সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ আবূ মালিক কামাল বিন আস-সাইয়্যিদ সালিম ৬৭ টি
সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ আবূ মালিক কামাল বিন আস-সাইয়্যিদ সালিম ৬৭ টি

হাদীস (حَدِيْث) এর শাব্দিক অর্থ: নতুন, প্রাচীন ও পুরাতন এর বিপরীত বিষয়। এ অর্থে যে সব কথা, কাজ ও বস্ত্ত পূর্বে ছিল না, এখন অস্তিত্ব লাভ করেছে তাই হাদীস। এর আরেক অর্থ হলো: কথা। ফক্বীহগণের পরিভাষায় নাবী কারীম (ﷺ) আল্লাহ্‌র রাসূল হিসেবে যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাকে হাদীস বলা হয়। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ এর সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কিত বর্ণনা ও তার গুণাবলী সম্পর্কিত বিবরণকেও হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেন। এ হিসেবে হাদীসকে প্রাথমিক পর্যায়ে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:

১। ক্বওলী হাদীস: কোন বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেছেন, অর্থাৎ যে হাদীসে তাঁর কোন কথা বিবৃত হয়েছে তাকে ক্বওলী (বাণী সম্পর্কিত) হাদীস বলা হয়।

২। ফে’লী হাদীস: মহানাবী (ﷺ)-এর কাজকর্ম, চরিত্র ও আচার-আচরণের ভেতর দিয়েই ইসলামের যাবতীয় বিধি-বিধান ও রীতিনীতি পরিস্ফুট হয়েছে। অতএব যে হাদীসে তাঁর কোন কাজের বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে তাকে ফে’লী (কর্ম সম্পর্কিত) হাদীস বলা হয়।

৩। তাকরীরী হাদীস: সাহাবীগণের যে সব কথা বা কাজ নাবী কারীম (ﷺ)-এর অনুমোদন ও সমর্থন প্রাপ্ত হয়েছে, সে ধরনের কোন কথা বা কাজের বিবরণ হতেও শরীয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি জানা যায়। অতএব যে হাদীসে এ ধরনের কোন ঘটনার বা কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় তাকে তাকরীরী (সমর্থন মূলক) হাদীস বলে।

সুন্নাহ (السنة): হাদীসের অপর নাম সুন্নাহ্ (السنة) সুন্নাত শব্দের অর্থ চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি। যে পন্থা ও রীতি নাবী কারীম (ﷺ) অবলম্বন করতেন তাকে সুন্নাত বলা হয়। অন্য কথায় রাসুলুল্লাহ (ﷺ) প্রচারিত উচ্চতম আদর্শই সুন্নাত। কুরআন মাজিদে মহত্তম ও সুন্দরতম আদর্শ (أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ) বলতে এই সুন্নাতকেই বুঝানো হয়েছে।

খবর (خبر): হাদীসকে আরবী ভাষায় খবরও (خبر) বলা হয়। তবে খবর শব্দটি হাদীস ও ইতিহাস উভয়টিকেই বুঝায়।

আসার (أثر ): আসার শব্দটিও কখনও কখনও রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর হাদীসকে নির্দেশ করে। কিন্তু অনেকেই হাদীস ও আসার এর মধ্যে কিছু পার্থক্য করে থাকেন। তাঁদের মতে- সাহাবীগণ থেকে শরীয়াত সম্পর্কে যা কিছু উদ্ধৃত হয়েছে তাকে আসার বলে।


ইলমে হাদীসের কতিপয় পরিভাষা

সাহাবী (صحابى): যিনি ঈমানের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর সাহচর্য লাভ করেছেন এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবী বলা হয়।

তাবেঈ (تابعى) : যিনি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর কোন সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততপক্ষ তাঁকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে তাবেঈ বলা হয়।

তাবে-তাবেঈ (تابعى تابع) : যিনি কোন তাবেঈ এর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততপক্ষ তাঁকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁকে তাবে-তাবেঈ বলা হয়।

মুহাদ্দিস (محدث) : যিনি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন তাঁকে মুহাদ্দিস বলা হয়।

শাইখ (شيخ) : হাদীসের শিক্ষাদাতা রাবীকে শায়খ বলা হয়।

শাইখান (شيخان) : সাহাবীগনের মধ্যে আবূ বকর (রা.) ও উমর (রা.) - কে একত্রে শাইখান বলা হয়। কিন্তু হাদীস শাস্ত্রে ইমাম বুখারী (রাহি.) ও ইমাম মুসলিম (রাহি.)-কে এবং ফিক্বহ-এর পরিভাষায় ইমাম আবূ হানীফা (রাহি.) ও আবূ ইউসুফ (রাহি.)-কে একত্রে শাইখান বলা হয়।

হাফিয (حافظ) : যিনি সনদ ও মতনের বৃত্তান্ত সহ এক লাখ হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাঁকে হাফিয বলা হয়।

হুজ্জাত (حجة) : অনুরূপভাবে যিনি তিন লক্ষ হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাঁকে হুজ্জাত বলা হয়।

হাকিম (حاكم) : যিনি সব হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাকে হাকিম বলা হয়।

রিজাল (رجال) : হাদীসের রাবী সমষ্টিকে রিজাল বলে। যে শাস্ত্রে রাবীগণের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে তাকে আসমাউর-রিজাল বলা হয়।

রিওয়ায়াত (رواية): হাদীস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়াত বলে। কখনও কখনও মূল হাদীসকেও রিওয়ায়াত বলা হয়। যেমন- এই কথার সমর্থনে একটি রিওয়ায়াত (হাদীস) আছে।

সনদ (سند): হাদীসের মূল কথাটুকু যে সূত্র পরম্পরায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে সনদ বলা হয়। এতে হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে।

মতন (متن): হাদীসে মূল কথা ও তার শব্দ সমষ্টিকে মতন বলে।

মারফূ (مرفوع): যে হাদীসের সনদ (বর্ণনা পরম্পরা) রাসুলুল্লাহ (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মারফূ হাদীস বলে।

মাওকূফ (موقوف) : যে হাদীসের বর্ণনা- সূত্র ঊর্ধ্ব দিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে , অর্থাৎ যে সনদ -সূত্রে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে তাকে মাওকূফ হাদীস বলে। এর অপর নাম আসার।

মাকতূ (مقطوع): যে হাদীসের সনদ কোন তাবেঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে মাকতূ হাদীস বলা হয়।

তা’লীক (تعليق): কোন কোন গ্রন্থকার হাদীসের পূর্ণ সনদ বাদ দিয়ে কেবল মূল হাদীস বর্ণনা করেছেন। এরূপ করাকে তা’লীক বলা হয়।

মুদাল্লাস (مدلس): যে হাদীসের রাবী নিজের প্রকৃত শাইখের (উস্তাদের) নাম উল্লেখ না করে তার উপরস্থ শাইখের নামে এভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে মনে হয় যে, তিনি নিজেই উপরস্থ শাইখের নিকট তা শুনেছেন অথচ তিনি তাঁর নিকট সেই হাদীস শুনেন নি- সে হাদীসকে মুদাল্লাস হাদীস এবং এইরূপ করাকে ‘তাদ্লীস’ আর যিনি এইরূপ করেন তাকে মুদালস্নীস বলা হয়।

মুযতারাব (مضطرب): যে হাদীসের রাবী হাদীসের মতন ও সনদকে বিভিন্ন প্রকারে বর্ণনা করেছেন সে হাদীসকে হাদীসে মুযতারাব বলা হয়। যে পর্যন্ত না এর কোনরূপ সমন্বয় সাধন সম্ভবপর হয়, সে পর্যন্ত এই হাদীসের ব্যাপারে অপেক্ষা করতে হবে অর্থাৎ এই ধরনের রিওয়ায়াত প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

মুদ্রাজ (مدرج): যে হাদীসের মধ্যে রাবী নিজের অথবা অপরের উক্তিকে অনুপ্রবেশ করিয়েছেন, সে হাদীসকে মুদ্রাজ এবং এইরূপ করাকে ‘ইদরাজ’ বলা হয়।

মুত্তাসিল (متصل): যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষত আছে, কোন সত্মরেই কোন রাবীর নাম বাদ পড়ে নি তাকে মুত্তাসিল হাদীস বলে।

মুনকাতি (منقطع): যে হাদীসের সনদে ধারাবাহিকতা রক্ষত হয় নি, মাঝখানে কোন এক সত্মরে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুনকাতি হাদীস, আর এই বাদ পড়াকে ইনকিতা বলা হয়।

মুরসাল (مرسل): যে হাদীসের সনদে ইনকিতা শেষের দিকে হয়েছে, অর্থাৎ সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে এবং তাবেঈ সরাসরি রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর উল্লেখ করে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাকে মুরসাল হাদীস বলা হয়।

মু’আল্লাক ( معلق ) : সনদের ইনকিতা প্রথম দিকে হলে, অর্থাৎ সাহাবীর পর এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়লে তাকে মু’আল্লাক হাদীস বলা হয়।

মু‘দাল (معضل): যে হাদীসে দুই বা ততোধিক রাবী ক্রমান্বয়ে সনদ থেকে বাদ পড়েছে তাকে মু‘দাল হাদীস বলে।

মুতাবি ও শাহিদ (متابع و شاهد): এক রাবীর হাদীসের অনুরূপ যদি অপর রাবীর কোন হাদীস পাওয়া যায় তবে দ্বিতীয় রাবীর হাদীসকে প্রথম রাবীর হাদীসের মুতাবি বলা হয়। যদি উভয় হাদীসের মূল রাবী অর্থাৎ সাহাবী একই ব্যক্তি না হয় তবে দ্বিতীয় ব্যক্তির হাদীসকে শাহিদ বলে। আর এইরূপ হওয়াকে শাহাদাত বলে। মুতাবা’আত ও শাহাদাত দ্বারা প্রথম হাদীসটির শক্তি বৃদ্ধি পায়।

মা‘রূফ ও মুনকার (معروف و منكر): কোন দুর্বল রাবীর বর্ণিত হাদীস অপর কোন মাকবূল (গ্রহণযোগ্য) রাবীর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী হলে তাকে মুনকার বলা হয় এবং মাকবূল রাবীর হাদীসকে মা‘রূফ বলা হয়।

সহীহ (صحيح) : যে মুত্তাসিল হাদীসের সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ আদালত ও যাবত (ধারণ ক্ষমতা) গুণ সম্পন্ন এবং হাদীসটি যাবতীয় দোষত্রুটি ও শায মুক্ত তাকে সহীহ হাদীস বলে।

হাসান (حسن) : যে হাদীসের মধ্যে রাবীর যাবত (ধারণ ক্ষমতা) এর গুণ ব্যতীত সহীহ হাদীসের সমস্ত শর্তই পরিপূর্ণ রয়েছে তাকে হাসান হাদীস বলা হয়। ফক্বীহগণ সাধারণত সহীহ ও হাসান হাদীসের ভিত্তিতে শরীয়াতের বিধান নির্ধারণ করেন।

যঈফ (ضعيف ) : যে হাদীসের রাবী কোন হাসান হাদীসের রাবীর গুণসম্পন্ন নন তাকে যঈফ হাদীস বলে।

মাওযূ‘ ( موضوع ) : যে হাদীসের রাবী জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা কথা রটনা করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার বর্ণিত হাদীসকে মাওযূ‘ হাদীস বলে।


রাবীর সংখ্যা বিচারে হাদীস প্রধানত দু‘প্রকার। যথা: ১. মুতওয়াতির (متواتر) ও ২. আহাদ (أحاد)।

১. মুতওয়াতির (متواتر): বৃহৎ সংখ্যক রাবীর বর্ণিত হাদীস, মিথ্যার ব্যাপারে যাদের উপর একাট্টা হওয়া অসম্ভব, সনদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ সংখ্যা বিদ্যমান থাকলে হাদীসকে মুতওয়াতির (متواتر) বলা হয়।

২. আহাদ (أحاد): أحاد তিন প্রকার। যথা:

মাশহুর (مشهور): যে কোন সত্মরে হাদীস বর্ণনা কারীর সংখ্যা যদি দুই এর অধিক হয়, কিন্তু মুতওয়াতির এর পর্যায়ে পৌঁছে না তাকে মাশহুর (مشهور) বলে।

আযীয (عزيز): যে কোন সত্মরে হাদীস বর্ণনা কারীর সংখ্যা যদি দু‘জন হয় ।

গরীব (غريب): যে কোন সত্মরে হাদীস বর্ণনা কারীর সংখ্যা যদি এক জন হয় ।

শায (شاذ): একাধিক নির্ভরযোগ্য রাবীর বিপরীত একজন নির্ভরযোগ্য রাবীর বর্ণনাকে শায হাদীস বলে।

কিয়াস (قياس): অর্থ অনুমান, পরিমাপ, তুলনা ইত্যাদি। পরিভাষায়: শাখাকে মূলের সঙ্গে তুলনা করা, যার ফলে শাখা ও মূল একই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

তাক্বলীদ (تقليد): দলীল উল্লেখ ছাড়াই কোন ব্যক্তির মতামতকে গ্রহণ করা।

ইজতিহাদ (اجتهاد): উদ্দিষ্ট জ্ঞান অর্জনের প্রচেষ্টা চালানোকে ইজতিহাদ বলে।

শরীয়াত (شريعة): অর্থ: আইন, বিধান, পথ, পন্থা ইত্যাদি। পরিভাষায়: মহান আল্লাহ্‌ স্বীয় দ্বীন হতে বান্দার জন্য যা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন তাকে শরীয়াত বলে।

মাযহাব (مذهب): অর্থ- মত, পথ, মতবাদ ইত্যাদি। ফিক্বহী পরিভাষায়: ইবাদাত ও মু‘আমালাতের ক্ষেত্রে শারঈ হুকুম পালনের জন্য বান্দা যে পথ অনুসরণ করে এবং প্রত্যেক দলের জন্য একজন ইমামের উপর অথবা ইমামের ওসীয়ত কিংবা ইমামের প্রতিনিধির উপর নির্ভর করে তাকে মাযহাব বলে।

নাযর (نذر): কোন বিষয়ে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য চিন্তা-ভাবনা করাকে নাযর বলে।

আম (عام): সীমাবদ্ধ করা ছাড়াই যা দুই বা ততোধিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে তাকে আম বলে।

খাস (خاص): আম এর বিপরীত, যা নির্দিষ্ট বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে।

ইজমা (اجماع): কোন এক যুগে আলিমদের কোন শারঈ বিষয়ের উপর এক মত পোষণ করাকে ইজমা বলে।

মুসনাদ (مسند): যার সনদগুলো পরস্পর এমনভাবে মিলিত যে, প্রত্যেকের বর্ণনা সুস্পষ্ট।

ফিক্বহ (فقه): ইজতিহাদ বা গবেষণার পদ্ধতিতে শারঈ হুকুম সম্পর্কে জানার বিধানকে ফিক্বহ বলে।

আসল বা মূল (اصل): এমন প্রথম বিষয়, যার উপর ভিত্তি করে কোন কিছু গড়ে উঠে। যেমন- দেয়ালের ভিত্তি।

ফারা বা শাখা (فرع): আসলের বিপরীত যা কোন ভিত্তির উপর গড়ে উঠে।

ওয়াজিব (واجب): যা আমল করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে আর পরিত্যাগ করলে শাস্তি পাওয়া যাবে।

মানদূব (مندوب): যা আমল করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে আর পরিত্যাগ করলে শাস্তি হবে না।

মাহযূর (محظور): যা পরিত্যাগ করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে আর আমল করলে শাস্তি পাওয়া যাবে।

মাকরূহ (مكروه): যা পরিত্যাগ করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে আর আমল করলে শাস্তি হবে না।

ফাৎওয়া (فتوى): জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির নিকট থেকে দলীল ভিত্তিক শারঈ হুকুম সুস্পষ্ট বর্ণনা করে নেয়াকে ফাৎওয়া বলে।

নাসিখ (ناسخ): পরিবর্তিত শারঈ দলীল যা পূববর্তী শারঈ হুকুমকে রহিত করে দেয় তাকে নাসিখ বলে।

মানসূখ (منسوخ): আর যে হুকুমটি রহিত হয়ে যায় সেটাই মানসূখ।

মুতলাক্ব (مطلق): যা প্রকৃতিগত দিক থেকে জাতির সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে কিন্তু অনির্দিষ্টভাবে একটি অর্থকে বুঝায়।

মুকাইয়্যাদ (مقيد): যা মুতলাক্বের বিপরীত অর্থাৎ জাতির সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে না। বরং নির্দিষ্ট একটি অর্থকে বুঝায়।

হাক্বীকাত (حقيقة): শব্দকে আসল অর্থে ব্যবহার করাকে হাক্বীকত বলে। যেমন- সিংহ শব্দটি এক প্রজাতির হিংস্র প্রাণীকে বুঝায়।

মাজায (مجاز): শব্দ যখন আসল অর্থকে অতিক্রম করে তার সাথে সাদৃশ্য রাখে এমন অর্থ প্রকাশ করে তখন তাকে মাজায বলে। যেমন- সাহসী লোককে সিংহের সাথে তুলনা করা।

الحمد لله على آلائه، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له في أرضه وسمائه، وأشهد أن محمدً عبده ورسوله وخاتم أنبيائه، صلى الله عليه وعلى وآله وأصحابه صلاة دائمة إلى يوم لقائه وسلم تسليمًا كثيرًا.

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য যিনি অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্‌ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। আসমান ও জমীনে তাঁর কোন শরীক নেই । আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসূল এবং তার পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ নাবী। তাঁর (মুহাম্মাদ ﷺ) উপর, তাঁর পরিবার বর্গের উপর এবং তাঁর সকল সাহাবার উপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত সদা-সর্বদা অজস্র সালাম ও শামিত্মর ধারা বর্ষিত হোক।

অতঃপর সমস্ত মর্যাদাবান ও মহিমান্বিত শারঈ জ্ঞান এবং বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে ইসলামী সাধারণ প--তগণ তাদের রচনাবলীর প্রারম্ভে ও মূল্যবান গ্রন্থাবলিতে একটি রীতির প্রচলন করেছেন যে, ‘‘জ্ঞানের মর্যাদা অর্জিত জ্ঞানের মর্যাদার উপর নির্ভরশীল এবং তার ঐতিহ্যের মান-মর্যাদা তার শাখার উপর প্রভাব বিসত্মার করে’’।

পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশেস্নষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিদ্বানদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সমস্ত জ্ঞানের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, কল্যাণময় ও উপকারী জ্ঞান হলো: বান্দার কর্মের বিধি-বিধান সম্পর্কীয় জ্ঞান। যা পরবর্তীতে ‘‘ফিক্বহুল ইসলামী’’ বা ইসলামী জ্ঞান নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

[আল্লাহ্‌ তা‘আলার বাণী এ কথার প্রতিই ইঙ্গিত বহন করছে:

﴿فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ﴾

অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান (ফিক্বহ) আহরণ করতে পারে এবং তারা যখন আপন সম্প্রদায়ের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ) থেকে বেঁচে থাকে (সূরা আত-তাওবা:১২২)]।

মহানাবী (ﷺ) বলেছেন:

مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ بِالدِّينِ

‘‘আল্লাহ্‌ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা (ফিক্বহ) দান করেন’’।[1] এমন কি নাবীগৃহে পালিত আব্দুলস্নাহ ইবনে আব্বাস (ؓ) এর জন্য দ্বীনের ফক্বীহ হওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে দু‘আ করে তিনি বলেছিলেন:

"اللهم فقهه فى الدين و علمه التأويل"

‘‘হে আল্লাহ্‌! আপনি তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা দান করুন ও ব্যাখ্যা করার জ্ঞান দান করুন’’ (মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বাল ২৩৯৭, সহীহ)। ফলে মহানাবী (ﷺ) এর দু‘আর বরকতে তিনি কুরআনের মুফাস্সির, উম্মতের মধ্যে প--ত ব্যক্তি ও জ্ঞানের সাগর হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। তার এ খ্যাতি অব্যাহত আছে, কখনও তা নিঃশেষ হবে না।


‘‘ফিক্বহুল ইসলামী’’ বা ইসলামী জ্ঞানের মর্যাদা ও সম্মান বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না এবং একে সীমাবদ্ধ করাও সম্ভব নয়। কেননা-

ক। এ জ্ঞানের বিধানগুলো একজন মুসলিমের জীবন চলার সাথে সম্পৃক্ত। যা তার মাঝে ও তার প্রভুর মাঝে এবং তার মাঝে ও আল্লাহ্‌র অন্যান্য বান্দার মাঝে সম্পর্ক তৈরি করে। সুতরাং এর দ্বারা বান্দা তার প্রভুর সাথে প্রকাশ্যে ও গোপনে সম্পর্কের সেতুবন্ধন রচনা করতে পারে। আর এ সম্পর্ক গড়ে উঠে ত্বহারাত, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হাজ্জসহ অন্যান্য ইবাদাত সম্পাদনের মাধ্যমে।

খ। এ জ্ঞানের মাধ্যমে ইসলামের পতাকা বিসত্মার করা সম্ভব হয় ও কুরআনের নিদর্শন সমুন্নত হয়। আর এটা জিহাদ, মাগাযী, জীবন-কাহিনী, নিরাপত্তা, চুক্তি প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়।

গ। এ জ্ঞানের মাধ্যমে বৈধ রিযিক অন্বেষণ করা যায় এবং পাপ ও অপরাধের গ-- থেকে দূরে থাকা সম্ভব হয়। এটা ক্রয়-বিক্রয়, পছন্দের স্বাধীনতা (খিয়ার), সুদ, খরচ করা ও এ সংক্রান্ত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে অবগত হওয়া যায়, যা একে অপরের অর্থনৈতিক লেনদেনের সাথে সম্পৃক্ত।

ঘ। এ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শরীয়াত মোতাবেক সম্পদ হসত্মান্তর; যেমন- ওয়াকফ্, ওসীয়াত ও অনুরূপ অর্থনৈতিক বিধি-বিধান সম্পর্কে জানা যায়।

ঙ। এ জ্ঞানের মাধ্যমে উত্তরাধিকার বন্টন আইনের (ফারায়েজ) সঠিক বিধান জানা যায়। ফলে উক্ত জ্ঞানার্জনকারী অর্ধেক জ্ঞানার্জনের সৌভাগ্য অর্জন করে। এর ফলে সুশৃঙ্খলভাবে ও সুষম বন্টনের মাধ্যমে যথাযথ মালিকের কাছে সম্পদ অর্পণ করা সম্ভব হয়।

চ। এ জ্ঞানের মাধ্যমে শারঈ দাম্পত্য জীবন ও ত্বালাকসহ অন্যান্য সংশিস্নষ্ট বিষয়াদির ক্ষেত্রে সুখী জীবন-যাপন করা যায়।

ছ। এ জ্ঞানের মাধ্যমে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত জরূরী বিষয় সমূহ যেমন অপরাধ, রক্তপণ, দ--লঘুদ-সহ প্রভৃতি বিধানের ব্যাপারে ইসলামে নিরাপত্তার যে গুরুত্ব রয়েছে তা জানা যায়। ফলে নিরাপদ ও আরাম আয়েশে জীবন যাপন করা সম্ভব হয়।

জ। অনুরূপভাবে খাদ্য, কুরবানী, মানত (নযর) ও শপথের বিধান জানা যাবে এবং ন্যায়-পরায়ণতার ভিত্তিতে ও দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিচার-ফায়সালা, তার নিয়ম-কানুন, পদ্ধতি ও বিধানের বর্ণনা জানা যাবে। ফলে উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে তার অধিকার পৌঁছানো যাবে ও ছিনিয়ে নেয়া বস্ত্ত তার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হবে।

এ সমস্ত মূল্যবান নিয়ামতের কারণে আলিমগণ ফিক্বহুল ইসলামী লেখার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ফলে তারা অসংখ্য নিয়ম-নীতি তৈরি করেছেন। আর বহু খণ্ড- বিভক্ত হাজার হাজার গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন।

এ সমস্ত মহামতি বিদ্বানগণ বিভিন্ন শ্রেণীর ফিক্বহ গ্রন্থ রচনা এবং তাদের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ফলে তাদের স্বীয় বোধগম্যতার প্রতি টান থাকার কারণে ও তাদের ঝোঁক প্রবণতায় ভিন্নতা থাকার কারণে তাদের প্রণীত গ্রন্থগুলোর মাঝে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে।

তাই কেউ স্বীয় মাযহাবের গ--র মধ্যে থেকে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন এবং তাতে অতিরিক্ত কিছু সংযোজন করেছেন। কেউ আবার বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত ফিক্বহী মাযহাব সমূহের গ--র মধ্যে থেকে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। অনুরূপভাবে তাদের মধ্যে কেউ আবার বিতর্কিত মাসআলাগুলোর দলীলসমূহ ও দলীল গ্রহণের পদ্ধতিসমূহ উল্লেখ করেছেন।

তাদের মধ্যে একদল হলেন অগ্রগামী। যারা ইজতিহাদ, বিশেস্নষণ ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। ফলে মহানাবী (ﷺ) এর সমস্ত সুনানের দলীলের আলোকে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এ জন্য তারা নবুওয়াতের দীপাধার হতে দলীল গ্রহণ করে সামনে পথ চলেছেন। সুনানের বাহন যে দিকে গেছে তারাও সে দিকে ভ্রমণ করেছেন। সুনেই যে পথের অভিমুখী হয়েছে তারাও সে পথের অভিমুখী হয়েছেন। এর ফলে তারা সঞ্চিত জ্ঞান ও চিন্তা-চেতনার আবির্ভাব ঘটিয়েছেন যা সর্বোত্তম নিয়ম-কানুন ও হিদায়াতমূলক রীতির উপর গড়ে উঠেছে।

এ প্রকার ফিক্বহ হল মহানাবী (ﷺ) এর সাহাবাদের পক্ষ থেকে চলে আসা মূল ফিক্বহ। সাহাবাগণ এটাকে তাবেঈদের কাছে সঠিক ভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। অনুরূপ ভাবে তাদের পরবর্তী তাবে-তাবেঈনগণ তাদের কাছ থেকে তা ভালভাবে গ্রহণ করেছেন। ফলে তারা এই উত্তম রীতিতে ও সঠিক পন্থায় গ্রন্থ প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছেন।[2]

এ প্রকার দ্বীনি ফিক্বহের ব্যাপারে ইবনুল কাইয়্যিম তার ‘তাহযীবু সুনেই’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন:[3]

‘‘যে বিষয়ের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় এবং যে বিষয়টির সর্বোত্তম লক্ষ্য হাসিলের জন্য প্রতিযোগীগণ প্রতিযোগিতা করেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বীগণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ও কর্মঠগণ যা উদ্ধারের পিছনে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন, তা হলো শেষ নাবী ও সমগ্র বিশ্ব প্রতিপালকের রাসূল (ﷺ) থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান। রাসূল (ﷺ) এর অনুসরণ ছাড়া কেউ নাজাত পাবে না। তার সাথে সম্পৃক্ততা ছাড়া কেউ উভয় জগতে সফলকাম হতে পারবে না। যে ব্যক্তি তার আদর্শ গ্রহণে ধন্য হয়েছে সে মুক্তি পেয়েছে ও সফলতা অর্জন করেছে। যে তাঁর থেকে বিমুখ হয়েছে সে খতিগ্রস্থ ও বঞ্চিত হয়েছে। কেননা সৌভাগ্যের পরশ তাঁকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। ঈমানের কেন্দ্র তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হয়েছে। সুতরাং তাঁকে ছাড়া আল্লাহ্‌র নিকটে পৌঁছা ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব নয়। তাঁকে (রাসূল ﷺ) ছাড়া হিদায়াত অন্বেষণ করা মানে স্বয়ং পথ ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ্‌ তা‘আলার কাছে পৌঁছানোর জন্য তিনি (আল্লাহ্‌) যে পথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সে পথ ব্যতীত কিভাবে তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব? যে ব্যক্তি এ পথে চলতে চায়, তার জন্য এটা পথ প্রদর্শক। আল্লাহ্‌ তাঁর রাসূল (ﷺ) কে এ পথের আহবানকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি তাঁকে এ পথের প্রত্যেকটি প্রবেশদ্বারে আহবায়ক ও হিদায়াতকারী হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। আর এ পথেই হিদায়াত রয়েছে। সুতরাং যে এ পথ ভিন্ন অন্য পথে চলতে চায় তার জন্য হিদায়াতের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে এবং সে আল্লাহ্‌র হিদায়াত ও সৌভাগ্যের পথ থেকে বঞ্চিত হবে। বরং যখনই অতিরিক্ত ইজতিহাদের প্রাদুর্ভাব দেখা দিবে তখন আল্লাহ্‌র পথ থেকে পলায়নপরতা ও দূরত্ব বৃদ্ধি পাবে। এর কারণ হলো: সে সরল-সঠিক পথে চলা থেকে বিরত থেকেছে। যথার্থ রীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মানুষের অভিমতকে মেনে নিয়েছে। বেশি তর্ক করার মাধ্যমে নিজেকে সন্তুষ্ট রেখেছে। চিরস্থায়ী ভাবে তাক্বলীদের পথকে বেছে নিয়েছে। অন্যান্য তাক্বলীদকারী বান্দাদের পরিবারভুক্ত হয়ে থাকাকে পছন্দ করেছে। ইলমের সোজা রাসত্মায় সে চলতে পারে নি। জ্ঞান-সোপানের মর্যাদায় সে আরোহণ করতে পারে নি। তার অন্তরে জ্ঞানের প্রদীপ প্রজ্বলিত হয় নি। তার হৃদয় জ্ঞানের বাগিচায় ভ্রমণ করে নি। বরং সে এমন ওলান থেকে দুধ পান করেছে যেটা সতীত্বের দিক দিয়ে পবিত্র নয়। সে লবণাক্ত পানশালায় নেমে তার হৃদয় ও জিহবা দিয়ে পানশালার পানি ঘোলাটে করে ফেলেছে।

এ অশুভ পরিণতি থেকে লজ্জাস্থান, জীবন ও ধন-সম্পদ মহান আল্লাহ্‌র কাছে পরিত্রাণ চাচ্ছে যিনি হালাল-হারামের বিধান দাতা এবং অধিকারসমূহ শরীয়াত ও বিধান দাতা (আল্লাহ্‌) কাছে উদ্ধার কামনা করছে। অতএব যে নিজেকে সৌভাগ্যবান করতে আগ্রহী এবং যার অন্তর সচেতন ও জাগ্রত, তার উচিৎ- ঐ বিষয়ে সাহায্য করার প্রয়াস চালানো হতে বিরত থাকা, যা তার কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। আর দুনিয়াবী জীবনে যাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে অথচ তারা ধারণা করছে তারা সঠিক কাজই করছে, তাদের পথ থেকেও তার বিরত থাকা উচিৎ। কেননা আল্লাহ্‌ এমন একটি দিনের ব্যবস্থা রেখেছেন যে দিন বাতিলপন্থিরা খতিগ্রস্থ হবে এবং হক্বপন্থিরা লাভবান হবেন।

﴿وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا﴾

অর্থাৎ: আর সে দিন যালিম ব্যক্তি নিজের হাত দুটো কামড়িয়ে বলবে- ‘হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে সঠিক পথ অবলম্বন করতাম’ (সূরা : ফুরকান-২৭) ।

﴿يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ فَمَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَأُولَئِكَ يَقْرَءُونَ كِتَابَهُمْ وَلَا يُظْلَمُونَ فَتِيلًا﴾

স্মরণ কর, যে দিন আমি প্রত্যেক মানুষকে তাদের ইমামসহ ডাকব। অতঃপর যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তারা নিজেদের আমলনামা পাঠ করবে এবং তাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও অবিচার করা হবে না (সূরা : আল-ইসরা-৭১)।

সুতরাং যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ) ছাড়া অন্যকে ইমাম হিসেবে গ্রহণ করেছে, তাঁর সুন্নাতকে পিছনে ফেলে রেখেছে এবং তার চোখের সামনে মানুষের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিয়েছে, সে অচিরেই বুঝতে পারবে যে, ক্বিয়ামতের দিন সে কোন মালপত্র হারিয়েছে এবং আমলনামা ওযনের সময় সে বুঝতে পারবে যে, কতটুকু মূল্যবান বস্ত্ত অথবা ভোগ-বিলাসের নিকৃষ্ট বস্ত্ত সে উপস্থিত করেছে’’।[4]

এ থেকেই আমার পছন্দের বিন্যাস অনুযায়ী ফিক্বহের অধ্যায়সমূহ সংকলন করার সুদৃঢ় ইচ্ছা ও কল্পনা মনে উদয় হয়েছে।[5] এই আশা করে যে, যেন আমি দ্বীনি ফিক্বহের ক্ষেত্রে কল্যাণ পেতে পারি।

[1] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বুখারী ৭১, মুসলিম ১০৩৭ মু‘আবিয়াহ বর্ণিত হাদীস।

[2] প্রতিষ্ঠিত ফিক্বহ সম্পর্কে আরও জানতে দেখুন!‘ ই‘লামুল মুয়াক্বিয়ীন’ (১/৫-৬ ও তার পরবর্তী অংশ) এবং আল হাযবী প্রণীত, ‘আল-ফিক্বরম্নস সামী ফী তারীখিল ফিক্বহিল ইসলামী’।

[3] দেখুন! ‘তাহযীবু সুনানি আবি দাউদ’ (১/৫-৭), আনসারম্নস সুন্নাতিল মুহাম্মাদিয়্যাহ প্রেস, মিশর কর্তৃক ১৩৬৭ হি: সনে মুদ্রিত। শাইখ আহমাদ শাকির ও মুহাম্মাদুল ফিক্বহীর দ্বারা তাহক্বীককৃত। ইবনে হাযাম (রাহি) প্রণীত ‘আহকাম’ গ্রন্থে (১/১০৩,১২৫) এরূপ ভাবার্থে বর্ণিত হয়েছে।

[4] ‘তাক্বরীবু উলূমি ইবনি কাইয়্যিম’ গ্রন্থে (পৃ:১০-১৪) আলস্নামা বাকর আবি যায়দ ( আলস্নাহ তাকে হিফাযত করম্নন) এর ভূমিকা হতে গৃহীত।

[5] ইনশা আলস্নাহ অতি সত্বর আমি আমার গ্রন্থ প্রণয়নের পদ্ধতি আলোচনা করব।
যে তিনটি কারণ আমাকে বইটিকে এ পদ্ধতিতে ও বিন্যাসে সাজাতে উদ্বুদ্ধ করেছে

প্রথমত: পুরাতন ফিক্বহ শাস্ত্রগুলোর কিছু নেতিবাচক মনোভাব। সেটা গঠনগত দিক থেকে হতে পারে কিংবা বিষয়বস্তগত দিক থেকে হতে পারে:[1]

ক। গঠনগত, বিন্যাসগত ও অধ্যায়গত দিকগুলো হলো: এ সমস্ত কিতাবের মধ্যে কিছু কিতাবের বিষয়বস্ত্তগুলো এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যে, একটি বিষয় অন্যটির মাঝে অনুপ্রবেশ করেছে। ফলে কাঙিক্ষত মাসআলাটি উদ্ঘাটন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এমন কি বিশেষজ্ঞদের কাছেও এটা দুষ্কর হয়ে যায়। বিশেষ করে এ সমস্ত কিতাবে বিষয়ভিত্তিক কোন সূচিপত্র উল্লেখ করা হয় নি, যা উল্লেখ করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গবেষকদের কাছে সহজ সাধ্য হত।

আরেকটি হলো: পদ্ধতিগত দিক। যদিও এ সমস্ত গ্রন্থের পদ্ধতি ও রীতিগুলো তৎকালীন যুগের জন্য উপযুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে তা বুঝা অনেক কঠিন। সংক্ষপ্ত ইবারত ও দীর্ঘ কথাকে স্বল্প কথার মাধ্যমে সংক্ষেপ করণের রীতি এ সব গ্রন্থে লক্ষণীয়। ফলে তা দুর্বোধ্যতা ও দুর্বলতার দিকে নিয়ে যায়। এ ত্রুটিগুলো মতন তথা সংক্ষিপ্ত গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায় যা ব্যাপকভাবে পরবর্তী মনীষীগণের মাধ্যমে সংকলিত হয়েছে। আর এগুলোই পাঠক ও ফিক্বহ বিশেষজ্ঞদের নিকট উত্তম গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

এ গ্রন্থগুলোর আরেকটি দিক হলো: এগুলোতে ঐতিহাসিক প্রমাণ বহন করে এমন পরিভাষাগত বাক্যের ব্যাপক ব্যবহার করা হয়েছে। যার উদ্দেশ্য সে সময়ের মানুষ ছাড়া আর অন্য কেউ বুঝে না।

খ। বিষয়বস্ত্তগত দিক থেকে যে নেতিবাচক দিক রয়েছে তা হলো: এ গ্রন্থগুলোর কিছু কিছু গ্রন্থ সমসাময়িক যুগের বিশেষ প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতির আলোকে লেখা হয়েছে। যা শুধু সে যুগে উদ্ভাবিত সমস্যার সমাধান দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী যুগে নতুন আরেকটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।

যেমন এ কিতাবগুলোর কিছু কিতাব (বিশেষ করে পরবর্তী যুগে) মাযহাব প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে রচিত হয়েছে, যেখানে কোন উপযুক্ত দলীল পেশ করা হয় নি এবং মাসআলাগুলোকে একটি অপরটির সাথে তুলনা করা হয় নি অথবা প্রাধান্যও দেয়া হয় নি।

তদুপরি, অধিকাংশ মাযহাবী গ্রন্থগুলো মাযহাব প্রীতির রোগে আক্রান্ত হয়েছে যা ক্রোধের সৃষ্টি করে। এ সব গ্রন্থে সাধারণত মাযহাবকে অাঁকড়ে ধরার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। হয়তো বা এ স্বজনপ্রীতিটা ইমামের কোন বক্তব্যের কারণেই অথবা ইমামের অনুসারী ও ছাত্রের বাড়াবাড়ীর কারণেই হয়েছে। কিংবা সে মাযহাবের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পছন্দনীয় বিষয়ের কারণেই হয়েছে অথবা এ সমস্ত মূল গ্রন্থের ব্যাখ্যা গ্রন্থের কারণে হয়েছে। এছাড়াও এসব গ্রন্থে অধিকহারে জাল-যঈফ হাদীসের ছড়া-ছড়ি হয়েছে। এসব দুর্বলতার দিকে কোন ইঙ্গিত দেয়া হয় নি।


দ্বিতীয়ত: আধুনিক ফিক্বহ শাস্ত্রে অনেক নেতিবাচক দিক লক্ষ্য করা যায়:

বর্তমান যুগের গ্রন্থগুলো যদিও উত্তম বিন্যাসে বিন্যাসিত ও যুগোপযোগী, গবেষক ও সাধারণ পাঠকের কাছে খুবই প্রিয় এবং যদিও এ সব গ্রন্থে মাযহাব প্রীতির প্রভাব পড়ে নি, তবুও এ সব গ্রন্থে অসংখ্য নেতিবাচক বিষয় মিশ্রিত হয়ে আছে। বরং এ সব নেতিবাচক দিকগুলো কখনও অনেক ভয়াবহ ও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এ নেতিবাচক দিকগুলো বিষয়বস্ত্ত সংক্রান্ত এবং এমন ফলাফল সংক্রান্ত যা বিশেষভাবে গবেষণা করা প্রয়োজন। এগুলো কখনও নতুন মাসআলার এবং উদ্ভাবিত সমস্যার সৃষ্টি করে। এই নেতিবাচক দিকগুলো হলো:

ক। এ সব গ্রন্থে গবেষণাগত দুর্বলতা লক্ষ করা যায় এবং এগুলোতে পূর্ববর্তী ফিক্বহ ও হাদীস গ্রন্থ হতে রেফারেন্স গ্রহণ করে কোন গবেষণা করা হয় নি। যা মূলতঃ গবেষণা, ফাৎওয়া ও লেখনীর ক্ষেত্রে পথ চলার জন্য মূল হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হয়। এর ফলে আমরা দেখি যে, যে বিষয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মুসলমান ঐকমত্য পোষণ করেছেন, সে বিষয়ে কেউ আবার মতভেদ করেছে। অথবা এমন মতামতকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে যা বিরল, পরিত্যক্ত ও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কিংবা সে তার মনমতো কিছু মতামতের ক্ষেত্রে রাফেজী ও তার অনুরূপ ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের ফিক্বহ শাস্ত্রে বিচরণ করেছে। আর এটাকে সে মুসলমানদের কাছে ইসলামী ফিক্বহ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছে এবং বুঝাতে চেয়েছে যে, এটা মুসলমান বিদ্বানদের অভিমত!![2]

খ। এ গ্রন্থগুলোর কিছু গ্রন্থ বিদ্বানদের মতামতে ভরপুর। এ মতামতগুলোর ক্ষেত্রে কোন প্রকার দলীলের প্রতি ভ্রুক্ষপ করা হয় নি এবং একটিকে আরেকটির উপর প্রাধান্যও দেয়া হয় নি। ফলে গবেষক ও পাঠকগণ এ ক্ষেত্রে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এমনকি কিছু কিছু গ্রন্থের লেখক এ সমস্ত মতামতের যে কোন একটি অভিমতকে গ্রহণ করার স্বাধীনতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এ যুক্তি দেখিয়ে যে, এই মতামতগুলো পূর্ববর্তী কোন কোন বিদ্বানের বক্তব্য।[3]

গ। এ সমস্ত গ্রন্থের অধিকাংশ গ্রন্থে দলীলের বিশুদ্ধতার উপর গুরুত্ব দেয়া হয় নি এবং প্রাধান্যও দেয়া হয় নি। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিলেও তা বিদ্বানদের নীতিমালার আলোকে হয় নি।

ঘ। এসব গ্রন্থের কিছু গ্রন্থকে ফিক্বহী গবেষণা মূলক নীতির আলোকে রচনা করা প্রয়োজন। কেননা কিছু কিছু গ্রন্থ বক্তৃতাকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেখানে জ্ঞানের পরশ লক্ষ করা যায় না।

ঙ। কখনও আবার এ সব গ্রন্থ ইসলামের শত্রুদের আরোপিত মতামত ও সংশয় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং কিছু কিছু বিধান যেমন: শামিত্মর বিধান, যুদ্ধের বিধান, কর সংক্রান্ত বিধান, আন্তর্জাতিক সম্পর্কিত বিধান, বিধর্মী ও মুশরিকদের সাথে আদান-প্রদানের বিধান, বিচার-ফায়সালাগত বিধান, দাসত্বের বিধান, বহু বিবাহের বিধান প্রভৃতি বিধানসমূহ দুর্বল কথার মাধ্যমে পেশ করা হয়েছে। কেননা সে এক্ষেত্রে প্রতিহত করার স্থানে অবস্থান করেছে। যার ফলে তার মধ্যে ইসলামকে দোষ মুক্ত করার আগ্রহ থাকার কারণে কিছু প্রতিষ্ঠিত বিধানকে বাতিল করেছে এবং কিছু দুর্বল মতামতকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করেছে।[4]

চ। যেমনটি এ গ্রন্থগুলো প্রভাবিত হয়েছে প্রভুর হিদায়াত ও নাবীর সুন্নাত হতে বিভ্রান্ত উম্মতের কর্মকা- দ্বারা। ফলে তা মানুষের জন্য ওযর-আপত্তি ও অযৌক্তিক কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে। যা নিষিদ্ধ ও হারাম কাজগুলোকে সহজ করে দিয়েছে। বাসত্মবতার চাপ সৃষ্টি করে তা মানুষের উপর অবধারিত করে দিয়েছে এবং ভারি বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে স্পষ্ট দলীলগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে এবং সহীহ আসারগুলোকে যঈফ (দুর্বল) বানিয়ে ফেলেছে।[5]

ছ। আধুনিক ফিক্বহ শাস্ত্রগুলো নতুন উদ্ভাবিত বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে তারা ওযূহাত দেখিয়েছে যে, এ সব বিষয়গুলো পূর্ববর্তী বিদ্বানগণ আলোচনা করেন নি। বর্তমান যুগে এর সাথে অনেক ঘটনা জড়িত এবং এসব বিষয়ের সাথে মানুষের অনেক প্রয়োজন সম্পৃক্ত আছে, যার ব্যাপারে ইসলামের কোন সঠিক বিধান পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এ সব বিষয়ের সমাধান দিতে গিয়ে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রণ করে ফেলেছে। আমরা যদি জীবন বীমা, আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং কৃত্রিম প্রজননসহ আরও অন্যান্য বিষয়াবলির দিকে লক্ষ করি, তাহলে অনেক আশ্চর্য বিষয় খুঁজে পাব।[6]

এ ছাড়াও আধুনিক যুগের অধিকাংশ গ্রন্থগুলো গবেষণা মূলক হওয়া সত্ত্বেও তা একই বিষয়ের উপর লিখিত। যদিও পরিপূর্ণ ফিক্বহ গ্রন্থ পাওয়া যায়, কিন্তু তা পূর্বোলেস্নখিত অধিকাংশ নেতিবাচক দিক থেকে মুক্ত নয়।


তৃতীয়ত: মুহাদ্দিস ও ফক্বীহদের মাঝে অগ্নিযুদ্ধ ও সৃষ্ট ঘৃণা বোধ:

আমি হাদীস বিভাগের অনেক ছাত্র ভাইকে দেখেছি যে, তারা ইলমুল ফিক্বহ শিক্ষা করা থেকে বিরত থাকে এবং পবিত্র সুনণাহকে দিরায়াত (উপলদ্ধি) ছাড়া শুধু রেওয়ায়াত (বর্ণনা) গত দিক থেকে গ্রহণ করতে ব্যসত্ম থাকে। আবার ফিক্বহ শাস্ত্রের অধিকাংশ ছাত্রকে দেখেছি যে, তারা হাদীস শাস্ত্রের জ্ঞানার্জন, তার সনদ পরিচিত ও মতন মুখস্থ করা থেকে বিরত থাকে। অথচ তারা মাযহাবী ফিক্বহী গ্রন্থ আয়ত্তকরণ ও সংক্ষপ্ত ফিক্বহী গ্রন্থগুলো মুখস্থ করার ক্ষেত্রে নিবেদিত থাকে। এ ঘৃণাবোধ অতীত থেকেই বিদ্যমান। যাকে উত্তেজিত করেছে কিছু সংখ্যক হাদীস সংকলক ও মুষ্টিমেয় ফক্বীহ। এটা মূলতঃ তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হয়েছে। ফলে তারা একে অপরকে নিন্দা করে ও বাঁকা চোখে দেখে।

ইমাম খাত্ত্বাবী রাহিমাহুল্লাহ (মৃত্যু ৩৮৮ হিঃ) বলেন:[7]

‘‘আমাদের যামানায় বিদ্বানদের দেখা যায় যে, তারা দু’টি দলে ও মতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে:

১। হাদীস ও আসার এর অনুসারী। ২। ফিক্বহ ও যুক্তির (নাযর) অনুসারী।

তবে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে একটিকে অপরটি থেকে পৃথক করা যায় না এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনে একটি অপরটির মুখাপেক্ষী। কেননা ভিত্তির দিকে লক্ষ্য করে হাদীস হচ্ছে আসল এবং স্থাপনার দিকে লক্ষ্য করে ফিক্বহ হচ্ছে তার শাখা-প্রশাখা। স্থাপনা যদি মূল ভিত্তির উপর না রাখা হয়, তাহলে সেটা অকার্যকর হবে এবং ভিত ছাড়া বিল্ডিং তৈরি করলে সেটি অকেজো ও ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। আমি উভয় দলকে পেয়েছি নিকটতম প্রতিবেশী ও পাশাপাশি দু‘টি বাড়ীর মত। প্রত্যেকটি দল একে অপরের ব্যাপক প্রয়োজনে আসে। তাদের উভয়কেই তার সাথীর নিকট জরুরী ভিত্তিতে দরকার হয়। তারা যেন হিজরতকারী ভাইয়ের মত। কোন প্রকার প্রাধান্য ছাড়াই সঠিক পথে চলার জন্য একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে যারা হাদীস ও আসারের অনুসারী তাদের অধিকাংশই রেওয়ায়াত বা বর্ণনার অনুরাগী, বিভিন্ন পদ্ধতি একত্রিতকারী, গরীব ও শা’য হাদীস অনুসন্ধানকারী, যার অধিকাংশই জাল অথবা মাকলুব বা পরিবর্তিত। তারা মতনের দিকে লক্ষ্য করে না, অর্থও বুঝে না এবং এর গোপন ভেদ ও গুঢ় রহস্যও উদ্ভাবন করতে পারে না। বরং ফক্বীহদের সমালোচনা করে, তাদের বাঁকা চোখে দেখে এবং সুন্নাত বিরোধী বলে আখ্যা দেয়। তারা এটা বুঝতে পারে না যে, তারা যে জ্ঞান অর্জন করেছে তা খুব সামান্য এবং এটাও বুঝে না যে, ফক্বীহদের গালি দেয়া পাপের কাজ।

অপরদিকে যারা ফিক্বহ ও যুক্তির (নাযর) এর অনুসারী তাদের অধিকাংশই স্বল্প হাদীস ছাড়া তেমন হাদীস বর্ণনা করে না। তারা সহীহ হাদীসকে যঈফ থেকে পৃথক করে না। উত্তম হাদীসকে নিমণমানের হাদীস থেকে আলাদা করে না। তাদের কাছে যে হাদীস পৌঁছে তা তাদের দাবীকৃত মাযহাবের অনুকূলে হয়ে গেলে এবং তাদের বিশ্বাসকৃত মাযহাবের মত অনুযায়ী হলে বিতর্কিত বিষয়ে তা দ্বারা দলীল গ্রহণ করতে আপত্তি করে না। কোন যঈফ ও মুনকাতি হাদীস যদি তাদের কাছে প্রসিদ্ধি লাভ করে তাহলে সেই যঈফ ও মুনকাতি হাদীস গ্রহণের জন্য বিভিন্ন পরিভাষা তৈরি করে। এমন করে ক্রমাগতভাবে কোন নির্ভরযোগ্যতা ছাড়া ও নিশ্চিত জ্ঞান ছাড়াই তাদের মাঝে বিভিন্ন মন্তব্য পরিলক্ষত হয়। এর ফলে রাবীর বর্ণনা থেকে তাদের পদস্খলন ঘটে এবং তাতে বিভ্রামিত্ম সৃষ্টি হয়।

মূলতঃ হাদীস ও ফিক্বহ শাস্ত্র হলো, অকৃত্রিম দু’ভাই স্বরূপ এবং পরিপূর্ণতার দিক দিয়ে উভয়ে খুবই নিকটবর্তী। এ জন্য ইবনুল মাদানী (রাহি.) বলেন: ‘‘হাদীসের অর্থ নিয়ে গবেষণা করাটা অর্ধেক জ্ঞানার্জন করার সমান। আর রিজাল শাস্ত্র সম্পর্কে জানাও অর্ধেক জ্ঞানার্জনের সমান’’।[8] সুতরাং হাদীস ও ফিক্বহ শাস্ত্র যেন একজন আলিমের জন্য একই পাখির দু’ডানা স্বরূপ।

শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:[9] ‘‘ ফিক্বহ শাস্ত্র রচনাকারী যদিও ফিক্বহ শাস্ত্র ও ইলমুল উসূল সম্পর্কে সুদক্ষ হয় এবং সহায়ক সকল বিষয়ে পা--ত্য অর্জন করে এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার গুণাগুণ বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। কিন্তু যদি তিনি হাদীস শাস্ত্রের উপর নির্ভর না করেন, হাদীস শাস্ত্রে অদক্ষ হন, সহীহ ও দুর্বল হাদীস সম্পর্কে না জেনে গ্রন্থ রচনা ও প্রণয়ন করেন তাহলে তার গ্রন্থটি ভিত্তিহীন বলে বিবেচিত হবে। কেননা কিয়দংশ ছাড়া ফিক্বহ শাস্ত্রের সম্পূর্ণটাই হাদীস শাস্ত্র হতে গৃহীত। এ বিধানটি কুরআনুল কারীম স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে। সুতরাং যদি কেউ হাদীস শাস্ত্রে জ্ঞানী না হয়, সে ব্যাপারে যদি দক্ষ না হয় এবং গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে যদি হাদীস শাস্ত্রের উপর নির্ভর না করে তাহলে শাস্ত্রবিদগণ তাদের শাস্ত্র দিয়ে কি করবেন?!’’

এ জন্যই ফিক্বহের সুক্ষ্ম আর মাসআলার ক্ষেত্রে ন্যায়-পরায়ণ ও শক্তিশালী মাযহাব হলো- মুহাদ্দিসদের মাযহাব। কেননা তারা নবুওয়াতের ঝরণা থেকে পান করেছেন এবং রিসালাতের প্রদীপ থেকে আলো গ্রহণ করেছেন। এখানেই তারা আসা-যাওয়া করেছেন।[10]

‘‘সে ব্যক্তি কতই না মন্দ মুহাদ্দিস! যাকে হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তা জানেন না। অথচ তিনি হাদীস সংকলন করার কাজে ব্যাস্ত থাকেন। আর সে ব্যক্তি কতই না মন্দ ফক্বীহ! যাকে বলা হয় রাসূল (ﷺ) এর এ বাণীর অর্থ কি? তখন তিনি তার অর্থ ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে বলতে পারেন না’’।[11]

সালাফদের ত্বরীকা ও রীতি-নীতি ছিল রেওয়ায়াতকে দেরায়াতের সাথে এবং দেরায়াতকে রেওয়ায়াতের সাথে মিলিয়ে নেয়া। আর এই রীতি গ্রহণের ব্যাপারেই তারা উপদেশ দিয়েছেন।

মাসআব আযযুবাইরী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মালিক বিন আনাসকে বলতে শুনেছি, তিনি তার দুই ভাগ্নে তথা আবূ উয়াইস এর দুই ছেলে আবূ বকর ও ইসমাঈলকে বলেন: ‘‘আমি তোমাদের দু‘জনকে এ বিষয়টিকে ভালবাসতে ও অনুসন্ধান করতে দেখছি। তথা হাদীস শ্রবণ করতে দেখছি। তখন তারা দু‘জন বললেন, হাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন। তখন মালিক বিন আনাস বললেন: যদি তোমরা হাদীস দ্বারা মানুষের উপকার করতে চাও এবং আল্লাহ্‌ও যদি তোমাদের দ্বারা উপকার করিয়ে নিতে চান, তাহলে হাদীস স্বল্প করে সংগ্রহ কর, কিন্তু হাদীসের ব্যাপারে গভীর জ্ঞানার্জন করার চেষ্টা কর’’।[12]

আমার কথা হল: সহীহ সুন্নাহ ও আসার হতে সুক্ষ্ম ফিক্বহ শাস্ত্র গ্রহণ করা আমাদের একামাত্র কর্তব্য যা বিদ্বানদের নীতিমালার আলোকে পূর্ববর্তী উম্মাহ ও ফক্বীহদের বোধগম্যতার মাধ্যমে প্রবহমান।

[1] শাইখ সুলাইমান আল আওদাহ (আল্লাহ তাকে হিফাযত করুন) প্রণীত ‘যওয়াবিতু লিদ্দিরাসাতিল ফিক্বহিয়্যাহ’ পৃ:৩৩-৩৮, সামান্য পরিবর্তন করে।

[2] ‘যওয়াবিতু লিদ্দিরাসাতিল ফিক্বহিয়্যাহ’ পৃ: ৪৫।

[3] এ মাসআলার ব্যাপারে সতর্কবাণী শীঘ্রই আসবে।

[4] ‘যওয়াবিতু লিদ্দিরাসাতিল ফিক্বহিয়্যাহ’ পৃ: ৪১,৪২ ।

[5] প্রাগুক্ত পৃ:৪২।

[6] প্রাগুক্ত পৃ:৪৭।

[7] ‘মা‘আলিমুস সুনান’ (১/৭৫)

[8] আল খত্বীব প্রণীত ‘আল জা‘মি লিআখলাক্বির রাবী ওয়াস সা‘মি’ (২/২১১) ।

[9] ‘আদাবুত ত্বলাব’ পৃ: ৪৫-৪৬ ।

[10] সালিহ আল উসাইমীন প্রণীত ‘তাযকিরাতুল হাদীসী ওয়াল মুতাফাক্বিহ’ পৃ:৬।

[11] ইবনুল যাওযী প্রণীত ‘সইদুল খতির’ পৃ: ৩৯৯-৪০০ ।

[12] রমাহ রমযী প্রণীত ‘আল-মুহাদ্দিসুল ফাযিল’ পৃ: ২৪১ ও আল-খতীব ‘নাসীহাতু আহলিল হাদীস’ (পৃ: ৩৭) যা- ‘তাযকিরাতুল হাদীসী ওয়াল মুতাফাক্বিহ’ (পৃ: ২৮) হতে গৃহীত হয়েছে।
এ গ্রন্থ প্রণয়নের পদ্ধতি (المسلك في هذا الكتاب)

অতঃপর উল্লেখিত তিনটি বিষয় আমাকে এ গ্রন্থটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে অগ্রগামী হতে উৎসাহিত করেছে। আমি আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন এর দ্বারা ইসলাম ও মুসলমানদের উপকার দান করেন এবং তিনি যেন এটাকে তার দ্বীনের পা--ত্য অর্জনের পদ্ধতির ক্ষেত্রে একটি পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেন। আর আমি অন্যের মাঝে যে নেতিবাচক দিকগুলো দেখে সমালোচনা করেছি, তা থেকে যেন তিনি আমাকে দূরে রাখেন। এ ধরনের নেতিবাচক বিষয়ের ক্ষেত্রে আমিও নিজেকে ত্রুটিমুক্ত মনে করছি না।

নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে আমি এ গ্রন্থকে সাজিয়েছি:

১. সামান্য কিছু ভিন্নতা ছাড়া আমি এর লেখনী ও অধ্যায়গুলোকে অধিকাংশ ফিক্বহ গ্রন্থের কাছাকাছি নিয়মে সাজিয়েছি। প্রথমেই আমি ইবাদাত সংক্রান্ত আলোচনা দিয়ে শুরু করেছি। যাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, ত্বহারাত (পবিত্রতা), সালাত, জানাযা, যাকাত, সিয়াম ও হাজ্জ অধ্যায়। ইবাদাত সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও আমি এর সঙ্গে সংযোজন করেছি। যেমন: শপথ, মানত, পানাহার, শিকার, যবেহ প্রভৃতি অধ্যায়। এর পর আমি এর সাথে পারিবারিক তথা ব্যক্তিগত বিষয়াবলীর বিধান এবং এর সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোও উল্লেখ করেছি। যেমন: পোশাক, সৌন্দর্য, নাযর ও মীরাস সংক্রান্ত অধ্যায়। এরপর উল্লেখ করা হয়েছে حدود (দণ্ডবিধি), جنايت(অপরাধ সমূহ) ও ديات (রক্তপণ) অধ্যায়। এরপর ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত অধ্যায়। এভাবেই গ্রন্থটি সাজানো হয়েছে।

২. এ গ্রন্থের ভূমিকায় আমি মাযহাবের উৎপত্তি, বিদ্বানদের মতভেদের কারণ এবং তাক্বলীদ সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করেছি। যা একজন শিক্ষার্থীর জন্য ফিক্বহ শাস্ত্র পাঠের পূর্বে জানা আবশ্যক।

৩. আমি এ গ্রন্থের বিষয়গুলো এবং বিষয়ের শব্দগুলো সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় সাজাতে চেষ্টা করেছি। যাতে গবেষক ও সাধারণ পাঠকদের জন্য উপযোগী হয়। সাথে সথে আমি সুক্ষ্মতা ও উদ্দেশ্য হাসিলের দিকে লক্ষ্য রেখে যথাসম্ভব এর ইবারতগুলো ফক্বীহদের ইবারতের কাছাকাছি করে সাজানোর ব্যাপারে খেয়াল রেখেছি। কখনও কখনও আমি বিভিন্ন ফিক্বহ গ্রন্থ থেকে সংকলন করে উত্তম ইবারতও নির্বাচন করেছি।

৪. পাঠকের স্মৃতিতে যুগপৎ সংঘটিত হয়, এমনভাবে আমি এর মাসআলাগুলোকে ধারাবাহিকভাবে যুক্তি ভিত্তিক সাজিয়েছি। যাতে তা দ্রুত বুঝা যায় ও সহজে গ্রহণ করা যায়।

৫. বিস্তারিত শিরোনাম রচনার ক্ষেত্রে আমি গুরুত্ব দিয়েছি। যাতে স্পষ্টভাবে এর উদ্দেশ্য বুঝা যায়। এছাড়াও শিরোনামের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। যাতে আলোচনার বিষয়বস্ত্ত নির্ধারিত হয়ে যায় এবং বিষয়বস্ত্তগুলোকে একটি অপরটি থেকে পার্থক্য করা যায় ও চিন্তা-চেতনাগুলোকে একই বিষয়ের মধ্যে সাজানো যায়।

৬. মাসআলাগুলোর ক্ষেত্রে সমস্ত দলীল একত্রিত করে ও তা বাছাই করে এবং মাসআলা সংক্রান্ত হাদীসগুলো সহীহ-যঈফ নির্ণয় করে আমি যথাসম্ভব কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে উপযুক্ত দলীল পেশ করার চেষ্টা করেছি। আমার সাধ্য অনুযায়ী এ দলীলগুলো সংক্ষিপ্তভাবে টীকায় উল্লেখ করেছি। কোন মাসআলার ক্ষেত্রে যদি কোন ইজমা থাকে তাহলে আমি তার সূত্রও উল্লেখ করে দিয়েছি।

৭. যদি কোন মাসআলার ক্ষেত্রে মতভেদ পাওয়া যায় (যা অধিকাংশ ফিক্বহী মাসআলার ক্ষেত্রে হয়ে থাকে), তাহলে আমি সে মতভেদ উল্লেখ করতে অলসতা করি নি। আর তা করবই বা কেন? কেননা কাতাদাহ বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি মতভেদ সম্পর্কে জানে না, সে ব্যক্তি নাসিকা দিয়ে ফিক্বহ এর ঘ্রাণ গ্রহণ করতে পারে নি’’।[1]

মূলতঃ মতভেদ সম্পর্কে অজ্ঞতা এমন হক্বকে বাতিল করার দিকে নিয়ে যায়, যা হয়তো সে জানে না। কেননা হক্বটা শুধু বিদ্বানদের যে কোন একজনের কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সে যে মাপেরই বিদ্বান হোক না কেন। এজন্য ওসমান বিন আত্বা তার পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি মানুষের মতভেদ সম্পর্কে জানে না তার ফাৎওয়া দেয়া উচিৎ নয়। এরূপ যদি না করে তাহলে সে তার কাছে যে জ্ঞান রয়েছে তার চেয়ে নির্ভরযোগ্য জ্ঞানকে বাতিল করে দিতে পারে’’।[2]

যদি কোন মাসআলার ক্ষেত্রে মতভেদটা গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমার উপস্থাপন পদ্ধতি হল, আমি সকল মতামতসহ বিদ্বানদের মধ্যে যারা এ মতামতগুলো দিয়েছেন তাদের কথা উল্লেখ করেছি। মতামতগুলো সংকলনের ক্ষেত্রে আমি যথাসম্ভব স্ব-স্ব ইমামের গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছি। অথবা বিদ্বানদের নিকট নির্ভরযোগ্য মাযহাবী গ্রন্থগুলোর উপর নির্ভর করেছি। সাথে সাথে আমি টীকাতে এ সমস্ত মতামতের নির্ভরযোগ্যতার কথা উল্লেখ করে দিয়েছি।

অতঃপর আমি এ সমস্ত মতামতের ক্ষেত্রে যে দলীলগুলো জানতে পেরেছি তা বর্ণনা করে দিয়েছি। সাথে সাথে যদি দলীলটি স্পষ্ট না হয়, তাহলে আমি দলীল গ্রহণের পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছি। কখনও আবার যে সব দলীলের ব্যাপারে প্রশ্ন বা আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে এবং বিপরীত পক্ষ থেকে এর যা উত্তর দেয়া হয়েছে সে বিষয়টিও উল্লেখ করে দিয়েছি। যাতে এর দ্বারা পরিপূর্ণ উপকার পাওয়া যায়। এভাবেই আমি সকল মাসআলার ক্ষেত্রে বিদ্বানদের মতামতগুলো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি।

৮. আমি শুধু এ মতামতগুলো সংকলন ও দলীলগুলো বর্ণনা করাকেই যথেষ্ট মনে করি নি। কেননা প্রাধান্য দেয়া ছাড়াই শুধু মতামত পেশ ও দলীল বর্ণনা করা হলে, সাধারণ পাঠক এর সঠিকতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে হতাশা ও দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে পড়ে যাবে। কারণ একজন গবেষক যখন সমস্ত মতামত একত্রিত করল এবং তা বাছাই করল। কিন্তু প্রাধান্য দিল না, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যরা এর সঠিকতা নির্ণয় করতে সক্ষম হবে না। তাই আমি সকল মতামত বুঝার চেষ্টা করেছি এবং সেগুলো সনদ ও মতনগত দিক থেকে যাচাই-বাছাই করেছি। সর্বোপরি এর উদ্দেশ্য বুঝেছি, একটিকে আরেকটির সাথে তুলনা করেছি এবং যথাসম্ভব এ ক্ষেত্রে আমি বিদ্বানদের নীতিমালা আরোপ করারও চেষ্টা করেছি। যেন প্রাধান্যপ্রাপ্ত অভিমতটিই গ্রহণ করা যায়। যে মাপেরই ব্যক্তি হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে আমি কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার চেষ্টা করি নি। মূলতঃ একনিষ্ঠ গবেষক তিনি, যিনি হক্ব এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্য অন্বেষণের চেষ্টা করেন। এর পরে তার আর কোন যায় আসে না যে, সে কি বলল বা অমুকে কি বলল। বিশেষ করে একনিষ্ঠ গবেষক তিনি, যিনি হক্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক ইমামের মতামত ত্যাগ করে অন্য ইমামের মতামত গ্রহণ করতেও পরওয়া করে না।

এ ক্ষেত্রে আমি সুদৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করেছি যে, সর্বদা আমি শরীয়াতের দলীলের সাথেই থাকব। এখান থেকেই শ্রবণ করব, এর দিকেই মনোযোগ দিব এবং এর উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করব। এর আগে বেড়ে কোন কথা বলব না। যা বলা যায় না তা বলব না। যে অর্থের সম্ভাবনা রাখে না, সে অর্থ করার চেষ্টাও করব না এবং নিজের অথবা মানুষের প্রবৃত্তির অনুসরণ করব না। এর মূল উদ্দেশ্য হল, যদি প্রাধান্যের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য দিকটা স্পষ্ট হয়ে যায় তাহলে, আমার যোগ্যতা অনুযায়ী তা প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করব। আর যদি প্রাধান্যের ক্ষেত্রে সঠিক দিকটা স্পষ্ট না হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে আমি নীরবতা পালন করব। কেননা দলীল-প্রমাণ ছাড়া প্রাধান্য দেয়া বৈধ নয়।

ইবনু আব্দিল বার বলেন: ‘‘বিদ্বানদের মতভেদের সময় কুরআন, সুন্নাহ ও এ দু’য়ের নীতিমালার আলোকে গঠিত ইজমা ও কিয়াস থেকে দলীল গ্রহণ করা ওয়াজিব। এটা এমন নয় যে, কোন কোন ক্ষেত্রে এ গুলো থেকে যে দলীল পাওয়া যাবে না। যদি দলীলগুলো সমপর্যায়ের হয়ে যায়, তাহলে কুরআন সুন্নাহর দিক দিয়ে যে দলীলটা বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ সে দিকেই ধাবিত হতে হবে। আর যদি তা স্পষ্ট না হয় তাহলে নীরবতা পালন করতে হবে। নিশ্চিত জ্ঞান ছাড়া কোনটিকে অকাট্যভাবে গ্রহণ করা বৈধ হবে না’’।[3]

কখনও আবার সমস্ত মতামতের মধ্যে দুইটি শক্তিশালী মতামতকে নির্বাচন করেছি অথবা আমার কাছে যে মতামতগুলো দুর্বল মনে হয়েছে সেগুলোকে দুর্বল বলেছি। সুতরাং এগুলো মূলতঃ আংশিক প্রাধান্য যা সঠিক মাসআলার কাছাকাছি নিয়ে যাবে।

যদি কোন অভিমত স্পষ্টভাবে অন্যের উপর প্রাধান্য পায়, তাহলে আমি অকাট্য দলীলের মাধ্যমে শক্তিশালী কথার দ্বারা তা উল্লেখ করেছি। সাথে সাথে পূর্বোলেস্নখিত নিয়মের মত করেই এ মতের প্রবক্তাদেরও উল্লেখ করেছি। এরপর সংক্ষিপ্তভাবে মতভেদের বিষয়টিরও ইঙ্গিত দিয়েছি। কখনও আমি বাতিল, অগ্রহণযোগ্য যা বর্ণনা ও উল্লেখ করা নিয়ে ব্যাস্ত থাকা উচিৎ নয়, এমন মতভেদগুলো আলোচনা করা থেকে বিরত থেকেছি। তবে কোন উপকার থাকলে তা উল্লেখ করেছি।

মতামত নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি চেষ্টা করেছি যে, সালাফদের মতসমষ্টি থেকে আমি বের হব না। সুতরাং পূর্বে বলা হয় নি এমন কোন নতুন মতামত নিয়ে আসার কোন চেষ্টা আমি করি নি। কেননা পূর্ববর্তীদের এসব মতামতের উপর সীমাবদ্ধ থাকাটা তাদের পক্ষ থেকে ইজমা হিসেবে ধরে নিতে হবে এবং মনে করতে হবে যে, এদের মতামতের মধ্যেই হক্ব সীমাবদ্ধ রয়েছে। হক্ব এদের মতামতের বাইরে যেতে পারে না। যদিও এসব মতামতের মধ্যে কোনটির সাথে হক্ব সংশ্লিষ্ট তা নিয়ে তারা মতভেদ করেছেন। সুতরাং এ ধারণা করা যাবে না যে, সমস্ত উম্মতের মাঝে যে কোন এক যুগে হক্ব গোপন থাকতে পারে।

আমি এ ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে সতর্ক করে দিচ্ছি যে, আমার নির্বাচনগুলো আমি ব্যতীত অন্যের জন্য অবধারিত হওয়াটা আবশ্যক নয়। যদিও আমার এই নির্বাচনগুলো উপকার দিতে পারে ঐসকল ব্যক্তিদের যারা মাসআলাকে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। আর যে শিক্ষার্থী মাসআলাকে প্রাধান্য দিতে সক্ষম তার ক্ষেত্রে এ উপকার হবে যে, আমি তার জন্য বিক্ষিপ্ত মাসআলাগুলো একত্রিত করে দিলাম। ফলে কোন বাধ্যবাধকতা ছাড়াই তার কাছে যেটা সঠিক বলে বিবেচিত হবে সেটাকেই সে প্রাধান্য দিবে। আর যদি কোন বিচক্ষণ ব্যক্তি আমার এ কথাগুলো অবগত হওয়ার পর তা শক্তিশালী মনে না করেন, তাহলে তিনি যেন আমার প্রতি দয়া পরবশ হয়ে বিনয়ের ডানা নত করে দেন। আমার উপর তাকে যে জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে, এ জন্য তিনি যেন আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করেন।

মূলতঃ যখন মহিয়ান আল্লাহ্‌র দ্বীনের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পায়, তখন হক্বপন্থি বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি তার দয়া প্রদর্শনও বৃদ্ধি পায়।

উল্লেখিত বিন্যাস ও পদ্ধতিতে আমি আমার এ গ্রন্থের অধিকাংশ অংশকেই সাজিয়েছি। এমনকি আমি যখন "كتاب البيوع" এর শুরুর দিকে পৌঁছলাম তখন আমি ভ্রমণে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। এমন সময় প্রকাশকও (আল্লাহ্‌ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দান করুন) গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য পিড়াপিড়ি করছিলেন। তখন আমাদের ভাই শাইখ ফুয়াদ সিরাজ (আল্লাহ্‌ তাকে হিফাযত করুন) প্রণিত "البيوع المحرمة" নামক সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা আমার এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করার জন্য আল্লাহ্‌র কাছে ইসিত্মখারা করলাম। তবে বিভিন্ন মতামত সমূহের মধ্যে মতভেদ ও প্রাধান্যের ব্যাপারে যে শর্তটি আমি আমার গ্রন্থে আরোপ করেছি সে শর্তের আলোকে অত্র আলোচনাটি লিপিবদ্ধ করা হয় নি। আর যে আলোচনার পরিপূর্ণটা গ্রহণ করা যায় না, তার অধিকাংশটা ছাড়াও যায় না। আমার শর্তালোকে এ অংশটুকু আলোচনা করতে হলে পরিপূর্ণ প্রচেষ্টা, দীর্ঘ সময় ও বিশেষ গুরুত্বের প্রয়োজন। বিশেষ করে এ গ্রন্থের আলোচনার ক্ষেত্রে অধিকাংশ নব উদ্ভাবিত মাসআলার জন্য এটা করা প্রয়োজন। প্রকৃত পক্ষ আমি "كتاب البيوع" এর আলোচনা শুরুও করেছিলাম। কিন্তু আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় সফরে যেতে বাধ্য হওয়াই এটা সম্পূর্ণ হয়ে উঠে নি। সুতরাং আমি আশা করব যে, পাঠকরা যেন আমার এই ওযরটি গ্রহণ করেন। যেহেতু আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় আমি কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য যাত্রা শুরু করেছিলাম। ইনশা আল্লাহ্‌ আগামী সংস্করণে এ বিষয়ে একটি অধ্যায় আলোচনা করার চেষ্টা করব।

পরিশেষে আরেকটি কথা না বলেই পারছি না যে, যারা মাসআলা প্রণয়নের ব্যাপারে, কিতাব ধার দেয়ার ব্যাপারে, লেখার ব্যাপারে, কপি করার ব্যাপারে, সংকলনের ব্যাপারে, ছাপানোর ব্যাপারে অথবা অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানের ব্যাপারে এ কাজটি সম্পন্ন এবং এভাবে প্রকাশ করার জন্য যে কোন ভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছেন, তাদের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও একনিষ্ঠ দু‘আ করছি। বিশেষ করে আমাদের ভাই শাইখ ফুয়াদ সিরাজ (আল্লাহ্‌ তার জ্ঞানে, আমলে ও পরিবারে বরকত দান করুন), শাইখ হানী আল-হাজ্জ (আল্লাহ্‌ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করুন), আমার সম্মানিত দু’ভাই মুস্তফা আশ-শামী ও ফাইসাল আব্দুল ওয়াহিদ (আল্লাহ্‌ তাদের হিফাযত করুন) এবং সম্মানিত ভাই সাইয়্যিদ ফাতহী এর কথা উল্লেখ করছি। আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করছি তিনি যেন তাদের অশেষ সাওয়াব ও প্রতিদান দান করেন এবং আমাদেরকে তাদের সাথে চিরস্থায়ী জান্নাতে একত্রিত করেন।

আমি এ গ্রন্থের নাম রেখেছি "صحيح فقه السنه و توضيح مذاهب الأئمة" (বিশুদ্ধ সুন্নাহ সম্বলিত ফিক্বহ ও ইমামগণের মতামতের বিশ্লেষণ)। বিদ্বানদের কাছে নিজ ত্রুটি প্রকাশ করতে আমার কোন অসুবিধা নেই এবং এটা জানাতেও কোন সমস্যা নেই যে, এ ক্ষেত্রে আমার ক্ষমতা খুবই স্বল্প।

যদি আমি ভুল করি, তাহলে ভুল থেকে কে নিষ্কৃতি পেয়েছে? আর যদি আমাকে ভুল বুঝা হয়, তাহলে কার পক্ষ থেকে আমাকে ভৎর্সনা করা হচ্ছে?

আমি জানি যে, মানুষকে যেহেতু ত্বরাপ্রবণ করে সৃষ্টি করা হয়েছে, তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে ভুল করে ও তার পদস্খলন হয়। যদি আমি সঠিক করে থাকি তাহলে তা শুধু আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকেই হয়েছে। আর যদি ভুল করে থাকি তাহলে তা আমার নিজের পক্ষ থেকে ও শয়তানের পক্ষ থেকে হয়েছে। আল্লাহ্‌ ও তার রাসূল (ﷺ) এ থেকে মুক্ত। এ ক্ষেত্রে আমি দৃষ্টান্ত স্বরূপ কবির পংক্তি পেশ করলাম-

لقد مضيتُ وراءَ الركبِ ذا عرجٍ مؤمّلاً جبرَ ما لاقيتهُ من عَرَجِ

فإن لحقت بهم من بعدما سبقوا فكم لربِّ الورى في الناسِ من فَرَجِ

وإن ضللتُ بقفرِ الأرضِ منقطعاً فما على أعرج في الناسِ من حَرَجِ

‘‘আমি খঞ্জত্ব নিয়ে একটি অভিযাত্রী দলের পিছনে অগ্রসর হয়েছি,

আমার এই খঞ্জত্বের শক্তিটুকুর উপর ভরসা করেই।

যদি তাদের অনেক দূর অগ্রসর হওয়ার পরও আমি তাদের সাথে মিলিত হতে পারি (তবে এতে আমার কোন কৃতিত্ব নেই)।

সৃষ্টি কুলের স্রষ্টা, মানুষের জন্য কতই না সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।

আর আমি যদি জনমানবহীন অরণ্যে একাকি বিভ্রান্ত হয়ে যায়,

তবে মানব সমাজে একজন খঞ্জ ব্যক্তির জন্যে কিবা ক্ষতি হবে’’।

আমি আল্লাহ্‌র কাছে কামনা করছি, তিনি যেন এ কর্মের দ্বারা আমাকে ও আমার শিক্ষার্থী ভাইদেরকে উপকার দান করেন। আমি তাঁর (আল্লাহ্‌র) সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ কাজের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠ নিয়ত কামনা করছি। কেননা অন্তর তার হাতেই রয়েছে। আমি এ আশাও করছি যে, তাঁর সৃষ্টি জীবের কাউকে যেন এই একনিষ্ঠ নিয়্যাতের মধ্যে অংশীদার না করেন। আর এই নিষ্ঠার সম্পূর্ণ প্রতিদান যেন সাক্ষাৎ এর দিন (ক্বিয়ামতের দিন) আমাকে দান করেন!

﴿يَوْمَ لَا يَنْفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ ٭ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ﴾

যে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবে না। তবে যিনি আল্লাহ্‌র কাছে সুস্থ অন্তরে আসবেন তার ব্যাপার টি আলাদা। (সূরা : শু‘আরা-৮৮,৮৯)

আমাদের প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর উপর, তাঁর পরিবারবর্গের উপর এবং তাঁর সাহাবাদের উপর আল্লাহ্‌র দয়া, শান্তি ও বরকত অবতীর্ণ হোক!


নিবেদক

দয়ালু পালনকর্তা, সমস্ত জাহানের মালিক আল্লাহ্‌ তা‘আলার কাছে ক্ষমা ভিখারী
আবূ মালিক কামাল ইবনু সাইয়্যিদ সালিম

[1] ‘জা‘মিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহ’ (২/৪৬) ।

[2] ‘জা‘মিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহ’ (২/৪৬) ।

[3] ‘জা‘মিউ বায়ানিল ইলম’ (১/৮০) ।

মহানাবী (ﷺ) এর যুগে ফিক্বহ শাস্ত্র (الفقه في عهد النبي صلى الله عليه وسلم)

জেনে রাখুন! রাসূল (ﷺ) এর স্বর্ণযুগে ফিক্বহ শাস্ত্র রচিত হয় নি। বর্তমান যুগের ফক্বীহগণ যেমনটি তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিভিন্ন বিধানের রুকনসমূহ, শর্তসমূহ, আদাব বা শিষ্টাচারসমূহ প্রণয়ন ও দলীল দ্বারা একটিকে অপরটি থেকে পৃথক করার যে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, রাসূল (ﷺ) এর যুগে ধর্মীয় বিধান নিয়ে এরূপ আলোচনা হয় নি। বর্তমান যুগের ফক্বীহগণ তাদের কর্মের রূপরেখা তৈরি করেছেন এবং এ রূপরেখা গুলোর সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন বিষয়ের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যে বিধানকে যতটুকু সীমাবদ্ধ রাখা দরকার ততটুকু সীমাবদ্ধ রেখেছেন। এরূপ অনেক কার্যক্রম বর্তমান যুগের ফক্বীহদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। আর রাসূল (ﷺ) এর স্বর্ণযুগের রূপরেখাটা ছিল এরূপ যে, তিনি যখন ওযূ করেছেন তখন সাহাবাগণ তাঁর ওযূ করা দেখেছেন। ‘‘এটা ওযূর রুকন, ঐটা আদব’’ এরূপ কোন বর্ণনা ছাড়াই সাহাবাগণ তাঁর ওযূর পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। তারা মহানাবী (ﷺ) কে সালাত আদায় করতে দেখেছেন এবং যে ভাবে তিনি সালাত আদায় করেছেন সে ভাবেই তারা সালাত আদায় করেছেন। মহানাবী (ﷺ) হাজ্জ পালনের সময় জনগণ তা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাঁর মত করেই তারা হাজ্জের কার্যক্রম সম্পাদন করেছেন। মহানাবী (ﷺ) এর অধিকাংশ সময়টা এভাবেই কেটেছে। তিনি তাঁর উম্মতকে এমন কোন বিস্তারিত বর্ণনা দেন নি যে, ওযূর ফরয ৬টি বা ৪টি। তিনি এমনটি কখনও ভাবেন নি যে, মানুষ ধারাবাহিকতা ছাড়া ওযূ করবে। ফলে এ ওযূকে সঠিক বা ভুল বলে রায় দেয়া হবে। (তবে আল্লাহ্‌ চাইলে তা ভিন্ন ব্যাপার)। মহানাবী (ﷺ) এ সংক্রান্ত বিষয়ে খুব কমই জিজ্ঞাসিত হতেন। জনগণ বিভিন্ন প্রেক্ষাপট অনুযায়ী তার কাছে ফাৎওয়া চাইলে তিনি সে বিষয়ে ফাৎওয়া দিতেন। কোন সংকট দেখলে তা নিরসন করতেন। তিনি মানুষকে ভাল কাজ করতে দেখলে তার প্রশংসা করতেন। আর গর্হিত কাজ করতে দেখলে তা প্রত্যাখ্যান করতেন। সমাজে ঘটে যাওয়া কোন বিচার ফায়সালার ব্যাপারে তার কাছে যে ফাৎওয়া চাওয়া হত, তার সঠিক সমাধান দিতেন। কেউ অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করতেন। প্রত্যেক সাহাবী যথাসম্ভব (আল্লাহ্‌ যা তার জন্য সহজ করে দেন) তাঁর ইবাদাত, ফাৎওয়া ও কোন সমাধান অবলোকন করে তা মুখস্থ করে নিতেন এবং তা মনে রাখতেন। তারা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো অনুধাবন করতেন। ফলে তাদের নিকট সঞ্চিত নিদর্শনের মাধ্যমে কেউ তাকে জায়েয বলতেন, কেউ মুস্তাহাব বলতেন, কেউ আবার মানসূখ (রহিত) বলতেন। কোন দলীলের দিকে দৃষ্টিপাত না করে নিজের আত্মবিশ্বাস ও প্রশান্তির ভিত্তিতে তারা মহানাবী (ﷺ) এর কাছ থেকে দ্বীনি জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। এভাবেই রাসূল (ﷺ) এর সোনালী যুগ অতিবাহিত হয়েছে।

সাহাবাদের যুগে ফিক্বহ শাস্ত্র (عهد الصحابة رضي الله عنهم)

এর পর সাহাবাগণ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন এবং প্রত্যেকেই বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী হয়ে যান। তাদের মাঝে বিভিন্ন ঘটনার উদ্ভব ঘটে ও মাসআলা-মাসায়েলের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ফলে তারা বিভিন্ন ফাৎওয়ার সম্মুখীন হন এবং তাদের মেধা ও সংরক্ষিত জ্ঞান অনুযায়ী এর সমাধান দেন। যদি এগুলো সম্ভব না হত তাহলে ইজতিহাদ করে ফাৎওয়া দিতেন। রাসূল (ﷺ) যে বিধানের যে হুকুম দিয়েছেন তার কারণ জানার চেষ্টা করতেন। যেখানেই পাওয়া যাক না কেন রাসূল (ﷺ) এর কোন বিধানের ব্যাপারে অবগত হলে তারা তা বাস্তবায়ন করতেন। কোন ইবাদাত রাসূল (ﷺ) এর পদ্ধতির আলোকে বাস্তবায়ন হওয়ার ক্ষেত্রে তারা কখনও কার্পণ্য বা আলস্য করতেন না।

সাহাবাদের মতভেদের কারণ ও এর চিত্র (أسباب اختلاف الصحابة وصوره)

রাসূল (ﷺ) এর সাহাবাদের মাঝে তৎকালীন সময়ে যে মতানৈক্য সংঘটিত হয়, তার কয়েকটি নমুনা নিমেণ আলোচিত হলো:

১। কোন সাহাবা কোন বিষয়ের ফায়সালা অথবা ফাৎওয়ার বিধান শুনতেন, যা অপরজন শুনেন নি। ফলে যিনি শুনেন নি তিনি ঐ বিষয়ে তার ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে ফাৎওয়া দিতেন। এটা কয়েকভাবে হতে পারে-

(ক) হয়ত তার ইজতিহাদটা হাদীস মোতাবেক হয়ে যেত। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- একদা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এক মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, যার স্বামী তার মহর নির্ধারণ না করেই মারা গেছেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি রাসূল (ﷺ) কে এ বিষয়ে ফায়সালা দিতে দেখি নি। ফলে তারা বিষয়টি নিয়ে একমাস যাবৎ মতভেদ করেন এবং এর সঠিক উত্তর জানার চেষ্টা করেন। পরিশেষে ইবনে মাসউদ তার ইজতিহাদের মাধ্যমে ফাৎওয়া দিয়ে বললেন, মহিলার বংশীয় নারীদের মহরের ন্যায় তার মহর নির্ধারিত হবে। এর কমও দিবে না, বেশিও দিবে না এবং তাকে ইদ্দত পালন করতে হবে ও সে স্বামীর মীরাস পাবে। তখন মা’কাল বিন ইয়াসার দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলেন যে, ‘‘আপনার ফায়সালার ন্যায় রাসূল (ﷺ) জনৈকা মহিলার ফায়সালা দিয়েছিলেন’’। এটা শুনে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এতো আনন্দিত হলেন যে, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি কখনও এতো আনন্দিত হন নি।

(খ) তাদের মাঝে মুনাজারাহ বা তর্ক বিতর্ক দেখা দিত। ফলে প্রবল ধারণার ভিত্তিতে হাদীস প্রাধান্য পেত। এরপর তারা ইজতিহাদ ত্যাগ করে শ্রুত বিষয়ের দিকে ফিরে যেতেন। যেমন: আবূ হুরাইরা (রাঃ) এর প্রথম মতামত ছিল যে, ‘‘যে ব্যক্তি জুনুবী অবস্থায় সকাল করবে সে সিয়াম পালন করতে পারবে না’’। ফলে রাসূল (ﷺ) এর কিছু সংখ্যক স্ত্রী তাকে এর বিপরীত খবর দিলে, তিনি (আবূ হুরাইরা) স্বীয় অভিমত পরিত্যাগ করেন।

(গ) তাদের কাছে হাদীস পৌঁছেছে। কিন্তু তা প্রবল ধারণার ভিত্তিতে নয়। ফলে তারা ইজতিহাদ ত্যাগ করেন নি। বরং হাদীস নিয়ে সমালোচনা করেছেন। এর উদাহরণ হলো: একদা ফাতিমা বিনতে কায়েস উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) এর কাছে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, তিনি তিন তালাক প্রাপ্তা হলে রাসূল (ﷺ) তার জন্য কোন ভরণ-পোষণ ও বাসস্থান নির্ধারণ করে দেন নি। উমার (রাঃ) তার এ সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘‘আমরা কোন মহিলার কথা শুনে আল্লাহ্‌র কিতাবকে ত্যাগ করতে পারি না। আমরা জানি না, সে সত্য বলছে না মিথ্যা বলছে’’। আর আয়িশা (রা.) তাকে বলেন, হে ফাতিমা! ‘‘কোন বাসস্থান ও ভরণ পোষণ নির্ধারণ করা হয় নি’’ তোমার এ কথাটির সত্যতার ব্যাপারে তুমি আল্লাহ্‌কে ভয় কর।

(ঘ) মূলতঃ তাদের কাছে কোন হাদীসই পৌঁছে নি। এর উদাহরণ হলো: আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) নারীদেরকে নির্দেশ দিতেন যে, তারা যখন (জানাবাতের) গোসল করবে তখন যেন তাদের চুলের বেনী খুলে দেয়। এই ফাৎওয়াটি আয়িশা (রা.) শুনার পর বলেন, কি আশ্চর্য লাগছে, ইবনে উমার (রাঃ) মহিলাদের চুলের বেনী খুলার নির্দেশ দিচ্ছেন, তাহলে (হাজ্জের সময়) নারীদের চুল মুণ্ডন করতে নির্দেশ দেন না কেন! অথচ আমি ও রাসূল (ﷺ) একই পাত্রে (জানাবাতের) গোসল করতাম (তখন বেনী খুলতাম না) এবং তিন বারের বেশি সময় পানি ঢালতাম না।

২। সাহাবাগণ রাসূল (ﷺ) কে কোন কাজ করতে দেখলে, সেটাকে কেউ সুন্নাত বলতেন, কেউ আবার জায়েয বলেন: এর উদাহরণ হলো:

সাহাবাগণ রাসূল (ﷺ) কে তওয়াফের ক্ষেত্রে রমল করতে (বীরের ন্যায় চলতে) দেখেছেন, ফলে জমহুর আলিম তওয়াফের ক্ষেত্রে রমল করাকে সুন্নাত মনে করেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, মূলত রাসূল (ﷺ) এটা করেছিলেন মুশরিকদের উক্তি ‘‘ইয়াসরিবের জ্বর মুসলমানদের দুর্বল করে দিয়েছে’’ এ ধারণার কারণে। এটা সুন্নাত নয়।

৩। ধারণার কারণে মতভেদ: এর উদাহরণ হলো: রাসূল (ﷺ) হাজ্জ করেছেন এবং মানুষেরা তাঁর হাজ্জ প্রত্যক্ষ করেছেন। ফলে তাদের কেউ মনে করেন যে, তিনি হাজ্জে তামাত্তু করেছেন। কেউ মনে করেন, তিনি হাজ্জে কিরান করেছেন। আবার কেউ মনে করেন যে, তিনি হাজ্জে ইফরাদ করেছেন।

৪। ভুল-ভ্রান্তির কারণে মতভেদ: এর উদাহরণ হলো: বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, রাসূল (ﷺ) রজব মাসে উমরা করেছেন। হযরত আয়িশা (রা.) এ কথা শুনে বলেন: ‘‘ইবনে উমার (রাঃ) এটা ভুল করে বলেছেন’’।

৫। হাদীস সংরক্ষণের ত্রুটির কারণে মতভেদ: এর উদাহরণ হলো: ইবনে উমার (রাঃ) রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণনা করে বলেন: ‘‘মৃত ব্যক্তির জন্য তার পরিবার ক্রন্দনের ফলে মৃত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হবে’’। হযরত আয়িশা (রা.) এর সঠিক সমাধান দিয়ে বলেন, ইবনে উমার (রাঃ) একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধারণার ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি হলো: ‘‘একদা রাসূল (ﷺ) জনৈকা ইয়াহুদীর কবরের নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, এমতাবস্থায় তার পরিবারবর্গ তার জন্য ক্রন্দন করছিল। অতঃপর মহানাবী (ﷺ) বললেন, তারা তার জন্য ক্রন্দন করছে, অথচ তাকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছে’’। এর ফলে ইবনে উমার ধারণা করেছিলেন যে, ক্রন্দন করাটাই কবরে শাস্তি হওয়ার কারণ এবং তিনি আরও ধারণা করেছিলেন যে, এ হুকুমটা সার্বজনীনভাবে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য।

৬। বিধানের কারণের মধ্যে মতভেদ: এর উদাহরণ হলো: জানাযার জন্য দাঁড়ানো। কেউ বলেন, এটা মূলতঃ ফেরেশতাদের সম্মানের জন্য দাঁড়ানো হয়। ফলে মু’মিন ও কাফির সবাই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কেউ বলেন, মৃত্যুর ভয়ের জন্য দাঁড়ানো হয়। ফলে এ ক্ষেত্রেও মু’মিন ও কাফির সবাই অন্তর্ভুক্ত। আবার কেউ বলেন, ‘‘একদা মহানাবী (ﷺ) এর পাশ দিয়ে এক ইয়াহুদীর জানাযা অতিক্রম করছিল তখন তিনি তার মাথার উপর দিয়ে লাশটি অতিক্রম করাকে অপছন্দনীয় মনে করে দাঁড়িয়ে গেলেন। এতে বুঝা গেল, বিধানটি কাফেরের জন্য খাস।

৭। বিতর্ককারীদের মাঝে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে মতভেদ: এর উদাহরণ হল: মহানাবী (ﷺ) ক্বিবলাকে সামনে রেখে পেশাব-পায়খানা করতে নিষেধ করেছেন। ফলে এক দলের মতে, এ হুকুম হল সার্বজনীন হুকুম এবং এ বিধান রহিত হয় নি। আর জাবের (রাঃ) রাসূল (ﷺ) কে তাঁর মৃত্যুর এক বছর পূর্বে ক্বিবলাকে সামনে রেখে পেশাব করতে দেখেছেন। ফলে তিনি মনে করেন, এর ফলে পূর্বের নিষেধাজ্ঞাটি রহিত হয়ে গেছে। অন্যদিকে ইবনে উমার (রাঃ) ক্বিবলাকে পেছনে রেখে রাসূল (ﷺ) কে হাজাত সম্পূর্ণ করতে দেখেছেন। ফলে এর দ্বারা তিনি পূর্বের সকল মতামতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরূপ আরও মন্তব্য রয়েছে।


তাবেঈদের যুগে ফিক্বহ শাস্ত্র (الفقه في عهد التابعين)

মোট কথা, মহানাবী (ﷺ) এর সাহাবাদের যুগে তাদের মতামতের ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। অতঃপর তাবেঈরা যথাসাধ্য তাদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করতেন। এর পর তারা মহানাবী (ﷺ) এর হাদীস ও সাহাবাদের মতামত থেকে যা শুনতেন তা মুখস্থ করে নিতেন ও মনে রাখতেন। তারা মতভেদগুলো যথাসাথ্য সমন্বয় করার চেষ্টা করতেন। একটি মতামতকে আরেকটির উপর প্রাধান্য দিতেন। তাদের দৃষ্টিতে কিছু মতামতকে বাতিল করে দিতেন, যদিও বড় সাহাবাদের পক্ষ থেকে কোন আসার (সাহাবীর বাণী) প্রমাণিত হোক না কেন। যেমনটি কোন কোন ক্ষেত্রে (পরিস্থিতির আলোকে) মহানাবী (ﷺ) এর মতের উল্টো করাটাও তাদের মাঝে ব্যাপকতা লাভ করেছিল।

ফলে প্রত্যেক তাবেঈ বিদ্বানের অনুকূলে একটি করে মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলে বিভিন্ন ইমামের আবির্ভাব ঘটেছে। যেমন: মদ্বীনায় সাঈদ বিন মুসাইয়িব ও সালিম বিন আবদুল্লাহ বিন উমার। এদের পরে সেখানে ইমাম হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন যুহরী, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ ও রবীয়াহ বিন আব্দুর রহমান। মক্কাতে ইমাম হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, আত্বা বিন আবি রিবাহ। কুফায় ছিলেন ইবরাহীম আন-নাখঈ ও শা’বী। বসরাতে ছিলেন হাসান বসরী। ইয়ামানে ত্বউস বিন কায়সান এবং সিরিয়ায় ইমাম হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন মাকহুল । মহান আল্লাহ্‌ তাদের অন্তরকে ইলম দ্বারা সিক্ত করেছেন এবং তাতে তারা মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে তাবেঈগণ তাদের কাছ থেকে হাদীস, সাহাবাদের ফাৎওয়া ও তাদের মতামত এবং এ সমস্ত বিদ্বানের মাযহাব ও তাদের বিভিন্ন বিশ্লেষণ গ্রহণ করেছেন। যাদের ফাৎওয়ার প্রয়োজন হয়েছে তারা তাদের কাছে ফাৎওয়া চেয়েছেন। তাদের মাঝে বিভিন্ন মাসআলা মাসায়েলের উদ্ভব ঘটেছে এবং নেইা প্রকার বিচার-ফায়সালা তাদের নিকট উত্থাপিত হয়েছে।

সাঈদ বিন মুসাইয়িব ও ইবরাহীম আন-নাখঈ এবং তাদের মতো আরও অনেকেই ফিক্বহ শাস্ত্রের অধ্যায় রচনা করেছেন। সাঈদ বিন মুসাইয়িব ও তার অনুসারীগণ মনে করতেন যে, হারামাইনের অধিবাসীগণ ফিক্বহ শাস্ত্রে বড় পণ্ডিত। তাদের মাযহাবের মূল ভিত্তি ছিল উমার (রাঃ) ও উসমান (রাঃ) এর ফাৎওয়া এবং তাদের বিচার ফায়সালা। ইবনে উমার (রাঃ), আয়িশা ও ইবনে আব্বাসসহ মদ্বীনার কাজীদের বিচার ফায়সালাও তাদের মাযহাবের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত ছিল।

অপর দিকে নাখঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও তাঁর অনুসারীগণ মনে করতেন যে, আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) ও তার অনুসারীগণই ফিক্বহ শাস্ত্রে বড় পণ্ডিত। তাদের মাযহাবের মূল ভিত্তি ছিল ইবনে মাসউদের (রা.) ফাৎওয়া। আলী (রাঃ) এর বিচার ফয়সালা ও তার ফাৎওয়া। শুরাইহসহ কুফার অন্যান্য কাজীদের বিচার ফায়সালাও তাদের মাযহাবের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত ছিল। প্রত্যেক দলই বিভিন্ন মাসআলার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্যতা ও দলীল অন্বেষণের বিষয় খেয়াল রাখতেন। যে বিষয়ে বিদ্বানগণ ঐকমত্য পোষণ করতেন, সে টিকে তারা দৃঢ় ভাবে গ্রহণ করতেন। আর কোন বিষয়ে যদি বিদ্বানদের মাঝে মতানৈক্য দেখা দিত তাহলে, শক্তিশালী ও বিশুদ্ধ অভিমতটিই তারা গ্রহণ করতেন। তাদের অর্জিত জ্ঞান দ্বারা যদি কোন মাসআলার সমাধান দিতে না পারতেন, তাহলে তারা তাদের কথা ত্যাগ করে বিভিন্ন ইঙ্গিত ও মাসআলার দাবীটির অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। ফলে প্রত্যেক বিষয়ে তাদের নিকট অসংখ্য মাসআলার উদ্ভব ঘটে।


তাবেঈদের পরবর্তী যুগে ফিক্বহ শাস্ত্র (الفقه بعد عهد التابعين)

অতঃপর মহান আল্লাহ্‌ তাবেঈদের পরবর্তী যুগে ইলম বহনকারী একটি দলের আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। তারা তাবেঈদের কাছ থেকে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং তাদের শাইখদের রীতি-নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা রাসূল (ﷺ) এর হাদীসের সনদ গ্রহণ করেছেন। সাহাবী ও তাবেঈদের মতামত দ্বারা দলীল স্থাপন করেছেন। মূলতঃ তারা এটা জানতেন যে, তাদের (সাহাবী ও তাবেঈদের) কাছ থেকে যে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করা হয় তা হয়তো, রাসূল (ﷺ) থেকে বর্ণিত হাদীস থেকেই গৃহীত যা তারা সংরক্ষিত করে ‘মাওকূফ’ হাদীসে পরিণত করেছেন। অথবা তারা যে মাসআলাটি ইসিত্মমবাত (উদ্ভাবন) করেছেন তা মানসূস বা শারঈ দলীল থেকেই গৃহীত। আর তারা যে ইজতিহাদটি করেছেন তা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই করেছেন। বাস্তবেই তারা (সাহাবা ও তাবেঈগণ) ছিলেন প্রত্যেক বিষয়ে তাদের পরবর্তী ধারক বাহকদের চেয়ে উত্তম কর্মী, অত্যধিক বিশুদ্ধ মতামত প্রদানকারী, যামানার দিক থেকে সবার অগ্রগামী এবং জ্ঞান সংরক্ষণে অত্যধিক তৎপর। তাদের (সাহাবা ও তাবেঈগণের) মধ্যে যে মতভেদগুলো পরিলক্ষিত হয়েছে সে গুলো ছাড়া তাদেরই রেখে যাওয়া পথ ও পদ্ধতি দ্বারাই দ্বীনের আমল নির্দিষ্ট হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, (কোন পরিস্থিতির কারণে) রাসূল (ﷺ) এর হাদীস তাদের মতের প্রকাশ্য বিরোধী হয়েছে।

গ্রন্থ রচনার এই যুগে তাদেরকে ঐশী অনুপ্রেরণা প্রদান করা হয়েছিল। ফলে ইমাম মালিক ও মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান বিন আবূ জি’ব মদ্বীনায়, ইবনে জুরাইয ও ইবনে উয়াইনা মক্কায়, সাওরী কুফায় এবং রবীঈ বিন সবীহ বসরায় কিতাব রচনা করেন। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) মদ্বীনাবাসীদের মধ্যে হাদীস বর্ণনায় বেশি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন। সনদের দিক থেকে তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী। তৎকালীন সাতজন ফক্বীহর চেয়ে তিনিই হযরত উমারের ফায়সালা, আবদুল্লাহ বিন উমার ও আয়িশা (রা.) এবং তাদের অনুসারীদের মতামতের ব্যাপারে অধিক অবগত। তিনি এবং তার মতো অনেকের মাধ্যমেই রেওয়ায়াত ও ফাৎওয়ার জ্ঞান সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার কাছে যখন কোন বিষয়ের সমাধান চাওয়া হত, তখন তিনি হাদীস বর্ণনা করতেন ও ফাৎওয়া দিতেন, ফলে সকলে উপকৃত হতেন।

ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) দৃঢ়ভাবে ইবরাহীম আন-নাখঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও তার অনুসারীদের মাযহাবকে গ্রহণ করেছিলেন। তার মাযহাব থেকে তিনি কখনও বিচ্ছিন্ন হতেন না (তবে আল্লাহ্‌ চাইলে কিছুটা ব্যতিক্রম হত)। তার মাযহাবকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে তিনি সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন। মাসআলা বের করার ক্ষেত্রে তিনি সূক্ষ্ম নজর রাখতেন। মাসআলার শাখা-প্রশাখা রচনা করতেন। ফিক্বহশাস্ত্র সম্পূর্ণ করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অপরিসীম। এখানে তার (আবূ হানীফার) প্রসিদ্ধ অনুসারী আবূ ইউসূফ (রাহিমাহুল্লাহ) এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এ সময় মুহাম্মাদ বিন হাসান সমসাময়িক বিদ্বানদের মধ্যে গ্রন্থ প্রণয়নে সুদক্ষ পণ্ডিত ছিলেন এবং অধ্যয়নে মনোনিবেশের ক্ষেত্রে অত্যন্তআন্তরিক ছিলেন। তার (মুহাম্মাদ বিন হাসান) ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে, তিনি আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) ও আবূ ইউসূফ (রাহিমাহুল্লাহ) এর নিকট ফিক্বহ শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন। অতঃপর মদ্বীনায় গিয়ে ইমাম মালিক রচিত ‘মুয়াত্তা’ অধ্যয়ন করেন। এর পর নিজ দেশে ফিরে যান। অতঃপর ‘মুয়াত্তা’ এর যেসব মাসআলা তার অনুসারীদের মাযহাবের সাথে মিলে যেত, সেগুলো আলাদা করে এক এক করে সাজাতেন। আর যদি না মিলত তাহলে দেখতেন যে, যদি সাহাবা ও তাবেঈদের একটি দলের মতামত তার মাযহাবের অনুসারীদের সাথে মিলে যাচ্ছে, তাহলে তিনি সেটিকেই প্রাধান্য দিতেন। যদি তিনি কোন দুর্বল কিয়াস অথবা ব্যাখ্যা (তাখরীজ) পেতেন, যা এমন সহীহ হাদীস বিরোধী যে সহীহ হাদীসের উপর ফক্বীহগণ এবং অধিকাংশ বিদ্বান আমল করতেন, তাহলে তিনি তা (দুর্বল কিয়াস অথবা ব্যাখ্যা) ত্যাগ করে সালফে সালেহীনের বিশুদ্ধ অভিমতটিই গ্রহণ করতেন। তারা (মুহাম্মাদ বিন হাসান ও আবূ ইউসূফ) উভয়ে ইমাম আবূ হানীফার (রাহিমাহুল্লাহ) মতো যথাসাধ্য নাখঈ এর দলীলকেই গ্রহণ করতেন। এজন্য মৌলিকতার সামঞ্জস্য থাকায় তাদের এবং ইমাম আবূ হানীফার মাযহাবকে একটিই মাযহাব মনে করা হত, যদিও মূল ও শাখাগত ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে তারা স্বতন্ত্র মুজতাহিদ ছিলেন, যা ইমাম আবূ হানীফার সাথে সাংঘর্ষিক ছিল।

তাদের মাযহাবের প্রকাশকাল এবং ফিক্বহী মূলনীতি ও শাখা প্রণয়নের সূচনা লগ্নে ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এর আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর তিনি তাদের প্রাথমিক কর্মকাণ্ড- এমন কিছু বিষয় লক্ষ করেন, যা তাকে তাদের পথে চলতে বাধা দেয়। যেমন: তিনি তাদেরকে মুরসাল ও মুনকাতি হাদীস গ্রহণ করতে দেখেন, যাতে অনেক ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাদের লক্ষ করেছেন যে, বিতর্কিত বিষয়গুলো সমন্বয় সাধনের উপযুক্ত কোন কায়দা বা নিয়ম-কানুন তাদের কাছে ছিল না। ফলে তাদের ইজতিহাদে অনেক ভুলভ্রান্তি স্থান পেয়েছে। এটা লক্ষ করেই তিনি কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করে গ্রন্থাকারে তা লিপিবদ্ধ করেন। ফিক্বহ শাস্ত্রের মূলনীতির বিষয়ে এটাই সর্বপ্রথম লিখিত গ্রন্থ। ইমাম শাফেঈ তৎকালীন সময়ে আরও যে বিষয়গুলো লক্ষ করেছেন তা হলো, সাহাবাদের মতামতগুলো তার সময়ই একত্রিত হয়েছে এবং এগুলো ব্যাপকতা লাভ করে বিভিন্ন মতানৈক্য ও শাখা-প্রশাখার উদ্ভব ঘটেছে। তিনি দেখলেন যে এর অধিকাংশই এমন সহীহ হাদীস বিরোধী যেগুলো তাদের কাছে পৌঁছে নি। তিনি (শাফেঈ) সালফে সালেহীনদের দেখেছেন যে, এরূপ ক্ষেত্রে তারা হাদীসের দিকেই ফিরে গেছেন। সুতরাং তিনিও তাদের বিতর্কিত অভিমতগুলোকে পরিত্যাগ করেন এবং বলেন: ‘‘তারাও মানুষ আমরাও মানুষ’’।

ফক্বীহদের একটি দলকে তিনি দেখেছেন যে, তারা কিয়াস দ্বারা এমন কিছু রায়কে মিশ্রিত করেছেন, যা শরীয়াত অনুমোদন দেয় নি। ফলে এর একটিকে অন্যটি থেকে তারা পৃথক করেন নি।

মোট কথা, তিনি (ইমাম শাফেঈ) যখন এ সমস্ত কর্মকাণ্ডগুলো লক্ষ করলেন, তখন ফিক্বহ শাস্ত্রের মূল মন্ত্রে মনোনিবেশ করে এর কিছু নীতিমালা ও শাখা-প্রশাখা প্রণয়ন করলেন এবং কিছু গ্রন্থ রচনা করলেন, যাতে মুসলিম উম্মাহ উপকৃত হতে পারে। তার এ কর্মপদ্ধতির উপর ফক্বীহগণ একাত্মতা ঘোষণা করলেন। অতঃপর তারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েন। এ ভাবেই ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এর মাযহাব বিস্তার লাভ করে।

আহলুল হাদীস ও আহলুর রা’য় এর মাঝে মতভেদের কারণ (أسباب الاختلاف بين أهل الحديث وأهل الرأي)

জেনে রাখুন! তাবেঈ ও তার পরবর্তী যুগের একদল আলিম রায়ের মাঝে ডুবে থাকাকে অপছন্দ করতেন এবং একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ফাৎওয়া প্রদান ও মাসআলা উদ্ভাবন করাকে ভয় পেতেন। হাদীস বর্ণনা করাই ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে হাদীস ও আসার গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করার কাজটি প্রসারতা লাভ করে। বিভিন্ন পুসিত্মকা ও পা-ুলিপি লেখালেখির কাজ শুরু হয়। অতঃপর তারা তৎকালীন সময়ের বড় বড় বিদ্বানের সাক্ষাৎ লাভের জন্য হিজাজ, সিরিয়া, ইরাক, মিশর, ইয়ামান ও খোরাসানের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিভ্রমণ করে হাদীসগুলোকে গ্রন্থে একত্র করেন ও বিভিন্ন পা-ুলিপির অনুকরণে গ্রন্থ প্রণয়ন করার প্রয়াস চালিয়ে যান। ফলে তাদের কাছে এতো হাদীস ও আসার একত্র করা সম্ভব হয়েছিল, যা ইতিপূর্বে কখনও সম্ভব হয় নি। প্রত্যেক অঞ্চলের ফক্বীহ সাহাবী ও তাবেঈদের যে আসারসমূহ মুফতীদের কাছে গোপন হয়েছিল এ সময়ে তাদের কাছে তা একত্রিত হয়ে যায়। এর পূর্বে কারও পক্ষে নিজ অঞ্চল ও স্বীয় সঙ্গী-সাথীদের হাদীস সংকলন ছাড়া দূরবর্তী কোন অঞ্চলে গিয়ে হাদীস সংকলন করা সম্ভব হয় নি। এ সময়ে গ্রন্থায়ন, আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে হাদীসের সনদগত অস্পষ্ট বিষয়গুলো স্পষ্ট করা সম্ভব হয়েছে।

অতঃপর বর্ণনা শাস্ত্রের বিধান তৈরি ও হাদীস জানার পর সে সময়ের মুহাক্কিকগণ ফিক্বহের দিকে মনোনিবেশ করেন। এ সময় তাদের কাছে পূর্ববর্তী কোন ব্যক্তির তাক্বলীদের উপর ঐকমত্য পোষণ করা হবে এমন কোন রায়ের অস্তিত্ব ছিল না, যদিও প্রত্যেকটি মাযহাবের নীতিমালা বিরোধী হাদীস ও আসার লক্ষ করা যেত। এ যুগে ও এর পূর্ববর্তী যুগে যে সমস্ত মাসআলা-মাসায়েলের সমালোচনা হয়েছে, তার প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে তারা মারফূ, মুত্তাসিল, মুরসাল অথবা মাওকূফ হাদীসর মধ্যে যে কোন একটি হাদীস পেয়েছেন কিংবা শাইখাইন, সমস্ত খলীফা অথবা বিভিন্ন অঞ্চলের ফক্বীহ ও কাজীদের আসার সমূহের মধ্যে কোন আসার পেয়েছেন। ফলে এভাবেই আল্লাহ্‌ তাদের জন্য সুন্নাতের উপর আমল করা সহজ করে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, হাদীসের রেওয়ায়াতের ব্যাপারে ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী, হাদীসের সত্মর জানার ক্ষেত্রে সুপণ্ডিত ও ফিক্বহ শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হলেন, আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)। এরপর ইসহাক বিন রাহওয়াই (রাহিমাহুল্লাহ)। ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) কে বলেন: ‘‘আপনারা আমাদের চেয়ে সহীহ খবরের ব্যাপারে বেশি অবগত। সুতরাং কোন সহীহ খবর পেলে আমাকে জানাবেন। কুফা, বসরা অথবা সিরিয়ার যে কোন অঞ্চলই হোক না কেন আমি সেখানে গিয়ে তা সংগ্রহ করব’’।

এদের উত্তরসূরী হিসেবে একটি দল মনে করল যে, তাদের পূর্ব অনুসারীগণ যথেষ্ট পরিমাণ হাদীস সংগ্রহ ও সরবরাহ করেছেন এবং এর মূলনীতির উপর ফিক্বহ শাস্ত্র রচনা করেছেন। ফলে তারা অন্য বিষয়ে মনোনিবেশ করলেন। যেমন:


ইয়াযিদ বিন হারুন, ইয়াইয়া আল কাত্তান, আহমাদ ও ইসহাকসহ আরও যে সমস্ত হাদীস বিশারদ যে হাদীসগুলো সহীহ হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন, তা বাছাই করার কাজ।
বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের ফক্বীহ এবং বিদ্বানগণ যে ফিক্বহ শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে মাযহাব রচনা করেছেন, সে সমস্ত হাদীসগুলো একত্রিত করার কাজ।
প্রত্যেক হাদীসের উপযুক্ত বিধান দানের কাজ এবং প্রত্যেক এমন হাদীসের উপযুক্ত বিধান দানের কাজ যে হাদীসগুলো পূর্ব যুগ থেকেই ব্যাখ্যা করা হয় নি, এর মধ্যে শা’য ও ফা’য এর মত বিরল বর্ণনার হাদীসও রয়েছে।

এ সব মহৎ কাজগুলো এ যুগের বিদ্বানগণ সম্পূর্ণ করেন। এক্ষেত্রে যারা বড় অবদান রেখেছেন তারা হলেন, ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, আবদ বিন হুমাইদ, দারেমী, ইবনে মাজাহ, আবূ ই’য়ালা, তিরমিযী, নাসাঈ, দারাকুত্বনী, হাকেম ও বাইহাক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) সহ আরও অনেকেই।

অন্যদিকে এদের বিপরীতে ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ), সুফইয়ান ও তাদের পরবর্তীদের যুগে এমন একটি দলকে দেখা গেছে, যারা মাসআলা-মাসায়েল বর্ণনা করাকে অপছন্দ করতেন না এবং ফাৎওয়া প্রদান করতে ভয় পেতেন না। বরং তারা হাদীস বর্ণনা করতে ও তা রাসূল (ﷺ) এর দিকে সম্বোধন করতে ভয় পেতেন। এমন কি শা’বী বলেন: ‘‘যিনি রাসূল (ﷺ) এর বরাত দিয়ে হাদীস বর্ণনা করবেন, তিনি আমাদের কাছে খুবই প্রিয় ব্যক্তি। তবে কেউ রাসূল (ﷺ) এর বরাত দিয়ে হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে কোন কম-বেশি করলে, তার দায়ভার সে নিজেই বহন করবে’’।

ফলে তাদের প্রয়োজনে হাদীস, ফিক্বহ ও মাসআলা-মাসায়েল লিপিবদ্ধের কাজ শুরু হয়। তার কারণ হল, তাদের কাছে তেমন কোন হাদীস ও আসার ছিল না, যার দ্বারা তারা হাদীস বিশারদদের নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী ফিক্বহী মাসআলা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবে। সে সময় বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্বানদের মতামতের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করার জন্য, মতামতগুলো সংকলন ও সে ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য তাদের অন্তর সুপ্রসন্ন হয় নি। এ ব্যাপারে তারা নিজেদেরকেই দায়ী করেন। তারা তাদের ইমামদেরকে এমন বিশ্বাস করতেন যে, তারা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সুউচ্চ মর্যাদায় সমাসীন। তাদের অন্তর তাদের অনুসারীদের প্রতি ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়েছিল। যেমনটি ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: ‘‘ইবরাহীম নাখঈ সালিমের চাইতে ফিক্বহ শাস্ত্রে বেশি অভিজ্ঞ। যদি সাহাবাদের মর্যাদা বেশি না হত তাহলে আমি বলতাম যে, ইবনে উমার (রাঃ) এর চাইতে আলকামাহ ফিক্বহ শাস্ত্রে বেশি অভিজ্ঞ’’।

তাদের ছিল তীক্ষ্ম মেধা শক্তি, সচেতন যুক্তি-তর্ক ও দ্রুত এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার জ্ঞান, যার মাধ্যমে তারা তাদের অনুসারীদের মতামতের বিবিধ মাসআলার জওয়াব উদ্ভাবন করতে সক্ষম হতেন। ফলে তারা ব্যাখ্যার নিয়মানুসারে ফিক্বহ শাস্ত্র রচনা করেন। এভাবে বিভিন্ন মাযহাবের ব্যাখ্যার কার্যক্রম চালু হয়ে তা ব্যাপকতা লাভ করে। প্রত্যেক মাযহারের মধ্যে যারা প্রসিদ্ধ বিদ্বান ছিলেন, তাদের কাছে বিভিন্ন বিচার-ফায়সালা ও ফাৎওয়ার দায়িত্ব অর্পিত হত। ফলে তাদের গ্রন্থগুলো জনসমাজে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তা ছড়িয়ে পড়ে।


এ সময় মাদরাসাতুল হাদীস ও মাদরাসাতুল ফিক্বহ নামে দু’ধরণের মাদরাসার সূচনা হয়। এ দু‘টিকে (হাদীস ও ফিক্বহ) লক্ষ্য করে আল্লামা খত্ত্বাবী ‘মা‘আলিমুস সুনেই’ গ্রন্থ রচনা করে বলেন:[1]

‘‘আমাদের যামানায় বিদ্বানদের দেখা যায় যে, তারা দু‘টি বিষয় অর্জন করেছে এবং দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে:

১. হাদীস ও আসার এর অনুসারী।

২. ফিক্বহ ও যুক্তির (নাযর) অনুসারী।

তবে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে একটিকে অপরটি থেকে পৃথক করা যায় না এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনে একটি অপরটির মুখাপেক্ষী। কেননা ভিত্তির দিকে লক্ষ্য করে হাদীস হচ্ছে আসল এবং স্থাপনার দিকে লক্ষ্য করে ফিক্বহ হচ্ছে তার শাখা-প্রশাখা। স্থাপনা যদি মূল ভিত্তির উপর না রাখা হয়, তাহলে সেটা অকার্যকর হবে এবং ভিত ছাড়া বিল্ডিং তৈরি করলে সেটি অকেজো ও ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। আমি উভয় দলকে পেয়েছি নিকটতম প্রতিবেশী ও পাশাপাশি দু’টি বাড়ীর মত। প্রত্যেকটি দল একে অপরের ব্যাপক প্রয়োজনে আসে। তাদের উভয়কেই তার সাথীর নিকট জরুরী ভিত্তিতে দরকার হয়। তারা যেন হিজরতকারী ভাইয়ের মতো। কোন প্রকার প্রাধান্য ছাড়াই সঠিক পথে চলার জন্য একে অপরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে যারা হাদীস ও আসারের অনুসারী তাদের অধিকাংশই রেওয়ায়াত বা বর্ণনার অনুরাগী, বিভিন্ন পদ্ধতি একত্রিতকারী, গরীব ও শা’য হাদীস অনুসন্ধানকারী, যার অধিকাংশই জাল অথবা মাকলূব বা পরিবর্তিত। তারা হাদীসের মূল ভাষ্যের দিকে লক্ষ্য করে না, অর্থও বুঝে না এবং এর গোপন ভেদ ও গুঢ় রহস্যও উদ্ভাবন করতে পারে না। বরং ফক্বীহদের সমালোচনা করে, তাদের বাঁকা চোখে দেখে এবং সুন্নাত বিরোধী আখ্যা দেয়। তারা এটা বুঝতে পারে না যে, তারা যে জ্ঞান অর্জন করেছে তা খুব সামান্য এবং এটাও বুঝে না যে, ফক্বীহদের গালি দেয়া পাপের কাজ।

অপরদিকে যারা ফিক্বহ ও নাযর (যুক্তি) এর অনুসারী তাদের অধিকাংশই স্বল্প হাদীস ছাড়া তেমন হাদীস বর্ণনা করে না। তারা সহীহ হাদীসকে যঈফ থেকে পৃথক করে না। উত্তম হাদীসকে নিম্নমানের হাদীস থেকে আলাদা করে না। তাদের কাছে যে হাদীস পৌঁছে তা তাদের দাবীকৃত মাযহাবের অনুকূলে হয়ে গেলে এবং তাদের বিশ্বাসকৃত মাযহাবের মত অনুযায়ী হলে বিতর্কিত বিষয়ে তা দ্বারা দলীল গ্রহণ করতে আপত্তি করে না। কোন যঈফ ও মুনকাতি হাদীস যদি তাদের কাছে প্রসিদ্ধি লাভ করে তাহলে সেই যঈফ ও মুনকাতি হাদীস গ্রহণের জন্য বিভিন্ন পরিভাষা তৈরি করে। এভাবে ক্রমাগতভাবে কোন নির্ভরযোগ্যতা ও নিশ্চিত জ্ঞান ছাড়াই তাদের মাঝে বিভিন্ন মন্তব্য পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে রাবীর বর্ণনা থেকে তাদের পদস্খলন ঘটে এবং তাতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

এদের মধ্যে একটি দল ছিল, (আল্লাহ্‌ তাদের তাওফীক্ব দান করুন) যদি তাদের কাছে তাদের মাযহাবের বিদ্বানগণ ও তাদের দলনেতারা নিজের পক্ষ থেকে ইজতিহাদ করে কোন কথা বর্ণনা করেন, তাহলে সে ক্ষেত্রে তারা নির্ভরযোগ্যতার বিষয়টা তালাশ করেন এবং তারা কোন চুক্তি বা অঙ্গীকার চাইতেন না। ফলে আমি ইমাম মালিকের অনুসারীদের পেয়েছি যে, তারা তাদের মাযহাবের মধ্যে ইবনে কাসিম, আশহাব ও তাদের উভয়ের মত মহৎ ব্যক্তিদের বর্ণনা ছাড়া অন্য কোন বর্ণনাকে নির্ভরযোগ্য মনে করতেন না। যদি আবদুল্লাহ বিন আব্দুল হাকাম ও তার সমপর্যায়ের বর্ণনা তাদের কাছে আসত তাহলে সেটাকে তারা তেমন গুরুত্ব দিতেন না। ইমাম আবূ হানীফা (রাহি.) এর অনুসারীদের দেখবেন যে, তারা স্বীয় অনুসারীদের মধ্যে হতে আবূ ইউসুফ, মুহাম্মাদ বিন হাসান, আলিয়্যাহ এবং তার (আবূ হানীফার) গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রদের বর্ণনা ছাড়া কোন কিছুই গ্রহণ করতেন না। যদি তাদের কাছে হাসান বিন যিয়াদ আল্লু’লু এবং তার মত বর্ণনাকারীদের কোন মতামত আসত, যা ইমাম আবূ হানীফার মতের বিরোধী তাহলে তারা তা গ্রহণও করতেন না এবং বিশ্বাসও করতেন না। অনুরূপভাবে আপনি ইমাম শাফেঈ (রাহি.) এর অনুসারীদের দেখবেন যে, তারা তার মাযহাবের মধ্যে মাযিনী, রাবীঈ বিন সুলাইমান আল মারাদী এর বর্ণনাকে প্রাধান্য দেন। যদি তাদের কাছে খুযায়মাহ, জারমী এবং তাদের মত বিদ্বানের কোন বর্ণনা আসে, তাহলে তার দিকে তারা ভ্রূক্ষেপ করতেন না এবং এটাকে তার (শাফেঈর) মতামত বলে গণ্য করতেন না। এভাবে ধর্মীয় বিধানের ক্ষেত্রে স্ব-স্ব মাযহাবের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ব্যাপারে প্রত্যেকটি মাযহাবের ইমাম ও উস্তাদের গোঁড়ামীর অভ্যাস ছিল। তাদের অবস্থা যদি এ রূপই হয় যে তারা শাখাগত মাসআলা ও বর্ণনার ক্ষেত্রে তাদের নির্ভরযোগ্য ও সুপ্রতিষ্ঠিত শাইখদের ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে বর্ণনা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট না হন, তাহলে কিভাবে তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মহৎ কাজ সম্পূর্ণ করা সহজ হবে? আর কিভাবে তারা সকল ইমামের ইমাম ও মহান প্রভুর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) এর রেওয়ায়াত ও বর্ণনার প্রতি ভরসা রাখবে? অথচ রাসূল (ﷺ) এর হুকুম পালন করা ওয়াজিব ও তাঁর আনুগত্য করা আবশ্যক, তাঁর হুকুমের নিকট আত্মসমর্পণ করা ও তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা আমাদের উপর অপরিহার্য। এমনকি তিনি যে ফায়সালা দিয়েছেন সে ব্যাপারে আমাদের অন্তরে কোন দ্বিধা রাখা যাবে না এবং তাঁর সমাধান ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অন্তরে কোন প্রকার বিদ্বেষ রাখা যাবে না। ভেবে দেখেছেন কি যে, কোন ব্যক্তি যখন নিজের ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শন করে এবং তার নিজের অধিকারের ব্যাপারে প্রতিপক্ষের প্রতি উদার হয়ে তাদের কাছ থেকে অবৈধ টাকা বা সম্পদ গ্রহণ করে এবং এর প্রতিদানে তাদের দোষত্রুটি ঢেকে রাখে। সুতরাং অন্যের পক্ষে যখন সে প্রতিনিধিত্ব করবে তখন কি তার অধিকারের ক্ষেত্রে এরূপ করা বৈধ হবে? যেমন দুর্বলের প্রতিনিধিত্ব করা, ইয়াতিমের অভিভাবক হওয়া এবং অনুপস্থিত ব্যক্তির উকিল হওয়া! এরূপ করলে সে ওয়াদার খিয়ানতকারী ও দায়িত্বের প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতাকারী ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে বিবেচিত হবে কি? এই দৃষ্টান্তটি বাসত্মবে হতে পারে কিংবা নিছক উদাহরণ হতে পারে।


কিন্তু কিছু সংখ্যক দল রয়েছে যারা সত্যের পথকে কঠিন মনে করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা সহনশীলতা দেখানোকে ভাল মনে করেছে। এরা দ্রুত প্রাপ্তিকে পছন্দ করেছে। ফলে তারা জ্ঞানের পথকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছে। সামান্য জ্ঞানের উপর তারা সীমাবদ্ধ থেকেছে এবং উসূলে ফিক্বহ এর পরিভাষাগত সামান্য কিছু শব্দের উপর অনড় থেকেছে যেগুলোকে তারা ‘ইলাল’ বা কারণ হিসেবে নামকরণ করে থাকে। এ গুলোকেই তারা জ্ঞানের ক্ষেত্রে ও অনুসরণের ক্ষেত্রে নিজেদের জন্য মডেল বানিয়ে নিয়েছে। এটাকে তারা নিজেদের বিবাদের সময় ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। এটাকে অনর্থক কথা ও ঝগড়া-ঝাটির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। এর দ্বারা তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এবং এর উপর ভিত্তি করে একে অপরের সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়। এ বিবাদের সমাধানের জন্য যখন তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তখন তাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তি দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে সমাধান দিয়ে থাকেন। ফলে তিনি ঐ যুগের একজন উল্লেখযোগ্য ফক্বীহ হিসেবে অভিহিত হন। তার দেশে ও শহরে তিনি সম্মানিত একজন নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।


এ দলটিকে শয়তান সুক্ষ্ম কৌশলে কুমন্ত্রণা দিয়েছে এবং নিপুণ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাদের মাঝে ঢুকে পড়েছে। শয়তান তাদের বলে, তোমাদের কাছে যা আছে তা তো সংক্ষিপ্ত জ্ঞান, এটা নগণ্য পণ্যের মতো, এর দ্বারা প্রয়োজন ও পরিপূর্ণতায় পৌঁছা যায় না। সুতরাং এক্ষেত্রে বিভিন্ন কথার সাহায্য নাও, এর সাথে বিচ্ছিন্ন কথা মিলিয়ে দাও এবং বিদ্বানদের নীতিমালার সহযোগিতা নাও; যাতে কোন ব্যক্তির মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি বৃদ্ধি পায়। এভাবেই ইবলিস তাদের প্রতি তার ধারণাকে সত্য বলে প্রমাণিত করেছে এবং তাদের অনেকেই তার আনুগত্য ও অনুসরণ করেছে। তবে মু’মিনদের একটি দল ইবলিসের অনুসরণ করে নি। সুতরাং বিবেকবান ব্যক্তিবর্গের জন্য পরিতাপ! শয়তান তাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের লক্ষ্যস্থল ও সঠিক পথ থেকে ধোঁকা দিয়ে কোন দিকে পথ দেখাচ্ছে? আল্লাহ্‌ আমাদের সাহায্য করুন। ইমাম খত্ত্বাবীর (রাহিমাহুল্লাহ) উক্তি এখানে শেষ হল।

[1] আল্লামা খত্ত্বাবী প্রণীত‘মা‘আলিমুস সুনান’ (১/৭৫-৭৬) ।

জেনে রাখুন! ১ম ও ২য় শতাব্দীতে মানুষ কোন মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ করতেন না। এ ব্যাপারে আবূ তালিব আল মক্কী ‘কূতুল কুলূব’ গ্রন্থে বলেন ‘‘গ্রন্থাবলী ও দলসমূহ নব আবিষ্কৃত। বিভিন্ন বক্তব্য, একই মাযহাবের মাধ্যমে ফাৎওয়া দেয়া, সে মাযহাবের অভিমতকেই গ্রহণ করা, সকল ক্ষেত্রে সে মাযহাবেরই উদ্ধৃতি দেয়া এবং সে মাযহাবের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করার আগ্রহ ১ম ও ২য় শতাব্দীর মানুষের মাঝে ছিল না’’।

ইবনে হুমাম ‘তাহরীর’ গ্রন্থে বলেন: ‘‘তারা একবার এক জনের কাছে ফাৎওয়া চাইতেন, আবার অন্য জনের কাছেও চাইতেন। তারা কোন একজনের ফাৎওয়ার উপর অটল থাকা আবশ্যক মনে করতেন না’’।

সে সময়ের বিদ্বানগণ ২টি স্তরে বিভক্ত ছিলেন। একদল কিতাব, সুন্নাহ ও আসার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আগ্রহী ছিলেন। এমন কি তারা অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে মানুষের ফাৎওয়ার ও তাদের প্রশ্নের সমাধান দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতেন। ফলে তাদের অধিকাংশ উত্তর কুরআন, সুন্নাহ ও আসারের উপর নির্ভরশীল ছিল। এ শ্রেণীর বিদ্বানকে ‘‘মুজতাহিদ’’ (গবেষক) নামে অভিহিত করা হত।

অপর একদল বিদ্বান কুরআন ও সুন্নাহ এর এতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছিলেন যা দ্বারা বিস্তারিত দলীলের মাধ্যমে ফিক্বহের মূলমন্ত্র ও মৌলিক মাসআলাগুলোর জ্ঞানার্জন সম্ভব হয়েছিল। কিছু মাসআলার ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ হতে দলীল গ্রহণের মাধ্যমে তাদের কাছে প্রবল মতামত অর্জিত হয়েছে। আর কিছু মাসআলার ক্ষেত্রে তারা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন এবং এর জন্য তারা বিদ্বানদের পরামর্শের মুখাপেক্ষী হয়েছেন। কেননা সাধারণ মুজতাহিদের কাছে পরিপূর্ণ ভাবে ফাৎওয়া প্রদানের যে উপকরণ থাকে তাদের কাছে সে সকল উপকরণ ছিল না। সুতরাং এ শ্রেণীর বিদ্বানগণ কোন ক্ষেত্রে মুজতাহিদ এবং কোন ক্ষেত্রে মুজতাহিদ নন। অথচ সাহাবা ও তাবেঈদের যুগ থেকে এই ধারাবাহিকতা চলে আসছে যে, তাদের কাছে যখন হাদীস পৌঁছতো তখন তারা কোন শর্ত আরোপ করা ছাড়াই তার উপর আমল করতেন।


২য় শতাব্দীর পর মুজতাহিদদের মাযহাবের প্রকাশ

২য় শতাব্দীর পর মুজতাহিদদের স্ব-স্ব মাযহাবের আবির্ভাব ঘটে। এরূপ মানুষ খুব কমই ছিলেন যারা স্ব-স্ব মুজতাহিদদের মাযহাবের উপর নির্ভর করতেন না। এ সময়ে যে সকল মুজতাহিদ ফিক্বহ বিষয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন, তারা নিন্মোক্ত দু‘টি অবস্থা থেকে মুক্ত ছিলেন না:

১। তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর মুজতাহিদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল পূর্বের মুজতাহিদগণ যে মাসআলাগুলোর উত্তর দিয়েছেন সেগুলো বিস্তারিত দলীলসহ, সমালোচনাসহ ও সংশোধনসহ বুঝার চেষ্টা করা এবং একটিকে আরেকটির উপর প্রধান্য দেয়া। এ শ্রেণীর মুজতাহিদদের জন্য আবশ্যক ছিল পূর্বের ইমামের ফাৎওয়াটিকে সুন্দর করা এবং এতে কিছু সংযোজন করা। যদি তার সংযোজনটা তার অনুসৃত মাযহাবের ইমামের মতামত অনুযায়ী হওয়ার ক্ষেত্রে কম হত, তাহলে তাকে একই মাযহাবের ভিন্ন ধারার চিন্তাবিদ হিসেবে গণ্য করা হত। আর যদি সংযোজনটা বেশি হত, তাহলেও তাকে মাযহাবের দিক থেকে আলাদা ভাবা হত না। এতদসত্ত্বেও তাকে মাযহাবের একজন অনুসারী হিসেবেই সম্বোধন করা হত এবং তাকে ঐ ব্যক্তি হতেও আলাদা ধরা হত, যে ব্যক্তি স্বীয় মাযহাবের মৌলিক বিষয়ে ও শাখা বিষয়ের অনেক ক্ষেত্রে অন্য ইমামের প্রতি সহানুভূতিশীল। এ সময়ে এমন কিছু গবেষণা পাওয়া গেছে, যে বিষয়ে পূর্বে কোন সমাধান দেয়া হয় নি। যেহেতু ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটতেই থাকে। আর (ইজতিহাদের) দরজাও তো উন্মুক্ত রয়েছে। ফলে তারা স্বীয় ইমামের উপর ভরসা না করে কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের আসারের মাধ্যমে এর সমাধান গ্রহণ করেছেন। তবে পূর্বের সমাধানের চেয়ে এটা খুব কমই হত। একে সেই মাযহাবের দিকে সম্বন্ধিত একজন সাধারণ মুজতাহিদ হিসেবে ধরা হত।

২। অপর শ্রেণীর মুজতাহিদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল সমসাময়িক যুগে উদ্ভাবিত এমন ফাৎওয়ার মাসআলা সম্পর্কে জানা, যে ব্যাপারে পূর্ববর্তীগণ কোন আলোচনা করেন নি। এ ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় অনুসৃত মাযহাবের ইমামের তৈরিকৃত সকল মূলনীতির উপর সহানুভূতিশীল হয়ে ফাৎওয়া দিতেন। এ নীতি পূর্বোলেস্নখিত প্রথম শ্রেণীর নীতির চেয়ে মারাত্মক। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন: ফিক্বহ এর মাসআলাগুলো একটি অপরটির সাথে জড়িত বা সম্পর্কিত। এর শাখাগুলো তার মূল নীতিমালার সাথে সম্পৃক্ত। যদি তিনি তাদের মাযহাবের সমালোচনা ও সংশোধন শুরু করেন, তাহলে তিনি এমন কাজকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নিবেন যা তিনি করতে সক্ষম নন। তিনি সারা জীবনেও তা সমাধান করে শেষ করতে পারবেন না। সুতরাং পূর্বের নীতির দিকে দৃষ্টি দেয়া ছাড়া ও শাখা-প্রশাখাগুলোকে পূর্বের নীতির সাথে জড়িত করা ছাড়া তার কোন পথ নেই। এ সময় কুরআন, সুন্নাহ, সালাফদের আসার ও কিয়াস দ্বারা ইমামের মতের উপর এরূপ কিছুটা সংযোজন করার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তবে তা প্রয়োজন অনুযায়ী খুবই কম। আর এ ধরনের মুজতাহিদকে সে মাযহাবের একজন মুজতাহিদ হিসেবে ধরা হয়।


৪র্থ শতাব্দীর পর মানুষের মাঝে যা ঘটেছিল

অতঃপর এ শতাব্দী পর অপর একদল মানুষ ছিল, যাদের কেউ ডান পন্থি, কেউ আবার বামপন্থি। তাদের মাঝে যা ঘটেছিল তার বর্ণনা নিমণরূপ:

ইলমে ফিক্বহ ও তার ব্যাখ্যার ব্যাপারে মানুষের মাঝে মতভেদ ও ঝগড়া-বিবাদ লক্ষ করা যেত। ইমাম গাযালী এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেন:

খোলাফায়ে রাশেদার যুগের সমাপ্তির পর অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ গোষ্ঠী খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তারা ফাৎওয়ার জ্ঞান ও বিধানের ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। যার ফলে তারা ফক্বীহদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়েছিল এবং সর্বাবস্থায় তাদের (ফুক্বাহাদের) সঙ্গী হওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। তবে কিছু সংখ্যক আলিম পূর্বের নীতিতে অনড় ছিলেন এবং দ্বীনের হক্ব দলকে শক্তভাবে ধরে রেখেছিলেন। যখন তাদের ডাকা হত তখন তারা পলায়ন করতেন ও এড়িয়ে যেতেন। সে যুগের লোকেরা আলিমদের সম্মান লক্ষ্য করল এবং আলিমদের উপেক্ষা সত্ত্বেও তাদের প্রতি সমসাময়িক নেতৃবর্গের আগ্রহ প্রত্যক্ষ করল। ফলে এ যুগের মানুষেরা সম্মান ও প্রতিপত্তি অর্জনের আশায় জ্ঞান অন্বেষণের পথ বেছে নিল।

তাদের স্বপক্ষে মানুষ যুক্তিবিদ্যা, যুক্তিতর্ক, সাওয়াল জওয়াব ও বিবাদের পথ উন্মুক্ত হয় এমন কিছু রচনা করল। এভাবে অনেক ঘটনার সূত্রপাত হয়।

অপরদিকে একদল তাক্বলীদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকত। তাদের মাঝে এ বিশ্বাস পিপীলিকার ন্যায় চলাচল করতে লাগল অথচ তারা তা নিজেরা বুঝতে পারত না। এর কারণ হল, ফক্বীহগণ প্রতিযোগিতা করতেন ও তাদের মাঝে বিবাদ লেগে থাকত। কেউ কোন ফাৎওয়া প্রদান করলে তার ফাৎওয়া প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা জবাব দেয়া হত। পূর্বের আলিমগণ কর্তৃক সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না আসা পর্যন্ত বিতর্ক বন্ধ হত না। অনেক সমস্যা কাজীদের নিকট আসত আর তারা এর সমাধান দেয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তারা আমানতদার না হওয়ার কারণে তাদের ফায়সালা গৃহীত হত না। তবে জনসাধারণের এ ব্যাপারে সন্দেহ না হলে এবং ইতিপূর্বে বলা হয়েছে এমন হলে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।

আর কখনও কখনও তারা তাক্বলীদ প্রত্যাখ্যান করে কিতাব ও সুন্নাহর উপর আমলের দাবীর মুখে তাদের ইমামদের কথাকে সংক্ষিপ্ত করেছেন এবং মতানৈক্যগুলোর ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের পছন্দনীয় ইমামদের নির্বাচন করেছেন। ফলে তাদের পর নির্ভেজাল তাক্বলীদের যুগের আবির্ভাব ঘটেছে। যার ফলে তারা হক্ব থেকে বাতিলকে পার্থক্য করতে পারেন না এবং উদ্ভাবনী ফাৎওয়া থেকে বিবাদকে আলাদা করতে পারেন না। এভাবে তাদের মাঝে মাযহাবের গোঁড়ামীর আবির্ভাব ঘটে। এ থেকে বিভক্তির সূচনা হয় এবং তারা একে অপরকে বিভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করেন। এমনকি কেউ যদি স্বীয় মাযহাবের একটি মাসআলার ক্ষেত্রেও বিপরীত মত অবলম্বন করেন তাহলে তাকে মিলস্নাত বহির্ভূত বলে আখ্যায়িত করা হতো। মাযহাবের ইমাম যেন আল্লাহ্‌র প্রেরিত নাবী। তার আনুগত্য করা যেন ফরয হয়ে পড়েছে। এর পর এমন লোকের আবির্ভাব ঘটল যিনি ফাৎওয়া দিতেন যে, হানাফী অনুসারীগণের ইমাম শাফেঈর অনুসারী হওয়া না জায়েয এবং শাফেঈদের সাথে হানাফীদের বিবাহ দেয়া না জায়েয। তবে অন্যান্য লোকজন ‘‘আহলে কিতাবকে বিবাহ করা জায়েয’’ এর উপর ভিত্তি করে শাফেঈদের সাথে হানাফীদের বিবাহ জায়েয মনে করতেন।

এ বিদ‘আতের আবির্ভাবের ফলে মাসজিদে হারামে চার জায়গায় চার ইমামের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান সৃষ্টি হয়[1] এবং বিভিন্ন দল ও উপদলের সূচনা হতে থাকে। প্রত্যেকেই স্বীয় মাযহাবের লোকজনকে সহযোগিতা করত। এরূপ বিদ‘আতের আবির্ভাবের ফলে সুযোগ বুঝে ইবলিস তার স্থান দখল করে বসে। সাবধান! এতে মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি ও অনৈক্য দেখা দেয়। আল্লাহ্‌ আমাদের এ থেকে রক্ষা করুন!

এর পর আরও অধিক ফেতনা-ফাসাদের যুগ আসল এবং তাক্বলীদে (দলীলবিহীন অনুসরণ) ভরপুর হয়ে গেল। মানুষের অন্তর হতে সুকৌশলে আমানত ছিনিয়ে নেয়া হলো। এমনকি তারা দ্বীনের ব্যাপারে নিরর্থক কথা বলা পরিত্যাগ করে এ কথা বলে তুষ্ট হল যে:

﴿إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ﴾

নিশ্চয় আমরা তো আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে এক মতাদর্শের উপর পেয়েছি তাই আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি (সূরা যুখরুফ-২৩)। তারা আরও বলল যে, আল্লাহ্‌র কাছে আমরা অভিযোগ সোপর্দ করলাম, তিনিই সাহায্যকারী। তার প্রতি আমাদের আস্থা ও নির্ভরতা।

এতদসত্ত্বেও আল্লাহ্‌র বান্দার মধ্য হতে একটি হক্বপন্থি দল থেকেই গেছে, যাদেরকে কেউ অপমানিত করলেও তাদের কোন ক্ষতি হয় না। তারাই আল্লাহ্‌র জমীনে তাঁর একনিষ্ঠ সৈনিক। যদিও তারা সংখ্যায় কম। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে কামনা করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করেন।

ফিক্বহী মাযহাব সৃষ্টি এবং মতভেদের এই আলোচনা উপস্থাপনের পর আমি কিছু সতর্কবাণী পাঠক মহলে উপস্থাপন করতে চাই। যাতে আল্লাহ্‌র বান্দার মধ্যে তিনি যাকে ইচ্ছা এর দ্বারা উপকার দেন।

[1] এটা আল-মা‘সূমী ‘হাদিইয়্যাতুস সুলতান’ গ্রন্থে (পৃ:৪৮) উলেস্নখ করেছেন।
প্রথম সতর্কবাণী: কুরআন ও সুন্নাহর উপর আমল করা ওয়াজিব

প্রথম সতর্কবাণী: কুরআন ও সুন্নাহর উপর আমল করা ওয়াজিব[1]

জেনে রাখা আবশ্যক যে, কুরআন ও সুন্নায় বহু দলীল রয়েছে। সুতরাং সকল দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির উচিৎ একতাবদ্ধ হয়ে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল (ﷺ) এর উপর আমল করা।

আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন:

﴿اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ﴾

তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ হতে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর (সূরা : আল আ‘রাফ-৩) ।

‘‘আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর যা অবতীর্ণ করেছেন’’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ‘কুরআন’ এবং এর ব্যাখ্যাকারী গ্রন্থ ‘হাদীস’। কোন মানুষের মতামত নয়। আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا﴾

আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা আস যা আল্লাহ্‌ নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে, তখন মুনাফিকদেরকে দেখবে তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যাচ্ছে (সূরা : আন-নিসা-৬১) ।

এ আয়াত এ কথাই প্রমাণ করছে যে, যখন তাকে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার আহবান জানানো হয় তখন তা থেকে যে বিমুখ হয় তার চরিত্র সম্পূর্ণ মুনাফিকের মত। কেননা উপদেশ দেয়া হয় আম শব্দের মাধ্যমে, বিশেষ কারণের দ্বারা নয়। আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ﴾

অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ্‌ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর- যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ (সূরা : আন-নিসা-৫৯)।


আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এর দিকে প্রত্যাবর্তন করার অর্থ হল, তাঁর কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। আর রাসূল (ﷺ) এর মৃত্যুর পর তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করার অর্থ হল তাঁর সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করা।

আর এ বিষয়টিকে ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত করে বলা হচ্ছে যে,

إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ

অর্থাৎ, যদি তোমরা আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান রাখ। তথা দ্বন্দ্ব নিরসনকে কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নাতে রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করাই হল প্রকৃত ঈমানের পরিচয়। সুতরাং এ থেকে বুঝা যায় যে, যদি কেউ দ্বন্দ্ব নিরসনে কিতাব ও সুন্নাহ ছাড়া অন্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করে তাহলে সে ঈমানদার নয়।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَاتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ﴾

তোমাদের উপর অতর্কিতভাবে আযাব আসার পূর্বেই তোমাদের কাছে রবের পক্ষ থেকে যে উত্তম ওহী নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ কর (সূরা যুমার-৫৫)।

নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কুরআন হল সর্বোত্তম কিতাব যা আমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর সুন্নাত হল, কুরআনের ব্যাখ্যাকারী। আমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে যে উত্তম কিতাব আমাদের উপর নাযিল করা হয়েছে, যারা তার অনুসরণ করবে না তাদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারী দিয়ে আল্লাহ্‌ বলেছেন:

﴿مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ﴾

তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর অতর্কিতভাবে আযাব আসার পূর্বেই (সূরা যুমার-৫৫)। আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ ﴾

যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে অতঃপর এর যা উত্তম তা অনুসরণ করে তাদেরকেই আল্লাহ্‌ হিদায়াত দান করেন আর তারাই বুদ্ধিমান (সূরা যুমার-১৮)।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কোন ব্যক্তির মতামতের চেয়ে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল (ﷺ) অতি উত্তম। আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ﴾

রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে তিনি তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহ্‌কেই ভয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ শাস্তি প্রদানে কঠোর (সূরা হাশর-৭) ।

আল্লাহ্‌র বাণী:

‘‘ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ’’

এর মাধ্যমে যারা সুন্নাতে রাসূলের প্রতি আমল করবে না তাদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে যারা মনে করবে যে, অনুসরণের জন্য কোন ব্যক্তির মতামতই যথেষ্ট।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا﴾

অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ্‌ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহ্‌কে অধিক স্মরণ করে (সূরা : আল-আহযাব-২১)।

এখানে ‘أُسْوَةٌ’ অর্থ أقتداء তথা অনুসরণ করা। সুতরাং মুসলমানের উচিৎ রাসূল (ﷺ) এর আদর্শে জীবন গঠন করা। আর এটাই হবে তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾

তোমার প্রতিপালকের শপথ তারা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদ নিরসনে তোমাকে বিচারক মানবে, অতঃপর তোমার মীমাংসায় নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা অনুভব করবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে মেনে নিবে (সূরা নিসা-৬৫)।

আল্লাহ্‌ তায়ালা অত্র আয়াতে কসম করে বলছেন যে, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের বিতর্কিত বিষয়ের ফায়সালা রাসূল (ﷺ) এর মাধ্যমে গ্রহণ করবে।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

অতঃপর তারা যদি তোমার আহবানে সাড়া না দেয়, তাহলে জেনে রাখ, তারা তো নিজেদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করে। আর আল্লাহ্‌র দিকনির্দেশনা ছাড়া যে নিজের খেয়াল খুশির অনুসরণ করে তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ্‌ যালিম কওমকে হিদায়াত করেন না (সূরা : কাসাস-৫০)।


রাসূল (ﷺ) এর মৃত্যুর পর তার অনুসরণ করা বলতে তাঁর সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করাকে বুঝায়। এ সুন্নাতই হল কিতাবুলস্নাহর ব্যাখ্যাকারী। মহাগ্রন্থ কুরআনে এসেছে যে, নিশ্চয়ই রাসূল (ﷺ) ওহী ছাড়া কোন কিছুর অনুসরণ করতেন না। আর যে রাসূল (ﷺ) এর আনুগত্য করল সে যেন স্বয়ং আল্লাহ্‌রই আনুগত্য করল।

মহান আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ﴾

বল, আমার নিজের পক্ষ থেকে এতে কোন পরিবর্তনের অধিকার নেই। আমিতো শুধু আমার প্রতি অবতীর্ণ ওহীর অনুসরণ করি। নিশ্চয় আমি যদি রবের অবাধ্য হই তবে ভয় করি কঠিন দিবসের আযাবের (ইউনুস-১৫)।

তিনি আরও বলেন:

﴿قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ لَكُمْ إِنِّي مَلَكٌ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ﴾

বল, ‘তোমাদেরকে আমি বলি না, আমার নিকট আল্লাহ্‌র ভা-ারসমূহ রয়েছে এবং আমি গায়েব জানি এবং তোমাদেরকে বলি না, নিশ্চয় আমি ফেরেশতা। আমি কেবল তারই অনুসরণ করি যা আমার নিকট ওহী প্রেরণ করা হয়’ (সূরা : আনআম-৫০)।

তিনি সূরা আহকাফ এর মধ্যে বলেন:

﴿قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ وَمَا أَدْرِي مَا يُفْعَلُ بِي وَلَا بِكُمْ إِنْ أَتَّبِعُ إِلَّا مَا يُوحَى إِلَيَّ وَمَا أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ مُبِينٌ﴾

বল, ‘আমি রাসূলদের মধ্যে নতুন নই। আর আমি জানি না আমার ও তোমাদের ব্যাপারে কী করা হবে। আমার প্রতি যা ওহী করা হয়, আমি কেবল তারই অনুসরণ করি। আর আমি একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র (সূরা আহকাফ-৯)।

আল্লাহ্‌ সূরা আম্বিয়ার মধ্যে বলেন:

﴿قُلْ إِنَّمَا أُنْذِرُكُمْ بِالْوَحْيِ وَلَا يَسْمَعُ الصُّمُّ الدُّعَاءَ إِذَا مَا يُنْذَرُونَ﴾

বল, ‘আমি তো কেবল ওহী দ্বারাই তোমাদেরকে সতর্ক করি’। কিন্তু যারা বধির তাদেরকে যখন সতর্ক করা হয়, তখন তারা সে আহবান শুনে না (সূরা আম্বিয়া-৪৫)।


সুতরাং ভীতি প্রদর্শন শুধু ওহীর মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ, অন্য কিছুর মাধ্যমে নয়।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿قُلْ إِنْ ضَلَلْتُ فَإِنَّمَا أَضِلُّ عَلَى نَفْسِي وَإِنِ اهْتَدَيْتُ فَبِمَا يُوحِي إِلَيَّ رَبِّي إِنَّهُ سَمِيعٌ قَرِيبٌ﴾

বল, ‘যদি আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাই তবে আমার অকল্যাণেই আমি পথভ্রষ্ট হব। আর যদি আমি হিদায়াত প্রাপ্ত হই তবে তা এজন্য যে, আমার রব আমার প্রতি ওহী প্রেরণ করেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও অতি নিকটবর্তী (সূরা : সাবা-৫০)।


সুতরাং বুঝা গেল যে, ওহীর পথই হল হিদায়াতের পথ। এরূপ আরও অনেক আয়াত রয়েছে। যখন উপরের আলোচনা থেকে বুঝা গেল যে, রাসূল (ﷺ) এর পথ হল, ওহীর অনুসরণ করা। সুতরাং জানা আবশ্যক যে, কুরআন রাসূল (ﷺ) এর আনুগত্য করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। আর রাসূল (ﷺ) এর আনুগত্য করা মানে আল্লাহ্‌র আনুগত্য করা।

যেমন আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ﴾

যে রাসূল (ﷺ) এর আনুগত্য করল সে আল্লাহ্‌রই আনুগত্য করল (নিসা-৮০)।

আল্লাহ্‌ আরও বলেন:

﴿قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ﴾

বল, যদি তোমরা আল্লাহ্‌কে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে ভালবাসবেন (সূরা আলে ইমরান-৩১)।

আল্লাহ্‌ কারও যিম্মাদারী নেন নি যে, দুনিয়াতে সে পথ ভ্রষ্ট হবে না এবং আখিরাতে হতভাগা হবে না। বরং যিম্মাদারী নিয়েছেন শুধু ওহীর অনুসারীদের।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَى﴾

অতঃপর যখন তোমাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে হিদায়াত আসবে, তখন যে আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না এবং দুর্ভাগাও হবে না (সূরা ত্বহা-১২৩)।

সূরা ত্বহা এর অত্র আয়াতটি প্রমাণ করে যে, ওহীর অনুসারী কখনও পথভ্রষ্ট হবে না এবং হতভাগা হবে না। সূরা বাক্বারার আয়াত প্রমাণ করছে যে, ওহীর অনুসারীদের কোন ভয় নেই এবং চিন্তাও নেই।

যেমন আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ﴾

অতঃপর যখন আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে কোন হিদায়াত আসবে, তখন যারা আমার হিদায়াত অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না (সূরা বাক্বারা-৩৮)।


নিঃসন্দেহে ওহীর অনুসারীগণ পথভ্রষ্ট ও হতভাগা নয় এবং তাদের কোন ভয় ও চিন্তা নেই। কুরআনের বাণী দ্বারা এটা স্পষ্ট বুঝা যায়। কোন আলিমের অন্ধ অনুসরণের মাধ্যমে এটা অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ সে আলিম নিষ্পাপ নন। সে জানে না, সে যার তাক্বলীদ করছে সে সঠিক কথা বলছে না ভুল কথা বলছে। এটা ঐ আলিমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে, কুরআন ও সুন্নাহ অনুধাবন করা থেকে বিমুখ থাকে। বিশেষ করে যে কুরআন ও হাদীসকে এড়িয়ে গিয়ে তাক্বলীদকৃত আলিমের মতামতকে যথেষ্ট মনে করবে।

কুরআনের বহু সংখ্যক আয়াত প্রমাণ করছে যে, ওহীর অনুসরণ ও তার প্রতি আমল করা আবশ্যক। অনুরূপ ভাবে বহু সংখ্যক হাদীস দ্বারাও কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নাতে রাসূল (ﷺ) এর উপর আমল করা আবশ্যক বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। কেননা রাসূলের আনুগত্য করা আল্লাহ্‌র আনুগত্যের নামান্তর।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ﴾

রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে তিনি তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহ্‌কেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ্‌ শাস্তি প্রদানে কঠোর (সূরা হাশর-৭) ।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾

আর তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্‌ ও রাসূলের, যাতে তোমাদের উপর দয়া করা হয় (সূরা আল ইমরান-১৩২)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ﴾

বল, তোমরা আল্লাহ্‌ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর। তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্‌ কাফিরদেরকে ভালবাসেন না (সূরা আল ইমরান-৩২)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ﴾

আর যারা আল্লাহ্‌ ও রাসূলের আনুগত্য করে তারা তাদের সাথে থাকবে, আল্লাহ্‌ যাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন (সূরা : আন-নিসা-৬৯)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا﴾

আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই এক মহা সাফল্য অর্জন করল (সূরা : আহযাব-৭১)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا﴾

যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহ্‌রই আনুগত্য করল। আর যে বিমুখ হল, তবে আমি তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করি নি (সূরা : আন-নিসা-৮০)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ﴾

হে মু’মিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্‌র ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ্‌ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর- যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ (সূরা : আন-নিসা-৫৯)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ۞ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ ﴾

এগুলো আল্লাহ্‌র সীমারেখা। আর যে আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে আল্লাহ্‌ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর এটা মহা সফলতা । আর যে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ্‌ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক আযাব (আন-নিসা-১৩,১৪)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَاحْذَرُوا فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّمَا عَلَى رَسُولِنَا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ﴾

আর তোমরা আল্লাহ্‌র আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর রাসূলের এবং সাবধান হও। তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রাখ যে, আমার রাসূলের দায়িত্ব শুধু সুস্পষ্ট প্রচার করা (মায়েদা-৯২)। আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾

আর আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, যদি তোমরা মু’মিন হও (সূরা : আনফাল-১)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيعُوهُ تَهْتَدُوا وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ﴾

বল, ‘তোমরা আল্লাহ্‌র আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর।’ তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি শুধু তার উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরাই দায়ী। আর যদি তোমরা তার আনুগত্য কর, তবে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর রাসূলের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া (সূরা : নূর-৫৪)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾

আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হতে পার (সূরা : নূর-৫৬)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَلَا تُبْطِلُوا أَعْمَالَكُمْ﴾

হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্‌র আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। আর তোমরা তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করো না (সূরা মুহাম্মাদ-৩৩)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ۞ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَخْشَ اللَّهَ وَيَتَّقْهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ﴾

মু’মিনদের কথা এই যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এ মর্মে আহবান করা হয় যে, তিনি তাদের মাঝে বিচার মীমাংসা করবেন, তখন তারা বলে: ‘আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম।’ আর তারাই সফলকাম। আর যে কেউ আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহ্‌কে ভয় করে এবং তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তারাই কৃতকার্য (সূরা : নূর-৫১-৫২)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرًا﴾

অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ্‌ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহ্‌কে অধিক স্মরণ করে (সূরা : আল-আহযাব-২১)।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ﴾

আর মু’মিন পুরুষ এবং মু’মিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়িম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ্‌ শীঘ্রই দয়া করবেন (সূরা : তাওবা-৭১)।

নিঃসনেদহে বিদ্বানদের মতে, উল্লেখিত আয়াতসমূহ দ্বারা এবং ওহী সংক্রান্ত অনুরূপ আরও আয়াত দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এর প্রতি আনুগত্য করা কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নাতে রাসূল (ﷺ) এর প্রতি আমল করার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহর দলীলসমূহ প্রমাণ করছে যে, ওহীর ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা, তা নিয়ে গবেষণা, সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জন ও তার প্রতি আমল করা আবশ্যক।

অতএব এ সমস্ত দলীল দ্বারা ওহীর ব্যাপারে চিন্তা করা, গবেষণা করা ও তার উপর আমল করার দাবীকে খাস করা বিশুদ্ধ হবে না নির্দিষ্ট মুজতাহিদগণ ছাড়া। যারা ইজতিহাদের এমন শর্তসমূহ একত্রিত করেছেন, যা পরবর্তী উসূলবীদগণের নিকট সুপরিচিতি, যেটি এমন দলীলের মুখাপেক্ষী যার দিকে প্রত্যাবর্তন করা আবশ্যক। অবশ্য এ নীতিমালাটির ব্যাপারে কোন দলীল নেই।

আর কুরআন ও সুন্নাহ প্রমাণ করে যে, ওহীর ব্যাপারে চিন্তা ও গবেষণা করা আবশ্যক এবং তা থেকে যে শিক্ষা অর্জন করা হবে তার উপর আমল করা ওয়াজিব। যে জ্ঞানটি অর্জন করা হবে, তা যেন বিশুদ্ধ জ্ঞান হয়। চাই তা অল্পই হোক বা বেশি হোক।

অনুরূপভাবে সাহাবাগণ কোন ব্যক্তির কথার কারণে রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাত পরিত্যাগ করেন নি। সে যে মাপেরই লোক হোক না কেন। বরং ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন- ‘‘আমি আশঙ্কা করছি যে, তোমাদের উপর আসমান থেকে পাথর পড়তে পারে, আমি বলছি আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আর তোমরা বলছ আবূ বকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ) বলেছেন?!’’

শাইখদ্বয়, তথা আবূ বকর (রাঃ) ও উমার (রাঃ) যখন কোন মাসআলা সম্পর্কে জানতেন না তখন মানুষদেরকে আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ) এর হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। একদা আবূ বকর (রাঃ) বলেন: আমি রাসূল (ﷺ) কে দাদীর অংশ সম্পর্কে কিছু বলতে শুনি নি। তাই তিনি যুহরের সালাত শেষ করে জনগণকে প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি দাদীর অংশ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) কে কিছু বলতে শুনেছ? তখন মুগীরাহ্ বিন শু’বাহ (রাঃ) বললেন যে, আমি শুনেছি। আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ) তাকে এক-ষষ্ঠাংশ দিয়েছেন। অতঃপর আবূ বকর (রাঃ) বললেন, তুমি ব্যতীত আর কেউ কি এ কথা শুনেছে? মুহাম্মাদ বিন মুসালিস্নমাহ (রাঃ) বললেন, মুগীরা (রাঃ) সত্য কথাই বলেছেন। অতঃপর আবূ বকর (রাঃ) এক ষষ্ঠাংশ প্রদান করলেন।

নতুন চাঁদ উঠার ব্যাপারে উমার (রাঃ) মানুষকে প্রশ্ন করার ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। অতঃপর তিনি মুগীরাহ (রাঃ) এর খবরের দিকে ফিরে গেছেন। উমার (রাঃ) জনগণকে মহামারী সম্পর্কে আরেকটি প্রশ্ন করেছিলেন এবং তিনি আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) এর খবরের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এছাড়া এ ব্যাপারে আরও বহু প্রসিদ্ধ ঘটনা রয়েছে, যা হাদীসের গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে।

[1] ‘আযওয়াউল বায়ান’ (৭/৪৭৯-৪৮৫) ।
দ্বিতীয় সতর্কবাণী: অনুসৃত ইমামদের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান

জেনে রাখুন! চার ইমাম ও অন্যান্য ইমামের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান হল, সমস্ত ন্যায়নিষ্ঠ মু’মিনের ব্যাপারে আমাদের যে অবস্থান তার মত। আর তা হল, তারা যে জ্ঞান ও তাকওয়ার অধিকারী ছিলেন এ জন্য তাদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করা, তাদেরকে সম্মান করা, তাদের মর্যাদা প্রদান করা ও তাদের প্রশংসা করা। কিতাব ও সুন্নাহ এর প্রতি আমলের ক্ষেত্রে আমরা তাদের আনুগত্য করব। কুরআন ও সুন্নাহ তাদের মতামতের উপর অগ্রাধিকার পাবে। তাদের অভিমত সম্পর্কিত জ্ঞান সঠিক পথে পরিচালিত হতে সাহায্য করবে এবং তাদের অভিমত থেকে যেগুলো কুরআন সুন্নাহ বিরোধী তা পরিত্যাগ করতে সহায়তা করবে। আর যে সব মাসআলার ক্ষেত্রে কুরআন সুন্নাহর কোন দলীল পাওয়া যায় না, সে ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা হল, তাদের ইজতিহাদের দিকে দৃষ্টি দেয়া। এমনটি হতে পারে যে, আমাদের ইজতিহাদের চেয়ে ইমামদের ইজতিহাদ বেশি সঠিক। কেননা তারা আমাদের চেয়ে বেশি জ্ঞান ও তাকওয়ার অধিকারী। তবে আমাদেরও লক্ষ রাখতে হবে ও সতর্ক থাকতে হবে যে, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আমরা যেন অধিকতর নিকটবর্তী মতামতগুলো গ্রহণ করি এবং সন্দেহযুক্ত মতামত থেকে দূরে থাকি।[1] এরূপ পদক্ষপের ক্ষেত্রে আমি কিছু দিক নির্দেশনা দিতে চাই:

১। জেনে রাখুন! যে, ইমামগণ (রাহি:) নিষ্পাপ নন। প্রত্যেক ইমামের উপর বিভিন্ন মাসআলার ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বিদ্বানগণ বলেছেন- সংশ্লিষ্ট ইমাম এক্ষেত্রে সুন্নাতের বিপরীত করেছেন।

তন্মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) উল্লেখযোগ্য। তার ক্ষেত্রে এরূপ বেশি ঘটেছে। কেননা তিনি অধিক মতামত (রায়) গ্রহণ করতেন। তিনি সম্পদের ক্ষেত্রে শপথ ও সাক্ষ্য দ্বারা ফায়সালা করার হাদীসের উপর এবং অবিবাহিত ব্যাভিচারীকে এক বছর দেশান্তর করার হাদীসের উপর আমল করেন না। এরূপ আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) এর উপর অভিযোগ আনা হয়ে থাকে যে, তিনি শাওয়াল মাসের ৬ টি সিয়াম অস্বীকার করেন এবং জুম‘আর দিন সিয়াম পালন করা উত্তম বলে থাকেন। যদিও তিনি একাই এ অভিমত দিয়েছেন। কেননা এ দু‘টি ব্যাপারে তার কাছে হাদীস পৌঁছে নি। ইমাম মালিক (রাহি.) খিয়ারে মজলিস এর হাদীসের উপর আমল পরিত্যাগ করেছেন। অথচ এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত আছে! এরূপ আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে।

ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) সমালোচিত হয়েছিলেন যে, পর্দা ছাড়া শুধু মহিলাকে স্পর্শ করা হলেই ওযূ নষ্ট হয়ে যাবে। অথচ হাদীসে এর বিপরীত কথা বর্ণিত হয়েছে এবং এর অনেক উত্তরও রয়েছে।

অনুরূপ ভাবে ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) সমালোচিত হয়েছিলেন- (শাবানের ২৯ তারিখে চাঁদ দেখা না গেলে) সন্দেহের দিন সাবধানতা বশতঃ রমযানের সিয়াম পালন করার কারণে। অথচ দলীল প্রমাণ করছে যে, এ দিন সিয়াম পালন করা নিষেধ। এরূপ আরও দৃষ্টান্ত রয়েছে।

এখানে ইমামগণ যে সমালোচিত হয়েছেন, এ জন্য তাদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা এবং তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা তারা আল্লাহ্‌ ও রাসূল (ﷺ) এর পক্ষ থেকে যে বিধান এসেছে সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। অতঃপর তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ইজতিহাদ করেছেন। সুতরাং যার ইজতিহাদ সঠিক হবে তিনি ইজতিহাদ করার জন্য ও ইজতিহাদ সঠিক হওয়ার জন্য নেকী পাবেন। আর ইজতিহাদ ভুল হলে ইজতিহাদের জন্য নেকী পাবেন। আর ভুলের কারণে ওযর রয়েছে। তাদের মহৎ মর্যাদার স্বীকারওক্তির মধ্য দিয়ে আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল এটা বর্ণনা করা যে, আমরা যেন কিতাবুলস্নাহ ও সুন্নাতে রাসূল (ﷺ) কে তাদের মতামতের উপর প্রাধান্য দেয়াটা আমাদের উপর আবশ্যক মনে না করি। কেননা তারা গুণাহ থেকে নিষ্পাপ নন।[2]

২। জেনে রাখা ভাল যে, গ্রহণযোগ্য ইমামদের কেউ উম্মতের কাছে ব্যাপকভাবে গৃহীত হবেন না, যদি তিনি স্বেচ্ছায় রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাত এর মধ্যে হতে সূক্ষ্ম কিংবা বড় বিষয়ে রাসূল (ﷺ) এর বিরোধিতা করেন। কেননা এ ব্যাপারে তারাই দৃঢ়ভাবে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, রাসূল (ﷺ) এর ইত্ত্বেবা (অনুসরণ) করা ওয়াজিব। আর রাসূল (ﷺ) ব্যতীত অন্য মানুষের কথা গৃহীত হতে পারে আবার পরিত্যাজ্যও হতে পারে। কিন্তু যদি কেউ এমন মতামত পেশ করে যা সহীহ হাদীস বিরোধী, তাহলে তা অবশ্যই পরিত্যাগ করার যৌক্তিকতা রয়েছে।[3]

৩। হাদীসের বিরোধিতার ক্ষেত্রে ইমামগণ (রাহি:) এর ওযর তিন ভাগে বিভক্ত:[4]

১ম প্রকার- মহানাবী (ﷺ) এটা বলেছেন বলে বিশ্বাস না করা: এর কয়েকটি কারণ রয়েছে।

(১) তার নিকট আসলেই হাদীস পৌঁছে নি। আর যার নিকট হাদীস পৌঁছে নি তার উপর সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জন আবশ্যক হয়ে পড়ে না। যখন হাদীস না পৌঁছে তখন সে ব্যাপারে প্রকাশ্য আয়াত দ্বারা অথবা অন্য হাদীস দ্বারা কিংবা কিয়াস বা ইসিত্মসহাব দ্বারা মতামত পেশ করা তার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ মতামতটি হয়ত কখনও হাদীসের অনুকূলে হয়ে যায়, আবার কখনও প্রতিকূলে চলে যায়। কিছু হাদীসের ক্ষেত্রে সালাফদের যে বিপরীত মতামত পাওয়া যায়, এটা তার অন্যতম কারণ। কেননা রাসূল (ﷺ) এর হাদীস অবগত হওয়াটা প্রত্যেকের জন্য সম্ভব ছিল না।[5]

(২) হয়ত হাদীস পৌঁছেছে। কিন্তু তার কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি।

(৩) তার ইজতিহাদে হাদীসটি যঈফ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অন্য পদ্ধতিতে অকাট্য দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে অন্যের কাছে তার বিপরীত মত পাওয়া যাচ্ছে। এটা কারও কাছে সঠিক হতে পারে, আবার কারও কাছে ভুল হতে পারে।

(৪) ন্যায় সঙ্গত মজবুত খবরে ওয়াহেদ এর ব্যাপারে এমন শর্তারোপ করা, যে ব্যাপারে অন্যরা বিরোধিতা করেছে। যেমন, যখন কিয়াসের মূলনীতি হাদিসটির উল্টো হবে তখন বর্ণনাকারীর জন্য ফক্বীহ হওয়ার শর্তারোপ করা ইত্যাদি।

(৫) তার নিকট হাদীস পৌঁছে এবং গৃহীতও হয়েছে। কিন্তু সে তা ভুলে গেছে।

২য় প্রকার - এ উক্তি দ্বারা এ মাসআলাটি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে, এমন বিশ্বাস না করা: এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। যথাঃ

(১) হাদীসটি দ্বারা কি দলীল গ্রহণ করা যেতে পারে তা বুঝতে না পারা। কেননা কখনও তার কাছে হাদীসের অর্থটি অপরিচিত হয়ে থাকে এবং বিদ্বানগণ এর ব্যাখ্যার ব্যাপারে মতানৈক্য করে। কখনও রাসূল (ﷺ) এর ভাষায় শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তার ভাষায় ও রীতিতে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। অথবা শব্দটি কখনও বহুঅর্থবোধক (মুশতারিক) কিংবা সংক্ষিপ্ত (মুজমাল) হয়ে থাকে। আবার কখনও শব্দটি প্রকৃত অর্থ (হাকীকত) ও রূপক অর্থ (মাযায) এর মাঝে দ্বিধান্বিত হয়ে থাকে। ফলে তার নিকট যে অর্থটি বেশি নিকটবর্তী সে অর্থে তা ব্যবহার করে। যদিও এর অন্য অর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন সাহাবাদের একটি দল প্রথমে الخيط الأبياضও الخيط الأسود এর অর্থ الحبلবা রশি বলে জানতেন। এরূপ আরও উদাহরণ রয়েছে।

কখনও আবার দলীলের অর্থটা গোপন থাকে। কেননা মতামতসমূহের উদ্দেশ্যের মাঝে অনেক প্রশস্ততা রয়েছে এবং বক্তব্যের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝার ক্ষেত্রে বিভিন্নতা রয়েছে।

(২) তার বিশ্বাস যে- হাদীস দ্বারা মূলতঃ কোন দলীল গ্রহণ করা যাবে না। এ প্রকার ও পূর্বের প্রকারটির মাঝে পার্থক্য এই যে, পূর্বেরটির মাঝে কোন দলীলটি গৃহীত হবে তা বুঝা যাবে না। আর এ প্রকারের মাঝে তা বুঝা যাবে কিন্তু বিশ্বাস করবে না যে, এটা সহীহ দলীল।

(৩) তার বিশ্বাস যে, এ অর্থের বিপরীতে আরেকটি অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে যা প্রমাণ করছে যে- এখানে এটি উদ্দেশ্য নয়, বরং ঐটিই উদ্দেশ্য। যেমন আম-খাসের পারস্পারিক বিরোধিতা, মুতলাকের সাথে মুকাইয়াদের বিরোধিতা, আমরে মুতলাকের সাথে এমন কিছুর বিরোধিতা যা ওয়াজিব হওয়াকে বাধা দেয়, এরূপ অন্যান্য বিরোধিতা।

৩য় প্রকার: তার বিশ্বাস হলো, হাদীসের শব্দ ও ব্যাখ্যা অন্যের বিশ্বাসের বিরোধী অথবা প্রকৃতপক্ষে হাদীসটি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত মতের বিরোধী নয়।

এ সকল কারণ ও অন্যান্য কারণের জন্য ইমামগণ হাদীসের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে ওযর পেশ করে থাকেন। মূলতঃ এটাই তাদের (ইমামদের) মতভেদের মূল কারণ।

৪। যখন এটা নির্ধারিত হলো, অতঃপর যে মতামতের ক্ষেত্রে সহীহ হাদীস দ্বারা দলীল স্পষ্ট হয়েছে এবং যার ব্যাপারে বিদ্বানদের একটি দলের ঐকমত্য রয়েছে, সে মত থেকে অন্য কোন আলিমের মতামতের দিকে ধাবিত হওয়া আমাদের উচিৎ নয়, যদিও সে আলিমের এ স্পষ্ট মতামতটি খণ্ডন করার যোগ্যতা রয়েছে এবং যদিও তিনি অধিক জ্ঞানী হন না কেন। কেননা শরীয়াতের দলীলের চেয়ে বিদ্বানদের মতামতে ভুলের মাত্রা বেশি। কারণ শরীয়াতের দলীল সমস্ত বান্দার উপর প্রমাণ স্বরূপ। কিন্তু আলিমের মতামত এর বিপরীত। আর শরীয়াতের দলীল যতক্ষণ না অন্য দলীলের বিরোধিতা করে ততক্ষণ পর্যন্ত তা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আলিমের মতামত এরূপ নয়। মূলতঃ একজন আলিম হাদীস পরিত্যাগ করার জন্য স্বয়ং ওযর প্রাপ্ত। আর আমরা এটি (হাদিস বর্জিত মতামত) প্রত্যাখ্যান করার জন্য ওযর প্রাপ্ত।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ وَلَا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ﴾

সেটা এমন এক উম্মত যা বিগত হয়েছে। তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের জন্যই, আর তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের জন্যই। আর তারা যা করত সে সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না (সূরা: বাকারাহ-১৩৪)।


আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ﴾

অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ্‌ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর- যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ (সূরা : আন-নিসা-৫৯)।


উল্লেখিত কারণগুলোর কোন একটির জন্য যদি মতামত ত্যাগ করা হয়, অতঃপর যদি কোন সহীহ হাদীস আসে যেখানে হালাল-হারাম কিংবা কোন বিধানের কথা উল্লেখ থাকে, তাহলে আমরা ইমামের হাদীস বর্জন করার যে কারণগুলো বর্ণনা করলাম, তার কোন একটির কারণে তাদের কেউ যদি এ সহীহ হাদীসটিকে পরিত্যাগ করে, তাহলে হালালকে হারাম করার কারণে অথবা আল্লাহ্‌র অবতীর্ণ বিধানের উল্টো বিধান দেয়ার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হবে- আমাদের জন্য এ বিশ্বাস রাখা বৈধ হবে না। অনুরূপভাবে হাদীসে যদি একথাও বলা থাকে যে, যে ব্যক্তি এরূপ কাজ করবে তার জন্য অভিশাপ, গযব কিংবা শাস্তি অথবা অনুরূপ কিছু রয়েছে। তাহলেও তাকে একথা বলা বৈধ হবে না যে, যে আলিম এটি বৈধ করবে কিংবা এটা সম্পাদন করবে সে এই শাস্তিরই অন্তর্ভুক্ত। একথাটির ব্যাপারে উম্মতের মাঝে কারও মতভেদ রয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে বাগদাদের কতিপয় মু‘তাযিলা এর বিরোধিতা করেছেন। সুতরাং যার কাছে হারাম হওয়ার কোন হাদীস পৌঁছে নি, এমতাবস্থায় তিনি যদি শারঈ দলীলের দিকে সম্বোধন করে এটাকে বৈধ বলে সমাধান দেন, তাহলে এ ক্ষেত্রে তিনি ওযর প্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য। আর এ ক্ষেত্রে তিনি তার ইজতিহাদের কারণে প্রতিদান পাবেন ও প্রশংসিত হবেন। আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَدَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ إِذْ يَحْكُمَانِ فِي الْحَرْثِ﴾

আর স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানের কথা, যখন তারা শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করছিলেন ( আম্বিয়া-৭৮)।

﴿فَفَهَّمْنَاهَا سُلَيْمَانَ وَكُلًّا آتَيْنَا حُكْمًا وَعِلْمًا﴾

অতঃপর আমি এ বিষয়ের ফয়সালা সুলায়মানকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। আর আমি তাদের প্রত্যেককেই দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান (সূরা: আম্বিয়া-৭৯)।

অত্র আয়াতে আল্লাহ্‌ সুলাইমান (ؑ) এর ‘বুঝ’ বা অনুধাবনকে বিশিষ্টতা দান করেছেন এবং উভয়ের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রশংসা করেছেন।

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আমর বিন আস থেকে বর্ণিত হয়েছে, মহানাবী (ﷺ) বলেন:

إِذَا حَكَمَ الحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ

বিচারক যদি কোন ফায়সালা করতে গিয়ে প্রচেষ্টা করে সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে তার জন্য দু‘টি নেকী রয়েছে। আর প্রচেষ্ট করার পর ভুল হলে একটি নেকী রয়েছে।[6]

সুতরাং এ থেকে বুঝা গেল যে, মুজতাহিদ ভুল করলে তার একটি প্রতিদান রয়েছে। আর এটা তার ইজতিহাদের কারণে। আর যে ভুলটা হয়েছে তার জন্য সে ক্ষমা প্রাপ্ত হবে। কেননা শরীয়াতের সমস্ত বিধানের ক্ষেত্রে ওযর প্রাপ্ত হওয়ার কারণে কিংবা কঠিন হওয়ার কারণেও সাওয়াব পাওয়া যায়।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ﴾

দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নি (সূরা: হাজ্জ-৭৮)।

আল্লাহ্‌ আরও বলেন:

﴿يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ﴾

আল্লাহ্‌ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না (সূরা: বাকারাহ-১৮৫)।


৫। ইমামগণ তাদের তাক্বলীদ (দলীলবিহীন অনুসরণ) না করার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। অন্ধ বিশ্বাসী গোঁড়াপন্থিরা নিজেদেরকে তাদের ইমামের অনুসারী বলে দাবি করে, তাদের মাযহাব ও মতামতকেই শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। তারা এটাকে আসমান থেকে অবতীর্ণ ওহীর বিধানের মত বলে মনে করে।[7]

যেমন আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন:

﴿اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ﴾

তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ হতে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর (সূরা আরাফ-৩)।


এ ব্যাপারে ইমামগণের (রাহিমাহুল্লাহ) পক্ষ থেকে যে সব মতামত আমরা জানতে পেরেছি, তার কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো:[8]

(১) আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ)

ইমামগণের মধ্যে প্রথমেই হলেন ইমাম আবূ হানীফা নু’মান বিন সাবিত (রাহিমাহুল্লাহ)। তার সাথীগণ তার অনেক কথা বিভিন্ন ভাষায় বর্ণনা করেছেন, সব কয়টি কথা একটাই বিষয়ের প্রতি নির্দেশ করে, আর তা হচ্ছে: হাদীসকে অাঁকড়ে ধরা ও তার বিপক্ষে ইমামগণের কথা পরিহার করা ওয়াজিব।

কথাগুলো হচ্ছে:

(ক) ( إذا صح الحديث فهو مذهبي )

অর্থ: হাদীস বিশুদ্ধ হলে ওটাই আমার মাযহাব বলে পরিগণিত হবে।


(খ) ( لا يحل لأحد أن يأخذ بقولنا ما لم يعلم من أين أخذناه )

অর্থ: আমরা কোথা থেকে কথাটি নিলাম এটা না জানা পর্যন্ত কারও জন্য আমাদের কথা গ্রহণ করা বৈধ নয়।

অপর বর্ণনায় রয়েছে:

( حرام على من لم يعرف دليلي أن يفتي بكلامي )

অর্থ: যে আমার কথার প্রমাণ জানে না তার পক্ষে আমার কথার দ্বারা ফাৎওয়া প্রদান করা হারাম।

অন্য বর্ণনায় আরও বাড়িয়ে বলেছেন:

( فإننا بشر نقول القول اليوم ونرجع عنه غدا )

অর্থ: কেননা আমরা মানুষ, আজ এক কথা বলি, আবার আগামীকাল তা থেকে ফিরে যাই।

অপর বর্ণনায় রয়েছে:

( ويحك يا يعقوب ( هو أبو يوسف ) لا تكتب كل ما تسمع مني فإني قد أرى الرأي اليوم وأتركه غدا وأرى الرأي غدا وأتركه بعد غد )

অর্থ: হে হতভাগা ইয়াকুব! (আবূ ইউসূফ) তুমি আমার থেকে যা শুন তা লেখ না, কেননা আমি আজ এক মত পোষণ করি এবং আগামীকাল তা পরিহার করি, আবার আগামীকাল এক মত পোষণ করি আর পরশুদিন তা পরিত্যাগ করি।

(গ) ( إذا قلت قولا يخالف كتاب الله تعالى وخبر الرسول صلى الله عليه وسلم فاتركوا قولي )

অর্থ: যখন আমি এমন কথা বলি যা আল্লাহ্‌ তা’আলার কিতাব ও রাসূল (ﷺ) এর হাদীস বিরোধী তা হলে তোমরা আমার কথা পরিত্যাগ করবে।

(২) মালিক বিন আনাস (রাহিমাহুল্লাহ)

ইমাম মালিক বিন আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:

( إنما أنا بشر أخطئ وأصيب فانظروا في رأيي فكل ما وافق الكتاب والسنة فخذوه وكل ما لم يوافق الكتاب والسنة فاتركوه )

(ক) আমি নিছক একজন মানুষ। আমি ভুলও করি শুদ্ধও করি। তাই তোমরা লক্ষ কর আমার অভিমতের প্রতি। এগুলোর যতটুকু কুরআন ও সুন্নাহর সাথে মিলে তা গ্রহণ কর আর যতটুকু এতদোভয়ের সাথে গরমিল হয় তা পরিত্যাগ কর।

( ليس أحد بعد النبي صلى الله عليه وسلم إلا ويؤخذ من قوله ويترك إلا النبي صلى الله عليه وسلم )

(খ) নাবী (ﷺ) ব্যতীত অন্য যে কোন লোকের কথা গ্রহণীয় এবং বর্জনীয় কিন্তু নাবী (ﷺ)এর সকল কথা গ্রহণীয়।


(গ) ইবনু অহাব বলেন: আমি মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) কে ‘ওযূ’ তে পদযুগলের অঙ্গুলিসমূহ খিলাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে শুনেছি: তিনি (উত্তরে) বলেন: লোকদেরকে তা করতে হবে না। (ইবনু অহাব) বলেন: আমি তাকে লোকসংখ্যা কমে আসা পর্যন্ত ছেড়ে রাখলাম। অতঃপর বললাম, আমাদের কাছে এ বিষয়ে হাদীস রয়েছে, তিনি বললেন, সেটা কী? আমি বললাম: আমাদেরকে লাইস ইবনু সা’য়াদ, ইবনু লহী’য়াহ ও আমার ইবনুল হারিস ইয়াযীদ ইবনু আমর আল মু’য়াফিরী থেকে তিনি আবূ আব্দির রহমান আল হুবালী থেকে তিনি আল মুসতাউরিদ বিন শাদ্দাদ আল কুরাশী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يدلك بخنصره ما بين أصابع رجليه অর্থ: আমি রাসূল (ﷺ) কে দেখেছি তিনি তাঁর কনিষ্ঠাঙ্গুলি দ্বারা পদযুগলের আঙ্গুলিগুলোর মধ্যভাগ মর্দন করেছেন। এতদশ্রবণে ইমাম মালিক বলেন, এ তো সুন্দর হাদীস। আমি এ যাবৎ এটি শুনি নি। পরবর্তীতে তাকে জিজ্ঞাসিত হতে শুনেছি তাতে তিনি আঙ্গুলি মর্দনের আদেশ দিতেন।


(৩) শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ)

ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে এ মর্মে অনেক চমৎকার চমৎকার কথা উদ্ধৃত হয়েছে। তার অনুসারীগণ তার এ সব কথায় অধিক সাড়া দিয়েছেন এবং উপকৃতও হয়েছেন। কথাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

( ما من أحد إلا وتذهب عليه سنة لرسول الله صلى الله عليه وسلم وتعزب عنه فمهما قلت من قول أو أصلت من أصل فيه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم لخلاف ما قلت فالقول ما قال رسول الله صلى الله عليه وسلم وهو قولي )

(ক) প্রত্যেক ব্যক্তি থেকেই আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ) এর কিছু সুন্নাহ গোপন থাকবেই ও ছাড়া পড়বেই। তাই আমি যে কথাই বলেছি অথবা মূলনীতি উদ্ভাবন করেছি, সে ক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) থেকে আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য পাওয়া গেলে আল্লাহ্‌র রাসূলের কথাই হচ্ছে চূড়ান্ত আর এটিই হবে আমার কথা।

أجمع المسلمون على أن من استبان له سنة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يحل له أن يدعها لقول أحد

(খ) মুসলমানগণ এ ব্যাপারে একমত যে, যার কাছে রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাহ্ (হাদীস) পরিষ্কাররূপে প্রকাশ হয়ে যায় তার পক্ষে বৈধ নয় অন্য কারও কথায় তা বর্জন করা।

( إذا وجدتم في كتابي خلاف سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فقولوا بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم ودعوا ما قلت )

(গ) তোমরা যখন আমার কিতাবে রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাহ বিরোধী কিছু পাবে তখন আল্লাহ্‌র রাসূলের সুন্নাত অনুসারে কথা বলবে, আর আমি যা বলেছি তা ছেড়ে দিবে।

অপর বর্ণনায় রয়েছে:

"فاتبعوها ولا تلتفتوا إلى قول أحد".

তোমরা তারই (সুন্নাতেরই) অনুসরণ কর, আর অন্য কারও কথার প্রতি ভ্রূক্ষেপ কর না।

(ঘ) ( إذا صح الحديث فهو مذهبي ) অর্থ: হাদীস বিশুদ্ধ হলে এটাই আমার গৃহীত পন্থা (মাযহাব)।

( أنتم أعلم بالحديث والرجال مني فإذا كان الحديث الصحيح فأعلموني به أي شيء يكون : كوفيا أو بصريا أو شاميا حتى أذهب إليه إذا كان صحيحا )

(ঙ) আপনারাই (এখানে আহমাদ ইবনে হাম্বালকে সম্বোধন করা হয়েছে) হাদীস বিষয়ে ও তার রিজালের (বর্ণনাকারীদের) ব্যাপারে আমার অপেক্ষা অধিক জ্ঞাত, তাই সহীহ হাদীস পেলেই আমাকে জানাবেন, চাই তা কুফাবাসীদের বর্ণনাকৃত হোক, চাই বাসরাবাসীদের হোক অথবা শাম-বাসীদের (সিরিয়ার) হোক বিশুদ্ধ হলে আমি তাই গ্রহণ করব।

كل مسألة صح فيها الخبر عن رسول الله صلى الله عليه وسلم عند أهل النقل بخلاف ما قلت فأنا راجع عنها في حياتي وبعد موتي

(চ) যে বিষয়ে আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ) থেকে আমার কথার বিরুদ্ধে হাদীস বর্ণনাকারীদের নিকট বিশুদ্ধরূপে কোন হাদীস পাওয়া যাবে আমি আমার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর আমার বক্তব্য পরিহার করে রাসূল (ﷺ) এর হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম।

( إذا رأيتموني أقول قولا وقد صح عن النبي صلى الله عليه وسلم خلافه فاعلموا أن عقلي قد ذهب )

(ছ) যখন তোমরা দেখবে যে, আমি এমন কথা বলছি যার বিরুদ্ধে নাবী (ﷺ) থেকে বিশুদ্ধ হাদীস রয়েছে তবে জেনে রাখ যে, আমার বিবেক হারিয়ে গেছে।

( كل ما قلت فكان عن النبي صلى الله عليه وسلم خلاف قولي مما يصح فحديث النبي أولى فلا تقلدوني )

(জ) আমি যা কিছুই বলেছি তার বিরুদ্ধে নাবী (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে হাদীস এসে গেলে নাবী (ﷺ) এর হাদীসই হবে অগ্রাধিকারযোগ্য, অতএব আমার অন্ধ অনুসরণ করো না।

( كل حديث عن النبي صلى الله عليه وسلم فهو قولي وإن لم تسمعوه مني )

(ঝ) নাবী (ﷺ)-এর সব হাদীসই আমার বক্তব্য যদিও আমার মুখ থেকে তা না শুনে থাক।


(৪) আহমাদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল ইমামগণের মধ্যে সর্বাধিক হাদীস সংগ্রহকারী এবং তা বাসত্মবে রূপায়ণকারী ছিলেন। তাই তিনি শাখা প্রশাখামূলক কথা ও মতামত সম্বলিত কিতাব লেখা অপছন্দ করতেন। তিনি বলেন:

( لا تقلدني ولا تقلد مالكا ولا الشافعي ولا الأوزاعي ولا الثوري وخذ من حيث أخذوا )

(ক) তুমি আমার অন্ধ অনুসরণ করো না; মালিক, শাফেঈ, আওযায়ী, সাউরী এদেরও কারও অন্ধ অনুসরণ করো না বরং তাঁরা যেখান থেকে (সমাধান) গ্রহণ করেন তুমি সেখান থেকেই তা গ্রহণ কর। অপর বর্ণনায় রয়েছে:

لا تقلد دينك أحدا من هؤلاء ما جاء عن النبي صلى الله عليه وسلم وأصحابه فخذ به ثم التابعين بعد الرجل فيه مخير

তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে এদের কারও অন্ধ অনুসরণ করবে না। নাবী (ﷺ) ও তাঁর সাহাবাদের থেকে যা কিছু আসে তা গ্রহণ কর, অতঃপর তাবেঈদের। তাদের পরবর্তীদের ব্যাপারে কোন ব্যক্তির জন্য যে কারও নিকট থেকে গ্রহণ করার স্বাধীনতা রয়েছে।

আবার কোন সময় বলেছেন:

( الاتباع أن يتبع الرجل ما جاء عن النبي صلى الله عليه وسلم وعن أصحابه ثم هو من بعد التابعين مخير )

অনুসরণ হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নাবী (ﷺ) ও তাঁর সাহাবাদের থেকে যা আসে তার অনুসরণ করবে অতঃপর তাবেঈদের পর থেকে সে (যে কারও অনুসরণে) স্বাধীন থাকবে।

( رأي الأوزاعي ورأي مالك ورأي أبي حنيفة كله رأي وهو عندي سواء وإنما الحجة في الآثار )

(খ) আওযায়ী, মালিক ও আবূ হানীফা প্রত্যেকের মতামত হচ্ছে মতামত মাত্র এবং আমার কাছে তা সমান (মূল্য রাখে); তবে প্রমাণ রয়েছে কেবল হাদীসের ভিতর।

( من رد حديث رسول الله صلى الله عليه وسلم فهو على شفا هلكة )

(গ) যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ) এর হাদীস প্রত্যাখ্যান করলো সে ধ্বংসের তীরে উপনীত হলো।

এ সবই হলো ইমামগণ (রাহিমাহুল্লাহ) এর বক্তব্য যাতে হাদীসের উপর আমল করার ব্যাপারে নির্দেশ রয়েছে এবং অন্ধভাবে তাদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। কথাগুলো এতই স্পষ্ট যে, এগুলো কোন তর্ক বা ব্যাখ্যার অপেক্ষাই রাখে না।

অতএব যে ব্যক্তি ইমামদের কিছু কথার বিরুদ্ধে গেলেন কিন্তু সকল সুস্পষ্ট হাদীস অাঁকড়ে ধরলেন তিনি ইমামদের মাযহাব বিরোধী হবেন না এবং তাদের ত্বরীকা থেকে বহিষ্কৃতও হবেন না। বরং তিনি হবেন তাদের প্রত্যেকের অনুসারী। আরও হবেন, শক্ত হাতল মজবুতভাবে ধারণকারী, যে হাতল ছিন্ন হবার নয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শুধু ইমামদের মতভেদের কারণে সুস্পষ্ট হাদীস প্রত্যাখ্যান করে তার অবস্থা এমনটি নয়, বরং সে এর মাধ্যমে তাদের অবাধ্য হলো এবং তাদের পূর্বোক্ত কথাগুলোর বিরোধিতা করলো।

আল্লাহ্‌ বলেন:

﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾

তোমার প্রতিপালকের শপথ তারা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদ নিরসনে তোমাকে বিচারক মানবে, অতঃপর তোমার মীমাংসায় নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা অনুভব করবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে মেনে নিবে (সূরা নিসা-৬৫)।

তিনি আরও বলেন:

﴿فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

তাই যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করে তারা যেন ভীতিগ্রসত্ম থাকে (কুফর, শিরক বা বিদ‘আত দ্বারা) ফিৎনায় আক্র

[1] ‘আযওয়াউল বায়ান’ (৭/৫৫৫) ।

[2] দেখুন! ‘আযওয়াউল বায়ান’ (৭/৫৫৬-৫৭৬) ।

[3] রফউল মালাম আনিল আয়িম্মাতিল আ‘লাম’ যা- ‘মাজমূউল ফাৎওয়া’ গ্রন্থ (২০/২৩২) হতে গৃহীত।

[4] দেখুন! ‘রফউল মালাম আনিল আয়িম্মাতিল আ‘লাম’ ও ‘মাজমূউল ফাৎওয়া’ (২০/২৩১-২৯০) ।

[5] সাহাবা এবং অন্যান্যদের মাঝে এটা বাসত্মবায়নের দৃষ্টামত্ম দেখুন- প্রাগুক্ত (২০/২৩৪-২৩৮)।

[6] সহীহ: বুখারী ৭৩৫২ ও মুসলিম ১৭১৬।

[7] ‘রফউল মালাম’ যা ‘মাজমূউল ফাৎওয়া’ (২০/২৫০-২৫২) হতে কিছুটা পরিবর্তনসহ গৃহীত।

[8] আলস্নামা আলবানী (রাহি.) প্রণীত ‘সিফাতু সলাতিন্নাবী’ (পৃ: ৪৬-৫৭) হতে গৃহীত।
সুন্নাহ অনুসরণ করতে যেয়ে ইমামগণের অনুসারীগণ কর্তৃক তাদের কিছু কথা পরিহারের নমুনা:

পূর্বোলেস্নখিত কারণ সাপেক্ষ ইমামগণের অনুসারীবৃন্দ-

﴿ثُلَّةٌ مِنَ الْأَوَّلِينَ ۞ وَقَلِيلٌ مِنَ الْآخِرِينَ ﴾

পূর্ববর্তীদের অধিক সংখ্যক এবং পরবর্তীদের অল্প সংখ্যক লোক (সূরা ওয়াক্বিয়াহ-১৩,১৪)
স্বীয় ইমামদের সব কথা গ্রহণ করতেন না। বরং তাদের অনেক কথাই তারা বাদ দিয়েছেন যখন সুন্নাহ বিরোধী বলে স্পষ্ট হয়েছে।

এমনকি ইমামদ্বয় মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (রাহিমাহুল্লাহ) ও আবূ ইউসুফ (রাহিমাহুল্লাহ) তাদের শাইখ আবূ হানীফার (রাহিমাহুল্লাহ) প্রায় এক তৃতীয়াংশ মাযহাব-এর বিরোধিতা করেছেন। ফিক্বহের কিতাবগুলোই একথা বর্ণনার জন্য যথেষ্ট।

এ ধরনের কথা ইমাম মাযিনী ও ইমাম শাফেঈর অন্যান্য অনুসারীদের বেলায়ও প্রযোজ্য। আমরা যদি এর উপর দৃষ্টান্ত পেশ করতে যাই তবে কথা দীর্ঘ হয়ে যাবে এবং এই বইয়ে আমি সংক্ষপায়নের যে উদ্দেশ্য পোষণ করেছি তা থেকেও বেরিয়ে পড়ব। তাই দু’টি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হবো:

ক। ইমাম মুহাম্মাদ তাঁর ‘‘মুওয়াত্ত্বা’’ গ্রন্থে বলেন (পৃ.১৫৮): আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) ইসতিসকার কোন সালাত আছে বলে মনে করতেন না। তবে আমাদের কথা হচ্ছে যে, ইমাম লোকজনকে নিয়ে দু‘রাকা‘আত সালাত পড়বেন, অতঃপর দু’আ করবেন এবং স্বীয় চাদর পাল্টাবেন ...... (শেষ পর্যন্ত)।

খ। ইসাম বিন ইউসুফ আল বালখী যিনি ইমাম মুহাম্মাদ এর সাথী ছিলেন এবং ইমাম আবূ ইউসুফ এর সংশ্রবে থাকতেন তিনি ইমাম আবূ হানীফার কথার বিপরীত অনেক ফাৎওয়া প্রদান করতেন, কেননা (আবূ হানীফা) যেগুলোর দলীল জানতেন না অথচ তার কাছে অন্যদের দলীল প্রকাশ পেয়ে যেত, তাই সে মতেই ফাৎওয়া দিয়ে দিতেন। তাই তিনি রুকুতে গমনকালে ও রুকু থেকে উঠার সময় হসত্মযুগল উত্তোলন (রফউল ইয়াদাইন) করতেন। যেমনটি নাবী (ﷺ) থেকে মুতওয়াতির বর্ণনায় এসেছে।

তার তিন ইমাম কর্তৃক এর বিপরীত বক্তব্য তাকে এ সুন্নাত মানতে বাধা দেয় নি। এ নীতির উপরেই প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির অটল থাকা ওয়াজিব, চার ইমাম ও অন্যান্যদের সাক্ষ্য দ্বারা এটাই ইতিপূর্বে প্রতীয়মান হয়েছে।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৬৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 7 পরের পাতা »