লগইন করুন
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ইমামগণের মধ্যে সর্বাধিক হাদীছ সংগ্ৰহকারী এবং তা বাস্তবে রূপায়ণকারী ছিলেন। তাই তিনি শাখা প্রশাখামূলক কথা ও মতামত সম্বলিত কিতাব লিখা অপছন্দ করতেন।[1]
তিনি বলেন,
لاتقلدنی، ولا تقلد مالکا ولا الشافعی ولا الاوزاعی ولا الثوري، وخذ من حيث أخذوا
(১) তুমি আমার অন্ধ অনুসরণ করো না; মালিক, শাফিয়ী, আওযায়ী, ছাউরী এদেরও কারো অন্ধ অনুসরণ করো না বরং তারা যেখান থেকে (সমাধান) গ্ৰহণ করেন তুমি সেখান থেকেই তা গ্রহণ করা।[2]
وفى رواية : لاتقلد دينك أحدا من هؤلاء، ماجاء عن النبي صلى الله عليه وسلم وأصحابه فخذ به ثم التابعين بعد الرجل فيه مخير
অপর বর্ণনা রয়েছেঃ তোমরা দীনের ব্যাপারে এদের কারো অন্ধ অনুসরণ করবে না। নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবাদের থেকে যা কিছু আসে তা গ্ৰহণ কর, অতঃপর তাবিয়ীদের। তাদের পরবর্তীদের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির জন্য যে কারো থেকে গ্ৰহণ করার স্বাধীনতা রয়েছে। আবার কোন সময় বলেছেন, অনুসরণ হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর ছাহাবাদের থেকে যা আসে তার অনুসরণ করবে। অতঃপর তাবিয়ীদের পর থেকে সে (যে কারো অনুসরণে) স্বাধীন থাকবে।[3]
رأي الأوزاعي، ورأي مالك، ورأي أبي حنيفة كله رأي، وهو عندي سواء وانما الحجة فى الاثار
(২) আওযায়ী, মালিক ও আবু হানীফা প্রত্যেকের মতামত হচ্ছে মতামতই এবং আমার কাছে তা সমান (মূল্য রাখে), প্রমাণ রয়েছে কেবল হাদীছের ভিতর।[4]
من رد حدیث رسول الله صلى الله عليه وسلم فهو علی شفا هلکة
(৩) যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীছ প্রত্যাখ্যান করলো সে ধ্বংসের তীরে উপনীত।[5]
এসবই হল ইমামগণ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম)-এর বক্তব্যসমূহ যাতে হাদীছের উপর আমল করার ব্যাপারে নির্দেশ রয়েছে এবং অন্ধভাবে তাদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ রয়েছে। কথাগুলো এতই স্পষ্ট যে, এগুলো কোন তর্ক বা ব্যাখ্যার অপেক্ষাই রাখে না।
অতএব যে ব্যক্তি ইমামদের কিছু কথার বিরুদ্ধে গেলেও সকল সুসাব্যস্ত হাদীছ আঁকড়ে ধরবেন তিনি ইমামদের মাযহাব বিরোধী হবেন না এবং তাদের তরীকা থেকে বহিষ্কৃতও হবেন না। বরং তিনি হবেন তাদের প্রত্যেকের অনুসারী। আরো হবেন, শক্ত হাতল মজবুতভাবে ধারণকারী, যে হাতল ছিন্ন হবার নয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শুধু ইমামদের বিরোধিতা করার কারণে সুসাব্যস্ত হাদীছ প্রত্যাখ্যান করে তার অবস্থা এমনটি নয়, বরং সে এর মাধ্যমে তাদের অবাধ্য হল এবং তাদের পূর্বোক্ত কথাগুলোর বিরোধিতা করল। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থঃ তোমার প্রতিপালকের শপথ-তারা ঈমানদার হতে পারবে না। যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদ নিরসনে তোমাকে বিচারক মানবে, অতঃপর তোমার মীমাংসায় নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা অনুভব করবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে মেনে নিবে।[6]
তিনি আরো বলেনঃ
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থঃ তাই যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন ভীতিগ্ৰস্ত থাকে (কুফর, শিরক বা বিদআত দ্বারা) ফিৎনায় আক্রান্ত হওয়ার অথবা যন্ত্রণাদায়ক শান্তি প্ৰাপ্ত হওয়ার ব্যাপারে।[7]
হাফিয ইবনু রাজাব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, যার কাছেই নাবী (ছাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ পৌছে যায় এবং তিনি তা বুঝতে পারেন। তাহলে তার উপর এটাকে উম্মতের জন্য বিশদভাবে বর্ণনা করে দেয়া ও তাদের মঙ্গল কামনা করা এবং তার নির্দেশ পালন করার আদেশ প্ৰদান করা ওয়াজিব যদিও তা উম্মতের বিরাট কোন ব্যক্তিত্বের বিরোধী হয়। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ যে কোন বড় ব্যক্তির মতামত অপেক্ষা অধিক শ্রদ্ধা ও অনুসরণযোগ্য, যিনি (বড় ব্যক্তিত্ব) ভুলবশত কোন কোন ক্ষেত্রে নাবীর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করেন। এজন্যেই ছাহাবাগণ ও তৎপরবর্তী লোকেরা ছহীহ হাদীছের বিরুদ্ধাচরণকারীর প্রতিবাদ করেছেন।
বরং কখনও প্রতিবাদে কঠোরতাও পোষণ করেছেন।[8] বিদ্বেষ নিয়ে নয় বরং তিনি তাদের অন্তরের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হলেন তাঁদের নিকট আরও প্রিয়তম এবং তাঁর আদেশ সব সৃষ্টিকুলের উর্ধে। তাই যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও অন্য কারো আদেশের মধ্যে বৈপরিত্য দেখা দিবে তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ প্রাধান্য পাওয়ার ও অনুসরণের অধিক যোগ্য হবে।
তবে এ নীতি নবীর বিপরীত প্রমাণিত কথার প্রবক্তার (মুজতাহিদের) বেলায় নয়, যেহেতু তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত[9] কারণ তিনি তাঁর নির্দেশের বিরোধীতাকে অপছন্দ করেন না। যখন তার বিপরীতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ প্রকাশ পেয়ে যায়।[10]
আমি বলছিঃ কিভাবেইবা তারা এটাকে অপছন্দ করবেন। অথচ তারা স্বীয় অনুসারীদেরকে এ বিষয়ে আদেশ প্রদান করেন, যেমনটি পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে এবং তারা অনুসারীদের উপর ওয়াজিব করেন নিজেদের কথাকে সুন্নাতের মোকাবিলায় পরিহার করতে। বরং ইমাম শাফি'ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সাথীদেরকে আদেশ দেন যে, তারা যেন বিশুদ্ধ হাদীছকে তাঁর দিকে সম্বন্ধ করে, যদিওবা তিনি এটি গ্রহণ করেননি। অথবা এর বিপরীত মত পোষণ করেন।
এ জন্যই তত্ত্ববিদ ইবনু দাকীকিল ঈদ (রাহিমাহুল্লাহ) সেসব বিষয়গুলো একত্রিত করেন যাতে চার ইমামের মাযহাবই বিশুদ্ধ হাদীছের বিরোধিতা করেছে- এককভাবে বা যৌথভাবে, এবং তা এক বৃহৎ খণ্ডে লিপিবদ্ধ করেছেন। তার শুরুতে তিনি বলেনঃ মুজতাহিদ ইমামগণের দিকে এ সমস্ত বিষয়ের সম্বন্ধ করা হারাম, তাদের অন্ধ অনুসারী ফকীহদের কর্তব্য হবে এগুলো জানা, যাতে ইমামগণের দিকে এসবের সম্বন্ধ জড়িয়ে তাদের প্রতি মিথ্যারোপ না করতে হয়।[11]
[2] আল ফাল্লানী (১১৩ পৃঃ), ইবনুল কাইয়িম “আল-ই’লাম” এর (২/৩০২ পৃঃ)।
[3] আবু দাউদ এর “মাসায়েল ইমাম আহমাদ” (২৭৬-২৭৭ পৃঃ)
[4] ইবনু আব্দিল বার “আল-জামে” এর (২/১৪৯)
[5] ইবনুল জাওযী (১৮২ পৃঃ)
[6] সূরা আন-নিসা ৬৫ আয়াত।
[7] সূরা আন-নূর ৬৩ আয়াত।
[8] আমি বলছিঃ যদিও সেই কঠোরতা স্বীয় পিতা ও উলামাদের বিরুদ্ধেও হয়। যেমন ইমাম ত্বাহাবী “শারহু মা’আনীল আসার” কিতাবে (১/৩৭২ পৃঃ) বর্ণনা করেন, আবু ইয়া'লা তার “মুসনাদ” গ্রন্থে (৩/১৩১৭ পৃঃ আল-মাকতাবুল ইসলামী প্রকাশনীর) উত্তম সনদে সালিম বিন আদিল্লাহ বিন উমর থেকে বর্ণনা করেন যার রাবীগণ বিশ্বস্ত । তিনি বলেন, আমি ইবনু উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে মসজিদে বসেছিলাম, হঠাৎ তার কাছে সিরিয়ার এক লোক আগমন করে এবং তাঁকে তামাত্তু হজ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। ইবনু উমর বললেনঃ এই প্রকার হজ্জ ভাল ও সুন্দর; লোকটি বললঃ আপনার পিতাও এই হজ্জ থেকে নিষেধ করতেন। ইবনু উমর বললেনঃ তোমার ধ্বংস হোক! আমার পিতা যদিও এ হজ্জ থেকে নিষেধ করেছেন কিন্তু নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এটা করেছেন এবং এর আদেশ দিয়েছেন, তুমি কি আমার পিতার কথা গ্রহণ করবে নাকি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশ? লোকটি বলল- রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশই শিরোধার্য হবে। তখন তিনি বললেনঃ তুমি আমার কাছ থেকে উঠে চলে যাও। (আহমাদ হাঃ ৫৭০০)। এই অর্থে হাদীছ বর্ণনা করেন, (তিরমিযী ২/৮২ ভাষ্য, তুহফাতুল আহওয়াজীসহ) এবং তিনি একে ছহীহ বলেছেন, ইবনু আসাকির (৭/৫১/১) ইবনু আবি যি’ব থেকে বর্ণনা করেন তিনি বলেনঃ সা’দ বিন ইবরাহীম (অর্থাৎ আব্দুর রহমান বিন আওফের ছেলে) এক ব্যক্তির উপর রাবী'আহ বিন আবি আব্দির রহমান এর মত দ্বারা ফায়ছালা প্ৰদান করেন, আমি তাঁকে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে তার ফায়ছালার বিপক্ষে হাদীছ শুনলাম, তাতে সা'দ রাবী’আহিকে বললেনঃ এ হচ্ছে ইবনু আবি যি'ব সে আমার কাছে বিশ্বস্ত। সে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে আপনার ফায়ছালার বিরুদ্ধে হাদীছ পেশ করছে, রাবী'আহ তাকে বললেনঃ আপনি ইজতিহাদ করেছেন এবং আপনার ফায়ছালা প্ৰদানও সম্পন্ন হয়েছে, তখন সা’দ বললেনঃ কি আশ্চর্য আমি সা’দের ফায়ছালা বাস্তবায়ন করব। আর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ফায়ছালা বাস্তবায়ন করব না? বরং সা'দের মায়ের ছেলে সা’দ এর ফায়ছালাকে প্রত্যাখ্যান করব। আর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ফায়ছালা বাস্তবায়ন করব। এই বলে সা’দ বিচারাপত্ৰ হাজির করতে বলেন এবং তা ছিড়ে ফেলেন। আর যার বিরুদ্ধে ফায়ছালা দিয়েছিলেন তার পক্ষে রায় প্রদান করেন।
[9] আমি বলছিঃ বরং তিনি প্রতিদান প্রাপ্ত হবেন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণীঃ হাকিম (শাসক) যদি ইজতিহাদ করে ফায়ছালা প্ৰদান করেন আর তা সঠিক হয় তবে তার জন্য দু'টি প্রতিদান। আর যদি ইজতিহাদ করে ফায়াছালা প্ৰদান করেন এবং তাতে ভুল করে ফেলেন তবে তার জন্য একটি প্রতিদান। (বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য)
[10] “ই’কাযুল হিমাম” এর টীকায় তা উদ্ধৃত করেন (৯৩ পৃষ্ঠা)।
[11] আল ফাল্লানী (৯৯ পৃঃ)