সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে ইসলামের পথে পরিচালিত করেছেন এবং আমাদেরকে তার অনুসারী বানিয়েছেন; আল্লাহ যদি আমাদেরকে হেদায়াত না করতেন, তাহলে আমরা হেদায়াত পেতাম না; আমি আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার প্রশংসা করছি এবং তাঁর নি‘য়ামতের ব্যাপারে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি; আর তাঁর নিকট তাঁর অনুগ্রহ ও করুনা বৃদ্ধির আবেদন করছি; আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, যিনি একক, যাঁর কোনো শরীক নেই; আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাঁকে তিনি হেদায়েত ও সত্য দীনসহ সুসংবাদ বাহক ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন; তিনি সত্যের দিকে আহ্বান করেছেন এবং কল্যাণের পথ প্রদর্শন করেছেন; আল্লাহ তাঁর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীগণ ও কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যে ব্যক্তি তাঁর হেদায়েতের অনুসরণ করবে তার উপর রহমত, শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন।
অতঃপর
হে মুসলিমগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, তোমাদের রবের নির্দেশকে সমীহ কর, তোমাদের দীন ও আমানতসমূহকে হেফাযত (সংরক্ষণ) কর এবং তোমরা তোমাদের দায়িত্বসমূহ পালন কর; আর তোমরা তোমাদের নিজেদের ব্যাপারে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা করে নাও।
অনেক মানুষ সৌভাগ্যের অনুসন্ধান করে; আর অন্বেষণ করে শান্তি, স্থিতি এবং দেহ ও মনের প্রশান্তি; যেমনিভাবে সে দুর্ভাগ্য ও অস্থিরতার কারণসমূহ, দুশ্চিন্তার উদ্দীপকসমূহ এবং বিশেষ করে পারিবারিক কলহ থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে চেষ্টাসাধনা করে।
তবে তাদের জানা উচিত যে, এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাঁর উপর ভরসা এবং সকল বিষয় তাঁর প্রতি সোপর্দ করা ব্যতীত এসব বাস্তবায়ন করা যাবে না, আর সাথে সাথে তিনি যেসব নিয়মনীতি ও উপায় প্রণয়ন করেছেন, সেগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উপর যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে তা হলো পরিবার গঠন ও তাকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর প্রজ্ঞায় পরিবারকে পুরুষ ও নারী নির্বিশেষ সকল মানুষের জন্য তৈরি করেছেন প্রত্যাবর্তনস্থল হিসেবে; যাতে সে অবস্থান করবে এবং সেখানে প্রশান্তি অনুভব করবে; আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি এ অনুগ্রহ প্রকাশ করে বলেন:
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١ ﴾ [الروم: ٢١]
“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জোড়া; যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং সৃজন করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও সহমর্মিতা। নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে।” - (সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১ )।
হ্যাঁ, আল্লাহ বলেছেন: ‘যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়’; তিনি বলেন নি: ‘যাতে সে তার সাথে বাস করে’, সুতরাং আল্লাহর এ বাণীর দাবী হচ্ছে যে, পরিবারের আচার-আচরণ হবে স্থিতিশীল আর অনুভূতি হবে প্রশান্তির কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে সর্বোচ্চ অর্থে শান্তি ও নিশ্চিন্ততা প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যেকেই তার সঙ্গীর মধ্যে অস্থিরতার সময় প্রশান্তি এবং সঙ্কটময় মুহূর্তে আনন্দ অনুভব করবে।
দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কের মূলভিত্তি হল: ভালোবাসা, ঘনিষ্টতা ও সখ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত সাহচর্য ও মিলন। এ সম্পর্কের শিকড় অনেক গভীরে, বিস্তৃতি অনেক দূর ব্যপ্ত, স্বয়ং ব্যক্তির সাথে তার আত্মার যে সম্পর্ক, এটা তার সাথে খুব চমৎকারভাবে তুলনাযোগ্য, যা আমাদের প্রতিপালকের কিতাব বর্ণনা করেছে, তিনি বলেছেন:
﴿ هُنَّ لِبَاسٞ لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٞ لَّهُنَّۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]
“তারা তোমাদের পোষাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোষাকস্বরূপ।” - ( সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭ )।
তাছাড়া এই সম্পর্ক ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষা এবং লালনপালন দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে যা গঠন করে, তা স্নেহপূর্ণ মাতৃত্ব ও শ্রমনির্ভর পিতৃত্বের ছায়াতল ছাড়া হতে পারে না।
এ সম্মানিত পারিবারিক পরিবেশের চেয়ে আর কোন পরিবেশ অধিক পবিত্র হতে পারে?
সম্মানিত পাঠক:
এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার উপর মুসলিম পরিবারের অবকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে; যার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক এবং যা মেনে চললে তা থেকে দূরে থাকে বিচ্ছিন্নতার ঝড়ো হাওয়া ও ভঙ্গ ও কর্তিত হওয়ার তুফান। সে সব খুঁটিসমূহের অন্যতম হচ্ছে:
১. আল্লাহর উপর পূর্ণ ঈমান ও তাঁর তাকওয়া অবলম্বন:
যে সব খুঁটির উপর মুসলিম পরিবার দাঁড়িয়ে থাকে, তন্মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: ঈমানের রশিকে শক্তভাবে আকড়ে ধরা ... আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান; অন্তর যা লুকিয়ে রাখে, সে বস্তু সম্পর্কে যিনি জানেন তাকে ভয় করা; তাকওয়া ও আত্মপর্যবেক্ষণকে অপরিহার্য করে নেয়া; আর যুলুম থেকে এবং সত্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অন্যায়ের আশ্রয় নেওয়া থেকে দূরে থাকা। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ ... ذَٰلِكُمۡ يُوعَظُ بِهِۦ مَن كَانَ يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مَخۡرَجٗا ٢ وَيَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَيۡثُ لَا يَحۡتَسِبُۚ وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُۥٓۚ ... ٣ ﴾ [الطلاق: ٢، ٣]
“ ... এর দ্বারা তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখে, তাকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। আর যে কেউ আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য (উত্তরণের) পথ করে দেবেন, আর তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে দান করবেন রিযিক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ...” - (সূরা আত-তালাক, আয়াত: ২ - ৩)।
আর এই ঈমানকে শক্তিশালী করবে: আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের ব্যাপারে চেষ্টা করা, তার ব্যাপারে যত্নবান থাকা এবং সে ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা করা; তোমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীটি নিয়ে ভেবে দেখ, তিনি বলেছেন:
« رحم الله رجلا قام من الليل فصلى وأيقظ امرأته فصلت , فإن أبت نضح في وجهها الماء ( يعني : رش عليها الماء رشا رفيقا ) , ورحم الله امرأة قامت من الليل فصلت وأيقظت زوجها فصلى , فإن أبى نضحت في وجهه الماء » . (رواه أحمد و أبو داود و النسائي و ابن ماجه ) .
“আল্লাহ রহম করুন এমন পুরুষ ব্যক্তির প্রতি, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে উঠে, অতঃপর সালাত আদায় করে এবং সে তার স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়, তারপর সেও সালাত আদায় করে; অতঃপর সে (স্ত্রী) যদি ঘুম থেকে উঠতে আপত্তি করে, তাহলে তার মুখমণ্ডলের উপর হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দেয়। আর আল্লাহ রহম করুন এমন নারীর প্রতি, যে রাতে ঘুম থেকে উঠে, অতঃপর সালাত আদায় করে এবং সে তার স্বামীকে জাগিয়ে দেয়, তারপর সেও সালাত আদায় করে; অতঃপর সে (স্বামী) যদি ঘুম থেকে উঠতে আপত্তি করে, তাহলে তার মুখমণ্ডলের উপর হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দেয়।”[1]
স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কটি পার্থিব ও বস্তুগত কোনো সম্পর্ক নয়; নয় চতুষ্পদ জন্তুর প্রবৃত্তির মত কোনো সম্পর্ক; বরং তা হল আত্মীক ও সম্মানজনক একটি সম্পর্ক; আর যখন এই সম্পর্কটি নির্ভেজাল ও যথাযথ হবে, তখন তা মৃত্যুর পর পরকালীন জীবন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে; আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿جَنَّٰتُ عَدۡنٖ يَدۡخُلُونَهَا وَمَن صَلَحَ مِنۡ ءَابَآئِهِمۡ وَأَزۡوَٰجِهِمۡ وَذُرِّيَّٰتِهِمۡۖ ﴾ [الرعد: ٢٣]
“স্থায়ী জান্নাত, তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকাজ করেছে তারাও।” - ( সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৩ )।
২. সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপন করা: যে জিনিসটি এ পবিত্র দাম্পত্য সম্পর্ককে হেফাযত ও তত্ত্বাবধান করে, তা হল পরস্পর সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপন করা; আর এটা ততক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হবে না, যতক্ষণ না প্রত্যেক পক্ষ তার ভাল-মন্দ সম্পর্কে বুঝতে পারবে। বস্তুত ঘর ও পরিবারের ব্যাপারে সার্বিক পূর্ণতার বিষয়টি সুদূর পরাহত, তাই পরিবারের সদস্য কিংবা অন্যদের মধ্যে সকল বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণতা লাভ করার আশা করাটা মানব স্বভাবে নাগালের বাইরের বিষয়।
>সুস্থ বিবেক এবং পরিপক্ক চিন্তার দাবী হচ্ছে, কতিপয় অসহিষ্ণুতাকে গ্রহণ করা এবং অসুখকর বিষয় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখার ব্যাপারে মনকে তৈরী করে রাখা। কারণ, পুরুষ হল পরিবারের কর্তা, তার নিজের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা নারীর চেয়ে অধিক হবে এটাই দাবি। কেননা, পুরুষ জানে যে, নারী তার সৃষ্টিগত ও স্বভাব-প্রকৃতির দিক থেকে দুর্বল; যখন তাকে প্রত্যেক বিষয়ে জবাবদিহির সম্মুখীন করা হবে, তখন সে সব বিষয়ে জবাব দিতে অক্ষম হয়ে পড়বে; আর তাকে সোজা করার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করার বিষয়টি তাকে ভেঙ্গে ফেলার দিকে নিয়ে যাবে, আর তার ভেঙ্গে যাওয়া মানে তাকে তালাক দেওয়া; নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে কোনো কথা বলেন না, (বরং যা বলেন আল্লাহর পক্ষ থেকেই বলেন) তিনি বলেন,
« استوصوا بالنساء فإن المرأة خلقت من ضلع وإن أعوج شيء في الضلع أعلاه , فإن ذهبت تقيمه كسرته , وإن تركته لم يزل أعوج فاستوصوا بالنساء » . ( رواه البخاري و مسلم ) .
“তোমরা নারীদের ব্যাপারে উত্তম উপদেশ গ্রহণ কর। কারণ, নারী জাতিকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে; আর পাঁজরের হাড়গুলোর মধ্যে উপরের হাড়টি অধিক বাঁকা; সুতরাং তুমি যদি তা সোজা করতে যাও, তাহলে তা ভেঙ্গে ফেলবে; আর যদি এমনি ছেড়ে দাও, তাহলে সব সময় তা বাঁকাই থেকে যাবে; কাজেই নারীদের সাথে কল্যাণমূলক কাজ করার উপদেশ গ্রহণ কর।”[1] সুতরাং নারীর মধ্যে বক্রতার বিষয়টি মৌলিকভাবেই সৃষ্টিগত; অতএব, আবশ্যক হলো সহজসুলভ আচরণ করা এবং ধৈর্য ধারণ করা।
তাই পুরুষের উপর কর্তব্য হল, তার পরিবারের পক্ষ থেকে যে অসহিষ্ণু আচরণের প্রকাশ ঘটবে, সে ক্ষেত্রে তার সাথে দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে না পড়া; আর সে যেন তাদের মধ্যকার বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকসমূহ থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে চলে এবং তার কর্তব্য হল তাদের মধ্যকার ভাল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা, আর এর মধ্যে সে অনেক ভালো কিছু পাবে।
অনুরূপ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
« لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً ( أي : لا يبغض و لا يكره ) إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ » . ( رواه مسلم ) .
“কোন মুমিন পুরুষ কোনো মুমিন নারীকে ঘৃণা ও অপছন্দ করবে না; যদি সে তার কোনো স্বভাবকে অপছন্দ করেও, তাহলে সে তার অপর একটি স্বভাবকে পছন্দ করবে।”[2] আর সে যেন এ ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণে ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করে; সে যদি তার অপছন্দনীয় কোনো কিছু দেখে, তাহলে এটাই শেষ কথা হিসেবে গ্রহণ না করে, কারণ সে জানে না কোথায় রয়েছে কল্যাণের মাধ্যম ও ভালোর উৎস।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ... وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا ١٩ ﴾ [النساء: ١٩]
“ ... আর তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে; তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।” - (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯ )।
আর শান্তি কিভাবে হবে? আর প্রশান্তি ও হৃদ্যতা কোত্থেকে আসবে? যখন পরিবারের কর্তা কঠোর প্রকৃতির, দুর্ব্যবহারকারী ও সংকীর্ণমনা হন; যখন তাকে নির্বুদ্ধিতা পরাভূত করে; আর তাড়াহুড়া, সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে ধীরতা ও রাগের ক্ষেত্রে দ্রুততার বিষয়টি তাকে অন্ধ করে তুলে; যখন সে প্রবেশ করে, তখন বেশি বেশি খোটা দেয়; আর যখন বের হয়, তখন সে কুধারণা করে? অথচ এটা জানা কথা যে, উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপন এবং সৌভাগ্যের উপায়-উপকরণসমূহ কেবল উদারতা এবং ভিত্তিহীন যাবতীয় ধ্যানধারণা ও সন্দেহ থেকে দূরে থাকার মধ্য দিয়েই অর্জিত হতে পারে। আর আত্মমর্যাদা বা ব্যক্তিত্বের অহংবোধ কখনও কখনও কিছু সংখ্যক মানুষকে কুধারণা পোষণ করার দিকে নিয়ে যায়... তাকে নিয়ে যায় বিভিন্ন কথাবার্তার অপব্যাখ্যা কিংবা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে সন্দেহ তৈরী করতে। আর তখন তা কোনো নির্ভরযোগ্য কারণ ছাড়াই ব্যক্তির জীবনকে বিস্বাদ করে দেয় এবং মনকে অস্থির করে তুলে। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ وَلَا تُضَآرُّوهُنَّ لِتُضَيِّقُواْ عَلَيۡهِنَّۚ ﴾ [الطلاق: ٦]
“আর তাদেরকে উত্যক্ত করবে না সংকটে ফেলার জন্য।” - (সূরা আত-তালাক, আয়াত: ৬)। আর কিভাবে এ কাজটি একজন লোক তার স্ত্রী সম্পর্কে করতে পারে, অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
« خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي » . ( رواه الترمذي و ابن ماجه ) .
“তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম, তোমাদের মধ্যে যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম; আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীর নিকট উত্তম।”[3]
>[2] মুসলিম, আস-সহীহ (১৪৬৯);
ফায়দা: হাফেয ইবনু হাজার র. যা বলেছেন, তার সারকথা হল: হাদীসের মধ্যে সহানুভূতির মাধ্যমে স্ত্রীকে পুনর্গঠনের ইঙ্গিত রয়েছে; সুতরাং সে তাতে অতিরঞ্জন করবে না, যাতে সংসার ভেঙ্গে যায়; আর সে তাকে একেবারে ছেড়ে দেবে না; যাতে সে তার বক্রতার উপরেই চলতে থাকবে। আর এর বিধিবদ্ধ নিয়ম হল: যখন স্ত্রী তার স্বভাবগত ত্রুটিটি বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে, আর তা তাকে সরাসরি অবাধ্যতাকে গ্রহণ করার দিকে অথবা আবশ্যকীয় বিষয় বর্জন করার দিকে নিয়ে যাবে; এমতাবস্থায় সে তাকে বক্রতার উপর ছেড়ে দেবে না। পক্ষান্তরে যখন তার বক্রতাটি কোনো বৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে হয়, তখন সে তাকে তার উপর ছেড়ে দেবে। - দেখুন: ফাতহুল বারী, ৯/২৫৪।
[3] হাদিসটি সহীহ; তা বর্ণনা করেছেন তিরমিযী (৩৮৯২); ইবনু মাজাহ (১৯৭৭); ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ (১৩১২)
মুসলিম নারীর জেনে রাখা উচিত যে, সৌভাগ্য, ভালোবাসা ও অনুকম্পা তখনই পরিপূর্ণতা লাভ করবে, যখন সে সচ্চরিত্রবান ও দ্বীনদার হবে; সে তার নিজের জন্য উপকারী ইতিবাচক দিকগুলো জেনে নিবে; যাতে সে তার সীমা অতিক্রম ও লঙ্ঘন না করে; সে তার স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিবে; কারণ, তাকে পরিচালনার ব্যাপারে স্বামীর উপর দায়িত্ব রয়েছে, স্বামী তাকে হেফাযত করবে, সংরক্ষণ করবে এবং তার জন্য ব্যয় করবে; সুতরাং স্ত্রীর উপর আবশ্যক হলো, স্বামীর আনুগত্য করা, স্বামীর জন্য সে তার নিজকে সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করা এবং স্বামীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করা; আর স্ত্রী তার নিজের কাজ-কর্ম সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিবে ও তা যথাযথভাবে পালন করবে এবং সে তার নিজের ও সংসারের প্রতি যত্নবান হবে; সে হবে পবিত্রা স্ত্রী, মমতাময়ী মাতা, তার স্বামীর সংসারের রক্ষণাবেক্ষণকারিনী দায়িত্বশীলা, যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে তাকে জবাবদিহী করতে হবে। সে তার স্বামীর ভালো ও সৌন্দর্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দিবে, তার অবদান ও উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপনের বিষয়টিকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করবে না; এই ধরনের অবজ্ঞা প্রদর্শন ও অস্বীকার করার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করেছেন, তিনি বলেছেন:
« أريت النار فإذا أكثر أهلها النساء يكفرن » . قيل : أيكفرن بالله ؟ قال : « يكفرن العشير ويكفرن الإحسان ؛ لو أحسنت إلى إحداهن الدهر ثم رأت منك شيئا قالت : ما رأيت منك خير قط » . ( رواه البخاري ) .
“আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়; (তখন আমি দেখি) তার অধিবাসীদের অধিকাংশই স্ত্রীলোক, যারা কুফরী করে। জিজ্ঞাসা করা হল: তারা কি আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করে? তিনি বললেন: “তারা স্বামীর অবাধ্য হয় এবং ইহসান (সদ্ব্যবহার) অস্বীকার করে; তুমি যদি দীর্ঘকাল তাদের কারও প্রতি ইহসান করে থাক, এরপর সে তোমার সামান্য অবহেলা দেখলেই বলে, আমি কখনও তোমার কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পাইনি।”[1]
সুতরাং আবশ্যক হল ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করা এবং অপরাধ বা ভুল-ভ্রান্তির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা ... স্বামী উপস্থিত থাকলে তার প্রতি দুর্ব্যবহার করবে না, আর স্বামী অনুপস্থিত থাকলে, স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।
এর মাধ্যমেই পারস্পরিক সন্তুষ্টি অর্জিত হবে, সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব স্থায়ী হবে এবং আন্তরিকতা, ভালবাসা ও সহমর্মিতা প্রাধান্য বিস্তার করবে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষায়:
« أيما امرأة ماتت وزوجها عنها راض دخلت الجنة » . (رواه الترمذي و ابن ماجه) .
“যে নারীই তার প্রতি তার স্বামী সন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় মারা যাবে, সে নারী জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[2]
সুতরাং হে মুসলিম জাতি! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ যে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও একতা অর্জন করার মাধ্যমে সৌভাগ্য পরিপূর্ণতা লাভ করবে, শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ তৈরি হবে এবং তরুণ সমাজ বেড়ে উঠবে এমন এক মর্যাদাবান ঘরে, যা ভালাবাসার দ্বারা পরিপূর্ণ, পারস্পরিক বুঝাপড়ার দ্বারা সমৃদ্ধ ... মাতৃত্বের সহানুভূতিশীলতা ও পিতৃত্বের করুণার মাঝে (বিদ্যমান) ... তারা অবস্থান করবে অনেক দূরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিতর্কের শোরগোল এবং একে অন্যের সাথে বাড়াবাড়ি থেকে; যাতে করে সেখানে থাকবে না কোনো প্রকার অনৈক্য, মতবিরোধ ও দুর্ব্যবহার, কাছে কিংবা দূরে। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿... رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا ٧٤ ﴾ [الفرقان: ٧4]
“ ... হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন, যারা হবে আমাদের জন্য চোখজুড়ানো। আর আপনি আমাদেরকে করুন মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য।”- (সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৭৪)।
>[2] হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তিরমিযী (১১৬১) এবং তিনি তাকে ‘হাসান’ বলেছেন; ইবনু মাজাহ (১৮৫৪); হাকেম, ৪/১৭৩ এবং তিনি বলেছেন: হাদিসটির সনদ সহীহ (বিশুদ্ধ)।
পরিশেষে- আমার মুসলিম ভাই ও বোন! আল্লাহ তোমাদেরকে তাওফীক দিন:
নিশ্চয়ই পরিবারের সংস্কার হল গোটা সমাজের নিরাপত্তার উপায়; এমন সমাজকে সংস্কার করা অসম্ভব, যাতে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়েছে; কিভাবেই বা সম্ভব, অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পারিবারকে নিয়ামত হিসেবে আমাদের কাছে অনুগ্রহ হিসেবে তুলে ধরেছেন। যে নেয়ামতটি হচ্ছে পরিবারের পরস্পর বন্ধন, মিলন ও চিরাচয়িত সম্পর্ক ..। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:
﴿ وَٱللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا وَجَعَلَ لَكُم مِّنۡ أَزۡوَٰجِكُم بَنِينَ وَحَفَدَةٗ وَرَزَقَكُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَٰتِۚ أَفَبِٱلۡبَٰطِلِ يُؤۡمِنُونَ وَبِنِعۡمَتِ ٱللَّهِ هُمۡ يَكۡفُرُونَ ٧٢ ﴾ [النحل: ٧٢]
“আর আল্লাহ তোমাদের থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন; আর তোমাদের যুগল থেকে তোমাদের জন্য পুত্র-পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবণোপকরণ দান করেছেন। তবুও কি ওরা মিথ্যাতে বিশ্বাস করবে এবং ওরা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?” - ( সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৭২ )।
নিশ্চয়ই স্বামী-স্ত্রী ও তাদের মধ্যকার মজবুত সম্পর্ক এবং পিতা-মাতা ও তাদের কোলে বেড়ে উঠা সন্তান-সন্ততি- এ বিষয় দু’টি বর্তমান জাতি ও ভবিষ্যৎ জাতি হিসেবে বিবেচ্য। তাই এটা বলা যায় যে, শয়তান যখন পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করার ব্যাপারে সফল হবে, তখন এর মাধ্যমে সে কেবল একটি সংসারকেই ধ্বংস করবে না, কোনো সীমাবদ্ধ অনিষ্টতাই সংঘটিত করবে না বরং তা গোটা জাতিকে বড় ধরনের ক্ষতি ও দ্রুততর অনিষ্টতার মধ্যে নিক্ষেপ করবে। আর বর্তমান বাস্তবতা তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সুতরাং আল্লাহ ঐ পুরুষ ব্যক্তিকে রহম করুন, যিনি প্রশংসনীয় চরিত্র ও উৎকৃষ্ট মনের অধিকারী, উদার, কোমল, দয়ালু, তার পরিবারের প্রতি স্নেহপরায়ণ এবং তার কাজের ব্যাপারে বিচক্ষণ; যিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না, কঠোরতা আরোপ করে যুলুম করেন না এবং দায়িত্বের ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দেন না।
আর আল্লাহ ঐ নারীর প্রতি রহম করুন, যিনি ভুল-ত্রুটি খোঁজে বেড়ান না, বেশি শোরগোল করেন না, সততাপরায়ণা, আনুগত্যপরায়ণা এবং অদৃশ্য অংশের হেফাজতকারিনী, যেভাবে আল্লাহ হেফাজত করেছেন।
সুতরাং হে স্বামী ও স্ত্রীগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; আর হে মুসলিমগণ! তোমরাও আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করবে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দিবেন।
(আল্লাহ রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের প্রতি; আরও রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন তাঁর সাহাবীগণ এবং কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যারা তাঁদেরকে উত্তমভাবে অনুসরণ করবে তাদের প্রতি)।
سبحانك اللهم و بحمدك , أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك و أتوب إليك
(হে আল্লাহ! তোমার প্রশংসাসহ তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি; আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তোমার নিকট তাওবা করছি)।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টি করেন, অতঃপর সুঠাম করেন, যিনি নির্ধারণ করেন, অতঃপর পথনির্দেশ করেন; আমি তার প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করছি। তিনি শেষে ও প্রথমে সকল প্রশংসার প্রাপ্য মালিক। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, যাঁর কোনো শরীক নেই; আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নেতা ও নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি নির্বাচিত নবী ও বান্দা; আল্লাহ তাঁর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীগণ এবং যে ব্যক্তি তাঁর দা‘ওয়াতের মাধ্যমে দা‘ওয়াত দান করে ও যে ব্যক্তি তাঁর পদ্ধতির অনুসরণে জীবনযাপন করে, সে ব্যক্তিসহ উল্লেখিত সকলের উপর রহমত, শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন।
অতঃপর:
জেনে রাখুন, আল্লাহ আপনাকে তাওফীক দিন— আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম মহান নিয়ামত ও নিদর্শন হল ঘর-সংসার, যা আশ্রয়স্থল ও শান্তি নিকেতন; তার ছায়াতলে মানবগোষ্ঠী ভালবাসা ও অনুকম্পা, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা এবং মহৎ জীবন ও শালীনতা লাভ করবে ... তার কোলে শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজ বেড়ে উঠবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বিস্তার লাভ করবে এবং পারস্পরিক দায়বদ্ধতা শক্তিশালী হবে। অন্তরের সাথে অন্তর যুক্ত হবে ... এবং মনের সাথে মনের আলিঙ্গন হবে; আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ هُنَّ لِبَاسٞ لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٞ لَّهُنَّۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]
“তারা তোমাদের পোষাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোষাকস্বরূপ।” - ( সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭ )।
এই মজবুত সম্পর্ক ও উন্নত সংসারের মধ্যে উত্তম বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটবে এবং ঐসব পুরুষ ব্যক্তিগণ বেড়ে উঠবে, যাদেরকে আমানতস্বরূপ মহান দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে; আর ঐসব নারীদেরকে শিক্ষা দেওয়া হবে, যারা বংশমূল তথা জাতির ভবিষ্যতকে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করে।
জীবনের বাস্তবতা এবং মানুষ (যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন; আর যা তিনি সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে তিনি সবচেয়ে বেশি ভাল জানেন) সে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে কখনও কখনও (জীবনের বাস্তবতায়) এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যাতে দিক-নির্দেশনা কাজ করে না এবং ভালবাসা ও প্রশান্তি সুদৃঢ় হয় না; যার কারণে কখনও কখনও দাম্পত্য সম্পর্ক অটুট রাখা কষ্টকর ও কঠিন হয়ে যায়। ফলে তাতে দাম্পত্য জীবনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় না এবং তার দ্বারা নবীন সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে সমর্থ হয় না। আর এ বিশৃঙ্ল ও অনৈক্যের অবস্থা বা পরিস্থিতিসমূহের কারণসমূহ কখনও কখনও হয়ে থাকে আভ্যন্তরীণ আবার কখনও কখনও হয় বহিরাগত।
যেমন কখনও কখনও এ সমস্যার উত্থান হয়: স্বামী-স্ত্রীর অভিভাবক অথবা তাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্য অনভিজ্ঞ ব্যক্তির হস্তক্ষেপ, অথবা স্বামী-স্ত্রীর সকল ছোট বড় কর্মকাণ্ডের পশ্চাদ্ধাবন; আবার কখনও কখনও পরিবারের কোনো কোনো অভিভাবক এবং পরিবারের বড়দের পক্ষ থেকে তাদের অধিনস্থদের উপর এত বেশি নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া হয় যে, তা কখনও কখনও বিচারকের নিকট বিচার নিয়ে যাওয়ার পর্যন্ত গড়ায়; ফলে আড়ালে ঢাকা রহস্যসমূহ প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং গোপন বিষয়সমূহ উম্মোচন হয়ে যায়, আর এগুলো হয় নিছক ছোট-খাট বিষয় অথবা তুচ্ছ কিছু কারণে; যার উৎপত্তি হয়ত অনুপযুক্ত অথবা প্রজ্ঞাশূন্য হস্তক্ষেপ অথবা তাড়াহুড়া ও দ্রুততা অবলম্বন বা গুজব ও আজে-বাজে কথায় কান দেওয়া ও সেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করা।
আর কখনও কখনও সমস্যার উৎসস্থল হয়: দীনের ব্যাপারে দূরদর্শিতার স্বল্পতা ও মহানুভব শরী‘য়তের বিধিবিধানসমূহের ব্যাপারে অজ্ঞতা এবং পুঞ্জীভূত কুঅভ্যাস ও দুর্বল চিন্তাধারা লালন করা।
ফলে কোনো কোন স্বামী বিশ্বাস করে বসে যে, তালাকের দ্বারা হুমকি দেওয়া অথবা তা উচ্চারণ করা হল দাম্পত্য বিরোধ ও পারিবারিক সমস্যার একটি সঠিক সমাধান; সুতরাং সে তার প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় এবং তার নির্দেশ প্রদান ও নিষেধাজ্ঞার সময়ে, এমনকি তার সকল অবস্থায় (স্ত্রীর সাথে) কথাবার্তার ক্ষেত্রে তালাকের শব্দগুলো ব্যতীত অন্য কিছু জানে না বা বুঝে না; আর সে এও জানে না যে, এর দ্বারা সে প্রকারান্তরে আল্লাহর আয়াতসমূহকে উপহাস হিসেবে গ্রহণ করেছে; সে তার কর্মকাণ্ডে অপরাধী বা পাপী হচ্ছে, তার সংসার ধ্বংস করছে এবং তার পরিবার-পরিজন হারাচ্ছে।
হে মুসলিমগণ! এটাই কি দীনের ফিকহ তথা সুক্ষ্ম জ্ঞান হতে পারে?!
নিশ্চয়ই শরী‘য়ত কর্তৃক অনুমোদিত সুন্নাত পদ্ধতি যে তালাকের বিধান রয়েছে তার উদ্দেশ্য দাম্পত্য সম্পর্কের বন্ধন বা রশি কর্তন করা নয়, বরং বলা যায় যে, এ পদ্ধতির তালাক হচ্ছে এই সম্পর্ক সাময়িকভাবে আটকে রাখা এবং প্রতীক্ষা, চিন্তাভাবনা ও সংশোধনের একটি পর্যায়; আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ ... لَا تُخۡرِجُوهُنَّ مِنۢ بُيُوتِهِنَّ وَلَا يَخۡرُجۡنَ إِلَّآ أَن يَأۡتِينَ بِفَٰحِشَةٖ مُّبَيِّنَةٖۚ وَتِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ ٱللَّهِ فَقَدۡ ظَلَمَ نَفۡسَهُۥۚ لَا تَدۡرِي لَعَلَّ ٱللَّهَ يُحۡدِثُ بَعۡدَ ذَٰلِكَ أَمۡرٗا ١ فَإِذَا بَلَغۡنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمۡسِكُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٍ أَوۡ فَارِقُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٖ ... ﴾ [الطلاق: ١، ٢]
“ ... তোমরা তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও বের হবে না, যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়। আর এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা; যে আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে, সে নিজেরই উপর অত্যাচার করে। আপনি জানেন না, হয়ত আল্লাহ এর পর কোনো উপায় করে দেবেন। অতঃপর তাদের ইদ্দত পূরণের কাল আসন্ন হলে তোমরা হয় যথাবিধি তাদেরকে রেখে দেবে, না হয় তাদেরকে যথাবিধি পরিত্যাগ করবে। ...” - (সূরা আত-তালাক, আয়াত: ১-২)।
এটাই হচ্ছে শরী‘য়ত। বরং বিষয়টি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; নিশ্চয়ই সুন্নাত পদ্ধতিতে তালাক প্রদানের বিধানটি প্রতিকারের সর্বশেষ অস্ত্র এবং এর পূর্বে অনেকগুলো উপায় রয়েছে।
আমার মুসলিম ভাই ও বোন:
যখন বিরোধের আলামত, অবাধ্যতা, মতানৈক্যের লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তখন তালাক বা তালাকের হুমকি প্রদান করা তার প্রতিকার নয়।
প্রতিকারের জন্য যা দাবি করা হয়, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল: ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, বিবেক ও বুদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্নতা এবং স্বভাব-প্রকৃতির ক্ষেত্রে ভিন্নতার বিষয়টি অনুধাবন করা; সাথে আরও জরুরি হল অনেক বিষয়ে উদারতার পরিচয় দেওয়া এবং দেখেও না দেখার ভান করা; কারণ সব সময় সে যা পছন্দ ও কামনা করে, তার মধ্যে মঙ্গল ও কল্যাণ হয় না, বরং কখনও কখনও সে যা পছন্দ ও কামনা করে না, তার মধ্যেই কল্যাণ হয়; আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ ... وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا ١٩ ﴾ [النساء: ١٩]
“আর তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে; তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।” - (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯ )।
কিন্তু যখন সমস্যা প্রকাশ পাবে, পারস্পরিক দায়বদ্ধতার বন্ধনে শিথিলতা দেখা দিবে এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে অবাধ্যতা, তার স্বভাব চরিত্রে অহমিকা এবং তার দায়িত্ব থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রকাশ পাবে; যেমন- ঘৃণার প্রকাশ পাওয়া, স্বামীর অধিকারের ব্যাপারে কমতি করার বিষয় এবং স্বামীর মর্যাদাকে অবজ্ঞা করার বিষয় প্রকাশ করা, তখন ইসলামে এর চিকিৎসা বা প্রতিকার সুস্পষ্ট; তাতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনোভাবেই তালাক প্রসঙ্গ আসবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সুস্পষ্ট কিতাবে বলেন:
﴿ ... وَٱلَّٰتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَٱهۡجُرُوهُنَّ فِي ٱلۡمَضَاجِعِ وَٱضۡرِبُوهُنَّۖ فَإِنۡ أَطَعۡنَكُمۡ فَلَا تَبۡغُواْ عَلَيۡهِنَّ سَبِيلًاۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيّٗا كَبِيرٗا ٣٤ ﴾ [النساء: ٣٤]
“ ... আর স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদেরকে প্রহার কর। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ অন্বেষণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, মহান।” - (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৪ )।
তাই বুঝা গেল যে, উক্ত অবস্থার প্রতিকার হবে উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে, ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, অধিকারসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে এবং আল্লাহর গজব ও ঘৃণা থেকে ভয় প্রদর্শন করার মাধ্যমে; সাথে আরও প্রয়োজন বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যের পথে চলার জন্য উৎসাহ প্রদান ও ভয় প্রদর্শন করা।
আর কখনও কখনও অহমিকা ও অবাধ্যতার মোকাবিলায় শয্যা বর্জন ও বয়কট করা হচ্ছে এর প্রতিকার; আপনারা লক্ষ্য করুন যে, শয্যা বর্জন করার অর্থ শয়নকক্ষ বর্জন করা নয়; ... তা হল শয্যা বর্জন করা, ঘর বয়কট করা নয় ... পরিবার বা সন্তান বা অপরিচিত লোকজনের সামনে নয়।
উদ্দেশ্য হল প্রতিকার করা, ঘোষণা করা অথবা অপমান করা অথবা গোপন বিষয় প্রকাশ করা নয়; বরং উদ্দেশ্য হল বর্জন ও বয়কটের মাধ্যমে অবাধ্যতা ও অহংকারের মোকাবিলা করা, যা পারস্পরিক ঐক্য, সংহতি ও সমতার দিকে পরিচালিত করে।
আর কখনও কখনও কিছু কঠোর ও রূঢ় মনোভাবের মাধ্যমে প্রতিকার হতে পারে; কারণ, কিছু মানুষ এমনও রয়েছে, যাদেরকে সোজা করার ক্ষেত্রে উত্তম ব্যবহার ও ভদ্র কথায় কোনো কাজ হয় না; বরং তারা এমন শ্রেণীর মানুষ যাদেরকে অধিকাংশ সময় নম্র ব্যবহার ও সহিষ্ণুতা অবাধ্য করে তোলে ... সুতরাং যখন কঠোরতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে, তখন অবাধ্য ব্যক্তি থেমে যাবে এবং বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি শান্ত হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, কখনও কখনও কিছু চাপ প্রয়োগের আশ্রয় নেয়াটাও কার্যকর প্রতিষেধক হতে পারে; আর কেনই বা সে তার আশ্রয় নিবে না, অথচ দায়িত্বের প্রতি বৈরী ভাব ও স্বভাব-প্রকৃতি থেকে বের হওয়ার মত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে যাচ্ছে?
আর সকল বিবেকবান ব্যক্তির নিকট বিদিত যে, কঠোরতা যখন সংসারের জন্য তার শৃঙ্খলা ও মজবুত বন্ধনকে ফিরিয়ে দিবে এবং পরিবারকে ফিরিয়ে দিবে ভালবাসা ও হৃদ্যতা, তখন তা নিঃসন্দেহে তালাক ও বিচ্ছেদের চেয়ে উত্তম; তা হবে ইতিবাচক, শিক্ষামূলক ও অর্থবহ সমাধান; ঘায়েল করা ও প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে নয়; বরং তার দ্বারা অবাধ্যতাকে দমন করা হয় এবং বিশৃঙ্খলাকে সংযত করা করা হয়।
আর যখন স্ত্রী তার স্বামীর পক্ষ থেকে দুর্ব্যবহার ও উপেক্ষার আশঙ্কা করবে, তখন আল-কুরআনুল কারীম তার প্রতিকারের দিক নির্দেশনা প্রদান করে তাঁর বাণীর মাধ্যমে, আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ وَإِنِ ٱمۡرَأَةٌ خَافَتۡ مِنۢ بَعۡلِهَا نُشُوزًا أَوۡ إِعۡرَاضٗا فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَآ أَن يُصۡلِحَا بَيۡنَهُمَا صُلۡحٗاۚ وَٱلصُّلۡحُ خَيۡرٞۗ ... ﴾ [النساء: ١٢٨]
“আর কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর দুর্ব্যবহার কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে, তবে তারা আপোস-নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাদের কোনো গোনাহ নেই এবং আপোস-নিষ্পত্তিই শ্রেয়।” - (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১২৮ ); প্রতিকার হবে আপোস-নিষ্পত্তি ও শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে, তালাক ও সম্পর্ক বাতিলের মাধ্যমে নয়। আবার কখনও কখনও বিবাহ বন্ধনকে সুরক্ষার জন্য আর্থিক অথবা ব্যক্তিগত অধিকারের কিছু কিছু বিষয় ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিকার হতে পারে।
وَٱلصُّلۡحُ خَيۡرٞۗ [আপোস-নিষ্পত্তি উত্তম]। অবাধ্যতা, দুর্ব্যবহার, বিদ্বেষ ও তালাকের চেয়ে আপোস-নিষ্পত্তি উত্তম।
আমার মুসলিম ভাই ও বোন:
এটা একটা গতিশীল আবেদন এবং আল্লাহর দীনের ফিকহের দিক থেকে ও তাঁর বিধিবিধানের উপর ভিত্তি করে আচার-আচরণের একটি সংক্ষিপ্ত স্মারক; সুতরাং তার থেকে মুসলিমগণ কোথায় যাচ্ছে?
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিরোধের ব্যাপারে কেন সালিস নিয়োগ করা হয় না? এ সমাধান থেকে কেন সংস্কারকগণ বিরত থাকে? সে কি প্রকৃত সংশোধনের ব্যাপারে অমনোযোগী, নাকি পরিবার ভাঙ্গন ও সন্তানদেরকে বিভক্ত করার ব্যাপারে উৎসাহী?
নিশ্চয়ই আপনি তাকে নির্বুদ্ধিতা, বাড়াবাড়ি, আল্লাহর ভয় ও তাঁর নজরদারী থেকে দূরুত্বে অবস্থান, তাঁর বিধিবিধানের অধিকাংশকে প্রত্যাখ্যান এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা রেখার ব্যাপারে ছিনিমিনি খেলা ছাড়া অন্য কিছু মনে করবেন না।
ইমাম ইবনু মাজাহ ও ইবনু হিব্বান প্রমূখ গ্রন্থকারগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন:
« ما بال أقوام يلعبون بحدود الله . يقول أحدهم : قد طلقتك . قد راجعتك . قد طلقتك ؟ أيلعب بحدود الله و أنا بين أظهركم » . ( رواه ابن ماجه و ابن حبان ) .
“কিছু লোকের কি হল যে তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে; তাদের কেউ কেউ বলে: আমি তোমাকে তালাক দিলাম, আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনলাম, আমি তোমাকে তালাক দিলাম? সে কি আল্লার নির্ধারিত সীমানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, অথচ আমি তোমাদের মাঝেই রয়েছি?”[1]
>দ্বন্দ্ব নিরসনের ব্যাপারে যখন সকল উপায় ব্যর্থ হবে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখা যখন কঠিন ও কষ্টকর হয়ে যাবে, এমনকি যখন তার সাথে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত অভিষ্ট লক্ষ্য ও মহান তাৎপর্য বাস্তবায়ন করা না যায়, তখন শরী‘য়তের উদারতা ও তার বিধানসমূহের পরিপূর্ণতার প্রমাণ হচ্ছে যে, এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য উপায় রাখা হয়েছে। তবে মুসলিমগণের অনেকেই শরী‘য়ত কর্তৃক অনুমোদিত সুন্নাত পদ্ধতির তালাকের সম্পর্কে অজ্ঞ এবং আল্লাহর সীমারেখা ও তাঁর শরী‘য়তের প্রতি লক্ষ্য রাখা ছাড়াই তালাক শব্দটি উচ্চারণ করে থাকে।
ঋতুবর্তীকালীন সময়ে তালাক দেয়া হারাম, (একসাথে) তিন তালাক প্রদান করা হারাম এবং এমন ঋতুমুক্তকালীন সময়ে তালাক প্রদান করাও হারাম, যাতে উভয়ের মাঝে মিলন (সহবাস) হয়েছে; সুতরাং এ ধরনের সকল তালাক বিদ‘আত ও হারাম (নিষিদ্ধ)। এ ধরনের তালাকদাতার পাপ হবে; কিন্তু আলেমগণের বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী তালাক সংঘটিত হয়ে যাবে।
যে সুন্নাত পদ্ধতির তালাক সম্পর্কে অবহিত হওয়া মুসলিমগণের উপর ওয়াজিব, তা হলো: ঋতুমুক্তকালীন সময়ে মাত্র এক তালাক প্রদান করা যাতে উভয়ের মিলন (সহবাস) হয়নি, অথবা গর্ভকালীন সময়ের মাঝে তালাক প্রদান করা।
এ পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তালাক প্রদান করা নিঃসন্দেহে একটি প্রতিকার হিসেবে বিবেচিত। কারণ, এতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বেশ কিছু সময় পায়, সে সময়ে তারা চিন্তা-ভাবনা কিংবা পর্যালোচনা করতে পারে।
আর এই পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তালাক প্রদানকারীকে ঋতুমুক্তকালীন সময়ের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে; আর হতে পারে যে, তখন তার মন পরিবর্তন হবে, হৃদয় জগ্রত হবে এবং আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের জন্য নতুন কোনো উপায় করে দেবেন, ফলে তাদের সম্পর্ক তালাক পর্যন্ত গড়াবে না।
আর ইদ্দতের সময়কাল, — চাই তা মাসিক জনিত ইদ্দত হউক, অথবা নির্দিষ্ট মাসসমূহের ইদ্দত হউক, অথবা গর্ভস্থ সন্তানের প্রসব সংশ্লিষ্ট ইদ্দত হউক— এ সময়ের মধ্যে স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা ও আত্মপর্যালোচনার যথেষ্ট সুযোগ থাকে; যা কখনও কখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভালবাসার বন্ধন ও দাম্পত্য সম্পর্ককে মিলিয়ে দিতে পারে।
আর মুসলিমগণ যা জানে না তন্মধ্যে অন্যতম হল: স্ত্রীকে যখন রেজ‘য়ী (প্রত্যাবর্তনযোগ্য) তালাক দেওয়া হবে, তখন তার উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল স্বামীর ঘরে অবস্থান করা; সে বের হবে না এবং তাকে বের করে দেওয়া হবে না।
বরং আল্লাহ তা‘আলা তাকে (স্বামীর ঘরকে) তার (স্ত্রীর) জন্য ঘর হিসেবে বরাদ্দ দিয়ে দিলেন; আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ لَا تُخۡرِجُوهُنَّ مِنۢ بُيُوتِهِنَّ ﴾ [الطلاق: ١]
“তোমরা তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করো না” - (সূরা আত-তালাক, আয়াত:১); এই আয়াতটি (ঘরে) অবস্থান করার বিষয়টিকে দৃঢ়তার সাথে তাদের অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। সুতরাং তার স্বামীর ঘরে তার অবস্থান করার মানে তার পুনরায় প্রত্যাবর্তনের একটা পথ, ভালবাসার সহনুভূতি উত্থাপন করার ক্ষেত্রে আশার সূচনা এবং সম্মিলিত জীবনযাপনের বিষয়টি স্মরণ করানো। ফলে এই অবস্থায় তালাকের হুকুমের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অবস্থান দূরে প্রতীয়মান হলেও চোখের দৃশ্যপট থেকে তার অবস্থান স্বামীর নিকটে।
আর এর দ্বারা মূলত উদ্দেশ্য হল তাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া অশান্ত ঝড়কে শান্ত করা, হৃদয়ে নাড়া দেওয়া, অবস্থানসমূহ পুণ পর্যালোচনা এবং ধীরে-সুস্থে নিজ সংসার, শিশু ও পরিবারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ লাভ। আল-কুরআনের ভাষায়:
﴿ ... لَا تَدۡرِي لَعَلَّ ٱللَّهَ يُحۡدِثُ بَعۡدَ ذَٰلِكَ أَمۡرٗا ١ ﴾ [الطلاق: ١ ]
“ ... আপনি জানেন না, হয়ত আল্লাহ এর পর কোনো উপায় করে দেবেন।” - ( সূরা আত-তালাক, আয়াত: ১ )।
সুতরাং হে মুসলিমগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর ... এবং তোমাদের ঘর-সংসারসমূহকে হেফাযত কর; আর তোমাদের দীনের বিধানসমূহ জানতে ও বুঝতে শিখ ... আর আল্লাহর সীমারেখা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখ এবং তা লঙ্ঘন করো না; আর তোমারা তোমাদের নিজেদের মাঝে (সম্পর্কের) সংশোধন ও সংস্কার করে নাও।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে দীনের ব্যাপারে সঠিক বুঝ এবং শরী‘য়তের ব্যাপারে দূরদর্শিতা দান করুন; হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার কিতাবের হিদায়াতের মাধ্যমে উপকৃত করুন; আর আপনার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা আচার-আচরণ আমাদেরকে দান করুন।