সহীহাইনে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ بِالخَيْرِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَلْقَاهُ كُلَّ لَيْلَةٍ فِي رَمَضَانَ، حَتَّى يَنْسَلِخَ، يَعْرِضُ عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ القُرْآنَ، فَإِذَا لَقِيَهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، كَانَ أَجْوَدَ بِالخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ المُرْسَلَةِ».
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। রমযানে জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সাথে দেখা করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রমযানের প্রতি রাতেই জিবরীল আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিবরীল আলাইহিস সালাম যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি রহমত প্রেরিত বায়ূর চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন”।[1]
মুসনাদে আহমাদে আরও বর্ধিত আছে,
«لَا يُسْأَلُ عَنْ شَيْءٍ إِلا أَعْطَاهُ».
“তার কাছে কোনো কিছু চাওয়া হলেই তাকে তা দিয়ে দিতেন”।[2]
....
হাদীসে বর্ণিত الجودُ শব্দের অর্থ, ব্যাপক দান খয়রাত। আল্লাহ নিজেকে الجودُ গুণে গুণান্বিত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা হলেন সর্বাধিক দানশীল, তাঁর দান বিশেষ সময় অনেকগুণে বৃদ্ধি পায়। যেমন, রমযান মাসে। এ মাসেই তিনি কুরআন নাযিল করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلۡيَسۡتَجِيبُواْ لِي وَلۡيُؤۡمِنُواْ بِي لَعَلَّهُمۡ يَرۡشُدُونَ١٨٦﴾ [البقرة: ١٨٦]
“আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৮৬]
আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টিগতভাবে সর্বাধিক পরিপূর্ণ ও সর্বোৎকৃষ্ট গুণ দিয়ে তৈরী করেছেন। যেমন, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
«بعثت لأتمم مَكَارِم الْأَخْلَاق».
“আমি সচ্চরিত্রকে পরিপূর্ণ করতে প্রেরিত হয়েছি”।[3] তাই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণভাবেই সকল মানুষের চেয়ে সর্বাধিক দানশীল ব্যক্তি ছিলেন, যেমন তিনি সর্বাধিক সম্মানিত, বীর ও সমস্ত প্রশংসিত গুণাবলীতে পরিপূর্ণ ছিলেন। তার দানশীলতা সব ধরণের দানশীলতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর রযমান মাসে তার দানশীলতা অন্যান্য মাসের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে যেত, যেমনিভাবে তার রবের দানও রমযানে অনেকগুণ বেড়ে যায়।
রমযান মাসে তিনি ও জিবরীল আলাইহিস সালাম মিলিত হতেন। আর জিবরীল আলাইহিস সালাম হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত ফিরিশতা। তারা উভয়ে মিলে নাযিলকৃত কুরআন পরস্পর পড়ে শুনাতেন। আর কুরআন হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম কিতাব, যা ইহসান ও উত্তম আখলাকের প্রতি উৎসাহিত ও অনুপ্রেরিত করে। আর এ সম্মানিত কিতাবই ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্র, যেহেতু তিনি এ কিতাবের সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট ছিলেন, এ কিতাবের অসন্তুষ্টিতে অসন্তুষ্ট ছিলেন, এ কিতাব সেসব বিষয়ে উৎসাহিত করেছে তিনি সেসব কাজ করতে দ্রুত এগিয়ে আসতেন এবং যা কিছু থেকে বিরত থাকতে ধমক দিয়েছে তিনিও তা থেকে বিরত থাকতেন। তার হায়াত শেষ হওয়া নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এ মাসে তার দান-খয়রাত ও দয়া বহুগুণে বৃদ্ধি পেত যখন জিবরীল আলাইহিস সালামের সাথে রমযানে সাক্ষাৎ করতেন ও পরস্পর পরস্পরকে বেশি বেশি কুরআন পড়ে শুনাতেন।
উত্তম চরিত্র ও দানশীলতার প্রতি অনুপ্রেরণা দানকারী এ কিতাব নিঃসন্দেহে জিবরীল আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাতের কারণে উত্তম আখলাকের এক বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে।
রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে অনেক উপকারিতা রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি হলো:
১. সময়ের মর্যাদা ও এতে আমলের সাওয়াব অনেকগুণ বৃদ্ধি পাওয়া।
২. সাওম পালনকারী ও আল্লাহর যিকিরকারীকে তাদের ইবাদতের কাজে সাহায্য করলে তাদের সাওয়াবের অনুরূপ সাওয়াব পাওয়া যায়, যেমনিভাবে কেউ আল্লাহর পথের মুজাহিদকে জিহাদে যাওয়ার উপকরণ প্রস্তুত করে দিলে সেও জিহাদের সাওয়াব পাবে এবং কেউ মুজাহিদের পরিবার-পরিজনের কল্যাণে বাড়ি থাকলেও সে জিহাদের সাওয়াব পাবে।
যায়েদ ইবন খালিদ আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِمْ، مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا».
“কেউ যদি কোনো সাওম পালনকারীকে ইফতার করায় তবে তার জন্যও অনুরূপ (সিয়ামের) সাওয়াব হবে। কিন্তু এতে সাওম পালনকারীর সাওয়াবে কোনো ঘাটতি হবে না”।[4]
৩. রমযান এমন একটি মাস যাতে আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন, বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে। আল্লাহ এ রাতে তাঁর দয়ালু বান্দার ওপর রহমত বর্ষণ করেন। যেমন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«وَإِنَّمَا يَرْحَمُ اللَّهُ مِنْ عِبَادِهِ الرُّحَمَاءَ».
“আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মাঝে যারা দয়ালু, তিনি তাদের প্রতি রহম করেন”।[5] সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদতে কঠোর পরিশ্রমী হবে আল্লাহও তার প্রতি দান, দয়া ও আমলের সাওয়াব সেভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণে দান করবেন।
৪. সাওম ও সদাকা একত্রিত হলে জান্নাত পাওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়।
«إِنَّ فِي الجَنَّةِ غُرَفًا تُرَى ظُهُورُهَا مِنْ بُطُونِهَا وَبُطُونُهَا مِنْ ظُهُورِهَا» ، فَقَامَ أَعْرَابِيٌّ فَقَالَ: لِمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: «لِمَنْ أَطَابَ الكَلَامَ، وَأَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَأَدَامَ الصِّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ».
“জান্নাতে একটি প্রাসাদ রয়েছে যার ভিতর থেকে বাহির এবং বাহির থেকে ভিতর পরিদৃষ্ট হবে। তখন এক বেদুঈন উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, হে আল্লাহর রাসূল এটি কার হবে? তিনি বললেন, এটি হবে তার যিনি ভালো কথা বলে, অন্যকে খাদ্য খাওয়ায়, সর্বদা সাওম পালন করে এবং যখন রাতে মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন সে উঠে সালাত আদায় করে”।[6]
এসব গুণাবলীর সবগুলোই রমযান মাসে পাওয়া যায়। ফলে মুমিন এ মাসে সিয়াম, সালাত, সদকা ও উত্তম কথাবার্তা বলে থাকেন। কেননা সাওম তাকে অনর্থক ও অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখে এবং সালাত ও সদকা ব্যক্তিকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে।
কোনো এক সৎপূর্বসূরী বলেছেন: সালাত ব্যক্তিকে অর্ধেক পথ পর্যন্ত পৌঁছায়, সাওম তাকে মহান মালিকের দরজা পর্যন্ত পৌঁছায়, সদকা তার হাত ধরে মহান মালিকের কাছে প্রবেশ করায়।
সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন জিজ্ঞাসা করলেন,
«مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: «فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: «فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِينًا؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، قَالَ: «فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيضًا؟» قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ: أَنَا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ، إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ».
“তোমাদের মধ্যে আজ কে সিয়াম পালনকারী আছে? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি সাওম পালনকারী। তিনি বললেন, আজ তোমাদের কে জানাযার সাথে চলেছ? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি। তিনি বললেন, আজ তোমাদের কে মিসকীনকে খাদ্য খাইয়েছ? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন আমি। তিনি বললেন, তোমাদের কেউ রোগীর শুশ্রূষা করেছ? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আমি। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যার মধ্যে এই কাজসমূহের সমাবেশ ঘটবে সে নিশ্চয়ই জান্নাতে প্রবেশ করবে”।[7]
[2] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২০৪২, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[3] মুসনাদ বাযযার, হাদীস নং ৮৯৪৯; মুসতাদরাক হাকিম, হাদীস নং ৪২২১, ইমাম হাকিম হাদীসটিকে মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ বলেছেন। ইমাম যাহাবীও একমত পোষণ করেছেন। আস-সুনান আল-কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং ২০৭৮২।
[4] তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৭, ইমাম তিরমিযী রহ. বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ। ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৭৪৬। ইমাম আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। ইবন হিব্বান, ৩৪২৯।
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯২৩।
[6] তিরমিযী, হাদীস নং ১৯৮৪, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে গরীব বলেছেন। আলবানী রহ. হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[7] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৮২।