লেখক যদি কোনো কিতাবের ব্যাপক প্রচার ও প্রসিদ্ধ চায়, তাহলে সে অবশ্যই মানুষকে আকৃষ্ট করা ও তাদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। অতএব যদি সত্যিই হয় যে, এ জাতীয় কিতাবের প্রতি মানুষের আগ্রহ নেই, তাহলে তাদের অনাগ্রহের জন্য আপনারাও কম দায়ী নন, তাদের অনাগ্রহের প্রতি আপনাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ পাচ্ছে। তাদেরকে আপনারা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে দেননি, তাদেরকে বলনেনি এক বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করে অপর বিষয় ত্যাগ করা সমীচীন নয়। এরূপ ঘটতে থাকলে মানুষেরা ইসলামকে কোনো এক ইবাদত, অথবা কোনো এক আদব অথবা কোনো এক অভ্যাসে সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ করে ফেলবে, বরং অনেকের নিকট তো এখনই সালাত, সিয়াম ও কতক জিকিরের মাঝে ইসলাম সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। কেউ ইসলামকে সীমাবদ্ধ করেছে শুধু সদাচরণে। কারো নিকট বিশেষ অবস্থা অথবা বিশেষ আকৃতি অথবা বিশেষ পোশাকের নাম-ই ইসলাম। কারো নিকট কয়েকটি ফিকহি মাসআলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ইসলাম, অথবা কিছু বিষয়-আশয় ও কিছু স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় জানাই ইসলাম, ইত্যাদি।
আপনি যদি তাদেরকে ইসলামের ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতার প্রতি দাওয়াত দেন, তার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, যেমন আল্লাহর তাওহীদ, আখিরাতের প্রতি ঈমান, আল্লাহর বিধান মোতাবেক ফয়সালা করা ও তার শরীয়ত আঁকড়ে ধরা; অথবা ইসলামী খিলাফত পুনরুদ্ধার ও কায়েম করার আলোচনা এবং কুফরি মতবাদসমূহের বাতুলতা প্রকাশ করেন, যেমন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি, তাহলে তারা ভাববে আপনি ইসলাম ছাড়া অপর কোনো বিষয়ে আলোচনা করছেন। তারা বলবে, ‘এটাই তো রাজনীতি, আর রাজনীতির সাথে দ্বীনকে সম্পৃক্ত করা বৈধ নয়।’
এ জাতীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী লোকদের জন্য যদি সেসব বিষয় জুমার খুতবা, মসজিদের হালকা, বিভিন্ন সেমিনার ও ছোট ছোট কিতাবে প্রকাশ করা হত, যা পড়া ও বুঝা সহজ, তাহলে তাদের থেকে এরূপ বিচ্যুতিমূলক কথা কখনো বের হত না।
আমরা লেখক বা প্রকাশক যাই হই, পাঠকদের চাহিদা ও বেচাকেনার বাজার গরম রাখার জন্য দ্বীনকে অসম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা, দ্বীনকে বিকৃত করা, তার এক বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে অপর বিষয়কে ত্যাগ করার মত মারাত্মক ক্ষতিকর কাজে প্রবৃত্ত হওয়া ও তাতে অংশগ্রহণ না করা ওয়াজিব। এরূপ আচরণ আমাদের থেকে প্রকাশ পেলে প্রকারান্তরে আমরাই দ্বীনের গণ্ডিকে সংকীর্ণ করে ফেলব এবং দ্বীনকে জীবন ও রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে সেকুলার বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের সহযোগী হয়ে যাব।
কোনো লেখক বা প্রকাশক বলতে পারেন: “আমরা এ বিষয়ে লেখি না, কারণ এগুলো অনেক বড় ও গভীর বিষয়, এতে ভুল করা সামান্য ব্যাপার নয়, এসব বিষয়ে লেখার জন্য অনেক ইলম প্রয়োজন, যা আমাদের নেই”। হ্যাঁ এ কথাও সত্য, কারণ বর্তমান যারা এ বিষয়ে লিখছে, তারা তার উপযুক্ত নয়... তার কারণ হয়তো তারা বিষয়টি বুঝেন না, অথবা ভুলভাবে বুঝেন-তাদের জ্ঞান এ ব্যাপারে পরিপক্ব নয়, যদি এরূপ সঠিক হয় –এটাই সঠিক- অনেকের ক্ষেত্রে, তবে বড় আলেমগণ কোথায়, কোথায় ওলামা মাশায়েখগণ, এটা যদি তাদের দায়িত্ব না হয়, তাহলে এ দুঃখজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তাদের কাজ কী?!
ইসলাম প্রচার ও ব্যাপক করার জন্য প্রাথমিক থেকে শুরু করে ভার্সিটি পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষক, প্রফেসর ও অধ্যাপকদের নিম্নরূপ দায়িত্ব পালন করা জরুরি:
১. বিশুদ্ধ শিক্ষানীতি ও সিলেবাস তৈরি করা, যেন শিক্ষার প্রত্যেক শাখা ইসলামের সেবায় ব্যবহার হয়, একমাত্র গবেষণাই যেন তার উদ্দেশ্য না হয়। উল্লেখ্য যে, আমাদের দ্বীন আল্লাহর পক্ষ থেকে, তাতে অগ্র-পশ্চাৎ কোনো দিক থেকে বাতিল প্রবেশ করতে পারে না, আবার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও আল্লাহর সৃষ্ট, অতএব বিজ্ঞান ও দ্বীনের মাঝে কোনো বৈপরীত্য নেই, তাই বৈজ্ঞানিক অনেক আবিষ্কারকে ঈমানের সেবক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অনুরূপ নাস্তিকতার বাতুলতা প্রমাণ ও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য বিজ্ঞানের অনেক মূলনীতিকে ব্যবহার করা যায়, যাতে খোদ নাস্তিকরা বিশ্বাসী, যার বিপরীত কোনো নীতি তারা বিশ্বাস করে না। এ জন্য ছাত্রদের সিলেবাস নির্ধারণের সময় এসব বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা জরুরি। এগুলো অবশ্যই স্পষ্টভাবে বুঝাবে, তাতে ইশারা ও ইঙ্গিত প্রদান করা যথেষ্ট নয়। এ বিষয়টিকে যথাযথভাবে বুঝা ও বাস্তবায়ণ করা সিলেবাস প্রণয়ন ও নির্ধারণকারীদের উপর একান্ত কর্তব্য।
২. শিক্ষা উপকরণকে তাতে প্রবিষ্ট কুফরি ও গোমরাহি মুক্ত করা, হতে পারে কোনো বই এমন লোকের তৈরি, যে দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা দ্বীন বিদ্বেষী। তাই মুসলিম শিক্ষক কখনো বই-পুস্তক যেভাবে আছে সেভাবে পাঠদান করে ক্ষান্ত হয় না, এরূপ করা বৈধও নয়। তার কর্তব্য হচ্ছে, বই-পুস্তকে বিদ্যমান ভ্রষ্টতা ছাত্রদেরকে বলা ও তা থেকে সতর্ক করা। অতএব শিক্ষককে শুধু বিষয়ের শিক্ষক হলে চলবে না, তাকে অবশ্যই এ বিদ্যাগুলোকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করার কাজ করত হবে এবং তাতে বিদ্যমান সন্দেহগুলো দূর করতে হবে। এভাবে তিনি নিজেকে একজন আল্লাহর পথে আহ্বানকারী দা‘ঈ, উপদেশদাতা ও সঠিক পথপ্রদর্শনকারী হিসেবে ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করবেন।
৩. ইসলামকে ভালোভাবে বুঝানো, অথবা ইসলামী আকিদা প্রতিষ্ঠা করা, অথবা মুসলিমদের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া, তাদের সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্তি দূর করা, অথবা ইসলামী শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার যখন কোনো সুযোগ আসবে শিক্ষক সেটাই লুফে নিবেন।
এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষককে অবশ্যই আধুনিক ও শর‘য়ী উভয় জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া জরুরি, তাহলে তিনি সঠিকভাবে স্বীয় দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবেন, যা দিয়ে আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছেন।