আর যদি প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের দ্বারা উদ্দেশ্য হয়, কুতুব, গাউস ও অন্যান্য পূণ্যবান ব্যক্তি, যিনি তৎকালীন সময়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে বিবেচিত, তাহলে এটা তার উদ্দেশ্য হওয়া সম্ভব; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একই সময়ে দু’জন সমমর্যাদার লোক থাকা অসম্ভব নয়, অনুরূপভাবে তিনজন ও চারজনও থাকতে পারে। সুতরাং কোনো সময়ে উত্তম ব্যক্তি একজনই হবেন এমনটি দৃঢ়ভাবে বলা কখনই সম্ভব নয়। বরং একদল লোক এমন হতে পারেন যাদের কেউ অপর কারও থেকে একদিকে উত্তম হবেন, অন্যজন অপরদিক থেকে উত্তম হবেন। এ বিষয়গুলো কাছাকাছি পর্যায়ের কিংবা সমপর্যায়ের।
তাছাড়া কোনো এক সময় যদি কোনো লোক সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে বিবেচিত হয়েও যান, তাকে কুতুব বা গাউস নামকরণ করা বিদ‘আত। কারণ, এ ধরনের নামকরণের ব্যপারে মহান আল্লাহ কোনো কিছু অবতীর্ণ করেন নি। আর উম্মাতের পূর্বসূরীদের কোনো ব্যক্তি ও ইমামগণ এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেন নি। অথচ পূর্বসূরীগণ তাদের কোনো কোনো মানুষের ব্যপারে ধারণা করতেন যে, অমুক ব্যক্তি তাদের মধ্যে সর্বোত্তম অথবা উক্ত ব্যক্তি সে যুগের উত্তম মানুষের অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু তারা সেসব ব্যক্তিদের ব্যাপারে তথাকথিত গাউস, কুতুব ইত্যাদি নাম ব্যবহার করেন নি। কেননা এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ কোনো কিছুই অবতীর্ণ করেন নি। বিশেষ করে যারা এসব নামের প্রবর্তক তারা দাবী করে যে, প্রথম কুতুব হলেন হাসান ইবন আলী ইবন আবী তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। অতঃপর পর্যায়ক্রমে পরবর্তী অন্যান্য মাশায়েখদের তালিকা রয়েছে। আর এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শিয়া-রাফেযী কোনো মত অনুযায়ীই এটা সঠিক নয়। কারণ, (যদি তাদের কথা শুদ্ধ হয়) তবে কোথায় আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী রাদিআল্লাহু আনহুমসহ অন্যান্য অগ্রগামী মুহাজির ও আনসারগণ? অথচ হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর সময় কেবল পরিণত বয়সে উপনীত হওয়ার কাছাকাছি ছিলেন। (বড় বড় সাহাবীগণের ওপর তাকে প্রাধান্য দেওয়ার রহস্য কী?)
এসব বক্তব্যের প্রবর্তক কোনো কোনো বড় শায়খ থেকে বর্ণনা করা হয় যে, কুতুব, গাউস ও পূর্ণবান ব্যক্তির জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের অনুরূপ হয়, তাদের ক্ষমতা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা অনুযায়ী হয়। তাই (তাদের ধারণামতে) আল্লাহ যা জানেন তারাও তা জানে আর আল্লাহ যেটার ক্ষমতা রাখেন তারাও সেটার ক্ষমতা রাখে। আর তারা মনে করে থাকে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও অনুরূপ ছিলেন। আর এটা তাঁর থেকে স্থানান্তরিত হয়ে হাসান এর দিকে যায় এবং হাসান থেকে তার শিষ্যের কাছে ক্রমান্বয়ে যায়। একথা যখন আমার কাছে বর্ণনা করা হয় তখন আমি বর্ণনা করে বলি যে, এটা স্পষ্ট কুফুরী ও নিকৃষ্ট অজ্ঞতাপ্রসূত কথা। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যপারে এমনটি দাবী করা কুফুরী, তিনি ব্যতীত অন্যের ব্যাপারে সেটা আরও মারাত্মক কথা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُل لَّآ أَقُولُ لَكُمۡ عِندِي خَزَآئِنُ ٱللَّهِ وَلَآ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ وَلَآ أَقُولُ لَكُمۡ إِنِّي مَلَكٌۖ﴾ [الانعام: ٥٠]
“বলুন, ‘আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার নিকট আল্লাহর ভাণ্ডারসমূহ আছে, আর আমি গায়েবও জানি না এবং তোমাদেরকে এও বলি না যে, আমি ফিরিশতা।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫০]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ وَلَوۡ كُنتُ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ لَٱسۡتَكۡثَرۡتُ مِنَ ٱلۡخَيۡرِ وَمَا مَسَّنِيَ ٱلسُّوٓءُۚ﴾ [الاعراف: ١٨٨]
“বলুন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোনো অধিকার নেই। আমি যদি গায়েবের খবর জানতাম তবে তো আমি অনেক কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোনো অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না।” [সূরা আল-আ‘রাফ:১৮৮]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَقُولُونَ لَوۡ كَانَ لَنَا مِنَ ٱلۡأَمۡرِ شَيۡءٞ مَّا قُتِلۡنَا هَٰهُنَا﴾ [ال عمران: ١٥٤]
“তারা বলে, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কোনো কিছু করার থাকলে আমরা এখানে নিহত হতাম না।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৪]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَقُولُونَ هَل لَّنَا مِنَ ٱلۡأَمۡرِ مِن شَيۡءٖۗ قُلۡ إِنَّ ٱلۡأَمۡرَ كُلَّهُ٥٤﴾ [ال عمران: ١٥٤]
“নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্বিগ্ন করেছিল এ বলে যে, ‘আমাদের কি কোনো কিছু করার আছে’? বলুন, ‘সব বিষয় আল্লাহরই ইখতিয়ারে।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৪]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لِيَقۡطَعَ طَرَفٗا مِّنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ أَوۡ يَكۡبِتَهُمۡ فَيَنقَلِبُواْ خَآئِبِينَ ١٢٧ لَيۡسَ لَكَ مِنَ ٱلۡأَمۡرِ شَيۡءٌ أَوۡ يَتُوبَ عَلَيۡهِمۡ أَوۡ يُعَذِّبَهُمۡ فَإِنَّهُمۡ ظَٰلِمُونَ ١٢٨﴾ [ال عمران: ١٢٧، ١٢٨]
“যাতে তিনি কাফেরদের এক অংশকে ধ্বংস করেন বা তাদেরকে লাঞ্ছিত করেন। ফলে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। তিনি তাদের তাওবা কবুল করবেন বা তাদেরকে শাস্তি দেবেন- এ বিষয়ে আপনার করণীয় কিছুই নেই। কারণ তারা তো যালেম।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১২৭, ১২৮]
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
﴿إِنَّكَ لَا تَهۡدِي مَنۡ أَحۡبَبۡتَ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ٥٦﴾ [القصص: ٥٦]
“আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছে করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবেন না; বরং আল্লাহই যাকে ইচ্ছে সৎপথে আনয়ন করেন এবং সৎপথ অনুসারীদের সম্পর্কে তিনিই ভালো জানেন।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৫৬]
আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার জন্য আমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। তারপর তিনি বলেন,
﴿مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَ﴾ [النساء: ٨٠]
“কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল, আর তিনি আমাদেরকে তার অনুসরন করার জন্য আদেশ দিয়েছেন।” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০]
অতঃপর তিনি বলেন,
﴿قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ ٣١﴾ [ال عمران: ٣١]
“বলুন, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১]
আর তিনি আমাদেরকে তাঁর রাসূলকে শক্তিশালী করার, সম্মান করার ও সাহায্য করার জন্য আদেশ দিয়েছেন এবং তার জন্য কিছু হক নির্ধারণ করেছেন যা তিনি তাঁর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহতে বর্ণনা করেছেন। এমনকি তিনি আমাদের জন্য ওয়াজিব করেছেন তিনি যেন আমাদের কাছে আমাদের নিজেদের ও পরিবার পরিজন থেকে অধিক ভালোবাসার মানুষ হন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلنَّبِيُّ أَوۡلَىٰ بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ مِنۡ أَنفُسِهِمۡۖ ٦﴾ [الاحزاب: ٦]
“নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও ঘনিষ্টতর” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৬]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿قُلۡ إِن كَانَ ءَابَآؤُكُمۡ وَأَبۡنَآؤُكُمۡ وَإِخۡوَٰنُكُمۡ وَأَزۡوَٰجُكُمۡ وَعَشِيرَتُكُمۡ وَأَمۡوَٰلٌ ٱقۡتَرَفۡتُمُوهَا وَتِجَٰرَةٞ تَخۡشَوۡنَ كَسَادَهَا وَمَسَٰكِنُ تَرۡضَوۡنَهَآ أَحَبَّ إِلَيۡكُم مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَجِهَادٖ فِي سَبِيلِهِۦ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦۗ وَٱللَّهُ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٤﴾ [التوبة: ٢٤]
বলুন, ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর (আল্লাহর) পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশি প্রিয় হয় তোমাদের পিতৃবর্গ, তোমাদের সন্তানরা, তোমাদের ভ্রাতাগণ, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের আপনগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশংকা কর এবং তোমাদের বাসস্থান যা তোমরা ভালোবাস, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত।’ আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৪]
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«والذي نفسي بيده، لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَلَدِهِ وَوَالِدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ».
“যার হাতে আমার প্রাণ ঐ সত্ত্বার শপথ করে বলছি, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে প্রিয় হবো তার সন্তান-সন্তুতি, পিতা-মাতা ও সকল মানুষ থেকে প্রিয় হবো”।[1]
আর উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তো আমার কাছে সবকিছুর থেকে বেশি প্রিয় তবে আমার নিজ সত্ত্বা থেকে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, যতক্ষণ আমি তোমার কাছে তোমার সত্ত্বার থেকেও বেশি প্রিয় হবো, (ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না) তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, এখন আপনি আমার নিকট আমার নিজ সত্ত্বা থেকেও অধিক প্রিয়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এখন হে উমার (ঈমানের দাবী যথার্থ হয়েছে)।
অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ: مَنْ كَانَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَمَنْ أَحَبَّ عَبْدًا لاَ يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ، وَمَنْ يَكْرَهُ أَنْ يَعُودَ فِي الكُفْرِ، بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللَّهُ، مِنْهُ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ»
“তিনটি বস্তুর যার মধ্যে ঘটবে সে অবশ্যই ঈমানের স্বাদ লাভ করেছে, যার কাছে আল্লাহ ও তার রাসূল এতদোভয়ের বাইরের সবকিছু থেকে প্রিয় হবে, যে কেউ কাউকে কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই ভালোবাসবে আর যে কেউ কুফুরী থেকে আল্লাহ তাকে উদ্ধার করার পর সে তাতে ফিরে যাওয়া এমনভাবে অপছন্দ করবে যেমন আগুনে নিক্ষেপ করাকে অপছন্দ করে”[2]।
>[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২১।