ইমাম শাফেয়ীর রাহিমাহুল্লাহ প্রতি ইমামিয়াদের অপবাদ

এই ফেরকাবাজদের নিকট ইমাম শাফেয়ী জারজ সন্তান!!

শিয়া আলেম ইউসুফ বাহরাইনীর কাশকুল গ্রন্থে বলা হয়, “উল্লেখিত ব্যক্তি তার উল্লেখিত গ্রন্থে তাদের কিছু আলেম থেকে বর্ণনা করেন যে, শাফেয়ীর বাবা চার বছর শাফেয়ীর মার কাছ থেকে দূরে ছিলেন। চার বছর পরে এসে দেখলেন যে, তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। এরপর শাফেয়ীর মা শাফেয়ীকে প্রসব করলেন। পরবর্তীতে শাফেয়ী যখন ইলম ও পদমর্যাদার দিক থেকে এই পর্যায়ে পৌঁছেন এবং নিজের ব্যাপারে এই ঘটনা অবগত হন তখন এই মত গ্রহণ করেন।

তাদের কোনো কোনো প্রাজ্ঞ আলেম এই ঘটনাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, যেহেতু আবু হানীফা জীবিত ছিলেন তাই শাফেয়ী চার বছর মায়ের পেটে আত্মগোপন করে থাকেন। যখন আবু হানীফার মৃত্যুর কথা জানতে পারেন তখন এ জগতে বের হন। যেন দুই ইমামের সম্মিলন না ঘটে। আল্লাহ্‌ আপনার প্রতি রহম করুন। একটু লক্ষ্য করে দেখুন, কী মুবারকময় এই নবজাতক! কেমন সতী এই মহিলা! কিভাবে এই শিশুটাকে তার স্বামীর বলে চালিয়ে দিল! যে কারণটা উল্লেখ করা হল তাও বা কেমন! তাদের মাযহাবের একজন ইমামের ব্যাপারে কিভাবে তারা এমন একটা খোঁড়া কারণ মেনে নিতে পারল!”[1]

ইমামিয়াদের স্ববিরোধিতার একটা দৃষ্টান্ত হল তারা ইমাম শাফেয়ীকে শিয়া ও রাফেযী বলে অভিহিত করেন!!

এ ব্যাপারে ফাহরাসাত কিতাবের লেখক ইবনে নাদিম[2] বলেন, “শাফেয়ী ছিলেন কট্টর শিয়া। একবার এক ব্যক্তি তাকে একটা মাসয়ালা জিজ্ঞেস করলে তিনি তার জবাব দেন। তখন লোকটি বলল, আপনি আলী ইবন আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর মতের খেলাফ করলেন। তিনি বললেন, পারলে তুমি আলী ইবন আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে তা সাব্যস্ত কর। তাহলে আমি আমার গাল মাটিতে রেখে বলব, আমি ভুল করেছি এবং আমি আমার মত ত্যাগ করে তার মত গ্রহণ করব।”[3]

ইমামিয়াদের জনৈক ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে কতগুলো পংক্তি বানিয়ে ইমাম শাফেয়ীর কবিতার পংক্তির সাথে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে: ইমাম শাফেয়ী তার কবিতাতে বলেছেন,

“ও আরোহী, মীনা থেকে যাওয়ার সময় তুমি মুহাস্সাবে একটু বিরতি কর সেখানকার খাইফের অধিবাসী ও চলমান লোকদের কানে কানে বলো,

এবং ঊষাকালে যখন মীনার উদ্দেশ্যে সমুদ্রের উর্মিমালার ন্যায় মানুষের ঢল নামে তখন তুমি খাইফে অবস্থানরত ও দণ্ডায়মান ব্যক্তিদের মাঝে ঘোষণা করে দাও,

মুহাম্মদের বংশধরদের ভালোবাসা যদি রাফেযীবাদ হয়, তাহলে জ্বিন-ইনসান সাক্ষী থাকুক আমি রাফেযী।”[4]

আর বারো ইমামী এক শিয়া এই পংক্তিগুলোর সাথে আরো যে পংক্তিগুলো সংযোজন করেছে সেগুলো হল-

“দাঁড়াও এবং ঘোষণা দাও যে, আমি মুহাম্মদ (ﷺ), তাঁর ওসিয়তকৃত প্রতিনিধি ও তাঁর সন্তানদের প্রতি বিদ্বেষী নই।

তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আমি ঐ দলের লোক যারা আহলে বাইতের মিত্রতা ভঙ্গকারী নয়।

বলে দাও যে, তোমরা আলীর উপর অন্যদেরকে যে প্রাধান্য দিয়েছ এর প্রতি ইবনে ইদ্রিস সন্তুষ্ট নয়।”[5]

এ ছাড়াও তারা আরো কিছু কবিতার পংক্তি অসদুপায়ে ইমাম শাফেয়ীর নামে চালিয়ে দিয়েছে। যেমন,

“আমার শাফায়াতকারী হচ্ছেন- আমার নবী, বুতুল,[6] হায়দার,[7] নবীজির দুই নাতি, সাজ্জাদ, বাকের আলমাজদী,

জাফর, বাগদাদে দীর্ঘকাল বসবাসকারী, রেজা, তার কলিজার টুকরারা, দুই আসকারী এবং মাহদী।[8]

আমার ধর্ম হচ্ছে শিয়াবাদ। আমার পরিবার-পরিজন মক্কাতে এবং বাড়ী হচ্ছে আসকালান[9]।

কতই না উত্তম আমার জন্মস্থান! কতই না গৌরবময়! আমার মাযহাব হচ্ছে জগতের সেরা মাযহাব![10]

নবীর বংশধর হচ্ছে আমার মাধ্যম, তারাই আপনার কাছে আমার ওছিলা।

আমি আশাবাদী আগামীকল্য আমার আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে।”[11]


একবার ইমাম শাফেয়ীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সাথে খলিফা হারুনুর রশীদের কিছুটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল। খলিফার প্রতি অপবাদ দেওয়া ও খলিফাকে উৎখাতের অভিযোগে ইমাম শাফেয়ীকে আরো দশজন আলাউয়ীর সাথে বাগদাদে খলিফার দরবারে ধরে আনা হয়। এ ঘটনাকে ইমামিয়া শিয়াদের অনেকে দলীল হিসেবে পেশ করে বলেন যে, ইমাম শাফেয়ী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু শিয়া ছিলেন।[12]

এ অভিযোগের জবাব হচ্ছে-

‘ইমাম শাফেয়ীর প্রতি রাফেযীবাদের যে অভিযোগ তোলা হয়’ তা তার সম্পর্কে সহীহ সনদের ভিত্তিতে যে অগণিত, অসংখ্য মুতাওয়াতির বর্ণনা এসেছে এবং তার যেসব বাণী সংরক্ষিত আছে তার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

তাছাড়া ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ রাফেযীদের প্রতি যে মনোভাব পোষণ করতেন তার সাথেও এ অভিযোগ সাংঘর্ষিক। ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “রাফেযীদের চেয়ে অধিক মিথ্যাবাদী আমি আর কাউকে দেখিনি!?”[13]

ইমাম শাফেয়ীর এ মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে ইমামিয়া শিয়া ইউসুফ আল-বাহরাইনী তার বিদ্বেষপূর্ণ কবিতার পংক্তিতে বলেন-

“ওহে শাফেয়ী, তোমার এ দাবী মিথ্যা; মিথ্যাবাদীর প্রতি আল্লাহ্‌র লা‘নত হোক।

বরং তোমার কাছে তোমার ওস্তাদদের ভালোবাসা একদিকে, আর আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ একদিকে।

তোমরা তো এক মাবুদকে বাদ দিয়ে জিবতের, তাগুতের ইবাদত করছো।

হে নাসেবী[14], শরীয়ত ও তাওহীদ থেকে তোরা নাসেবীর দলেরা অনেক দূরে।

তোরা সামেরীর সাথে গো বৎসকে ইমাম ‘আলী ইবন আবী তালেবের’[15] উপর অগ্রগণ্যতা দিয়েছিস।

তার বিরুদ্ধে যুদ্ধবাজ ও দখলদার শত্রুদেরকে তোরা একান্তভাবে ভালোবেসেছিস।

তোরা ভালোবাসার দাবী করছিস; অথচ কোনো বুদ্ধিমান, প্রত্যয়ী, সত্যসন্ধানীর কর্ম এমন নয়।

অথচ ভালোবাসার শর্ত হচ্ছে, সাহাবীর প্রতি বিদ্বেষপোষণকারীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা।

এর দলীল হচ্ছে কুরআনের বাণী “তুমি পাবে না”। তা কতো আলোকিত ও উজ্জ্বল প্রমাণ।

যদি তাওহীদের বাণী সত্য পথ থেকে বিচ্যুতকারী না হয় তাহলে এর চেয়ে সমুজ্জল, সুস্পষ্ট কোনো দলীল আছে কি?

পূর্ববর্তীদের দোষ ঢাকার জন্য তোরা একটা নীতি গ্রহণ করেছিস;

তা হলো পূর্ববর্তীদের মাঝে যা ঘটেছে তা থেকে আমরা চুপ থাকব।

যা কিছু ঘটেছে সবকিছুকে আমরা ভাল হিসেবে নিব যেন আমরা আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি পেতে পারি।

ধিক, শত ধিক এমন বিবেকের জন্য যে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রবঞ্চনার মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

“তুমি পাবে না” দ্বারা আমরা বুঝাতে চেয়েছি আল্লাহ্‌ তা‘আলার বাণী, ‘তুমি পাবে না এমন কোনো কওম - যারা আল্লাহ্‌ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখে, আবার আল্লাহ্‌ ও তার রাসূলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ ভালোবাসা রাখে।’ [মুজাদালা:২২] অর্থাৎ এমন ব্যক্তি মুমিন নয়। তার ঈমানের দাবী নির্জলা মিথ্যা। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসার দাবী করে, আবার তার ভালোবাসার মানুষের শত্রুদের সাথেও ভালোবাসা রাখে সেও মিথ্যাবাদী।”[16]

[1] ইউসুফ আল বাহরাইনীর ‘আলকাশকুল’ গ্রন্থের পৃ: (৩/৪৬); আল হেলাল লাইব্রেরী, বৈরুত; প্রথম সংস্করণ।

[2] তিনি মুহাম্মদ ইবন ইসহাক ইবন মুহাম্মদ ইবন ইসহাক আননাদীম আল-ওয়াররাক। ‘ফাহরাসাতু উলামা’ গ্রন্থের লেখক। ইবনে হাজার তার ব্যাপারে বলেন, “তিনি নির্ভরযোগ্য কেউ নন। তার উল্লেখিত গ্রন্থটি প্রমাণ করে যে, তার মাঝে মুতাযিলাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।…আমি তার কিতাবটি পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে- সে রাফেজী, মুতাযিলি। এছাড়া সে আহলে সুন্নাহকে ‘হাশাউয়্যিয়্যাহ্‌’ নাম দিয়ে কটাক্ষ করেছে। (মৃঃ ৪৩৮) [লিসানুল মিযান (৫/৭২), মুজামুল মুআল্লিফীন (৯/৪১)।

[3] ইবনে নাদীমের ‘আলফাহরাসত’ (পৃঃ ২৯৫), হিজরী ১৩৯৮ মোতাবেক ১৯৭৮ খ্রিঃ এর সংস্করণ।

[4] ‘দিওয়ানুশ শাফেয়ী’ সংকলক: ড. মুহাম্মদ যাহদী ইয়াকুন (পৃঃ ৯০-৯১) এবং ‘শি’রুশ শাফেয়ী’ সংকলক: ড. মুজাহিদ মুস্তফা বাহজাত (পৃঃ ১৪৯)।

[5] দেখুন: দেহলাবীর ‘আততুহফা আলইসনা আশারিয়া’ (ق৬১/ب) এবং আলুসির ‘মুখতাসারুত তুহফা’ (পৃঃ ৩৪-৩৫)। বস্তুত এগুলো যে ইমাম শাফেয়ীর নামে মিথ্যাচার করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। [সম্পাদক]

[6] তারা ফাতেমা (রাঃ) কে বুতুল বলে। দেখুন: ‘বিহারুল আনওয়ার’ (৪৩/১১০) ও (৮৭/২১২)।

[7] হায়দার দ্বারা আলী (রাঃ) কে বুঝানো হয়েছে।

[8] দেখুন: ‘আততুহফা আলইসনা আশারিয়া’ (ق৬১/ب) এবং আলুসির ‘মুখতাসারুত তুহফা’ (পৃঃ ৩৫)। এছাড়াও আমি অন্য দুটি পংক্তি পেয়েছি। যে পংক্তিদ্বয় শব্দ ও মর্মের দিক থেকে এ দুটি পংক্তির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ঐ পংক্তি দুটি একজন ইমামিয়া শিয়ার। মাজিনদারানীর ‘মানাকিবু আলে আবী তালেব’ নামক গ্রন্থে তা উল্লেখ করা হয়।

[9] সম্ভবত এই পংক্তিটি দ্বারা এদিকে ইঙ্গিত করা উদ্দেশ্য যে, গাজাতে ইমাম শাফেয়ীর জন্মের পর মক্কায় আসার পূর্বে তাকে আসকালানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

[10] রাযির ‘মানাকিবু শাফেয়ী’ (পৃঃ ১৪০)।

[11] রাযির ‘মানাকিবু শাফেয়ী’ (পৃঃ ১৪১), তার কাছ থেকে ড. মুহাম্মদ ইয়াকুন ‘দিওয়ানুশ শাফেয়ীতে উল্লেখ করেছেন (পৃঃ ৫৪), কিন্তু ইমামিয়া শিয়া মুহাম্মদ ইবন শাহর আ-শুব মা-জিনদারানী এ পংক্তিদ্বয়কে মুহাম্মদ ইবন সমরকন্দীর বলে উল্লেখ করেছেন। দেখুন: মানাকিবু আলে আবী তালেব (২/১৫২)। পক্ষান্তরে সুন্নী আলেম ইবনে হাজার হাইতামী এই পংক্তিদ্বয়কে ইমাম শাফেয়ীর কবিতার পংক্তি বলে দৃঢ় মত পোষণ করেছেন। আল্লাহ্‌ তাকে মাফ করুন।[আস সাওয়াইক ২/৫২৪]

[12] দেখুন: রাযির ‘মানাকিবু শাফেয়ী’ (পৃঃ ১৪১), ইবনে কাছীরের ‘ত্বাবাকাতুশ শাফেয়িয়্যাহ্’ (ভূমিকা: ১৪), ‘মানহাজুল ইমাম শাফেয়ী’ কিতাবের অবলম্বনে (২/৪৯২)।

[13] দেখুন: ইবনে আবী হাতেমের ‘আ-দাবুশ শাফেয়ী’ (পৃঃ ১৮৯)।

[14] নাসেবী বলা হয় তাদেরকে যারা আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে।

[15] ইবনে আবী তালেব দ্বারা আলী (রাঃ)কে বুঝাতে চেয়েছে।

[16] ইউসুফ আল বাহরাইনীর ‘আলকাশকুল’ (২/১১৭); বৈরুতের আল হেলাল লাইব্রেরী; প্রথম সংস্করণ (১৯৮৬ খ্রিঃ)।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে