৫. সাওম ও সদকা একত্রিত হলে তা গুনাহের কাফফার জন্য সর্বাধিক কার্যকরী, জাহান্নাম থেকে রক্ষাকারী ও জাহান্নাম থেকে দূরে অবস্থানকারী, বিশেষ করে এর সাথে যদি কিয়ামুল লাইল যুক্ত হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে,
«الصِّيَامُ جُنَّةٌ كَجُنَّةِ أَحَدِكُمْ مِنَ الْقِتَالِ».
“সাওম এমন ঢালস্বরূপ, তোমাদের যুদ্ধে ব্যবহৃত ঢালের ন্যায়”।[1]
মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে,
«الصِّيَامُ جُنَّةٌ، وَحِصْنٌ حَصِينٌ مِنَ النَّارِ».
“সাওম ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নাত থেকে মুক্তির সুদৃঢ় সুরক্ষা”।[2]
মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الْخَطِيئَةَ، وَصَلَاةُ الرَّجُلِ فِي جَوْفِ اللَّيْلِ».
“এবং সাদাকা (যাকাত) বা দান খায়রাত) গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেয়, যেভাবে পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়। এমনিভাবে গভীর রাতে ব্যক্তির কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জু্র)ও গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়।”[3]
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ».
“তোমারা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচ (নিজেকে রক্ষা কর) যদিও তা খেজুরের টুকরা দ্বারাও হয় (সামান্য বস্তু সদাকা করতে পারলেও তা কর)”।[4]
আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন, ‘তোমরা রাতের অন্ধকারে দুরাক‘আত সালাত আদায় করো কবরের অন্ধকার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, প্রচণ্ড গরমের দিনে সাওম পালন করো হাশরের ময়দানের গরম থেকে বাঁচার জন্য, কিয়ামতের ভয়াবহ দিনের আযাব থেকে রক্ষা পেতে গোপনে সদকা দাও।’
৬. রমযান মাসে সাওম পালন করতে গিয়ে অনেক সময় কিছু ভুল-ত্রুটি ও কমতি দেখা দেয়। সাওম গুনাহের কাফফারা হওয়ার শর্ত হচ্ছে যেসব বিষয় থেকে হিফাযত থাকা অত্যাবশ্যকীয় সেসব বিষয় থেকে বিরত থাকা। যেমন, ইবন হিব্বানে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, অধিকাংশ সাওম পালনকারীই যেভাবে সাওম পালন করা দরকার সেভাবে সাওম পালনের শর্তাবলী তাদের মধ্যে একত্রিত হয় না। এ কারণেই কোনো ব্যক্তিকে এভাবে বলতে নিষেধ করা হয়েছে যে, আমি পুরো রমযান সাওম পালন করেছি বা পুরো রাত সালাত আদায় করেছি। অতএব, এসব সদকার দ্বারা সাওম পালনে সংঘটিত ভুল-ত্রুটিসমূহের কাফফারা হয়ে যায়। এ কারণেই রমযান শেষে সাওম পালনকারীকে অনর্থক ও অশ্লীল কথাবার্তা ও কাজ থেকে পবিত্র করতে যাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে।
৭. সাওম পালানকারী সাওম অবস্থায় পানাহার পরিহার করে থাকে। আর কেউ সায়িমদেরকে পানাহার সরবাহ করে তাদেরকে শক্তিশালী করলে তার অবস্থা ঐ ব্যক্তির মতোই যে নিজে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য প্রবৃত্তিকে ত্যাগ করল এবং এর দ্বারা সে সহমর্মিতা দেখালো। এ কারণেই সায়িমের সাথে অন্য সায়িমকে ইফতার করানো শরী‘আতসম্মত হয়েছে। কেননা ইফতারের সময় খাদ্য গ্রহণ তার কাছে অনেক প্রিয়, ফলে সে সহমর্মিতা দেখিয়ে তার সাথে অন্যকে খাওয়ালো, যদিও সে খাদ্যের প্রতি তার নিজেরই ভালোবাসা ছিল। এভাবে কাজটি করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা পানাহার হারাম করার পরে তার জন্য হালাল করে তাকে যে নি‘আমত দান করেছেন সে নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করা। কেননা কোনো কিছু নিষেধ করার পরে উক্ত জিনিসের প্রকৃত মর্যাদা বুঝা যায়।
কোনো এক ‘আরিফ বিল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হলো, শরী‘আতে কেন সাওম বিধিবদ্ধ করা হয়েছে? তিনি বললেন, ধনীরা যাতে ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করতে পারে, ফলে সে ক্ষুধার্তকে কখনও ভুলবে না। এটি সাওম শরী‘আতসম্মত হওয়ার কিছু উপকারিতা। সালমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, “রমযান মাস পরস্পর সহমর্মিতার মাস।” যে ব্যক্তি অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছতে পারবে না সে সহমর্মিতার দলের স্তরে পৌঁছতে পারবে না। অনেক পূর্বসূরীরা ইফতারের সময় সহমর্মিতা ও অন্যকে অগ্রাধিকার দিতেন। ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা মিসকীন ব্যতীত ইফতার করতেন না। পরিবারের কেউ নিষেধ করলে তিনি সে রাতে কিছু খেতেন না। তিনি খাদ্য খাওয়ার সময় কেউ আসলে তিনি তার ভাগের খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন এবং কোনো প্রার্থনাকারীকে দিতেন। তিনি যখন ঘরে ফিরে আসতেন তখন অন্যদের খাবার খাওয়া শেষ হয়ে যেত। ফলে তিনি না খেয়েই সেদিন সাওম পালন করতেন।
এক সৎব্যক্তি সারাদিন সাওম পালন করে খাবার খাওয়ার ইচ্ছা করল। এমতাবস্থায় তার কাছে আরেকজন সাওম পালনকারী এসে বলল, কে আছ সত্যবাদী ক্ষুধার্ত এক ব্যক্তিকে খাদ্য দিবে? তখন তিনি বললেন, সাওয়াব বিহীন আল্লাহর এ বান্দা খাদ্য দিবে। তখন উক্ত ব্যক্তি খাবারের বাটি নিয়ে চলে গেল আর সৎলোকটি ক্ষুধার্ত থেকেই রাত কাটাল।
একলোক ইমাম আহমাদ রহ.-এর কাছে এসে কিছু চাইল। তিনি তার ইফতারির জন্য প্রস্তুতকৃত দু’টি রুটিই তাকে দান করে দিলেন। অতঃপর তিনি ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই সকাল করলেন। হাসান রহ. সাওম পালন করে নিজে না খেয়ে লোকদেরকে খাবার খাওয়াতেন এবং পাশে বসে তাদেরকে খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করত।
৮. সাওমের আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে। ইমাম শাফে‘ঈ রহ. বলেছেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণে এবং মানুষের কল্যাণ, প্রয়োজনীয়তা ও সালাত-সাওমের ব্যস্ততার কারণে জীবিকা নির্বাহে কম সময় পাওয়ার কারণে রমযান মাসে বেশি বেশি দান-সদকা করা আমি পছন্দ করি। ৯. রমযান মাসে বেশি পরিমাণে পরস্পর কুরআন পাঠ, শিক্ষা দেওয়া, এ জন্য একত্রিত হওয়া ও যিনি ভালো হাফিয তার কাছে কুরআন শুনানো ইত্যাদি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এ হাদীসে রমযান মাসে অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত মুস্তাহাব প্রমাণিত।
>[2] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৯২২৫, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, তবে এ সনদটিকে হাসান বলেছেন।
[3] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২২০১৬, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে তুরুক ও শাওয়াহেদের ভিত্তিতে সহীহ বলেছেন, তবে এ সনদটি মুনকাতি‘।
[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪১৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০১৬।