অতঃপর জাহেলীরা ইবাদতের উপর্যুক্ত কিছু প্রকারকে মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্যের প্রতি প্রদান করত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, নিশ্চয় এসব ওলীগণ, তাদের সত্তা এবং তাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক উর্ধ্বে। আর জাহেলী লোকদের ধারণামতে এ ওলীগণ তাদের প্রয়োজনসমূহ আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করবে। সেসব ওলীগণের উদাহরণ যেমন, তায়েফে লাত নামক প্রতীমাকে ডাকা হতো আল্লাহকে বাদ দিয়ে আর লাত মৃত্যুর পূর্বে মানুষের জন্য উপকারী ছিল বিশেষত হাজীদের জন্য। ফলে তিনি ছাতু জাতীয় খাবার পরিবেশন করতেন। এটি আরবদের নিকট পরিচিত এক ধরণের খাবার, সেটাকে হাজীদের নিকট পেশ করত। অতঃপর যখন সে মারা গেল তখন তার অবস্থা হলো তাদের মতো যাদের সম্পর্কে মানুষ বিশ্বাস করত যে, তাদের মধ্যে অনেক ভালো সৎকর্ম ছিল। ফলে সে যুগের মানুষেরা দুঃখ পেল এবং তারা তার কবরের দিকে ঘুরা ফেরা করতে লাগল। তারপর তারা সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করল। অতঃপর তাকে তাদের অসীলা হিসাবে বানাল এবং তার কবরে তাওয়াফ করতে লাগল। আর তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ ও দুঃখ কষ্ট লাঘবে তার নিকট প্রার্থনা করতে লাগল। অনুরূপভাবে তারা উযযা ও মানাত থেকেও চাইতো। যেমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠ أَلَكُمُ ٱلذَّكَرُ وَلَهُ ٱلۡأُنثَىٰ ٢١ تِلۡكَ إِذٗا قِسۡمَةٞ ضِيزَىٰٓ ٢٢ إِنۡ هِيَ إِلَّآ أَسۡمَآءٞ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ ٢٣﴾ [النجم: ١٩، ٢٣]
“তোমরা লাত ও উযযা সম্পর্কে আমাকে বল? আর মানাত সম্পর্কে, যা তৃতীয় আরেকটি? তোমাদের জন্য কি পুত্র আর আল্লাহর জন্য কন্যা? এটাতো তাহলে এক অসম বন্টন। এগুলো কেবল কতিপয় নাম, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা রেখেছ। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোনো দলীল প্রমাণ নাযিল করেন নি।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ১৯-২৩]
এতদসত্বেও তারা জানত যে, যাদেরকে তারা ডাকছে তারা এ জগতে কোনো কিছু সৃষ্টি করে নি। আর তারা রিযিক, জীবন-মৃত্যু ও অন্যন্য কোনো কিছুর মালিক নয়। আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন,
﴿قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ فَقُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ ٣١﴾ [يونس: ٣١]
“বল, আসমান ও জমিন থেকে কে তোমাদের রিযিক দেন? অথবা কে শ্রবণ ও দৃষ্টিসমূহের মালিক? আর কে মৃত থেকে জীবিতদের বের করেন আর জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন? কে সব বিষয় পরিচালনা করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ’। সুতরাং তুমি বল, ‘তারপরও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না’?” [সূরা ইউনুছ, আয়াত: ৩১]
অর্থাৎ যখন তোমরা জানলে যে, এসবের কর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা তাহলে কি তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করবে না, ফলে দো‘আর ক্ষেত্রেও তোমরা তাকে অনুরুপভাবে একক হিসাবে মনে কর যেভাবে সৃষ্টির বিষয়ে তাকে একক জান?
অতএব, এ থেকে বুঝা যায় যে, কাফিররা ঐ সকল নেককার ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে যা আশা করে তাহলো তারা যেন তাদেরকে মহান আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেন। তাদের ধারণা মতে আল্লাহ ঐসব মৃত নেককার ব্যক্তিদের দো‘আ কবুল করেন। ফলে তিনি সাহায্য প্রার্থনাকারীদের প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। আর এটাই হলো সত্য ইলাহের ব্যাপারে তাদের নিকৃষ্ট অপমান। তার কারণ হলো, মহান রব আল্লাহ কোনো মানুষের মতো নন যে, তার নিকট কোনো কিছু চাইতে কোনো মন্ত্রী অথবা সাহায্যকারী অথবা অন্য কোনো কিছুর প্রয়োজন। যেমনিভাবে মানুষের অবস্থা, যেহেতু সকল বিষয়ে তাদের পরিবেষ্টনে নয়। এখানে কুরআনুল কারীম থেকে আমরা জানতে পারি যে, যে কেউ আল্লাহ ব্যতীত কোনো মৃত ও অন্যান্যকে ডাকবে এমন ব্যাপারে যা সিদ্ধ করতে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কেউ সক্ষম নয়, সে মুশরিক ও আল্লাহর অস্বীকারকারী। মহান আল্লাহ তা‘আলা তাদের সন্দেহ সংশয় স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেন,
﴿إِنَّ ٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ عِبَادٌ أَمۡثَالُكُمۡۖ فَٱدۡعُوهُمۡ فَلۡيَسۡتَجِيبُواْ لَكُمۡ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١٩٤﴾ [الاعراف: ١٩٤]
“আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাক তারা তোমাদের মতো বান্দা। সুতরাং তোমরা তাদেরকে ডাক। অতঃপর তারা যেন তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৯৪]
আর আল্লাহ তা‘আলা দলিল বর্ণনা করেছেন যে, নিশ্চয় তারা যাদের ডাকে তারা তাদের ডাক শুনে না। যদিও বির্তকের খাতিরে মেনে নেওয়া হয় তথাপিও কখনো তারা তাদের ডাকে সাড়া দিবে না। আর তারা কিয়ামতের ময়দানে তাদের এসব কর্মকে অস্বীকার করবে। তাদের এসব কর্মকে কুরআনে দলীল দ্বারা শির্ক নামকরণ করা হয়েছে। আর তা হলো সূরা ফাতিরে আল্লাহর বাণী:
إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ بِشِرۡكِكُمۡۚ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثۡلُ خَبِيرٖ
“যদি তোমরা তাদেরকে ডাক, তারা তোমাদের ডাক শুনবে না; আর শুনতে পেলেও তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না এবং কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শরীক করাকে অস্বীকার করবে। আর সর্বজান্তা আল্লাহর ন্যায় কেউ তোমাকে অবহিত করবে না।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ১৪]
সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত প্রত্যেক মৃত যাদের ডাকা হয় তারা শুনতে পায় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّكَ لَا تُسۡمِعُ ٱلۡمَوۡتَىٰ ٨٠ ﴾ [النمل: ٨٠]
‘‘নিশ্চয় আপনি মৃতদেরকে কথা শুনাতে পারেন না’’ [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৮০]
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
وَمَآ أَنتَ بِمُسۡمِعٖ مَّن فِي ٱلۡقُبُورِ
‘‘কিন্তু যে ব্যাক্তি কবরে আছে তাকে আপনি শুনাতে পারবেন না।’’ [সূরা ফাতির, আয়াত: ২২]
আর তারা গায়েব সম্পর্কে জানে না। যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও গায়েব সম্পর্কে জানেন না। যেমন সূরা আল-আ‘রাফে বর্ণিত হয়েছে,
﴿ قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ وَلَوۡ كُنتُ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ لَٱسۡتَكۡثَرۡتُ مِنَ ٱلۡخَيۡرِ وَمَا مَسَّنِيَ ٱلسُّوٓءُۚ ﴾ [الاعراف: ١٨٨]
“বল, ‘আমি আমার নিজের কোনো উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতা রাখি না, তবে আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোনো ক্ষতি স্পর্শ করত না।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৮৮]
তাহলে কীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিচুস্তরের কোনো মানুষের পক্ষে গায়েব জানা সম্ভব হতে পারে? ফলে কোনো ব্যক্তি কবরের নিকট গিয়ে কোনো কিছু চাইলে তার পক্ষে কিছু জানা সম্ভব নয়; বরং তারা অস্তিত্বহীনের কাছেই কোনো কিছু চাচ্ছে। আর তাদের জন্য আল্লাহর নিকট (ওলীগণের) সত্ত্বার মাধ্যমে কোনো শাফা‘আত চাওয়াও শুদ্ধ নয়। কারণ মহান আল্লাহ আরবদেরকে মৃত ব্যক্তির নিকট চাওয়ার কারণে কাফির বলেছেন, যদিও তাদের বক্তব্য ছিল
مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ
“আমরা কেবল এজন্যই তাদের ইবাদত করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]
অর্থাৎ আমরা তাদেরকে ডাকি না। কেননা ডাকাই হচ্ছে ইবাদত, অচিরেই এই সম্পর্কে বর্ণনা করা হবে। বস্তুত তাদের নিকট শাফা‘আত প্রার্থনা করা অনেক বড় ভুল। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِ
“কে আছে যে তাঁর (আল্লাহর) নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ছাড়া?” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৫]
وَلَا يَشۡفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ٱرۡتَضَىٰ
“আর তারা শুধু তাদের জন্য সুপারিশ করে যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৮]
তিনি (সুবহানাহু) পবিত্রময় সত্ত্বা, মৃতদের কাছ থেকে শাফা‘আত চাওয়া পছন্দ করেন না। কেননা মৃতের কোনো জীবন নেই এবং কোনো ক্ষমতা নেই। তাহলে কীভাবে অস্তিত্বহীনের কাছে চাইবে? তার কাছেই তো চাওয়া যায়, যার ক্ষমতা আছে আর তিনি হলেন আল্লাহ তা‘আলা।