এ কথা জোর তাকিদ দিয়ে বলা যায় যে, সুন্নী চার ইমাম কখনো শাসকগোষ্ঠীর তাবেদার ছিলেন না। অতএব তাদের ফতোয়া শাসকগোষ্ঠীর কুপ্রবৃত্তি মোতাবেক হওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং শাসকদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। চাই কোনো শাসক ন্যায়পরায়ন হোক অথবা জালেম হোক। শরীয়তের দলীল-প্রমাণ যা দাবী করে তারা শাসকদের সাথে সে রকম আচরণ করতেন। যদি বারো-ইমামী শিয়াদের দাবীটা সঠিক হত তাহলে বিচারকের পদ না নেওয়ার কারণে ইমাম আবু হানীফাকে কি প্রহার করা হত এবং মৃত্যু পর্যন্ত জেলে আটক করে রাখা হত?![1] শুধু একটা ফতোয়ার কারণে ইমাম মালেককে কি প্রহার করা হত এবং মদীনার আনাচে-কানাচে তাকে ঘুরানো হত?![2] অথবা ‘কুরআন সৃষ্ট নয়’ এ কথা বলার কারণে কি ইমাম আহমাদকে এই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হত?![3] যদি ইমামিয়াদের মধ্যে কোনো বিবেকবান মানুষ থাকে তবে তারা এসব প্রশ্নের জবাব দিক।
তারা সুন্নী ইমামদের আরো যে সব দোষ বর্ণনা করেন তাহলো-
“সুন্নীদের উক্ত চার ইমাম শাসকদের দোষত্রুটি জনসমক্ষে প্রকাশ করতেন না, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন না বা মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতেন না, ইত্যাদি’
(এর জবাব হচ্ছে) ইমামরা কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে অথবা ব্যক্তিগত কোনো সুবিধা আদায়ে অথবা সামষ্টিক কোনো স্বার্থ রক্ষার্থে এ ধরনের অবস্থান নেন নি। বরং তাদের এ ধরনের অবস্থান ছিল এজন্য যেন উম্মতের মাঝে কোনো বিভেদ সৃষ্টি না হয় এবং মুসলিমদের জামায়াতে কোনো বিছিন্নতা তৈরী না হয়। আর এটাই রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাহ্র দাবী, যে সুন্নাহ্র ব্যাপারে তোমরা ইমামিয়া শিয়ারা সবচেয়ে বেশী অজ্ঞ!!
এখানে আমরা কিছু রেওয়ায়েত উল্লেখ করব যে রেওয়ায়েতগুলো প্রমাণ করে যে, ইমামরা যে অবস্থান নিয়েছিলেন সেটাই সঠিক অবস্থান:
বুখারী ও মুসলিমে উবাদা ইবন সামেত থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বায়‘আতের আহ্বান জানালেন তখন আমরা তার হাতে বায়‘আত করলাম। তিনি আমাদের কাছ থেকে যে প্রতিশ্রুতি নিলেন তার মধ্যে এটাও ছিল যে, ‘পছন্দ হোক বা না হোক, সুবিধা হোক অথবা অসুবিধা হোক, এমনকি অধিকার বঞ্চিত হলেও আমরা (শাসকের) কথা শুনব, তার আনুগত্য করব এবং শাসকের সাথে ক্ষমতা নিয়ে টানাটানি করব না যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মাঝে সুস্পষ্ট কোনো কুফরী পাওয়া না যায়। যে-কুফরী কুফরী হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো দলীল আছে।’[4]
অনুরূপভাবে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তিনটি গুণ থাকলে কোনো মুসলিমের অন্তর সেগুলোকে বিদ্বেষ, ঘৃণা কিংবা অপছন্দ করতে পারে না।[5] আমলে আল্লাহ্র জন্য একনিষ্ঠতা, শাসকবর্গের কল্যাণ কামনা করা এবং মুসলিমদের জামা‘আতকে আঁকড়ে থাকা। কেননা মুসলিমদের দো‘আ এর চারপাশকে ঘিরে আবর্তমান।”[6]
আউফ ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন, সাবধান! জেনে রাখো, কারো উপর যখন কেউ নেতা হয়ে আসে, অতঃপর সে নেতাকে কোনো গুনাহর কাজ করতে দেখে তার উচিত ঐ গুনাহকে অপছন্দ করা। কিন্তু তারপরও তার আনুগত্য করে যাওয়া। আনুগত্যের হস্ত তুলে না নেওয়া।”[7]
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, “তোমার জন্য কঠিন হোক অথবা সহজ হোক, তোমার কাছে ভাল লাগুক বা না লাগুক, এমনকি তোমার প্রাপ্য অধিকার ছিনিয়ে নিলেও নেতার কথা শুনা এবং তার আনুগত্য করা তোমার উপর ফরয।”[8]
অন্য এক শব্দে এসেছে- “যদি তারা তোমার মাল কুক্ষিগত করে এবং মারতে মারতে তোমার পিঠ বাঁকা করে ফেলে তবুও।”[9]
এ ব্যাপারে সাহাবীদের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমগণের বাণী
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, “আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বড় বড় সাহাবীরা সাবধান করতে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের শাসকদেরকে গালি দিবে না, তাদের সাথে প্রতারণা করবে না, তাদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবে না। আল্লাহ্কে ভয় কর এবং ধৈর্য্য ধারন কর। আল্লাহ্র ফয়সালা বেশী দূরে নয়।”[10]সুন্নী চার ইমামের প্রতি বারো ইমামী শিয়াদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার পর এবার ইমামদের প্রত্যেকের ব্যাপারে আলাদা আলাদাভাবে তাদের যেসব অভিযোগ সে বিষয়ে আলোকপাত করব।
[2] এই ঘটনাটি দেখুন: ‘আল ইনতিকা (পৃঃ ৪৩-৪৪) এবং শাজারাতুয যাহাব (১/২৯০)।
[3] এই ঘটনাটি দেখুন: আবু নুআইমের ‘হিলয়াতুল আউলিয়া’ (৯/১৯৫-২০৪) এবং ইবনে কাছীরের ‘আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া’ (১৪/৩৯৩-৪০৫)।
[4] হাদীসটি ইমাম বোখারী (৬৬৪৭) ও মুসলিম (১৭০৯) বর্ণনা করেন।
[5] বরং তা গ্রহণ করে নেয়, তাই হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা বা অপছন্দ সেখানে স্থান পায় না। [সম্পাদক]
[6] হাদীসটি বর্ণনা করেন তিরমিযী তার জামে’ গ্রন্থে (২৬৫৮), ইবনে মাজাহ্ তার সুনান গ্রন্থে (২৩০), আহমাদ তার মুসনাদ গ্রন্থে (১৩৩৭৪, ২১৬৩০), ইবনে আবী আসেম তার সুন্নাত (১/৯৪) নামক গ্রন্থে; শেষোক্ত গ্রন্থের মুহাক্কিক বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। এছাড়াও ইবনে হিব্বান তার সহীহ গ্রন্থে (৬৭, ৬৮০)।
[7] হাদীসটি বর্ণনা করেন ইমাম আহমাদ তার গ্রন্থে (২৪০২৭), মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে (১৮৫৫) এবং ইবনে আবী আসেম তার সুন্নাত নামক গ্রন্থে (২/৭২১-৭২২)।
[8] হাদীসটি ইমাম মুসলিম তার সহীহ গ্রন্থে (১৮৩৬) আবু হুরাইরা (রাঃ) এর সনদে এবং ইমাম আহমাদ তার মুসনাদ গ্রন্থে উবাদা ইবন ছামেত (রাঃ) এর সনদে উল্লেখ করেন।
[9] হাদীসটি ইবনে হিব্বান তার সহীহ গ্রন্থে (৪৫৬২, ৪৫৬৬) উবাদা ইবন সামেত (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন।
[10] ইবনে আবী আসেম তার সুন্নাত নামক গ্রন্থে (২/৬৯৩) এই আসারটি উল্লেখ করেন। মুহাক্কিক বলেন: এই বর্ণনাটির সনদ হাসান।