অন্যের কাছে দো‘আ চাওয়ার বিধান, সে ব্যক্তি জীবিত হোক কিংবা মৃত - ২

বস্তুত কবরের নিকট সালাত আদায় করা কিংবা মাযারে সালাত আদায় করা মুস্তাহাব বা এতে ফযীলত রয়েছে বলে আমাদের ইমামদের মধ্য থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য পূর্বসূরী বলেন নি। আর তারা এটাও বলেন নি যে, সেখানে সালাত আদায় ও দো‘আ করা অন্যান্য স্থানে সালাত আদায় ও দো‘আ করা থেকে উত্তম; বরং সকলের ঐকমত্যে মসজিদ ও ঘরে সালাত আদায় করা নবী ও ওলীদের কবরের নিকট সালাত আদায় থেকে উত্তম। চাই সেটা মাযার নামকরণ করা হোক বা না হোক।

আর আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদসমূহে এমন কিছু কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন যা মাযারে করতে অনুমতি দেন নি। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن مَّنَعَ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ أَن يُذۡكَرَ فِيهَا ٱسۡمُهُۥ وَسَعَىٰ فِي خَرَابِهَآۚ ١١٤﴾ [البقرة: ١١٤]

“আর তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে তাঁর নাম স্মরণ করতে বাধা দেয় এবং এগুলো বিরাণ করার চেষ্টা করে?” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১১৪] তিনি মাযারের ব্যাপারে তা বলেন নি। অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ বলেন,

﴿َوَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِ﴾ [البقرة: ١٨٧]

“আর তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় থাক।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭] মাযারে ই‘তিকাফ করতে বলা হয় নি।

﴿قُلۡ أَمَرَ رَبِّي بِٱلۡقِسۡطِۖ وَأَقِيمُواْ وُجُوهَكُمۡ عِندَ كُلِّ مَسۡجِدٖ﴾ [الاعراف: ٢٩]

“বলুন, আমার রব আমাকে ইনসাফ করার নির্দেশ দিয়েছে, আরও নির্দেশ দিয়েছে যেন তোমরা তোমাদের চেহারাকে প্রতিষ্ঠিত কর প্রতিটি মসজিদের স্থানে”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২৯]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿إِنَّمَا يَعۡمُرُ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَأَقَامَ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَى ٱلزَّكَوٰةَ وَلَمۡ يَخۡشَ إِلَّا ٱللَّهَۖ فَعَسَىٰٓ أُوْلَٰٓئِكَ أَن يَكُونُواْ مِنَ ٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٨﴾ [التوبة: ١٨]

“তারাই তো আল্লাহর মসজিদের আবাদ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অতএব, আশা করা যায়, তারা হবে সৎপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿وَأَنَّ ٱلۡمَسَٰجِدَ لِلَّهِ فَلَا تَدۡعُواْ مَعَ ٱللَّهِ أَحَدٗا ١٨﴾ [الجن: ١٨]

“আর নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্য। কাজেই আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না”। [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ১৮]

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«صلاة الرجل في الجماعة تفضل على صلاته في بيته وسوقه خمساً وعشرين درجة»

“কোনো ব্যক্তির মসজিদে সালাত আদায় করা বাড়ী ও বাজার হতে পঁচিশ গুণ বেশি মর্যাদাপূর্ণ।”[1]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,

«مَنْ بَنَى لِلَّهِ مَسْجِدًا بَنَى الله لَهُ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ»

“যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোনো মসজিদ নির্মাণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানাবেন।” অথচ কবর, যাকে মসজিদ বানানোর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত আছে এবং যে এমন কাজ করবে তাকে তিনি অভিসম্পাত দিয়েছেন। যা একাধিক সাহাবী ও তাবে‘ঈও উল্লেখ করেছেন। যেমনটি ইমাম বুখারী রহ. তার সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আর তাবরানী ও অন্যান্যরাও তাদের তাফসীরসমূহে বর্ণনা করেছেন। আর এ বিষয়টি ওয়াসিমা ও অন্যান্যগণ (কাসাসুল আম্বিয়া) গ্রন্থে আল্লাহ তা‘আলার নিন্মোক্ত বাণীর তাফসীরে বর্ণনা করেছেন:

﴿وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا ٢٣﴾ [نوح: ٢٣]

“আর তারা বলেছে, ‘তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে; পরিত্যাগ করো না ওয়াদ, সুওয়া‘আ, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে”। [সূরা নূহ, আয়াত: ২৩] তারা বলেছেন, “এসব হচ্ছে নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের নেককার ব্যক্তিবর্গের নাম। অতঃপর যখন তারা মারা গেলো তারা তাদের কবরের প্রতি আসক্ত হলো। তারপর দীর্ঘসময় তাদের ওপর অতিবাহিত হলো, অতঃপর তারা তাদের আকৃতিগুলোকে মূর্তিরূপে গ্রহণ করে। বস্তুত কবরের প্রতি তাদের আসক্তি, সেগুলোর স্পর্শ, চুম্বন ও কবরবাসীদের নিকট দো‘আ করা প্রভৃতিই হলো শির্কের মূল-ভিত্তি এবং মূর্তিপূজার গোড়ার কথা। আর একারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«اللَّهُمَّ لاَ تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَناً يُعْبَدُ»

“হে আল্লাহ! আপনি আমার কবরকে এমন মূর্তি বানাবেন না, যার ইবাদত করা হয়।”[2]

আর আলিমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, কোনো লোক যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর যিয়ারত করে অথবা তিনি ব্যতীত অন্যান্য নবী ও ওলীদের তথা সাহাবী ও আহলে বাইত ও অন্যান্যদের কবর যিয়ারত করে, সে তা স্পর্শ করবে না এবং চুম্বনও করবে না; বরং পৃথিবীতে পাথরসমূহের মধ্যে হাজরে আসওয়াদ ছাড়া আর কোনো পাথরকে চুম্বন করা বৈধ নয়। আর সে জন্যই সহীহ বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,

«والله إِنِّي لَأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ، وَلَوْلاَ أَنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُك»

“আল্লাহর শপথ করে বলছি। নিশ্চয় আমি জানি তুমি একটি পাথর মাত্র। কোনো ক্ষতি ও উপকার কারতে পার না, যদি আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তবে তোমাকে চুম্বন করতাম না।”[3]

আর একারণেই ইমামগণের ঐকমত্যে কোনো ব্যক্তির জন্য সুন্নত নয় কাবাঘরের হাজরে ইসমাঈল বা হাতীম সংলগ্ন বাকী দুটি রুকন অথবা কাবার দেয়াল অথবা মাকামে ইবরাহীম অথবা বায়তুল মুকাদ্দাসের পাথর, কিংবা কোনো নবী বা ওলীর কবর চুম্বন অথবা স্পর্শ করা সুন্নাত নয়। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিম্বারের ওপর হাত রাখা, যা তখন বর্তমান ছিল, তাতেও তারা মতানৈক্য করেছেন। ইমাম মালেক রহ. ও অন্যান্যরা এটা মাকরূহ বলেছেন। কেননা এটা বিদ‘আত। আর মালেক যখন ‘আতা রহ.-কে এ কাজ করতে দেখলেন তখন তিনি তার থেকে ইলম গ্রহণ করেন নি। যদিও ইমাম আহমাদ ও অন্যান্যগণ এটাতে রুখসত বা ছাড় আছে বলে মত দিয়েছেন। কেননা ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এমনটি করেছেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর স্পর্শ করা ও চুমো দেওয়াকে সকল ইমাম অপছন্দ ও নিষিদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন। কেননা তারা জানত যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শির্কের যাবতীয় উপায়-উপকরণ ও সকল ছিদ্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং আর তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আর দীনকে একনিষ্টভাবে একমাত্র সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন।

>
[1] সহীহ মুসলিম (১/৩৭৮)।

[2] মুয়াত্তা মালেক (১/১৮৫); মুসনাদে আহমদ (২/২৪৬)।

[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬১০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২৭০।