কুরআনে কারীম ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে গুনাহ্ মাফের আমল ইসলামহাউজ.কম ৩২ টি
কুরআনে কারীম ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে গুনাহ্ মাফের আমল ইসলামহাউজ.কম ৩২ টি

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« قَالَ اللَّهُ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى: مَنْ عَلِمَ أَنِّي ذُو قُدْرَةٍ عَلَى مَغْفِرَةِ الذُّنُوبِ، غَفَرْتُ لَهُ وَلا أُبَالِي مَا لَمْ يُشْرِكْ بِي شَيْئًا» . (صحيح الجامع الصغير و زيادته: 4206).

“আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন: যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, আমিই গুনাহ মাফ করার ক্ষমতাবান, তাকে আমি ক্ষমা করে দেই এবং যতক্ষণ সে আমার সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করে, ততক্ষণ (তাকে ক্ষমা করার ব্যাপারে) আমি কোনো কিছুর পরওয়া করি না।” [সহীহুল জামে‘ আস-সাগীর ওয়া যিয়াদাতুহু: ৪২০৬]।

 সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য; আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি; আর আমাদের নফসের জন্য ক্ষতিকর এমন সকল খারাপি এবং আমাদের সকল প্রকার মন্দ আমল থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। আল্লাহ যাকে পথ প্রদর্শন করেন, কেউ তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না; আর তিনি যাকে পথহারা করেন, কেউ তাকে পথ দেখাতে পারবে না। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল।

অতঃপর:

বান্দা অপরাধ থেকে মুক্ত নয়; সুতরাং এই ত্রুটি থেকে কোনো আদম সন্তানই মুক্ত নয়। আর নিষ্পাপ শুধু সেই, যাকে আল্লাহ তা‘আলা পাপমুক্ত করেছেন।

আর মানুষ শক্তি ও সামর্থ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে; এটাই অমোঘ মূলনীতি। আর যে ব্যক্তি নিজকে নিয়ে পর্যালোচনা করবে, সে তাকে এই ধরনের ত্রুটিতে ভরপুর পাবে; সুতরাং যখন তাকে তাওফীক (শক্তি-সামর্থ্য) দেওয়া হবে, তখন তার উপর ধ্বংসাত্মক আক্রমণের ভয়ে সে এর থেকে সতর্ক ও সচেতন হবে এবং আল্লাহর পথ থেকে ভিন্ন পথে চলার কারণে সে ব্যথা অনুভব করবে। অতঃপর যখন সে ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করবে, তখন সে মুক্তির আশায় গুনাহের অভ্যাস ছেড়ে দিয়ে দ্রুত আল্লাহর দিকে ফিরে আসবে। আর তখন সে গুনাহ মাফের দরজা উন্মুক্ত অবস্থায় পাবে, যার দুই পাল্লায় লেখা থাকবে:

﴿ قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣ ﴾ [الزمر: ٥٣]

“বলুন, ‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ---আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় আল্লাহ্ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[1]

পাপ মোচন দু’ভাবে হয়:

প্রথমত: মুছে ফেলা বা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া; যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا » . ( رواه الترمذي ) .

“আর তুমি অসৎ কাজ করলে সাথে সাথেই সৎকাজ কর, তাহলে ভালো কাজ মন্দ কাজকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।”[2] আর এটা হল ক্ষমার পর্যায়।

দ্বিতীয়ত: পরিবর্তন করে দেওয়া; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿إِلَّا مَن تَابَ وَءَامَنَ وَعَمِلَ عَمَلٗا صَٰلِحٗا فَأُوْلَٰٓئِكَ يُبَدِّلُ ٱللَّهُ سَيِّ‍َٔاتِهِمۡ حَسَنَٰتٖۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا ٧٠﴾ [الفرقان: ٧٠]

“তবে যে তাওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, ফলে আল্লাহ্ তাদের গুণাহসমূহ নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[3] আর এটা হল ‘মাগফিরাত’ তথা গুনাহ মাফের পর্যায়।

আর যে ব্যক্তি (গুনাহ মাফের) দু’টি পর্যায় নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে, সে সূক্ষ্ম পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারবে; কারণ, মাগফিরাতের মধ্যে ক্ষমার উপর অতিরিক্ত ইহসান ও দয়ার ব্যাপার রয়েছে; আর এ দু’টিই উত্তম ও শুভসংবাদ।

জেনে রাখুন, এই দীন কত উদার! আর তার নিয়মনীতি কত সহজ! তার প্রতিটি শ্লোগানই হল উচ্চতা, শ্রেষ্ঠত্ব, পবিত্রতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নির্ভর; আর তার প্রত্যেকটি অর্পিত দায়িত্বপূর্ণ কাজ, শাস্তিবিধান, নির্দেশ এবং ধমক বা তিরস্কারের মূল লক্ষ্য হল পবিত্র ও পরিশুদ্ধ ব্যক্তি তৈরি করা। আল-কুরআনের ভাষায়:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ

“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই রবের ‘ইবাদাত কর, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হও।”[4]

নিশ্চয় এই শ্লোগান এবং শরী‘য়ত কর্তৃক নির্ধারিত এই দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ মানুষের দুর্বলতা ও অক্ষমতা সম্পর্কে অচেতন নয়, তার শক্তি ও সামর্থ্যের সীমানা অতিক্রম করে না, তার স্বভাবকে অবজ্ঞা করে না এবং তার মনের অনেক অনেক আগ্রহ ও উদ্দীপনা সম্পর্কে অজ্ঞ নয়।

আর সেই কারণেই অর্পিত কাজের দায়িত্ব ও শক্তি-সামর্থ্যের মধ্যে, ঠেলে দেওয়া ও টেনে ধরার মধ্যে, উৎসাহিত করা ও হুমকি প্রদানের মধ্যে, নির্দেশ ও তিরস্কারের মধ্যে এবং অপরাধের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড আকারে শাস্তির ভয় প্রদর্শন ও ক্ষমার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারি আশা পোষণ করার মধ্যে এক চমৎকার ভারসাম্য রয়েছে।

এই দীন মানব আত্মাকে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ অভিমুখী এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। ... এর পরেও সেখানে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার অবারিত রহমত ... যা ভুল-ত্রুটির মত ঘাটতি পূরণ করবে ... সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হবে ... তাওবা কবুল করবে ... গুনাহ ক্ষমা করবে ... পাপরাশি ধুয়ে-মুছে সাফ করে দিবে ... এবং প্রত্যাবর্তনকারীদের সামনে তাদের বাসস্থান ও আঙ্গিনা জান্নাতের দিকে দরজা উন্মুক্ত করে দিবে।

দ্বীনের কাণ্ডারী আলেম দ্বিতীয় শাইখুল ইসলাম ইবনু কায়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ রহ. বলেন:

وأقدِمْ ولا تقْنَعْ بعَيْشٍ مُنَغَّصٍ

فما فازَ باللذاتِ مَن ليس يقدمُ

(পদক্ষেপ নাও এবং অস্বস্তিকর জীবনে তুমি সন্তুষ্ট হয়ো না;

কারণ, আনন্দ-ফুর্তির দ্বারা সে ব্যক্তি সফল হবে না, যে (তাওবার পথে) অগ্রসর হবে না।

وإن ضاقتِ الدنيا عليكَ بأسرِها

ولم يكُ فيها منزلٌ لكَ يُعلَمُ

(যদিও দুনিয়ার তাবৎ কর্মকাণ্ডের কারণে তোমার উপর দুনিয়া সঙ্কুচিত হয়ে গেছে

এবং জানা মতে তোমার জন্য তাতে কোনো বাসস্থানও নেই)।

فحيَّ على جناتِ عدْنٍ فإنَّها

منازلكَ الأولى وفيها المخيَّمُ

(সুতরাং তুমি শ্বাশ্বত বাসস্থান জান্নাতের দিকে আস; কেননা, তা

তোমার প্রথম বাসস্থান এবং তাতে রয়েছে তাঁবু গাড়ার স্থান)।

ولكننا سَبْيُ العدوِّ فهل ترى

نعودُ إلى أوطانِنا ونسلَّمُ

(কিন্তু আমারা হলাম শত্রুর হাতে বন্দী; কেননা, তুমি কি মনে কর—

আমরা আমাদের নিজ আবাসভূমিতে ফিরে যাব এবং তা সঠিক বলে মেনে নেব)।

وقد زعموا أن الغريبَ إذا نأى

وشطَّتْ به أوطانُه فهو مغرم

(আর তারা ধারণা করে যে, প্রবাসী ব্যক্তি যখন দূরে চলে যায়

এবং তার কারণে তার মাতৃভূমি খান খান হয়, তখন সে তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে)।

وأيُّ اغترابٍ فوق غربَتِنا التي

لها أضحتِ الأعداءُ فينا تَحَكَّمُ

(আমাদের প্রবাসজীবনের উপর আর কোনো প্রবাসজীবন কী আছে?

যেখানে আমাদের উপর কর্তৃত্ব হয়ে যায় শত্রুগণের)।

আমরা যে বিষয় অধ্যয়ন করছি, তা হল আল-কুরআনের একগুচ্ছ সুস্পষ্ট আয়াত এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কতগুলো বিশুদ্ধ হাদিস যেগুলো আমি একত্রিত করেছি; অতঃপর আমি তা লিপিবদ্ধ করেছি, যার সবকটিই একই অর্থের অন্তর্ভুক্ত; আর তা হল এমন আমল, যার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছে গুনাহ মাফ আর পাপরাশি মোচনের।

আমি এ আলোচনাটি সাজিয়েছি কয়েকটি অধ্যায়ে, যাতে পাঠক সহজেই তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অনুধাবন করতে পারে এবং আমি তার নাম দিয়েছি:

« مكفرات الذنوب في ضوء القرآن الكريم و السنة الصحيحة المطهرة »

(আল-কুরআনুল কারীম ও পবিত্র সহীহ সুন্নাহ’র আলোকে গুনাহ্ মাফের আমল)

এখন দেখুন আমরা কিন্তু আমাদের সেই ওয়াদাকৃত বিষয়টি উপস্থাপনের কাজ শুরু করতে যাচ্ছি এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট আশা করছি যে, তিনি তার দ্বারা আমাদেরকে উপকৃত করবেন; তিনি হলেন খুবই নিকটতম, আবেদন-নিবেদন কবুলকারী, তিনি ব্যতীত উপাসনার যোগ্য আর কোনো ইলাহ্ নেই, আমি তাঁর উপরই ভরসা করি এবং তাঁর কাছেই তাওবা করি। আর সরল পথ আল্লাহর কাছেই পৌঁছায়।

লেখক:

আবূ উসামা সালীম ইবন ‘ঈদ আল-হেলালী
জামাদিউল উলা, ১৪০৮ হিজরী, আম্মান, জর্দান।

[1] সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩

[2] তিরমিযী, হাদিস নং- ১৯৮৭, তিনি হাদিসটিকে হাসান-সহীহ বলেছেন।

[3] সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৭০

[4] সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২১

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট গ্রহণযোগ্য মূলনীতি ও জীবনবিধান হল ইসলাম; কারণ, তা হল প্রধান বিষয়; সুতরাং যে ব্যক্তি ইসলাম ভিন্ন অন্য কোনো পথ অনুসরণ করে চলবে, সেই ব্যক্তি ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ

“নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন।”[1]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন:

وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ

“আর কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।”[2]

কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা হলেন ন্যায়পরায়ণ ও দয়াবান, তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরীকে পছন্দ করেন না; তাই তারা যখন কুফরী করা থেকে বিরত থাকবে, তখন তিনি তাদেরকে (তার প্রিয় বান্দা হিসেবে) গ্রহণ করে নিবেন এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন; কেননা, তিনি হলেন ক্ষমাশীল ও দয়াবান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِن يَنتَهُواْ يُغۡفَرۡ لَهُم مَّا قَدۡ سَلَفَ وَإِن يَعُودُواْ فَقَدۡ مَضَتۡ سُنَّتُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٣٨ وَقَٰتِلُوهُمۡ حَتَّىٰ لَا تَكُونَ فِتۡنَةٞ وَيَكُونَ ٱلدِّينُ كُلُّهُۥ لِلَّهِۚ فَإِنِ ٱنتَهَوۡاْ فَإِنَّ ٱللَّهَ بِمَا يَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٣٩ ﴾ [الانفال: ٣٨، ٣٩]

“যারা কুফরী করে তাদেরকে বলুন, ‘যদি তারা বিরত হয়, তবে যা আগে হয়ে গেছে আল্লাহ্ তা ক্ষমা করবেন; কিন্তু তারা যদি অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি করে, তবে পূর্ববর্তীদের রীতি তো গত হয়েছেই। আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকবে যতক্ষণ না ফেৎনা দুর হয় এবং দ্বীন পূর্ণরূপে আল্লাহ্‌র জন্য হয়ে যায়; তারপর যদি তারা বিরত হয়, তবে তারা যা করে আল্লাহ্ তো তার সম্যক দ্রষ্টা।”[3]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«إذا أَسْلَمَ الْعَبْدُ، فَحَسُنَ إِسْلاَمُهُ، كَتَبَ اللَّهُ له كل حسنة كان أَزْلَفَهَا، وَمُحِيَتْ عَنْهُ كُلُّ سَيِّئَةٍ كَانَ أَزْلَفَهَا، ثُمَّ كان بعد ذلك الْقِصَاصُ ، الْحَسَنَةُ بِعَشْر أَمْثَالِهَا إلى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ ، وَالسَّيِّئَةُ بِمِثْلِهَا ، إِلاَّ أَنْ يَتَجَاوَزَ اللَّهُ عَنْهَا » . ( رواه البخاري و النسائي ) .

“বান্দা যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার ইসলাম গ্রহণ উত্তমভাবে হয়, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার আগের সকল ভাল কাজকে ভাল কাজ বলে গণ্য করেন এবং তার আগের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দেওয়া হয়; অতঃপর শুরু হয় প্রতিদান; একটি সৎ কাজের বিনিময়ে দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত সাওয়াব দেওয়া হয়; আর একটি মন্দ কাজের বিনিময়ে তার সমপরিমাণ মন্দ প্রতিফল; তবে আল্লাহ যদি মাফ করে দেন, তাহলে ভিন্ন কথা।”[4]

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী একটি অতিরিক্ত হুকুম (বিধান) সাব্যস্ত করল, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়া হিসেবে প্রমাণিত; তা হল ইসলাম পূর্ব সময়ের সকল ভাল কাজকে ভাল কাজ বলে গণ্য করে নেওয়া[5]; আর অনুরূপভাবে তা হয়ে যাবে মহান আল্লাহর অপার দান এবং মহান রব কর্তৃক প্রদত্ত পুরস্কার।

অতএব, ঐ সত্তার নামে শপথ করে বলছি, যাঁর হাতে আমার জীবন! এই মহান অনুগ্রহ ও অবদান থেকে আত্মভোলা ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ উদাসীন থাকতে পারে না, যাকে শয়তান দখল করে নিয়েছে, ফলে সে তার রবকে ভুলে গেছে। আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ وَقَالُواْ لَوۡ كُنَّا نَسۡمَعُ أَوۡ نَعۡقِلُ مَا كُنَّا فِيٓ أَصۡحَٰبِ ٱلسَّعِيرِ ١٠ فَٱعۡتَرَفُواْ بِذَنۢبِهِمۡ فَسُحۡقٗا لِّأَصۡحَٰبِ ٱلسَّعِيرِ ١١ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَخۡشَوۡنَ رَبَّهُم بِٱلۡغَيۡبِ لَهُم مَّغۡفِرَةٞ وَأَجۡرٞ كَبِيرٞ ١٢ وَأَسِرُّواْ قَوۡلَكُمۡ أَوِ ٱجۡهَرُواْ بِهِۦٓۖ إِنَّهُۥ عَلِيمُۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ ١٣ أَلَا يَعۡلَمُ مَنۡ خَلَقَ وَهُوَ ٱللَّطِيفُ ٱلۡخَبِيرُ ١٤ ﴾ [الملك: ١٠، ١٤]

“আর তারা বলবে, যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম, তাহলে আমরা জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হতাম না। অতঃপর তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে। সুতরাং ধ্বংস জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসীদের জন্য! নিশ্চয় যারা গায়েব অবস্থায় তাদের রবকে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। আর তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনি তো অন্তরসমূহে যা আছে তা সম্পর্কে সম্যক অবগত। যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন না? অথচ তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।”[6]

হে সন্দেহের মরুভূমিতে দিশেহারা মানব জাতি! ঐ আল্লাহর দিকে পালিয়ে আস, সবকিছু যাঁর রহমত ও জ্ঞানের পরিধিভুক্ত।

হে বিচ্ছিন্ন প্রবৃত্তির মরীচিকায় উত্তেজিত কামনাবিভোর জাতি! মহান রব ও নিরবিচ্ছিন্ন ছায়ার দিকে ছুটে আস।

হে লোকসকল! এ মাহান সংবাদটি নিয়ে মুহূর্তকাল চিন্তা, গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ কর।

আবদুর রাহমান ইবন শুমাসাহ আল-মাহরী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

« حَضَرْنَا عَمْرَو بنَ العَاصِ رضي الله عنه وَهُوَ في سِيَاقَةِ الْمَوْتِ ، فَبَكَى طَوِيلاً ، وَحَوَّلَ وَجْهَهُ إِلَى الجِدَارِ ، فَجَعَلَ ابْنُهُ يَقُولُ : يَا أبَتَاهُ ، أمَا بَشَّرَكَ رسولُ الله صلى الله عليه وسلم بكَذَا ؟ أمَا بَشَّرَكَ رسولُ الله صلى الله عليه وسلم بِكَذَا ؟ قَالَ : فَأقْبَلَ بِوَجْهِهِ ، فَقَالَ : إنَّ أفْضَلَ مَا نُعِدُّ شَهَادَةُ أنْ لا إلهَ إِلاَّ الله ، وَأنَّ مُحَمَّداً رسول اللهِ ، إنِّي قَدْ كُنْتُ عَلَى أطْبَاقٍ ثَلاَثٍ :

لَقَدْ رَأيْتُنِي وَمَا أحَدٌ أشَدُّ بُغضاً لرسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - مِنِّي ، وَلاَ أحَبَّ إليَّ مِنْ أنْ أكُونَ قدِ اسْتَمكنتُ مِنْهُ فَقَتَلْتُه ، فَلَوْ مُتُّ عَلَى تلكَ الحَالِ لَكُنْتُ مِنْ أهْلِ النَّارِ .

فَلَمَّا جَعَلَ اللهُ الإسلامَ في قَلْبِي أتَيْتُ النبيَّ صلى الله عليه وسلم ، فقُلْتُ : ابسُطْ يَمِينَكَ فَلأُبَايِعُك ، فَبَسَطَ يَمِينَهُ . قَالَ : فَقَبَضْتُ يَدِي ، فَقَالَ : « مَا لَكَ يَا عَمْرُو ؟ » . قلتُ : أردتُ أنْ أشْتَرِطَ . قَالَ : « تَشْتَرِط مَاذا ؟ » قُلْتُ : أنْ يُغْفَرَ لِي ، قَالَ : « أمَا عَلِمْتَ أن الإسلامَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ ، وَأن الهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبلَهَا ، وَأنَّ الحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ ؟ » .

وَمَا كَانَ أحدٌ أحَبَّ إليَّ مِنْ رَسُولِ الله صلى الله عليه وسلم ، وَلاَ أجَلَّ في عَيني مِنْهُ وَمَا كُنْتُ أُطيقُ أن أملأ عَيني مِنْهُ ؛ إجلالاً لَهُ ، ولو سئلت أن أصفه مَا أطقت ، لأني لَمْ أكن أملأ عيني مِنْهُ ، ولو مُتُّ عَلَى تِلْكَ الحالِ لَرجَوْتُ أن أكُونَ مِنْ أهْلِ الجَنَّةِ .

ثُمَّ وَلِينَا أشْيَاءَ مَا أدْرِي مَا حَالِي فِيهَا ؟ فَإذَا أنَا مُتُّ فَلاَ تَصحَبَنِّي نَائِحَةٌ وَلاَ نَارٌ ، فَإذا دَفَنْتُمُونِي ، فَشُنُّوا عَليَّ التُّرابَ شَنّاً ، ثُمَّ أقِيمُوا حَوْلَ قَبْرِي قَدْرَ مَا تُنْحَرُ جَزورٌ ، وَيُقْسَمُ لَحْمُهَا ، حَتَّى أَسْتَأنِسَ بِكُمْ ، وَأنْظُرَ مَا أُرَاجعُ بِهِ رسُلَ رَبّي » . ( رواه مسلم ) .

“আমরা ‘আমর ইবন ‘আসের নিকট হাযির হলাম, তখন তিনি ছিলেন মুমূর্ষাবস্থায়— মৃত্যুযন্ত্রনায় কাতর; তারপর তিনি বহুক্ষণ ধরে কাঁদলেন এবং তার চেহারা দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে নেন। এ অবস্থা দেখে তার পুত্র তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন: হে আব্বাজান! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আপনাকে এরূপ সুসংবাদ শোনান নি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আপনাকে অমুক সুসংবাদ শোনান নি? বর্ণনাকারী বলেন: তারপর তিনি মুখ ফেরালেন এবং বললেন: আমাদের সর্বোত্তম পুঁজি হল এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। বস্তুত আমি জীবনে তিন তিনটি পর্যায়[7] অতিক্রম করেছি:

আমার জীবনের এমন একটি পর্যায়ও ছিল, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে আর কারও প্রতি আমার এতো বেশি কঠোর বিদ্বেষ ও শত্রুতা ছিল না; আওতায় পেলে তাঁকে হত্যা করে ফেলার চাইতে বেশি প্রিয় আমার নিকট আর কিছু ছিল না; সুতরাং ঐ অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হয়ে যেত, তাহলে আমি নিশ্চিত জাহান্নামের অধিবাসী হয়ে যেতাম।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা যখন আমার অন্তরে ইসলামের মনোভাব ও আকর্ষণ তৈরি করে দিলেন, তখন আমি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসলাম এবং তারপর বললাম: আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, আমি আপনার নিকট (আনুগত্যের) বাই‘আত গ্রহণ করতে চাই; তখন তিনি তাঁর ডানহাত প্রসারিত করে দিলেন। তিনি (‘আমর ইবন ‘আস রা.) বললেন: এবার আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। তিনি বললেন: হে ‘আমর! তোমার কী হয়েছে? জবাবে আমি বললাম: আমি শর্ত করতে চাই। তিনি বললেন: তুমি কী শর্ত করতে চাও? জবাবে আমি বললাম: আমাকে যেন ক্ষমা করে দেওয়া হয়; এবার তিনি বললেন: “তোমার কি জানা নেই যে, ইসলাম ইসলাম-পূর্ব জীবনের সকল গুনাহ মিটিয়ে দেয়? আর হিজরত হিজরত-পূর্ব জীবনের সকল গুনাহ ধ্বংস করে দেয়? আর হাজ্জ হাজ্জ-পূর্ব জীবনের সকল গুনাহ ধ্বংস করে দেয়?” (যাই হউক, এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বাই‘আত গ্রহণ করলাম)।

আর তখন আমার নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে অধিক প্রিয় আর কেউ রইল না; আমার চোখে তাঁর চেয়ে অধিক মর্যাদাবানও আর কেউ থাকল না এবং তাঁর অপরিসীম মর্যাদা ও গাম্ভীর্যের দরুন আমি চোখভরে তাঁর প্রতি তাকাতে পর্যন্ত পারতাম না। ফলে আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আকার-প্রকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তার বর্ণনা দিতে আমি অক্ষম হবো, কারণ আমি তাঁর প্রতি পূর্ণ চোখে তাকাতাম না। এই অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হয়ে যেতো, তাহলে আমি জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার নিশ্চিত আশা ছিল।এরপর আমাদেরকে অনেক যিম্মদারী বা দায়-দায়িত্ব মাথায় নিতে হলো; জানি না, সেসব ব্যাপারে আমার অবস্থা কী হবে? যাই হউক, আমার যখন মৃত্যু হবে, তখন আমার জানাযায় যেন কোনো বিলাপকারিনী ও আগুনের সংশ্রব না থাকে। আর তোমরা যখন আমাকে দাফন করবে, তখন আমার কবরে অল্প অল্প করে মাটি ফেলবে; অতঃপর আমার কবরের চারপাশে এ পরিমাণ সময় অবস্থান করবে, যে সময়ের মধ্যে একটি উট যবাই করে তার মাংস বণ্টন করা যায়; যাতে আমি তোমাদের ভালবাসা ও সান্নিধ্য লাভ করতে পারি এবং আমার রবের পাঠানো ফিরিশ্তাদের সাথে কি ধরনের বাক-বিনিময় হয়, তা জেনে নিতে পারি।”[8]

>
[1] সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯

[2] সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫

[3] সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৮ - ৩৯

[4] ইমাম বুখারী রহ. হাদিসটি ‘তা‘লিকাত’ এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন: (১/৯৭— ফতহুল বারী); তবে « كَتَبَ اللَّهُ له كل حسنة كان أَزْلَفَهَا » (আল্লাহ তা‘আলা তার আগের সকল ভাল কাজকে ভাল কাজ বলে গণ্য করেন)— এই কথাটি তার বর্ণনার মধ্যে নেই। আর ইমাম নাসায়ী রহ. হাদিসটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর বর্ণনায় তিনি « كَتَبَ اللَّهُ له كل حسنة كان أَزْلَفَهَا »— এই কথাটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

হাফেয ইবনু হাজার ‘আসকালানী তাঁর ‘ফতহুল বারী’ (১/৯৯) নামক গ্রন্থে বলেন: “ইমাম বুখারী রহ. এর বর্ণনা যা বাদ গিয়েছে, তা বাকি সকল বর্ণনার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে; আর তা হল ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে করা সকল ভাল কাজকে ভাল কাজ বলে গ্রহণ করার বিষয়টি।”

[5] দেখুন: আমার প্রবন্ধ ‘মুবতিলাতুল আ‘মাল’ ( مبطلات الأعمال ), মাসআলা (প্রশ্ন) নং- ১; তাতে এই বিধান প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে; যা দারু ইবনিল কায়্যিম— দাম্মাম থেকে প্রকাশিত।

[6] সূরা আল-মুলক, আয়াত: ১০ - ১৪

[7] অর্থাৎ তিনটি পর্যায় মানে তিনটি অবস্থা অতিক্রম করেছি; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

لَتَرۡكَبُنَّ طَبَقًا عَن طَبَقٖ

“অবশ্যই তোমরা এক স্তর থেকে অন্য স্তরে আরোহণ করবে।” - (সূরা আল-ইনশিকাক, আয়াত: ১৯)।

[8] মুসলিম, হাদিস নং- ৩৩৬
১. ২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ও অনুসরণ করা

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা একের পর এক ধারাবাহিকভাবে তাঁর রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন, যাতে তাঁরা পথহারা মানুষদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে নিয়ে যেতে পারেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের অনুসরণ করাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۚ ﴾ [النساء: ٦٤]

“আল্লাহর অনুমতিক্রমে কেবলমাত্র আনুগত্য করার জন্যই আমরা রাসূলদের প্রেরণ করেছি।”[1]

আর নবী-রাসূল প্রেরণের ধারাবহিকতায় নবীদের মাঝ থেকে আমাদের জন্য বরাদ্ধ হয়েছেন মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যেমনিভাবে উম্মাতগণের মধ্য থেকে আমরা হলাম তাঁর ভাগের উম্মাত; এই জন্য তাঁর আনুগত্য করা ছাড়া আর কোনো আনুগত্যই শুদ্ধ হবে না। আর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে আল-কুরআনুল কারীম অনেকভাবে বক্তব্য পেশ করেছে, যেগুলোকে সুস্পষ্ট আয়াত বলে গণ্য করা হয়:

(ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনার আবশ্যকতা নিয়ে বর্ণিত আয়াত:

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

فَ‍َٔامِنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِ ٱلنَّبِيِّ ٱلۡأُمِّيِّ ٱلَّذِي يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَكَلِمَٰتِهِۦ وَٱتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ

“কাজেই তোমরা ঈমান আন আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসূল উম্মী নবীর প্রতি, যিনি আল্লাহ্ ও তাঁর বাণীসমূহে ঈমান রাখেন। আর তোমরা তার অনুসরণ কর, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।”[2]

আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার বিষয়টির সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য ও অনুসরণ করার বিষয়টিকে; সুতরাং জানা গেল যে, ব্যক্তির সকল অবস্থায় এই শর্তটি পূরণ করা আবশ্যক।

(খ) যে আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা মানে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা; কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করা ছাড়া আল্লাহর আনুগত্য হয় না:

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ

“কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল।”[3]

(গ) যে আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করার নির্দেশের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার বিষয়টিকে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে:

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنكُمۡۖ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের।”[4]

(ঘ) যেসব আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার বিষয়টিকে আল্লাহর বন্দাগণের জন্য তাঁর রহমত পাওয়ার উপলক্ষ্য বানিয়ে দেওয়া হয়েছে:

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ

“আর তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা কৃপা লাভ করতে পার।”[5] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন:

وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ

“আর তোমরা রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমাদের উপর রহম করা হয়।”[6]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

وَيُطِيعُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ سَيَرۡحَمُهُمُ ٱللَّهُۗ

“আর তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে; তারাই, যাদেরকে আল্লাহ্ অচিরেই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”[7]

(ঙ) যে আয়াত হেদায়াতের বিষয়টিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার শর্তের সাথে সংযুক্ত করেছে:

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ قُلۡ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَۖ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّمَا عَلَيۡهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيۡكُم مَّا حُمِّلۡتُمۡۖ وَإِن تُطِيعُوهُ تَهۡتَدُواْۚ وَمَا عَلَى ٱلرَّسُولِ إِلَّا ٱلۡبَلَٰغُ ٱلۡمُبِينُ ٥٤ ﴾ [النور: ٥٤]

“বলুন, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর।’ তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তার উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তিনিই দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরাই দায়ী; আর তোমরা তার আনুগত্য করলে সৎপথ পাবে, মূলত: রাসূলের দায়িত্ব শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া।”[8]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের বিষয়টি তখনই প্রকৃত রূপে ফুটে উঠবে, যখন মুসলিম ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে হুবহু প্রাধান্য দিবে; কেননা, সে নিশ্চিতভাবে জানে যে, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মানব জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত (তার জন্ম থেকে কবরে মাটি চাপা দেওয়া পর্যন্ত) ছোট ও বড় সকল বিষয়কে নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছে।

সুতরাং যে ব্যক্তি এই কাজটি করবে, সে যেন গুনাহ্ মাফ ও পাপ মোচনের সুসংবাদ গ্রহণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ

“বলুন, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[9]

আর যখন একদল জিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শুনতে পায় এবং জানতে পারে যে, তাঁর অনুসরণ করা গুনাহ্ মাফের উপায়, তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে ফিরে যায়। আল-কুরআনের ভাষায়:

يَٰقَوۡمَنَآ أَجِيبُواْ دَاعِيَ ٱللَّهِ وَءَامِنُواْ بِهِۦ يَغۡفِرۡ لَكُم مِّن ذُنُوبِكُمۡ وَيُجِرۡكُم مِّنۡ عَذَابٍ أَلِيمٖ

“হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তাঁর উপর ঈমান আন, তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে তোমাদেরকে রক্ষা করবেন।”[10]

আর এই জন্যই খাঁটি মুমিনদেরকে দেখা যায়— তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা ও মিনতি করে, যাতে তিনি তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন, পাপসমূহ মোচন করে দেন এবং সর্বোত্তমভাবে মৃত্যু তথা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ رَّبَّنَآ إِنَّنَا سَمِعۡنَا مُنَادِيٗا يُنَادِي لِلۡإِيمَٰنِ أَنۡ ءَامِنُواْ بِرَبِّكُمۡ فَ‍َٔامَنَّاۚ رَبَّنَا فَٱغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرۡ عَنَّا سَيِّ‍َٔاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ ٱلۡأَبۡرَارِ ١٩٣ ﴾ [ال عمران: ١٩٣]

“হে আমাদের রব! আমরা এক আহ্বায়ককে ঈমানের দিকে আহ্বান করতে শুনেছি, ‘তোমরা তোমাদের রবের উপর ঈমান আন।’ কাজেই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব! আপনি আমাদের পাপরাশি ক্ষমা করুন, আমাদের মন্দ কাজগুলো দূরীভূত করুন এবং আমাদেরকে সৎকর্মপরায়ণদের সহগামী করে মৃত্যু দিন।”[11]

আর এই ধরনের অসীলা করাটা শরী‘য়তসম্মত অসীলার এক প্রকার; কেননা, সে সৎকাজ দ্বারা অসীলা করেছে।অতএব, হে আমাদের রব! তোমার নবীর প্রতি আমাদের ভালবাসা এবং কথায় ও কাজে তাঁর সুন্নাতের অনুসরণ করার কারণে আপনি আমাদের অন্তরকে আপনার দীনের উপর অটল রাখুন; আর আপনি এক মুহূর্তের জন্যেও আমাদেরকে আমাদের নিজেদের দায়িত্বে ছেড়ে দিবেন না; আর আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি দয়া করুন, আপনিই আমাদের অভিভাবক। অতএব কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।

>
[1] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৪

[2] সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৮

[3] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০

[4] সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৯

[5] সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩২

[6] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫৬

[7] সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৭১

[8] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫৪

[9] সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১

[10] সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ৩১

[11] সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯৩

হে মুক্তির পথের পথিক বান্দা! জেনে রাখুন, তাওবা হলো ইসলামের মূলনীতিসমূহের অন্যতম একটি; আর তা হলো মহাশক্তিধর মালিকের নিকট নিশ্চিত অবস্থানের দিকে ভ্রমণকারীদের প্রথম মানযিল এবং পরকালের দিকে অভিযাত্রীদের দীর্ঘ পথের সূচনা।

তা সত্ত্বেও এটা যেমনিভাবে সূচনা, ঠিক অনুরূপভাবে এটা মাঝামাঝি ও শেষও বটে; সুতরাং তা থেকে কোনো নৈতিকতা সম্পন্ন বান্দা বিচ্ছিন্ন হতে পারে না এবং মৃত্যু পর্যন্ত সে তা অব্যাহত রাখবে। আর তাওবার সূচনা হল এমনভাবে লজ্জিত বা অনুশোচনা করা, যা এ দৃঢ়তা, সঠিক ইচ্ছাশক্তি ও প্রকৃত জ্ঞানবোধ জন্ম দিবে যে, পাপরাশি হলো বান্দা ও তার প্রতিপালকের মাঝখানে পর্দা বা অন্তরায়; কেননা, তা অন্তরের ময়লা বা কালিমা; সুতরাং সে দ্রুত মুক্তি ও শান্তির দিকে চলবে; আর আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া ছাড়া তাঁর থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই; আর যে ব্যক্তি তার রবের নিকট আশ্রয় নেয়, সে এমন আশ্রয়ে চলে যায়, যেখানে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং কখনও সে ফিরে আসবে না শূন্য হাতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ تُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ تَوۡبَةٗ نَّصُوحًا عَسَىٰ رَبُّكُمۡ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمۡ سَيِّ‍َٔاتِكُمۡ

“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর---বিশুদ্ধ তাওবা; সম্ভবত তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন।”[1]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« التَّائِبُ مِنْ الذَّنْبِ كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَهُ » . ( رواه ابن ماجه ) .

“গুনাহ্ থেকে তাওবাকারী ব্যক্তি ঐ ব্যক্তির মত, যার কোনো গুনাহ্ নেই।”[2]

অতএব, হে আমার ভাই! তাওবা ও তোমার মাঝে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল রচিত হওয়ার পূর্বেই তুমি তাওবার কাজটি দ্রুত সম্পন্ন কর; কারণ, কোনো ব্যক্তিই জানে না যে, আল্লাহ তার সাথে কেমন আচরণ করবেন।

জনৈক কবির কবিতা:

قَدِّمْ لِنَفْسِكَ تَوْبَةً مَرْجُوَّةً

قَبْلَ المَمَاتِ وَقَبْلَ حَبْسِ الأَلْسُنِ

(তুমি তোমার নিজের জন্য প্রত্যাশিত তাওবা পেশ কর

মৃত্যুর পূর্বে এবং কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই)।

بادِر بها غَلقَ النّفوس فإنَّها

ذُخرٌ وغُنم للمُنيب المحسِنِ

(সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগেই তুমি তা সম্পন্ন কর; কারণ, তা হলতাওবাকারী সৎকর্মশীল ব্যক্তির জন্য সঞ্চিত ধন ও গনীমত)।

>
[1] সূরা আত-তাহরীম আয়াত: ৮

[2] ইবনু মাজাহ, হাদিস নং- ৪২৫০ এবং অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাদিসটি আবদুল্লাহ আবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। আমি বলি: হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।

ইসলামের প্রত্যেকটি আদেশ ও নিষেধের মধ্যে সূক্ষ্ম ও স্থূলভাবে উদারতার বিষয়টি সুস্পষ্ট; সুতরাং বাস্তবেই নতুনভাবে সেটার পুনরুত্থান ঘটেছে ইসলামের মূলবস্তুতে এবং তার প্রত্যেকটি কর্মপদ্ধতি, নিয়মনীতি ও শাসনব্যবস্থার মধ্যে।

ইসলামের মধ্যে উদারতার বিষয়টি স্বর্ণের এমন প্রলেপের মত নয় যে, মানুষ কোনো মরুভূমির মরীচিকায় ঝাঁপিয়ে পড়বে, পিপাসা কাতর ব্যক্তি তাকে পানি মনে করবে, কিন্তু যখন সে সেটার কাছে আসে, তখন দেখে সেটা আসলে কিছুই নয়।

উদারতা মানে বদান্যতা ও দানশীলতার মাধ্যমে মনের তৃপ্তি,

স্বচ্ছতা ও দীনদারীর দ্বারা হৃদয়ে আনন্দ উপভোগ করা,

সহজ ও সরল করার মাধ্যমে নম্রতা প্রদর্শন করা,

আনন্দময় ও সুসংবাদ নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল চেহারা প্রদর্শন,

কোনো প্রকার অপদস্থতা ছাড়াই মুমিনগণের প্রতি বিনয় প্রদর্শন,

কোনো প্রকার ধোকা ও প্রতারণা ছাড়াই লেনদেনে ছাড় প্রদান,

কোনো প্রকার খাতির ও তোষামোদ ছাড়াই আল্লাহর দিকে আহ্বান করার ক্ষেত্রে সহজ পন্থা অবলম্বন,

কোনো প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও গড়িমসি ছাড়াই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার দীনের আনুগত্য করা।

বস্তুত উদারতা হচ্ছে ইসলামের দরজা,

নৈতিক চরিত্রের উচ্চ সোপান

এবং ঈমানের সর্বোত্তম বস্তু।

এটাই হলো সে উদারতা, যা পাপরাশিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়; আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ وَلَا يَأۡتَلِ أُوْلُواْ ٱلۡفَضۡلِ مِنكُمۡ وَٱلسَّعَةِ أَن يُؤۡتُوٓاْ أُوْلِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينَ وَٱلۡمُهَٰجِرِينَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۖ وَلۡيَعۡفُواْ وَلۡيَصۡفَحُوٓاْۗ أَلَا تُحِبُّونَ أَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٌ ٢٢ ﴾ [النور: ٢٢]

“আর তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্তকে ও আল্লাহর রাস্তায় হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না; তারা যেন ওদেরকে ক্ষমা করে এবং ওদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ্ তোমাদেরকে ক্ষমা করুন? আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[1]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« تَلَقَّتِ الْمَلائِكَةُ رُوْحَ رَجُلٍ مِمَّنْ كَانَ قَبْلَكُمْ ، قَالُوا لَهُ : عَمِلْتَ مِنَ الْخَيْرِ شَيْئًا ؟ قَالَ : لا ، قَالُوا : تَذَكَّرْ ، قَالَ : كُنْتُ أُدَايِنُ النَّاسَ ، فَآمُرُ فِتْيَانِي أَنْ يُنْظِرُوا الْمُوسِرَ ، وَيَتَجَاوَزُوا عَنِ الْمُعْسِرِ ، قَالَ قَالَ اللَّهُ : تَجَاوَزُوا عَنْهُ » . ( رواه البخاري و مسلم ) .

“তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতের এক ব্যক্তির রূহের সাথে ফিরিশ্তাগণ সাক্ষাৎ করে (অর্থাৎ তার মৃত্যুকালে) জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি (বিশেষ) কোনো সৎকাজ করেছ কি? সে বলল: না, তারা বললেন: স্মরণ করে দেখ; সে বলল: আমি মানুষের সাথে লেনদেন করতাম; তারপর অসচ্ছল ব্যক্তিদের অবকাশ দিতে ও সচ্ছল ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে আমি আমার লোকদেরকে নির্দেশ দিতাম। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: এরপর মহান আল্লাহ তা‘আলা বললেন: “তাকে দায়মুক্ত করে দাও।”[2]

[1] সূরা আন-নূর, আয়াত: ২২

[2] বুখারী, হাদিস নং- ১৯৭১; মুসলিম, হাদিস নং- ৪০৭৬

আমি বলি: হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।

মানুষ প্রবৃত্তি ও লোভ-লালসার কাছে দুর্বল; সুতরাং বান্দা যখন কোনো অন্যায় ও অপরাধ করে ফেলে, তখন সে যেন দ্রুত তার মোকাবিলায় একটি ভাল কাজ করে ফেলে; যেমন— কর্কশ ব্যবহারের মোকাবিলা করবে কোমল ব্যবহার দ্বারা, ক্রোধের মোকাবিলা করবে সংযম প্রদর্শন করার দ্বারা এবং এভাবে করে প্রতিটি মন্দের মোকাবিলায় ভালো অভ্যাস গড়ে তুলবে এবং সমস্যার সমাধান করবে; আর এটাই সবচেয়ে লাগসই পদ্ধতি কিন্তু এটা হওয়া এমন শর্ত নয় যে প্রয়োজনে তার অন্যথা করা যাবে না; কারণ, রোগের চিকিৎসা করা হয় তার বিপরীত বস্তুর দ্বারা; আর প্রতিটি অপরাধই অন্তরকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে, যা তার বিপরীতে ভালকাজের মত নূর বা আলো ছাড়া দূর করতে পারে না।

আর যে ব্যক্তি এ অবস্থানের অনুসন্ধান করবে, সে দেখবে যে সবচেয়ে সুন্দর ও দ্রুত কার্যকরী পন্থা হলো পুরাতন গুনাহের জন্য নতুন করে ভালকাজ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

إِنَّ ٱلۡحَسَنَٰتِ يُذۡهِبۡنَ ٱلسَّيِّ‍َٔاتِۚ ذَٰلِكَ ذِكۡرَىٰ لِلذَّٰكِرِينَ

“নিশ্চয় সৎকাজ অসৎকাজকে মিটিয়ে দেয়। উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য এটা এক উপদেশ।”[1]

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« اتَّقِ اللَّهَ حَيْثُ مَا كُنْتَ ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الْحَسَنَةَ تَمْحُهَا ، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ » . ( رواه الترمذي ) .

“তুমি যেখানেই থাক, আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং অসৎকাজ করলে সাথে সাথেই সৎকাজ কর, তাহলে ভাল কাজ মন্দ কাজকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে; আর মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে মেলামেশা কর।”[2]

>
[1] সূরা হুদ, আয়াত: ১১৪

[2] তিরমিযী, হাদিস নং- ১৯৮৭; হাদিসটি অন্যান্য হাদিসের সমর্থনের কারণে সহীহ, যেমনটি আমি ‘তাখরীজু আহাদিসিল অসিয়্যাতিস সুগরা’ ( تخريج أحاديث الوصية الصغرى ) নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছি, হাদিস নং- ৩

আমি বলি: হাদিসটি হাসান পর্যায়ের।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« إن من موجبات المغفرة بذل السلام وحسن الكلام » .

“ক্ষমা নিশ্চিতকরণের অন্যতম উপায় হলো সালাম বিনিময় করা এবং উত্তম কথা বলা।”[1]

>
[1] খারায়েতী, ‘মাকারিমুল আখলাক’ ( مكارم الأخلاق ): পৃ. ২৩; আর একই সনদে হাদিসটি বর্ণনা করেন আল-কাদা‘য়ী, ‘মুসানদু শিহাব’ (مسند الشهاب), হাদিস নং- ১১৪০, তিনি বলেন: আমাদের নিকট হাদিস বর্ণনা করেছেন সালেহ ইবন আহমাদ ইবন হাম্বল, তিনি বলেন: আমাদের নিকট হাদিস বর্ণনা করেছেন আমার পিতা, তিনি বলেন: আমাদেরকে ইবনুল আশজা‘য়ী একখানা কিতাব দিয়েছেন, যাতে সুফিয়ান থেকে বর্ণিত হাদিস বর্ণিত আছে, তিনি মিকদাম ইবন শুরাইহ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি তার পিতা থেকে— তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কোন আমল আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তখন তিনি বললেন: অতঃপর তিনি উপরিউক্ত হাদিসটি উল্লেখ করেন। আর হাদিসটি সহীহ; আরও দেখুন: ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহীহাহ’ ( سلسلة الأحاديث الصحيحة ), হাদিস নং- ১০৩৫

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلَّا غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا » . (رواه أبو داود و الترمذي و ابن ماجه) .

“দুই মুসলিমের যখন সাক্ষাৎ হয় এবং তারা পরস্পর মুসাফাহা করে, তখন তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।”[1]

>
[1] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৫২১২; তিরিমিযী, হাদিস নং- ২৭২৭; ইবনু মাজাহ, হাদিস নং- ৩৭০৩; আহমদ, হাদিস নং- ৪/২৮৯ ও ৩০৩ এবং তাঁরা ভিন্ন আরও অনেকে হাদিসটি বারা ইবন ‘আযেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। আর হাদিসের সনদটি দুর্বল; কেননা, সনদের মধ্যে আবূ ইসহাক নামে ‘মুদাল্লিস’ বর্ণনাকারী রয়েছে। তবে এই হাদিসের সমর্থনে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদিস বর্ণিত আছে, যা ইমাম আহমাদ রহ. ‘হাসান’ সনদে বর্ণনা করেছেন, হাদিস নং- ৩/১৪২; মোটকথা অন্য হাদিসের সমর্থনের কারণে হাদিসটি সহীহ, আল্লাহ তা‘আলাই সব চেয়ে ভাল জানেন।
২. ৬. জীব-জন্তুর প্রতি দয়া ও কোমল আচরণ করা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمْشِي بِطَرِيقٍ ، إِذْ اشْتَدَّ عَلَيْهِ الْعَطَشُ ، فَوَجَدَ بِئْرًا ، فَنَزَلَ فِيهَا فَشَرِبَ ، ثُمَّ خَرَجَ ، فَإِذَا كَلْبٌ يَلْهَثُ يَأْكُلُ الثَّرَى مِنَ الْعَطَشِ ، فَقَالَ الرَّجُلُ : لَقَدْ بَلَغَ هَذَا الْكَلْبَ مِنَ الْعَطَشِ مِثْلُ الَّذِي بَلَغَ مِنِّيْ ، فَنَزَلَ الْبِئْرَ ، فَمَلأَ خُفَّهُ ، ثُمَّ أَمْسَكَهُ بِفِيهِ حَتَّى رَقِيَ ، فَسَقَى الْكَلْبَ ، فَشَكَرَ اللَّهُ لَهُ ، فَغَفَرَ لَهُ ، فَقَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنَّ لَنَا مِنَ الْبَهَائِمِ لأَجْرًا ؟ فَقَالَ : « فِي كُلِّ ذَاتِ كَبِدٍ رَطْبَةٍ أَجْرٌ» . ( رواه البخاري و مسلم و أبو داود و أحمد ) .

“একদা এক ব্যক্তি পথে হেঁটে যাচ্ছিল, এক পর্যায়ে তার তীব্র পিপাসা লাগে; তারপর সে একটি কূপ পেয়ে গেল, তারপর সে তাতে অবতরণ করল এবং পানি পান করল; অতঃপর সে উঠে এলো; হঠাৎ করে দেখল, একটি কুকুর হাপাচ্ছে, পিপাসায় কাতর হয়ে কাদ চাটছে; অতঃপর লোকটি বলল: এ কুকুরটি পিপাসায় সেরূপ কষ্ট পাচ্ছে, যেরূপ কষ্ট আমার হয়েছিল। অতঃপর সে কূপে অবতরণ করল এবং তার মোজার মধ্যে পানি ভরল, তারপর তা মুখ দিয়ে তা (কামড়িয়ে) ধরে উপরে উঠে এলো। তারপর সে কুকুরটিকে পানি পান করাল। তারপর আল্লাহ তাকে তার প্রতিদান দিলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! জীব-জন্তুর জন্যও কি আমাদের পুরস্কার আছে? জবাবে তিনি বললেন: হ্যাঁ, প্রত্যেক সতেজ হৃদয়ের (সাথে ভালো ব্যবহারের) জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে।”[1]

এই হলো জীবজন্তুর প্রতি দয়া ও কোমল ব্যবহারের ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের কতিপয় দৃষ্টিভঙ্গি।

আর এই বর্ণনার মধ্যে কতিপয় ইউরোপীয় কাফিরদের দ্বারা প্রভাবিত জ্ঞানপাপীদের জন্য সত্য সুন্দর ও সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে যে, ইসলাম এসব ইউরোপীয় কাফিরদের অনেক আগেই জীবজন্তুর প্রতি দয়া ও কোমল আচরণের নিয়মকানুন প্রণয়ন করেছে, যা তারা মুসলিমগণের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছে, তাতে ব্যাপক প্রসার করেছে এবং তাকে বিধিবদ্ধ করেছে, এমনকি ঐসব জ্ঞানপাপীরা ধারণা করে নিয়েছে যে, তা ইউরোপীয়দের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

এই ইসলামী মূলনীতির মূলবস্তু হলো দয়া, সহানুভূতি, সেগুলোর উপর সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপিয়ে না দেওয়া এবং সেগুলোকে খেল ও তামাশার উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ না করা।

কিন্তু যেসব কাফির জীবজন্তুর প্রতি দয়া করার নীতিতে বিশ্বাসী এবং এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা গড়ে তুলেছে, তাদের নিকট জীবজন্তুর প্রতি দয়া করার বিষয়টি এমন নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তারা তাকে মানুষের উপর মর্যাদা দিয়ে ফেলেছে।আর তাদের কোনো কোন দেশে তারা বিষয়টিকে খেল-তামাশার বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছে; উদাহরণস্বরূপ সাবেক মুসলিম স্পেন বর্তমান খ্রিষ্টান স্পেন রাজ্যে বিস্তৃত বলদ বা ষাড়ের মধ্যকার লড়াইয়ের কথা বলা যায় (!)।

>
[1] বুখারী, হাদিস নং- ৫৬৬৩; মুসলিম, হাদিস নং- ৫৯৯৬; আবূ দাউদ, হাদিস নং- ২৫৫০; আহমদ, হাদিস নং- ২/৩৭৫ ও ৫১৭ এবং তাঁরা ভিন্ন আরও অনেকে হাদিসটি আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 পরের পাতা »