স্বালাতে মুবাশ্‌শির আবদুল হামীদ ফাইযী ২৯৫ টি
স্বালাতে মুবাশ্‌শির আবদুল হামীদ ফাইযী ২৯৫ টি

মহান আল্লাহর অনুগ্রহে ‘স্বালাতে মুবাশ্‌শির’-এর দ্বিতীয় খন্ড পাঠকের হাতে উপস্থিত হল। তার জন্য তাঁর দরবারে লাখো শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। দ্বীনের অন্যতম খুঁ টির একটি কাঠামো পেশ করতে পেরে আমি নিজেকে যেমন ধন্য মনে করছি, তেমনি আশা করছি দুআ ও সওয়াব লাভের।

কেবল সহীহ হাদীসকে ভিত্তি করেই, অধিক ক্ষেত্রে কে কি বলেছেন তা উল্লেখ না করেই কেবল সহীহ দিকটা তুলে ধরেছি আমার এই পুস্তিকায়। মানুষের মনে সহীহ শিক্ষার চেতনা ও বাসনার কথা খেয়াল রেখেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। আল্লাহ যেন তা কবুল করেন, তাই আমার কামনা।

বিভিন্ন বিতর্কিত মাসায়েলে আমি বর্তমান বিশ্বের প্রধান ৩টি রত্ন; বর্তমান বিশ্বের অদ্বিতীয় মুহাদ্দিস আল্লামা শায়খ মুহাম্মাদ নাসেরুদ্দ্বীন আলবানী, আল্লামা শায়খ ইবনে বায এবং আল্লামা ও ফকীহ্‌ শায়খ ইবনে উষাইমীন (রাহিমাহুমুল্লাহু জামীআন)গণের হাদীস লব্ধ ও সহীহ দলীল ভিত্তিক মতকে প্রাধান্য দিয়েছি। আর এ কথা অবশ্যই প্রমাণ করে যে, আমি তাঁদের প্রত্যেকের; বরং প্রত্যেক হ্‌ক-সন্ধানী রব্বানী আলেমের ভক্ত ও অনুরক্ত। তা বলে কারো অন্ধভক্ত নই। পক্ষান্তরে প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য অধিকারীর অধিকার সঠিকরুপে আদায় করা। উলামার যথার্থ কদর করা। প্রত্যেক হ্‌ক-সন্ধানীর অনুরক্ত হওয়া; যদিও বা তাঁদের কোন কোন অভিমত আমার-আপনার বুঝের অনুকূল নয়। বলা বাহুল্য, খাঁটি সোনা স্বর্ণকারই চিনতে পারে; স্বর্ণ-ব্যবসায়ী নয়।

‘নামায’ ইসলামের প্রধান ইবাদত। ‘নামায’ শব্দটি ফারসী, উর্দু , হিন্দী ও আমাদের বাংলা ভাষায় আরবী ‘সালাত’ অর্থেই পরিপূ র্ণ রুপে ব্যবহৃত বলেই আমি ‘সালাত’-এর স্থানে ‘নামায’ই ব্যবহার করেছি। তাছাড়া বাংলাভাষীর অধিকাংশ মানুষ ‘সালাত’ শব্দটির সাথে পরিচিত নয়। তাই পরিচিত ও প্রসিদ্ধ শব্দই ব্যবহার করতে আমি প্রয়াস পেয়েছি। আর এতে শরয়ী কোন বাধাও নেই। সুতরাং এ বিষয়ে সুহৃদ পাঠকের কাছে আমার ইজতিহাদী কৈফিয়ত পেশ করে সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

বিনীত

আব্দুল হামীদ আল-মাদানী

আল-মাজমাআহ সঊদীআরব

প্রয়োজনের তাকীদে যা কিছু লিখি, সবই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। আল্লাহ যেন তা আমাকে দান করেন এবং কাল কিয়ামতে এরই অসীলায় আমাকে, আমার শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা ও ওস্তাযগণকে, আর এ বই-এর উদ্যোক্তা, প্রকাশক ও সকল আমলকারী পাঠককে তাঁর মেহ্‌মান-খানা বেহেশ্তে স্থান দেন। আমীন।

আমল ও ইবাদত শুদ্ধ-অশুদ্ধ এবং তাতে সওয়াব পাওয়া-না পাওয়ার কথা নিয়তের উপর নির্ভরশীল। নিয়ত শুদ্ধ হলে আমল শুদ্ধ; নচেৎ না। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যাবতীয় আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির তা-ই প্রাপ্য হয়, যার সে নিয়ত করে থাকে। যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব কোন বিষয় লাভের উদ্দেশ্যে হয়, সে ব্যক্তির তা-ই প্রাপ্য হয়। যার হিজরত কোন মহিলাকে বিবাহ্‌ করার উদ্দেশ্যে হয়, তার প্রাপ্যও তাই। যে যে নিয়তে হিজরত করবে সে তাই পেয়ে থাকবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১নং)

নাম নেওয়া লোক দেখানো, কোন পার্থিব স্বার্থলাভ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে কোন আমল করা এক ফিতনা; যা কানা দাজ্জালের ফিতনা অপেক্ষা বড় ও অধিকতর ভয়ঙ্কর । একদা সাহাবীগণ কানা দাজ্জালের কথা আলোচনা করছিলেন। ইত্যবসরে আল্লাহর রসূল (ﷺ) বের হয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, “ আমি কি তোমাদেরকে এমন (ফিতনার) কথা বলে দেব না, যা আমার নিকট কানা দাজ্জালের ফিতনার চেয়ে অধিকতর ভয়ানক?” সকলে বললেন, ‘অবশ্যই হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “ তা হল গুপ্ত শির্ক; লোকে নামায পড়তে দাঁড়ালে তার প্রতি অন্য লোকের দৃষ্টি খেয়াল করে তার নামাযকে আরো সুন্দর বা বেশী করে পড়তে শুরু করে।” (ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, বায়হাকী, সহিহ তারগিব ২৭নং)

বলাবাহুল্য, আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভ ছাড়া অন্য কোন স্বার্থলাভের উদ্দেশ্যে কোনও আমল করলে গুপ্ত শির্ক করা হয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “সুতরাং দুর্ভোগ সেই সকল নামাযীদের, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন। যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে এবং গৃহ্‌স্থালির প্রয়োজনীয় ছোটখাটো সাহায্য দানে বিরত থাকে।” (কুরআন মাজীদ ১০৭/-)

জ্ঞাতব্য যে, প্রত্যেক ইবাদাত কবুল হওয়ার মূল বুনিয়াদ হল তাওহীদ।

অতএব মুশরিকের কোন ইবাদাত গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন প্রত্যেক ইবাদত মঞ্জুর হওয়ার জন্য মৌলিক শর্ত হল দু’টি; নিয়তের ইখলাস বা বিশুদ্ধচিত্ততা এবং মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর তরীকা, যা সহীহ হাদীসে বর্ণিত।

১। নামাযীকে প্রকৃত মুসলিম হতে হবে
২। জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। (পাগল বা জ্ঞানশূন্য হবে না)
৩। বিবেকসম্পন্ন হতে হবে। (সাত বছরের নিম্ন বয়সী শিশু হবে না)
৪। (ওযু-গোসল করে) পবিত্র হতে হবে
৫। নামাযের সঠিক সময় হতে হবে
৬। শরীরের লজ্জাস্থান আবৃত হতে হবে
৭। শরীর, পোশাক ও নামাযের স্থান থেকে নাপাকী দূর করতে হবে
৮। কিবলার দিকে মুখ করতে হবে
৯। মনে মনে নিয়ত করতে হবে

১। (ফরয নামাযে) সামথ্য হলে কিয়াম (দাঁড়ানোর সময় দাঁড়িয়ে নামায পড়া)
২। তাকবীরে তাহ্‌রীমা
৩। (প্রত্যেক রাকআতে) সূরা ফাতিহা
৪। রুকু
৫। রুকু থেকে উঠে খাড়া হওয়া
৬। (সাষ্টাঙ্গে) সিজদাহ
৭। সিজদাহ থেকে উঠে বসা
৮। দুই সিজদার মাঝে বৈঠক
৯। শেষ তাশাহহুদ
১০। তাশাহহুদের শেষ বৈঠক
১১। উক্ত তাশাহ্‌হুদে নবী (ﷺ) এর উপর দরুদ পাঠ
১২। দুই সালাম
১৩। সমস্ত রুকনে ধীরতা ও স্থিরতা
১৪। আরকানের মাঝে তরতীব ও পর্যায়ক্রম।

১। তাকবীরে তাহ্‌রীমা ছাড়া সমস্ত তাকবীর
২। রুকুর তাসবীহ্‌
৩। (ইমাম ও একাকী নামাযীর জন্য) ‘সামিআল্লাহু লিমানহামিদাহ্‌’ বলা
৪। (সকলের জন্য) ‘রাব্বানা অলাকালহাম্‌দ’ বলা
৫। সিজদার তাসবীহ্‌
৬। দুই সিজদার মাঝে দুআ
৭। প্রথম তাশাহহুদ
৮। তাশাহহুদের প্রথম বৈঠক।

হিজরতের পূর্বে নবুওয়াতের ১২ অথবা ১৩তম বছরে শবে-মি’রাজে সপ্ত আসমানের উপরে সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রসূলের সাক্ষাতে (বিনা মাধ্যমে) নামায ফরয হয়। প্রত্যহ্‌ ৫০ ওয়াক্তের নামায ফরয হলে হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত জিবরীল (আঃ) এর পরামর্শমতে মহানবী (ﷺ) আল্লাহ তাআলার নিকট কয়েকবার যাতায়াত করে নামায হাল্কা করার দরখাস্ত পেশ করলে ৫০ থেকে ৫ অক্তে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু আল্লাহর কথা অনড় বলেই ঐ ৫ ওয়াক্তের বিনিময়ে ৫০ ওয়াক্তেরই সওয়াব নামাযীরা লাভ করে থাকেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৫৮৬৪নং)

নামায ফরয হওয়ার গোড়াতে (৪ রাকআতবিশিষ্ট নামাযগুলো) দু’ দু’ রাকআত করেই ফরয ছিল। পরে যখন নবী (ﷺ) মদ্বীনায় হিজরত করলেন, তখন (যোহ্‌র, আসর ও এশার নামাযে) ২ রাকআত করে বেড়ে ৪ রাকআত হল। আর সফরের নামায হল ঐ প্রথম ফরমানের মুতাবেক। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ১৩৪৮ নং)

মহান আল্লাহ বলেন,

اُتْلُ مَا أُوْحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلاَةَ، إِنَّ الصَّلاَةَ تَنْهى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ، وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَر

অর্থাৎ, তুমি তোমার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট গ্রন্থ পাঠ কর এবং যথাযথভাবে নামায পড়। নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে। আর অবশ্যই আল্লাহর যিক্‌র (স্মরণই) সর্বশ্রেষ্ঠ। (কুরআন মাজীদ ২৯/৪৫)

নামায মুমিনের চক্ষুকে শীতল করে, তার যাবতীয় ছোট ছোট গুনাহ বা লঘু ও উপপাপকে মোচন করে দেয়। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “কি অভিমত তোমাদের, যদি তোমাদের কারো দরজার সামনেই একটি নদী থাকে এবং সেই নদীতে সে প্রত্যহ্‌ পাঁচবার গোসল করে, তার শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে কি? সকলে বলল, ‘না, তার শরীরে কোন ময়লা অবশিষ্ট থাকবে না।’ তিনি বললেন, “অনুরুপই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের উপমা। ঐ নামাযসমূহের ফলেই (নামাযীর) সমস্ত গুনাহকে আল্লাহ মোচন করে দেন।” (বুখারী ৫২৮নং, মুসলিম ৬৬৭নং, তিরমিযী, নাসাঈ)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “কাবীরাহ্‌ গুনাহ না করলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমুআহ থেকে অপর জুমুআহ -এর মধ্যবর্তীকালে সংঘটিত পাপসমূহের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত)।” (মুসলিম ২৩৩নং, তিরমিযী, প্রমুখ)

হযরত আবু উসমান (রাঃ) বলেন, একদা একটি গাছের নিচে আমি সালমান (রাঃ) এর সাথে (বসে) ছিলাম। তিনি গাছের একটি শুষ্ক ডাল ধরে হিলিয়ে দিলেন। এতে ডালের সমস্ত পাতাগুলি ঝড়ে গেল। অত:পর তিনি বললেন, ‘হে আবু উসমান! তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না কি যে, কেন আমি এরুপ করলাম?’ আমি বললাম, ‘কেন করলেন?’ তিনি বললেন, ‘ একদা আমিও আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সাথে গাছের নিচে ছিলাম। তিনি আমার সামনে অনুরুপ করলেন; গাছের একটি শুষ্ক ডাল ধরে হিলিয়ে দিলেন। এতে তার সমস্ত পাতা খসে পড়ল। অতঃপর বললেন, “হে সালমান! তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না কি যে, কেন আমি এরুপ করলাম?” আমি বললাম, কেন করলেন? তিনি উত্তরে বললেন, “মুসলিম যখন সুন্দরভাবে ওযু করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে তখন তার পাপরাশি ঠিক ঐভাবেই ঝরে যায় যেভাবে এই পাতাগুলো ঝরে গেল। আর তিনি এই আয়াত পাঠ করলেন,

وَأَقِمِ الصَّلاَةَ طَرَفَىِ النَّهَارِ وَزُلَفاً مِّنَ اللَّيْلِ، إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّآتِ، ذلِكَ ذِكْرى لِلذَّاكِرِيْنَ

অর্থাৎ, আর তুমি দিনের দু’ প্রান্তভাগে ও রাতের প্রথামাংশে নামায কায়েম কর। পুণ্যরাশি অবশ্যই পাপরাশিকে দূরীভূত করে দেয়। (আল্লাহর) স্মরণকারীদের জন্য এ হল এক স্মরণ। (সূরা হূদ ১১৪ আয়াত) (আহ্‌মদ, নাসাঈ, ত্বাবারানী, সহীহ তারগীব ৩৫৬নং)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “বান্দা যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন তার সে তার সমস্ত গুনাহকে নিয়ে তার মাথায় ও দুই কাঁধে রাখা হয়। অতঃপর সে যখনই রুকূ ও সিজদা করে, তখনই একটি একটি করে সমস্ত গুনাহগুলি ঝরে পড়ে যায়।” (বাইহাকী, সহীহ জামে ১৬৭১নং)

নামায ও তার গুরুত্বের কথা কুরআন মাজীদের বহু জায়গাতেই আলোচিত হয়েছে। কোথাও নামায কায়েম করার আদেশ দিয়ে, কোথাও নামাযীর প্রশংসা ও প্রতিদান এবং বেনামাযীর নিন্দা ও শাস্তি বর্ণনা করে, আল্লাহ তাআলা নামাযের প্রতি বড় গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এক স্থানে তিনি বলেন,

فإنْ تَابُوْا وَأَقَامُوا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّيْنِ

অর্থাৎ, তারপর তারা যদি তওবা করে নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই। (নচেৎ নয়।) (কুরআন মাজীদ ৯/১১)

অন্যত্র বলেন,

مُنِيْبِيْنَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوْهُ وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَلاَ تَكُوْنُوْا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ

অর্থাৎ, বিশুদ্ধচিত্তে তাঁর অভিমুখী হও; তাঁকে ভয় কর, যথাযথভাবে নামায পড়, আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হ্‌য়ো না। (কুরআন মাজীদ ৩০/৩১)

কুরআন মাজীদে নামাযকে মহান আল্লাহ ‘ঈমান’ বলে আখ্যায়ন করেছেন, তিনি বলেন,

وَمَا كَانَ اللّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ: (১৪৩) سورة البقرة

অর্থাৎ, আল্লাহ তোমাদের (কা’বার দিক ছাড়া বায়তুল মাকদেসের দিকে মুখ করে আদায়কৃত পূর্বের) ঈমান (নামায)কে বরবাদ করবেন না। (কুরআন মাজীদ ২/১৪৩)

নামায মু’মিনের ঈমান ও মুসলিমের ইসলামের নিদর্শন। মহানবী (ﷺ) বলেন, “ইসলাম ও শির্ক এবং কুফরের মাঝে পার্থক্য নির্বাচনকারী হল এই নামায।” (মুসলিম, সহীহ ৮২নং, মিশকাত ৫৬৯নং)

কোন আমল ত্যাগ করার ফলে কেউকাফে র হয়ে যায় না। কিন্তু সাহাবাগণ নামায ত্যাগ করাকে কুফরী মনে করতেন। (তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৭৯নং)

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি নামায ত্যাগ করে তার দ্বীনই নেই।” (ইবনে আবী শাইবাই, ত্বাবারানীর কাবীর, সহীহ তারগীব ৫৭১নং)

হযরত আবূ দারদা (রাঃ) বলেন, “যার নামায নেই তার ঈমানই নেই।” (ইবনে আব্দুল বার, প্রমুখ, সহীহ তারগীব ৫৭২নং)

প্রিয় নবী (ﷺ) আরো বলেন, “আমাদের ও ওদের (কাফেরদের) মাঝে চুক্তিই হল নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি তা ত্যাগ করবে, সে কাফের হয়ে যাবে (বা কুফরী করবে।) (তিরমিযী, সুনান ২৬২১, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ১০৭৯ নং)

তিনি আরো বলেন, “পাঁচ ওয়াক্ত নামায আল্লাহ বান্দাগণের উপর ফরয করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা যথার্থরুপে আদায় করবে এবং তাতে গুরুত্ব দিয়ে তার কিছুও বিনষ্ট করবে না, সেই ব্যক্তির জন্য আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি আছে যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে ব্যক্তি তা আদায় করবে না, সে ব্যক্তির জন্য আল্লাহর কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে শাস্তি দেবেন, নচেৎ ইচ্ছা হলে জান্নাতেও দিতে পারেন।” (মালেক, মুঅত্তা, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, সহিহ তারগিব ৩৬৩ নং)

পূর্বোক্ত আয়াত ওহাদীসের ভিত্তিতে বড় বড় বহু উলামাগণ বলেছেন যে, বেনামাযী কাফের। কোন মুসলিম (নামাযী) নারীর সাথে তার বিবাহ্‌ হতে পারে না, তার যবাইকৃত পশুর মাংসহালাল হয় না, সে মারা গেলে তার জানাযা পড়া হবে না, মুসলিম (নামাযী) ছেলেরা তার ওয়ারিস হবে না বা সেও নামাযী বাপের ওয়ারিস হবে না এবং তাকে মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করা হবে না --- ইত্যাদি।

অবশ্য শেষোক্তহাদীস এবং অনুরুপ অন্যান্যহাদীসের ভিত্তিতে অন্যান্য আলেমগণ বলেন যে, ‘বেনামাযী কাফের নয়, তবে নামায ত্যাগ করা কাফেরের কাজ বটে।’ (ইবনে বায, ইবনে উসাইমীন ও আলবানীর ফতোয়া দ্রষ্টব্য)

যাইবা হোক উক্ত আয়াত ওহাদীসসমূহে নামাযের বিরাট গুরুত্ব স্পষ্ট। নামায হল দ্বীনের খুঁটি। (তিরমিযী, সুনান ২১১০, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান ৩৯৭৩ নং) দ্বীনের পাঁচটি বুনিয়াদের মধ্যে এটাই হল দ্বিতীয় বুনিয়াদ। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৪নং) তাই তো প্রিয় নবী (ﷺ) জীবনের শেষ মুহূর্তে মরণ-শয্যায় শায়িত অবস্থাতেও নামাযের জন্য ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। ইন্তেকালের পূর্বে শেষ উপদেশে তিনি নামাযের গুরুত্ব সম্বন্ধে উম্মতকে সচেতন করে গেলেন। বললেন, “নামায! নামায! আর ক্রীতদাস-দাসী (এর ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থেকো।) (জামে ৩৮৭৩ নং)

সাবালক হলেই মুসলিমের উপর নামায ফরয হয়। তবুও অভ্যস্ত করার উদ্দে শ্যে ই আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা তোমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে তাদের বয়স ৭ বছর হলেই নামাযের আদেশ দাও। ১০ বছর বয়সে নামাযে অ ভ্যা সী না হলে তাদেরকে প্রহার কর। আর তাদের প্রত্যেকের বিছানা পৃথক করে দাও।” (আবূদাঊদ, সুনান, মিশকাত ৫৭২নং)

সব ওয়াক্তের নামায নয়, কেবলমাত্র এক ওয়াক্তের আসরের নামায ছুটে গেলে বা না পড়া হলে তার ক্ষতির পরিমাণ বুঝাতে প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আসরের নামায ত্যাগ করে, সে ব্যক্তির আমল পন্ড হয়ে যায়।” (বুখারী ৫৫৩, নাসাঈ)

তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তির আসরের নামায ছুটে গেল, তার যেন পরিবার ও ধন-মাল লুণ্ঠন হয়ে গেল।” (মালেক, বুখারী ৫৫২, মুসলিম ৬২৬ নং প্রমুখ)

মহান আল্লাহ বলেন,

فخلفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ أَضَاعُوا الصَّلاَةَ وَاتَّبَعُوا الشَّهَوَاتِ فَسَوْفَ يَلْقَوْنَ غَيًّا

অর্থাৎ, ওদের পর এল এমন (অপদার্থ) পরবর্তীদল; যারা নামায নষ্ট করল ও কুপ্রবৃত্তি-পরবশ হল। সুতরাং ওরা অচিরেই কঠিন শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। (কুরআন মাজীদ ১৯/৫৯)

আল্লাহ তাআলা বলেন,

(فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّيْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ عَنْ صَلاَتِهِمْ سَاهُوْنَ، الَّذِيْنَ هُمْ يُرَاؤُوْنَ)

অর্থাৎ, সুতরাং দুর্ভোগ সেই সকল নামাযীদের, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন। যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে। (কুরআন মাজীদ ১০৭/৪-৬) বলা বাহুল্য, নামাযী হয়েও নামাযে গাফলতি করার কারণে যদি দোযখের দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়, তাহলে বেনামাযী হয়ে কত বড় দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে তা অনুমেয়।

মরণের পরপারে মধ্যজগতে নামাযে উদাসীন ও শৈথিল্যকারী ব্যক্তির মাথায় কিয়ামত অবধি পাথর ঠুকে ঠুকে মারা হবে। (বুখারী ১১৪৩নং)

নামায আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পর্কের এক সেতুবন্ধ। “কিয়ামতের দিন বান্দার নিকট থেকে সর্বাগ্রে যে আমলের হিসাব নেওয়া হবে তা হল নামায। সুতরাং তা সঠিক হয়ে থাকলে তার অন্যান্য আমলও সঠিক বলে বিবেচিত হবে। নচেৎ অন্যান্য সকল আমল নিষ্ফল ও ব্যর্থ হবে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৩৬৯নং)

নামায এত গুরুত্বপূর্ণ যে, তার শর্তাবলী বর্তমান থাকা কালে তা (নাবালক শিশু, পাগল ও ঋতুমতী মহিলা ছাড়া) কারো জন্য কোন অবস্থাতেই মাফ নয়। এমন কি যুদ্ধের ময়দানে প্রাণহ্‌ন্তা রক্ত-পিপাসু শত্রুদলের সামনেও নয়! (কুরআন মাজীদ ৪/১০২) অসুস্থ অবস্থায় খাড়া হয়ে না পারলে বসে, বসে না পারলে কাৎ হয়ে শুয়েও নামায পড়তেই হবে। (বুখারী, মিশকাত ১২৪৮ নং) ইশারা-ইঙ্গিতে রুকু-সিজদা না করতে পারলে মনে মনে নিয়তেও নামায পড়তে হবে। চেষ্টা সত্ত্বেও পবিত্র থাকতে অক্ষম হলেও ঐ অবস্থাতেই নামায ফরয। (ইবনে উসাইমীন, কাইফা য়্যাতাত্বাহ্‌হারুল মারীযু অয়্যুসাল্লী দ্রষ্টব্য)

নামায কবুল হওয়ার জন্য যেরুপ বিশুদ্ধ ঈমান এবং হৃদয়কে সিক্ত ও কুফরী ধারণা ও বিশ্বাস থেকে পবিত্র রাখা জরুরী শর্ত, তদ্রুপ নামাযীর বাহ্যিক দেহ্‌ ও পোশাক-আশাককে পবিত্র রাখাও এক জরুরী শর্ত। যেহেতু “নামাযের চাবিকাঠিই হল পবিত্র তা ।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৩১২ নং) তাছাড়া এই পবিত্রতা হল অর্ধেক ঈমান। (মুসলিম, মিশকাত ২৮১নং)

(বিশেষ করে পানি দ্বারা অর্জিত) পবিত্রতায় বৃদ্ধি হয় মনোযোগ, দূর হয় আলস্য, তন্দ্রা ও নিদ্রা, স্ফূর্তির সাথে ইবাদতে মন বসে অধিক।

মযী বা মলমূত্র থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানি বা (যথেষ্ট পানি না পাওয়া গেলে) মাটির ঢেলা ব্যবহার করে তা দূর করা এবং ওযু করাই যথেষ্ট। অবশ্য কোন প্রকারের মৈথুন দ্বারা বা স্বপ্নে অথবা যৌনচিন্তায় উত্তেজনা ও তৃপ্তির সাথে বীর্যপাত করলে বা হলে গোসল ফরয। যেমন সঙ্গমে যোনীপথে লিঙ্গাগ্র প্রবেশ করিয়ে বীর্যপাত না করলেও গোসল ফরয। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৪৩০নং) অনুরুপ মহিলাদের মাসিক ও নেফাস থেকে পবিত্র হওয়ার জন্যও গোসল ফরয।

ওযু ও গোসলের জন্য ব্যবহার্য পানিও পবিত্র তথা পবিত্রকারী হওয়া জরুরী। সাধারণত: পুকুর, নদী, নালা, সমুদ্র, প্রভৃতির পানি পবিত্র ও পবিত্রকারী। যে পানিতে পবিত্র কোন জিনিস -যেমন আটা, সাবান, জাফরান ইত্যাদি মিশ্রিত হয়, সে পানির রং, গন্ধ বা স্বাদ পরিবর্তন না হলে তাতে ওযু-গোসল চলবে।

পানিতে কোন অপবিত্র জিনিস পড়ে যাওয়ার ফলে অথবা অন্য কোন কারণে যদি তার রং, স্বাদ বা গন্ধ পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে তা নাপাক গণ্য হবে। পরিবর্তন না হলেও যদি পানি ২ কুল্লাহ্‌ (প্রায় ২৭০ লিটার, মতান্তরে ১৯১ থেকে ২০০ কেজি) এর চেয়ে কম হয়, তাহলেও তা নাপাক। এর বেশী হলে সে পানি পাক। তাতে ওযু-গোসল চলবে। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৪৭৭নং)

যে পানি একবার ওযু-গোসলে ব্যবহার হয়েছে, সে পানি পাক। কিন্তু তাতে আর ওযু-গোসল হবে না।

মানুষ, গাধা, খচ্চর, পাখী,হালাল পশু, বিড়াল প্রভৃতির এঁটো পানি পাক; তাতে ওযু-গোসল চলবে। অবশ্য শূকর ও কুকুরের এঁটো পানি নাপাক। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৩৩-৩৭পৃ:)

নাপাকীর গোসল করতে হলে গোসলের নিয়ত করে মুসলিম প্রথমে ৩ বার দুইহাত কব্জি পর্যন্ত ধুবে। অতঃপর বাম হাতের উপর পানি ঢেলে দেহের নাপাকী ধুয়ে ফেলবে। তারপর বাম হাতকে মাটি অথবা সাবান দ্বারা ধুয়ে নামাযের জন্য ওযু করার মত পূর্ণ ওযু করবে। অবশ্য গোসলের জায়গা পরিষ্কার না হলে পা দুটি গোসল শেষে ধুয়ে নেবে। ওযুর পর ৩ বার মাথায় পানি ঢেলে ভাল করে চুলগুলো ধোবে, যাতে সমস্ত চুলের গোড়ায় গোড়ায় পানি পৌঁছে যায়। তারপর সারা দেহে ৩ বার পানি ঢেলে ভালরুপে ধুয়ে নেবে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৪৩৫-৪৩৬ নং)

মহিলাদের গোসলও পুরুষদের অনুরুপ। অবশ্য মহিলার মাথার চুলে বেণী বাঁধা (চুটি গাঁথা) থাকলে তা খোলা জরুরী নয়। তবে ৩ বার পানি নিয়ে চুলের গোড়া অবশ্যই ধুয়ে নিতে হবে। (বুখারী, মিশকাত ৪৩৮নং) নখে নখপালিশ বা কোন প্রকার পুরু পেন্ট্‌ থাকলে তা তুলে না ফেলা পর্যন্ত গোসল হবে না। পক্ষান্তরে মেহেদী বা আলতা লেগে থাকা অবস্থায় গোসল হয়ে যাবে। কপালে টিপ (?) থাকলে ছাড়িয়ে ফেলে (কপাল) ধুতে হবে। নচেৎ গোসল হবে না।

বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও মাসিকের গোসল, অথবা মাসিক ও ঈদ, অথবা বীর্যপাত বা সঙ্গম-জনিত নাপাকী ও জুমআ বা ঈদের গোসল নিয়ত হলে একবারই যথেষ্ট। পৃথক পৃথক গোসলের দরকার নেই। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু ৬০পৃ: দ্র:)

গোসলের পর নামাযের জন্য আর পৃথক ওযুর প্রয়োজন নেই। গোসলের পর ওযু ভাঙ্গার কোন কাজ না করলে গোসলের ওযুতেই নামায হয়ে যাবে। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৪৪৫নং)

রোগ-জনিত কারণে যদি কারো লাগাতার বীর্য, মযী, স্রাব বা ইস্তিহাযার খুন ঝরে তবে তার জন্য গোসল ফরয নয়; প্রত্যেক নামাযের জন্য ওযুই যথেষ্ট। এই সকল অবস্থায় নামায মাফ নয়। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৬০-৫৬১ নং)

প্রকাশ যে, গোসল, ওযু বা অন্যান্য কর্মের সময় নিয়ত আরবীতে বা নিজ ভাষায় মুখে উচ্চারণ করা বিদআত।

সতর্কতার বিষয় যে, নাপাকী দূর করার জন্য কেবল গা-ধোয়া বা গা ডুবিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। পূর্বে ওযু করে যথানিয়মে গোসল করলে তবেই পূর্ণ গোসল হয়। নচেৎ অনেকের মতে কুল্লি না করলে এবং নাকে পানি না নিলে গোসলই শুদ্ধ হবে না। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন /৩০৪)

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৯৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 27 28 29 30 পরের পাতা »