সত্যনিষ্ঠ আলেমদের নিকট সঠিক বক্তব্য হলো খিদির আলাইহিস সালাম মৃত। তিনি ইসলাম পান নি। যদি তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে অবশিষ্ট থাকতেন তাহলে অবশ্যই তার জন্য ওয়াজিব হতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনা এবং তার সাথে জিহাদ করা। যেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর ও অন্যান্যদের ওপর এটা ওয়াজিব করেছেন। আর তিনি অবশ্যই মক্কা-মদীনায় অবস্থান করতেন। কাফির সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত থেকে তাদের জাহাজ মেরামত করার চেয়ে সাহাবীগণের সাথে উপস্থিত থেকে সংগ্রাম করা এবং দীনের সাহায্য সহযোগিতা করা তার জন্য উত্তম হতো। তিনি এমন মানুষদের থেকে দূরে অবস্থান করতেন না যাদেরকে উত্তম জাতি হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। আর তাদের থেকে গোপনও থাকতেন না।
তাছাড়া মুসলিমদের জন্য তাদের দীন ও দুনিয়ার কোনো বিষয়ে খিদির ও তার মতো কোনো অনুরূপ কোনো লোকের প্রয়োজনও নেই। কেননা মুসলিমগণ তো তাদের দীন সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গ্রহণ করেছেন। যিনি তাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দিয়েছেন। আর তাদেরকে তাদের নবী বলেছেন:
«لو كان موسى حيا بين أظهركم ما حل له إلا أن يتبعنى»
“যদি মূসা জীবিত থাকতো অতঃপর তোমরা তাকে অনুসরণ করতে আর আমাকে ছেড়ে দিতে তাহলে অবশ্যই তোমরা পথভ্রষ্ট হতে।”[1]
আর ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম আকাশ থেকে যখন অবতীর্ণ হবেন তখন তিনি একমাত্র আল্লাহর কিতাব ও নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত দ্বারা বিচার-ফয়সালা করবেন। তাহলে খিদির ও অন্যন্যদের কী প্রয়োজন থাকতে পারে? আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকাশ থেকে ঈসা আলাইহিস সালাম এর প্রত্যাগমণ সম্পর্কে ও মুসলিমদের সাথে তার উপস্থিতির বিষয়টি তাদেরকে অবহিত করেছেন। তিনি বলেন,
«كيف تهلك أمة أنا أولها وعيسى ابن مريم آخرها؟»
“কীভাবে ধ্বংস হবে একটি উম্মত, যার শুরুতে আমি রয়েছি আর তার শেষে রয়েছে ঈসা ইবন মারইয়াম।”[2]
তাহলে যখন উপরোক্ত দু’জন নবী, (মুহাম্মাদ ও ঈসা) যারা মূসা, ইবরাহীম ও নূহসহ সর্বোত্তম রাসূল হিসেবে বিবেচিত আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইইহ ওয়াসাল্লাম আদম সন্তানদের নেতা, এরা কেউই এ উম্মত থেকে গোপনে অবস্থান করেন নি, সাধারণ ও বিশেষ কারও থেকেই নয়, তাহলে এমন কেউ কীভাবে এ উম্মত থেকে গোপনে অবস্থান করতে পারেন যিনি তাদের মত নন? (অর্থাৎ খিদির, কারণ তিনি তাদের মতো নন)। আর যদি খিদির সর্বদা জীবিতই ছিলেন তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো তার নাম উচ্চারণ কেন করেন নি, তার সর্ম্পকে তার উম্মাতকে কেন কোনো সংবাদ দেন নি এবং তার সঠিক পথপ্রাপ্ত খলিফাগণও কেন কিছু বলেন নি?
আর কোনো বক্তার বক্তব্য: ‘নিশ্চয় খিদির ওলীগণের নকীব’ তার জবাবে বলা হবে, কে তাকে নকীব (দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা) নিযুক্ত করেছেন? অথচ সর্বোত্তম ওলীগণ হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীগণ। তাদের মধ্যে তো খিদির নেই। (তাহলে তাকে কে এ কাজে নিয়োগ দিল?) সাধারণত এ অধ্যায়ে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তার কিছু অংশ মিথ্যা। কিছু কোনো ব্যক্তির ধারণার ওপর নির্ভরশীল, যে কিনা কোনো ব্যক্তিকে দেখে ধারণা করলো যে নিশ্চয় সে খিদির। আর বলে বসল, নিশ্চয় সে খিদির।যেমনিভাবে রাফেযীরা কোনো লোককে দেখে ধারণা করে বলে, নিশ্চয় সে অপেক্ষমান নিষ্পাপ ইমাম অথবা সে লোকটিই তা দাবী করে। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল থেকে বর্ণিত, তার কাছে খিদির সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে লোক তোমাকে অনুপস্থিত কারও দিকে ন্যস্ত করে সে তোমার সাথে ন্যায্য কাজটি করে নি, আর শয়তান ব্যতীত কেউ মানুষের মুখে এটা ছড়ায় নি। অন্য জায়গায় আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
>[2] মুসান্নাফে ইবন আবি শাইবাহ (৫/২৯৯)।
আর যদি প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, কুতুব, গাউস ও অন্যান্য পূণ্যবান ব্যক্তি, যিনি তৎকালীন সময়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে বিবেচিত, তাহলে এটা তার উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একই সময়ে দু’জন সমমর্যাদার লোক থাকা অসম্ভব নয়, অনুরূপভাবে তিনজন ও চারজনও থাকতে পারে। সুতরাং কোনো সময়ে উত্তম ব্যক্তি একজনই হবেন এমনটি দৃঢ়ভাবে বলা কখনই সম্ভব নয়। বরং একদল লোক এমন হতে পারেন যাদের কেউ অপর কারও থেকে একদিকে উত্তম হবেন, অন্যজন অপরদিক থেকে উত্তম হবেন। এ বিষয়গুলো কাছাকাছি পর্যায়ের কিংবা সমপর্যায়ের।
তাছাড়া কোনো এক সময় যদি কোনো লোক সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে বিবেচিত হয়েও যান, তাকে কুতুব বা গাউস নামকরণ করা বিদ‘আত। কারণ, এ ধরনের নামকরণের ব্যপারে মহান আল্লাহ কোনো কিছু অবতীর্ণ করেন নি। আর উম্মাতের পূর্বসূরীদের কোনো ব্যক্তি ও ইমামগণ এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেন নি। অথচ পূর্বসূরীগণ তাদের কোনো কোনো মানুষের ব্যপারে ধারণা করতেন যে, অমুক ব্যক্তি তাদের মধ্যে সর্বোত্তম অথবা উক্ত ব্যক্তি সে যুগের উত্তম মানুষের অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু তারা সেসব ব্যক্তিদের ব্যাপারে তথাকথিত গাউস, কুতুব ইত্যাদি নাম ব্যবহার করেন নি। কেননা এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ কোনো কিছুই অবতীর্ণ করেন নি। বিশেষ করে যারা এসব নামের প্রবর্তক তারা দাবী করে যে, প্রথম কুতুব হলেন হাসান ইবন আলী ইবন আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। অতঃপর পর্যায়ক্রমে পরবর্তী অন্যান্য মাশায়েখদের তালিকা রয়েছে। আর এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শিয়া-রাফেযী কোনো মত অনুযায়ীই এটা সঠিক নয়। কারণ, (যদি তাদের কথা শুদ্ধ হয়) তবে কোথায় আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী রাদিআল্লাহু আনহুমসহ অন্যান্য অগ্রগামী মুহাজির ও আনসারগণ? অথচ হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর সময় কেবল পরিণত বয়সে উপনীত হওয়ার কাছাকাছি ছিলেন। (বড় বড় সাহাবীগণের ওপর তাকে প্রাধান্য দেওয়ার রহস্য কী?)
এসব বক্তব্যের প্রবর্তক কোনো কোনো বড় শায়খ থেকে বর্ণনা করা হয় যে, কুতুব, গাউস ও পূর্ণবান ব্যক্তির জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের অনুরূপ হয়, তাদের ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা অনুযায়ী হয়। তাই (তাদের ধারণামতে) আল্লাহ যা জানেন তারাও তা জানে আর আল্লাহ যেটার ক্ষমতা রাখেন তারাও সেটার ক্ষমতা রাখে। আর তারা মনে করে থাকে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও অনুরূপ ছিলেন। আর এটা তাঁর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে হাসান এর দিকে যায় এবং হাসান থেকে তার শিষ্যের কাছে ক্রমান্বয়ে যায়। একথা যখন আমার কাছে বর্ণনা করা হয় তখন আমি বর্ণনা করে বলি যে, এটা স্পষ্ট কুফুরী ও নিকৃষ্ট অজ্ঞতাপ্রসূত কথা। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যপারে এমনটি দাবী করা কুফুরী, তিনি ব্যতীত অন্যের ব্যাপারে সেটা আরও মারাত্মক কথা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُل لَّآ أَقُولُ لَكُمۡ عِندِي خَزَآئِنُ ٱللَّهِ وَلَآ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ وَلَآ أَقُولُ لَكُمۡ إِنِّي مَلَكٌۖ﴾ [الانعام: ٥٠]
“বলুন, ‘আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার নিকট আল্লাহর ভাণ্ডারসমূহ আছে, আর আমি গায়েবও জানি না এবং তোমাদেরকে এও বলি না যে, আমি ফিরিশতা।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫০]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ وَلَوۡ كُنتُ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ لَٱسۡتَكۡثَرۡتُ مِنَ ٱلۡخَيۡرِ وَمَا مَسَّنِيَ ٱلسُّوٓءُۚ﴾ [الاعراف: ١٨٨]
“বলুন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোনো অধিকার নেই। আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম তবে তো আমি অনেক কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোনো অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না।” [সূরা আল-আ‘রাফ:১৮৮]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَقُولُونَ لَوۡ كَانَ لَنَا مِنَ ٱلۡأَمۡرِ شَيۡءٞ مَّا قُتِلۡنَا هَٰهُنَا﴾ [ال عمران: ١٥٤]
“তারা বলে, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কোনো কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৪]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَقُولُونَ هَل لَّنَا مِنَ ٱلۡأَمۡرِ مِن شَيۡءٖۗ قُلۡ إِنَّ ٱلۡأَمۡرَ كُلَّهُ٥٤﴾ [ال عمران: ١٥٤]
“নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল এ বলে যে, ‘আমাদের কি কোনো কিছু করার আছে’? বলুন, ‘সব বিষয় আল্লাহরই ইখতিয়ারে।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৪]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لِيَقۡطَعَ طَرَفٗا مِّنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ أَوۡ يَكۡبِتَهُمۡ فَيَنقَلِبُواْ خَآئِبِينَ ١٢٧ لَيۡسَ لَكَ مِنَ ٱلۡأَمۡرِ شَيۡءٌ أَوۡ يَتُوبَ عَلَيۡهِمۡ أَوۡ يُعَذِّبَهُمۡ فَإِنَّهُمۡ ظَٰلِمُونَ ١٢٨﴾ [ال عمران: ١٢٧، ١٢٨]
“যাতে তিনি কাফেরদের এক অংশকে ধ্বংস করেন বা তাদেরকে লাঞ্ছিত করেন। ফলে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। তিনি তাদের তাওবা কবুল করবেন বা তাদেরকে শাস্তি দেবেন- এ বিষয়ে আপনার করণীয় কিছুই নেই। কারণ তারা তো যালেম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৭, ১২৮]
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ٥٦﴾ [القصص: ٥٦]
“আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছে সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভালো জানেন।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৫৬]
আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার জন্য আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। তারপর তিনি বলেন,
﴿مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَ﴾ [النساء: ٨٠]
“কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল, আর তিনি আমাদেরকে তার অনুসরন করার জন্য আদেশ দিয়েছেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০]
অতঃপর তিনি বলেন,
﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ ٣١﴾ [ال عمران: ٣١]
“বলুন, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১]
আর তিনি আমাদেরকে তাঁর রাসূলকে শক্তিশালী করার, সম্মান করার ও সাহায্য করার জন্য আদেশ দিয়েছেন এবং তার জন্য কিছু হক নির্ধারণ করেছেন যা তিনি তাঁর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহতে বর্ণনা করেছেন। এমনকি তিনি আমাদের জন্য ওয়াজিব করেছেন তিনি যেন আমাদের কাছে আমাদের নিজেদের ও পরিবার পরিজন থেকে অধিক ভালোবাসার মানুষ হন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلنَّبِيُّ أَوۡلَىٰ بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ مِنۡ أَنفُسِهِمۡۖ ٦﴾ [الاحزاب: ٦]
“নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্টতর” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿قُلۡ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمۡ وَأَبۡنَآؤُكُمۡ وَإِخۡوَٰنُكُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ وَعَشِيرَتُكُمۡ وَأَمۡوَٰلٌ ٱقۡتَرَفۡتُمُوهَا وَتِجَٰرَةٞ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَمَسَٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَآ أَحَبَّ إِلَيۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَجِهَادٖ فِي سَبِيلِهِۦ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٤﴾ [التوبة: ٢٤]
বলুন, ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহর) পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত।’ আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৪]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«والذي نفسي بيده، لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ».
“যার হাতে আমার প্রাণ ঐ সত্ত্বার শপথ করে বলছি, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে প্রিয় হবো তার সন্তান-সন্তুতি, পিতা-মাতা ও সকল মানুষ থেকে প্রিয় হবো”।[1]
আর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তো আমার কাছে সবকিছুর থেকে বেশি প্রিয় তবে আমার নিজ সত্ত্বা থেকে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতক্ষণ আমি তোমার কাছে তোমার সত্ত্বার থেকেও বেশি প্রিয় হবো, (ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না) তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, এখন আপনি আমার নিকট আমার নিজ সত্ত্বা থেকেও অধিক প্রিয়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এখন হে উমার (ঈমানের দাবী যথার্থ হয়েছে)।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ: مَنْ كَانَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَمَنْ أَحَبَّ عَبْدًا لاَ يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَمَنْ يَكْرَهُ أَنْ يَعُودَ فِي الكُفْرِ، بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللَّهُ، مِنْهُ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ»
“তিনটি বস্তুর যার মধ্যে ঘটবে সে অবশ্যই ঈমানের স্বাদ লাভ করেছে, যার কাছে আল্লাহ ও তার রাসূল এতদোভয়ের বাইরের সবকিছু থেকে প্রিয় হবে, যে কেউ কাউকে কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই ভালোবাসবে আর যে কেউ কুফুরী থেকে আল্লাহ তাকে উদ্ধার করার পর সে তাতে ফিরে যাওয়া এমনভাবে অপছন্দ করবে যেমন আগুনে নিক্ষেপ করাকে অপছন্দ করে”[2]।
>[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২১।
আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে তার নিজের হক-অধিকারসমূহ বর্ণনা করেছেন, যেগুলো কেবল তার জন্যই হতে পারে, অন্য কারও সেগুলো থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে তিনি তার রাসূলের অধিকারও বর্ণনা করেছেন আর মুমিনদের পরস্পরের অধিকারসমূহ বর্ণনা করেছেন। যা আমরা অন্য স্থানে বর্ণনা করেছি। আর তা যেমন আল্লাহর বাণী,
﴿وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَخۡشَ ٱللَّهَ وَيَتَّقۡهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَآئِزُونَ ٥٢﴾ [النور: ٥٢]
“আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে তারাই কৃতকার্য।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫২] সুতরাং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য, ভয় এবং তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে একমাত্র আল্লাহর। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَوۡ أَنَّهُمۡ رَضُواْ مَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ سَيُؤۡتِينَا ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ وَرَسُولُهُۥٓ إِنَّآ إِلَى ٱللَّهِ رَٰغِبُونَ ٥٩﴾ [التوبة: ٥٩]
“আর ভালো হত যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে সন্তুষ্ট হত এবং বলত, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, অচিরেই আল্লাহ আমাদেরকে দেবেন নিজ করুণায় এবং তাঁর রাসূলও; নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই প্রতি অনুরক্ত।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৫৯]
অতএব যেতে হবে আল্লাহ ও তার রাসূলের কাছে, কিন্তু অনুরক্ত হতে হবে কেবল আল্লাহর দিকে।
আর মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُوا ٧﴾ [الحشر: ٧]
“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক।” [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ৭] কেননা হালাল হলো আল্লাহ ও তার রাসূল যা হালাল করেছেন এবং হারাম হলো আল্লাহ ও তার রাসূল হারাম করেছেন। তবে সহায়, উপায় ও যথেষ্টতা কেবল আল্লাহর কাছেই প্রাপ্ত হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, সাহাবায়ে কেরাম বলেছিলেন,
﴿وَقَالُواْ حَسۡبُنَا ٱللَّهُ﴾ [ال عمران: ١٧٣]
“আর তারা বলেছিল, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৩] তারা বলেন নি যে, ‘আমাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূল যথেষ্ট।’
মহান আল্লাহ আরও বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ حَسۡبُكَ ٱللَّهُ وَمَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ٦٤﴾ [الانفال: ٦٤]
“হে নবী! আপনার জন্য ও আপনার অনুসারীদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬৪] অর্থাৎ আল্লাহ আপনার জন্য যথেষ্ট, অনুরূপভাবে মুমিনদের মধ্য থেকে যারা আপনার অনুসরণ করে তাদের জন্যও আল্লাহ যথেষ্ট।
এটাই হচ্ছে এ আয়াতের বিশুদ্ধ ও অকাট্য অর্থ, আর এজন্যই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারা উভয়েই সংকটের সময় বলেছিলেন,
﴿حَسۡبُنَا ٱللَّهُ وَنِعۡمَ ٱلۡوَكِيلُ﴾
“আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট আর তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক”।
মহান আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন এবং সবচেয়ে প্রজ্ঞাময়। আর সালাত ও সালাম পেশ করুন আল্লাহ তা‘আলা তার সর্বোত্তম সৃষ্টি আমাদের নেতা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, তার পরিবার এবং সাহাবীগণেরও ওপর।