তাক্বদীরঃ আল্লাহ্‌র এক গোপন রহস্য আব্দুল আলীম ইবনে কাওসার ২৬ টি
তাক্বদীরঃ আল্লাহ্‌র এক গোপন রহস্য আব্দুল আলীম ইবনে কাওসার ২৬ টি

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য। দরূদ এবং সালাম বর্ষিত হোক আমাদের শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর।

তাক্বদীর ঈমানের ছয়টি স্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ। প্রকৃত মুমিন হতে হলে অবশ্যই তাক্বদীরে বিশ্বাস করতে হবে, তাক্বদীরে বিশ্বাস স্থাপন বৈ কেউ মুমিন হতে পারবে না। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে তাক্বদীর সংক্রান্ত অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। সেজন্য ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিষয়টি সরাসরি আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্য যারপর নেই বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ আল্লাহ্‌র কতিপয় নাম ও গুণাবলীর সাথেই এর সরাসরি সম্পর্ক।

তাক্বদীরে বিশ্বাস মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সেজন্য এমনকি জাহেলী যুগেও মানুষ এতে বিশ্বাস করত। জাহেলী অনেক কবির কবিতায় এমন বিশ্বাসের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কবি আনতারা তার প্রেমিকা আবলাকে লক্ষ্য করে বলেন,

يا عَبلُ أينَ من المَنيَّة ِ مَهْربي إن كانَ ربي في السَّماءِ قَضاها

‘হে আবলা! আমার প্রভূ আসমানে যদি আমার মৃত্যুর ফায়ছালা করেই রাখেন, তাহলে মৃত্যু থেকে আমার পালাবার পথ কোথায়!’[1]

এরপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এসে তাক্বদীরের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তুলে ধরেন। ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট থেকে সরাসরি দ্বীনের জ্ঞান লাভ করেন। সেজন্য তাঁরা ছিলেন তাক্বদীর উপলব্ধির ক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রগণ্য এবং এর প্রতি তাঁদের বিশ্বাসও ছিল অটুট। ফলে তাঁরা তাক্বওয়া এবং শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কিন্তু ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর যুগের শেষের দিকে ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতির পর মুসলিম দেশসমূহে গ্রীক, পারসিক, ভারতীয় দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটতে শুরু করে। ফলে তাক্বদীর অস্বীকারের মত নিকৃষ্ট মতবাদের জন্ম হয়। তারপর উমাইয়া যুগে জন্ম হয় জাবরিইয়াহ মতবাদের। এসব ভ্রান্ত মতবাদের অপতৎপরতা আজও অব্যাহত রয়েছে।

মহান আল্লাহ আহলুস্‌ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতকে তাক্বদীরের সঠিক উপলব্ধি দান করেছেন। কারণ তারা সরাসরি পবিত্র কুরআন, ছহীহ হাদীছ এবং সালাফে ছালেহীনের বক্তব্য অনুযায়ী তাক্বদীর বুঝার চেষ্টা করেছেন। মূলতঃ তাক্বদীরসহ শরী‘আতের  যেকোনো বিষয় বুঝার ক্ষেত্রে এই পথেই মুক্তি নিহিত রয়েছে।

তাক্বদীরের মৌলিক বিষয়গুলি উপলব্ধি করতে পারলে একজন মুমিনের ঈমান পরিপক্ক হবে, আল্লাহ সম্পর্কে তার ধারণা সুন্দর হবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সে প্রভূত কল্যাণ অর্জন করতে পারবে। পক্ষান্তরে তাক্বদীরে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হলে উভয় জীবনে নেমে আসবে চরম হতাশা এবং মর্মন্তুদ শাস্তি।

আমরা এ প্রবন্ধে তাক্বদীরের মৌলিক বিষয়গুলি সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহই একমাত্র তাওফীক্বদাতা।

[1]. দিওয়ানু আনতারা ইবনে শাদ্দাদ, (বৈরূত: মাত্ববা‘আতুল আদাব, প্রকাশকাল: ১৮৯৩ ইং), পৃ: ৯২।

অনেকেই বলে তাক্বদীর সম্পর্কে আলোচনা করা মোটেই ঠিক নয়। কারণ এ সম্পর্কে আলোচনা করলে হৃদয়ের মণিকোঠায় সন্দেহের ধূম্রজাল বাসা বাধতে পারে। তবে বিষয়টি আসলে তেমন নয়। কারণঃ

১. তাক্বদীর ঈমানের অন্যতম একটি রুকন। এর প্রতি  ঈমান না আনয়ন করা পর্যন্ত কারো ঈমান পূর্ণ হবে না। কিন্তু এ সম্পর্কে আলোচনা না করলে একজন মুসলিম তা কিভাবে বুঝবে?!

২. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদীছ ‘হাদীছে জিবরীল’-এ প্রসঙ্গে আলোচনা এসেছে। বলা বাহুল্য যে, জিবরীল (‘আলাইহিস্‌সালাম) মানুষের রূপ ধরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর নিকটে হাদীছটি নিয়ে এসেছিলেন এবং ঘটনাটি ছিল রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শেষ জীবনে। সেদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন,

«فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ»

‘তিনি হচ্ছেন জিবরীল (‘আলাইহিস্‌সালাম)। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শেখাতে এসেছিলেন’।[1] বুঝা গেল, তাক্বদীর সম্পর্কে জানা দ্বীনের অংশ; তাক্বদীরের অন্ততঃ প্রাথমিক জ্ঞানটুকু থাকা যরূরী।

৩. এ বিষয়ে অসংখ্য আয়াতে তাক্বদীরের বিবরণ এসেছে। আর মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের আয়াতসমূহ গবেষণার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে,

﴿كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ﴾ [سورة ص: 29]

‘এটি একটি বরকতময় কিতাব। এটিকে আমি আপনার উপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ গবেষণা করে’ (ছোয়াদ ২৯)।  তাহলে আমরা কিভাবে বলতে পারি যে, এ বিষয়ে আলোচনা করা ঠিক নয়?!

৪. তাক্বদীর সম্পর্কে অনেক হাদীছ এসেছে। ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে তাক্বদীরের সূক্ষ্ম বিষয়েও জিজ্ঞেস করতেন এবং তিনি তাঁদেরকে সঠিক জবাব দিতেন। অনুরূপভাবে ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)ও তাঁদের ছাত্র তাবেঈনকে তাক্বদীর বিষয়ে শিক্ষা দিতেন।

৫. ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)সহ আমাদের পূর্বসূরী প্রায় সকল আলেম তাক্বদীর সম্পর্কে কথা বলেছেন, পৃথক বই-পুস্তক, প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাহলে কি তাঁরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশের বিরোধিতা করেছেন? কখনই না। মানুষ যাতে পথভ্রষ্ট না হয়ে যায় এবং তারা যাতে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে, সেজন্য তাদেরকে তাক্বদীর বিষয়ক হক্ব কথাটি বুঝানো কি উচিৎ নয়? এ বিষয়ে উত্থাপিত নানা প্রশ্ন এবং জটিলতার সঠিক জবাব দেওয়া কি করণীয় নয়?

৬. আমরা যদি তাক্বদীর সম্পর্কে আলোচনা করা ছেড়ে দিই, তাহলে সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে অজ্ঞ হয়ে যাবে। এই সুযোগে বাতিল মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং তাক্বদীর সম্পর্কে মুসলিমদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পথ সহজ হয়ে যাবে।

[1]. ছহীহ মুসলিম, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ঈমান, ইসলাম ও ইহ্‌সানের বিবরণ এবং তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য’ অনুচ্ছেদ (রিয়ায: বায়তুল আফকার আদ-দাওলিইয়াহ, প্রকাশকাল: ১৯৯৭ইং), হা/৮।
কিন্তু প্রশ্ন হল, তাহলে যেসব হাদীছে তাক্বদীরের আলোচনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলির সঠিক ব্যাখ্যা কি?

এক্ষণে, আমরা নীচে এজাতীয় কয়েকটি হাদীছ এবং সেগুলির সঠিক ব্যাখ্যা উল্লেখ করছিঃ

১. রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,

 «إذا ذُكِرَ أصْحابِي فأمْسِكُوا وإذا ذُكِرَتِ النُّجُومُ فأَمْسِكُوا وَإذا ذُكِرَ القَدَرُ فأمْسِكُوا»

‘আমার ছাহাবা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না। তারকারাজির বিধিবিধান, প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না। অনুরূপভাবে তাক্বদীর সম্পর্কে কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না’।[1]

২. আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

 «خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَنَحْنُ نَتَنَازَعُ فِى الْقَدَرِ فَغَضِبَ حَتَّى احْمَرَّ وَجْهُهُ حَتَّى كَأَنَّمَا فُقِئَ فِى وَجْنَتَيْهِ الرُّمَّانُ فَقَالَ: أَبِهَذَا أُمِرْتُمْ أَمْ بِهَذَا أُرْسِلْتُ إِلَيْكُمْ إِنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ حِينَ تَنَازَعُوا فِى هَذَا الأَمْرِ عَزَمْتُ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تَتَنَازَعُوا فِيهِ»

‘আমরা তাক্বদীর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছিলাম, এমন সময় আমাদের নিকট রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আসলেন। অতঃপর তিনি ভীষণ রেগে গেলেন, রাগের প্রচণ্ডতায় তাঁর চেহারা মোবারক লাল হয়ে গেল; মনে হচ্ছিল, তাঁর কপোলদ্বয়ে ডালিম ভেঙ্গে তার রস লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর তিনি বললেন, তোমরা কি এমন তর্ক-বিতর্ক করার জন্য আদিষ্ট হয়েছ নাকি আমি এ মর্মে তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি! তোমাদের পূর্ববর্তীরা তো তখনই ধ্বংস হয়েছিল, যখন তারা এ বিষয়ে ঝগড়া করেছিল। তোমাদের প্রতি আামার কঠোর নির্দেশ রইলো যে, তোমরা এ নিয়ে তর্ক করবে না’।[2]

হাদীছগুলির সঠিক ব্যাখ্যাঃ

 ১. হাদীছগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাক্বদীর নিয়ে বিনা দলীলে এবং বিনা জ্ঞানে অহেতুক এবং বিভ্রান্তিকর আলোচনা করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

 ﴿وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ﴾ [سورة الاسراء: 36]

‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে তুমি মাথা ঘামাইও না’ (ইসরা ৩৬)।  কারণ কুরআন-হাদীছের দিকনির্দেশনা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দ্বারা তাক্বদীরের সবকিছু অনুধাবন আদৌ সম্ভব নয়। অতএব, বিতর্কমূলক এবং আল্লাহ্‌র সিদ্ধান্তে সামান্যতম আপত্তিকর কোন আলোচনা করা যাবে না।

তবে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দলীল ভিত্তিক তাক্বদীর বুঝার উদ্দেশ্যে এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাবে; বরং আলোচনা করা উচিৎ।

২. হাদীছগুলিতে তাক্বদীর নিয়ে আপত্তিকর প্রশ্ন উত্থাপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমনঃ কেউ একগুঁয়েমী প্রশ্ন করতে পারে, আল্লাহ কেন অমুককে হেদায়াত করলেন, আর অমুককে পথভ্রষ্ট করলেন? এত সৃষ্টি থাকতে আল্লাহ কেন মানুষের উপর শরী‘আতের দায়িত্ব ভার অর্পণ করলেন? আল্লাহ কেন অমুককে ধনী করলেন, আর অমুককে গরীব করলেন? ইত্যাদি...সেজন্য আবূ হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণিত উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী ক্বারী তাক্বদীর নিয়ে ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর ঐদিনের আলোচনার ধরণ তুলে ধরেন এভাবে, আমরা তাক্বদীর নিয়ে বিতণ্ডা করছিলাম। আমাদের কেউ কেউ বলছিলেন, সবকিছু যদি তাক্বদীর অনুযায়ী হয়ে থাকে, তাহলে কেন বান্দাকে সুখ বা শাস্তি দেওয়া হবে? যেমনটি মু‘তাযিলারা বলে থাকে। আবার কেউ কেউ বলছিলেন, একদলকে জান্নাতী এবং অপর দলকে জাহান্নামী হিসাবে নির্ধারণ করার তাৎপর্য কি? এর জবাবে তাঁদের কেউ কেউ বলছিলেন, কেননা বান্দার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। এর জবাবে আবার কেউ কেউ বলছিলেন, তাহলে তার সেই ইচ্ছাশক্তি কে সৃষ্টি করেছেন?[3] আর এমন বিতণ্ডার কারণেই সেদিন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রেগে গিয়েছিলেন এবং তাঁদেরকে এত্থেকে নিষেধ করেছিলেন।

তবে কেউ সত্যিকার অর্থে তাক্বদীর জানার জন্য প্রশ্ন করলে তাতে কোন দোষ নেই।

৩. ইবনে মাসঊদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণিত উক্ত হাদীছেই আমরা আমাদের এ মতের পক্ষে বক্তব্য পাই। কেননা হাদীছটিতে বলা হয়েছে, ছাহাবায়ে করাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-এর কথা উঠলে তোমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে না। তার মানে কি এই যে, তাঁদের মর্যাদা-মাহাত্ম্যের কথা বলা যাবে না? নিশ্চয়ই তা নয়। বরং এখানে তাঁদের মাঝে সৃষ্ট মতানৈক্য, কলহ-দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাক্বদীরের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক তদ্রূপই।

৪. রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এসব হাদীছে ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) কে তাক্বদীর নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে নিষেধ করেছেন। কারণ তর্ক-বিতর্ক হলে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় আর মতানৈক্য সৃষ্টি হলে সেখানে অসত্য প্রবেশ করে। তবে ভ্রান্ত ফের্কাগুলির বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের জবাব দেওয়া নিষিদ্ধ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং তা হক্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামের শামিল।

একটি প্রশ্ন এবং তার সমাধান: বিদ্বানগণ বলছেন, তাক্বদীর আল্লাহ্‌র এক গোপন রহস্য। তাহলে আমরা কিভাবে এমন একটি বিষয়ে কথা বলতে পারি? জবাবে বলব, আমরাও অকপটে স্বীকার করি, তাক্বদীর আল্লাহ্‌র গোপন রহস্য। কিন্তু তাক্বদীর গোপন রহস্য হওয়ার বিষয়টি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের হিকমতের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন: আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন, পথ প্রদর্শন করেন, মৃত্যু ঘটান, জীবন দান করেন, কাউকে দেন আবার কাউকে মাহরূম করেন ইত্যাদি বিষয়ে আল্লাহ্‌র হিকমত জানতে চাওয়া বৈধ নয়।[4]

হাযার চেষ্টা সত্ত্বেও তাক্বদীরের সবকিছু বুঝা সম্ভব নয়। কারণ, তাক্বদীরের জ্ঞান গায়েবী বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত; যা আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ জানেন না, তিনি যদি কাউকে না জানিয়ে থাকেন, তবে অন্যরা সেটা কিভাবে জানবে? এমনকি আল্লাহ্‌র নিকটতম কোন ফেরেশতা এবং নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)গণও গায়েবের কোনই খবর রাখেন না। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ স্বয়ং রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে লক্ষ্য করে মহান আল্লাহ বলেন,

 ﴿قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ۚ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾ [سورة الأعراف: 188]

‘আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু আল্লাহ চান, তা ব্যতীত। আর আমি যদি গায়েবের কথা জানতাম, তাহলে অনেক কল্যাণ অর্জন করতে পারতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করতে পারত না। আমি ঈমানদারগণের জন্য শুধুমাত্র একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা বৈ আর কিছুই নই’ (আ‘রাফ ১৮৮)।

মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে তাক্বদীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে গভীর চিন্তা করলে পথভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। অতএব একজন প্রকৃত মুমিনের আল্লাহ্‌র বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। একজন মুমিনকে রীতিমত সৎকর্ম করে যেতে হবে এবং অসৎকর্ম বর্জন করতে হবে।[5]

[1]. ত্ববারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, তাহক্বীক: হামদী আব্দুল মাজীদ সিলাফী (কায়রো: মাকতাবাতু ইবনে তায়মিইয়াহ, তা.বি.), ১০/২৪৩, হা/১০৪৪৮; শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন (সিলসিলাহ ছহীহাহ, ১/৭৫, হা/৩৪)।

[2]. জামে‘ তিরমিযী, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, ‘তাক্বদীর নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া থেকে কঠোরতা’ অনুচ্ছেদ (রিয়ায: মাকতাবাতুল মা‘আরেফ, প্রথম প্রকাশ: তা. বি.), হা/২১২৩; শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।

[3]. মোল্লা আলী ক্বারী, মিরক্বাতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ, তাহক্বীক্ব: জামাল আয়তানী, ১/২৭৭, হা/৯৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনা’ অনুচ্ছেদ, (বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, প্রথম প্রকাশ: ২০০১ইং)।

[4]. ড. আব্দুর রহমান ইবনে ছালেহ আল-মাহমূদ, আল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার ফী যউয়িল কিতাবি ওয়াস্‌-সুন্নাহ ওয়া মাযাহিবিন্‌-নাস ফীহি, (রিয়ায: দারুল ওয়াত্বান, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৯৭ইং), পৃ: ২৪-২৭; মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আল-হামাদ, আল-ঈমানু বিল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার, (রিয়ায: দারু ইবনে খুযায়মা, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৯৮ইং), পৃ: ১১-১৫।

[5]. শায়খ ছালেহ আল-ফাওযান, জামে‘উ শুরূহিল আক্বীদাতিত-ত্বহাবিইয়াহ (কায়রো: দারু ইবনিল জাওযী, প্রথম প্রকাশ: ২০০৬ইং), ২/৫৩০ ও ৫৪৩ ।

‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ) বা তাক্বদীরের আভিধানিক অর্থঃ

‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ) শব্দটির ‘দাল’ বর্ণে যবর দিয়ে অথবা সাকিন করে দু’ভাবেই পড়া যায়। ‘মুজমালুল্লুগাহ’ (مجمل اللغة) অভিধান প্রণেতা বলেন, ‘আল-ক্বাদ্‌র’ (اَلْقَدْرُ) অর্থঃ কোন কিছুর পরিধি, সীমা বা পরিমাণ। অনুরূপভাবে ‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ)-এরও একই অর্থ।  ‘মু‘জামু মাক্বায়ীসিল্লুগাহ’ (معجم مقاييس اللغة) প্রণেতা বলেন, ‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ) শব্দটি কোন কিছুর পরিধি বা শেষ সীমানা নির্দেশ করে। তিনি বলেন, আল্লাহ কর্তৃক তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছুর পরিমাণ, শেষ সীমা ইত্যাদি নির্ধারণ করার নাম ‘আল-ক্বাদ্‌র’ (اَلْقَدْرُ)। ‘আল-ক্বাদার’ (اَلْقَدَرُ)ও একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।  ইবনে মানযূর (রহেমাহুল্লাহ) লেহ্‌ইয়ানী (রহেমাহুল্লাহ) থেকে উল্লেখ করেন, যবর যোগে শব্দটি বিশেষ্য (اسم) এবং সাকিন যোগে ক্রিয়ামূল (مصدر) হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

তাক্বদীরের পারিভাষিক অর্থঃ
সবকিছু ঘটার আগেই সে সম্পর্কে আল্লাহ্‌র সম্যক জ্ঞান, সেগুলি লাউহে মাহফূযে লিপিবদ্ধ করণ, তদ্বিষয়ে তাঁর পূর্ণ ইচ্ছার সমন্বয় এবং অবশেষে সেগুলিকে সৃষ্টি করাকে তাক্বদীর বলে। 

ঈমানের ছয়টি রুকনের মধ্যে তাক্বদীর অন্যতম। ঈমানের এ গুরুত্বপূর্ণ রুকনটির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত কেউ মুমিন হতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

 ﴿إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ﴾ [سورة القمر: 49]

‘নিশ্চয় প্রত্যেকটি জিনিসকে আমরা ‘ক্বাদর’ তথা পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছি (আল-ক্বামার ৪৯)। ইবনু কাছীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, আহলে সুন্নাতের আলেমগণ এই আয়াত দ্বারা তাক্বদীর সাব্যস্ত হওয়ার দলীল গ্রহণ করেন।[1] অন্য আয়াতে এসেছে,

 ﴿وَكَانَ أَمْرُ اللَّهِ قَدَرًا مَّقْدُورًا﴾ [سورة الأحزاب 38]

‘আর আল্লাহ্‌র বিধান সুনির্দিষ্ট, অবধারিত’ (আল-আহযাব ৩৮)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, অর্থাৎ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয় অবশ্যই ঘটবে, এর সামান্যতম কোন ব্যত্যয় ঘটবে না। তিনি যা চান, তা ঘটে। আর যা তিনি চান না, তা ঘটে না।[2]

হাদীছে জিবরীলে ঈমানের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,

 «أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ»

‘আল্লাহ্‌র প্রতি, তাঁর ফেরেশতামণ্ডলী, আসমানী কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, শেষ দিবস এবং তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের নাম ঈমান’।[3]

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আছ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, ‘আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি,

«كَتَبَ اللَّهُ مَقَادِيرَ الْخَلاَئِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ -قَالَ- وَعَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ»

‘আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ সবকিছুর তাক্বদীর লিখে রেখেছেন। তিনি বলেন, আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে’।[4]

ত্বাঊস (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, আমি অনেকজন ছাহাবীকে পেয়েছি, যাঁরা বলতেন, সবকিছু তাক্বদীর অনুযায়ীই হয়। তিনি বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কে বলতে শুনেছি, তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন, ‘সবকিছু তাক্বদীর মোতাবেকই ঘটে থাকে, এমনকি অপারগতা এবং বিচক্ষণতাও, অথবা বিচক্ষণতা ও অপারগতাও।[5] অন্য এক হাদীছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন,

« لَا يُؤْمِنُ الْمَرْءُ حَتَّى يُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ »

‘তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত কেউ মুমিন হতে পারবে না’।[6]

এ ধরনের আরো বহু আয়াত এবং হাদীছ আছে, যেগুলি অকাট্যভাবে তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনার অপরিহার্যতা প্রমাণ করে।

এছাড়া মুসলিম আলেমগণ সর্বসম্মতিক্রমে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য। ইমাম নববী (রহেমাহুল্লাহ), শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ), ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ)সহ অনেকেই এই ইজমা উল্লেখ করেছেন।[7]

[1]. তাফসীর ইবনে কাছীর, (রিয়ায: দারু ত্বায়বাহ, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৯৯ইং), ৭/৪৮২।

[2]. প্রাগুক্ত, ৬/৪২৭।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ঈমান, ইসলাম ও ইহসানের বর্ণনা, তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য এবং যে ব্যক্তি তাক্বদীরে বিশ্বাস করে না, তার সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা’ অনুচ্ছেদ।

[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৩।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৫।

[6]. মুসনাদে আহমাদ, ১১/৩০৫, হা/৬৭০৩, তাহক্বীক্ব: শু‘আইব আরনাঊত্ব, আদেল মুরশিদ প্রমুখ (বৈরূত: মুআস্‌সাসাতুর্‌ রিসালাহ, প্রথম প্রকাশ: ২০০১ইং), মুসনাদের মুহাক্কিক্বগণ বলেন, হাদীছটি ‘হাসান’।

[7]. ইমাম নববী, আল-মিনহাজ শারহু ছহীহি মুসলিম ইবনিল হাজ্জাজ, (বৈরূত: দারু এহ্‌ইয়াউত্‌ তুরাছিল আরাবী, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৩৯২হিঃ), ১/১৫৫; ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া, (মদীনাঃ বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স, প্রকাশকাল: ২০০৪ইং), ৮/৪৬৬; ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, (প্রিন্স সুলতান ইবনে আব্দুল আযীয (রহেমাহুল্লাহ)-এর অর্থায়নে মুদ্রিত, রিয়ায: প্রথম প্রকাশ: ২০০১ইং), ১১/৪৭৮।
তাক্বদীরের স্তরসমূহ - প্রথম স্তর: সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্‌র চিরন্তন জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন

তাক্বদীরের স্তর চারটি। মূলতঃ এই চারটি স্তরের উপর তাক্বদীরের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত বলে অনেকেই এগুলিকে তাক্বদীরের রুকন বা স্তম্ভ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।[1]

এগুলিকে আবার তাক্বদীর উপলব্ধির প্রবেশদ্বারও বলা হয়। সেজন্য প্রত্যেক মুসলিমের এ চারটি স্তর সম্পর্কে অন্ততঃ প্রাথমিক জ্ঞানটুকু থাকা অতীব যরূরী। এগুলির একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে ব্যক্তি এই চারটি স্তরের প্রত্যেকটি জানবে এবং বিশ্বাস করবে, তাক্বদীরের প্রতি তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এই চারটির কোন একটি বা একাধিক অমান্য করবে, তাক্বদীরের প্রতি তার ঈমান ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাবে।[2]

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই চারটি স্তরে বিশ্বাসী নয়, সে মূলতঃ তাক্বদীরকেই বিশ্বাস করে না’।[3]  নিম্নে উক্ত চারটি স্তরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হলঃ

প্রথম স্তর: সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্‌র চিরন্তন জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনঃ

একথার অর্থ হচ্ছে, সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্‌র পরিপূর্ণ জ্ঞান আছে এমর্মে আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে। যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু ঘটবে, সে সম্পর্কে তিনি জানেন। আর যা ঘটেনি, তা যদি ঘটত, তাহলে কিভাবে ঘটত, তাও তিনি জানেন। সৃষ্টির ভাল-মন্দ, আনুগত্য-অবাধ্যতা ইত্যাদি সার্বিক কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি খবর রাখেন। তাদের যাবতীয় অবস্থা, হায়াত-মউত, আয়ূস্কাল, রিযিক্ব, নড়াচড়া, স্থির থাকা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি সম্যক অবগত। তাদের মধ্যে কে দুর্ভাগা ও কে সৌভাগ্যবান হবে, বরযখী জীবনে তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে, পুনরুত্থানের পরে তাদের কি হবে ইত্যাদি সব বিষয়েই তিনি চিরন্তন জ্ঞানের অধিকারী।[4]

ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাদেরকে এ বিশ্বাস করতে হবে যে, সৃষ্টিজীব কি করবে, সে বিষয়ে আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের মাধ্যমে চিরস্থায়ীভাবে সম্যক অবগত। তিনি তাদের সৎকাজ, পাপকাজ, রিযিক্ব, আয়ূসহ সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ওয়াক্বিফহাল’।[5]

উছমান ইবনে সাঈদ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, সৃষ্টি জীবকে সৃষ্টির আগে থেকেই আল্লাহ তাদের সম্পর্কে ও তাদের আমল সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও জ্ঞাত থাকবেন। সৃষ্টি জগতকে সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের সাথে একটি সরিষার দানা পরিমাণও যোগ হয় নি’।[6]

মহান আল্লাহ বলেন,

 ﴿وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ ۚ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ۚ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ﴾ [سورة الأنعام: 59]

‘তাঁর কাছেই গায়েবী বিষয়ের চাবিসমূহ রয়েছে; এগুলি তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে, তিনিই জানেন। তাঁর জানার বাইরে (গাছের) কোন পাতাও ঝরে না। তাক্বদীরের লিখন ব্যতীত কোন শস্যকণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্যও পতিত হয় না’ (আন‘আম ৫৯)।

অন্যত্রে তিনি বলেন,

﴿إِنَّ اللَّهَ عِندَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا ۖ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ﴾ [سورة لقمان: 34]

‘নিশ্চয় আল্লাহ্‌র কাছেই ক্বিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোথায় সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত’ (লুক্বমান ৩৪)।

মহান আল্লাহ আরও বলেন,

﴿عَلِمَ أَن سَيَكُونُ مِنكُم مَّرْضَىٰ ۙ وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِن فَضْلِ اللَّهِ ۙ وَآخَرُونَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ﴾ [سورة المزمل: 20]  

‘তিনি জানেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে যমীনে বিচরণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে লিপ্ত হবে’ (মুয্‌যাম্মেল ২০)।

 অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

﴿هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ﴾ [سورة الحشر: 22]

‘তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ, যিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য এবং দৃশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (হাশর ২২)।

হাদীছে এসেছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে যখন মুশরিকদের ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘তারা বেঁচে থাকলে কি আমল করত, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবগত’।[7]

ইমরান ইবনে হুছাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! কে জান্নাতী আর কে জাহান্নামী তা কি পরিজ্ঞাত বিষয়? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ’। লোকটি বললেন, তাহলে মানুষ কেন আমল করবে? তিনি বললেন,

 «كُلٌّ يَعْمَلُ لِمَا خُلِقَ لَهُ أَوْ لِمَا يُيَسِّرُ لَهُ»

‘যাকে যেজন্য সৃষ্টি করা হয়েছে বা যার জন্য যা সহজ করা হয়েছে, সে তা-ই করবে’।[8] এরকম অসংখ্য আয়াত এবং হাদীছ রয়েছে, যেগুলি সর্ব বিষয়ে মহান আল্লাহ্‌র চিরন্তন জ্ঞানের প্রমাণ বহন করে।

[1]. দেখুন: ড. ওমর সুলায়মান আশক্বার, আল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার, (কুয়েত: মাকতাবাতুল ফালাহ, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৯০ইং), পৃ: ২৯-৩৬; আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/৫৯ ইত্যাদি।

[2]. আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/৫৯।

[3]. ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ), শিফাউল আলীল ফী মাসাইলিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার ওয়াল হিকমাতি ওয়াত্‌-তা‘লীল, (বৈরূতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিইয়াহ, তৃতীয় প্রকাশ: তা.বি), পৃ: ৫৫।

[4]. ফালাহ ইবনে ইসমাঈল, আল-ই‘তিক্বাদুল ওয়াজিব নাহ্‌ওয়াল ক্বাদার/৯।

[5]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৩/১৪৮।

[6]. ইমাম দারেমী, আর-রাদ্দু আলাল-জাহমিইয়াহ, তাহক্বীক্ব: বদর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-বাদ্‌র (কুয়েত: আদ-দারুস সালাফিইয়াহ, প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৫ইং), ‘আল্লাহ্‌র ইলমের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ, পৃ: ১১২।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৮, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, ‘মুসলিম এবং কাফেরদের ছোট বাচ্চারা মারা গেলে তাদের কি হুকুম’ অনুচ্ছেদ।

[8]. ছহীহ বুখারী, ৪/২০৯, হা/৬৫৯৬, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, ‘কলম শুকিয়ে গেছে..’ অনুচ্ছেদ, (মিশর: আল-মাকতাবাহ আস-সালাফিইয়াহ, প্রথম প্রকাশ: ১৪০০হিঃ)।
তাক্বদীরের স্তরসমূহ - দ্বিতীয় স্তর: আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী লাউহে মাহ্‌ফূযে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে তার সবই লিখে রেখেছেন এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা

দ্বিতীয় স্তর: আল্লাহ তাঁর চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী লাউহে মাহ্‌ফূযে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে তার সবই লিখে রেখেছেন এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করাঃ[1]

অর্থাৎ আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে যে, মহান আল্লাহ লাউহে মাহফূযে তাঁর চিরন্তন জ্ঞান মোতাবেক সৃষ্টিজগতের সবকিছুর তাক্বদীর কলম দ্বারা বাস্তবেই লিখে রেখেছেন; তাঁর চিরন্তন জ্ঞানের কোন কিছুই এই লেখনী থেকে বাদ পড়েনি। আর লাউহে মাহ্‌ফূযের এই লিখন ছিল আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে। তখন আল্লাহ কলম সৃষ্টি করে তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে সবকিছু লেখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।[2]

ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অতঃপর তিনি লাউহে মাহ্‌ফূযে সৃষ্টির তাক্বদীর লিখেন। সর্বপ্রথম তিনি কলম সৃষ্টি করে তাকে বলেন, লিখ। সে বলে, আমি কি লিখব? আল্লাহ বলেন, ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, তার সবই লিখ’।[3]

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ ۗ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَابٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾ [سورة الحج: 70]

‘তুমি কি জান না যে, আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, সব বিষয়ে আল্লাহ জানেন। এ সবকিছুই কিতাবে লিখিত আছে। এটা আল্লাহ্‌র কাছে সহজ’ (হাজ্জ ৭০)।

 অন্যত্র মহান আল্লাহ এরশাদ করেন,

﴿مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾ [سورة الحديد: 22]

‘যমীনে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর এমন কোন মুছীবত আসে না, যা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই। নিশ্চয়ই এটি আল্লাহ্‌র পক্ষে সহজ’ (আল-হাদীদ ২২)।

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনিল আছ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, ‘আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, ‘আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ সবকিছুর তাক্বদীর লিখে রেখেছেন। তিনি বলেন, আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে’।[4]

ইমরান ইবনে হুছাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আল্লাহ ছিলেন; তাঁর পূর্বে কিছুই ছিল না। আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে। অতঃপর আল্লাহ আসমান-যমীন সৃষ্টি করলেন এবং লাউহে মাহ্‌ফূযে সবকিছু লিখে রাখলেন’।[5]

তাক্বদীর লিপিবদ্ধের পাঁচটি পর্যায়ঃ

প্রথম পর্যায়ঃ আসমান-যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে আল্লাহ লাউহে মাহ্‌ফূযে সবকিছুর তাক্বদীর লিখে রাখেন। লাউহে মাহ্‌ফূযে বান্দার ভাগ্যে ভাল বা মন্দ যা-ই লিখে রাখা হয়েছে, তা-ই সে পাবে। ইমরান ইবনে হুছাইন (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর হাদীছদ্বয়ে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি।

দ্বিতীয় পর্যায়ঃ আল্লাহ বনী আদমকে তাদের পিতা আদম (‘আলাইহিস্‌ সালাম)-এর পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করে তাদের নিকট থেকে এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তারা যেন তাঁর সাথে শিরক না করে। এসময় তিনি তাদের সবাইকে দু’বার দু’মুষ্টিতে নিয়েছিলেন এবং এক মুষ্টিকে জান্নাতবাসী আর অপর মুষ্টিকে জাহান্নামবাসী হিসাবে লিখে রেখেছিলেন। এই লিখন ছিল লাউহে মাহ্‌ফূযে লিখনের পরের স্তরে।[6]

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِن بَنِي آدَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ ۖ قَالُوا بَلَىٰ ۛ شَهِدْنَا ۛ أَن تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَٰذَا غَافِلِينَ﴾ [سورة الأعراف: 172]

‘আর যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদেরকে বের করলেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি; যাতে ক্বিয়ামতের দিন এ কথা না বলতে পার যে, আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে বেখবর। ’ (আল-আ‘রাফ ১৭২)।

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে বলতে শুনেছি, ‘আল্লাহ অন্ধকারে তাঁর সৃষ্টিকে সৃষ্টি করে স্বীয় নূরের আলোচ্ছটা দিলেন। ঐদিন যাকে আল্লাহ্‌র নূরের আলোচ্ছটা স্পর্শ করেছে, সে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে, যাকে স্পর্শ করেনি, সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। সেজন্যই তো আমি বলি, কলম শুকিয়ে গেছে’।[7]

মনে রাখতে হবে, একদলকে জান্নাতী এবং অপর দলকে জাহান্নামী হিসাবে লিখে দেওয়া অথবা একদলকে আল্লাহ্‌র নূরের আলোচ্ছটা স্পর্শ করা এবং আরেক দলকে স্পর্শ না করার বিষয়টি এলোপাতাড়ি কোন বিষয় নয়; বরং আল্লাহ্‌র চিরন্তন জ্ঞান, ইচ্ছা এবং তাঁর পরিপূর্ণ ন্যায় ও ইনছাফের উপর ভিত্তি করেই তা সংঘটিত হয়েছে।

তৃতীয় পর্যায়ঃ মানুষ মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় আল্লাহ্‌র নির্দেশে ফেরেশতা এসে তার আয়ূ, কর্ম, রিযিক্ব এবং সে সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা, তা লিখে দেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,

«إِنَّ أَحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ فِى بَطْنِ أُمِّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا ، ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَ ذَلِكَ ، ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذَلِكَ ، ثُمَّ يَبْعَثُ اللَّهُ مَلَكًا ، فَيُؤْمَرُ بِأَرْبَعِ كَلِمَاتٍ ، وَيُقَالُ لَهُ اكْتُبْ عَمَلَهُ وَرِزْقَهُ وَأَجَلَهُ وَشَقِىٌّ أَوْ سَعِيد»

‘তোমাদের যে কাউকে চল্লিশ দিন ধরে তার মায়ের পেটে একত্রিত করা হয়, তারপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে সে জমাটবদ্ধ রক্ত হয় এবং তারপর অনুরূপ চল্লিশ দিনে সে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। অতঃপর চারটি বিষয়ের নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তার কাছে ফেরেশতা পাঠান এবং তার রিযিক্ব, দুনিয়াতে তার অবস্থানকাল, তার আমলনামা এবং সে দুর্ভাগা হবে না সৌভাগ্যবান হবে তা লিখে দেওয়ার জন্য তাঁকে বলা হয়’।[8]

লাউহে মাহ্‌ফূযের লিখন ছিল সমগ্র সৃষ্টিকুলের; কিন্তু মায়ের পেটের এই লিখন শুধুমাত্র মানুষ জাতির জন্য নির্দিষ্ট।[9]

চতুর্থ পর্যায়ঃ প্রত্যেক ক্বদরের রাতে ঐ বছরের সবকিছু লেখা হয়। লাউহে মাহফূযের লিখন অনুযায়ী আল্লাহ ফেরেশতামণ্ডলীকে ঐ বছরের সবকিছু লিখতে নির্দেশ দেন। ইহাকে বাৎসরিক তাক্বদীর বলা হয়। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ, فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ﴾[سورة الدخان: 3-4]  

‘আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়’ (দুখান ৩-৪)।[10]

ইবনে আব্বাস বলেন, ক্বদরের রাতে লাউহে মাহফূযের লিখন অনুযায়ী ঐ বছরের জন্ম, মৃত্যু, রিযিক্ব, বৃষ্টি ইত্যাদি সবকিছু আবার লেখা হয়। এমনকি ঐ বছর কে হজ্জ করবে আর কে করবে না, তাও লিখে রাখা হয়।[11]

পঞ্চম পর্যায়ঃ পূর্বের লিখিত তাক্বদীর অনুযায়ী প্রত্যেক দিন সবকিছুকে নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়। ইহাকে প্রাত্যহিক তাক্বদীর বলে। মহান আল্লাহ বলেন,

 ﴿كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ﴾ [سورة الرحمن: 29]

‘তিনি প্রতিদিন কোন না কোন কাজে রত আছেন’ (রহমান ২৯)।[12]

ইবনে জারীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলে ছাহাবায়ে কেরাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যেক দিন তিনি কি করেন? রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, কাউকে ক্ষমা করেন, কারো বিপদাপদ দূর করেন, কারো মর্যাদা বৃদ্ধি করেন আবার কারো মর্যাদার হানি করেন।[13]

তাক্বদীর লিপিবদ্ধের এই পাঁচটি পর্যায়ের শেষোক্ত চারটি পর্যায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বান্দার বিভিন্ন বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতামণ্ডলীকে তাঁদের স্ব-স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করা[14] এবং এগুলি লাউহে মাহফূযে লিখিত তাক্বদীরের বাইরে নয়; বরং এগুলি লাউহে মাহফূযের তাক্বদীরেরই অন্তর্ভুক্ত।[15]

শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিইয়াহ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ফেরেশতামণ্ডলীকে আল্লাহ তাক্বদীরের যেসব বিষয়ে অবহিত করান, তাঁরা কেবল সেগুলিই জানেন; সেগুলির বাইরে কিছুই জানেন না। যেমন: বান্দার মৃত্যু, রিযিক্ব, সে সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা ইত্যাদি।[16]

উল্লেখ্য যে, প্রাত্যহিক তাক্বদীর বাৎসরিক তাক্বদীর অপেক্ষা খাছ। বাৎসরিক তাক্বদীর মায়ের রেহেমে থাকাকালীন লিখিত তাক্বদীর অপেক্ষা খাছ। রেহেমে থাকাকালীন লিখিত তাক্বদীর আল্লাহ কর্তক মানুষের অঙ্গীকার নেওয়ার সময়কালীন তাক্বদীর অপেক্ষা খাছ। আর অঙ্গীকার নেওয়ার সময়কালীন তাক্বদীর লাউহে মাহফূযের তাক্বদীর অপেক্ষা খাছ।[17]

[1]. আব্দুল আযীয মুহাম্মাদ, আল-কাওয়াশেফুল জালিইয়াহ আন মা‘আনিল ওয়াসেত্বিইয়াহ, (রিয়ায: মাকতাবাতুর রিয়ায আল-হাদীছাহ, ষষ্ঠ প্রকাশ: ১৯৭৮ইং), পৃ: ৬২০।

[2]. আল-ই‘তিক্বাদুল ওয়াজিব নাহ্‌ওয়াল ক্বাদার/১১।

[3]. মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ৩/১৪৮।

[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৫৩ ‘তাক্বদীর’ অধ্যায়, ‘আদম এবং মূসা (আঃ)-এর বিতর্ক’ অনুচ্ছেদ,।

[5]. ছহীহ বুখারী, ৪/৩৮৭, হা/৭৪১৮, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, ‘তাঁর আরশ ছিল পানির উপরে এবং তিনিই আরশের সুমহান অধিপতি’ অনুচ্ছেদ।

[6]. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪৭০৩, ‘সুন্নাহ’ অধ্যায়, ‘তাক্বদীর’ অনুচ্ছেদ; ছালেহ ইবনে আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ আলুশ্‌-শায়খ, জামে‘উ শুরূহিল আক্বীদাতিত্‌-ত্বহাবিইয়াহ, ১/৫৬৯।

[7]. জামে‘ তিরমিযী, হা/২৬৪২, ঈমান অধ্যায়, ‘এই উম্মতের মধ্যে বিভক্তি’ অনুচ্ছেদ, ইমাম তিরমিযী (রহেমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।

[8]. ছহীহ বুখারী, ২/৪২৪, হা/৩২০৮, ‘সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায়, ‘ফেরেশতামণ্ডলীর বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।

[9]. জামে‘উ শুরূহিল আক্বীদাতিত্‌-ত্বহাবিইয়াহ, ১/৫৬৯-৫৭০; আব্দুল্লাহ জিবরীন, আত-তা‘লীক্বাতুয্‌ যাকিইয়াহ আলাল আক্বীদাতিল ওয়াসেত্বিইয়াহ, (রিয়ায: দারুল ওয়াত্বান, প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৮ইং), ২/১৫৭।

[10]. প্রাগুক্ত।

[11]. ইমাম ক্বুরত্বুবী, আল-জামে‘ লিআহকামিল ক্বুরআন, (কায়রো: দারুল কুতুবিল মিছরিইয়াহ, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৬৪ইং), ৬/১২৭।

[12]. জামে‘উ শুরূহিল আক্বীদাতিত্‌-ত্বহাবিইয়াহ, ১/৫৭০; আত-তা‘লীক্বাতুয্‌ যাকিইয়াহ আলাল আক্বীদাতিল ওয়াসেত্বিইয়াহ, ২/১৫৭।

[13]. ইবনে জারীর ত্ববারী, তাফসীরে ত্ববারী (জামেউল বায়ান ফী তা’বীলিল ক্বুরআন), তাহক্বীক্ব: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুহসিন তুর্কী, (দারু হাজার/হিজর, প্রথম প্রকাশ: ২০০১ইং), ২২/২১৪, বর্ণনাটি ‘হাসান’ (মা‘আরেজুল ক্ববূল-এর ৩/৯৩৯ পৃষ্ঠার টীকা দ্র:)।

[14]. সাঈদ ইসমাঈল, কাশফুল গায়ূম আনিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার, (প্রকাশকাল: ১৪১৭হি:), পৃ: ৩১-৩২; মিরক্বাতুল মাফাতীহ শারহু মিশকাতিল মাছাবীহ, ১/২৪০।

[15]. আব্দুর রাযযাক ইবনে আব্দুল মুহসিন আল-বাদ্‌র, তাযকিরাতুল মু’তাসী শারহু আক্বীদাতিল হাফেয আব্দিল গাণী আল-মাক্বদেসী (কুয়েত: গিরাস ফর প্রিন্টিং এণ্ড ডিস্ট্রিবিউশন, প্রথম প্রকাশ: ২০০৩ইং), পৃ: ১৫৩; আল-ঈমানু বিল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার/২৫২।

[16]. ফাতাওয়া ইবনে তায়মিইয়াহ, ১৪/৪৮৮-৪৯২।

[17]. জামে‘উ শুরূহিল আক্বীদাতিত্‌-ত্বহাবিইয়াহ, ১/৫৭০; হাফেয ইবনে আহমাদ হাকামী, মা‘আরেজুলল ক্ববূল, (দাম্মাম: দারু ইবনিল ক্বাইয়িম, তৃতীয় প্রকাশ: ১৯৯৫ ইং), ৩/৯৩৯।
তাক্বদীরের স্তরসমূহ - তৃতীয় স্তরঃ আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই হয় না একথার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস করা

আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে, সবকিছু সম্পর্কে আল্লাহ্‌র চিরন্তন জ্ঞান অনুযায়ী তিনি সেগুলি লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন এবং সেগুলিতে তাঁর ইচ্ছাও রয়েছে। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা হয়। যা ইচ্ছা করেন না, তা হয় না। আল্লাহ্‌র রাজ্যে এমনকি কোন কিছুর সামান্যতম নড়াচড়া বা স্থির থাকাও তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত হয় না। তিনি কোন কিছুকে যখন, যেভাবে এবং যে উদ্দেশ্যে করতে চান, তা ঠিক সে মতেই সংঘটিত হয়; তার তিল পরিমাণ ব্যত্যয় ঘটে না। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান, তিনি ব্যতীত কোন হক্ব মাবূদ নেই।[1]

মহান আল্লাহ বলেন,

 ﴿إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ﴾ [سورة يس: 82]

‘তিনি যখন কোন কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন তাকে কেবল বলে দেন, ‘হও’ এবং তখনই তা হয়ে যায় (ইয়াসীন ৮২)। অন্যত্র তিনি বলেন,

﴿وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً﴾ [سورة هود: 118]

‘আর তোমার পালনকর্তা যদি ইচ্ছা করতেন, তবে অবশ্যই সব মানুষকে একই জাতিতে পরিণত করতে পারতেন (হূদ ১১৮)। তিনি আরো বলেন,

﴿وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَن فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا﴾ [سورة يونس: 99]

‘আর তোমার প্রতিপালক যদি চাইতেন, তাহলে ভূ-পৃষ্ঠের সবাই ঈমান আনত (ইউনুস ৯৯)। এ জাতীয় আরো বহু আয়াত আছে, যেগুলি আল্লাহ্‌র পূর্ণ ইচ্ছা প্রমাণ করে।

আবু হুরায়রাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, দো‘আ করার সময় তোমাদের কেউ যেন না বলে, হে আল্লাহ! আপনি চাইলে আমাকে ক্ষমা করুন, আপনি চাইলে আমাকে রহম করুন এবং আপনি চাইলে আমাকে রিযিক্ব দান করুন। বরং সে যেন পাকাপোক্তভাবে তলব করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা খুশী, তা-ই করেন, কেউ তাঁকে বাধ্য করে না।[2]

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘পৃথিবীতে আগত সকল নবী-রাসূল (আলাইহিমুস সালাম)-এর সর্বসম্মতি, আল্লাহ প্রেরিত প্রত্যেকটি আসমানী কিতাব, আল্লাহ প্রদত্ত সৃষ্টির স্বাভাবিক অবস্থা এবং যু্ক্তি ও প্রত্যক্ষ দর্শন প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্‌র রাজ্যে তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই ঘটে না। তিনি যা ইচ্ছা করেন, তা হয়। আর যা তিনি ইচ্ছা করেন না, তা হয় না।[3]

[1]. আল-ই‘তিক্বাদুল ওয়াজিব নাহ্‌ওয়াল ক্বাদার/১৩।

[2]. ছহীহ বুখারী, ৪/৩৯৯-৪০০, হা/৭৪৭৭, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, ‘আল্লাহ্‌র ইচ্ছা’ অনুচ্ছেদ।

[3]. শিফাউল আলীল ফী মাসায়িলিল ক্বাদার ওয়াল-হিকমাতি ওয়াত-তা‘লীল/৯৩।
তাক্বদীরের স্তরসমূহ - চতুর্থ স্তরঃ আল্লাহ্‌র রাজ্যের সবকিছু তিনিই সৃষ্টি করেছেন একথার প্রতি ঈমান আনা

আমাদেরকে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে, আল্লাহ সবকিছুই জানেন, তাঁর চিরন্তন এই জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি সবকিছুই লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন, এ সবকিছুর পেছনে তাঁর পূর্ণ ইচ্ছা বিদ্যমান এবং সেই ইচ্ছা অনুযায়ীই তিনি সবকিছু সৃষ্টি করে থাকেন। প্রত্যেকটি জিনিসকে তিনি যে আকৃতিতে, যে সময়ে এবং যে বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টি করতে চান, সেভাবেই সৃষ্টি করেন।[1] আল্লাহ প্রত্যেকটি মানুষ এবং তার কর্ম সৃষ্টি করেছেন। আসমান-যমীনে অণু-পরমাণুসহ এমন কোন কিছু নেই যে, আল্লাহ তাকে এবং তার নড়াচড়া বা স্থিরতাকে সৃষ্টি করেননি।[2] ঘরের জানালা বা অন্য কোন ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতরে সূর্য্যকিরণ প্রবেশ করলে তাতে অসংখ্য অণু-পরমাণু পরিলক্ষিত হয়, এমনকি এসব অণু-পরমাণুর একটি কণাও আল্লাহ্‌র সৃষ্টির বাইরে নয়। বরং সেগুলির প্রত্যেকটি কণা সম্পর্কে আল্লাহ্‌র চিরন্তন সূক্ষ্ম জ্ঞান রয়েছে, তিনি তাকে লাউহে মাহফূযে লিখে রেখেছেন, তাতে তাঁর ইচ্ছা রয়েছে এবং সময় মত তিনি তা সৃষ্টি করেন। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ۖ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ﴾ [سورة الزمر: 62]

‘আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর দায়িত্বশীল’ (যুমার ৬২)।

বান্দার কর্মের স্রষ্টাও কি আল্লাহ নন?: বিভ্রান্ত অনেক ফের্কা বান্দার কর্মকে আল্লাহ্‌র সৃষ্ট নয় বলে মিথ্যা দাবী করে। কিন্তু আহলুস্‌ সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা মতে, বান্দার কর্মেরও মূল স্রষ্টা মহান আল্লাহ্‌ই; কিন্তু সেগুলি বাস্তবায়ন করে বান্দা। এরশাদ হচ্ছে,

 ﴿وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ﴾ [سورة الصافات: 96]

‘আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমাদের কর্মকে সৃষ্টি করেছেন’ (ছফফাত ৯৬)। মুফাস্‌সিরগণ বলেন, উক্ত আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, বান্দার কর্ম আল্লাহ্‌রই সৃষ্ট।[3] মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

 ﴿وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّمَّا خَلَقَ ظِلَالًا وَجَعَلَ لَكُم مِّنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرَّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُم بَأْسَكُمْ ۚ كَذَٰلِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ﴾ [سورة النحل: 81]

‘আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট বস্তু দ্বারা তোমাদের জন্য ছায়া বানিয়েছে। পাহাড়সমূহে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরী করেছেন এবং তোমাদের জন্যে পোশাক তৈরী করে দিয়েছেন, যা তোমাদেরকে গ্রীষ্ম এবং বিপদের সময় রক্ষা করে। এমনিভাবে তিনি তোমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহের পূর্ণতা দান করেন, যাতে তোমরা আত্মসমর্পণ কর’ (নাহ্‌ল ৮১)।

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনুল ক্বাইয়িম (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ এখানে স্পষ্ট ঘোষণা করলেন যে, তৈরীকৃত পোষাক তাঁরই তৈরী। কারণ পোষাকের কাঁচামালকে পোষাক বলা হয় না; বরং মানুষ কর্তৃক পোষাকের রূপ দেওয়া হলেই কেবল তাকে পোষাক বলা যায়। এতদ্‌সত্ত্বেও এটিকে  সরাসরি আল্লাহ্‌র সৃষ্টি বলা হল’।[4]

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,

 «إِنَّ اللَّهَ يَصْنَعُ كُلَّ صَانِعٍ وَصَنْعَتَهُ»

‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহই প্রত্যেকটি তৈরীকারক এবং তার তৈরীকৃত বস্তুকে সৃষ্টি করেন’।[5]

ইমাম বুখারী (রহেমাহুল্লাহ) এই হাদীছটি উল্লেখ করার পর বলেন, فَأَخْبَرَ أَنَّ الصِّنَاعَاتِ وَأَهْلَهَا مَخْلُوقَةٌ ‘রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাদীছটিতে ঘোষণা করলেন, তৈরীকৃত সবকিছু এবং সেগুলির তৈরীকারক আল্লাহ্‌রই সৃষ্টি’।[6]

আল্লাহ্‌র সৃষ্ট কর্ম মানুষ কর্তৃক বাস্তবায়নের একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একজন ফার্মাসিস্ট কোন ওষুধ বা বিষ বানাতে যেয়ে কয়েক প্রকার পদার্থ চয়ন করে। এরপর প্রত্যেক প্রকার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পদার্থ গ্রহণ করে ওষুধ তৈরী করে। আবার দেখা যায়, ঐ একই পদার্থের পরিমাণে পরিবর্তন আনে এবং সেগুলিকে সংমিশ্রণের মাধ্যমে বিষ তৈরী করে। এখানে ঔষধি এই পদার্থগুলির স্রষ্টা যেমন আল্লাহ, তেমনি ঐ ফার্মাসিস্ট, তার ক্ষমতা এবং জ্ঞানের স্রষ্টাও তিনি। বরং এই ওষুধ কিংবা বিষের স্রষ্টাও মূলতঃ আল্লাহই। অন্যভাবে বলা যায়, মহান আল্লাহ তার বান্দাকে কর্মশক্তি, ইচ্ছাশক্তি এবং জ্ঞান দান করেছেন। ফলে সে আল্লাহ্‌র সৃষ্ট পদার্থ থেকেই ভাল বা মন্দ জিনিস আবিষ্কার করছে। সে শূন্য থেকে কোন কিছু তৈরী করছে না; বরং যা করছে, আল্লাহ্‌র সৃষ্ট বস্তু থেকেই করছে; আর আল্লাহ্‌র দেয়া ক্ষমতা দিয়েই করছে।[7]

[1]. আল-ই‘তিক্বাদুল ওয়াজিব নাহ্‌ওয়াল ক্বাদার/১৪।

[2]. মা‘আরেজুল ক্ববূল ৩/৯৪০।

[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭/২৬; ইবনুল জাওযী, যাদুল মাসীর ফী ইলমিত তাফসীর, (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, তৃতীয় প্রকাশ: ১৯৮৪ইং), ৭/৭০ এবং অন্যান্য।

[4]. শিফাউল আলীল/১১৮।

[5]. ইমাম বুখারী, খালক্বু আফআলিল ইবাদ, ‘বান্দাদের কর্মসমূহ’ অনুচ্ছে, (বৈরূত: মুআস্‌সাসাতুর্‌ রিসালাহ, তৃতীয় প্রকাশ: ১৯৯০ ইং), পৃ: ২৫।

[6]. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৫।

[7]. কাশফুল গায়ূম আনিল ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১৮-১৯।
তাক্বদীরে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি

বিভ্রান্তির কারণঃ তাক্বদীরে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির অনেকগুলি কারণ রয়েছে। আমরা তন্মধ্যে মৌলিক কারণগুলি উল্লেখ করলামঃ

১. আল্লাহ্‌র কর্মকে সৃষ্টির কর্মের সাথে তুলনা করাঃ ভ্রান্ত প্রধান ফের্কাগুলি সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেটি প্রশংসনীয়, আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রেও ঐ একই জিনিসকে প্রশংসনীয় ভেবেছে। পক্ষান্তরে যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিন্দনীয়, সেটিকেই আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রেও নিন্দনীয় মনে করেছে। যেমনঃ তারা বলেছে, মানুষের ক্ষেত্রে যা ‘ন্যায়’ হিসাবে খ্যাত, আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রেও তা ‘ন্যায়’ হিসাবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে মানুষের ক্ষেত্রে যাকে ‘যুলম’ গণ্য করা হয়, তা আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রেও ‘যুলম’ হিসাবেই গণ্য হবে। তাক্বদীরকে ঘিরে বিভ্রান্তির এটি অন্যতম প্রধান কারণ।

২. আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টির মধ্যে পার্থক্য না করা: তারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা এবং সন্তুষ্টিকে একই গণ্য করেছে। সুতরাং যেসব বিষয়ের প্রতি আল্লাহ শরঈভাবে সন্তুষ্ট নন, তাদের দৃষ্টিতে সেগুলিকে তিনি সৃষ্টিগতভাবেও চাননি। যেমনঃ যেহেতু আল্লাহ কুফরীসহ অন্যান্য অন্যায়-অপকর্মকে ভালবাসেন না, সেহেতু তিনি সেগুলি সৃষ্টিও করেননি।

৩. মানুষের সংকীর্ণ বোধশক্তিকে ভাল-মন্দ নির্ণয়ের মানদণ্ড গণ্য করাঃ তাদের দৃষ্টিতে, আল্লাহ্‌র রাজ্যে যা কিছু হয়, সেগুলির ভাল-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করবে মানুষের আক্বল বা বোধশক্তি। সুতরাং আল্লাহ্‌র সৃষ্টিসমূহের মধ্যে যেগুলিকে আক্বল ভাল মনে করবে, সেগুলিই ভাল হিসাবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে আক্বল যেগুলিকে মন্দ গণ্য করবে, সেগুলি মন্দ হিসাবেই পরিগণিত হবে এবং সেগুলিকে আল্লাহ্‌র দিকে সম্বন্ধিত না করা যরূরী হবে।

৪. আল্লাহ্‌র প্রত্যেকটি কর্মের রহস্য উদঘাটনের ব্যর্থ প্রয়াস চালানোঃ তাক্বদীরের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এমর্মে প্রশ্ন করা যে, ‘এটি কেন হল?’ কারণ এ জাতীয় প্রশ্ন মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দেয়।[1]


কে সর্বপ্রথম তাক্বদীরকে অস্বীকার করে?: তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনা মানুষের স্বভাবগত বিষয়। সেজন্য জাহেলী যুগে কিংবা ইসলামের আবির্ভাবের পরে আরবে কেউ তাক্বদীরকে অস্বীকার করত না। কিন্তু গ্রীক এবং ভারতীয় দর্শনের বই-পুস্তক মুসলিম দেশসমূহে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাক্বদীরকে ঘিরে ফেতনা শুরু হয়। দিমাশ্‌ক এবং বাছরা নগরীতে সর্বপ্রথম এই ফাসাদ শুরু হয়। মক্কা-মদীনাতে ইলমের ব্যাপক চর্চা থাকার কারণে সেখানে এমন ফেতনা প্রবেশ করতে পারে নি।[2]

বাছরার অধিবাসী অগ্নিপূজকদের ঘরের সন্তান ‘সিসওয়াইহ্‌’ বা ‘সাওসান’ নামে এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম তাক্বদীরকে ঘিরে বিদ‘আত সৃষ্টি করে। ইমাম আওযা‘ঈ (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইরাকের অধিবাসী সাওসান নামক এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম তাক্বদীর সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য পেশ করে। এই ব্যক্তি মূলতঃ খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী ছিল, পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করলেও কিছুদিন পর আবার খ্রীষ্টান ধর্মে ফিরে যায়। তার কাছ থেকে তাক্বদীর অস্বীকারের এই মন্ত্র গ্রহণ করে মা‘বাদ জুহানী এবং মা‘বাদের কাছ থেকে গ্রহণ করে গায়লান’।[3] এই দু’জনের পরে ওয়াছেল ইবনে আত্বা এবং আমর ইবনে ওবাইদ এই মতবাদের প্রচার-প্রচারণা শুরু করে।[4]

ইমাম মুসলিম (রহেমাহুল্লাহ) ইয়াহ্‌ইয়া ইবনে ইয়া‘মুর (রহেমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করেন, ইয়াহ্‌ইয়া বলেন, ‘বাছরায় মা‘বাদ জুহানী নামীয় এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম তাক্বদীর অস্বীকার করে। আমি এবং হুমাইদ ইবনে আব্দুর রহমান হিম্‌ইয়ারী হজ্জ্ব বা ওমরা পালন করতে গেলাম। আমরা পরস্পর বলাবলি করলাম, যদি কোন ছাহাবীর সাথে আমাদের দেখা হয়, তাহলে তাঁর কাছে তাক্বদীর অস্বীকারকারীদের বক্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব। যাহোক, আমরা দু’জন ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর ছেলে আব্দুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কে মসজিদে প্রবেশ করতে দেখে তাঁকে দু’পাশ থেকে ঘিরে দাঁড়ালাম। আমি কথা শুরু করলাম, বললাম, হে আবু আব্দির রহমান! আমাদের এলাকায় কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, যারা কুরআন পড়ে, ইলম অর্জন করে... ইত্যাদি। কিন্তু তারা মনে করে, তাক্বদীর বলে কিছু নেই, আল্লাহ্‌র অজান্তেই সবকিছু এমনি এমনি হয়।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বললেন, ‘তাদের সাথে যদি তোমাদের দেখা হয়, তাহলে বলে দিও, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই এবং আমার সাথেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কসম করে বলছে, তাদের কারো যদি উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ স্বর্ণ হয় এবং সে তা দান করে দেয়, তবুও তাক্বদীরের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত আল্লাহ তার ঐ দান গ্রহণ করবেন না’। অতঃপর তিনি বললেন, আমার পিতা ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) আমাকে বর্ণনা করেছেন...। এরপর তিনি হাদীছে জিবরীল নামে প্রসিদ্ধ হাদীছটি উল্লেখ করলেন।[5]

এরপর উমাইয়া শাসনামলের শেষের দিকে জাবরিইয়াহ্‌দের আবির্ভাব ঘটে। তাদের মতে, বান্দা ইচ্ছা শক্তিহীন বাধ্যগত জীব। জাহ্‌ম ইবনে ছাফওয়ান নামক এক ব্যক্তি এই ভ্রান্ত মতবাদের পুরোধা।[6]

[1]. ছালেহ ইবনে আব্দুল আযীয আলুশ্‌-শায়খ, জামে‘ শুরূহিল-আক্বীদাতিত্‌-ত্বহাবিইয়াহ, ১/৫৪১-৫৪৩।

[2]. আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার/১৬৩।

[3]. ইমাম আজুর্‌রী, আশ্‌-শারী‘আহ, তাহক্বীক্ব: ড. আব্দুল্লাহ দুমায়জী, ‘তাক্বদীরের বিষয়টি কিভাবে এবং কেন হয়? ইত্যাদি অনুসন্ধান বর্জন করতে হবে আর ইহার প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং আত্মসমর্পণ করতে হবে’ অনুচ্ছেদ (রিয়ায: দারুল ওয়াত্বান, তা.বি), ২/৯৫৯; ইমাম লালকাই, শারহু উছূলি ইতিক্বাদি আহলিস্‌-সুন্নাহ, ‘ইসলামে তাক্বদীর অস্বীকারের বিষয়টি কবে শুরু হয়’ অনুচ্ছেদ, (রিয়ায: দারু ত্বায়বাহ, তা.বি), ৪/৭৫০।

[4]. আল-ঈমান বিল-ক্বাযা ওয়াল ক্বাদার/১৬৪।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮, ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘ঈমান, ইসলাম ও ইহসানের বর্ণনা, তাক্বদীরের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য এবং যে ব্যক্তি তাক্বদীরে বিশ্বাস করে না, তার সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা’ অনুচ্ছেদ।

[6]. ওমর সুলায়মান আশক্বার, আল-ক্বাযা ওয়াল-ক্বাদার/২৩।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 পরের পাতা »