিহজান’ (লাঠি)[4] দ্বারা স্পর্শ করেছেন এবং ‘মিহজান’-কে চুম্বন করেছেন।

আর তার উপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্পর্শের বিষয়টি ছিল তাঁর তাওয়াফ শুরু করার সময় এবং প্রতিবার দৌড়ের শুরুতে[5]। সুতরাং যদি তাঁর জন্য স্পর্শ করার কাজটি সহজ না হত, তাহলে তিনি তার দিকে ইশারা করতেন।[6]

আর প্রমাণিত আছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতি তাওয়াফে রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করতেন[7]; আর যদি স্পর্শ করাটা তাঁর জন্য সহজ না হত, তাহলে তিনি তা বর্জন করতেন, এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত; আর তাকে (রুকনে ইয়ামানীকে) চুম্বন করা অথবা তার দিকে ইশারা করার বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত বা প্রমাণিত নয়।[8]

আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করার জন্যই মুসলিমগণ এ সুন্নাতের ওপর আমলকে অব্যাহত রাখবে[9], আর তা হলো ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’-কে স্পর্শ করা, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে তারা এটা করবে না।

আর যখনই মুসলিমগণ হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’-কে স্পর্শ করবে, তখন তারা তাকে এ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করবে না যে, তাতে কিছু একটা আছে এবং তারা তার কাছে কোনো কিছু চাইবে না; আর তারা এ স্পর্শ করার কাজ থেকে আনুগত্যের সাওয়াব ছাড়া আর অন্য কোনো কিছু প্রত্যাশা করবে না। এ জন্যই প্রমাণিত আছে যে, উমার ইবনল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে স্পর্শ করার সময় বলতেন:

«إِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ، لَا تَضُرُّ، وَلَا تَنْفَعُ، وَلَوْلَا أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ، مَا قَبَّلْتُكَ»

“আমি নিশ্চিত জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র; তুমি কোনো ক্ষতি করতে পার না এবং কোনো উপকারও করতে পর না; যদি আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে আদৌ চুম্বন করতাম না।”[10]

ইমাম নববী রহ. বলেন, “উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ উক্তিটি শুধু এ জন্যই করেছেন যে, যাতে তিনি জনগণকে এ বক্তব্যটি শুনিয়ে দিতে পারেন এবং তাদের মাঝে তা ছড়িয়ে যায়। কারণ, খুব নিকট অতীতেই এমন একটা সময় ছিল, যখন তাদের মধ্যকার অনেকেই পাথর পূজার সাথে সম্পৃক্ত ছিল, পাথরকে সম্মান করত এবং তার ক্ষতি ও উপকার করার শক্তিতে বিশ্বাস করত, তারপর তিনি আশঙ্কা করলেন যে, তাদের কেউ কেউ এর দ্বারা প্রতারিত হতে পারে; ফলে তিনি যা বলার বললেন, আর আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানেন”।[11]

আর শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-‘উসাইমীন রহ. বলেন, “তাওয়াফকারীগণের কেউ কেউ যেসব ভুল-ত্রুটি বা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে তার অন্যতম একটি হলো: তারা ধারণা করেন যে, ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’-কে স্পর্শ করার বিষয়টি বরকতের জন্য, ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়, ফলে তারা বরকত হাসিলের জন্য তা স্পর্শ করে। আর এটা নিঃসন্দেহে তার প্রকৃত উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। কারণ, ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে স্পর্শ করা অথবা তাকে স্পর্শ ও চুম্বন করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান করা, আর এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে স্পর্শ করতেন, তখন বলতেন ‘আল্লাহু আকবার’। এটা ইঙ্গিত করে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান করা; এ পাথরটিকে স্পর্শ করার দ্বারা বরকত হাসিল করা উদ্দেশ্য নয়। আমীরুল মুমিনীন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

«وَاللَّهِ، إِنِّي لَأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ، لَا تَضُرُّ، وَلَا تَنْفَعُ، وَلَوْلَا أَنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ، مَا قَبَّلْتُكَ».

“আল্লাহর কসম! আমি নিশ্চিত জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র; তুমি কোনো ক্ষতি করতে পার না এবং কোনো উপকারও করতে পর না। যদি আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে আদৌ চুম্বন করতাম না।”এ ভুল ধারণাটি কিছু সংখ্যক মানুষের, আর তাদের ধারণা ও বিশ্বাস হলো, ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’-কে স্পর্শ করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে বরকত হাসিল করা, যা তাদের কাউকে কাউকে প্রলুব্ধ করে তার ছোট ছেলেকে নিয়ে আসতে, তারপর সে ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’-কে তার হাত দ্বারা স্পর্শ করে, অতঃপর সে তার ছোট্ট ছেলেকে অথবা তার শিশু বাচ্ছাকে তার ঐ হাত দ্বারা মুছে দেয়, যে হাত দ্বারা সে ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’-কে স্পর্শ করেছে। আর এটা বিকৃত আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত, যার থিকে নিষেধ করা ওয়াজিব এবং আরও আবশ্যক হলো জনগণকে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া যে, এ ধরণের পাথর কোনো ক্ষতি ও উপকার করতে পারে না। তাকে স্পর্শ করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান করা এবং তাঁর যিকির বা স্মরণকে প্রতিষ্ঠিত করা, পাশাপাশি তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ও অনুসরণ করা”।[12]

>
[1] হাদীসটি উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৫৩২; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১২৭০)।

[2] বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত শব্দের অর্থ: আর তা হলো: ‘তাকে হাত দ্বারা স্পর্শ করা’; ইবন কুতাইবা রহ. বলেন, তা (শব্দটি) বাবে এর মাসদার, শব্দ থেকে গৃহীত, অর্থ (পাথর), তার একবচন হলো। যেমন, আপনি বলেন: (আমি পাথর ছুঁয়েছি, যখন আপনি পাথর থেকে তা স্পর্শ করেছেন, যেমনিভাবে আপনি বলেন, আমি সুরমা লাগিয়েছি, যখন আপনি সুরমা থেকে কিছু গ্রহণ করেন)। -গারীবুল হাদীস: (১/৪২); আরও দেখুন: আল-মাজমূ‘উ শরহু ‘আল-মুহায্যাব’: (৮/৪৩-৪৪)।

[3] হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১২৬৮); আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ৫৮৭৫)। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা রহ. বলেন: “পাথর স্পর্শ করা ব্যতীত যখন কোনো কিছু দ্বারা তার দিকে ইশারা করবে, তখন সে তার হাত চুম্বন করবে না।; কারণ, চুম্বনটি শুধু পাথরের জন্য অথবা পাথরকে স্পর্শ করার কারণে।” [শরহুল ‘উমদা: (১/৪৩০)]।

[4] হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৫৩০; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১২৭২।

আর ‘মিহজান’ শব্দটি যেরযুক্ত ‘মীম’, সাকিনযুক্ত ‘হা’ ও যবরযুক্ত ‘জীম’ যোগে; আর তা হলো: দণ্ডের মত মাথা বাঁকা লাঠি, একবচন, বহুবচনে: -দেখুন: আল-মাজমূ‘উ শরহু ‘আল-মুহায্যাব’: (৮/৪৪); ‘হাশিয়াতুস্ সিন্দী ‘আলা সুনান আন-নাসাঈ’: (৫/২৫৭)।

[5] হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন; আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ৪৬৮৬; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ১৮৭৬; নাসাঈ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৯৪৭।

[6] হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৫৩৪।

[7] হাদীসটি আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন; আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ৪৬৮৬; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ১৮৭৬; নাসাঈ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৯৪৭।

[8] দেখুন: মাজমূ‘উ আল-ফাতাওয়া: (২৬/৯৭)।

[9] ইবন কুদামা রহ. উল্লেখ করেন: “দু’টি রুকনকে স্পর্শ করার ব্যাপারে আলেমদের ইজমা‘ হয়েছে: ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’।” -আল-মুগনী: (৫/২২৬)।

[10] হাদীসটি ‘মাওকুফ’ সনদে উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৫২০; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১২৭০।

[11] আল-মাজমূ‘উ শরহু ‘আল-মুহায্যাব’: (৮/৪২)।

[12] ফিকহুল ‘ইবাদাত: (পৃ. ৩৪৮-৩৪৯)।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »