বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
সকল প্ৰশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি তার বান্দাদের উপর ছলাত ফরয করেছেন এবং তাদেরকে এটি প্রতিষ্ঠিত করার ও সুন্দরভাবে সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর তাকে খুশু খুযুর সাথে আদায় করার মধ্যে সফলতা নিহিত করেছেন। ঈমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যকারী এবং নির্লজ্জতা ও অন্যায় কাজ থেকে বারণকারী বলে গণ্য করেছেন।
ছলাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নাবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর যাকে আল্লাহ তা’আলা এই বলে সম্বোধন করেছেনঃ
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ
অর্থঃ আমি (আল্লাহ) আপনার প্রতি যিকর (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি যাতে করে আপনি মানুষকে তাদের প্রতি অবতীর্ণ বিষয় ব্যাখ্যা করে দেন। [1]
তিনি এই দায়িত্বকে পুঙ্খাপুঙ্খরূপে পালন করে গেছেন। তিনি মানব জাতির জন্য কথা ও কাজের মাধ্যমে যেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম বিষয় হচ্ছে ছলাত। একদা তিনি মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে এবং রুকু করে ছলাত পড়েন। অতঃপর (ছাহাবাদেরকে) বলেনঃ “আমি এমনটি করলাম। এজন্য যাতে করে তোমরা আমার অনুকরণ করতে পার এবং আমার ছলাত শিখতে পারো।” [2]
তিনি আমাদের উপর তাঁর অনুসরণ করা ওয়াজিব করেছেন। তাঁর বাণী
হচ্ছেঃ صلوا کما رایتموني أصلي অর্থঃ তোমরা আমাকে যেভাবে ছলাত পড়তে দেখ ঠিক সেভাবে ছলাত পড়া।” [3]
যে ব্যক্তি তাঁর ছলাতের মত ছলাত পড়বে তাকে তিনি সুসংবাদ দিয়েছেন এ মর্মে যে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্ৰবেশ করাবেন বলে ওয়াদা করেছেন যেমন তিনি বলেনঃ
خمس صلوات افترضهن الله تعالى، من احسن وضوءهن وصلاتهن لوقتهن، واتم ركوعهن وخشوعهن كان له عهد على الله ان يغفر له، ومن لم يفعل فليس له عهد على الله إن شاء غفر له وإن شاء عذبه
অর্থঃ মহান আল্লাহ পাঁচ (ওয়াক্ত) ছলাত ফরয করেছেন, যে ব্যক্তি এগুলোর জন্য উযু সুন্দরভাবে সম্পাদন করবে, আর ঠিক সময় মত তা আদায় করবে, এর রুকু, সাজদা ও খুশু-খুযু (বিনয়ভাব) পূর্ণমাত্রায় পালন করবে, আল্লাহ তার ব্যাপারে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি তাকে ক্ষমা করবেন, আর যে এমনটি করবেনা তার ব্যাপারে আল্লাহর কোন অঙ্গীকার নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করতে পারেন। আর তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তিও দিতে পারেন।[4]
আরো দুরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পুণ্যবান মুত্তাকী ছাহাবাদের উপর যারা আমাদের জন্য তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইবাদত, ছলাত, কথা এবং কাজগুলোর বিবরণী সংকলন করেছেন আর কেবল এগুলিকেই তাদের মাযহাব ও আদর্শ হিসাবে গণ্য করেছেন। এমনিভাবে যারা তাদের মত কাজ করবে ও তাদের পথ ধরে চলবে প্ৰলয়কাল পর্যন্ত; তাদের উপরও বর্ষিত হোক দারুদ ও সালাম।
অতঃপর আমি যখন হাফিয মুনযিৱী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর “আত-তারগীব ওয়াত তারহীব” গ্রন্থের ছলাত অধ্যায়ের পঠন ও কিছু সালাফী ভাইদেরকে এর পাঠ দান শেষ করলাম- যা চার বৎসর যাবৎ চলেছিল- এ থেকে আমাদের প্রত্যেকের কাছে ইসলামে ছলাতের অবস্থান ও মর্যাদা সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আরও জানতে পারি, যে ব্যক্তি একে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে এবং সুন্দরভাবে সম্পন্ন করবে তার জন্য কি প্রতিদান, মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে। আর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছলতের সাথে এর মিল ও গরমিলের উপর পারিতোষিকে কম বেশি হয়। যেমন তিনি হাদীছে বলেন,
إِنَّ الْعَبْدَ لَيُصَلِّي الصَّلَاةَ مَا يُكْتَبُ لَهُ مِنْهَا إِلَّا عُشْرُهَا تُسْعُهَا ثُمُنُهَا سُبُعُهَا سُدُسُهَا خُمُسُهَا رُبُعُهَا ثُلُثُهَا نِصْفُهَا
অর্থঃ নিশ্চয়ই (কিছু) বান্দাহ এমন ছলাতও পড়ে যার বিনিময়ে তার জন্য কেবল ছলাতের এক দশমাংশ, নবমাংশ, অষ্টমাংশ, সপ্তমাংশ, ষষ্ঠাংশ, পঞ্চমাংশ, চতুর্থাংশ, তৃতীয়াংশ, অর্ধাংশ লিখিত হয়।[5]
এজন্যই আমি ভ্ৰাতৃমণ্ডলীকে অবহিত করেছিলাম যে, এই ছলাতকে যথাযোগ্য বা তার কাছাকাছি রূপে সম্পন্ন করা আদৌ সম্ভব নয় যতক্ষণ না রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছলাত সম্পাদন পদ্ধতিকে বিশদভাবে জানতে পারব, যেমন ছলাতের ওয়াজিব ও আদাবসমূহ, তার অবস্থাদি, দু'আ ও যিকরসমূহ, তারপর বাস্তব জীবনে এগুলোকে রূপায়নে মনোযোগী হব। এসবের পর আমরা আশা করতে পারি যে, আমাদের ছলাত আমাদেরকে নির্লজ্জ কাজ ও অন্যায় থেকে বিরত রাখবে এবং ছলাতের বিনিময়ে যেসব ছওয়াব ও প্রতিদান রয়েছে আমাদের জন্যে তা লিখা হবে। কিন্তু এসবের বিস্তারিত জ্ঞান লাভ বেশিরভাগ লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার এমনকি অনেক আলিমদের উপর তা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়- নির্দিষ্ট কোন মাযহাবে আবদ্ধ থাকার কারণে। আর পবিত্র সুন্নাহ (হাদীছ) গ্রন্থের সেবা, সংকলন, অধ্যয়ন ও গবেষণার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি মাত্রই একথা জানেন যে, প্রত্যেক মাযহাবেই কিছু এমন সুন্নাত রয়েছে যা অন্য মাযহাবে নেই, আর সমস্ত মাযহাবের মধ্যেই কিছু কথা ও কাজ এমন রয়েছে যেগুলির সম্বন্ধ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দিকে বিশুদ্ধরূপে সাব্যস্ত নয়। এইসব অশুদ্ধ হাদীছ বেশির ভাগই পরবর্তীদের (মুতাআখখিরীনদের) কিতাবাদিতে পাওয়া যায়।[6]
আমরা প্রায়ই তাদেরকে এ হাদীছকে দৃঢ়তার সাথে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দিকে সম্বন্ধ করতে দেখতে পাই।[7] তাই হাদীছ বিশারদগণ (আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করুন)-এসব কিতাবাদির কিছু প্ৰসিদ্ধ কিতাবের উপর অনুসন্ধান ও যাচাইমূলক কিছু গ্ৰন্থ রচনা করেন যা উক্ত কিতাবসমূহে উদ্ধৃত হাদীছগুলির ছহীহ, যাঈফ ও জাল হওয়ার কথা স্পষ্টভাবে বলে দেয়। যেমনঃ আল-ইনায়াতু বিমা’রিফাতি আহাদীসুল হিদায়া (হিদায়ার হাদীছ অনুসন্ধানমূলক কিতাব আল-ইনায়াহ) গ্রন্থ এবং الطرق والوسائل فی تخریج احاديث خلاصة الدلائل (খুলাছাতুদ্দালায়িল গ্রন্থের হাদীছ অনুসন্ধানের গ্রন্থ আত্তুরুকু অল ওয়াসায়িল) রচিত হয়েছে উভয়টাই শাইখ আব্দুল কাদির বিন মুহাম্মদ আল কুরাশী আল হানাফীর প্রণীত, আরো রয়েছে হাফিয যায়লাঈর (হিদায়ার হাদীস অনুসন্ধানের কিতাব) نصب الراية لأحاديث الهداية হাফিয ইবনু হাজার আল আসকালানী কর্তৃক এরই সংক্ষেপায়িত গ্ৰন্থ “আদ-দিরায়া”। তাঁরই রয়েছে “রাফিঈল কাবীর” গ্রন্থের হাদীছ অনুসন্ধানের গ্রন্থ التلخيص الجبير فى تخريج احاديث الرافعى الكبير
এছাড়াও আরো অনেক গ্ৰন্থ রয়েছে যা উল্লেখ করতে গেলে কথা দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। আমি বলতে চাইঃ যেহেতু ছলাতের বিস্তারিত জ্ঞান লাভ বেশীর ভাগ লোকের উপর কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তাই আমি তাদের জন্য এই গ্ৰন্থ সংকলন করলাম যাতে করে তারা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছলাত পদ্ধতি জানতে পারে ও ছালাতে তার নির্দেশনা মেনে চলতে পারে। আল্লাহর কাছে তারই আশা রাখি যার অঙ্গীকার তিনি তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যাবানিতে আমাদের দিয়েছেন এই হাদীছেঃ
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى, كَانَ لَهُ مِنْ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ, لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا
অর্থঃ যে ব্যক্তি হিদায়াতের দিকে ডাকে তার জন্যে এর পালনকারীদের সমপরিমাণ পুণ্য রয়েছে, এতে তাদের (পালনকারীদের) পুণ্য থেকে কিছুই কমবে না। (মুসলিম ও অন্যান্য, এটা সিলসিলা সহীহাহ ৮৬৩ পৃষ্ঠাতেও উদ্ধৃত হয়েছে।
[1] সূরা নাহল ৪৪ আয়াত
[2] বুখারী ও মুসলিম; ছলাতের কিয়াম সম্পর্কে আলোচনায় হাদীছটি পূর্ণাঙ্গভাবে উল্লেখ করা হবে।
[3] বুখারী, মুসলিম ও আহমাদ। হাদীছটি ইরওয়াউল গালীল কিতাবে ও ২১৩ নং হাদীছের অধীনে উদ্ধৃত হয়েছে।
[4] লিখক বলেন, এটি ছহীহ হাদীছ, একে একাধিক ইমাম ছহীহ বলেছেন, আমি একে ছহীহ আবু দাউদের (৪৫১ ও ১২৭৬) নম্বরে উদ্ধৃত করেছি।
[5] হাদীছটি ছহীহ, ইমাম ইবনুল মুবারক এটাকে “আয-যুহদ” কিতাবে উল্লেখ করেছেন, আবু দাউদ ও নাসাঈ উত্তম সনদে তা বর্ণনা করেছেন। আমি (লিখক) 'ছহীহ আবু দাউদে (৭৬১) নম্বরে তা উদ্ধৃত করেছি।
[6] আবুল হাসানাত লক্ষনৌভি স্বীয় কিতাব النافع الكبير لمن يطالع الجامع الصغير এর মধ্যে হানাফী ফিক্বহের কিতাবসমূহের শ্রেনী বিন্যাস করে কোনটা নির্ভরযোগ্য আর কোনটা নির্ভরযোগ্য নয় তা উল্লেখ করে বলেন, (১২২-১২৩ পৃঃ) “আমি কিতাবাদির যে শ্ৰেণীবিন্যাস উল্লেখ করেছি তা ফিকহী মাসআলা ভিত্তিক ছিল। তবে যদি এতে সন্নিবেশিত হাদীছগুলোর আলোকে বিবেচনা করা যায়, তাহলে এই শ্রেণী বিন্যাস ঠিক থাকবে না। কারণ কতক কিতাব এমন রয়েছে যেগুলোর উপর সুযোগ্য ফুকাহাগণ নির্ভরশীল ছিলেন। অথচ তা বানোয়াট (জাল) হাদীছ দ্বারা ভরপুর। বিশেষ করে ফাতওয়ার কিতাবগুলো যাতে প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে একথাই আমাদের সামনে স্পষ্ট হয় যে, এ সবের রচয়িতারা যদিও (ফিকাহ বিষয়ে) পরিপক্ক কিন্তু তারা হাদীছ বৰ্ণনার ক্ষেত্রে শিথিল৷”
আমি (আলাবানী) বলছিঃ যোগ্যতম আলিমদের কিতাবে বিদ্যমান এসব জাল বরং বাত্বিল হাদীছের মধ্যে রয়েছেঃ
من قضی صلوات من الفرائضں فی آخر جمعة من رمضان کان ذلك جابرا لکل صلاة فاتته فى عمره إلى سبعين سنة
অর্থঃ যে ব্যক্তি রামাযানের শেষ জুমুআয় বাদ পড়া কয়েক ওয়াক্ত ফরয ছলাত কাযা পড়বে তার জীবনের ৭০ বৎসর পর্যন্ত ছুটে যাওয়া ছলাতের জন্য সম্পূরক হবে। লক্ষীেভী (রাহিমাহুল্লাহ) “আল আসার আল মারফু’আত ফিল আখবারিল মাওযূ’আত” কিতাবে (উক্ত) হাদীছ উল্লেখ করে বলেনঃ (৩১৫ পৃঃ)- আলী আল ক্বারী তার “আল মাওযূ’আতিস সুগরা” ও “আল মাওযূ’আতিল কুবরা” কিতাবে বলেনঃ এটা সুনিশ্চিত বাতিল হাদিস, কেননা এটা ইজমার পরিপন্থী। যেহেতু কোন ইবাদত বহু বৎসর যাবৎ ছুটে যাওয়া ছলাতের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। তাছাড়া আন-নিহায়াহ গ্রন্থের লিখকসহ হিদায়াহ গ্রন্থের অন্যান্য ভাষ্যকারদের উদ্ধৃতি ধর্তব্য নয় কেননা তারা মুহাদ্দিছদের অন্তর্ভুক্ত নয়, আবার (এখানে) কোন হাদীছবেত্তার প্রতি তাঁরা এর সম্বন্ধও করেননি।
শওকানীর “আল-ফাওয়াইদুল মাজমূ’আহ ফিল আহাদীসিল মাওযূ’আহ” কিতাবে এ হাদীছটি উপরোক্ত শব্দের কাছাকাছি শব্দে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেনঃ “নিঃসন্দেহে এটি জাল হাদীছ আমি এটিকে ঐসব কিতাবাদিতে পাইনি যার লিখকগণ তাতে মাউযু হাদীছ সন্নিবেশিত করেছেন। তবে এটা বর্তমান যুগের “সান’আ” শহরের একদল ফকীহদের কাছে প্ৰসিদ্ধি লাভ করেছে আর তাদের অনেকেই এর উপর আমল করতে শুরু করেছে। আমার জানা নেই কে তাদের জন্য এটা বানিয়েছে। আল্লাহ মিথ্যুকদের অপদস্ত করুন।” (উদ্ধৃতি শেষ) ৫৪ পৃষ্ঠা।
অতঃপর লক্ষোভী বলেনঃ আমি হাদীছটি (জাল হওয়া সত্ত্বেও)। দৈনন্দিন নিয়মিত পঠিতব্য অষীফাহ, যিকর ও দু'আর বইসমূহে সংকলন ভিত্তিক ও বিবেক ভিত্তিক প্রমাণাদিসহ দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত শব্দে পাওয়া যায়। তাই তার জাল হওয়ার ব্যাপারে একটি পুস্তিকা রচনা করেছি। যার নাম হচ্ছেঃ (ردع الإخوان عن محدثات آخرجمعة رمضان) উক্ত পুস্তিকায় অনেক উপকারী কথা সন্নিবেশিত করেছি। যার মাধ্যমে মস্তিষ্ক প্রখর হবে এবং যেগুলো কান পেতে শুনার মত। তাই এ নিয়ে অধ্যয়ন করা উচিত যেহেতু এ বিষয়ে তা অতি সুন্দর ও মানগত দিক দিয়ে উন্নত।
আমি (আলাবানী) বলছিঃ ফিকহের কিতাবগুলোতে এ ধরনের বাত্বিল হাদীছ উদ্ধৃত হওয়ায় তাতে বিদ্যমান ঐসব হাদীছের বিশ্বস্তুত হারিয়ে দেয় যেগুলোকে নির্ভরযোগ্য কোন কিতাব এর দিকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়নি। আলী আল কারীর বক্তব্যে একথার প্রতিই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাই মুসলিম ব্যক্তির উচিত হবে হাদীছকে তার শাস্ত্রীয় বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে গ্রহণ করা। তাইতো অতীতের লোকেরা বলেছেনঃ “মক্কাবাসীগণ মক্কার রাস্তাঘাট সম্পর্কে সমধিক জ্ঞাত"। আর "ঘরের মালিক তাতে অবস্থিত জিনিস সম্পর্কে সমধিক অভিজ্ঞ।”
[7] ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) “আলমাজমূ শারহিল মুহাযযাব” এর প্রথম খণ্ডের ৬০ পৃষ্ঠায় বলেন যা সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
আহলুল হাদীছ ও অন্যান্য মুহাক্কিক বিদ্বানগণ বলেনঃ যঈফ হাদীছের ব্যাপারে একথা বলা যাবে না যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন অথবা তিনি করেছেন অথবা আদেশ দিয়েছেন বা নিষেধ করেছেন ইত্যাদি। দৃঢ়তামূলক শব্দসমূহ। বরং এসব ক্ষেত্রে শুধু দুর্বলতামূলক শব্দ যেমন রসূল থেকে বর্ণনা করা হয়েছে বা উদ্ধৃত হয়েছে ইত্যাদি। তারা বলেনঃ দৃঢ়তা জ্ঞাপক শব্দাবলী ছহীহ ও হাসান হাদীছের জন্য প্রযোজ্য আর দুর্বলতা জ্ঞাপক শব্দগুলো অন্যান্য হাদীছের বেলায় প্রযোজ্য। আর তা এজন্য যে, দৃঢ়তা জ্ঞাপক শব্দ সম্বন্ধকৃতের পক্ষ থেকে বিশুদ্ধ হওয়ার দাবী রাখে, তাই বিশুদ্ধ হাদীছ ছাড়া এ শব্দের প্রয়োগ অনুচিত। অন্যথায় মানুষ রাসূলের উপর মিথ্যারোপকারীর শামিল হবে। অথচ এই আদব রক্ষায় মুহাযযাবের লিখকসহ আমাদের (শাফিয়ীদের) ও অন্যান্য মাযহাবের অধিকাংশ ফুকাহাগণ ক্ৰটি করেছেন। বরং ঢালাওভাবে প্রত্যেক শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ এতে ক্ৰটি করেছেন। কেবল হাদীছ শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞগণ এথেকে বেঁচে গেছেন। এটা জঘন্য ধরনের শিথিলতা। কারণ তারা প্রায়ই ছহীহ হাদীছের ক্ষেত্রে বলে থাকে- রাসূল থেকে বর্ণিত হয়েছে, আর যঈফ হাদীছের ক্ষেত্রে বলেন অমুক বর্ণনা করেছেন। এটা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হওারই নামান্তর।
আমি যেহেতু এ বিষয়ে পরিপূর্ণ কোন কিতাবের সন্ধান পাইনি, তাই আমি ইবাদতের ক্ষেত্রে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পথ অনুসরণে আগ্রহী মুসলিম ভাইদের জন্য এমন একটি কিতাব লিখা নিজের উপর অনিবার্য মনে করলাম, যে কিতাবে তাকবীর থেকে সালাম পর্যন্ত যথাসম্ভব নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছলাতের পূর্ণ বিবরণী সন্নিবেশিত হবে যাতে করে সত্যিকার অর্থে যারা নবীপ্ৰেমিক তাদের যে কেউ এ কিতাব খানা পেলে সহজভাবে পূর্বোক্ত হাদীছের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পারে। (হাদীছটি এরূপ)
صلوا كما رأيتموني أصلي
অর্থঃ “তোমরা আমাকে যেমনভাবে ছলাত পড়তে দেখ ঠিক ঐভাবে ছলাত পড়।” এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমি দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করলাম এবং এ সম্পৰ্কীয় হাদীছ মন্থন করতে শুরু করলাম, হাদীছের বিভিন্ন গ্ৰন্থরাজি থেকে। সে চেষ্টারই ফসল হলো (হে পাঠক) আপনার সামনে উপস্থিত এই কিতাবটি। আমি নিজের উপর শর্ত করে নিয়েছি যে, এতে কেবল ঐ হাদীছগুলিই সন্নিবেশিত করব যেগুলির সূত্র হাদীছ শাস্ত্রের ব্যাকরণ ও মূলনীতি অনুসারে সুসাব্যস্ত। আর যে হাদীছ সূত্রের কোন পর্যায়ে অপরিচিত অথবা দুর্বল রাবী একা পড়ে যায় সে হাদীছ আমি প্ৰত্যাখ্যান করেছি। চাই তা অবস্থা বর্ণনার ক্ষেত্রে হোক অথবা যিকর সংক্রান্ত হোক অথবা ফযীলত বা অন্য কোন বিষয়ে হোক। যেহেতু আমি বিশ্বাস করি যে, সুসাব্যস্ত[1] ছহীহ হাদীছই যঈফ হাদীছ ব্যতীত যথেষ্ট। যঈফ হাদীছ নির্বিবাদে কেবল ধারণা বা অপ্রাধান্যযোগ্য ধারণার উপকারিতা দিতে সক্ষম, আর তা আল্লাহর বাণী অনুযায়ী- (لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا) হক থেকে মোটেও অমুখাপেক্ষী করতে পারে না।[2]
নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন-
إياكم والظن فإن الظن أكذب الحديث
অর্থঃ তোমরা ধারণা থেকে বেঁচে চল, কেননা ধারণা হচ্ছে সর্বাধিক মিথ্যা।[3]
তাইতো আল্লাহ পাক আমাদেরকে এর উপর আমল করার জন্য বাধ্য করেননি, বরং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ থেকে আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেনঃ
اتقوا الحديث عني إلا ما علمتم
অর্থঃ তোমরা আমার থেকে কেবল যা জান তা ব্যতীত অন্য কিছু বর্ণনা করা থেকে বিরত থাক। আর যখন তিনি যঈফ হাদীছ বৰ্ণনা করতে নিষেধ করলেন তখন এর উপর আমল করতে নিষেধ করবেন। এটাই অতি স্বাভাবিক।
হাদীছটি ছহীহ আখ্যায়িত করেছেন তিরমিযী, আহমাদ ও ইবনু আবী শাইবাহ। শাইখ মুহাম্মাদ সাঈদ আল-হালাবী স্বীয় গ্ৰন্থ “মুসালসালাতে” এটিকে বুখারীর দিকেও সম্পর্কিত করেছেন। যাতে তিনি প্রমাদে পতিত হয়েছেন। পরবর্তীতে আমার নিকট পরিস্ফুটিত হয়েছে যে, হাদীছটি যঈফ। (পূর্বে) ইবনু আবী শাইবাহর সানাদকে ছহীহ প্ৰতিপন্ন করার ব্যাপারে মানাবীর অনুসরণ করেছিলাম। অতঃপর এর সম্পর্কে নিজের পক্ষেই জানা সহজ হয়ে যায় যে, এটি স্পষ্ট দুর্বল আর এটি স্বয়ং তিরমিযী ও অন্যান্যদের সনদ। দেখুন। আমার কিতাব “সিলসিলাতুল আহাদীছছু ছহীহাহ” (হাদীছ নং ১৭৮৩)-এর স্থলাভিষিক্ত ছহীহ হাদীছটি এই
من حدث عني بحدیث یری آنه کذاب فهو احد الکاذبین رواه مسلم وغیره
যে ব্যক্তি আমার উদ্ধৃতিতে কোন হাদীছ বৰ্ণনা করে যার সম্পর্কে সে জানে (বা ধারণা করা হয়) যে এটি মিথ্যা সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদীদেরই একজন। এটি মুসলিম ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন। দেখুন। আমার কিতাব সিলসিলাতুল আহাদী ছিয যাঈফাহ এর ভূমিকা (প্রথম খণ্ড)। বরং উক্ত হাদীছ থেকে প্রয়োজন মুক্ত করে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর এ বর্ণাটিওঃ
إياكم وكثرة الحديث عني، من قال علي فلا يقولن إلاحقا أوصدقا، فمن قال علي مالم أقل فليتبوأ مقعده من النار (ابن أبي شيبة (٨/٧٦٠) وأحمد وغيرهما، و هو مخرج فی الصحیحة (١٧٥٣)
তোমরা সাবধান হও! আমার থেকে বেশী বেশী হাদীছ বর্ণনা করা থেকে। যে ব্যক্তি আমার উদ্ধৃতিতে কথা বলে সে যেন ন্যায় ও সত্য ছাড়া কিছু না বলে, যে ব্যক্তি আমার উদ্ধৃতিতে এমন কথা বলে যা আমি বলিনি, তবে সে জাহান্নামে তার স্থান নির্ধারণ করে নেয়। এটি সংকলন করেছেন ইবনু আবী শাইবাহ (৮/৭৬০) আহমাদ ও তারা দু’জন ব্যতীত অন্যান্যরা। আর এটি “আছছহীহা”তেও উদ্ধৃত হয়েছে। (১৭৫৩ নং)
আমি এ গ্রন্থটিকে দু’ ভাগে সাজিয়েছিঃ (১) উপরিভাগ (২) নিম্নভাগ। প্রথমটা কোন কিতাবের মূল বক্তব্যের ন্যায়- তাতে হাদীছের শব্দগুলি ও কিতাবের বিশেষ প্রয়োজনীয় বাক্যগুলি সন্নিবেশিত করেছি, আর এগুলিকে তার মানানসই স্থানে প্রয়োগ করেছি, এমনভাবে তার পারস্পরিক মিল বজায় রেখেছি যে, কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ দেখা যায়। হাদীছের বাক্য ও শব্দ যেভাবে হাদীছের কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে তাকে সেভাবেই সযত্নে সংরক্ষণ করেছি। কখনও একাধিক শব্দ থাকলে কোন একটাকে প্রাধান্য দিয়েছি প্রণয়নের বা অন্য কোন সুবিধার্থে। আবার কখনও এর সাথে ভিন্ন শব্দকে সংযোজন করেছি। এই বলে যে, (অপর শব্দে এমনটি রয়েছে) অথবা (অপর বর্ণনায় এমনটি রয়েছে)। ছাহাবাদের যারা হাদীছগুলি বৰ্ণনা করেছেন তাদের যৎসামান্য ছাড়া কারো নাম উল্লেখ করিনি। এমনিভাবে হাদীছ শাস্ত্রের ইমামদের মধ্যে থেকে এর বর্ণনাকারীদের নামও। অনুসন্ধান ও তত্ত্বান্বেষণের সহজতর দিকে লক্ষ করে।
আর দ্বিতীয়াংশটি প্রথমটির ভাষ্যের মত। এতে উপরিভাগে উল্লিখিত হাদীছসমূহের উদ্ধৃতি দিয়েছি, হাদীছের সব ক'টি শব্দ ও সূত্র পথকে উল্লেখ করেছি, তার সূত্র এবং সহযোগী হাদীছের ব্যাপারে ভাল, মন্দ, বিশুদ্ধ, অশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে মন্তব্য ব্যক্ত করেছি, এসব কিছু হাদীছ শাস্ত্রের মূলনীতির আলোকে সম্পাদিত হয়েছে। আর প্রায়ই (হাদীছের) কোন কোন সূত্রপথে এমন সব শব্দ ও বর্ধিত অতিরিক্ত কথা পাওয়া যায় বা অন্য সূত্রপথে মিলে না, এমতাবস্থায় এই শব্দ ও অতিরিক্ত কথাগুলিকে উপরিভাগের সাথে সঙ্গতি বজায় রাখা সম্ভব হলে তা জড়িয়ে দিয়েছি।
এবং লম্বালম্বি দু'টো ব্র্যাকেটের মাঝে স্থাপন করে এ কাজের প্রতি ইঙ্গিত করেছি এভাবে তাতে মূল হাদীছের একক সংকলকের নাম উল্লেখ করিনি। আর এটা ঐ অবস্থার কথা যখন হাদীছের বর্ণনার উৎস শুধু একজন ছাহাবী। অন্যথায় এটাকে স্বতন্ত্র আরেক প্রকার হাদীছ হিসাবে উল্লেখ করেছি। যেমনটি আপনি ছলাতের শুরুতে পঠিতব্য দু'আগুলির ব্যাপারে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখতে পাবেন। এটা একটা কঠিন ও উত্তম কাজ যা এমনভাবে অন্য কিতাবে আপনি পাবেন না। তাই ঐ আল্লাহর জন্যে সব প্রশংসা যার অনুগ্রহে পুণ্যকৰ্মসমূহ সম্পাদিত হয়।
তারপর আমাদের সংকলিত হাদীছ সম্পর্কে উলামাদের মতামত এবং তাদের দলীল উল্লেখ পূর্বক তার পর্যালোচনা ও পক্ষ বিপক্ষামূলক আলোচনা করব। অতঃপর এই প্রক্রিয়ায় উপরে উল্লেখকৃত সঠিক কথা উদ্ধার করবো। কখনও এমন কিছু মাসআলার অবতারণা করবো যে ব্যাপারে স্পষ্ট কোন হাদীছ নাই, বরং তা কেবল গবেষণালব্ধ মাসআলা যা আমার এই কিতাবের বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত নয়।
কিতাবটির নামকরণ করলামঃ “নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছলাত সম্পাদনের পদ্ধতি, তাকবীর থেকে সালাম পর্যন্ত যেন আপনি তা দেখছেন”। আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন একে তার সম্মানিত চেহারার জন্য নিরংকুশভাবে মনোনীত করেন এবং এর মাধ্যমে আমার মু’মিন ভাইদেরকে উপকৃত করেন, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা (প্রার্থনা) মঞ্জুরকারী।
[2] সূরা আন-নাজম ২৮ আয়াত।
[3] বুখারী ও মুসলিম, এটা আমার কিতাব “গায়াতুল মারাম ফী তাখরীজি আহাদীসুল হালাল ওয়াল হারাম” এ উদ্ধৃত হয়েছে হাদীছ নং ৪১২।
কিতাবটির বিষয় যেহেতু নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছলাত সংক্রান্ত নির্দেশনার বর্ণনা দান, তাই স্বভাবতই আমি পূর্বোল্লিখিত কারণে কোন নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুকরণ করবো না। বরং এতে কেবল ঐ হাদীছগুলিই উদ্ধৃত করব যা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে সাব্যস্ত। যেমনটি অতীত ও বর্তমানের।[1] মুহাদ্দিছীনের[2] অনুসৃত পথ।
নিঃসন্দেহে সুন্দর বলেছেন যে ব্যক্তি (নিম্নোক্ত) কথাটি বলেছেন
أهل الحديث هم أهل النبي وإن لم يصحبوا نفسه أنفاسه صحبوا
অর্থঃ আহলুল হাদীছগণ নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আপনজন, তারা যদিও তাঁর সংস্রব পায়নি। তবে তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসের সংস্রব পেয়েছে।[3] অর্থাৎ তারা তাঁর বাণীর সাথী হয়েছে, যে দিকে তাঁর বানী নির্দেশ করে তারা সে দিকে যায়।
আর এজন্যই মাযহাবগত তারতম্য থাকা সত্ত্বেও কিতাবটি হাদীছ ও ফিকহ-এর কিতাবাদিতে বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিক্ষিপ্ত মাসআলাগুলোর সম্মিলন সাধন করবে ইনশাআল্লাহ। বলতে কি এই কিতাবে যে পরিমাণ হক্ কথার সমাহার ঘটেছে অন্য কোন কিতাব বা মাযহাবে ঘটেনি।
আর এই কিতাব অনুযায়ী আমলকারী ইনশাআল্লাহ ঐ সব লোকের অন্তর্ভুক্ত হবেন যাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত করেছেনঃ
لِمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِهِ وَاللَّهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
স্বীয় ইচ্ছায় সেই সত্যের জন্যে যাতে তারা মতভেদ করেছে, আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ প্ৰদৰ্শন করেন।[4]
আমি যখন নিজের জন্য এই নীতি নির্ধারণ করি যে, শুধু বিশুদ্ধ হাদীছ অবলম্বন করব এবং বাস্তবেও এই কিতাবসহ অন্য কিতাবাদিতে এই নীতি অবলম্বন করেছি। যেগুলো অচিরেই মানুষের মাঝে বিস্তার লাভ করবে: ইনশাআল্লাহ তা'আলা। তখন থেকেই আমি একথা জানতাম যে, আমার এই কাজ সব দল ও মাযহাব (এর লোক)-কে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। বরং অচিরেই তাদের কেউ কেউ বা অনেকেই আমার প্রতি আঘাতমূলক কণ্ঠ ও দোষারোপের কলম ছুড়ে মারবে। তবে এতে আমার অসুবিধা নেই। কেননা আমি এটাও জানি যে, সকল মানুষের সন্তুষ্টি লাভ দুর্লভ ব্যাপার। আর নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ
من آرضی الناس بسخط الله و کله الله الی الناس
অর্থঃ যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করার মাধ্যমে মানুষকে সন্তুষ্ট করে আল্লাহ তাকে মানুষের দায়িত্বে অৰ্পণ করেন।[5]
আল্লাহ! কবি কত সুন্দর না বলেছেন
ولست بناج من مقالة طاعن
ولوکنت فی غارعلی جبل وعر
ومن ذا الذی ینجؤمن الناس سالما
ولوغاب عنهم بين خافيتي نسر
তুমি দোষারোপকারীর কথার গ্লানি থেকে নিস্কৃতি পাবেই না, যদিও বা দুৰ্গম পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেও।
আর কে আছে মানবের দোষারোপ থেকে মুক্তি পাওয়ার মত যদিও বা শকুনের ডানার তলে আড়াল হয় না কেন।
আমার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, এই (অনুসৃত) পথটাই হচ্ছে সর্বাধিক সঠিক পথ যার ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাহগণকে আদেশ প্রদান করেছেন এবং রাসূলগণের প্রধান আমাদের নাবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখিয়ে দিয়েছেন। আর এটাই সেই পথ যার অনুসরণ করেছেন ছাহাবা, তাবিঈন ও তৎপরবর্তী সৎ পূর্বসূরীগণ, যাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম চতুষ্টয় যাদের নামে সৃষ্ট মাযহাবসমূহের সাথে আজকের জগতের বেশীরভাগ মুসলিম সম্পর্কযুক্ত। তাদের প্রত্যেকেই সুন্নাহ (হাদীছ) আঁকড়ে ধরা ও তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করার অপরিহার্যতার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন এবং তার বিপরীত যে কোন কথাকে পরিত্যাগ করতেও একমত ছিলেন- সে কথার প্রবক্তা যত বড়ই হোন না কেন, যেহেতু নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মর্যাদা হচ্ছে তাদের তুলনায় অনেক বেশী এবং তাঁর পথ সর্বাধিক সঠিক। তাই আমি তাঁদের পথ ধরে চলেছি, আর তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি এবং হাদীছ আঁকড়ে ধরার ব্যাপারে তাদেরই নির্দেশসমূহ মেনে চলি। যদিও হাদীছটি তাদের কথার বিপরীতও হয়। তাদের এহেন নির্দেশনাবলীই সোজা পথে চলা ও অন্ধ অনুসরণ থেকে বিমুখ হওয়ার ব্যাপারে আমার উপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا
অর্থঃ “যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সাক্ষাতের আশা রাখে সে যেন নেক আমল করে আর স্বীয় প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে অংশিদার না করে।”(সূরা কাহাফ ১১০)
আমি বলছিঃ দ্বিতীয় পন্থাটাই ভাল বরং অপরিহার্য, কেননা প্রথম পন্থটি অনেক বিষয়ে তার বাস্তবতা অসম্ভব হওয়া সত্ত্বেও তাতে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর এই নির্দেশটি প্রতিফলিত হয় না। صلوا كما رأيتموني اصلي অর্থঃ “তোমরা আমাকে যেভাবে ছলাত পড়তে দেখা ঠিক ঐভাবে ছলাত পড়”, কেননা এমতাবস্থায় তার ছলাতে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ছলতের বিপরীত হওয়া অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। অতএব বিষয়টি অনুধাবন করুন।
[2] আবুল হাসনাত লাক্ষনোভী إمام الكلام فيما يتعلق بالقرءة خلف الإمام কিতাবের ১৫৬ পৃষ্ঠায় বলেনঃ যে ব্যক্তি ইনছাফের দৃষ্টিতে চিন্তা করবে এবং কোন রূপ গোড়ামি ব্যতিরেকে ফিকহ ও মূলনীতির সাগরে ডুব দিবে সে সুনিশ্চিতভাবে একথা জানতে পারবে যে, আলিমগণের মতভেদকৃত বেশীরভাগ মৌলিক ও অমৌলিক মাসআলায় অন্যদের তুলনায় মুহাদ্দিছগণের মাযহাবই শক্তিশালী। আমি যখন বিতর্কিত বিষয়ের শাখা প্রশাখায় ঘুরে বেড়াই তখন মুহাদ্দিছদের মাযহাবকে অন্যদের মাযহাব অপেক্ষা অধিকতর ইনছাফভিত্তিক পাই । আল্লাহ তা'আলা কতইনা ভাল করেছেন এবং এর উপরে তাদের কতনা শুকরিয়া-(প্রধান বক্তব্যে একথা এভাবেই এসেছে) আর কেনইবা এমন হবে না? তারা যে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রকৃত উত্তরাধিকারী এবং তাঁর শরীয়তের সত্যিকার প্রতিনিধি। আল্লাহ আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করে হাশর করুন এবং তাদের ভালবাসা ও চরিত্রের উপর রেখে মৃত্যু দান করুন।
[3] হাফিয যিয়াউদ্দীন আল-মাকদিসী তার “ফাযলুল হাদীছ ওয়া আহলিহী” কিতাবে উল্লেখ করেন যে, এর রচয়িতা হচ্ছেন কবি হাসান বিন মুহাম্মদ আল নাসাবী।
[4] সূরা আল-বাকারা ২১৩ আয়াত।
[5] তিরমিযী, কুযাঈ, ইবনু বিশারান ও অপরাপরগণ (বর্ণনা করেছেন)। উক্ত হাদীছ ও তার সূত্রগুলোর উপর “শারহুল আকীদা আত-ত্বহাবিয়্যাহ” কিতাবের হাদীছ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আলোকপাত করেছি। অতঃপর “সিলসিতুল আহাদীস আস-সহীহাহ” ২৩১১ নম্বরেও আলোচনা করেছি এবং বলেছি যে, একে যারা ছাহাবী পর্যন্ত ঠেকিয়েছেন (মাওকুফভাবে বর্ণনা করেছেন) এর ফলে তার কোন ক্ষতি সাধিত হবে না। আর একে ইবনু হিব্বান ছহীহ বলেছেন।
এখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ইমামগণের পক্ষ থেকে যে সব উক্তি আমি সংগ্ৰহ করেছি। তার কিছুটা উল্লেখ করা উপকারী বলে মনে করছি। হয়তোবা যারা তাদের বরং তাঁদের চেয়ে অনেক নিম্নপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের অন্ধ অনুকরণ করে; তাদের জন্য এতে উপদেশ থাকতে পারে।[1] তারা তাদের মাযহাব এবং কথাগুলোকে আসমান থেকে অবতীর্ণ ঐশী বাণীর ন্যায় শক্ত হাতে ধরে রাখে। অথচ, আল্লাহ তা’আলা বলেন:
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ
অর্থঃ তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বিষয়ের অনুসরণ করা, এতদ্ব্যতীত অন্য কোন ওলীর অনুসরণ কর না। তোমরা অল্পই উপদেশ গ্ৰহণ করে থাক।[2]
[2] সূরা আ'রাফ ৩ আয়াত।
ইমামগণের মধ্যে প্রথমেই হলেন ইমাম আবু হানীফা নুমান বিন ছাবিত (রাহিমাহুল্লাহ)। তাঁর সাথীগণ তাঁর অনেক কথা বিভিন্ন ভাষায় বর্ণনা করেছেন, সব কয়টি কথা একটাই বিষয়ের প্রতি নির্দেশ করে, আর তা হচ্ছেঃ হাদীছকে আকড়ে ধরা ও তার বিপক্ষে ইমামগণের কথা পরিহার করা ওয়াজিব। (কথাগুলো হচ্ছে)
(১) إذا صح الحديث فهو مذهبى অর্থঃ হাদীছ বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হলে ওটাই আমার মাযহাব বলে পরিগণিত হবে।[1]
لايحل لأحد أن يأخذ بقولنا ما لم يعلم من أين أخذناه (২)
আমরা কোথা থেকে কথাটি নিলাম এটা না জানা পর্যন্ত কারো জন্য আমাদের কথা গ্ৰহণ করা বৈধ নয়।[2]
অপর বর্ণনায় রয়েছেঃ
حرام على من لم يعرف دليلي أن يفتي بكلامي
অর্থঃ যে আমার কথার প্রমাণ জানে না তার পক্ষে আমার কথার দ্বারা ফতওয়া প্ৰদান করা হারাম। (টীকায় উল্লেখকৃত দ্বিতীয় বর্ণনাটি)
অন্য বর্ণনায় আরো বাড়িয়ে বলেছেনঃ
فإننا بشر، نقول القول اليوم ونرجع عنه غدا
অর্থঃ কেননা আমরা মানুষ, আজ এক কথা বলি, আবার আগামীকাল তা থেকে ফিরে যাই। (টীকায় উল্লেখকৃত তৃতীয় বর্ণনাটি।
অপর বর্ণনায় রয়েছেঃ
ويحك يا يعقوب (هو أبو يوسف) لا تكتب كل ما تسمع منى فإني قد أرى الرأى اليوم واتركه غدا، وأرى الرأى غدا واتركه بعد غد
অর্থঃ এই হতভাগা ইয়াকুব (আবু ইউসুফ) তুমি আমার থেকে যাই শুন তা লিখনা, কেননা আমি আজ এক মত পোষণ করি এবং আগামীকাল তা পরিহার করি, আবার আগামীকাল এক মত পোষণ করি আর পরশুদিন তা পরিত্যাগ করি।[3] (আল। ঈকায গ্রন্থের ৬৫ পৃষ্ঠার টীকা দ্রষ্টব্য)
اذا قلت قولا یخالف کتاب الله تعالی و خبر الرسول صلی الله عليه وسلم فاترکوا قولي (৩)
অর্থঃ যখন আমি এমন কথা বলি যা আল্লাহ তা'আলার কিতাব ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীছ বিরোধী তা হলে তোমরা আমার কথা পরিত্যাগ করবে।[4]
[1] ইবনু আবিদীন এর হাশিয়া ১ম খন্ড ৬৩ পৃষ্ঠা, “রসমিল মুফতী” ১ম খণ্ড ৪র্থ পৃষ্ঠা, ছালিহ আল ফাল্লানীর “ইকাযুল হিমাম” পৃষ্ঠা ৬২, ইবনু আবিদীন ইবনুল হুমামের উস্তায ইবনুশ শাহনা আল কাবীরের “শারহুল হিদায়া” থেকে উদ্ধৃতি করেনঃ
إذا صح الحديث وكان على خلاف المذهب عمل بالحديث ويكون ذلك مذهبه ولا يخرج مقلد عن كونه حنيفا بالعمل به فقد صح ان ابى حنيفة انه قال: إذا صح الحديث فهو مذهبي وقد حكى ذلك الامام ابن عبد البر عن ابى حنيفة وغيره من الأئمة
অর্থঃ যখন হাদীছ বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়ে যাবে আর তা মাযহাবের বিপক্ষে থাকবে তখন হাদীছের উপরেই আমল করা উচিত হবে এবং এটাই তাঁর (ইমামের) মাযহাব বলে বিবেচিত হবে। উক্ত হাদীছের উপর আমল করাটা তাকে হানাফী মাযহাব থেকে বহিষ্কার করবে না। কেননা বিশুদ্ধ সূত্রে ইমাম আবু হানীফা থেকে এসেছে যে, হাদীছ বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হলে এটাই আমার অনুসৃত পথ বলে জানতে হবে। একথা ইমাম ইবনু আব্দিল বার ইমাম আবু হানীফাসহ অন্যান্য ইমামদের থেকেও বর্ণনা করেন।
আমি বলছিঃ এটা হচ্ছে ইমামগণের ইলম ও তাকওয়ার পরিপূর্ণতার বহিঃপ্রকাশ। যাতে তারা একথারই ইঙ্গিত প্ৰদান করছেন যে, তারা সমস্ত হাদীছ আয়ত্ব করতে পারেননি। যে কথা ইমাম শাফিয়ী স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, পরবর্তীতে যার উল্লেখ রয়েছে। তাই কদাচ তাদের নিকট অনাগত অজানা সুন্নাতের বিপরীত কিছু (বচন-আচরণ) পাওয়া যেতে পারে। এজন্যই তাঁরা আমাদেরকে সুন্নাহ্ আকড়ে ধরার এবং এটাকেই তাদের অবলম্বিত পথ (মাযহাব) হিসাবে গণ্য করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা তাদের সবাইকে রহম করুন।
[2] ইবনু আব্দিল বার “আল ইনতিকা ফী ফাযায়েলুস সালাসাতিল আইম্মাতিল ফুকাহা” পৃষ্ঠা ১৪৫, ইবনুল কাইয়্যিম এর “ই’লামুল মুয়াক্কিঈন” (২/৩০৯), ইবনুল আবিদীন “আল বাহরুর রা’ইক” এর টীকায় (৬/২৯৩), “রসমীল মুফতী” পৃষ্ঠা ২৯, ৩২, শা’রানীর “আল মিযান” এ দ্বিতীয় বর্ণনাটি রয়েছে (১/৫৫) আর তৃতীয় বর্ণনা পাওয়া যাবে আব্বাছ আদদূরীর বর্ণনায় ইবনু মাঈন এর “আত-তারীখ” গ্রন্থে (৬/৭৭/১) যুফার থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে। এ ধরনের বর্ণনা ইমাম সাহেবের সাথী যুফার, আবু ইউসুফ এবং আফিয়া ইবনু ইয়াযীদ থেকেও এসেছে “আল-ইকায” পৃষ্ঠা ৫২, ইবনুল কাইয়িম আবু ইউসুফ থেকে একথার বিশুদ্ধতার কথা দৃঢ়তার সাথে বলেছেন। অতিরিক্ত কথাটি যা আবু ইউসুফকে সম্বোধন করে বলেছেন। “আল ইকায” এর ৬৫ পৃষ্ঠার টীকায় ইবনু আব্দিল বার ও ইবনুল কাইয়িম ও অন্যান্যদের থেকে উদ্ধৃত হয়েছে।
আমি বলছিঃ যদি তাদের কথা এমন হয়। এ সব লোকদের ব্যাপারে যারা তাদের কথার দলীল কি সেটা জানে নাই তবে ঐসব লোকদের ব্যাপারে তাদের কি বক্তব্য হতে পারে যারা তাদের (ইমামদের) কথার বিপক্ষে দলীল রয়েছে তা জানার পরেও দলীলের বিপরীত ফাতাওয়া দেয়। অতএব হে পাঠক! বাক্যটি নিয়ে আপনি ভেবে দেখুন, কেননা এ একটি বাক্যই তাকলীদের (অন্ধ অনুসরণের) প্রাচীর ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাইতো কোন এক মুকল্লিদ আলিমকে দলীল না জেনে ইমাম আবু হানীফার কথায় ফতওয়া দানে আমি বাধা প্ৰদান করলে তিনি এটাকে ইমাম সাহেবের কথা বলে অস্বীকার করেন।
[3] আমি বলছিঃ এর কারণ এই যে, ইমাম সাহেব প্রায়ই কিয়াস করে কথা বলতেন, তাই পরবর্তীতে যখন অপর একটি আরো শক্তিশালী কিয়াস প্রকাশ পেয়ে যেত অথবা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীছ তার কাছে পৌছে যেত তখন তিনি এটাই গ্ৰহণ করতেন। আর তার কথা পরিহার করতেন। শা’রানী “আল মিযান” গ্রন্থের ১ম খণ্ড ৬২ পৃষ্ঠায় বলেন যার সংক্ষেপ হচ্ছে এইঃ
আমরা এবং প্রত্যেক ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সম্পর্কে এই বিশ্বাস রাখি যে, যদি তিনি শরীয়ত (হাদীছ) লিপিবদ্ধ হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন আর হাফিযগণ তা একত্রিত করার জন্য বিভিন্ন দেশ ও সীমান্তে ভ্ৰমণ করে তা অর্জন করে ফেলতেন এবং তিনি তা হস্তগত করতে পারতেন তাহলে ইমাম সাহেব এগুলোই গ্ৰহণ করতেন। আর যতসব কিয়াস করেছিলেন তা পরিহার করতেন। ফলে তাঁর মাযহাবেও অন্যান্য মাযহাবের ন্যায় কিয়াস কমে আসত। কিন্তু শরীয়তের দলীল যেহেতু তার যুগে তাবেঈন ও তাবে’ তাবেঈনদের কাছে বিভিন্ন শহর, গ্রাম ও সীমান্তে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে ছিল তাই তার মাযহাবে আবশ্যিকভাবে অন্যান্য ইমামদের চেয়ে বেশী কিয়াসের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তা এই জন্য যে, তিনি তার কিয়াসকৃত মাসআলাগুলোতে স্পষ্ট দলীল পাননি। পক্ষান্তরে অন্যান্য ইমামগণ তার চেয়ে ব্যতিক্রম। কেননা হাদীছ শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ তাঁদের যুগে হাদীছ অন্বেষণ ও সংকলনের কাজ আঞ্জাম দিয়ে ফেলেছিলেন, তাতে শরীয়তের এক হাদীছ অপর হাদীছের ব্যাখ্যা প্ৰদান করেছে। এটাই ছিল তার মাযহাবে কিয়াস বেশী ও অন্যান্যদের মাযহাবে তা কম হওয়ার (মূল) কারণ।
আবুল হাসানাত লক্ষীেভী “আন-নাফিউল কাবীর” গ্রন্থের ১৩৫ পৃষ্ঠায় এতদ সংক্রান্ত বিষয়ের এক বৃহৎ অংশ উদ্ধৃত করেন এবং তার উপর সমর্থনমূলক এবং ব্যাখ্যাদানমূলক টীকা সংযুক্ত করেন। উৎসুক মহল তা পড়ে দেখতে পারেন।
আমি বলছিঃ আবু হানীফা (রহঃ) কর্তৃক অনিচ্ছাকৃতভাবে বিশুদ্ধ হাদীছ বিরোধী কথার পক্ষে যখন এহেন উযর বিদ্যমান, যা নিঃসন্দেহে গ্ৰহণযোগ্য। কেননা আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তাঁর সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপান না। অতএব তাকে কিছু সংখ্যক অজ্ঞ লোক যেভাবে কটাক্ষ করে কথা বলে তা মোটেও বৈধ নয়। বরং তার ব্যাপারে আদব রক্ষা করা ওয়াজিব। কেননা তিনি মুসলিম সমাজের ইমামগণের একজন যাদের দ্বারা এই দীনকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
তাঁর পক্ষ থেকে আমাদের কাছে অমৌলিক মাসআলার ক্ষেত্রে অনেক কিছু পৌছেছে। তিনি ভুল শুদ্ধ যা কিছু বলেছেন সর্বাবস্থায়ই প্রতিদান প্রাপ্ত হবেন। অপরপক্ষে তাঁর ভক্তদেরও উচিত হবে না যে, তারা তার হাদীছ বিরোধী কথাগুলো ধরে থাকবে। কেননা এটা তার মাযহাব নয়। যেমন আপনি এ ব্যাপারে তার কথাগুলো কিছুক্ষণ পূর্বে দেখলেন, তাই বলি (উপরোক্ত লোকদের) একদল হচ্ছে এক প্রান্তে আর অপর দল হচ্ছে অন্য প্রান্তে । অথচ হক বিরাজ করছে উভয় দলের মাঝামাঝিতে। আল্লাহ তা'আলার বাণীঃ
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমাদেরকে এবং ঈমান আনয়নে আমাদের অগ্রণী ভাইদেরকে ক্ষমা কর। আর ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখা না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় তুমি অতি মমতাময় দয়ালু। (সূরা আল-হাশর ১০ আয়াত)
[4] ফাল্লানীর “আল ইকায” গ্রন্থের ৫০ পৃষ্ঠায় তিনি এটাকে ইমাম মুহাম্মদের কথা বলেও উল্লেখ করেন। অতঃপর বলেনঃ এ কথা এবং এ মর্মের অন্য সব বক্তব্য মুজতাহিদের জন্যে নয় কেননা তিনি ইমামদের কথার প্রয়োজন বোধ করেন না। বরং এটি (ইমামের কথাকে দলীলের সঙ্গে মিলিয়ে মানা) মুকাল্লিদ-এর জন্যই প্রযোজ্য।
আমি বলছিঃ এর উপরেই ভিত্তি করে ইমাম শা'রানী “আল মিযান” গ্রন্থের ১ম খণ্ড ২৬ পৃষ্ঠায় বলেছেনঃ তুমি যদি বল, তবে সেই হাদীছকে কী করব যা আমার ইমামের মারা যাওয়ার পর বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়েছে এবং তিনি তা গ্রহণ করেননি। উত্তর হবে এই যে, তোমার পক্ষে ওয়াজিব হবে হাদীছের উপর আমল করা। কারণ তোমার ইমাম যদি এটি পেতেন এবং তা তার কাছে বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়ে যেত। তবে হয়তোবা তিনি এটাই মেনে নেয়ার জন্য তোমাকে নির্দেশ দিতেন। কারণ ইমামগণের প্রত্যেকেই শরীয়তের হাতে বন্দী। যে ব্যক্তি তা মেনে নিল সে দুই হাতে সমস্ত মঙ্গল অর্জন করে ফেলল। আর যে ব্যক্তি বললঃ আমার ইমাম যে হাদীছ গ্ৰহণ করেছেন কেবল সেই হাদীছের উপরেই আমি আমল করব সে ব্যক্তি থেকে অনেক মঙ্গল ছাড়া পড়বে যেমনটি হচ্ছে অনেক মাযহাবের ইমামদের অন্ধ অনুসারীদের বেলায়। তাদের পক্ষে উত্তম ছিল ইমামগণের অছিয়াত অনুযায়ী তাদের পরে যে সব হাদীছ বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়েছে তার উপর আমল করা। কেননা আমাদের বিশ্বাস যে, তারা যদি বেঁচে থাকতেন এবং তাদের ইন্তিকালের পরে যেসব হাদীছ বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়েছে তা পেয়ে যেতেন। তবে অবশ্যই তা গ্রহণ করতেন এবং তার উপরে আমল করতেন। আর যতসব কিয়াস ও কথা তাদের পক্ষ থেকে এসেছে তা পরিহার করতেন।
ইমাম মালিক বিন আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ
إنما أنا بشر آخطیء و أصیب، فانظروا فی رأیي، فکل ما وافق الكتاب والسنة فخذوه، وکل مالم يوافق الکتاب والسنة فاترکوه
অর্থঃ আমি নিছক একজন মানুষ। ভুলও করি শুদ্ধও বলি। তাই তোমরা লক্ষ্য করো আমার অভিমতের প্রতি। এগুলোর যতটুকু কুরআন ও সুন্নাহর সাথে মুলো গ্রহণ কর আর যতটুকু এতদুভয়ের সাথে গর্মিল হয় তা পরিত্যাগ কর।[1]
ليس أحد بعد النبى صلى الله عليه وسلم إلا ويؤخذ من قوله ويترك، إلا النبي صلى الله عليه وسلم (২)
অর্থঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ব্যতীত অন্য যে কোন লোকের কথা গ্ৰহণীয় এবং বর্জনীয় (কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সকল কথা গ্ৰহণীয়)।[2]
(৩) ইবনু অহাব বলেনঃ আমি মালিক (রাহঃ)-কে ‘ওযু তে পদ যুগলের অঙ্গুলিসমূহ খিলাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে শুনেছি তিনি (উত্তরে) বলেনঃ লোকদেরকে তা করতে হবে না। (ইবনু অহাব) বলেনঃ আমি তাকে লোকসংখ্যা কমে আসা পর্যন্ত ছেড়ে রাখলাম। অতঃপর বললাম, আমাদের কাছে এ বিষয়ে হাদীছ রয়েছে, তিনি বললেন, সেটা কী? আমি বললামঃ আমাদেরকে লাইছ ইবনু ছা’য়াদ, ইবনু লহীয়াহ ও আমর ইবনুল হারিছ ইয়াযীদ ইবনু আমর আল মু’য়াফিরী থেকে তিনি আবু আব্দির রহমান আল হুবালী থেকে তিনি আল মুসতাউরিদ বিন শাদ্দাদ আল কুরাশী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ
رایت رسول الله صلى الله عليه وسلم یدلك بخنصره ما بین اصابع رجلیه
অর্থঃ আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে দেখেছি তিনি তাঁর কনিষ্ঠাঙ্গুলি দ্বারা পদযুগলের অঙ্গুলিগুলোর মধ্যভাগ মর্দন করেছেন। এতদশ্রবণে ইমাম মালিক বললেন, এ-তো সুন্দর হাদীছ। আমি এ যাবৎ এটি শুনিনি। পরবর্তীতে তাঁকে জিজ্ঞাসিত হতে শুনেছি তাতে তিনি অঙ্গুলি মর্দনের আদেশ দিতেন।[3]
[2] এটি ইমাম মালিকের কথা হিসেবে পরবর্তীদের কাছে প্ৰসিদ্ধি লাভ করে। তার থেকে বর্ণিত হওয়ার বিশুদ্ধতা ইবনু আব্দিল হাদী সাব্যস্ত করেছেন, “ইরশাদুস সালেক” (১/২২৭)। ইবনু আব্দিল বার ঘটনাটি “আল-জামে’” এর (২/৯১) পৃষ্ঠায় এবং ইবনু হাযম “উসুলুল আহকাম” এর (৬/১৪৫, ১৭৯) পৃষ্ঠায় হাকীম ইবনু উতাইবাহ ও মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেছেন। তাকীউদ্দীন আস সুবকী “আল ফাতওয়া” এর (১/১৪৮) পৃষ্ঠায় ইবনু আব্বাসের কথা হিসাবে উদ্ধৃত করেন যার সৌন্দর্যে তিনি বিমোহিত হন। অতঃপর বলেন, কথাটি (মূলতঃ) ইবনু আব্বাসের কাছ থেকে মুজাহিদ গ্রহণ করেন, আর তাদের দু'জনের কাছ থেকে ইমাম মালিক তা গ্ৰহণ করেন এবং তার কথা বলে তা প্রসিদ্ধি লাভ করে।
আমি বলছিঃ অতঃপর তাদের কাছ থেকে ইমাম আহমাদ এটি গ্রহণ করেন, তাই আবু দাউদ “মাসায়েল ইমাম আহমাদ” গ্রন্থের ২৭৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন, আমি আহমদকে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেনঃ এমন কোন লোক নাই যার সব কথাই গ্রহণযোগ্য কেবল নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ব্যতীত।
[3] ইবনু আবী হাতিম “আলজারহু ওয়াত তা’দীল” গ্রন্থের ভূমিকা (৩১-৩২ পৃঃ)। বাইহাকী এটিকে পূর্ণরূপে “আস-সুনান” গ্রন্থের (১/৮১)-তে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে এ মর্মে অনেক চমৎকার চমৎকার কথা উদ্ধৃত হয়েছে।[1] তাঁর অনুসারীগণ তাঁর এ সব কথায় অধিক সাড়া দিয়েছেন এবং উপকৃতও হয়েছেন। কথাগুলোর মধ্যে রয়েছে।
مامن أحد إلا وتذهب عليه سنة لرسول الله صلى الله عليه وسلم وتعزب عنه، فمهما قلت من قول، أو أصلت من أصل فيه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم خلاف ما قلت، فالقول ماقال رسول الله صلى الله عليه وسلم، وهو قولي
প্রত্যেক ব্যক্তি থেকেই আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কিছু সুন্নাহ গোপন থাকবেই ও ছাড়া পড়বেই। তাই আমি যত কথাই বলেছি অথবা মৌলনীতি উদ্ভাবন করেছি। সেক্ষেত্রে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য পাওয়া গেলে আল্লাহর রাসূলের কথাই হচ্ছে চূড়ান্ত আর এটিই হবে আমার (বরণীয়) কথা।[2]
أجمع المسلمون على أن من استبان له سنة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يحل له أن يدعها لقول أحد
(২) মুসলমানগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যার কাছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ (হাদীছ) পরিষ্কাররূপে প্রকাশ হয়ে যায় তার পক্ষে বৈধ নয় অন্য কারো কথায় তা বর্জন করা।[3]
إذا وجدتم في كتابي خلاف سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فقولوا بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم ودعوا ماقلت. وفي رواية : فاتبعوها، ولا تلتفتوا إلى قول أحد
(৩) তোমরা যখন আমার কিতাবে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ্ বিরোধী কিছু পাবে তখন আল্লাহর রাসূলের সুন্নাতানুসারে কথা বলবে, আর আমি যা বলেছি তা ছেড়ে দিবে। অপর বর্ণনায় রয়েছেঃ তোমরা তারই (সুন্নতেরই) অনুসরণ কর, আর অন্য কারো কথার প্রতি ভ্ৰক্ষেপ করা না।[4]
إذا صح الحديث فهو مذهبي (8)
অর্থঃ হাদীছ বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়ে গেলে এটাই আমার গৃহীত পন্থা (মাযহাব)।[5]
أنتم أعلم بالحديث والرجال مني، فإذا كان الحديث الصحيح، فأعلموني به أي شيء يكون : كوفيا أو بصريا أو شاميا، حتى أذهب إليه إذا کان صحیحا
(৫)আপনারাই[6] হাদীছ বিষয়ে ও তার রিজালের (বর্ণনাকারীদের) ব্যাপারে আমার অপেক্ষা অধিক জ্ঞাত, তাই ছহীহ হাদীছ পেলেই আমাকে জানাবেন চাই তা কুফীদের বর্ণনাকৃত হোক চাই বাছারীর হোক অথবা শামীর (সিরিয়ার) হোক, বিশুদ্ধ হলে আমি তাই গ্ৰহণ করব।
كل مسألة صح فيها الخبر عن رسول الله صلى الله عليه وسلم عند أهل النقل بخلاف ما قلت فأنا راجع عنها فى حياتي وبعد موتي
(৬) যে বিষয়ে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে আমার কথার বিরুদ্ধে হাদীছু বর্ণনাকারীদের নিকট বিশুদ্ধরূপে কোন হাদীছ পাওয়া যাবে আমি আমার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর তা থেকে প্রত্যাবর্তন করলাম।[7]
اذا رأيتمنى أقول قولا وقد صح عن النبي صلى الله عليه وسلم خلافه فاعلموا أن عقلي قد ذهب
(৭) যখন তোমরা দেখবে যে, আমি এমন কথা বলছি। যার বিরুদ্ধে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বিশুদ্ধ হাদীছ রয়েছে। তবে জেনে রেখ যে, আমার বিবেক হারিয়ে গেছে।[8]
كل ماقلت فكان عن النبي صلى الله عليه وسلم خلاف قولي مما يصح فحديث النبى أولى فلا تقلدوني
(৮) আমি যা কিছুই বলেছি তার বিরুদ্ধে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে ছহীহ সূত্রে হাদীছ এসে গেলে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীছই হবে অগ্ৰাধিকারযোগ্য, অতএব আমার অন্ধ অনুসরণ করো না।[9]
كل حديث عن النبي صلى الله عليه وسلم فهو قولي، وإن لم تسمعوه مني
(৯) নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সব হাদীছই আমার বক্তব্য যদিও আমার মুখ থেকে তা না শুনে থাক।[10]
[2] হাকিম স্বীয় অবিচ্ছিন্ন সূত্রে শাফি'ঈ থেকে বর্ণনা করেন যেমন রয়েছে ইবনু আসাকির এর “তারীখে দেমাস্ক” গ্রন্থের (১৫/১/৩ পৃঃ), ইলামুল মুয়াক্কিঈন গ্রন্থে (২/৩৬৩, ৩৬৪ পৃঃ) ও আল ইকায গ্রন্থে (১০০ পৃষ্ঠা)।
[3] ইবনুল কাইয়িম (২/৩৬১), আল ফাল্লানী (৬৮ পূঃ)।
[4] আল হারাবীর “যাম্মুল কালাম” গ্রন্থে (৩/৪৭,১), খতীবের “আল ইহতিজাজু বিশ-শাফেঈ” ইবনু আসাকির (১৫/৯/১), নববীর “আল-মাজমূ” গ্রন্থে (১/৬৩), ইবনুল কাইয়িম (২/৩৬৮), আল ফাললানী (১০০ পৃঃ) অপর বর্ণনাটি আবু নুআইমের “আল-হিলইয়া” গ্রন্থে (৯/১০৭), ইবনু হিব্বানের “আস-সহীহ” গ্রন্থে (৩/২৮৪-ইহসান)। স্বীয় বিশুদ্ধ সনদে ইমাম থেকে তার (আবু নুআইমের) অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
[5] নববীর পূর্বোক্ত কিতাবে, শা’রানী তার গ্রন্থে (১/৫৭ পৃঃ) এটাকে হাকিম বাইহাকীর কথা বলে উল্লেখ করেন। আল ফাল্লানী (১০৭ পৃঃ)।
ইমাম শা’রানীর বলেনঃ হযম বলেন, (বাক্যটির অর্থ) তাঁর নিকট অথবা অন্য কোন ইমামের নিকট (হাদিছটি) বিশুদ্ধ হয়ে গেলে (সেটাই আমার মাযহাব)। আমি বলছিঃ ইমাম সাহেবের সমাগত বাণী সংশ্লিষ্ট কথার পরে স্পষ্টতঃ এই (ইবনু হযমের ব্যাখ্যারই) অর্থই বহন করে।
ইমাম নববীর বক্তব্যের সংক্ষেপ হচ্ছেঃ এই কথার উপর আমাদের সাথীগণ আমল করেছেন ফজরের আযানে “আস সলাতু খাইরুম মিনান নাওম” বলে ছলাতের জন্য মানুষকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান করার বিষয়ে (যার তিনি বিরোধী ছিলেন) এবং ইহরামের অবস্থা থেকে রোগের উযর সাপেক্ষে হালাল হওয়ার শর্তের ব্যাপারে (যে শর্ত তিনি করেছিলেন, অথচ রোগ ছাড়া অন্য কারণেও ইহরাম মুক্ত হওয়ার সপক্ষে হাদীছ এসেছে)। এতদুভয় বিষয় ছাড়াও আরো যা। (তার) মাযহাবের কিতাবসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আমাদের সাথীদের মধ্যে যারা (ইমামের ফাতাওয়ার বিপক্ষে) হাদীছ দ্বারা ফাতাওয়া দিয়েছেন বলে উল্লেখ রয়েছে তারা হচ্ছেনঃ আবু ইয়াকুব আল বুওয়াইত্বী, আবুল কাসিম আদদারিকী, আর যারা (ইমাম সাহেবের এই বাণীকে) আমল দিয়েছেন আমাদের মুহাদ্দিছ সাথীদের মধ্য হতে তারা হচ্ছেনঃ ইমাম আবূ বকর আল বাইহাকী ও অন্যান্যগন। আমাদের পূর্ববর্তীদের একদল এমন ছিলেন যারা কোন বিষয়ে ইমাম শাফিঈর মাযহাবের বিপরীতে হাদীছ পেলে তারা হাদীছের উপরেই আমল করতেন এবং এ দিয়েই ফাতাওয়া প্ৰদান করতেন। আর বলতেনঃ হাদীছের সাথে যা মিলে তাই ইমাম শাফিঈর মাযহাব।
শাইখ আবু আমর বলেন, শাফিঈদের মধ্যে যিনি এমন হাদীছ পান যা স্বীয় মাযহাবের বিরোধিতা করে তখন তিনি ভেবে দেখেন, যদি তাঁর মধ্যে ব্যাপক ইজতিহাদের উপকরণগুলো পরিপূর্ণ থাকে অথবা শুধু এই অধ্যায় বা বিষয়ে তা পাওয়া যায়। তবে হাদীছের উপর আমল করার ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতা রয়েছে। আর যদি তার মধ্যে ইজতিহাদের উপায়-উপকরণগুলো না পাওয়া যায়, আর হাদীছ বিরোধী কাজ তাঁর পক্ষে কঠিন মনে হয়। অথচ খুঁজাখুঁজি করে হাদীছের বিপরীত বক্তব্য পোষণকারীর পক্ষে কোন সমুচিত জওয়াব না পাওয়া যায় তবে ইমাম শাফিঈ ছাড়া অন্য কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ ইমাম যদি এর উপর আমল করে থাকেন তবে তার এটির উপর আমল করার অধিকার রয়েছে। আর এক্ষেত্রে এ নীতি অবলম্বন ইমামের মাযহাব পরিত্যাগের ব্যাপারে ‘উযর’ বলে বিবেচিত হবে। তাঁর এ কথা সুন্দর ও পালনীয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞাত।
আমি বলছিঃ এখানে অপর একটি পরিস্থিতি থেকে গেছে যা ইবনুছ ছালাহ (আবু আমর) উল্লেখ করেননি তা হচ্ছে যখন হাদীছের উপর আমলকারী কাউকে না পাওয়া যায় তখন কী করবে? এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তাকীউদ্দীন সুবকী। তাঁর “মা’না কওলীশ শাফিঈ ... ইযা সাহহাল হাদীছ ...” নামক গ্রন্থে (৩/১০২ পৃঃ) তিনি বলেনঃ আমার নিকট হাদীছ অনুসরণ করাই উত্তম। কেউ ধরে নিক যে, সে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সম্মুখে রয়েছে এবং তার কাছ থেকেই হাদীছ শুনল, তবে কি হাদীছ মান্য করতে দেরী করার কোন অবকাশ থাকবে? আল্লাহর শপথ, থাকবে না। আর প্রত্যেকেই তার বুঝ অনুযায়ী (হাদীছের প্রতি) আমল করতে বাধ্য। উক্ত আলোচনা ও তথ্যের পূর্ণ বিবরণ পাবেন “ই’লামুল মুয়াক্কিঈন” (২/৩০২ ও ৩৭০) এবং ফুল্লানীর কিতাব যার নাম
إيقاظ همم أولي الأبصار للإقتداء بسيد المهاجرين والأنصار وتحذيرهم عن الإبتداع الشائع في القرى والأمصار من تقليد المذاهب مع الحمية والعصبية بين فقهاء الأعصار
) কিতাবটি স্বীয় অধ্যায়ে অতুলনীয়। প্রত্যেক সত্য প্রিয় ব্যক্তির কর্তব্য অনুধাবন ও গবেষণামূলক মানসিকতা নিয়ে এটি পাঠ করা।
[6] সম্বোধনটি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে করেছেন, কথাটি ইবনু আবি হাতিম “আদাবুশ শাফিঈ” গ্রন্থের ৯৪-৯৫ পৃষ্ঠাতে বর্ণনা করেন, আবু নুআইম “আল হিলইয়া” গ্রন্থের (৯/১/০৬)। খতীব “আল ইহতিজাজ বিশ-শাফিঈ” গ্রন্থের (৮/১) খাতীব থেকে ইবনু আসাকির তার গ্রন্থে (১৫/৯/১) পৃষ্ঠা ইবনু আব্দিল বার “আল ইনতিকা” গ্রন্থে পৃষ্ঠা ৭৫। ইবনুল জাউযী “মানাকিব ইমাম আহমাদ” পৃষ্ঠা ৪৯৯ ও আল-হারাবী তার গ্রন্থের (২/৪৭/২) পৃষ্ঠাতে তিনটি সূত্র পথ দিয়ে আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল থেকে তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, শাফিয়ী তাকে (কথাটি) বলেছেন। সুতরাং কথাটি তাঁর থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত। এজন্যেই ইমাম সাহেবের দিকে এর সম্বন্ধকে সুদৃঢ়ভাবে সাব্যস্ত করেন ইবনুল কাইয়িম “আল-ই’লাম” গ্রন্থের (২/৩২৫) পৃষ্ঠা এবং আল ফুল্লানী “আল-ইকায” এর ১৫২ পৃষ্ঠায়। কথাটি উল্লেখ করতঃ বলেনঃ বাইহাকী বলেন, এজন্যই তাঁর (ইমাম শাফি'ঈর) দ্বারা বেশী হাদীছ গ্ৰহণ সম্ভব হয়, তিনি হিজায, সিরিয়া, ইয়ামন ও ইরাকবাসীকে জমায়েত করেন, তার কাছে যে হাদীছই বিশুদ্ধ সাব্যস্ত হয়েছে তাই গ্ৰহণ করেছেন। এতে কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব করেননি এবং তাঁর স্বদেশী মাযহাবের মিষ্টি কথার দিকে ধাবিত হননি। যখনই তিনি অন্য কারো নিকট হক প্রকাশিত পেয়েছেন তখনই তা গ্ৰহণ করেছেন। তাঁর পূর্বে যারা ছিলেন তাদের কেউ কেউ স্বজাতীয় ও স্বদেশীয় মাযহাবের জানা কথার উপরেই আমল সীমাবদ্ধ রাখেন, এর বিপরীত বিষয়ের বিশুদ্ধতা জানার চেষ্টা করেননি, আল্লাহ আমাদেরকে ও তাদেরকে ক্ষমা করুন।
[7] আবু নুআইম তাঁর “আল-হিলইয়া” গ্রন্থে (৯/১০৭ পৃঃ), আল হারাবী তার গ্রন্থের (১/৪৭ পৃঃ), ইবনুল কাইয়িম “ইলামুল মুয়াক্কিঈন” গ্রন্থের (২/৩৬৩ পৃঃ), আল ফুল্লানী (১০৪ পৃঃ)।
[8] ইবনু আবী হাতিম “আদাবুশ শাফেঈ” গ্রন্থে (৯৩ পৃঃ), আবুল কাসিম আস সামার কান্দি “আল-আমালী” তে, আরো রয়েছে আবু হাফছ আল মুআদ্দাব এর “আল মুনতাকী মিনহা” (১/২৩৪)-তে আবু নুআইম “আল-হিলইয়া” (৯/১০৬ পৃঃ), ইবনু আসাকির (১৫/৯/২) বিশুদ্ধ সনদে।
[9] ইবনু আবী হাতিম (৯৩, পৃঃ), আবু নুআইম ও ইবনু আসাকির (১৫/৯/২) বিশুদ্ধ
সনদে।
[10] ইবনু আবী হাতিম। এর (৯৩-৯৪ পৃঃ)।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ইমামগণের মধ্যে সর্বাধিক হাদীছ সংগ্ৰহকারী এবং তা বাস্তবে রূপায়ণকারী ছিলেন। তাই তিনি শাখা প্রশাখামূলক কথা ও মতামত সম্বলিত কিতাব লিখা অপছন্দ করতেন।[1]
তিনি বলেন,
لاتقلدنی، ولا تقلد مالکا ولا الشافعی ولا الاوزاعی ولا الثوري، وخذ من حيث أخذوا
(১) তুমি আমার অন্ধ অনুসরণ করো না; মালিক, শাফিয়ী, আওযায়ী, ছাউরী এদেরও কারো অন্ধ অনুসরণ করো না বরং তারা যেখান থেকে (সমাধান) গ্ৰহণ করেন তুমি সেখান থেকেই তা গ্রহণ করা।[2]
وفى رواية : لاتقلد دينك أحدا من هؤلاء، ماجاء عن النبي صلى الله عليه وسلم وأصحابه فخذ به ثم التابعين بعد الرجل فيه مخير
অপর বর্ণনা রয়েছেঃ তোমরা দীনের ব্যাপারে এদের কারো অন্ধ অনুসরণ করবে না। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবাদের থেকে যা কিছু আসে তা গ্ৰহণ কর, অতঃপর তাবিয়ীদের। তাদের পরবর্তীদের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির জন্য যে কারো থেকে গ্ৰহণ করার স্বাধীনতা রয়েছে। আবার কোন সময় বলেছেন, অনুসরণ হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবাদের থেকে যা আসে তার অনুসরণ করবে। অতঃপর তাবিয়ীদের পর থেকে সে (যে কারো অনুসরণে) স্বাধীন থাকবে।[3]
رأي الأوزاعي، ورأي مالك، ورأي أبي حنيفة كله رأي، وهو عندي سواء وانما الحجة فى الاثار
(২) আওযায়ী, মালিক ও আবু হানীফা প্রত্যেকের মতামত হচ্ছে মতামতই এবং আমার কাছে তা সমান (মূল্য রাখে), প্রমাণ রয়েছে কেবল হাদীছের ভিতর।[4]
من رد حدیث رسول الله صلى الله عليه وسلم فهو علی شفا هلکة
(৩) যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীছ প্রত্যাখ্যান করলো সে ধ্বংসের তীরে উপনীত।[5]
এসবই হল ইমামগণ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর বক্তব্যসমূহ যাতে হাদীছের উপর আমল করার ব্যাপারে নির্দেশ রয়েছে এবং অন্ধভাবে তাদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ রয়েছে। কথাগুলো এতই স্পষ্ট যে, এগুলো কোন তর্ক বা ব্যাখ্যার অপেক্ষাই রাখে না।
অতএব যে ব্যক্তি ইমামদের কিছু কথার বিরুদ্ধে গেলেও সকল সুসাব্যস্ত হাদীছ আঁকড়ে ধরবেন তিনি ইমামদের মাযহাব বিরোধী হবেন না এবং তাদের তরীকা থেকে বহিষ্কৃতও হবেন না। বরং তিনি হবেন তাদের প্রত্যেকের অনুসারী। আরো হবেন, শক্ত হাতল মজবুতভাবে ধারণকারী, যে হাতল ছিন্ন হবার নয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শুধু ইমামদের বিরোধিতা করার কারণে সুসাব্যস্ত হাদীছ প্রত্যাখ্যান করে তার অবস্থা এমনটি নয়, বরং সে এর মাধ্যমে তাদের অবাধ্য হল এবং তাদের পূর্বোক্ত কথাগুলোর বিরোধিতা করল। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থঃ তোমার প্রতিপালকের শপথ-তারা ঈমানদার হতে পারবে না। যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদ নিরসনে তোমাকে বিচারক মানবে, অতঃপর তোমার মীমাংসায় নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা অনুভব করবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে মেনে নিবে।[6]
তিনি আরো বলেনঃ
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থঃ তাই যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন ভীতিগ্ৰস্ত থাকে (কুফর, শিরক বা বিদআত দ্বারা) ফিৎনায় আক্রান্ত হওয়ার অথবা যন্ত্রণাদায়ক শান্তি প্ৰাপ্ত হওয়ার ব্যাপারে।[7]
হাফিয ইবনু রাজাব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যার কাছেই নাবী (ছাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ পৌছে যায় এবং তিনি তা বুঝতে পারেন। তাহলে তার উপর এটাকে উম্মতের জন্য বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া ও তাদের মঙ্গল কামনা করা এবং তার নির্দেশ পালন করার আদেশ প্ৰদান করা ওয়াজিব যদিও তা উম্মতের বিরাট কোন ব্যক্তিত্বের বিরোধী হয়। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ যে কোন বড় ব্যক্তির মতামত অপেক্ষা অধিক শ্রদ্ধা ও অনুসরণযোগ্য, যিনি (বড় ব্যক্তিত্ব) ভুলবশত কোন কোন ক্ষেত্রে নাবীর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করেন। এজন্যেই ছাহাবাগণ ও তৎপরবর্তী লোকেরা ছহীহ হাদীছের বিরুদ্ধাচরণকারীর প্রতিবাদ করেছেন।
বরং কখনও প্রতিবাদে কঠোরতাও পোষণ করেছেন।[8] বিদ্বেষ নিয়ে নয় বরং তিনি তাদের অন্তরের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন তাঁদের নিকট আরও প্রিয়তম এবং তাঁর আদেশ সব সৃষ্টিকুলের উর্ধে। তাই যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও অন্য কারো আদেশের মধ্যে বৈপরিত্য দেখা দিবে তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ প্রাধান্য পাওয়ার ও অনুসরণের অধিক যোগ্য হবে।
তবে এ নীতি নবীর বিপরীত প্রমাণিত কথার প্রবক্তার (মুজতাহিদের) বেলায় নয়, যেহেতু তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত[9] কারণ তিনি তাঁর নির্দেশের বিরোধীতাকে অপছন্দ করেন না। যখন তার বিপরীতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ প্রকাশ পেয়ে যায়।[10]
আমি বলছিঃ কিভাবেইবা তারা এটাকে অপছন্দ করবেন। অথচ তারা স্বীয় অনুসারীদেরকে এ বিষয়ে আদেশ প্রদান করেন, যেমনটি পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে এবং তারা অনুসারীদের উপর ওয়াজিব করেন নিজেদের কথাকে সুন্নাতের মোকাবিলায় পরিহার করতে। বরং ইমাম শাফি'ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সাথীদেরকে আদেশ দেন যে, তারা যেন বিশুদ্ধ হাদীছকে তাঁর দিকে সম্বন্ধ করে, যদিওবা তিনি এটি গ্রহণ করেননি। অথবা এর বিপরীত মত পোষণ করেন।
এ জন্যই তত্ত্ববিদ ইবনু দাকীকিল ঈদ (রাহিমাহুল্লাহ) সেসব বিষয়গুলো একত্রিত করেন যাতে চার ইমামের মাযহাবই বিশুদ্ধ হাদীছের বিরোধিতা করেছে- এককভাবে বা যৌথভাবে, এবং তা এক বৃহৎ খণ্ডে লিপিবদ্ধ করেছেন। তার শুরুতে তিনি বলেনঃ মুজতাহিদ ইমামগণের দিকে এ সমস্ত বিষয়ের সম্বন্ধ করা হারাম, তাদের অন্ধ অনুসারী ফকীহদের কর্তব্য হবে এগুলো জানা, যাতে ইমামগণের দিকে এসবের সম্বন্ধ জড়িয়ে তাদের প্রতি মিথ্যারোপ না করতে হয়।[11]
[2] আল ফাল্লানী (১১৩ পৃঃ), ইবনুল কাইয়িম “আল-ই’লাম” এর (২/৩০২ পৃঃ)।
[3] আবু দাউদ এর “মাসায়েল ইমাম আহমাদ” (২৭৬-২৭৭ পৃঃ)
[4] ইবনু আব্দিল বার “আল-জামে” এর (২/১৪৯)
[5] ইবনুল জাওযী (১৮২ পৃঃ)
[6] সূরা আন-নিসা ৬৫ আয়াত।
[7] সূরা আন-নূর ৬৩ আয়াত।
[8] আমি বলছিঃ যদিও সেই কঠোরতা স্বীয় পিতা ও উলামাদের বিরুদ্ধেও হয়। যেমন ইমাম ত্বাহাবী “শারহু মা’আনীল আসার” কিতাবে (১/৩৭২ পৃঃ) বর্ণনা করেন, আবু ইয়া'লা তার “মুসনাদ” গ্রন্থে (৩/১৩১৭ পৃঃ আল-মাকতাবুল ইসলামী প্রকাশনীর) উত্তম সনদে সালিম বিন আদিল্লাহ বিন উমর থেকে বর্ণনা করেন যার রাবীগণ বিশ্বস্ত । তিনি বলেন, আমি ইবনু উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে মসজিদে বসেছিলাম, হঠাৎ তার কাছে সিরিয়ার এক লোক আগমন করে এবং তাঁকে তামাত্তু হজ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। ইবনু উমর বললেনঃ এই প্রকার হজ্জ ভাল ও সুন্দর; লোকটি বললঃ আপনার পিতাও এই হজ্জ থেকে নিষেধ করতেন। ইবনু উমর বললেনঃ তোমার ধ্বংস হোক! আমার পিতা যদিও এ হজ্জ থেকে নিষেধ করেছেন কিন্তু নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এটা করেছেন এবং এর আদেশ দিয়েছেন, তুমি কি আমার পিতার কথা গ্রহণ করবে নাকি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ? লোকটি বলল- রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশই শিরোধার্য হবে। তখন তিনি বললেনঃ তুমি আমার কাছ থেকে উঠে চলে যাও। (আহমাদ হাঃ ৫৭০০)। এই অর্থে হাদীছ বর্ণনা করেন, (তিরমিযী ২/৮২ ভাষ্য, তুহফাতুল আহওয়াজীসহ) এবং তিনি একে ছহীহ বলেছেন, ইবনু আসাকির (৭/৫১/১) ইবনু আবি যি’ব থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেনঃ সা’দ বিন ইবরাহীম (অর্থাৎ আব্দুর রহমান বিন আওফের ছেলে) এক ব্যক্তির উপর রাবী'আহ বিন আবি আব্দির রহমান এর মত দ্বারা ফায়ছালা প্ৰদান করেন, আমি তাঁকে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে তার ফায়ছালার বিপক্ষে হাদীছ শুনলাম, তাতে সা'দ রাবী’আহিকে বললেনঃ এ হচ্ছে ইবনু আবি যি'ব সে আমার কাছে বিশ্বস্ত। সে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে আপনার ফায়ছালার বিরুদ্ধে হাদীছ পেশ করছে, রাবী'আহ তাকে বললেনঃ আপনি ইজতিহাদ করেছেন এবং আপনার ফায়ছালা প্ৰদানও সম্পন্ন হয়েছে, তখন সা’দ বললেনঃ কি আশ্চর্য আমি সা’দের ফায়ছালা বাস্তবায়ন করব। আর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ফায়ছালা বাস্তবায়ন করব না? বরং সা'দের মায়ের ছেলে সা’দ এর ফায়ছালাকে প্রত্যাখ্যান করব। আর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ফায়ছালা বাস্তবায়ন করব। এই বলে সা’দ বিচারাপত্ৰ হাজির করতে বলেন এবং তা ছিড়ে ফেলেন। আর যার বিরুদ্ধে ফায়ছালা দিয়েছিলেন তার পক্ষে রায় প্রদান করেন।
[9] আমি বলছিঃ বরং তিনি প্রতিদান প্রাপ্ত হবেন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণীঃ হাকিম (শাসক) যদি ইজতিহাদ করে ফায়ছালা প্ৰদান করেন আর তা সঠিক হয় তবে তার জন্য দু'টি প্রতিদান। আর যদি ইজতিহাদ করে ফায়াছালা প্ৰদান করেন এবং তাতে ভুল করে ফেলেন তবে তার জন্য একটি প্রতিদান। (বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য)
[10] “ই’কাযুল হিমাম” এর টীকায় তা উদ্ধৃত করেন (৯৩ পৃষ্ঠা)।
[11] আল ফাল্লানী (৯৯ পৃঃ)
পূর্বোল্লিখিত কারণ সাপেক্ষে ইমামগণের অনুসারীদের-
وَقَلِيلٌ مِنَ الْآخِرِينَ ٭ عَلَىٰ سُرُرٍ مَوْضُونَةٍ
পূর্ববর্তদের অধিক সংখ্যক এবং পরবর্তদের অল্প সংখ্যক[1] লোক স্বীয় ইমামদের সব কথা গ্ৰহণ করতেন না। বরং তাদের অনেক কথাই তারা বাদ দিয়েছেন যখন সুন্নাহ বিরোধী বলে সাব্যস্ত হয়েছে। এমনকি ইমামদ্বয় মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ও আবু ইউসুফ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁদের শাইখ আবু হানীফার (রহঃ) প্রায় এক তৃতীয়াংশ মাযহাব-এ বিরোধিতা করেছেন।[2] ফিকহের কিতাবগুলোই একথার বর্ণনার জন্য যথেষ্ট ।
এ ধরনের কথা ইমাম মুযানী[3] ও ইমাম শাফিঈর অন্যান্য অনুসারীদের বেলায়ও প্রযোজ্য। আমরা যদি এর উপর দৃষ্টান্ত পেশ করতে যাই তবে কথা দীর্ঘ হয়ে যাবে এবং এই বইয়ে আমি সংক্ষেপস্থানের যে উদেশ্য পোষণ করেছি তা থেকেও বেরিয়ে পড়ব ।
তাই দুটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হবঃ
১। ইমাম মুহাম্মদ তাঁর “মুওয়াত্তা”[4] গ্রন্থে বলেন (১৫৮ পৃঃ) আবু হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) ইসতিস্কার কোন ছলাত আছে বল মনে করতেন না। তবে আমার কথা হচ্ছে যে, ইমাম লোকজনকে নিয়ে দুরাকাআত ছলাত পড়বেন, অতঃপর দুআ করবেন এবং স্বীয় চাদর পাল্টাবেন শেষ পর্যন্ত।
২। ইছাম বিন ইউসুফ আল বালখী যিনি ইমাম মুহাম্মদ এর সাথী ছিলেন[5] এবং ইমাম আবু ইউসুফ এর সংশ্রবে থাকতেন[6] তিনি ইমাম আবু হানীফার কথার বিপরীত অনেক ফাতাওয়া প্ৰদান করতেন, কেননা (আবু হানীফা) যেগুলোর দলীল জানতেন না অথচ তার কাছে অন্যদের দলীল প্ৰকাশ পেয়ে যেত, তাই সেমতেই ফাতাওয়া দিয়ে দিতেন।[7] তাই তিনি রুকুতে গমনকালে ও রুকু থেকে উঠার সময় হস্তযুগল উত্তোলন (রফউল ইয়াদাইন) করতেন।[8] যেমনটি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে মুতাওয়াতির বর্ণনায় এসেছে। তাঁর তিন ইমাম কর্তৃক এর বিপরীত বক্তব্য তাকে এ সুন্নাত মানতে বাধা দেয়নি। এই নীতির উপরেই প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তিকে অটল থাকা ওয়াজিব, তার ইমাম ও অন্যান্যদের সাক্ষ্য দ্বারা এটাই ইতিপূর্বে প্রতীয়মান হয়েছে।
সারকথাঃ আমি আশা করব কোন মুকাল্লিদ (ভাই) তাড়াহুড়া করে এই কিতাবে অনুসৃত পন্থার উপর আঘাত হানবেন না এবং স্বীয় মাযহাবের বিরোধিতার অজুহাত পেশ করে এতে সন্নিবেশিত সুনান (হাদীছ) সমূহের উপর আমল পরিত্যাগ করবেন না।
বরং আমি আশা করি তিনি আবশ্যকীয়ভাবে সুন্নাত প্রতিপালনে ও ইমামদের সুন্নাত বিরোধী কথা পরিত্যাগের ব্যাপারে পূর্বোল্লিখিত ইমামদের উক্তিগুলো স্মরণ করবেন। জানা উচিত যে, এই পদ্ধতির (দৃষ্টিভঙ্গির) উপর অপবাদ হানা অন্ধভাবে অনুসৃত ইমামের উপরেই অপবাদ হানার নামান্তর, তিনি যে ইমামই হোন, কেননা আমি এই পদ্ধতি তাদের (ইমামদের) থেকেই গ্ৰহণ করেছি, যেমন ইতিপূর্বে তার বর্ণনা অতিবাহিত হল। তাই যে ব্যক্তি এই পথে তাদের থেকে দিক নির্দেশনা গ্ৰহণ না করল সে মহাবিপদের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হল। কেননা তা সুন্নাত থেকে বিমুখ হওয়াকে নিশ্চিত করে, অথচ মতানৈক্যের ক্ষেত্রে হাদীছ অনুসরণ করতে এবং তার উপর ভরসা রাখতে আমরা আদিষ্ট হয়েছি। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থঃ তোমার রবের শপথ তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদে তোমাকে বিচারক মেনে নিবে, অতঃপর তোমার মীমাংসায় নিজেদের অন্তরে কোনরূপ সংকীর্ণতা পোষণ করবে না, এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিবে।[9]
আল্লাহ্র কাছে দু’আ করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন যাদের ব্যাপারে তিনি বলেছেনঃ
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ٭ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
অর্থঃ মুমিনদেরকে যখন তাদের মধ্যে বিচার মীমাংসার জন্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তাদের বক্তব্য এই হওয়া উচিত যে, তারা বলবেঃ আমরা শুনলাম এবং মানলাম আর তারাই হচ্ছে সফলকাম। আর যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে, আর আল্লাহকে ভয় করে ও তার শাস্তির বিষয়ে আতঙ্কিত থাকে তারাই কৃতকার্য[10]
[2] ইবনু আবিদীন “আল-হাশিয়া” এর (১/১৬২ পৃঃ), লক্ষনোভী “আন-নাফিউল কাবীর” (৯৩ পৃঃ), উক্ত কথার সম্বন্ধ গাযালীর দিকে করেছেন।
[3] তিনি তার শাফেঈ ফিকহ সংক্ষেপায়ন “মুখতাসার ফী ফিকহিশ শাফেঈ” গ্রন্থের শুরুতে বলেন, যা ইমাম শাফিঈর গ্ৰন্থ “আল-উম্ম” এর টীকায় ছাপানো হয়েছে। কথাটি হচ্ছে, আমি এই কিতাবটি সংক্ষেপ করেছি। মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস আশশাফি'ঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ইলম থেকে এবং তার কথার মর্ম নিয়ে যাতে করে আগ্রহী ব্যক্তির নিকটবর্তী করে দিতে পারি। সাথে সাথে জানিয়ে দিয়েছি ইমাম সাহেব কর্তৃক তাঁর বা অন্য কারো অন্ধ অনুসরণের নিষেধাজ্ঞার কথা যাতে করে সে তার দ্বীনের ব্যাপারে বিবেচনা করতে পারে এবং তার ব্যাপারে নিজের সার্থেই সতর্কতা অবলম্বন করতে পারে।
[4] তিনি এই গ্রন্থে প্রায় বিশটা বিষয়ে স্বীয় ইমামের বিরোধিতা করেন, এর স্থানগুলোর প্রতি (পৃষ্ঠা উল্লেখ করতঃ) ইঙ্গিত করে দিচ্ছি- ৪২, ৪৪, ১০৩, ১২০, ১৫৮, ১৬৯, ১৭২, ১৭৩, ২২৮, ২৩০, ২৪০, ২৪৪, ২৭৪, ২৭৫, ২৮৪, ৩১৪, ৩৩১, ৩৩৮, ৩৫৫, ৩৫৬, মুওয়াত্বা মুহাম্মদ এর টীকা “আত-তা’লীকুল মুমাজ্জাদ আলা মুওয়াত্তা মুহাম্মাদ” থেকে সংগৃহীত।
[5] তার কথা ইবনু আবিদীন তার “আল-হাশিয়া” তে উল্লেখ করেন (১/৭৪) ও “রসমুল মুফতী” গ্রন্থে (১/১৭) কুরাশী এটিকে “আল জাওয়াহিরুল মুযীয়াহ কী তবাকাতিল হানাফিয়াহ” (৩৪৭ পৃঃ)-তে উল্লেখ করেন এবং বলেনঃ তিনি হাদীছের অনুসারী বিশ্বস্ত লোক ছিলেন, তিনি ও তাঁর ভাই ইবরাহীম স্বীয় যুগে বলখের দুই শাইখ ছিলেন।
[6] আল-ফাওয়াইদুল বাহীইয়াহ কী তারাজিমিল হানাফিয়াহ
[7] “আল-বাহরুর রা’ইক” (৬/৯৩), রসমুল মুফতী (১/২৮ পৃঃ)
[8] “আল ফাওয়াইদ” (১১৬ পৃঃ) অতঃপর সুন্দর টীকা সংযোজন করে বলেনঃ আমি বলছি, এ থেকে জানা গেল আবু হানীফা (রহঃ) থেকে মাকহুলের এ বর্ণনাটির বাতিল হওয়ার কথা যাতে রয়েছেঃ যে ব্যক্তি ছলাতে রাফউল ইয়াদাইন করবে তার ছলাত বিনষ্ট হবে। এ সেই বর্ণনা যেটি নিয়ে আমীর কাতিব আল ইতকানী বিভ্রান্ত হয়েছেন। যেমনটি তার জীবনীতে বর্ণিত হয়েছে। কেননা ইছাম বিন ইউসুফ আবু ইউসুফ এর সহচরবৃন্দের অন্তর্ভুক্ত হয়েও তিনি রাফউল ইদাইন করতেন। অতএব যদি এই বর্ণনার কোন ভিত্তি থাকত তবে আবু ইউসুফ ও ইছাম তা জানতেন। তিনি বলেনঃ এ থেকে আরো জানা যায় যে, যদি কোন হানাফী কোন এক বিষয়ে স্বীয় ইমামের মাযহাব পরিত্যাগ করে প্রতিপক্ষের দলীল শক্তিশালী হওয়ার ভিত্তিতে- তবে এর কারণে তিনি তাঁর তাকলীদ থেকে বেরিয়ে পড়েন না। বরং তা হবে তাকলীদ পরিহারের রূপধারী প্রকৃত তাকলীদ। তুমি কি দেখনা ইছাম বিন ইউসুফ তিনি রাফউল ইয়াদাইন না করার ব্যাপারে আবু হানীফার মাযহাব পরিত্যাগ করেন। তার পরেও তাকে হানাফী গণনা করা হয়? তিনি বলেন, অভিযোগ আল্লাহর কাছেই পেশ করছি আমাদের যুগের অজ্ঞ লোকদের ব্যাপারে। কারণ কেউ শক্তিশালী দলীলের ভিত্তিতে ইমামের একটি মাসআলা পরিহার করলে তারা তাকে দোষারোপ করে। এমনকি মাযহাব থেকে বহিষ্কার করে দেয়। তবে তারা যেহেতু সাধারণ পাবলিক তাই তাদের ব্যাপারে আশ্চর্যের কিছু নেই, আশ্চর্য হতে হয় তাদের বেলায় যারা উলামাদের বেশ ধরেও তাদের (অজ্ঞদের) চালচলনের মত চালচলন প্রদর্শন করে যেন চতুস্পদ জন্তু।
[9] সূরা আন-নিসা ৬৫ আয়াত।
[10] সূরা আন-নূর ৫১-৫২ আয়াত।
এসব সংশয়ের জবাব দেয়া হচ্ছে এজন্য যে, দশ বৎসর পূর্বে অত্র কিতাবের ভূমিকায় যা লিখেছিলাম। এই অল্প সময়েই আমি মুসলিম যুব সমাজে দীন ও ইবাদতের ক্ষেত্রে ইসলামের স্বচ্ছ প্রস্রবণ কুরআন ও হাদীছের দিকে প্রত্যাবর্তন করা অপরিহার্য হওয়ার দিশা দানে তার চমৎকার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। আলহামদুলিল্লাহ তাদের মধ্যে সুন্নাহ মান্যকারী এবং এর মাধ্যমে ইবাদতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তারা এই আদর্শে পরিচিতিও লাভ করে ফেলেছে। তবে অন্যদিকে তাদের কিছু সংখ্যককে আবার সুন্নাহ অনুসরণ করা থেকে থেমে থাকতে দেখেছি। আর এমনটি হয়েছে সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশমূলক আয়াত ও ইমামগণের উক্তিসমূহ উল্লেখ করার পর উক্ত নীতির অপরিহার্যতার ব্যাপারে সন্দেহ বশতঃ নয় বরং কিছু মুকাল্লিদের মাশাইখদের কাছ থেকে শ্ৰুত সংশয়ের ভিত্তিতে। তাই আমি সেগুলো উল্লেখ করে তার সমুচিত জবাব দানের প্রয়োজনীয়তা বোধ করি এই আশায় যে, তারাও সুন্নাহ অনুসরণকারীদের সাথে যোগ দিয়ে তার উপর আমল শুরু করে দিবেন। এবং এতে করে তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছায় মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন।
প্ৰথম সংশয়ঃ তাদের কেউ কেউ বলেন, আমাদের ধর্মীয় ব্যাপারে আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদর্শ মেনে নেওয়া নিঃসন্দেহে ওয়াজিব। বিশেষ করে নিছক ইবাদতের ক্ষেত্রে গবেষণা ও মতামতের কোন সুযোগ নেই। কেননা এগুলো শুধু দলীল নির্ভর বিষয় যেমন ছলাত, কিন্তু আমি মুকাল্লিদ শাইখদের কারো নিকট থেকে এই বিষয়ে আদেশ দিতে শুনিনি। বরং তাদেরকে দেখেছি তারা মতভেদকে স্বীকার করেন এবং এটাকে জাতির পক্ষে সুবিধাজনক ব্যাপার বলে ধারণা করেন। তারা এর স্বপক্ষে দলীল হিসাবে একটি হাদীছ পেশ করেন যেটিকে প্রায়ই তারা এরকম পরিস্থিতি সামনে আসলে সুন্নতের ঝাণ্ডা বাহীদের প্রতিবাদে আওড়িয়ে থাকে। যা হচ্ছে- اختلاف أمتى رحمة অর্থাৎ- আমার উম্মতের মতানৈক্য রাহমাতস্বরূপ। আমরা দেখছি যে, এ হাদীছ আপনি যে পথের দিকে দাওয়াত দিচ্ছেন তার এবং আপনার অত্র গ্রন্থসহ অন্যান্য গ্রন্থাদির বিরোধিতা করছে। অতএব এ হাদীছ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
উত্তর, দু’ভাবে হবেঃ
প্ৰথম উত্তরঃ হাদীছটি বিশুদ্ধ নয়, বরং তা বাত্বিল, তার কোন ভিত্তি নেই। আল্লামা সুবকী বলেন, আমি এ হাদীছের সূত্র পাইনি- না ছহীহ, না যাঈফ, না জাল হাদীছ।
আমি বলছিঃ বরং এ শব্দে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
....اختلاف أصحابي لكم رحمة
অর্থঃ ... আমার ছাহাবাদের মতভেদ তোমাদের জন্যে রাহমাত।
اصحابي کالنجوم فبأيهم اقتدیتم اهتدیتم
অর্থঃ “আমার ছাহাবাগণ তারকারাজির ন্যায়, তাদের যাকেই তোমরা অনুসরণ করবে। হিদায়াত পেয়ে যাবে।” এই উভয় বাক্যই বিশুদ্ধ নয়, প্রথমটি মারাত্মক দুর্বল, আর দ্বিতীয়টি জাল। আমি সব ক'টিকে “সিলসিলাতুল আহাদীস আয-যঈফা ওয়াল মাওযূ’আহ” গ্রন্থের ৫৮-৫৯, ৬১ নম্বরে যাচাই করে দেখেছি।
দ্বিতীয় উত্তরঃ হাদীছটি যঈফ হওয়ার সাথে সাথে তা কুরআন বিরোধীও বটে। কেননা মতবিরোধ থেকে বিরত ও ঐকমত্য থাকার ব্যাপারে আদেশ সংক্রান্ত আয়াত এত বেশী প্রসিদ্ধ যে, তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তবে দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু উল্লেখ করা যায়। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ
অর্থঃ আর তোমরা পরস্পরে বিবাদ কর না, তাহলে অকৰ্মান্য হয়ে পড়বে। এবং তোমাদের শক্তি হারিয়ে যাবে।[1] তিনি আরো বলেনঃ
وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ - مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
অর্থঃ আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে না। যারা তাদের দীনে বিভেদ সৃষ্টি করেছে আর নিজেরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত।[2]
তিনি আরো বলেনঃ
وَلَا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ إِلَّا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ
অর্থঃ তোমার পালনকর্তা যাদেরকে আঁনুগ্রহ করেন তারা ব্যতীত অন্যান্যরা সর্বদা মতভেদ করতেই থাকবে।[3]
তোমার প্রতিপালক তাদেরকে অনুগ্রহ করেন যারা মতভেদ করে না, সুতরাং বুঝা গেল। যারা বাত্বিলপন্থী তারাই মতভেদ করে। তবে কোন বিবেক বলবে যে, মতভেদ রাহমাত?
অতএব সাব্যস্ত হল যে, এ হাদীছ বিশুদ্ধ নয়, না সনদের (সূত্রের) দিক দিয়ে আর না মাতনের (শব্দের) দিক দিয়ে।[4] এখনি পরিষ্কার হয়ে গেল যে, এ হাদীছকে সংশয়ের উৎস বানানো বৈধ নয়- কুরআন হাদীছের উপর আমল বন্ধ রাখার জন্য যে ব্যাপারে ইমামগণও আদেশ দিয়েছেন।
[2] সূরা আর রুম ৩১-৩২ আয়াত।
[3] সূরা হুদ ১১৮-১১৯ আয়াত।
[4] যে ব্যক্তি বিস্তারিত জানতে চান এব্যাপারে তার পক্ষে উপরোক্ত গ্রন্থাদি পড়া উচিত।