রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরবাণী «فإنه لي» “সাওম আমার জন্য” এর ব্যাখ্যা হলো, আল্লাহ সাওমকে তাঁর নিজের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করেছেন যা তিনি অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে করেন নি। এর কয়েক ধরণের অর্থ হতে পারে। সবচেয়ে সুন্দর দু’টি ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:

প্রথমত: যখন প্রবৃত্তির চাহিদা চরম আকার ধারণ করে এবং তার সে চাহিদা পূরণের শক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এমন স্থানে সে চাহিদা পূরণ করা থেকে বিরত থাকে যেখানে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ তাকে দেখে না। এটি বান্দার সঠিক ঈমানের প্রমাণ। কেননা সাওম পালনকারী জানে যে, তার রয়েছ এমন একজন রব যিনি তার নির্জনের সব অবগত আছেন। তিনি নির্জনে তার স্বভাবজাত প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করতে হারাম করেছেন। ফলে বান্দা তার রবের শাস্তি থেকে রেহাই পেতে ও সাওয়াবের প্রত্যাশায় তাঁর আনুগত্য করল ও তাঁর আদেশ মান্য করল এবং তারঁ নিষেধ থেকে বিরত থাকল। এভাবে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তিনি তার অন্যান্য আমলের থেকে সাওমকে নিজের জন্য খাস করলেন। এ কারণেই তিনি এর পরে বলেছেন:

«يَتْرُكُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِي».

“সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে”।[1]

একজন সৎপূর্বসূরী বলেছেন: ঐ ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ যে গায়েবী প্রতিশ্রুতি পাওয়ার জন্য বর্তমানের প্রবৃত্তি পরিহার করল। মুমিন যেহেতু জানে যে, প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত থেকে সাওম পালনে তার প্রভুর সন্তুষ্টি রয়েছে, তাই সে নিজের প্রবৃত্তির ওপর তার মাওলা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ফলে সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। যেহেতু তার দৃঢ় ঈমান আছে যে, আল্লাহর দেওয়া সাওয়াব ও শাস্তি নির্জনে তার প্রবৃত্তির আনন্দের চেয়ে অধিক বেশি ও ভয়ানক। তাই সে তার প্রবৃত্তির ওপর তার রবের সন্তুষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বরং মুমিন কঠোর প্রহরের আঘাতের চেয়েও নির্জনে তার রবের অসন্তুষ্টিমূলক কাজ করতে বেশি অপছন্দ করে। এ কারণেই অনেক মুমিনকে বিনা ওযরে সাওম ভঙ্গ করতে বাধ্য করে প্রহর করলেও সে সাওম ভঙ্গ করতে রাজি হয় না। কেননা সে জানে, এ মাসে সাওম ভঙ্গ করা আল্লাহর অপছন্দ। আর এটির ঈমানের নিদর্শন। মুমিন প্রবৃত্তির চাহিদার কাজসমূহ অপছন্দ করে, যেহেতু সে জানে যে, এগুলো আল্লাহর অপছন্দ। তখন আল্লাহর সন্তুষ্টি মূলক কাজই তার আনন্দময়; যদিও তা তার প্রবৃত্তির বিপরীত। সাওমের কারণে যেহেতু নিম্নোক্ত কাজসমূহ হারাম যেমন, পানাহার, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি, অতএব যেসব কাজ সর্বদা ও সর্বত্রে চিরতরে হারাম সেগুলো থেকেও বিরত থাকা জরুরী যেমন, যিনা, মদপান, অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা, অন্যায়ভাবে অন্যের মান-সম্মান হানী করা, নিষিদ্ধ রক্তপাত করা ইত্যাদি। কেননা আল্লাহ এসব কাজ সর্বাবস্থায়, সর্বত্রে ও সর্বকালেই অপছন্দ করেন।

দ্বিতীয়ত: সাওম বান্দা ও তার রবের মধ্যকার গোপন ব্যাপার যা অন্য কেউ জানে না। কেননা সাওম সংঘটিত হয় গোপন নিয়াতের দ্বারা যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না এবং প্রবৃত্তির চাহিদা বর্জন করার মাধ্যমে যা বান্দা ইচ্ছা করলে গোপনে সেসব চাহিদা পূরণ করতে পারে। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, সাওমের সাওয়াব সংরক্ষণকারী ফিরিশতা লিপিবদ্ধ করেন না। আরও বলা হয়, এ ইবাদতের মধ্যে কোনো রিয়া তথা লৌকিকতা নেই। এটি প্রথম প্রকার তথা সঠিক ঈমানের প্রমাণের সাথে মিলে। কেননা যে ব্যক্তি তার নফসের কামনাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করে, যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানেন না এটি তার সঠিক ঈমানের প্রমাণ। আর আল্লাহ তাঁর ও বান্দার মধ্যকার গোপন আমলসমূহ পছন্দ করেন যা তিনি ব্যতীত কেউ জানে না।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, «ترك شهوتهُ وطعامه من أجلي» “সে আমার জন্য কামাচার ও পানাহার পরিত্যাগ করে”। এতে ঈঙ্গিত বহন করে যে, সাওম পালনকারী নিজের প্রবৃত্তির চাহিদা যেমন, পানাহার ও কামাচার ইত্যাদি সর্বোচ্চ প্রবৃত্তির কামনা পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন।

আর সাওমের মাধ্যমে প্রবৃত্তির খাম-খেয়ালী পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে রয়েছে অনেক উপকারিতা। সেগুলো নিম্নরূপ:

১- প্রবৃত্তিকে বিনষ্ট করে দেওয়া। কেননা উদরপূর্তি করে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস করলে প্রবৃত্তি ব্যক্তিকে অন্যায় কাজ, অকর্মণ্যতা ও অলসতার দিকে ঠেলে দেয়।

২- অন্তরকে চিন্তা-গবেষণা ও আল্লাহর যিকিরের জন্য খালি করা। কেননা এসব প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করলে অন্তর কঠিন ও অন্ধ হয়ে যায়। তখন তা অন্তর ও আল্লাহর যিকির ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণার মাঝে বাধা সৃষ্টি করে এবং অলসতায় পেয়ে বসে। আর পানাহার ত্যাগ করে উদরশূণ্য করলে অন্তর আলোকিত হয়, নরম হয়, কঠোরতা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর যিকির ও তাঁর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণার জন্য খালি হয়।

৩- ধন-ঐশ্বর্যবানরা তার ওপর আল্লাহর নি‘আমতের পরিমাণ বুঝতে পারে। সে গরীবের তুলনায় তার যথেষ্ট পরিমাণ পানাহার ও বিয়ে-শাদীর সামর্থ দেখতে পায় যা আল্লাহ তাকে দান করেছেন। আর সাওমের মাধ্যমে আল্লাহ তাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তা গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখেন। এতে তার কষ্ট অনুভব হয় এবং যাদেরকে আল্লাহ এ নি‘আমত থেকে বঞ্চিত করেছেন তখন সে উক্ত নি‘আমতের কথা স্মরণ করে। তখন তার ধন-ঐশ্বর্যের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করে এবং এ কাজ তাকে অভাবী দুঃখী ভাইয়ের প্রতি সহযোগিতা ও সাধ্যমত সমবেদনা প্রকাশে অত্যাবশ্যকীয় করে তোলে।

৪- সাওম রক্ত চলাচলের রাস্তা সংকুচিত করে যা আদম সন্তানের মধ্যে শয়তানের চলাচলের পথ। কেননা শয়তান বনী আদমের রক্ত চলাচলের রাস্তায় চলে। ফলে সাওমের দ্বারা শয়তানের সে ধোঁকা বন্ধ হয়, মানুষের প্রবৃত্তি ও ক্রোধ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাওমকে প্রবৃত্তির দমককারী বলেছেন। কেননা সাওম বিবাহের প্রবৃত্তিকে নি:শেষ করে দেয়।

জেনে রাখুন, সাওম পালন ছাড়া শুধু এসব বৈধ প্রবৃত্তি ত্যাগের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয় না যতক্ষণ সে সর্বাবস্থায় হারাম কাজ পরিহার না করবে। যেমন, মিথ্যা বলা, যুলুম করা, মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের ওপর সীমালঙ্ঘন করা ইত্যাদি পরিহার করা। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالعَمَلَ بِهِ، فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ».

“যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তাঁর এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই”।[2]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন:

«لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ فَقَطْ وَلَكِنَّ الصِّيَامَ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ».

“সাওম শুধু পানাহার ত্যাগ করা নয়; বরং অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ পরিহার করাই সাওম।”[3]

সহীহাইনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«َالصِّيَامُ جُنَّةٌ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ، فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ».

“সাওম ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সাওম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। কেউ যদি তাঁকে গালি দেয় অথবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন সাওম পালনকারী”।[4] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী «الجُنةُ» অর্থ ঢাল, যা দ্বারা ব্যক্তি আত্মরক্ষা করে, নিজেকে আড়াল করে এবং গুনাহে পতিত হওয়া থেকে তাকে রক্ষা করে। «والرَّفثُ» অর্থ অশ্লীলতা ও মন্দ কথাবার্তা।

মুসনাদে আহমাদ ও নাসাঈতে আবু ‘উবাইদাহ রহ. থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত,

«الصَّوْمُ جُنَّةٌ مَا لَمْ يَخْرِقْهَا».

“সাওম ঢালস্বরুপ যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভেঙ্গে না ফেলে।”[5]

....

কতিপয় সৎপূর্বসূরী বলেছেন: সবচেয়ে দুর্বল সাওম হলো পানাহার পরিহার করা। জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন: তুমি যখন সাওম পালন করবে তখন তোমার শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও জিহ্বাকে মিথ্যা ও হারাম কাজ থেকে সাওম (বিরত) রাখিও, প্রতিবেশিকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকো, তোমার যেন গম্ভীরতা ও প্রশান্তি থাকে, তুমি সাওমের দিন ও সাওম ব্যতীত দিনকে সমান করো না।

আমার শ্রবণ যদি হিফাযতকারী না হয়, আমার দৃষ্টি যদি অবনত না হয়, আমার কথা যদি চুপ না হয় তাহলে আমার সাওম শুধু ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ছাড়া কিছুই হবে না। যদিও তুমি বলো, আজকে আমি সাওম পালন করছি, অথচ তুমি সায়িম নও।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«رُبَّ صَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ صِيَامِهِ الْجُوعُ وَالْعَطَشُ، وَرُبَّ قَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ قِيَامِهِ السَّهَرُ».

“কিছু সাওম পালনকারীর সাওমের বিনিময়ে ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া কিছুই পায় না, আবার রাতে জাগরণকারী কিছু সালাত আদায়কারীর রাত্রি জাগরণ ব্যতীত কিছুই পায় না”।[6]

এর রহস্য হলো, বৈধ জিনিস পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার পদ্ধতি হলো, উক্ত সে বৈধ জিনিস পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পরে ততক্ষণ তা পরিপূর্ণ হয় না যতক্ষণ হারাম জিনিস পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা না হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি হারামে পতিত হয়ে মুবাহ জিনিস পরিহার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে তার উদাহরণ এরূপ যে ফরয ত্যাগ করে নফলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে।

....

«لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ يَفْرَحُهُمَا: إِذَا أَفْطَرَ فَرِحَ، وَإِذَا لَقِيَ رَبَّهُ فَرِحَ بِصَوْمِهِ».

“সাওম পালনকারীর জন্য রয়েছে দু’টি খুশী যা তাকে খুশী করে। যখন সে ইফতার করে, সে খুশী হয় এবং যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন সাওমের বিনিময়ে আনন্দিত হবে।”[7]

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১।

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৩।

[3] আততারগীর ওয়াততারহীব, ২/৩৬২, হাদীস নং ১৭৭৪। ইবনুল মাদীনী হাদীসের সনদটিকে মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ বলেছেন।

[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৫১।

[5] নাসাঈ, হাদীস নং ২২৩৫; আলবানী রহ. হাদীসটির সনদটিকে সহীহ ও মাকতু‘ বলেছেন। মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১৬৯০, মুহাক্কীক শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

[6] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৬৯০, ইবন খুযাইমা, হাদীস নং ১৯৯৭, ইবন হিব্বান, হাদীস নং ৩৪৮১। হাদীসটির সনদ সহীহ।

[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৪।