الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على رسوله الكريم، وعلى آله وصحبه اجمعين، وبعد
মহান আল্লাহ জ্বিন ও ইনসানকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সেই ইবাদতের অসীলায় তাদের জন্য পুরস্কার রেখেছেন জান্নাত। তিনি মানুষের আত্মাকে আহবান করে বলেছেন,
يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ (27) ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً (28) فَادْخُلِي فِي عِبَادِي (29) وَادْخُلِي جَنَّتِي (30)
অর্থাৎ, হে উদ্বেগশূন্য চিত্ত! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। সুতরাং তুমি আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর। (ফাজরঃ ২৭-৩০)
তিনি তার প্রস্তুতকৃত জান্নাতের প্রতি অধিক অধিক আগ্রহান্বিত হতে মানুষকে আহবান করেছেন। তিনি তা পাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি, ছুটাছুটি ও প্রতিযোগিতা করতে আদেশ করেছেন,
وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
অর্থাৎ, তোমরা প্রতিযোগিতা (ত্বরা) কর, তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে ক্ষমা এবং বেহেস্তের জন্য, যার প্রস্থ আকাশ ও পৃথিবীর সমান, যা ধর্মভীরুদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। (আলে ইমরানঃ ১৩৩)।
পক্ষান্তরে মানুষকে ভয় দেখিয়েছেন তার প্রস্তুতকৃত জাহান্নামের। তিনি বলেছেন,
وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ
অর্থাৎ, তোমরা সেই আগুনকে ভয় কর, যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। (আলে ইমরানঃ ১৩১)
তিনি যেমন মানুষকে আদেশ করেছেন, সে যেন নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করে, তেমনি আদেশ করেছেন, সে যেন তার পরিবারকেও রক্ষা করে। তিনি বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
অর্থাৎ, হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারপরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়ােজিত আছে নির্মম-হৃদয়, কঠোর-স্বভাব ফিরিস্তাগণ, যারা আল্লাহ যা তাদেরকে আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয়, তাই করে। (তাহরীমঃ ৬)
মুমিন বান্দার সেই প্রয়াস নিরন্তর। জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করে জান্নাতে স্থানলাভ করাই সবচেয়ে বড় সফলতা। আর সেই সফলতা লাভ হবে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভ করার মধ্য দিয়ে। তাই মুসলিম কালেমা পড়ে, সকল ফরয আদায় করে, সকল হারাম বর্জন করে। অধিক মর্যাদা লাভের জন্য অতিরিক্ত নফল ইবাদতও করে। অনুরূপ একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ ইবাদত মানুষকে জান্নাতের দিকে আহবান করা এবং জাহান্নাম থেকে সতর্ক করা। আমরা এই ইবাদতের মাধ্যমেও চাই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মহা পুরস্কার জান্নাত। আল্লাহ যেন আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতা ও ওস্তাদগণকে তার চিরসুখময় জান্নাতে স্থান দান করেন। আমীন। পুস্তিকাটি রচনা করতে যে সকল লেখকের পুস্তকের সাহায্য নেওয়া হয়েছে, মহান আল্লাহ তাদেরকেও জান্নাত নসীব করুন। আমীন।
বিনীত-আব্দুল হামীদ মাদানী
আল-মাজমাআহ ৮/১১/২০১০
জান্নাত শব্দের অর্থ হলঃ উদ্যান, বাগান, বাগিচা। ফারসী ভাষায় যাকে বেহেশত বলা হয়।
মহান আল্লাহ মহাপ্রতিদান স্বরূপ যা নিজ অনুগত বান্দার মরণের পর পরকালে প্রস্তুত রেখেছেন।
জান্নাত মানে শুধু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগানই নয়; বরং তাতে থাকবে বাসস্থান, অট্টালিকা এবং চরম সুখ-সামগ্রীর এমন সবকিছু, যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। সেখানে এমন সুখ থাকবে, যাতে কোন দুঃখের লেশমাত্র থাকবে না। এমন নির্মল শান্তি থাকবে, যাতে কোন প্রকার অশান্তির মলিনতা নেই। এত সুখসম্পদ থাকবে, যার কাল্পনিক বর্ণনা দিতেও মানুষের মন অক্ষম।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, 'আমি আমার পুণ্যবান বান্দাদের জন্য (জান্নাতে) এমন জিনিস প্রস্তুত রেখেছি, যা কোন চক্ষু দর্শন। করেনি, কোন কর্ণ শ্রবণ করেনি এবং যার সম্পর্কে কোন মানুষের মনে ধারণাও জন্মেনি। তোমরা চাইলে এ আয়াতটি পাঠ করতে পার---
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
যার অর্থ, “কেউই জানে না তার জন্য তার কৃতকর্মের বিনিময় স্বরূপ নয়ন-প্রীতিকর কি পুরস্কার লুকিয়ে রাখা হয়েছে।” (সাজদাহঃ ১৭ আয়াত, বুখারী-মুসলিম)।
পার্থিব জগতেই কত বিলাসপ্রিয় ধনকুবেররা বিলাসবহুল বাগান ও বাড়ি বানিয়ে বসবাস করে, কত রকম সুখ-সরঞ্জাম ও বিলাসসামগ্রী ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু সেসব কিছু জান্নাতের তুলনায় নেহাতই তুচ্ছ। যেহেতু জান্নাতের সুখ অনুপম, বেহেশতের শান্তি অতুল। যেহেতু “বেহেশতের একটি চাবুক পরিমাণ জায়গা পৃথিবী ও তন্মধ্যস্থিত সবকিছু অপেক্ষা উত্তম।” (বুখারী ৩২৫০নং)। “জান্নাতে ধনুক পরিমাণ স্থান (দুনিয়ার) যেসব বস্তুর উপর সূর্য উদিত কিম্বা অস্তমিত হচ্ছে, সেসব বস্তুর চেয়েও উত্তম।” (বুখারী-মুসলিম)।
জান্নাতের সে সুখ-সামগ্রী দেখে দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখী মানুষটিও সমস্ত দুঃখের কথা ভুলে যাবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। অতঃপর তাকে জাহান্নামে একবার (মাত্র) চুবানো হবে, তারপর তাকে বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো ভাল জিনিস দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখনো সুখ-সামগ্রী এসেছে? সে বলবে, না। আল্লাহর কসম! হে প্রভু! আর জান্নাতীদের মধ্য হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ার সবচেয়ে দুঃখী ও অভাবী ছিল। তাকে জান্নাতে (মাত্র একবার) চুবানোর পর বলা হবে, হে আদম সন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কখনো কষ্ট দেখছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ গেছে? সে বলবে, না। আল্লাহর কসম! আমার উপর কোনদিন কষ্ট আসেনি এবং আমি কখনো কোন বিপদও দেখিনি।” (মুসলিম)
আর সে কারণেই বেহেশতে স্থান লাভ করা এমন সৌভাগ্যের ব্যাপার, যার পর কোন সৌভাগ্য নেই। মহান আল্লাহর ভাষায় সেটাই মহা সফলতা। তিনি বলেন,
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ۗ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۖ فَمَن زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ۗ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
অর্থাৎ, জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর কিয়ামতের দিনই তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় প্রদান করা হবে। সুতরাং যাকে আগুন (দোযখ) থেকে দুরে রাখা হবে এবং (যে) বেহেশতে প্রবেশলাভ করবে, সেই হবে সফলকাম। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভােগ ব্যতীত কিছুই নয়। (আলে ইমরানঃ ১৮৫)
وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
অর্থাৎ, আল্লাহ বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীদেরকে এমন উদ্যানসমূহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন, যেগুলাের নিম্নদেশে বইতে থাকবে নদীমালা, সেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। আরও (প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন) চিরস্থায়ী উদ্যানসমূহে (জান্নাতে আদনে) পবিত্র বাসস্থানসমূহের। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় (নিয়ামত)। এটাই হচ্ছে মহা সফলতা। (তাওবাহঃ ৭২)
وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ وَذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
অর্থাৎ, যে আল্লাহ ও রসূলের অনুগত হয়ে চলবে, আল্লাহ তাকে বেহেস্তে স্থান দান করবেন; যার নীচে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং এ মহা সাফল্য। (নিসাঃ ১৩)
আহলে সুন্নাহ অল-জামাআতের আক্বীদা এই যে, মহান সৃষ্টিকর্তা জান্নাত-জাহান্নাম আগেই সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তার বাসিন্দা সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ, জান্নাত-জাহান্নাম বর্তমানে প্রস্তুত রয়েছে। মহান আল্লাহ জান্নাত সম্বন্ধে বলেছেন,
وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
অর্থাৎ, তোমরা প্রতিযোগিতা (ত্বরা) কর, তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে ক্ষমা এবং বেহেস্তের জন্য, যার প্রস্থ আকাশ ও পৃথিবীর সমান, যা ধর্মভীরুদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। (আলে ইমরানঃ ১৩৩)
سَابِقُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
অর্থাৎ, তোমরা আগ্রণী হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে, যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীর প্রশস্ততার মত, যা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহ ও তাঁর রসূলগণে বিশ্বাসীদের জন্য। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। (হাদীদঃ ২১)
আর জাহান্নাম সম্বন্ধে বলেছেন,
فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَن تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ ۖ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ
অর্থাৎ, যদি তোমরা (সূরা আনয়ন) না কর, এবং কখনই তা করতে পারবে না, তাহলে সেই আগুনকে ভয় কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত রয়েছে। (বাক্বারাহঃ ২৪)
وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ
অর্থাৎ, তোমরা সেই আগুনকে ভয় কর, যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। (আলে ইমরানঃ ১৩১)
إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا (21) لِّلطَّاغِينَ مَآبًا (22)
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই জাহান্নাম ওঁৎ পেতে রয়েছে---সীমালংঘনকারীদের প্রত্যাবর্তনস্থল রূপে। (নাবাঃ ২১–২২)
মহানবী (ﷺ) মিরাজের রাতে জান্নাত দর্শন করেছেন। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَىٰ (13) عِندَ سِدْرَةِ الْمُنتَهَىٰ (14) عِندَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَىٰ (15) إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَىٰ (16) مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ (17) لَقَدْ رَأَىٰ مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَىٰ (18)
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট। যার নিকট অবস্থিত (জান্নাতুল মাওয়া) বাসােদ্যান। যখন (বদরী) বৃক্ষটিকে, যা আচ্ছাদিত করার ছিল তা আচ্ছাদিত করল, তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। নিঃসন্দেহে সে তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিল। (নাজমঃ ১৩-১৮)।
বরং মহানবী (ﷺ) সে রাত্রে জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। (বুখারী-মুসলিম)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন মারা যায়, তখন সকালসন্ধ্যায় তার অবস্থানক্ষেত্র তাকে প্রদর্শন করা হয়। জান্নাতী হলে জান্নাতের এবং জাহান্নামী হলে জাহান্নামের। তাকে বলা হয়, এই হল তোমার থাকার জায়গা; যে পর্যন্ত না তোমাকে কিয়ামতে আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন।” (বুখারী ১৩৭৯, মুসলিম ২৮৬৬নং)
কবরের হিসাব ও প্রশ্ন সংক্রান্ত দীর্ঘ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, '...তখন আসমানের দিক হতে এক শব্দকারী শব্দ করেন, “আমার বান্দা সত্য বলেছে। সুতরাং তার জন্য বেহেস্তের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে বেহেস্তের একটি লেবাস পরিয়ে দাও। এ ছাড়া তার জন্য বেহেস্তের দিকে একটি দরজা খুলে দাও।” তখন তার প্রতি বেহেস্তের সুখ-শান্তি ও বেহেস্তের খোশবু আসতে থাকে এবং তার জন্য তার কবর দৃষ্টিসীমা বরাবর প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। (আহমাদ ৪/২৮৭-২৮৮, আবু দাউদ ৪৭৫৩নং)।
একদা সূর্যগ্রহণের নামায পড়তে পড়তে মহানবী জান্নাত দর্শন করে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং জাহান্নাম দর্শন করে পিছু হটেছিলেন। (মুসলিম ৯০১নং)
তিনি বলেছেন, “আমি জান্নাতের দুয়ারে দাঁড়ালাম। অতঃপর দেখলাম, যারা জান্নাতে প্রবেশ করেছে, তাদের অধিকাংশ গরীব-মিসকীন মানুষ। আর ধনবানদেরকে (তখনও হিসাবের জন্য আটকে রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে (অন্যান্য) জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আর আমি জাহান্নামের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেখলাম যে, যারা তাতে প্রবেশ করেছে, তাদের বেশীরভাগই নারীর দল।” (বুখারী ও মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে সাহাবীদের কোন কথা পৌছল। অতঃপর তিনি ভাষণ দিয়ে বললেন, “আমার নিকট জান্নাত ও জাহান্নাম পেশ করা হল। ফলে আমি আজকের মত ভাল ও মন্দ (একত্রে) কোন দিনই দেখিনি। যদি। তোমরা তা জানতে, যা আমি জানি, তাহলে কম হাসতে আর বেশি কাঁদতে।” সুতরাং সাহাবীদের জন্য সেদিনকার মত কঠিনতম দিন আর ছিল না। তাঁরা তাঁদের মাথা আবৃত করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। (বুখারী, মুসলিম)।
তিনি বলেছেন, “মুমিনদের রূহ জান্নাতের গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। পরিশেষে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দেহে ফিরিয়ে দেবেন।” (মালেক, নাসাঈ, বাইহাক্বী, সিঃ সহীহাহ ৯৯৫নং)
উক্ত হাদীস থেকে এ কথাও প্রমাণ হয় যে, কিয়ামত আসার পূর্বেও মুমিনদের রূহ জান্নাতে অবস্থান করে।
মহানবী (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহ যখন জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টি করলেন, তখন জিব্রাঈলকে জান্নাতের দিকে পাঠিয়ে বললেন, 'যাও, জান্নাত এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর। সুতরাং তিনি গেলেন এবং দর্শন করে ফিরে এসে বললেন, 'আপনার সম্মানের কসম! যে কেউ এর কথা শুনবে, সে এতে প্রবেশ করতে চাইবে। অতঃপর আল্লাহ জান্নাতকে কষ্টসাধ্য কর্মসমুহ দিয়ে ঘিরে দিতে আদেশ করলেন। তারপর আবার তাকে বললেন, যাও, জান্নাত এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর। সুতরাং তিনি গেলেন এবং দর্শন করে ফিরে এসে বললেন, আপনার সম্মানের কসম! আমার আশঙ্কা হয় যে, কেউ তাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
অতঃপর আল্লাহ তাকে জাহান্নামের দিকে পাঠিয়ে বললেন, 'যাও, জাহান্নাম এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর। সুতরাং তিনি গেলেন এবং দেখলেন, তার আগুনের এক অংশ অপর অংশের উপর চেপে রয়েছে। অতঃপর তিনি ফিরে এসে বললেন, ‘আপনার সম্মানের কসম! যে কেউ এর কথা শুনবে, সে এতে প্রবেশ করতে চাইবে না। তারপর জাহান্নামকে মনোলােভা জিনিসসমূহ দিয়ে ঘিরে দিতে আদেশ করলেন এবং পুনরায় তাকে বললেন, 'যাও, জাহান্নাম এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর। সুতরাং তিনি গেলেন এবং দর্শন করে ফিরে এসে বললেন, আপনার সম্মানের কসম! আমার আশঙ্কা হয় যে, কেউ পরিত্রাণ পাবে না, সবাই তাতে প্রবেশ করবে। (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, সঃ তারগীব ৩৬৬৯নং)
হাদীসগ্রন্থগুলিতে এই শ্রেণীর আরো হাদীস রয়েছে, যাতে প্রমাণ হয় যে, জান্নাত-জাহান্নাম সৃষ্টি করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
সুর ফুঁকার পরেও জান্নাত-জাহান্নাম অবশিষ্ট থাকবে, যেমন কিয়ামতে সূর্য থাকবে। অতএব এই সন্দেহে তা এখন সৃষ্ট নয় বলা যাবে না। বরং তা সৃষ্ট প্রস্তুত আছে। অবশ্য তার মধ্যে এমনও কিছু সাজ-সামগ্রী আছে, যা মহান আল্লাহ পরে সৃষ্টি করবেন।
বিচার দিনে মুমিনরা মাত্র যোহর থেকে আসরের সময়কাল অবধি অপেক্ষা করবে। অতঃপর তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে। সে কি আনন্দের দিন! যেদিন ফিরিশতাগণ তাদেরকে সম্মানের সাথে চির সুখময় বেহেশতের দিকে দলে দলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। কত কষ্ট ভোগা ও দেখার পর যখন জান্নাতের দরজায় পৌছবে, তখন ফিরিশতাগণ তাদেরকে সালাম ও স্বাগত জানাবেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا ۖ حَتَّىٰ إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ
অর্থাৎ, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করত, তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা জান্নাতের নিকট উপস্থিত হবে এবং জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হবে এবং তার রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, 'তোমাদের প্রতি সালাম (শান্তি), তোমরা সুখী হও এবং স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য জান্নাতে প্রবেশ কর। (যুমার ও ৭৩)।
এই জান্নাত হল সেই মু'মিনদের পুরস্কার, যাদের বিশ্বাস, কথা ও কর্ম শুদ্ধ ছিল। যাদের অন্তর ছিল নির্মল, কথা ছিল উত্তম এবং কর্ম ছিল সৎ।
তবে বেহেশতে পৌঁছনোর আগে কিছু কষ্ট স্বীকার অবশ্যই করতে হবে। জান্নাতে যাওয়ার আগে জাহান্নামের ওপর স্থাপিত পুল আছে। সেই পুল পার হয়ে যেতে হবে জান্নাতে। পুল পার হওয়ার আগে মুমিনদের আপোসের দেনা-পাওনার প্রতিশোধ দেওয়া-নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। জান্নাত প্রবেশের জন্য আমাদের শেষ নবী আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন।
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, বরকতময় মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন সকল মানুষকে একত্রিত করবেন। অতঃপর মুমিনগণ উঠে দাঁড়াবে এমনকি জান্নাতও তাদের নিকটবর্তী করে দেওয়া হবে (যার কারণে তাদের জান্নাতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে যাবে) সুতরাং তারা আদম (আঃ) এর নিকট আসবে অতঃপর বলবে হে আমাদের পিতা! আমাদের জন্য (আল্লাহর কাছে) জান্নাত খুলে দেওয়ার আবেদন করুন। তিনি বলবেনঃ (তোমরা কি জানো না যে,) একমাত্র তোমাদের পিতার ভুলই তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করেছে? সুতরাং আমি এর যোগ্য নই। তোমরা আমার ছেলে ইব্রাহিম (আঃ) এর নিকট যাও। নবী (ﷺ) বলেন, অতঃপর তারা ইব্রাহিম (আঃ) এর নিকট যাবে। ইব্রাহিম (আঃ) বলবেন, আমি এর উপযুক্ত নই। আমি আল্লাহর খলিল ছিলাম বটে কিন্তু এত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী নই। (অতএব) তোমরা মূসা (আঃ) এর নিকট যাও, যার সঙ্গে আল্লাহ সরাসরি কথা বলেছেন। ফলে তারা মূসার নিকট যাবে। কিন্তু তিনি বলবেন, আমি এর যোগ্য নই। তোমরা আল্লাহর কালেমা ও তার রূহ ঈসার নিকট যাও। কিন্তু ঈসাও বলবেন, আমি এর উপযুক্ত নই। অতঃপর তারা মোহাম্মদ (ﷺ) এর নিকট আসবে। সুতরাং তিনি দাঁড়াবেন। অতঃপর তাকে (দরজা খোলার) অনুমতি দেয়া হবে। আর আমানত ও আত্মীয়তার বন্ধনকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
সুতরাং উভয়ে পুল সিরাতের দুদিকে ডানে ও বামে দাঁড়িয়ে যাবে। অতঃপর তোমাদের প্রথম দল বিদ্যুৎ গতিতে (অতি দ্রুতবেগে) পুল পার হয়ে যাবে। আমি (আবূ হুরায়রা) বললাম, আমার পিতা মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক! বিদ্যুতের মতো গতিতে পার হওয়ার অর্থ কি? তিনি বললেন, তোমরা কি দেখনি যে বিদ্যুৎ কিভাবে চোখের পলকে যায় আসে? অতঃপর (দ্বিতীয় দল) বাতাসের মতো গতিতে পার হবে। অতঃপর (পরবর্তী দল) পাখির মতো এবং মানুষের দৌড়ের মতো গতিতে। তাদেরকে নিজ নিজ আমল (সিরাত্ব) পার করাবে। আর তোমাদের নবী পুল সিরাতের উপর দাঁড়িয়ে থাকবেন। তিনি বলবেন হে প্রভু! বাঁচাও, বাঁচাও! শেষ পর্যন্ত তাদের আমল সমূহ অক্ষম হয়ে পড়বে। এমনকি কোন ব্যক্তি পাছা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে (পুল-সিরাত) পার হবে। আর সিরাতের দুই পাশে আঁকড়া ঝুলে থাকবে। যাকে ধরার জন্য আদিষ্ট তাকে ধরে নেবে। অতঃপর (কিছু লোক) জখম হলেও বেঁচে যাবে। আর কিছু লোককে মুখ থুবড়ে জাহান্নামে ফেলা হবে। সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আবু হুরায়রার প্রাণ আছে! নিশ্চয় জাহান্নামের গভীরতা ৭০ বছরের (দূরত্বের পথ)। (মুসলিম ১৯৫ নং)
জান্নাতে সর্বপ্রথম যিনি প্রবেশাধিকার লাভ করবেন, তিনি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)। আর উম্মতসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে তারই উম্মত। এ হল মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত বিশেষ সম্মান।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমি সর্বপ্রথম জান্নাতের দরজায় করাঘাত করব। ...আমিই জান্নাতে প্রথম সুপারিশকারী হব।” (মুসলিম ১৯৭নং)
তিনি আরো বলেন, “আমি জান্নাতের নিকট এসে তার দরজা খুলতে বলব। দারোয়ান ফিরিশ্তা বলবেন, কে আপনি? আমি বলব, ‘মুহাম্মাদ। দারোয়ান বলবেন, আমি আদিষ্ট হয়েছি, যেন আপনার পূর্বে অন্য কারো জন্য দরজা না খুলি।” (ঐ)
তিনি আরো বলেন, “আমরা (দুনিয়ায়) সর্বশেষে এসেছি, (আখেরাতে) সর্বপ্রথম কিয়ামতে উপস্থিত হব এবং আমরাই সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করব।” (বুখারী ২৩৮, মুসলিম ৮৫৫নং)
এ উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম যে দলটি জান্নাতে প্রবেশ করবে, তা হল মুহাজিরীনের। (সিঃ সহীহাহ ৮৫৩নং)
সর্বপ্রথম একটি দল জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের চেহারা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল। যে দলের ঈমান হবে সর্বোচ্চ শিখরে, তাক্বওয়া ও পরহেযগারী হবে সবার শীর্ষে এবং আমল হবে সবচেয়ে উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “জান্নাতের প্রথম প্রবেশকারী দলটির আকৃতি পূর্ণিমা রাতের চাঁদের মত হবে। অতঃপর তাদের পরবর্তী দলটি আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় জ্যোতির্ময় হবে। তারা (জান্নাতে) পেশাব করবে না, পায়খানা করবে না, থুথ ফেলবে না, নাক ঝাড়বে না। তাদের চিরুণী হবে স্বর্ণের। তাদের ঘাম হবে কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধময়। তাদের ধুনুচিতে থাকবে সুগন্ধ কাঠ। তাদের স্ত্রী হবে আয়তলোচনা হুরগণ। তারা সকলেই একটি মানব কাঠামো, আদি পিতা আদমের আকৃতিতে হবে (যাদের উচ্চতা হবে) ষাট হাত পর্যন্ত।” (বুখারী-মুসলিম)
অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, “(জান্নাতে) তাদের পাত্র হবে স্বর্ণের, তাদের গায়ের ঘাম হবে কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধময়। তাদের প্রত্যেকের জন্য এমন দু’জন স্ত্রী থাকবে, যাদের সৌন্দর্যের দরুন মাংস ভেদ করে পায়ের নলার হাড়ের মজ্জা দেখা যাবে। তাদের মধ্যে কোন মতভেদ থাকবে না। পারস্পরিক বিদ্বেষ থাকবে না। তাদের সকলের অন্তর একটি অন্তরের মত হবে। তারা সকাল-সন্ধ্যায় তাসবীহ পাঠে রত থাকবে।” (ঐ)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “আমার কাছে সকল উম্মত পেশ করা হল। আমি দেখলাম, কোন নবীর সাথে কতিপয় (৩ থেকে ৭ জন অনুসারী) লোক রয়েছে। কোন নবীর সাথে এক অথবা দুইজন লোক রয়েছে। কোন নবীকে দেখলাম তার সাথে কেউ নেই। ইতিমধ্যে বিরাট একটি জামাআত আমার সামনে পেশ করা হল। আমি মনে করলাম, এটিই আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হল যে, এটি হল মূসা ও তাঁর উম্মতের জামাআত। কিন্তু আপনি অন্য দিগন্তে তাকান। অতঃপর তাকাতেই আরও একটি বিরাট জামাআত দেখতে পেলাম। আমাকে বলা হল যে, এটি হল আপনার উম্মত। আর তাদের সঙ্গে রয়েছে এমন ৭০ হাজার লোক, যারা বিনা হিসাব ও আযাবে বেহেস্ত প্রবেশ করবে।”
এ কথা বলে তিনি উঠে নিজ বাসায় প্রবেশ করলেন। এদিকে লোকেরা ঐ বেহেস্তী লোকদের ব্যাপারে বিভিন্ন আলোচনা শুরু করে দিল, যারা বিনা হিসাব ও আযাবে বেহেস্ত প্রবেশ করবে। কেউ কেউ বলল, ‘সম্ভবতঃ ঐ লোকেরা হল তারা, যারা আল্লাহর রসুল (ﷺ)-এর সাহাবা। কিছু লোক বলল, বরং সম্ভবতঃ ওরা হল তারা, যারা ইসলামে জন্মগ্রহণ করেছে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেনি। আরো অনেকে অনেক কিছু বলল। কিছু পরে আল্লাহর রসূল (ﷺ) তাদের নিকট বের হয়ে এসে বললেন, “তোমরা কি ব্যাপারে আলোচনা করছ?” তারা ব্যাপার খুলে বললে তিনি বললেন, “ওরা হল তারা, যারা ঝাড়ফুঁক করে না, ঝাড়ফুঁক করায় না এবং কোন জিনিসকে অশুভ লক্ষণ মনে করে না, বরং তারা কেবল আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে।”
এ কথা শুনে উক্কাশাহ ইবনে মিহসান উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন যে, (হে আল্লাহর রসূল!) আপনি আমার জন্য দুআ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে তাদের দলভুক্ত করে দেন!” তিনি বললেন, “তুমি তাদের মধ্যে একজন।” অতঃপর আর এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি আমার জন্যও দুআ করুন, যেন আল্লাহ আমাকেও তাদের দলভুক্ত করে দেন। তিনি বললেন, “উক্কাশাহ (এ ব্যাপারে) তোমার অগ্রগমন করেছে।” (বুখারী-মুসলিম)
শুধু সত্তর হাজারই নয়, বরং ঐ সত্তর হাজারের প্রত্যেক হাজারের সাথে আরো ৭০ হাজার করে (অর্থাৎ ৪৯ লক্ষ) মুসলিম জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ লাভ করবে। (সঃ জামেঃ ৬৯৮৮নং)
অন্য বর্ণনা মতে ঐ সত্তর হাজারের প্রত্যেক ব্যাক্তির সাথে আরো সত্তর হাজার করে মুসলিম জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আহমাদ, সিঃ সহীহাহ ১৪৮৪নং) অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার ৪৯০ কোটি মানুষ বিনা হিসাব ও আযাবে জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে।
বরং প্রথমোক্ত বর্ণনা অনুসারে মহান আল্লাহ্র তিন অঞ্জলি অতিরিক্ত মুসলিমকে বিনা হিসাব ও আযাবে জান্নাত প্রবেশের অধিকার দেওয়া হবে। আর তার সংখ্যা কেবল তিনিই জানেন।
সম্ভবতঃ এই অগ্রগামীদের কথাই মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে বলেছেন,
وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ (10) أُولَٰئِكَ الْمُقَرَّبُونَ (11) فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ (12) ثُلَّةٌ مِّنَ الْأَوَّلِينَ (13) وَقَلِيلٌ مِّنَ الْآخِرِينَ (14)
অর্থাৎ, আর অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তী। তারাই হবে নৈকট্যপ্রাপ্ত। তারা থাকবে সুখময় জান্নাতসমূহে। বহুসংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য হতে এবং অল্প সংখ্যক হবে পরবর্তীদের মধ্য হতে। (ওয়াকিয়াঃ ১০-১৪)
যেহেতু গরীবদের হিসাব কম; তাদের যাকাত নেই, হজ্জ নেই, মালের কোন হিসাব-নিকাশ নেই, তাই তারা নির্ঝঞ্জটে ধনীদের আগে আগেই জান্নাতে চলে যাবে। কিন্তু কতদিন আগে?
এক বর্ণনানুসারে ৪০ বছর আগে।
আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) বলেছেনঃ মুহাজিরদের দরিদ্রশ্রেনীর লোকেরা ধনশালীদের চেয়ে চল্লিশ বছর পূর্বে কিয়ামতের দিন জান্নাতে প্রবেশ করবে। (মুসলিম ২৯৭৯)
অন্য এক বর্ণনা মতে ৫০০ বছর আগে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ গরীব মুমিনরা ধনীদের পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিযী ২৩৫১ নং)
আসলে ধনী ও গরীবদের অবস্থা ভেদে সময়ের এই পার্থক্য হবে। সুতরাং যে গরীব সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং যে ধনী সবশেষে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের উভয়ের সময়ের ব্যাবধান হবে ৫০০ বছর। আর যে গরীব সবশেষে জান্নাত প্রবেশ করবে এবং যে ধনী সর্বপ্রথম জান্নাত প্রবেশ করবে, তাদের উভয়ের সময়ের ব্যবধান হবে ৪০ বছর। আর আল্লাহই ভাল জানেন।
যে গোনাহগার মু’মিনরা তওবা না করেই মারা যাবে এবং আল্লাহর ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হবে, আল্লাহর ইচ্ছায় তারা জাহান্নামে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত নির্দিষ্ট শাস্তি ভোগ করবে। তাদেরকে সরাসরি জাহান্নামে দেওয়া হবে অথবা পুলসিরাত পার হওয়ার সময় পুল থেকে পিছল কেটে জাহান্নামে পতিত হবে। কেউ সুপারিশের ফলে, কেউ মহান আল্লাহর দয়ায়, আবার কেউ শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে তওহীদের ফযীলতে জান্নাতে স্থান লাভ করবে। কিন্তু তাদের মধ্যে জাহান্নামের ছাপ থেকে যাবে এবং জান্নাতে তারা জাহান্নামী’ বলে পরিচিত থাকবে। (বুখারী)
জান্নাতে প্রবেশকারী সর্বশেষ ব্যক্তি অথবা সর্বনিম্ন মানের জান্নাতীও কিন্তু ছোট জান্নাতের বা কম সুখের অধিকারী হবে না। এ ব্যাপারে মহানবী (ﷺ) বলেছেন, “সর্বশেষে যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে বের হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তার সম্পর্কে অবশ্যই আমার জানা আছে। এক ব্যক্তি হামাগুড়ি দিয়ে (বা বুকে ভর দিয়ে) চলে জাহান্নাম থেকে বের হবে। তখন আল্লাহ আযযা অজাল্ল বলবেন, যাও জান্নাতে প্রবেশ কর। সুতরাং সে জান্নাতের কাছে এলে তার ধারণা হবে যে, জান্নাত পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে সে ফিরে এসে বলবে, হে প্রভু! জান্নাত তো পরিপূর্ণ দেখলাম। আল্লাহ আযযা অজাল্ল বলবেন, 'যাও, জান্নাতে প্রবেশ কর। তখন সে জান্নাতের কাছে এলে তার ধারণা হবে যে, জান্নাত তো ভরে গেছে। তাই সে আবার ফিরে এসে বলবে, হে প্রভু! জান্নাত তো ভরতি দেখলাম। তখন আল্লাহ আযযা অজাল্ল বলবেন, যাও জান্নাতে প্রবেশ কর। তোমার জন্য থাকল পৃথিবীর সমতুল্য এবং তার দশগুণ (পরিমাণ বিশাল জান্নাত)! অথবা তোমার জন্য পৃথিবীর দশগুণ (পরিমাণ বিশাল জান্নাত রইল)! তখন সে বলবে, হে প্রভু! তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছ? অথবা আমার সাথে হাসি-মজাক করছ অথচ তুমি বাদশাহ (হাসি-ঠাট্টা তোমাকে শোভা দেয় না)।” বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এমনভাবে হাঁসতে দেখলাম যে, তাঁর চোয়ালের দাঁতগুলি প্রকাশিত হয়ে গেল। তিনি বললেন, “এ হল সর্বনিম্ন মানের জান্নাতী।” (বুখারী-মুসলিম)
এ জান্নাতী যখন জান্নাতের বাসস্থানে প্রবেশ করবে, তখন তার দু’টি হুরী স্ত্রী তার নিকট এসে বলবে, সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তোমাকে আমাদের জন্য এবং আমাদেরকে তোমার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছেন। তখন সে বলবে, আমাকে যা দেওয়া হয়েছে, তা অন্য কাউকে দেওয়া হয়নি। (মুসলিম)।
মানুষের ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে আদি পিতা আদম (আঃ) ও মাতা হাওয়াকে জান্নাতেই রাখা হয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেন,
وَقُلْنَا يَا آدَمُ اسْكُنْ أَنتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ
অর্থাৎ, আমি বললাম, হে আদম তুমি তোমার স্ত্রীসহ বেহেস্তে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর, কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না; হলে তোমরা অনাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (বাক্বারাহঃ ৩৫)
وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِينَ
অর্থাৎ, আর বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর। কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (আরাফ ও ১৯)
কিন্তু শয়তানের প্রলোভন ও চক্রান্তে পড়ে আদম ও হাওয়া আল্লাহর অবাধ্য হয়ে গেলেন। ফলে তার শাস্তি স্বরূপ উভয়কে সেই সুখময় জান্নাত থেকে দুঃখময় এই মাটির ধরাধামে নামিয়ে দেওয়া হল। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ عَهِدْنَا إِلَىٰ آدَمَ مِن قَبْلُ فَنَسِيَ وَلَمْ نَجِدْ لَهُ عَزْمًا (115) وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَىٰ (116) فَقُلْنَا يَا آدَمُ إِنَّ هَٰذَا عَدُوٌّ لَّكَ وَلِزَوْجِكَ فَلَا يُخْرِجَنَّكُمَا مِنَ الْجَنَّةِ فَتَشْقَىٰ (117) إِنَّ لَكَ أَلَّا تَجُوعَ فِيهَا وَلَا تَعْرَىٰ (118) وَأَنَّكَ لَا تَظْمَأُ فِيهَا وَلَا تَضْحَىٰ (119) فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ الشَّيْطَانُ قَالَ يَا آدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَىٰ شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَّا يَبْلَىٰ (120) فَأَكَلَا مِنْهَا فَبَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِن وَرَقِ الْجَنَّةِ ۚ وَعَصَىٰ آدَمُ رَبَّهُ فَغَوَىٰ (121) ثُمَّ اجْتَبَاهُ رَبُّهُ فَتَابَ عَلَيْهِ وَهَدَىٰ (122) قَالَ اهْبِطَا مِنْهَا جَمِيعًا ۖ بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ ۖ فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَىٰ (123)
অর্থাৎ, আমি তো ইতিপূর্বে আদমের প্রতি নির্দেশ দান করেছিলাম। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল; আমি তাকে দৃঢ়সংকল্প পাইনি। (স্মরণ কর,) যখন আমি ফিরিশ্তাগণকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদাহ কর’, তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই সিজদাহ করল; সে অমান্য করল। অতঃপর আমি বললাম, হে আদম! এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু, সুতরাং সে যেন কিছুতেই তোমাদেরকে জান্নাত হতে বের করে না দেয়, দিলে তোমরা কষ্ট পাবে। তোমার জন্য এটাই থাকল যে, তুমি জান্নাতে ক্ষুধার্ত হবে না এবং নগ্নও হবে না। সেখানে পিপাসার্ত হবে না এবং রোদ্র-ক্লিষ্টও হবে না। অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল। সে বলল, 'হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষ ও অক্ষয় রাজ্যের কথা?’ অতঃপর তারা তা হতে ভক্ষণ করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা উদ্যানের বৃক্ষপত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। আদম তার প্রতিপালকের অবাধ্য হল; ফলে সে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল। এরপর তার প্রতিপালক তাকে মনোনীত করলেন। সুতরাং তিনি তার তওবা কবুল করলেন ও তাকে পথ নির্দেশ করলেন। তিনি বললেন, তোমরা একে অপরের শত্রুরূপে একই সঙ্গে জান্নাত হতে নেমে যাও। পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট সৎপথের নির্দেশ এলে, যে আমার পথনির্দেশ অনুসরণ করবে, সে বিপথগামী হবে না এবং দুঃখ-কষ্টও পাবে না। (ত্বাহাঃ ১১৫-১২৩)
আমাদের নবী (ﷺ) মিরাজের রাত্রে জান্নাত দর্শন করেছেন। এ ছাড়া শহীদগণ কিয়ামত হওয়ার পূর্বেই জান্নাতে বসবাস করেন। মাসরুক হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ)-কে (وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ) (অর্থাৎ, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনই মৃত মনে করো না, বরং তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।) (আলে ইমরানঃ ১৬৯) এই আয়াত প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘শোন! আমরাও এ বিষয়ে (নবী (ﷺ)-কে) জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “তাদের (শহীদদের) আত্মাসমূহ সবুজ পক্ষীকুলের দেহ মধ্যে অবস্থান করবে। ঐ পক্ষীকুলের অবস্থানক্ষেত্র হল (আল্লাহর) আরশে ঝুলন্ত দীপাবলী। তারা বেহেশতে যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করে বেড়াবে। অতঃপর পুনরায় ঐ দীপাবলীতে ফিরে এসে আশ্রয় নেবে। একদা তাদের প্রতিপালক তাদের প্রতি দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, 'তোমরা কি (আরো) কিছু কামনা কর? তারা বলল, 'আমরা আর কী কামনা করব? আমরা তো বেহেস্তে যেখানে খুশী সেখানে বিচরণ করে বেড়াচ্ছি!’ (আল্লাহ) অনুরূপভাবে তাদেরকে তিনবার প্রশ্ন করলেন। অতঃপর যখন তারা দেখল যে, কিছু না চাইলে তাদেরকে ছাড়াই হবে না, তখন তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা কামনা এই করি যে, আপনি আমাদের আত্মাসমূহকে আমাদের নিজ নিজ দেহে ফিরিয়ে দিন, যাতে আমরা আপনার রাহে দ্বিতীয়বার নিহত হয়ে আসতে পারি। অতঃপর আল্লাহ যখন দেখবেন যে, তাদের আর কোন প্রয়োজন (কামনা বা সাধ) নেই, তখন তাদেরকে স্ব-অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হবে।” (মুসলিম ১৮৮৭)।