সকল প্রশংসা বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি সপ্ত আসমান ও জমিনসমূহের ধারণকারী এবং সকল মখলুকের ব্যবস্থাপক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক, তার কোনো শরীক নেই। তিনি সত্য ও সুস্পষ্ট মালিক। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ তার বান্দা, সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত রাসূল। আল্লাহ তার উপর, তার পরিবারবর্গ ও তার সকল সাথীর উপর সালাত ও সালাম নাযিল করুন।
অতঃপর, বক্ষ্যমাণ নিবন্ধ বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত সংক্ষিপ্ত এক রচনা, যা বর্তমান বিশ্বে আত্মপ্রকাশকারী ও অনেক ইসলামী দেশে শিকড় গেড়ে বসা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নামক বাতিল গোষ্ঠী ও ফেরকা সম্পর্কে আলেমগণ লিখেছেন। এ মতবাদ ও তাদের ধারক-বাহকদের কথাবার্তা থেকে যদিও কখনো কখনো প্রকাশ্যে মনে হয় যে এরা তাদের স্বজাতির প্রতি মিল-মহব্বত ও দরদী; কিন্তু প্রায়শঃই তাদের অপ্রকাশ্য মূল উদ্দেশ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে, আর তা হচ্ছে, ইসলাম ও তার শিক্ষার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও হিংসা। ইসলামী আইন, ইবাদত, লেনদেন ও আচার-আচরণ এ মতবাদের চক্ষুশূল। প্রবৃত্তির অনুসরণ ও পার্থিব স্বার্থ হাসিল করাই তার প্রধান লক্ষ্য। “রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক কর” তার শ্লোগান। এ মতবাদ ও তার ধ্বজাধারীরা দ্বীনদার লোকদেরকে রক্ষণশীল, প্রগতির অন্তরায় ও পশ্চাৎগামী বলে গালমন্দ করে। সন্দেহ নেই, এ মতবাদে বিশ্বাসীরা মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রথম যুগের মুনাফিকদের থেকেও বেশী ক্ষতিকর, বরং পথভ্রষ্ট যে কোনো দল অপেক্ষা তারা অধিক খারাপ।
লেখক এ ফেরকার অধিকাংশ লক্ষ্য ও তার প্রধান অনিষ্টগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন- আল্লাহ তাকে তৌফিক দান করুন-।
এ মহাবিপদ থেকে নাজাতের জন্যে আত্মরক্ষার ঢাল সংগ্রহ করা, দুশমনকে চেনা, নিজেকে ও নিজের ভাইদেরকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র ন্যায় ভ্রান্ত মতবাদ থেকে দূরে রাখা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা তৌফিকদাতা ও সঠিক পথে পরিচালনাকারী। আল্লাহ তা‘আলা সালাত ও সালাম নাযিল করুন মুহাম্মদ, তার পরিবারবর্গ ও তার সকল সাথীর উপর।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান আল-জাবরিন।
সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, সালাত ও সালাম নাযিল হোক তার রাসূল মুহাম্মদের উপর, তার পরিবারবর্গ ও তার সকল সাথীর উপর। অতঃপর,
মুসলিম জাতি বর্তমান সময়ে তার ইতিহাসের সবচেয়ে দুরবস্থা পার করছে, সে আজ দুর্বল-লাঞ্ছিত; তার ঘাড়ে চেপে বসেছে নিকৃষ্ট জাতি ইয়াহূদী, খৃস্টান ও মূর্তিপূজারিরা। কারণ তারা নিজেদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত, যে দ্বীনকে আল্লাহ অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসার জন্য হিদায়েত ও পথপ্রদর্শক স্বরূপ নাযিল করেছেন-সে দিন থেকে তারা বিচ্যুত, এটাই একমাত্র কারণ।
দ্বীন থেকে এ বিচ্যুতি শুরুতে মুসলিম উম্মাহর এক শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন তা সম্প্রসারিত হয়ে এ মুসলিম জাতির বিরাট সংখ্যক লোকের মাঝে বিস্তার লাভ করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতার ফলে জাতীয় পর্যায়, আন্তর্জাতিক পরিসর, গবেষণার জগত ও মিডিয়ার রাজ্যে দিনদিন ইসলাম থেকে দূরত্ব বাড়ছে। যার ফলে মুসলিমরা আজ এতটাই বিচ্যুত যে, হিদায়েত ও তাকওয়ার মূল উৎস দ্বীনের দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে আসার প্রয়োজন বোধ করছে না।
এ জন্য ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও তার কুফল’ নামক সংক্ষিপ্ত নিবন্ধটি মুসলিম দেশে প্রচার করছি, হয়তো সে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রকৃত অবস্থা, মূল উৎস, দ্বীনের উপর তার কঠিন আঘাত ও ধ্বংসাত্মক প্রভাব সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে সজাগ করবে, অতঃপর তারা তা থেকে দ্রুত আত্মরক্ষা গ্রহণ করবে ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিবে। এ মতবাদ ও তার অনুসারীদের প্রত্যাখ্যান করবে এবং তাদেরকে আল্লাহর ইচ্ছায় নির্মূল করতে পারবে। তাহলে আমরা আমাদের দ্বীনের দিকে ফিরে যেতে পারব, আমাদের হারানো সম্মান ফিরে পাব, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَلِلَّهِ ٱلۡعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِۦ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ ٨ ﴾ [المنافقون: ٨]
“ইয্যত একমাত্র আল্লাহর জন্য, তার রাসূলের জন্য ও মুমিনদের জন্যই”।[1]
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে সঠিক পথ ও পদ্ধতির অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন।
মুহাম্মদ শাকের আশ-শারীফমক্কাতুল মুকাররামাহ
যে মতবাদটিকে ইংরেজিতে secularism বলা হয় তার আরবি প্রতিশব্দ হিসেবে বহুলভাবে علماني [‘আলমানি] শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর বাংলায় এর (সত্যের অপলাপকৃত) অনুবাদ করা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ শব্দ দিয়ে। তাহলে দেখা যাক সে সেকুলারিজম (বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা) কী? ছোট্ট একটি প্রশ্ন, কিন্তু তার উত্তর চাই স্পষ্ট, নিখুঁত ও বিস্তারিত। এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রত্যেক মুসলিমের জানা-থাকা জরুরি। আল্লাহর মেহেরবানী যে, এ পর্যন্ত সেকুলারিজমের উপর বহু গ্রন্থ লিখা হয়েছে, আমাদের কর্তব্য শুধু জানা ও আমল করা।
এবার প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করি, তবে এ জন্য আমাদের বেশী কষ্ট করতে হবে না, কারণ যেখানে ‘সেকুলারিজম’ বা তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ মতবাদের জন্ম, সে পাশ্চাত্য দেশসমূহে লিখিত অভিধানগুলো আমাদেরকে সেটার অর্থ খোজা ও সন্ধান করার কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে। ইংরেজি অভিধানে secularism শব্দের নিম্নরূপ অর্থ এসেছে:
১. পার্থিববাদী অথবা বস্তুবাদী।
২. ধর্মভিত্তিক বা আধ্যাত্মিক নয়।
৩. দ্বীনপালনকারী নয়, দুনিয়াবিমুখ নয়[1]।
একই অভিধানে secularism শব্দের সংজ্ঞায় এসেছে:
“secularism এমন একটি দর্শন, যার বক্তব্য হচ্ছে, চরিত্র-নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্মীয় নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না”।
‘ব্রিটিশ বিশ্বকোষ’-এ আমরা দেখি, সেখানে সেকুলারিজম সম্পর্কে বলা হয়েছে: “সেকুলারিজম একটি সামাজিক আন্দোলন, যার একমাত্র লক্ষ্য মানুষদেরকে পরকালমুখী থেকে ফিরিয়ে এনে দুনিয়ামুখী করা”।
Encyclopedia Britanica নামীয় ব্রিটিশ বিশ্বকোষে Atheism বা ‘নাস্তিকতা’ শিরোনামের অধীন secularism এর আলোচনা এসেছে। তাতে Atheism তথা নাস্তিকতাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
১. তাত্ত্বিক নাস্তিকতা (إلحاد نظري)
২. ব্যবহারিক নাস্তিকতা (إلحاد عملي)।
‘বিশ্বকোষ’ সেকুলারিজমকে দ্বিতীয় প্রকার নাস্তিকতার অন্তর্ভুক্ত করেছে।[2] এ আলোচনা থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হল:
এক. সেকুলারিজম একটি কুফরি দর্শন, তার একমাত্র লক্ষ্য দুনিয়াকে দ্বীনের প্রভাব মুক্ত করা। সেকুলারিজম একটি মতবাদ, তার কাজ হচ্ছে পার্থিব জগতের সকল বিষয়কে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ থেকে মুক্ত রেখে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, আদর্শিক ও পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার নিজের তৈরি বিধান দেওয়া ও সকল স্তরে নেতৃত্ব প্রদান করা।
দুই. সেকুলারিজমের সাথে জ্ঞান বা বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই, যেমন কতক কুচক্রী মানুষদেরকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার জন্য বলে, সেকুলারিজম অর্থ ‘ব্যবহারিক বিজ্ঞানের উপর গুরুত্বারোপ ও তার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা’। এ বক্তব্যের অসারতা ও সত্য গোপন করার অপকৌশল আমাদের বর্ণিত অর্থ থেকে স্পষ্ট, যা আমরা গ্রহণ করেছি ‘সেকুলারিজম’ এর সুতিকাগার থেকে, যে সমাজে তার জন্ম ও পরিচর্যা হয়েছে।তাই ‘সেকুলারিজম’ এর অর্থ যদি করা হয় ধর্মহীনতা, তাহলে তার সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা ও সঠিক অর্থ প্রকাশ পাবে এবং তাতে অপলাপের কিছু থাকবে না, বরং যথার্থ অর্থই স্পষ্ট হবে।
[2] নাস্তিকতার উপর আভিধানিক বিশ্লেষণ ড. মুহাম্মদ যায়ন আল-হাদি রচিতنشأة العلمانية বা ‘সেকুলারিজম এর উৎপত্তি’ গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
খৃস্টীয় পাশ্চাত্য সমাজ একসময় ধর্মীয় দোদুল্যতায় ভূগছিল, যা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের উর্বর ভূমি ও অনুকূল পরিবেশ, তখন সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ নামক বিষবৃক্ষটি জন্ম নেয় ও বেড়ে উঠে। ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া প্রসিদ্ধ বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে সর্বপ্রথম ফ্রান্সই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের উপর রাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড় করায়। এ মতবাদটি যদিও তার অভ্যন্তরে নাস্তিকতা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে দ্বীনকে দূরে সরিয়ে রাখা, এমনকি দ্বীনের সাথে শত্রুতা-বিদ্বেষ ও দ্বীন বিরোধিতা ইত্যাদি মারাত্মক চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড লালন করত, তারপরও তখনকার সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের আত্মপ্রকাশ ও তার অনুশীলন অনাকাঙ্ক্ষিত ও অদ্ভুত ছিল না, কারণ;
প্রথমত: সে-সময় তাদের ঈসায়ী দ্বীন আল্লাহর নিখাদ ওহী ভিত্তিক ছিল না, যা আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দা ও রাসূল ঈসা ইবনে মারয়াম ‘আলাইহিস সালামের নিকট প্রেরণ করেছেন, বরং তাতে বিকৃতি ও মিথ্যার হাত অন্যায় হস্তক্ষেপ করেছিল, তাই তাদের দ্বীন ছিল বিকৃত, পরিবর্তিত, বর্ধিত ও হ্রাসকৃত, যা মানব কল্যাণের বিপরীত অবস্থান নিয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাথেও তা ছিল সাংঘর্ষিক। সে-সময় ধর্মীয় দায়িত্ব আঞ্জাম দানকারী গির্জাগুলো তাদের সন্ন্যাসী ও সংসারবিরাগীদের বিকৃতি ও পরিবর্তনকে শুধু সমর্থন নয়, দ্বীন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যা পালন করা ও যার উপর অটল থাকা তখন প্রত্যেকের উপর ফরয ছিল। বৈজ্ঞানিক ও গবেষকদের বিরুদ্ধে গির্জায় অভিযোগ করা হয়, ফলে গির্জা তাদেরকে শাস্তি দেয়, কারণ তারা বিকৃত দ্বীনের বিপরীত আবিষ্কার করেছে, তাদেরকে যিন্দিক ও নাস্তিক বলে অপবাদ দেয়, অতঃপর তাদের অনেককে করা হয়েছে হত্যা, আবার অনেককে দেওয়া হয়েছে জ্বালিয়ে এবং তাদের বহুসংখ্যককে করা হয়েছে জেলে বন্দি।
দ্বিতীয়ত -খৃস্টানদের ধর্মীয় মুখপাত্র- গির্জাগুলো অত্যাচারী বাদশাহদের সাথে অনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, তাদেরকে পবিত্র ও নিষ্পাপ সত্ত্বা হিসেবে আখ্যায়িত করে। তারা প্রজাদের উপর যে জুলম ও অত্যাচার করত, গির্জাগুলো সেগুলোর বৈধতা প্রদান করত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এটাই প্রকৃত ধর্ম, যার শরণাপন্ন হওয়া ও যার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা সবার জন্য জরুরি।
তাই মানুষ গির্জার জেলখানা ও তার অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতির উপায় খুঁজে। তখন খৃস্টীয় দ্বীন থেকে বের হওয়া, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা, জীবন-ঘনিষ্ঠ সকল বিষয় যেমন রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও আদর্শ ইত্যাদি থেকে তাকে দূরে রাখা, বরং বিতাড়িত করা ব্যতীত মুক্তির কোনো উপায় ছিল না, কারণ তা জালেমদের পক্ষাবলম্বন ও বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
হায়! তাদের জন্য কতই না ভালো হত, যদি তারা সেই বিকৃত খৃস্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করত, কিন্তু তারা সে বিকৃত খৃস্টান ধর্মের উপর বিরক্ত হয়ে সকল দ্বীনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ আত্মপ্রকাশ করে।
খৃস্টীয় পাশ্চাত্য সমাজে এ জাতীয় ঘটনার আত্মপ্রকাশ আশ্চর্য কোনো বিষয় নয়, তবে ইসলামে তার কোনো সুযোগ নেই, বরং কল্পনা করাও অসম্ভব। কারণ ইসলামে রয়েছে আল্লাহর ওহী, যার অগ্র-পশ্চাৎ কোনো দিক থেকে বাতিল অনুপ্রবেশ করতে পারে না। এ দ্বীন বিকৃতি ও পরিবর্তন মুক্ত, তাতে কোনো বিষয় বৃদ্ধি কিংবা হ্রাস করা সম্ভব নয়, সে কাউকে পরোয়া করে না, হোক সে রাজা কিংবা প্রজা। সবাই তার শরীয়তের সামনে সমান। এ দ্বীন মানুষের প্রকৃত স্বার্থ সংরক্ষণকারী, এতে একটি বিধান নেই যা তাদের স্বার্থ পরিপন্থী। এ দ্বীন (ইসলাম) জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহ প্রদান করে। এতে প্রমাণিত এমন কোনো বিষয় নেই, যা বিজ্ঞানের প্রমাণিত বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক। অতএব দ্বীনে ইসলাম পুরোটাই সত্য, পুরো দ্বীনই কল্যাণ, পুরো দ্বীনই ন্যায় ও ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত। এ থেকে আমরা বলতে পারি, পাশ্চাত্য সমাজে দ্বীনের প্রতি বিদ্বেষ ও অনীহা থেকে যে চিন্তা ও মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে, ইসলামী দেশে কখনো তা প্রকাশ পেত না, বরং মুসলিম দেশের কেউ তা শ্রবণও করত না, যদি না থাকত সংঘবদ্ধ স্নায়ুযুদ্ধ, যা ইসলামের নিষ্ক্রিয় ও নিষ্প্রভ হালতে ঈমান-শূন্য কতক অন্তর ও সুস্থ চিন্তা-শূন্য কিছু বিবেককে শিকার করতে সক্ষম হয়েছে।
মুসলিম দেশে বসবাসকারী খৃস্টানরাও বিভিন্ন মিডিয়া ও প্রচার-যন্ত্রের সাহায্যে সেকুলার (ধর্মনিরপেক্ষ) মতবাদ আমদানি ও প্রসারের ক্ষেত্রে কম-যায়নি, তাদেরও রয়েছে বড় ভূমিকা ও ক্ষতিকর প্রভাব। অনুরূপ সেকুলারিজম প্রচারের ক্ষেত্রে মুসলিম শিক্ষানবিশরাও ভূমিকা রেখেছে প্রচুর, যারা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের জন্য পাশ্চাত্য দেশসমূহে গিয়েছিল। সেখানে তারা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ও তার আবিষ্কার দেখে ফেতনায় পতিত হয়, অতঃপর সে সকল দেশের প্রচলিত প্রথা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আচার-আচরণ বাস্তবায়ন ও প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে নিজ দেশে ফিরে আসে। অতঃপর এক শ্রেণির লোক সে সব (বিদেশ ফেরৎ তথাকথিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধ্বজাধারী) লোকদের পেশ করা এ সব তথ্য ও নীতিগুলো গ্রহণযোগ্য হিসেবে লুফে নেয়, তাদের ধারণা এরাই উপকারী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক-বাহক ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। বস্তুত এসব বিদেশ ফেরৎ লোকদের দেখা অভ্যাস, প্রথা ও পদ্ধতি যেগুলো তারা খুব বড় ও মহত চিন্তাধারা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে তা এমন সমাজের-যার সাথে দ্বীনের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই।
এ সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে আমরা মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অনুপ্রবেশ সম্পর্কে জানতে পারলাম, যা আমাদেরকে আরো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে:
এক. মুসলিম দেশে বাসকারী খৃস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা আমাদের জন্য ক্ষতিকর, তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই তাদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, আল্লাহ তাদেরকে যে স্থানে রাখতে বলেছেন আমরা তাদেরকে সেখানেই রাখব। তাদেরকে মুসলিম দেশে সামান্যতম কর্তৃত্ব ও পরামর্শ প্রদানের সুযোগ দেব না। সকল মিডিয়া, প্রচারযন্ত্র ও গণমাধ্যমগুলোর দরজা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য উন্মুক্ত করে রাখব না, বরং বন্ধ করে রাখব, যেন তারা মুসলিমদের মাঝে তাদের বিষ ছড়ানোর সুযোগ না পায়। কিন্তু এ কাজ করবে কে! অধিকন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান সেকুলারিজমের বিষ ছড়ানোর জন্য তাদেরকে বিভিন্ন পদ ও পদবী দিয়ে রেখেছে! আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট, তিনিই আমাদের অভিভাবক।
দুই. শিক্ষানবিশদের বহির্বিশ্বে পাঠানোর ঝুঁকিও অনেক। তার পরিণতি ভয়াবহ। অনেক মুসলিম সন্তান এমন চেহারা ও অন্তর নিয়ে সেখান থেকে এসেছে যা নিয়ে সে সেখানে যায়নি। অতএব বস্তুগত জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য সেখানে যাওয়া যখন ঝুঁকিপূর্ণ, তখন দ্বীনি ইলম শিখার জন্য সেখানে যাওয়া কিভাবে নিরাপদ, বিশেষ করে আরবি কিংবা ইসলামী বিষয়াদি শেখার জন্য?! আরবি কি আমাদের মুসলিমদের ভাষা, নাকি তাদের ভাষা?! কুরআনুল কারিম নাযিল হয়েছে আমাদের ভাষায়, না তাদের ভাষায়?[1]!
এটা কি কখনো সম্ভব বা যুক্তি সঙ্গত যে, একজন মুসলিম ইসলামের সঠিক জ্ঞান ও শরীয়তের বিদ্যার্জন করবে এমন লোকদের থেকে, যারা কট্টর কাফের, ইসলাম ও মুসলিমের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণকারী?!
>সেকুলারিজমের দু’টি রূপ রয়েছে। যার একটি অপরটি থেকে জঘন্য:
প্রথম রূপ: সরাসরি নাস্তিকতা: এ প্রকার সেকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতা) দ্বীনকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান ও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। তা ধর্মীয় কোনো বিষয় স্বীকার করে না, বরং যারা আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি ঈমানের দাওয়াত দেয়, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ জাতীয় সেকুলারিজমের (ধর্মনিরপেক্ষতার) অনুসারীরা নিজেদের কুফরি, অশ্লীলতা ও কুকর্মে আত্মগর্বী ও অহংকারী। তাদের কুফরির ফয়সালা করা সকল মুসলিমের পক্ষে সহজ। আলহামদুলিল্লাহ তাদের বিষয়টি মুসলিমদের নিকট স্পষ্ট। কোনো মুসলিম তাদের দিকে ধাবিত হয় না, তবে যে দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় সে ব্যতীত। এ ধরনের সেকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতা) জনসাধারণের নিকট কম বিপজ্জনক, তারা সাধারণ মানুষকে সহসা ধোঁকায় ফেলতে সক্ষম নয়, তবে দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, মুমিনদের সাথে শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করা এবং তাদেরকে কষ্ট দেওয়া, অথবা জেল দেওয়া অথবা হত্যা করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারাও কম ক্ষতিকর নয়।
দ্বিতীয় রূপ: পরোক্ষ নাস্তিকতা[1]:
এ প্রকার নাস্তিকতা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না, তাত্ত্বিকভাবে তার উপর ঈমান আনে, তবে দুনিয়ার কোনো বিষয়ে দ্বীনের কর্তৃত্ব মানে না। তাদের শ্লোগান দুনিয়াকে দ্বীন থেকে পৃথক কর। জনসাধারণকে ধোঁকায় ফেলা ও বিপথগামী করার ক্ষেত্রে এ প্রকার নাস্তিকতা বা সেকুলারিজম (তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা) অপেক্ষাকৃত বেশি বিপজ্জনক। কারণ তারা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার ও তার দ্বীনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে না, তাই তাদের কুফরির প্রকৃত অবস্থা অনেক মুসলিমের নিকট প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট থাকে।[2] দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও পর্যাপ্ত ইলম না থাকার কারণে তারা সেকুলারিজমকে (তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে) কুফরি বলে মনে করে না। এ কারণে মুসলিম দেশসমূহের অধিকাংশ সরকার সেকুলার (তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ) মতবাদের অনুসারী। অনেক, বরং অধিকাংশ মুসলিম তাদের হাকিকত জানে না।
এ প্রকার সেকুলারিজমের (ধর্মনিরপেক্ষতার) অনুসারী সংগঠনগুলো দ্বীন ও দ্বীনের দাওয়াত প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও নিশ্চিত থাকে, কেউ তাদের কাফের ও দ্বীন থেকে খারিজ বলবে না। কারণ, তারা প্রথম প্রকারের ন্যায় প্রকাশ্য নাস্তিকতাসহ আত্মপ্রকাশ করেনি। তাদের কাফের না বলা মুসলিমদের মূর্খতার প্রমাণ। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি আমাদেরকে ও সকল মুসলিমকে সঠিক জ্ঞান দান করুন। মুসলিম উম্মতকে দ্বীন বুঝার তৌফিক দিন, তারা যেন এসব সংস্থা ও সংগঠন থেকে আত্মরক্ষা গ্রহণ করে।
অতএব দ্বীন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কোনো মুসলিম সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতাবলম্বীদের কথা বা লেখনীতে আল্লাহর নাম অথবা রাসূলের নাম অথবা ইসলামের নাম শুনে বা দেখে আশ্চর্য হয় না[3], বরং তারাই আশ্চর্য হয় ও বিস্ময় প্রকাশ করে, যারা তাদের প্রকৃত অবস্থা জানে না।
মোদ্দাকথা:
উভয় প্রকার সেকুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতা) স্পষ্ট কুফরি, এতে কোনো সন্দেহ ও সংশয় নেই। যদি কেউ উল্লেখিত কোনো প্রকার ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ মনেপ্রাণে মেনে নেয়, সে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত ও মুরতাদ হয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুন। কারণ, ইসলামই হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন তথা জীবন বিধান, মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার স্পষ্ট বিধান রয়েছে, হোক তা আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চারিত্রিক বা সামাজিক কোনো শাখা। ইসলাম কখনো কোনো মতবাদকে তার বিধানে হস্তক্ষেপ করার অনুমতি দেয় না। ইসলামের সকল শাখায় পরিপূর্ণরূপে প্রত্যেক মুসলিমের প্রবেশ করা ফরয। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱدۡخُلُواْ فِي ٱلسِّلۡمِ كَآفَّةٗ ٢٠٨ ﴾ [البقرة: ٢٠٨]
“হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর”।[4]
কুরআনুল কারিমের কতক বিধান গ্রহণ করে কতক বিধান ত্যাগকারীকে আল্লাহ তা‘আলা কাফের বলেছেন। ইরশাদ হচ্ছে:
﴿ أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥ ﴾ [البقرة: ٨٥]
“তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফেল নন”।[5]
ইসলামে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত কোনো বিষয় যে প্রত্যাখ্যান করল, সে কাফের ও পথভ্রষ্ট, যদিও তার প্রত্যাখ্যান করা বিষয়ের পরিমাণ খুবকম ও সামান্য হয়। অতএব পার্থিব রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ইসলামের সকল বিধান যে প্রত্যাখ্যান করে, সে কাফের বলার অপেক্ষা রাখে না, যেমন সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারীরা।
দ্বিতীয়ত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারীদের মাঝে ইসলাম বিনষ্টকারী কারণও রয়েছে, যেমন তারা বিশ্বাস করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ থেকে অন্য কারও আদর্শ উত্তম, অনুরূপ তার ফয়সালা থেকে অন্য কারও বিচার-ফয়সালা উত্তম। এ কারণেও তারা কাফের।[6]
শায়খ আব্দুল আযীয ইবন বায রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “ইসলাম বিনষ্টকারী চতুর্থ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত ঐ ব্যক্তি, যে বিশ্বাস করল মানুষের তৈরি আইনি সংস্থাগুলো ইসলামী শরীয়তের বিধান থেকে উত্তম, অথবা বিশ্বাস করল যে, বিংশ শতাব্দীতে ইসলামী বিধান বাস্তবায়ন করা যুক্তিসঙ্গত নয়, অথবা ইসলাম প্রগতির অন্তরায়, অথবা বলল ইসলাম শুধু ব্যক্তি ও তার রবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, মানুষের জীবনের অন্য কোনো অংশে প্রবেশ করার অধিকার ইসলামের নেই”।[7]
[2] দ্বীনের সাথে পরোক্ষ নাস্তিকতা বা সেকুলারিজমের (ধর্মনিরপেক্ষতার) সংঘর্ষ অনেকের নিকট স্পষ্ট নয়, কারণ তাদের নিকট দ্বীন হচ্ছে ধর্মীয় কয়েকটি ইবাদতের নাম। তাই এ পরোক্ষ সেকুলারিজম (পরোক্ষ ধর্মনিরপেক্ষতা) যেহেতু মসজিদে সালাত আদায় ও বায়তুল্লাহ শরীফের হজকে নিষেধ করে না, তারা ধারণা করে নিয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা দীন বিরোধী নয়। কিন্তু দীনকে যারা সঠিকভাবে বুঝেন, তারা অবশ্যই জানেন যে, সেকুলারিজম (তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা) দীনের সাথে সাংঘর্ষিক। যে মতবাদ মানুষের জীবনের সব শাখায় আল্লাহর শরীয়তকে নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করেছে, তার চেয়ে স্পষ্ট ও কঠিন ইসলাম বিরোধী কোনো মতবাদ কি আছে? যদি তারা তা বুঝে!
[3] কারণ তারা ভালো করেই জানে যে এরা এগুলো ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষকে ধোকা দিচ্ছে। [সম্পাদক]
[4] সূরা বাকারা: (২০৮)
[5] সূরা বাকারা: (৮৫)
[6] দেখুন: শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব রহ. রচিত نواقض الإسلام গ্রন্থের ইসলাম বিনষ্টকারী চতুর্থ প্রকার। আরো দেখুন: শায়খ আব্দুল আযীয ইবন বায রহ. রচিত العقيدة الصحيحة গ্রন্থের (২৭) নং পৃষ্ঠা।
[7] দেখুন: শায়খ আব্দুল আযীয ইবন বায রহ. রচিত العقيدة الصحيحة গ্রন্থের (২৭) নং পৃষ্ঠা।
সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতালম্বীরা আরব ও ইসলামী বিশ্বে সংখ্যায় অগণিত, আল্লাহ তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি না করুন, তাদের অনেকে লেখক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক; কাউকে বলা হয় চিন্তাবিদ, আবার কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের বিরাট এক সংখ্যা বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে নানাভাবে কর্মরত ও কর্তৃত্বকারী, এ ছাড়া অন্যান্য পেশায়ও তাদের সংখ্যা কম নয়।
এসব পেশায় নিয়োজিত তারা সবাই একে অপরের সহযোগী, সবাই মিলে সেকুলার (বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা যা সত্যিকার অর্থে ধর্মহীনতা সে) মতবাদ প্রচারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ব্যয় করে, যে কারণে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতা আজ মানুষের জীবনের অধিকাংশ শাখায় বিস্তার লাভ করেছে। আল্লাহর নিকট মুক্তি ও নিরাপত্তা চাই।
ইসলামী বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতা বিস্তারের ফলে মুসলিমদের দ্বীন ও দুনিয়া ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে আমরা তার কিছু কুফল বর্ণনা করছি:
১. সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা বিস্তারের ফলে রাষ্ট্রী্য় জীবনে আল্লাহর বিধানকে নিষিদ্ধ করা, জীবনের সকল শাখা থেকে শরীয়তকে বিতাড়িত করা এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিলকৃত ওহীর পরিবর্তে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী কাফেরদের তৈরি বিধানকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আল্লাহর বিধানকে মানা ও মানব-রচিত বিধান প্রত্যাখ্যান করার আহ্বানকে তারা প্রগতির অন্তরায়, পশ্চাৎগামী ও রক্ষণশীলতা জ্ঞান করে। আল্লাহর দিকে দা‘ঈ বা আহ্বানকারীদেরকে তারা নানাভাবে হেয় ও উপহাস করে, সরকারি চাকুরী ও ক্ষমতা থেকে দূরে রাখে, যেন তারা জাতি ও যুবকদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম না হয়।
২. সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীদের কাজই হচ্ছে ইসলামী ইতিহাসকে বিকৃত করা, তাতে মিথ্যার অনুপ্রবেশ ঘটানো ও দিগ্বিজয়ী ইসলামী আন্দোলনের ফসল স্বর্ণযুগকে ব্যক্তি স্বার্থ ও জঙ্গীবাদ বা জংগলীপনার ফলাফল বলে গালমন্দ করা এবং সমাজে এ জাতীয় ধ্যান-ধারণা তৈরি করা।
৩. সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার সেবাদাসরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তাদের সেকুলার মতাদর্শের সেবক বানানোর কাজে লিপ্ত। এ কাজ তারা বিভিন্নভাবে সম্পন্ন করে, যেমন:
ক. শিক্ষা উপকরণ ও সিলেবাস দ্বারা ছাত্রদের মাঝে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রচার করা।
খ. ধর্মীয় শিক্ষার নির্ধারিত সময় সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা ও সংকুচিত করা।
গ. নির্দিষ্ট কতক ধর্মীয় বিষয় পাঠদানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, যে বিষয়গুলো সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের শিকড় উপড়ে ফেলতে পারে কিংবা সে মতবাদের ভ্রষ্টতার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে।
ঘ. শরীয়ত তথা কুরআন ও সুন্নাহর বিভিন্ন ভাষ্যের ব্যাপারে বিভ্রান্তি ও অপব্যাখ্যা ছড়িয়ে বিকৃতি ঘটানো, যেন মানুষ বুঝে শরীয়ত সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করে, অথবা ন্যূনতম পক্ষে বুঝে যে, ইসলামের সাথে তার সংঘর্ষ নেই।
ঙ. পূর্ণাঙ্গভাবে দ্বীন পালনকারী শিক্ষকদেরকে পাঠদান ও শিক্ষাঙ্গন থেকে দূরে রাখা এবং ছাত্রদেরকে তাদের সাথে মিশতে না দেওয়া। এ কাজ তারা বিভিন্নভাবে সম্পন্ন করে, যেমন দাফতরিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজে তাদেরকে ব্যস্ত রাখা, অথবা অর্থ উপার্জনের অন্য কোনো পথে তাদেরকে মগ্ন করে দেওয়া।
চ. ধর্মীয় বিষয়কে গুরুত্বহীন ও অতিরিক্ত বিষয়ের মান দেওয়া, যেমন শেষ পিরিয়ডে রাখা, যখন ছাত্রদের মাঝে ক্লান্তির ভাব সৃষ্টি হয়, যেন তারা ধর্মীয় শিক্ষায় উজ্জীবিত না হয়। আবার এমনভাবে এ বিষয়কে শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা যে এর সাথে ছাত্রদের পাশ-ফেলের সম্ভাবনা না থাকা।
৪. সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অন্যতম কাজ হচ্ছে, সত্য দ্বীনের অনুসারী ও মিথ্যা-বিকৃত দ্বীনের অনুসারী যেমন মুসলিম-ইয়াহূদী-খৃস্টান ও নাস্তিকদের থেকে পার্থক্য তুলে দেয়া, অতঃপর সবাইকে এক মানদণ্ডে রাখা ও বাহ্যিকভাবে সবাইকে সমান মর্যাদা দেয়া, যদিও সত্যিকার অর্থে তারা কাফের, নাস্তিক, পাপাচারী ও অপরাধীদেরকে তাওহীদের ধারক-বাহক, আল্লাহর আনুগত্যকারী ও ইমানদার লোকদের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
এ মতবাদের সামনে মুসলিম, খৃস্টান, ইয়াহূদী, ব্রাহ্মণ, মূর্তিপূজক সবাই সমান, তাদের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব তখনই তাদের কাছে মুখ্য হবে যখন কেউ তাদের মতবাদের আহ্বানে সাড়া দিবে।
এ মতবাদের ধ্বজাধারীদের দৃষ্টিতে খৃস্টান, ইয়াহূদী, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ বা সমাজতন্ত্রীর সাথে মুসলিম নারীর বিয়ে বৈধ, কোনো সমস্যা নেই, অনুরূপ তার দৃষ্টিতে মুসলিম দেশে ইয়াহূদী অথবা খৃস্টান অথবা অন্য কোনো কুফরি ধর্মের অনুসারীর শাসক হতে সমস্যা নেই।
তারা জাতীয় ঐক্য বা জাতীয়তাবাদের আড়ালে মুসলিম দেশের কর্তৃত্ব কাফেরদের হাতে তুলে দিতে চায়।
বরং জাতীয় ঐক্য বা জাতীয়তাবাদ ও দেশের অখণ্ডতাকে মূলনীতি ও একমাত্র ঐক্যের বন্ধন হিসেবে দেখে। কুরআনুল কারীমের যে অংশ অথবা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে হাদিস তাদের এ তথাকথিত জাতীয় ঐক্য বা জাতীয়তাবাদ নীতি বিরুদ্ধ হয়, তাকেই তারা ছুড়ে ফেলে ও প্রত্যাখ্যান করে। আর বলে: এটা দেশীয় একতা ও ঐক্য বিনষ্টকারী!
৫. এ মতবাদের অন্যতম একটি লক্ষ্য হচ্ছে, বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার প্রসার করা এবং পারিবারিক সিস্টেম ধ্বংস করা। এ জন্য তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যেমন:
ক. অশ্লীলতাকে বৈধতা দেওয়া ও তার জন্য কাউকে শাস্তি প্রদান করা যাবে না মর্মে আইন প্রণয়ন করা; যার দৃষ্টিতে ব্যভিচার ও সমকামিতা ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত, যে ব্যক্তি স্বাধীনতা! প্রত্যেকের জন্য নিশ্চিত করা জরুরি।
খ. শালীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী ও সেগুলোর সহায়তায় নিয়োজিত পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও রেডিও-টেলিভিশনের অনুমোদন দেওয়া ও তাতে অংশ গ্রহণ করা। কখনো পরোক্ষভাবে আবার কখনো প্রত্যক্ষভাবে সেসব অশ্লীলতা প্রচারে রত থাকা।
গ. স্কুল-ভার্সিটি, সামাজিক সংগঠন ও সংস্থাসমূহে পর্দা নিষিদ্ধ করা এবং অবাধ মেলামেশা ও অশ্লীলতাকে চাপিয়ে দেওয়া।
৬. বিভিন্নভাবে ইসলামী দাওয়াত বাধাগ্রস্ত করা, যেমন:
ক. ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশ ও প্রচারণায় বিধি-নিষেধ আরোপ করা, পক্ষান্তরে যেসব বই-পুস্তকের কারণে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করবে, ইসলামী ঈমান-আকিদা বিনষ্ট হবে ও শরীয়তের ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি হবে, সেগুলো অধিকহারে প্রকাশ ও বিতরণ করা।
খ. সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতাবলম্বী লোকদের বিভিন্ন মিডিয়ায় সুযোগ দেওয়া, যেন তারা দেশের অধিকাংশ মানুষের সামনে তাদের পথভ্রষ্টতা প্রচার করার সুযোগ পায় ও শরীয়তকে বিকৃত করতে সক্ষম হয়; পক্ষান্তরে যেসব আলেম মানুষের সামনে দ্বীনের হাকিকত তুলে ধরবেন তাদেরকে মিডিয়ায় নিষিদ্ধ করা হয়, অথবা ইসলামিক মিডিয়াগুলো বন্ধ করা হয়।
৭. সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের অন্যতম কাজ হচ্ছে, আল্লাহর পথে আহ্বানকারী দা‘ঈদের হয়রানী করে বেড়ানো, তাদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করা, তাদের উপর বিভিন্ন অপবাদ আরোপ করা এবং তাদেরকে বিভিন্ন খারাপ বিশেষণে বিশেষায়িত করা; সমাজে প্রচার করা যে, তারা রক্ষণশীল, বিবেক প্রতিবন্ধী ও পশ্চাতমুখী; আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে বৈরিতা পোষণকারী, চরমপন্থি ও উগ্রবাদী, বাস্তবতা বুঝে না, তারা মূল বস্তু ত্যাগ করে খোসা ধরে রাখে ইত্যাদি।
৮. এ মতবাদের অনুসারীদের অন্যতম কাজ হচ্ছে, যেসব মুসলিম সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে আপোষ করে না তাদেরকে নিঃশেষ করে দেওয়া, তাদেরকে দেশান্তর করে দেওয়া, অথবা জেলে দেওয়া অথবা হত্যা করা।
৯. এ মতবাদের অনুসারীদের অন্যতম কাজ হচ্ছে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের আবশ্যকতা অস্বীকার করা, জিহাদ নিষিদ্ধ করা এবং জিহাদকে একপ্রকার ডাকাতি ও বর্বরতা জ্ঞান করা। কারণ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের অর্থ আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্য যুদ্ধ করা, যেন পৃথিবীর বুকে ইসলামী হুকুমত ব্যতীত দাপুটে ও শক্তিধর কোনো হুকুমত না থাকে; পক্ষান্তরে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে দুনিয়ার সকল শাখা থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করা। ধর্ম সম্পর্কে তাদের সবচেয়ে সুন্দর উক্তি হচ্ছে: “মানুষ ও তার উপাস্যের মাঝে ধর্ম বিশেষ এক বন্ধন, যার প্রভাব ইবাদতগৃহের বাইরে ব্যক্তির কথা, কাজ ও চরিত্রে প্রতিফলিত হবে না”। অতএব আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার জন্যে জিহাদের অনুমতি তাদের দৃষ্টিতে না-থাকাই স্বাভাবিক।
ধর্মনিরপেক্ষ ও তার অনুসারীদের নিকট সম্পদ ও ভূ-খণ্ড রক্ষা ব্যতীত যুদ্ধ করা বৈধ নয়; দ্বীনের সুরক্ষা, দ্বীন প্রচার ও তার বিজয়ের জন্য জিহাদ করা তাদের নিকট বর্বরতা ও সীমালঙ্ঘনের শামিল, যা সভ্য প্রগতিশীল মানুষের নিকট গ্রাহ্য নয়!!
১০. তারা জাতীয়তা ও দেশাত্মবোধের দাওয়াত দেয়, তার ভিত্তিতে তারা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার স্বপ্ন দেখে। তাদের নিকট একতার মানদণ্ড হচ্ছে জাতীয়তাবাদ, অথবা ভাষা, অথবা ভূ-খণ্ড অথবা পার্থিব কোনো স্বার্থ; ধর্মের ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হওয়া তাদের সংবিধানে বৈধ নয়, বরং দ্বীন তাদের দৃষ্টিতে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টির বড় কারণ। তাদের কেউ এমনও বলেছে: “রক্তাক্ত শতাব্দীগুলোর অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, পরকালীন জীবনের নিরাপত্তার জিম্মাদার কথিত ধর্ম বা দ্বীন শান্তিকে ধ্বংস করেছে”।
আমরা এখানে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অনুসারীদের জন্ম দেওয়া মুসলিম দেশে বিদ্যমান কয়েকটি কুফল উল্লেখ করলাম, বস্তুত তার কুফল আরো অধিক, আরো ব্যাপক।
কেউ দৃষ্টি দিলে এ সকল কুফল অথবা তার বেশিরভাগ কুফল অধিকাংশ মুসলিম দেশে অনুভব করবে বা স্বচক্ষে দেখবে। আরো দেখবে যে, মুসলিম দেশের গভীর পর্যন্ত এ সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীয় শিকড় শক্তিশালী করেছে।
একজন মুসলিম তার ডানে-বামে মুসলিম অধ্যুষিত যে কোনো দেশের দিকে তাকালে খুব সহজে, বিনা কষ্টে ও অনায়াসে সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার এক বা একাধিক কুফল দেখতে পাবে, বরং তার বিবিধ কুফল থেকে মুক্ত কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
মুসলিমদের দ্বীন বিকৃত করার নিমিত্তে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে থাকে, যেমন:
১. দুর্বল প্রকৃতি ও দোদুল্যমান ঈমানদার লোকদেরকে সম্পদ ও পদের প্রলোভন দেওয়া, অথবা নারীর টোপ দেওয়া, যেন তারা সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার বাণী ও শ্লোগান মানুষের কর্ণকুহরে প্রবেশ করাতে ও প্রচার করতে পারে। অবশ্য তার পূর্বেই তারা তাদের প্রতারণার শিকার লোকদেরকে বিভিন্ন মিডিয়ায়, যেগুলোতে তাদের কর্তৃত্ব রয়েছে, সেগুলোতে এমনভাবে তুলে ধরে যেন মানুষ তাদেরকে আলেম, চিন্তাবিদ ও প্রচুর জান্তা হিসেবে জানে এবং সাধারণ লোকদের নিকট তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়, অতঃপর তাদের দ্বারা সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচার করায়, এভাবে তারা অনেক মানুষকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়।
২. কতিপয় লোককে তারা পাশ্চাত্য দেশে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদীদের আশ্রমে লালন করে এবং তাদেরকে একাডেমিক বিভিন্ন নামী-দামী পদবি প্রদান করে, যেমন ‘ডক্টরেট’ অথবা ‘প্রফেসর’ ইত্যাদি। অতঃপর সেখান থেকে প্রর্ত্যাবর্তন করার পর দ্বীনকে বিকৃত ও ভিন্নভাবে উপস্থাপনের জন্য তাদেরকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। এ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে তাদের অস্তিত্ব কতটুকুন ক্ষতিকর; অথচ তারাই সুশীল নামে খ্যাত, স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটির কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব তাদের হাতেই ন্যাস্ত।
৩. এ মতবাদে বিশ্বাসী লোকদের অপর একটি কূটকৌশল হচ্ছে, দ্বীন বা ধর্মকে বিভক্ত করা, তার নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর সমালোচনা ও লেখা-লেখি করা এবং মানুষদেরকে তাতে ব্যস্ত রাখা। এ লক্ষ্যে তারা দীনি ছাত্র, ধর্মীয় আলেম ও ইসলামের দিকে আহ্বানকারী দা‘ঈদের সাথে অযথা তর্কে লিপ্ত হয়, যেন তারা মানুষদেরকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপদেশ-নসিহত প্রদানের পরিবর্তে তর্কে ব্যস্ত থাকে।
৪. দীনি আলেম, ধর্মীয় ছাত্র ও আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী দা‘ঈদেরকে রেডিও-টেলিভিশন ও বিভিন্ন মিডিয়ায় পশ্চাৎগামী, চারিত্রিকভাবে অধঃপতিত ও দ্বিতীয় শ্রেণির লোক হিসেবে উপস্থাপন করা। আরো প্রচার করা যে, তারা পদ, সম্পদ ও নারী লোভী, যেন মানুষেরা তাদের কথায় বিশ্বাস না করে ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রচারের ময়দান উন্মুক্ত হয়।
৫. বিরোধপূর্ণ মাসআলা ও আলেমদের ইখতিলাফ নিয়ে বেশী আলোচনা করা, যেন মানুষ জানে দ্বীন মতবিরোধের স্থান এবং দীনি আলেমদের মাঝে কোনো ঐক্য নেই। এভাবে মানুষ বিশ্বাস করতে শিখবে যে, দ্বীনের কোনো বিষয় অকাট্য ও চূড়ান্ত নয়, অন্যথায় এতো বিরোধ সংগঠিত হত না। ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারীরা এ দিকটার প্রতি খুব গুরুত্বারোপ করে। মুসলিম সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতার কুপ্রভাব ছড়ানোর লক্ষ্যে এ জাতীয় বিষয়কে তারা বড় আকারে পেশ করে, যার অর্থ মুসলিমদেরকে তাদের দ্বীন থেকে দূরে রাখা।
৬. পাশ্চাত্য দেশসমূহের আদলে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি ও অপরিচিত কালচার সেন্টার নির্মাণ করা। এসব প্রতিষ্ঠান মুসলিম দেশে নির্মিত হলেও পরিচালিত হয় প্রকৃতপক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে। ইসলামের সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক দুর্বল করার লক্ষ্যে তারা চেষ্টার ত্রুটি করে না। একই সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষবাষ্প ছড়ানোর কাজও করে ব্যাপকভাবে, বিশেষ করে সামাজিক, দার্শনিক ও মনোবিদ্যা বিভাগে তাদের পদচারণা ও প্রচারণা খুব বেশী।
৭. শরীয়তের কতক বিধান, যার প্রয়োগ ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ও সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি রয়েছে, তার উপর স্থানকাল-পাত্র ও বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে অন্ধভাবে জমে থাকা। এভাবে তারা শরীয়তের ভুল ও বিকৃত দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে ধর্মনিরপেক্ষতা বা তার অধিকাংশ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে।
উদাহরণত শরীয়তের একটি নীতি রয়েছে: ‘মাসালেহে মুরসালাহ’ (জনস্বার্থ), এ নীতিকে তারা উল্টোভাবে বুঝে ও ভুল পথে প্রয়োগ করে, অতঃপর তার দোহাই দিয়ে ইসলামের যে অংশ তারা পছন্দ করে না তা প্রত্যাখ্যান করে ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিধানগুলো বাস্তবায়ন করে, যেকারণে মুসলিম দেশে ধীরেধীরে ধর্মনিরপেক্ষতা শক্তিশালী ও তার ভিত্তিসমূহ মজবুত হচ্ছে।
অনুরূপ শরীয়তের আর একটি নীতি রয়েছে: “দু’টি ক্ষতিকর বস্তু থেকে কম ক্ষতিকর বস্তু ও দু’টি ফেতনা থেকে ছোট ফেতনাকে গ্রহণ কর”। আরেকটি নীতি রয়েছে: “প্রয়োজন নিষিদ্ধ বস্তুকেও বৈধতা প্রদান করে”। আরেকটি নীতি রয়েছে: “ফায়দা হাসিল করার চেয়ে ক্ষতি দূর করাই অধিক শ্রেয়”। অনুরূপ একটি নীতি হচ্ছে: “ইসলাম সর্বযুগে উপযোগী”। আরেকটি নীতি রয়েছে: “অবস্থার ভিন্নতার ভিত্তিতে ফতোয়া ভিন্ন হয়”। এ জাতীয় নীতিকে তারা গলদভাবে প্রয়োগ করে অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদের সাথে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলে ও মুসলিমদের ধোঁকা দেয়।
অনুরূপ এসব নীতিকে তারা কাফেরদের দেশে প্রচলিত অর্থনৈতিক বিধান, রাজনৈতিক ভাবনা ও দর্শনকে মুসলিম দেশে আমদানি করার হাতিয়ার হিসেবে গলদভাবে প্রয়োগ করে, যেন অধিকাংশ মানুষ প্রকৃত অবস্থা না জেনে বদ্দীন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমার দৃষ্টিতে তাদের এ কৌশল সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়ঙ্কর, কারণ এতে মানুষ সন্দেহ ও ধোঁকায় পতিত হয়, তারা ভাবে এসব তো শরয়ীতের নীতি ও ইসলামের নিকট স্বীকৃত। তাদের এ কৌশলের মুখোশ উন্মোচনের জন্য স্বতন্ত্র কিতাব প্রয়োজন, তবেই দ্বীন থেকে সন্দেহ ও অস্পষ্টতা দূর করা সম্ভব হবে এবং মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝানো যাবে।
এখানে আমরা স্পষ্ট করতে চাই যে, এ জাতীয় নীতির উপর তাদের ভরসা করার অর্থ এ নয় যে, তারা ইসলামের এসব নীতিতে বিশ্বাসী। আবার এ অর্থও নয় যে, যে-উৎস থেকে এসব বিধান এসেছে, সে ইসলামের ব্যাপ্তি, ব্যাপকতা ও পরিপূর্ণতার উপর তাদের ঈমান রয়েছে, বরং এসব তাদের একটি বাহানা, এভাবে তারা নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য ও ভ্রান্ত মতবাদ বাস্তবায়ন করতে চায়।
লেখক যদি কোনো কিতাবের ব্যাপক প্রচার ও প্রসিদ্ধ চায়, তাহলে সে অবশ্যই মানুষকে আকৃষ্ট করা ও তাদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। অতএব যদি সত্যিই হয় যে, এ জাতীয় কিতাবের প্রতি মানুষের আগ্রহ নেই, তাহলে তাদের অনাগ্রহের জন্য আপনারাও কম দায়ী নন, তাদের অনাগ্রহের প্রতি আপনাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ পাচ্ছে। তাদেরকে আপনারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে দেননি, তাদেরকে বলনেনি এক বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করে অপর বিষয় ত্যাগ করা সমীচীন নয়। এরূপ ঘটতে থাকলে মানুষেরা ইসলামকে কোনো এক ইবাদত, অথবা কোনো এক আদব অথবা কোনো এক অভ্যাসে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ করে ফেলবে, বরং অনেকের নিকট তো এখনই সালাত, সিয়াম ও কতক জিকিরের মাঝে ইসলাম সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ ইসলামকে সীমাবদ্ধ করেছে শুধু সদাচরণে। কারো নিকট বিশেষ অবস্থা অথবা বিশেষ আকৃতি অথবা বিশেষ পোশাকের নাম-ই ইসলাম। কারো নিকট কয়েকটি ফিকহি মাসআলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ইসলাম, অথবা কিছু বিষয়-আশয় ও কিছু স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় জানাই ইসলাম, ইত্যাদি।
আপনি যদি তাদেরকে ইসলামের ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতার প্রতি দাওয়াত দেন, তার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, যেমন আল্লাহর তাওহীদ, আখিরাতের প্রতি ঈমান, আল্লাহর বিধান মোতাবেক ফয়সালা করা ও তার শরীয়ত আঁকড়ে ধরা; অথবা ইসলামী খিলাফত পুনরুদ্ধার ও কায়েম করার আলোচনা এবং কুফরি মতবাদসমূহের বাতুলতা প্রকাশ করেন, যেমন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি, তাহলে তারা ভাববে আপনি ইসলাম ছাড়া অপর কোনো বিষয়ে আলোচনা করছেন। তারা বলবে, ‘এটাই তো রাজনীতি, আর রাজনীতির সাথে দ্বীনকে সম্পৃক্ত করা বৈধ নয়।’
এ জাতীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী লোকদের জন্য যদি সেসব বিষয় জুমার খুতবা, মসজিদের হালকা, বিভিন্ন সেমিনার ও ছোট ছোট কিতাবে প্রকাশ করা হত, যা পড়া ও বুঝা সহজ, তাহলে তাদের থেকে এরূপ বিচ্যুতিমূলক কথা কখনো বের হত না।
আমরা লেখক বা প্রকাশক যাই হই, পাঠকদের চাহিদা ও বেচাকেনার বাজার গরম রাখার জন্য দ্বীনকে অসম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা, দ্বীনকে বিকৃত করা, তার এক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে অপর বিষয়কে ত্যাগ করার মত মারাত্মক ক্ষতিকর কাজে প্রবৃত্ত হওয়া ও তাতে অংশগ্রহণ না করা ওয়াজিব। এরূপ আচরণ আমাদের থেকে প্রকাশ পেলে প্রকারান্তরে আমরাই দ্বীনের গণ্ডিকে সংকীর্ণ করে ফেলব এবং দ্বীনকে জীবন ও রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের সহযোগী হয়ে যাব।
কোনো লেখক বা প্রকাশক বলতে পারেন: “আমরা এ বিষয়ে লেখি না, কারণ এগুলো অনেক বড় ও গভীর বিষয়, এতে ভুল করা সামান্য ব্যাপার নয়, এসব বিষয়ে লেখার জন্য অনেক ইলম প্রয়োজন, যা আমাদের নেই”। হ্যাঁ এ কথাও সত্য, কারণ বর্তমান যারা এ বিষয়ে লিখছে, তারা তার উপযুক্ত নয়... তার কারণ হয়তো তারা বিষয়টি বুঝেন না, অথবা ভুলভাবে বুঝেন-তাদের জ্ঞান এ ব্যাপারে পরিপক্ব নয়, যদি এরূপ সঠিক হয় –এটাই সঠিক- অনেকের ক্ষেত্রে, তবে বড় আলেমগণ কোথায়, কোথায় ওলামা মাশায়েখগণ, এটা যদি তাদের দায়িত্ব না হয়, তাহলে এ দুঃখজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তাদের কাজ কী?!
ইসলাম প্রচার ও ব্যাপক করার জন্য প্রাথমিক থেকে শুরু করে ভার্সিটি পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষক, প্রফেসর ও অধ্যাপকদের নিম্নরূপ দায়িত্ব পালন করা জরুরি:
১. বিশুদ্ধ শিক্ষানীতি ও সিলেবাস তৈরি করা, যেন শিক্ষার প্রত্যেক শাখা ইসলামের সেবায় ব্যবহার হয়, একমাত্র গবেষণাই যেন তার উদ্দেশ্য না হয়। উল্লেখ্য যে, আমাদের দ্বীন আল্লাহর পক্ষ থেকে, তাতে অগ্র-পশ্চাৎ কোনো দিক থেকে বাতিল প্রবেশ করতে পারে না, আবার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও আল্লাহর সৃষ্ট, অতএব বিজ্ঞান ও দ্বীনের মাঝে কোনো বৈপরীত্য নেই, তাই বৈজ্ঞানিক অনেক আবিষ্কারকে ঈমানের সেবক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অনুরূপ নাস্তিকতার বাতুলতা প্রমাণ ও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য বিজ্ঞানের অনেক মূলনীতিকে ব্যবহার করা যায়, যাতে খোদ নাস্তিকরা বিশ্বাসী, যার বিপরীত কোনো নীতি তারা বিশ্বাস করে না। এ জন্য ছাত্রদের সিলেবাস নির্ধারণের সময় এসব বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা জরুরি। এগুলো অবশ্যই স্পষ্টভাবে বুঝাবে, তাতে ইশারা ও ইঙ্গিত প্রদান করা যথেষ্ট নয়। এ বিষয়টিকে যথাযথভাবে বুঝা ও বাস্তবায়ণ করা সিলেবাস প্রণয়ন ও নির্ধারণকারীদের উপর একান্ত কর্তব্য।
২. শিক্ষা উপকরণকে তাতে প্রবিষ্ট কুফরি ও গোমরাহি মুক্ত করা, হতে পারে কোনো বই এমন লোকের তৈরি, যে দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা দ্বীন বিদ্বেষী। তাই মুসলিম শিক্ষক কখনো বই-পুস্তক যেভাবে আছে সেভাবে পাঠদান করে ক্ষান্ত হয় না, এরূপ করা বৈধও নয়। তার কর্তব্য হচ্ছে, বই-পুস্তকে বিদ্যমান ভ্রষ্টতা ছাত্রদেরকে বলা ও তা থেকে সতর্ক করা। অতএব শিক্ষককে শুধু বিষয়ের শিক্ষক হলে চলবে না, তাকে অবশ্যই এ বিদ্যাগুলোকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করার কাজ করত হবে এবং তাতে বিদ্যমান সন্দেহগুলো দূর করতে হবে। এভাবে তিনি নিজেকে একজন আল্লাহর পথে আহ্বানকারী দা‘ঈ, উপদেশদাতা ও সঠিক পথপ্রদর্শনকারী হিসেবে ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করবেন।
৩. ইসলামকে ভালোভাবে বুঝানো, অথবা ইসলামী আকিদা প্রতিষ্ঠা করা, অথবা মুসলিমদের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া, তাদের সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্তি দূর করা, অথবা ইসলামী শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার যখন কোনো সুযোগ আসবে শিক্ষক সেটাই লুফে নিবেন।
এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষককে অবশ্যই আধুনিক ও শর‘য়ী উভয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া জরুরি, তাহলে তিনি সঠিকভাবে স্বীয় দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবেন, যা দিয়ে আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছেন।
এ গবেষণার পরিশিষ্টে এসে এবার আমরা যা জানলাম তা বাস্তবে নিয়ে আসা ও তার উপর যথাযথ আমল করার ব্যাপারে মনোনিবেশ করি। এখানে আমল দ্বারা উদ্দেশ্য সে আমল নয়, যার উপকারিতা শুধু ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকে, এটাও একটা উদ্দেশ্য সন্দেহ নেই, তবে আমাদের উদ্দেশ্য সে আমল, যার দ্বারা ব্যক্তির সাথে মুসলিম উম্মতও উপকৃত হয়।
আমরা আমাদের ও অধীনদের ক্ষেত্রে বাস্তব বিশ্বাসে বিশ্বাসী হব ও তার উপর আমল করব। এতেই ক্ষান্ত হব না, বরং মানুষদেরকে আহ্বান করব ও ইসলামের হাকিকত সম্পর্কে বুঝাব। কিভাবে আমাদের শত্রুরা ভেতরে-বাইরে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে তাদেরকে সেগুলো সম্পর্কে সতর্ক করব। মুসলিম উম্মাহ বর্তমান কি পরিমাণ দুর্দশায় ভোগছে তাও তুলে ধরব তাদের সামনে। কোনো কষ্ট, বাঁধা ও বিরোধিতা আমাদেরকে এ দায়িত্ব থেকে বিরত রাখতে পারবে না। যদিও ধর্মনিরপেক্ষতার অনুসারী ও তার দোসররা আমাদেরকে কোণঠাসা করে কিংবা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, আমরা তার থেকে পিছপা হব না কখনো।
অবশ্যই আমাদেরকে দ্বীনের স্বার্থে দ্বীন মোতাবেক কাজ করতে হবে। আল্লাহ ও তার রাসূলের পছন্দনীয় আকিদা, কথা ও কর্মের উপর মানুষদের উঠাতে হবে, প্রয়োজনে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে হবে। আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে, যেন ফিতনা দূরীভূত হয় ও একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমার মনে হয় না, মুসলিমদের করণীয় সম্পর্কে আমি যথাযথ আলোচনা করতে পেরেছি, তবে এ গ্রন্থ একটি স্মারক হিসেবে কাজ করবে সন্দেহ নেই, যার দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে উপকৃত করবেন, হে আল্লাহ তুমি কবুল কর।
লেখক
৩-রবিউল আউয়াল, ১৪১১হি. রবিবার রাতে এ লেখা শেষ করলাম। শুরু-শেষে প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই।