إِنَّ الْحَمْدُ للهِ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا ، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
নিশ্চয় যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য। আমরা তারই প্রশংসা করি, তার কাছে সাহায্য চাই, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আল্লাহর নিকট আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টতা ও আমাদের কর্মসমূহের অকল্যাণ থেকে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ যাকে হিদায়াত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নেই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে হিদায়াত দেওয়ারও কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরীক নেই। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম নাযিল হোক তাঁর ওপর, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের ওপর এবং যারা কিয়ামত অবধি ইহসানের সাথে তাদের অনুসরণ করেন তাদের ওপর।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো পরিবার। পারিবারিক জীবন থেকেই গড়ে উঠে ইসলামী পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা। তাই ইসলাম পরিবারের সংশোধন ও শৃঙ্খলাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। একটি শিশুই একটি জাতির ভবিষ্যৎ। আজকের শিশুই আগামী দিনের কর্ণধার। তার তা‘লীম-তরবিয়তের ওপরই নির্ভর করবে আমাদের আগামী দিনের পরিবার বা সমাজ ব্যবস্থা কেমন হবে। আমাদের এ প্রবন্ধে শিশু শিক্ষার ধরণ কেমন হওয়া উচিৎ, শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে মাতা-পিতার ভূমিকা ও দায়িত্ব কী হওয়া উচিৎ, শিশুদের শিক্ষা কারিকুলাম এবং শিক্ষায় অবদান রাখার ক্ষেত্রে শিক্ষক ও সংস্কৃতিবিদ যারা রয়েছেন তাদের ভূমিকা কী ধরনের অবদান রাখা উচিৎ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও এ নিবন্ধে রয়েছে, পারিবারিক বন্ধন, বিবাহ, বিবাহ বন্ধন, স্বামীর অধিকার, স্ত্রীর অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ, একাধিক বিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা। আশা করব আমাদের এ লেখনীর মাধ্যমে ইসলামী পারিবারিক ব্যবস্থার বিশেষ দিক ও সৌন্দর্যগুলো আমাদের মধ্যে ফুটে উঠবে। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টাকে কবুল করুন। আমীন।
ইসলামী শিক্ষার সঠিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘সত্যবাদী মুমিন’ ‘রক্ষণশীল প্রতিনিধি’ এবং ‘দৃঢ়-বিশ্বাসী’ মানুষ তৈরি করা। আল্লাহর পরিচয় জানা ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালিন মুক্তি অর্জন করা। এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জন করা একমাত্র পরিতৃপ্ত ঈমানী শক্তি দ্বারাই সম্ভব। প্রতিনিধিত্বমূলক দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে সামনের দিক এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যয়ী হতে হবে। এছাড়াও সঠিক অনুভূতি, বাস্তবধর্মী কর্ম পদ্ধতি, হৃদয়ের সাহস, আমানত ও বিশ্বাসের দৃঢ়টা এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে আবশ্যিক উপকরণ। কাজের দক্ষতা এবং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন ছাড়া এ লক্ষ্যে পৌঁছা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।
আর সম্ভাবনাময় একজন মানুষ গঠন করতে হলে, এ সকল উন্নত গুণাবলীর বীজ মানব শিশুর মূল উৎস শিশু বয়সেই স্থাপন করতে হবে। এ জন্যই পরিবার এবং পারিবারিক সুসম্পর্কই হচ্ছে শিশুদের ইসলামী শিক্ষা তথা নববী শিক্ষার কারিকুলামের মূল ভিত্তি। কারণ, পরিবারই শিশুর মানসিক ও বৈষয়িক বিকাশের সর্বপ্রথম আশ্রয়স্থল। একটি মানব শিশু তার মানসিক ও বৈষয়িক যে কোনোও ধরনের প্রয়োজন পূরণে অক্ষম অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে। তখন একমাত্র পরিবারই তার সকল প্রকার প্রয়োজন পূরণে সহায়তা ও ব্যবস্থা করে তাকে সুন্দরভাবে লালন-পালনের যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এজন্যই পরিবার গঠন ও পরিবারের সুসম্পর্কই হচ্ছে মানবিক গঠন ও বিকাশের প্রাণকেন্দ্র। যার ওপর ভিত্তি করে মানবিক ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। এজন্যই পবিত্র আল-কুরআন ও রাসূলের বাণী এবং মানবতার মুক্তির ধর্ম ইসলাম পরিবার এবং পরিবারের সুসম্পর্ককে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এবং ব্যক্তি ও সমাজ গঠনে পরিবারকে প্রথম বীজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আমাদেরকে তাই পরিবার এবং পারিবারিক সুসম্পর্ক বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে হবে যাতে সঠিকভাবে পরিবার ও পারিবারিক সম্পর্কের মূল্যায়ন করে মুসলিম শিশুদেরকে যথাযথ তা‘লীম-তরবিয়তের ব্যবস্থা করে সঠিকভাবে লালন পালন করা যায়। তাদের থেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিস্থিতির আগ্রাসনের শিকার, অন্ধবিশ্বাস, ভ্রান্ত-অনুকরণ, বিচ্যুতি এবং চিন্তার স্থবিরতা ইত্যাদি অপসারণ করা যায়। বিশেষ করে বর্তমান চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় মুসলিম জাতিকে যেন হিফাযত করা যায়।
এ সম্পর্কে আল্লাহ আল-কুরআনে বলেন,
﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَح÷ۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١﴾ [الروم: ٢١]
“আর তাঁর নিদর্শনা-বলীর মধ্যে একটি নিদর্শন হচ্ছে যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে”। [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১]
আল্লাহ আরও বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا ٧٤﴾ [الفرقان: ٧٤]
“যারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এবং আমাদের সন্তানদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে চোখের শীতলতা দান কর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শস্বরূপ কর”। [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৭৪]
আল্লাহ আরও বলেন
﴿وَإِذۡ قَالَ لُقۡمَٰنُ لِٱبۡنِهِۦ وَهُوَ يَعِظُهُۥ يَٰبُنَيَّ لَا تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣ وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ وَهۡنًا عَلَىٰ وَهۡنٖ وَفِصَٰلُهُۥ فِي عَامَيۡنِ أَنِ ٱشۡكُرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيۡكَ إِلَيَّ ٱلۡمَصِيرُ ١٤ وَإِن جَٰهَدَاكَ عَلَىٰٓ أَن تُشۡرِكَ بِي مَا لَيۡسَ لَكَ بِهِۦ عِلۡمٞ فَلَا تُطِعۡهُمَاۖ وَصَاحِبۡهُمَا فِي ٱلدُّنۡيَا مَعۡرُوفٗاۖ وَٱتَّبِعۡ سَبِيلَ مَنۡ أَنَابَ إِلَيَّۚ ثُمَّ إِلَيَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَأُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ ١٥ يَٰبُنَيَّ إِنَّهَآ إِن تَكُ مِثۡقَالَ حَبَّةٖ مِّنۡ خَرۡدَلٖ فَتَكُن فِي صَخۡرَةٍ أَوۡ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ أَوۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ يَأۡتِ بِهَا ٱللَّهُۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَطِيفٌ خَبِيرٞ ١٦ يَٰبُنَيَّ أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ وَأۡمُرۡ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَٱنۡهَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَٱصۡبِرۡ عَلَىٰ مَآ أَصَابَكَۖ إِنَّ ذَٰلِكَ مِنۡ عَزۡمِ ٱلۡأُمُورِ ١٧ وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمۡشِ فِي ٱلۡأَرۡضِ مَرَحًاۖ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٖ فَخُورٖ ١٨ وَٱقۡصِدۡ فِي مَشۡيِكَ وَٱغۡضُضۡ مِن صَوۡتِكَۚ إِنَّ أَنكَرَ ٱلۡأَصۡوَٰتِ لَصَوۡتُ ٱلۡحَمِيرِ ١٩﴾ [لقمان: ١٣، ١٩]
“যখন লোকমান উপদেশ হিসেবে তার পুত্রকে বললেন: হে বৎস, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়। আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছর বয়সে। নির্দেশ দিয়েছি যে আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়ে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহাবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করো। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমার দিকেই এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে অবহিত করবো। হে বৎস, কোনো বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর খণ্ডের গর্ভে অথবা আকাশে, অথবা ভূগর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন-ভেদ জানেন, সবকিছু খবর রাখেন। হে বৎস! সালাত কায়েম কর, সৎ কাজের আদেশ দাও, মন্দ কাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে সবুর কর। নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ। অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনোও দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। পাদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নিচু কর। নিঃসন্দেহে গাধার আওয়াজ সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট আওয়াজ”। [সূরা লোকমান, আয়াত: ১৩-১৯]
আল্লাহ আরও বলেন,
﴿ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ ٱلَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى ٱلۡكِبَرِ إِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَۚ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ ٱلدُّعَآءِ ٣٩ رَبِّ ٱجۡعَلۡنِي مُقِيمَ ٱلصَّلَوٰةِ وَمِن ذُرِّيَّتِيۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلۡ دُعَآءِ ٤٠ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ يَوۡمَ يَقُومُ ٱلۡحِسَابُ ٤١﴾ [ابراهيم: ٣٩، ٤١]
“সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য, যিনি আমাদের বার্ধক্য বয়সে ইসমাইল ও ইসহাককে দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব দো‘আ শ্রবণ করেন। হে আমার রব! আমাকে সালাত কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমার রব! কবুল করুন আমাদের দো‘আ। হে আমাদের রব আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সব মুমিনকে ক্ষমা করুন, যেদিন হিসাব কায়েম হবে”। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৩৯-৪১]
আল্লাহ আরও বলেন,
﴿إِذۡ قَالَ لَهُۥ رَبُّهُۥٓ أَسۡلِمۡۖ قَالَ أَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٣١ وَوَصَّىٰ بِهَآ إِبۡرَٰهِۧمُ بَنِيهِ وَيَعۡقُوبُ يَٰبَنِيَّ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰ لَكُمُ ٱلدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٣٢﴾ [البقرة: ١٣١، ١٣٢]
“স্মরণ করুন, যখন তাকে তার রব বললেন: অনুগত হও। সে বলল আমি বিশ্ব পালকের অনুগত হলাম। এরই অসিয়ত করেছেন ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়াকূবও যে, হে আমার সন্তানগণ নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনো মারা যেও না”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৩১–১৩২]
আল্লাহ আরও বলেন,
﴿وَوَصَّيۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ بِوَٰلِدَيۡهِ إِحۡسَٰنًاۖ حَمَلَتۡهُ أُمُّهُۥ كُرۡهٗا وَوَضَعَتۡهُ كُرۡهٗاۖ وَحَمۡلُهُۥ وَفِصَٰلُهُۥ ثَلَٰثُونَ شَهۡرًاۚ حَتَّىٰٓ إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُۥ وَبَلَغَ أَرۡبَعِينَ سَنَةٗ قَالَ رَبِّ أَوۡزِعۡنِيٓ أَنۡ أَشۡكُرَ نِعۡمَتَكَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتَ عَلَيَّ وَعَلَىٰ وَٰلِدَيَّ وَأَنۡ أَعۡمَلَ صَٰلِحٗا تَرۡضَىٰهُ وَأَصۡلِحۡ لِي فِي ذُرِّيَّتِيٓۖ إِنِّي تُبۡتُ إِلَيۡكَ وَإِنِّي مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٥ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ نَتَقَبَّلُ عَنۡهُمۡ أَحۡسَنَ مَا عَمِلُواْ وَنَتَجَاوَزُ عَن سَئَِّاتِهِمۡ فِيٓ أَصۡحَٰبِ ٱلۡجَنَّةِۖ وَعۡدَ ٱلصِّدۡقِ ٱلَّذِي كَانُواْ يُوعَدُونَ ١٦﴾ [الاحقاف: ١٥، ١٦]
“আমরা মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে। যাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়তে লেগেছে ত্রিশ মাস। অবশেষে সে যখন শক্তি সামর্থ্যের বয়সে ও চল্লিশ বছরে পৌঁছেছে, তখন বলতে লাগল, হে আমার রব! আমাকে এরূপ ভাগ্য দান কর, যাতে আমি তোমার নি‘আমতের শোকর করি, যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎ কাজ করি। আমার সন্তানদেরকে সৎকর্ম পরায়ণ কর, আমি তোমার প্রতি তাওবা করলাম এবং আমি আজ্ঞাবহদের অন্যতম। আমরা এমন লোকদের সুকর্মগুলো কবুল করি এবং মন্দ কর্মগুলো মার্জনা করি। তারা জান্নাতীদের তালিকাভুক্ত সেই সত্য ওয়াদার কারণে, যা তাদেরকে দেওয়া হতো”। [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ১৫–১৬]
আল্লাহ আরও বলেন,
﴿وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ إِمَّا يَبۡلُغَنَّ عِندَكَ ٱلۡكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوۡ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُل لَّهُمَآ أُفّٖ وَلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُل لَّهُمَا قَوۡلٗا كَرِيمٗا ٢٣ وَٱخۡفِضۡ لَهُمَا جَنَاحَ ٱلذُّلِّ مِنَ ٱلرَّحۡمَةِ وَقُل رَّبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤﴾ [الاسراء: ٢٣، ٢٤]
“তোমার রব আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমাদের জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উহ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্টাচার-পূর্ণ কথা। তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে নম্র-ভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল: হে রব তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন পালন করেছেন”। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩-২৪]
আল্লাহ আরও বলেন,
﴿وَتَوَلَّىٰ عَنۡهُمۡ وَقَالَ يَٰٓأَسَفَىٰ عَلَىٰ يُوسُفَ وَٱبۡيَضَّتۡ عَيۡنَاهُ مِنَ ٱلۡحُزۡنِ فَهُوَ كَظِيمٞ ٨٤ قَالُواْ تَٱللَّهِ تَفۡتَؤُاْ تَذۡكُرُ يُوسُفَ حَتَّىٰ تَكُونَ حَرَضًا أَوۡ تَكُونَ مِنَ ٱلۡهَٰلِكِينَ ٨٥ قَالَ إِنَّمَآ أَشۡكُواْ بَثِّي وَحُزۡنِيٓ إِلَى ٱللَّهِ وَأَعۡلَمُ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٨٦ يَٰبَنِيَّ ٱذۡهَبُواْ فَتَحَسَّسُواْ مِن يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلَا تَاْيَۡٔسُواْ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ لَا يَاْيَۡٔسُ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٨٧﴾ [يوسف: ٨٣، ٨٦]
“এবং তাদের দিক থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন: হায় আফসোস ইউসুফের জন্য এবং দুঃখে তার চক্ষুদ্বয় সাদা হয়ে গেল। এবং অসহনীয় মনস্তাপে তিনি ছিলেন ক্লিষ্ট। তারা বলতে লাগল: আল্লাহর কসম আপনি তো ইউসুফের স্মরণ থেকে নিবৃত্ত হবেন না, যে পর্যন্ত মরণাপন্ন না হয়ে যান কিংবা মারা না যান। তিনি বললেন: আমি তো তোমার দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি যা জানি, তা তোমরা জান না। বৎসগণ! যাও ইউসুফ ও তার ভাইকে তালাশ কর এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না”। [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৮৪–৮৭]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا، أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا، وَخِيَارُهُمْ خِيَارُهُمْ لِنِسَائِهِمْ»
“তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিপূর্ণ মুমিন ঐ ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে উত্তম চরিত্রবান এবং তার পরিবারের প্রতি দয়াবান[1]।”
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও করেন, তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ঐ ব্যক্তি, যে তার পরিবারের কাছে ভালো। আর আমি আমার পরিবারের জন্য তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি”।[2]
ইমাম মুসলিম রহ. আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বর্ণনা করেন:
«تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ لِمَالِهَا وَلِحَسَبِهَا وَلِجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ تَرِبَتْ يَدَاكَ»
“চারটি বৈশিষ্ট্যের কারণে মেয়েদেরকে বিবাহ করা হয়। (১) তার ধন-সম্পদের কারণে, (২) বংশ মর্যাদার কারণে, (৩) শারীরিক সৌন্দর্যের কারণে এবং (৪) তার দীনদারীর কারণে। অতএব, তুমি ধার্মিকতাকে প্রাধান্য দাও। তোমার দু’হাত ধূলি ধূসরিত (তথা উত্তম) হোক।
ইমাম তিরমিযী রহ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا خَطَبَ إِلَيْكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَزَوِّجُوهُ، إِلَّا تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الأَرْضِ، وَفَسَادٌ عَرِيضٌ»
“যখন তোমাদের নিকট এমন কোনোও দীনদার, আমানতদার পাত্র বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে যার দীনদারী এবং চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট থাক, তাহলে তার সাথে তোমরা বিবাহ দিয়ে দাও। যদি তোমরা এমতাবস্থায় বিয়ে না দাও তাহলে জমিনে বড় ধরনের ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হতে পারে”।[3]
ইমাম আহমদ, ইমাম আবূ দাঊদ, ইমাম নাসাঈ ও ইমাম হাকিম রহ. সকলেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ، إِنِّي مُكَاثِرٌ الْأَنْبِيَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ»
“তোমরা স্নেহময়ী এবং অধিক সন্তান প্রসবকারী মেয়েদেরকে বিবাহ কর, যাতে আমি কিয়ামতের দিন অধিক উম্মতের মাধ্যমে গর্ব করতে পারি।[4]
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে হাদীস বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে,
«أَلَا كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالأَمِيرُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ، وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا، وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُ، وَالعَبْدُ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلَا فَكُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ»
“তোমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, নেতাও দায়িত্বশীল এবং সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষও তার পরিবারের দায়িত্বশীল সেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন নারীও তার স্বামীর ঘরের দায়িত্বশীল সেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”[5]
এ হচ্ছে ইসলামে পরিবারের গুরুত্ব, একমাত্র পরিবারই হচ্ছে সঠিকভাবে মানব তৈরির কারখানা এবং মানব শিশুর সর্বপ্রথম আশ্রয়স্থল। আর ইসলাম পরিবারকে এ ধরনের গুরুত্ব প্রদান- এটা আশ্চর্যের কোনোও বিষয় নয়। কারণ, মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব এবং পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। অপরদিকে এ সৃষ্টি জগতের প্রাণীকুলের মধ্যে একমাত্র মানব সন্তানের শিশুকাল সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। এমনকি এক দশকের চেয়েও বেশি সময় অতিক্রম করতে হয় শিশুকাল/বাল্যকাল পাড়ি দিতে। এ জন্যই শিশুকে তার বাল্যজীবনে মানসিক, শারীরিক আত্মিক তা‘লীম-তরবিয়ত, সেবা-যত্ন, পরামর্শ, দিক-নির্দেশনা ইত্যাদি দেওয়ার প্রয়োজন হয়। খলিফা হিসেবে তার দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত ও প্রস্তুত করার জন্য। আর এ সকল প্রয়োজন একমাত্র পরিবারই দিয়ে থাকে। সুতরাং মানব শিশুর আত্মিক, শারীরিক, বৈষয়িক বিকাশ এবং সকল প্রকার উন্নতি, অগ্রগতি-অবনতি, ইতিবাচক হোক আর নেতিবাচক হোক সকল ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।এ সকল কারণে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, কেন ইসলাম পরিবার ও পরিবার গঠন এত বেশি গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিয়েছে এবং পরিবার গঠনকে পৈত্রিক ও মাতৃক সুসম্পর্ক এবং মানুষের ফিৎরাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে? তার একমাত্র কারণ হচ্ছে, পরিবারের ভীত মজবুত করা এবং পরিবারের সদস্যদের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। আর এ জন্যই ইসলাম পরিবার গঠন, মানুষের ফিৎরাত, পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক অধিকার ইত্যাদি সর্ব বিষয়ে যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদান করেছে।
[2] ইবন মাজাহ ও হাকেম।
[3] তিরমিযী, হাদীস নং ১০৮৪।
[4] আহমদ, হাদীস নং ১২৬১৩।
[5] তিরমিযী, হাদীস নং ১৭০৫।
পরিবার গঠনে ইসলামী শরী‘আতের রহস্য ও তাৎপর্য ততক্ষণ পর্যন্ত অনুধাবন করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত পরিবার গঠনে মানুষে স্বভাবসুলভ দিকগুলো সম্পর্কে এবং পরিবারের সকল সদস্যদের দায়িত্ব ও একে অপরের পরিপূরক ভূমিকা সম্পর্কে অনুধাবন করতে না পারবে। কারণ, মানুষ যখন এ সকল বিষয়ে অনুধাবন করতে পারবে তখন ইসলামী শরী‘আতকে বুঝতে পারবে। আর যখন ইসলামী শরী‘আতকে বুঝতে পারবে, তখন পরিবার গঠন সম্পর্কে ইসলামী শরী‘আতের রহস্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে বুঝতে পারবে এবং পরিবারের সকল সদস্যদের দায়িত্ব বুঝাও তখন সহজ হবে।
অতএব, পরিবারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে পরিবারের সকল সদস্যের পরিপূরকমূলক দায়িত্বের প্রতি খেয়াল রেখেই দায়িত্ব অর্পণ ও পরিবার পরিচালনা করা। এটিই হচ্ছে মানুষের পারিবারিক সদস্যদের মাঝে আত্মিক ও জৈবিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি।
সাধারণত মানুষের মধ্যকার এ সম্পর্ক এবং বিশেষ করে পরিবারের সদস্যদের মাঝে এ ধরনের সম্পর্কের বিষয়ে ইসলামী শরী‘আতের দিক নির্দেশনাগুলো না বুঝার কারণে পরিবার গঠন ও পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে বুঝতে পারে না। যার কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব ও সম্পর্কের বিষয়ে ভুল করে থাকে। তারা মনে করে যে, পরিবারের সকলের দায়িত্ব ও সম্পর্ক সমান। ফলে তারা মানুষের ফিৎরাত বা স্বভাবকে অনুধাবন করতে ভুল করে। আর যখন স্বভাবকে অনুধাবন করতে ভুল করে, তখনই পরিবারের সদস্যদের মাঝে দায়িত্ব অর্পণে বিশৃঙ্খলা ও সীমালঙ্ঘন করে থাকে- যা শেষ পর্যন্ত পরিবারের মন্দ ডেকে নিয়ে আসে। অতএব, যতক্ষণ পর্যন্ত পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে মানুষের ফিৎরাত সম্পর্কে অনুধাবন না করা যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবার গঠনের ব্যাপারে ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করা সম্ভব হবে না।
আর পরিবারের সদস্যদের পরস্পর সম্মতি ও পরিপূরক ভূমিকা পরিবারের নারী-পুরুষ, বাবা-মা, ভাই-বোন, তথা সকল সদস্যের মাঝে ভালোবাসা, দয়া, অনুগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে। আর যখনই পরিবার থেকে সম্মতি ও পরিপূরক ভূমিকা, ভালোবাসা, দয়া অনুগ্রহ ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যায়, তখনই বাবার সম্পর্ক মায়ের সাথে এবং ছেলে-মেয়ের সম্পর্ক বাবার সাথে তথা পরিবারের প্রতিটি সদস্যের একে অপরের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। তখন সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্য তার মানসিক, আর্থিক, জৈবিক, ও দৈহিক বিকাশে প্রয়োজনীয় তা‘লীম-তরবিয়ত, সেবা-যত্ন, সহযোগিতা ও নিরাপত্তা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হয়। একটি শিশুর মানবিক আত্মিক, জৈবিক ও দৈহিক বিকাশ এবং একটি আদর্শ পরিবার গঠন তখনই সম্ভব, যখন পরিবারের সকল সদস্য তার সাধ্যানুযায়ী দায়িত্ব আদায় করে বা আদায় করতে চেষ্টা করে।
পুরুষের তুলনায় নারীর শারীরিক দুর্বলতা এবং সন্তানের সাথে নারীর বৈষয়িক ও আত্মিক আবেগ ও দয়াময় সম্পর্ক তাদের প্রতি দয়া অনুগ্রহ, সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রতি অনুপ্রাণিত করে। অপর দিকে নারীর তুলনায় পুরুষের জৈবিক দুর্বলতা এবং নারীত্বের কামনা- বাসনা ও তাদের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ ও ভালোবাসার প্রতি অনুপ্রেরণা যোগায়। এ জন্যই আল্লাহ নারীর হাতে জৈবিক প্রশান্তির লাগাম তুলে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের এ জৈবিক ও বৌদ্ধিক প্রশান্তির ওপর পুরুষ সহজে প্রভাব ফেলতে পারে না, বরং নারী তার ইচ্ছায় জৈবিক ও বৌদ্ধিক প্রশান্তির ওপর অবিচল থাকতে পারে। সে তার এ অবিচলতা ততক্ষণ পর্যন্ত হারায় না, যতক্ষণ পর্যন্ত পুরুষ তাকে দৈহিকভাবে স্পর্শ না করে বা দৈহিকভাবে স্পর্শ করার অনুমতি না দেয়। সুতরাং যখন একজন পুরষ নারীকে জৈবিক আবেগে স্পর্শ করে, তখন আর নারী তার জৈবিক ও বুদ্ধিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। অপর দিকে নারীর তুলনায় পুরুষের জৈবিক ও কাম-দুর্বলতার কারণে একজন নারীর দৃষ্টি বরং শুধুমাত্র কামনা-বাসনা ও চিন্তা-ধ্যান তাকে জৈবিক-ভাবে প্রভাবিত করে ফেলে। এমন কি অনেক সময় নারী তার বুদ্ধির মাধ্যমে একজন পুরুষকে তার প্রতি দুর্বল করে ফেলতে পারে। যার ফলে পুরুষ স্বাভাবিকভাবে নারী ও সন্তানদের প্রতি দুর্বল, নম্র ও দয়াপরবশ হয়ে পড়ে। এ সকল দিক বিবেচনায় নারী-পুরুষের অস্তিত্ব রক্ষা ও তাদের কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসলামী শরী‘আত নারী-পুরুষের মাঝে বিবাহের ব্যবস্থা করেছে। সেই বিবাহের মাধ্যমে বা বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে মানুষের বংশ মর্যাদা ও রক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা রেখেছে। এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিশুর মানবিক, দৈহিক ও আত্মিক বিকাশ ঘটে এবং নারী ও সন্তানদের ওপর পুরুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। এ জন্যই আল্লাহ পুরুষদেরকে নারী ও সন্তানদের দায়িত্ব ভার গ্রহণ ও বহন করার ক্ষমতা দান করেছেন। এ সবকিছুর মধ্য দিয়ে নারী পুরুষের মধ্যে প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, গড়ে উঠে পরিবার। সেই পরিবারই হয় সন্তানের শান্তি, নিরাপত্তা ও আশ্রয়স্থল। নিশ্চয় পুরুষকে নারীত্ব ও মাতৃত্বের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য তাকে নারীর তুলনায় সাহসিক ও শক্তিশালী হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে তারা পারিবারিক প্রয়োজনে নারী ও সন্তানদের প্রয়োজন পূরণ এবং তাদের লালন পালন ও পরিচালনা করতে পারে। নারীদেরকে পুরুষের তুলনায় দুর্বল, নম্র, কোমল ও আবেগময়ী করে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে পরনির্ভরশীল দুর্বল শিশু ও আবেগময়ী পুরুষ তাদের কাছে শান্তি ও আশ্রয় নিতে পারে।
এ জন্যই পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পুরুষের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আর নারীদেরকে তাদের শক্তি সামর্থ্য ও ইচ্ছানুযায়ী পারিপার্শ্বিক অবস্থার আলোকে কাজ-কর্ম করার নির্দেশ প্রদান করেছে। তার চেয়ে বেশি কিছু তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা বাধ্য করা, তাঁদের প্রতি যুলুম ও দুর্ব্যবহারের নামান্তর, যা শরী‘আত, মানুষের স্বভাব এবং নারী পুরুষের একে অন্যের পরিপূরক নীতির পরিপন্থী।
মানুষের স্বভাব এবং নারীকে দুর্বল ও পুরুষকে সবল করে সৃষ্টি ইত্যাদির বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ইসলামে নারী-পুরুষের সতরের পার্থক্যের রহস্য অনুধাবন করা যায়। ইসলাম নারীর সতরের পরিমাণ বেশি এবং পুরুষের সতরের পরিমাণ কম বা স্বল্প-ভাবে নির্ধারণ করেছে।
এ ইসলাম নারীর প্রতি যুলুম করে নি, বরং নারীকে হিফাযত করেছে এবং নারী ও পুরুষ উভয়ের দিক বিবেচনা করে পারিবারিক বন্ধনের ব্যবস্থা করেছে।
ইসলাম পুরুষদেরকে সীমিত পরিমাণ সতরের নির্দেশ দিয়েছে, যাতে তাদের কাজ-কর্মে সমস্যা বা ব্যাঘাত না ঘটে, তেমনিভাবে পুরুষের সতরের পরিমাণ কম থাকাতে নারীর প্রতি বা মাতৃত্বের প্রতি ফিতনা যুলুম ও সীমা লঙ্ঘনের অবকাশ নেই বললেই চলে। কারণ, নারী স্বভাবগতভাবে জৈবিক বিষয়ে অধিক সংযমশীল। অপরদিকে পুরুষের তুলনায় নারীকে অধিক সতরের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যাতে পুরুষের যুলুম ও জৈবিক সীমালঙ্ঘন এবং ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে নারী ও মাতৃত্বকে হিফাযত করা যায়। তেমনিভাবে পুরুষদেরকেও হিফাযত করা যায়। কারণ, স্বভাবগতভাবে নারীর তুলনায় পুরুষ জৈবিক বিষয়ে অধিক দুর্বল এবং আবেগপ্রবণ। এমনকি নারীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দৃষ্টি পর্যন্ত পুরুষকে আকৃষ্ট ও দুর্বল করে ফেলতে পারে। এ জন্যই ইসলামী শরী‘আত নারী-পুরুষের এ রকম সতরের বিধান দিয়েছে। এটিই হচ্ছে ইসলামী শরী‘আতের নারী-পুরুষের সতরের ব্যবধানের রহস্য।
এ জন্যই ইসলামী শরী‘আত বিবাহের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত নারীকে বিশেষভাবে দেখার অনুমতি দিয়েছে, তাতেও ইসলামী শরী‘আতের হিকমত রয়েছে।
তেমনিভাবে ইসলামী শরী‘আত নারীকে একসাথে একাধিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে নিষেধ করেছে। কারণ, নারীকে এক সাথে একাধিক বিবাহের অনুমতি দেওয়া হলেও মানুষের পিতৃ পরিচয় ও বংশ পরিচয় থাকবে না। তাই ধ্বংস হয়ে যাবে পরিবার এবং বিবাহের ফলাফল। এজন্যই ইসলামী শরী‘আত নারীকে একসাথে একাধিক বিবাহের অনুমতি দেয় নি।
অপর দিকে ইসলামী শরী‘আত পুরুষদেরকে শর্তসাপেক্ষে একসাথে একাধিক বিবাহের অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ পুরুষের যদি জৈবিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকে এবং একাধিক স্ত্রীদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে প্রয়োজন অনুসারে একাধিক বিয়ে করতে পারে। কারণ, এতে বিবাহের উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সমস্যা হয় না। সন্তানের পিতৃ পরিচয় ও বংশ মর্যাদা বহাল থাকে। পরিবারও ধ্বংস হয় না বরং একাধিক পরিবার হতে পারে। কিন্তু তার পরেও ইসলামী শরী‘আত পুরুষদেরকে শুধু ফুর্তির জন্য একসাথে একাধিক বিয়ে করার অনুমোদন দেয়নি। কারণ, এর ফলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে এবং স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের ভালোবাসা, সহমর্মিতা, দয়া, অনুগ্রহ ইত্যাদি হ্রাস পায়। একে-অন্যে হিংসা বিদ্বেষের মাধ্যমে স্বামী কর্তৃত্বে আঘাত হানে, পরিবার ভেঙ্গে যায়। এমনকি পরিবারের সদস্যদের মাঝে আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। অতএব, ইসলামী শরী‘আতের এ সিস্টেমের ভিত্তিতে, দয়া-ভালোবাসা-সহমর্মিতার ওপর একটি আদর্শ পরিবার গড়ে ওঠে। জাগ্রত হয় একে অন্যের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব। তখন স্বামী তার স্ত্রীকে এমন কোনোও কাজে বাধ্য করতে পারে না বা তার ওপর এমন কোনো কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে না, যা তার ইচ্ছা ও সাধ্যের বাইরে। তেমনিভাবে স্ত্রীও তার স্বামীকে এমন কোনোও কাজে বাধ্য বা তার ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না, যা তার ইচ্ছা ও সাধ্যের বাইরে। আর এতেই রয়েছে পরিবারের শান্তি।
যদি স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে মেনে নিতে না পারে, তাদের মধ্যে ঝগড়া ঝাটি, মনোমালিন্যতা ভুল বুঝাবুঝি লেগেই থাকে। তখন তাদেরকে বিবাহ বন্ধনে অটল থাকতে বাধ্য করা যাবে না, বরং ইসলামী শরী‘আত স্বামীকে তালাক প্রদানের অনুমতি আর স্ত্রীকে খুলা‘-এর মাধ্যমে নিজেকে মুক্ত করে নেওয়ার অনুমতি প্রদান করেছে। কারণ, এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে বিবাহ বহাল রাখা তাদের জন্য এবং বিশেষ করে সন্তানের জন্য বিচ্ছেদের চেয়েও অধিক ক্ষতিকারক।
এজন্যই ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর এ বিষয়াবলিকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে, কুরআনে তার বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে এবং স্বামী-স্ত্রীকে তাদের দায়িত্ব, অধিকার ও করণীয় সম্পর্কে সতর্ক ও নসীহত করেছে। ইসলাম স্বামী-স্ত্রী উভয়কে তাদের নিজ সত্ত্বা ও তাদের ব্যক্তিগত মালিকানার সম্পত্তি নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার ও খরচ করার অধিকার দিয়েছে। এতে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের ওপর বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন বা অন্য কোনো ধরনের প্রতারণামূলক আশ্রয় না নিয়ে তাদের মধ্যে প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা ও একে অন্যের পরিপূরক ও সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে সুখী সুন্দর পরিবার গঠন ও জীবন পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্যটা হয়েই যায়, তাহলে ইসলাম তাদেরকে সৎ ও সঠিক পন্থায় যে কোনোও মাধ্যমেই হোক মীমাংসার নির্দেশ দিয়েছে। যাতে বিচ্ছেদের মাধ্যমে একটি পরিবার ধ্বংস না হয় এবং সন্তান সন্ততি বিপদে না পড়ে। কিন্তু তার পরেও যদি তাদের মধ্যে সমঝোতা ও মীমাংসা সম্ভব না হয়, তখন ইসলাম স্বামীকে তালাকের মাধ্যমে আর স্ত্রীকে খুলা‘-এর মাধ্যমে বিচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছে। এতে তাদের উভয়েরই ক্ষতি রয়েছে, তালাকের ক্ষেত্রে স্বামী তার স্ত্রীকে প্রদত্ত মোহর হারাবে এবং আরেকটি সংসার গড়তে অতিরিক্ত বোঝা-সহ নতুন করে ভরণ পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আর খুলা‘র ক্ষেত্রে স্ত্রী তার প্রাপ্য সম্পদ তথা মোহর হারালো। এ জন্যই ইসলামী শরী‘আত খুলা-এর ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীকে মোহর হিসেবে যে সম্পদ দিয়েছেন তাতেই খুলা‘ করার নির্দেশ দিয়েছে। এ হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর সংসার ও তাদের বিচ্ছেদের বিষয়ে ইসলামী শরী‘আতের দিক নির্দেশনা।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারই হচ্ছে সমাজের মূল ভিত্তি। মানুষকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পরিবারই তার প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেয়। ইসলামী শরী‘আত পরিবারের সকল সদস্যের দিক ও প্রয়োজন বিবেচনা করে পরিবারের জন্য কিছু বিধি বিধান ও নিয়ম নীতি দিয়েছে। যার ওপর ভিত্তি করে দয়া-অনুগ্রহ-সহমর্মিতার ভিত্তিতে একটি আদর্শ পরিবার গড়ে উঠে।
মানুষ যেমন পরিবারের সদস্য তেমনি সমাজেরও সদস্য। মানুষের রয়েছে পারিবারিক দায়িত্ব এবং সামাজিক দায়িত্ব। এ পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্বের মিশ্রণ এবং বৈপরীত্যও রয়েছে, যা অনেক সময় ভুল বুঝাবুঝি ও সীমালঙ্ঘনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং পরিবারে পিতার যেমন একটি অবস্থান রয়েছে তেমনি রয়েছে মায়ের ও ছেলে-মেয়েদের, তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে পারিবারিক আলাদা ও ভিন্ন ধরনের দায়িত্ব ও ভূমিকা, যা তাদের সামাজিক দায়িত্ব ও ভূমিকার সাথে মিলে না।
অতএব, পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাথে বাবার সম্পর্ক হচ্ছে আত্মিক সম্পর্ক, সম্মান মর্যাদা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক, তেমনিভাবে পরিবারে, মা-মেয়ে, ভাই-বোন ইত্যাদির সম্পর্ক যা সামাজিক সম্পর্কের সাথে মিলবে না। কারণ, সামাজিকভাবে অনেক সময় বাবার চেয়ে ছেলের অবস্থান মায়ের চেয়ে মেয়ের অবস্থান স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর অবস্থান অনেক উন্নত ও ঊর্ধ্বে হতে পারে তাদের প্রত্যেকের বিবেক বুদ্ধি সামর্থ্য ইত্যাদি অনুযায়ী। তাদের এ সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্ব ও ভূমিকার মিশ্রণ ও বৈপরীত্য কোনোও কোনোও সময় পরিবারের সদস্যদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি, মনোমালিন্য, অনধিকার চর্চা, সীমালঙ্ঘন ও পারিবারিক দুর্বলতা ইত্যাদি সৃষ্টি হতে পারে।
পুরুষ হচ্ছে পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারের ছেলে-মেয়ের বংশ পরিচয় তার সঙ্গে সম্পর্কিত সন্তান সন্ততি ও স্ত্রীকে পরিচালনা করা, তাদের যথাযথ শান্তি নিরাপত্তা, উন্নতি অগ্রগতি ইত্যাদি নিশ্চিত করা, এমনকি পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্যান্যদের সাথে সম্পর্কের মাধ্যম হচ্ছে স্বামী। কারণ, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি তাদের নিরাপত্তা, শান্তি, উন্নতি, অগ্রগতি ইত্যাদি নির্ভর করে পরিবারের পুরুষ বা স্বামীর ওপর। আর এসব কিছুর ওপর নির্ভর করে পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। তাই ব্যক্তি ও সমাজকে গঠন করতে হলে পরিবারকে গঠন করতে হবে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদেরকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, সাধারণত পুরুষ এবং মহিলা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবের লোক। পুরুষ হচ্ছে একক স্বভাবের লোক আর নারী হচ্ছে দ্বৈত স্বভাবের লোক। পুরুষের রয়েছে শুধুমাত্র কাজের ক্ষমতা। আর নারীর রয়েছে কাজ ও সন্তান প্রসবের ক্ষমতা। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী সন্তান প্রসব এবং তার লালন পালনের অর্থাৎ মাতৃত্বের যোগ্যতা নিয়েই জীবন-যাপন করে। সন্তান প্রসবে এবং আদর-যত্ন, লালন-পালনে নারী ও মাতৃত্বের বিকল্প নেই। এজন্যই একটি সন্তানকে যথাযথভাবে লালন-পালন করতে হলে, নারী ও মাতৃত্বকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। তাই একজন মা বা নারীকেও তার আত্মিক, মানসিক, বৈষয়িক সবকিছু উজাড় করে সন্তান লালন-পালন করতে হবে। এজন্যই নারীকে পুরুষের থেকে আলাদা করা যাবে না। নারীকে পুরুষ থেকে আলাদা করা বা দূরে রাখার মানেই হচ্ছে নারীর ওপর এবং সন্তান সন্ততির ওপর মানসিক ও বৈষয়িক-ভাবে যুলুম করা। সুতরাং নারীকে পুরুষেরই কর্তৃত্বাধীন ও ছত্র-ছায়ায় রাখতে হবে।
অপর দিকে পুরুষ হচ্ছে শুধুমাত্র কাজের যোগ্যতা সম্পন্ন একক স্বভাবের অধিকারী। পুরুষের মধ্যে সন্তান গর্ভধারণের ক্ষমতা নেই। এজন্য পুরুষকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে যোগ্যতা-সম্পন্ন ও শক্তিশালী করে সৃষ্টি করা হয়েছে। নারী তার যথাযথ চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম করে তা‘লীম-তরবিয়তের আদর যত্ন ও লালন পালনের মাধ্যমে একটি সন্তানকে তার প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তারই মধ্য দিয়ে যথাসম্ভব তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য স্বামীকে বা পুরুষকে সহযোগিতা করতে হবে। এটিই হচ্ছে একটি পরিবারের আসল ও মূল কথা এবং স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকের মৌলিক দায়িত্ব।
এ জন্যই পরিবার ও সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের ভূমিকার মধ্যে কোনো ধরনের বৈপরীত্য, নিজের প্রাধান্য সৃষ্টি করার কোনোও অবকাশ নেই, প্রত্যেকের একটি সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা রয়েছে এবং প্রত্যেকের দায়িত্ব একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে গণ্য। তাই পরিবার ও সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে একজন নারীর প্রথম দায়িত্ব ও ভূমিকা মা ও মাতৃত্বের ভূমিকা পালন, যা পরিবার ও সমাজের মূল ভিত্তি। অর্থাৎ একজন নারী মা হিসেবেই তার সন্তান সন্ততিকে হাজার কষ্টের পরও সারা রাতের আরামের ঘুম হারাম করে সর্বাধিক আদর সোহাগ আর স্নেহ মমতার ভিতর দিয়ে লালন-পালন করেন, যা একজন পুরুষ কখনও করতে পারে না। এটিই হচ্ছে একজন নারী ও পরিবারের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় চাওয়া পাওয়া, এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ইসলামী শরী‘আত সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। সুতরাং এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের বিরোধিতা সমাজের যে কেউ করুক না কেন সে ইসলামী শরী‘আতের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সঠিক ফিতরাত/স্বভাব থেকে দূরে সরে যাবে এবং ইসলামী শরী‘আতের বিরোধিতা করবে। এটা সে পাশ্চাত্য প্ররোচনায় করুক আর ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের অন্ধ অনুকরণেই করুক, সমান কথা। যে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি ও তাদের প্ররোচনায় আজ নারী সমাজকে দেহ-ব্যবসা আর যৌনাচারে লিপ্ত করে তাদের ভোগের পাত্র আর খেলনার উপকরণে পরিণত করেছে। তেমনিভাবে কিছু কিছু মুসলিম রাষ্ট্রের অন্ধ অনুকরণ আর অন্ধ বিশ্বাসের কারণে নারীদেরকে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতা, যথাযথভাবে সন্তান লালন-পালন, স্বামীর সেবা ও তাকে সহযোগিতা এবং জাতি ও সমাজের সেবামূলক শিক্ষা দীক্ষা ও চিন্তা-চেতনা থেকে বঞ্চিত করে অজ্ঞতা, মূর্খতা, সংকীর্ণতার বন্দিশালায় আবদ্ধ করে রেখেছে। অথচ আধুনিক বিশ্বে দেশ, জাতি ও সমাজের সেবায় এবং নারী সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের তথ্য, প্রযুক্তিগত উপকরণ তৈরি করা হয়েছে যাতে সে নিজেকে পরিবার, সন্তান-সন্ততি ও সমাজ সেবার জন্য প্রস্তুত করে নিতে পারে।
বর্তমান মুসলিম সমাজে নারীদের প্রতি খুবই কঠোরতা করা হয়ে থাকে। এমনকি শরী‘আত অনুমতি দিয়েছে এমন কোনো অনুষ্ঠানেও তাদের অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। যার কারণে তারা অনেকাংশে জ্ঞান অর্জন ও বিভিন্ন শিক্ষা লাভ হতে বঞ্চিত। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে মুসলিম নারীদেরকে তুলনামূলক-ভাবে শিক্ষা-সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। এমনকি হিন্দু নারীদের থেকেও মুসলিম নারীদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে। অথচ ইসলাম নারীদেরকে যে অধিকার ও স্বাধীনতা দিয়েছে হিন্দু ধর্মে তার কিঞ্চিতও দেয় নি, তারপরেও হিন্দু নারীরা সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, অথচ একজন মুসলিম নারীকে অংশ গ্রহণ করতে দেওয়া হয় নি। যার ফলে মুসলিম সন্তানদের তা‘লীম-তরবিয়ত ও সুশিক্ষা এবং ইসলামের সামাজিক কর্মকাণ্ডে দুর্বলতা চলে আসছে। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মাদ আল-গাযালী রহ.-এর গ্রাম্য ও বাল্য জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলী থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। তিনি কীভাবে গ্রামের সর্বস্তরে নারীদেরকে দেখতে পান, কিন্তু দেখতে পান না একমাত্র মসজিদে। সে প্রসঙ্গেই ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।
‘আমার অত্যন্ত আশ্চর্য লাগে যখন আমি দেখি যে, বর্তমান বিশ্বে মুসলিম দেশসমূহে মুসলিমদের মসজিদগুলোতে নারীদের জন্য সালাতের কোনো ব্যবস্থা করা হয় নি। আর কোনো মতে ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্দার আড়ালে পিছনের কাতারে এমনভাবে ব্যবস্থা করা যে, একজন মহিলার এ অবস্থায় সেখানে সালাত পড়াটাও কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। অথচ তারা মসজিদে সালাতে গেলে অধিক পর্দা অবলম্বন ও অত্যন্ত আদরের সাথে যায়। এমনকি মসজিদে অন্যান্য সকল মুসল্লীও পাক-সাফ হয়ে একমাত্র আল্লাহর প্রতি মুতাওয়াজ্জাহ হয়ে মসজিদে সালাত পড়তে যায়। তারপরেও কোনো জিনিসটি নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা প্রদান করে? বা মসজিদে উপস্থিত হলেও কোনো বিষয়টি নারীদেরকে সর্বশেষ কাতারে পর্দার আড়ালে সংকুচিত স্থানে সালাত আদায় করতে বলে? অথচ মুসলিমদের ইবাদতের স্থান মসজিদ থেকে বের হলেই হাট বাজার রাস্তা ঘাটে নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নির্দ্বিধায় সব ধরনের কাজ করছে!! সেখানে কি তাদের মানসিক কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় না? আসে না তাদের মনে কোনো ধরনের কুমন্ত্রণা? আসে শুধু পাক-পবিত্র স্থান মসজিদে আল্লাহর ইবাদতের কাজে!!আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, অধিকাংশ মুসলিম দেশে মুসলিমদের মসজিদসমূহে জুমার সালাত ও তার খুৎবায় পর্যন্ত মুসলিম নারীদের উপস্থিত হতে দেখা যায় না এবং তাদের জন্য মসজিদে উপস্থিত হবার বা সালাতের কোনো ব্যবস্থাও করা হয় না। এতে মনে হয়, যেন আল্লাহর নির্দেশ শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য এসেছে, নারীদের বেলায় কিছুই আসে নি, ইসলাম নারীদেরকে সামাজিক অধিকার দেয় নি। সামাজিক দায়-দায়িত্ব বলতে নারীদের কোনো ধরনের ভূমিকাই নেই এবং নারীদের সামাজিক কোনো মর্যাদাই নেই। প্রকৃত পক্ষে মুসলিম নারীদের সম্পর্কে এ সকল সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে নারীদের বেলায় ইসলামিক নির্দেশের ভুল বুঝাবুঝি, অর্থাৎ ইসলাম নারীদের পারিবারিক দায়-দায়িত্ব, সন্তান লালন-পালন, দেখা-শোনায়, স্তন্যদানে ও মাতৃত্বমূলক দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনে জুমা ও জামা‘আতে উপস্থিত না হবার অনুমতি প্রদান করেছিল। যাতে একজন মায়ের জামা‘আতে বা জুমু‘আর সালাতে উপস্থিতির কারণে তার দুধের শিশু চটপট ও কষ্ট না করে। বিশেষ করে রাতের সালাত এশা ও ফজরের সালাতে নারীদের মসজিদে জামা‘আতে উপস্থিত না হওয়ার জন্য অনুমতি প্রদান করেছে। যাতে তার পারিবারিক দায়িত্ব পালনে কোনো সমস্যা না হয়। পারিবারিক দায়-দায়িত্ব এবং সন্তান লালন-পালন ইত্যাদি কারণ ছাড়া নারীদেরকে মসজিদে সালাতের জামা‘আতে উপস্থিত হতে এবং জুমু‘আর সালাত ও খুৎবাতে উপস্থিত হতে নিষেধ ও বাধা প্রদান করে নি। কারণ, পুরষ যেমন সমাজের অংশ, নারীও তেমন সমাজের অংশ; পুরুষের যেমন ধর্মীয় দায়িত্ব পালন আবশ্যকীয়, নারীরও তেমন আবশ্যকীয়। এতে ধর্মীয় ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালনে নারী-পুরুষ উভয়েরই মধ্যে কোনো পার্থক্য ও প্রাধান্যের কোনো কারণ নেই। কিন্তু ইসলামের সেই নির্দেশকে ভুল বুঝার কারণে নারীদেরকে মসজিদ, জামা‘আত, জুমু‘আ, খুৎবা ইত্যাদি থেকে বিরত রাখা হচ্ছে ও নিষেধ করা হচ্ছে। অথচ ইসলামের নির্দেশ ছিল তাদের প্রতি সহনশীলতার জন্য। ইসলাম কখনো তাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করে নি। রাসূলের বাণী «لَا تَمْنَعُوا نِسَاءَكُمُ الْمَسَاجِدَ» “তোমরা নারীদেরকে আল্লাহর মসজিদে আসতে বাধা প্রদান কর না[1]।”
বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা বিশ্বের সামনে মুসলিমদের সভ্যতা-সংস্কৃতির পরাজয়ের কারণ হচ্ছে, আমাদের কৃষ্টি-কালচার, আচার-আচরণ তথা ইসলামী শরী‘আত এবং তাদের কৃষ্টি-কালচার, আচার-আচরণ ও তাদের শরী‘আত সম্পর্কে কোনো জ্ঞান অর্জন না করে এবং কোনো বাছ-বিচার ও যাচাই বাছাই ছাড়াই পদাঙ্ক অনুসরণ করা। বিশেষ করে নারীদের বেলায় আমরা নির্দ্বিধায় প্রতিটি পদক্ষেপে তাদের অনুসরণ করছি, অথচ আমাদের শরী‘আত ও তাদের শরী‘আতে রয়েছে আকাশ পাতাল ব্যবধান। মুসলিম ও ইসলামী শরী‘আত বাদ দিয়ে কোনো সময় এমন কোনো কাজ সমর্থন করতে পারে না, যে কাজে পারিবারিক বন্ধনে ভাঙ্গন বা বিভেদ সৃষ্টি করে অথবা নারীর ইজ্জত সম্মানে আঘাত হানে অথবা নারীর মাতৃত্বের ভূমিকায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বা বিপদকে টেনে আনে।
পশ্চিমা বিশ্বে নারীদের বেলায় যে সমস্ত আচরণ করা হচ্ছে এবং পুরুষের মতো করে বিনা বাধায় বিনা শর্তে নারীদেরকে কর্মক্ষেত্রে বের করে দেখা হচ্ছে। এ সমস্ত বিষয় পরিবারকে ভাঙ্গন ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং নারীদের ইজ্জত সম্মান ও সম্ভ্রমের ওপর আঘাত হেনে তাদের ব্যভিচার ও দেহ-ব্যবসার প্রতি অনুপ্রাণিত করছে। পশ্চিমা বিশ্বে নারীদের পণ্য হিসেবেই কাজে লাগানো হচ্ছে। তাদের মধ্যে নেই কোনো সামাজিক বন্ধন এবং নেই কোনো স্নেহ মমতা। পশ্চিমা নারীরা যখন বুড়ো হয়ে যায়, তখন তাদের আর কোনো মূল্যায়ন থাকে না। তারা তখন ঘৃণা ও অবহেলার পাত্রে পরিণত হয়।