এখানে কাফির বা পাপিষ্ঠ আত্মার ভ্রমণ কাহিনী এমনভাবে বর্ণনা করব যেমনভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: কাফির বান্দা, অন্য বর্ণনায় পাপিষ্ঠ বান্দা যখন পৃথিবী ত্যাগ করে আখিরাতের দিকে অগ্রসর হয় তখন আকাশ থেকে কালো চেহারা বিশিষ্ট কঠিন হৃদয়ের ফিরিশতাগণ অবতীর্ণ হয়, যাদের সঙ্গে আগুনের পোশাক রয়েছে। অতঃপর চোখের শেষ দৃষ্টি দূরত্বে বসে থাকে, শুধু মৃত্যুর ফিরিশতা এগিয়ে এসে তার মাথার পাশে বসে বলে: হে খারাপ আত্মা! আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং গজবের দিকে বের হয়ে আস। তিনি বলেন: তখন সমস্ত শরীরে তা ছড়িয়ে পড়লে এমনভাবে টেনে বের করবে যেমনভাবে ভিজা তুলা থেকে বহু কাটা বিশিষ্ট লাঠি টেনে বের করা হয়। এতে তার সকল শিরা উপশিরা ছিড়ে বের হয়ে আসবে। তারপর আকাশ ও জমিনসহ আকাশের সকল ফিরিশতাগণ তাকে অভিশম্পাত করে, সেই সাথে আকাশের সকল দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং প্রত্যেক দরজার অধিবাসিগণ আল্লাহর নিকট দো‘আ করতে থাকে যে, তাদের নিকট দিয়ে যেন তা না নেওয়া হয়। তারপর মৃত্যুর ফিরিশতা রূহটি হাতে নিয়ে এক মুহূর্তও রাখতে পারে না; বরং অপেক্ষমান ফিরিশতাগণ আংটায় রেখে দেয় এবং তা থেকে মৃত জানোয়ারের দেহের দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। অতঃপর তা নিয়ে উপরে উঠতে থাকে, যখনই কোনো ফিরিশতার নিকট দিয়ে অতিবাহিত হয়, তখন তারা বলে: এ খারাপ আত্মাটি কার? তখন পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ নামে ডাকা নাম ধরে তারা বলবে: এটি অমুকের ছেলে অমুক, যতক্ষণ না পৃথিবীর আকাশ পর্যন্ত যাবে। সেখানে পৌঁছে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য বলা হবে কিন্তু খোলা হবে না।
﴿لَا تُفَتَّحُ لَهُمۡ أَبۡوَٰبُ ٱلسَّمَآءِ وَلَا يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ ٱلۡجَمَلُ فِي سَمِّ ٱلۡخِيَاطِۚ﴾ [الاعراف: ٤٠]
“তাদের জন্য আকাশের দরজা খোলা হবে না এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সূচের নাভী দিয়ে উট প্রবেশ করবে।” [সূরা আল-‘আরাফ, আয়াত: ৪০]
তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: তার জায়গা নিম্ন ভূমিতে উপস্থিত সিজ্জিনে লিখে দাও। কেননা আমি তাদেরকে অঙ্গিকার দিয়েছি যে, তাদেরকে যেখান থেকে সৃষ্টি করেছি সেখানে ফিরিয়ে নিব, পুনরায় সেখান থেকে বের করব। তারপর আকাশ থেকে তার রূহকে ছুড়ে মারা হলে তার শরীরে এসে প্রবেশ করবে। অতঃপর তিনি পড়লেন,
﴿وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ ٱلسَّمَآءِ فَتَخۡطَفُهُ ٱلطَّيۡرُ أَوۡ تَهۡوِي بِهِ ٱلرِّيحُ فِي مَكَانٖ سَحِيقٖ ٣١﴾ [الحج: ٣١]
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশিদার করবে সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর মৃতভোজি পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোনো দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।” [সূরা আল-হজ, আয়াত: ৩১]
তারপর শরীরে তার রূহ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেন: তখন সে তার নিকট থেকে ফিরে যাওয়া সাথীদের জুতার আওয়াজ শুনতে পাবে। অতঃপর তার নিকট গম্ভীর দু’জন ফিরিশতা এসে ধমকাবে এবং তাকে বসিয়ে বলবে:
তোমার রব কে?
সে বলবে: হায়! হায়! আমি জানি না।
তারা বলবে: তোমার দীন কী?
সে বলবে হায়! হায়! আমি জানি না।
তারা বলবে: সেই লোকটি কে? যাকে তোমাদের নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল? তখন সে তাঁর নাম স্মরণ করতে পারবে না,
বলা হবে (তাঁর নাম কি) মুহাম্মদ?
সে বলবে: হায়! হায়! আমি জানি না কিন্তু লোকজনকে এ নাম বলতে শুনেছি।
তিনি বলেন: তাকে বলা হবে তুমি জান নি এবং যারা জেনেছে তাদের অনুসরণও কর নি। তখন আকাশ থেকে একজন আহ্বানকারী আহ্বান করে বলবেন: সে মিথ্যা বলেছে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও এবং জাহান্নামের একটি দরজা খুলে দাও; যেন সেখান থেকে উত্তাপ ও প্রখর বাষ্প আসতে থাকে এবং তার কবরকে এমন সংকীর্ণ করে দেওয়া হবে যে, তার বুকের হাড়গুলো একদিক থেকে অন্য দিকে চলে যাবে। তারপর বিশ্রী মুখ বিশিষ্ট জীর্ণ কাপড় পরিহিত দুর্গন্ধযুক্ত এক ব্যক্তি তার নিকট আসবে- অন্য বর্ণনায় তার বেশ ধরে বলবে: তুমি এমন একটি সুসংবাদ গ্রহণ কর, যা তোমার অনিষ্ট করবে। আজ সেই দিন যে দিনের অঙ্গিকার তোমাকে দেওয়া হয়েছিল।
সে বলবে: তুমি কে? তোমাকে আল্লাহ এমন দুঃসংবাদ দিয়ে পাঠিয়েছেন? তোমার চেহারাতো সেই চেহারা যা অনিষ্ট বয়ে আনে।
সে বলবে: আমি তোমার মন্দ আমল। আল্লাহর কসম! তুমি তাঁর আনুগত্যের প্রতি ছিলে অত্যন্ত নিশ্চল এবং তাঁর নাফরমানির প্রতি ছিলে চতুর। সুতরাং আল্লাহ তোমার মন্দের যথাযথ প্রতিদান দিয়েছেন।
অতঃপর তার জন্য একজন অন্ধ, বধির এবং কুৎসিত ফিরিশতা নিযুক্ত করা হবে, যার হাতে থাকবে একটি হাতুড়ী। যদি এর দ্বারা কোনো পাহাড়ে আঘাত করা হয় তবে পাহাড় ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে। তা দ্বারা তাকে আঘাত করে ধুলিস্যাৎ করে দেবে। আবার আল্লাহ তাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিবেন, আবার তাকে মারলে এমন জোরে চিৎকার করবে যে, জিন্ন ও মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সকল সৃষ্টিজীব তা শুনতে পাবে। অতঃপর তার জন্য জাহান্নামের একটি দরজা খুলে দিয়ে জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দেওয়া হবে। তখন সে বলবে: হে আল্লাহ! তুমি কিয়ামত সংঘটিত কর।[1]
প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ, এটিই ছিল আকাশ ও জমিনে আত্মার সবচেয়ে বড় বিচরণ বা ভ্রমণ। হায়! আমি যদি জানতাম! কোনো বিমানে আমাদের আত্মার ভ্রমণ হবে, কোনো ফিরিশতা আমাদের রূহকে অভ্যর্থনা জানাবে এবং কোনো নামে আমাদেরকে ডাকা হবে!। কবরে সবচেয়ে বড় ফিতনায় কী হবে আমাদের অবস্থা, বারযাখের কোনো ঘরে আমরা অতিসত্বর পদার্পন করব এবং সেখানে কি আমরা শাস্তিপ্রাপ্ত হব নাকি শান্তিপ্রাপ্ত হব? নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, প্রতিটি মুসলিম আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করার আশা আকাঙ্খা রাখে; কিন্তু মানুষ যদি নিজের হিসেব নিজেই করে, তবে তার বর্তমান অবস্থার একটি চিত্র ফুটে উঠবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿بَلِ ٱلۡإِنسَٰنُ عَلَىٰ نَفۡسِهِۦ بَصِيرَةٞ ١٤ وَلَوۡ أَلۡقَىٰ مَعَاذِيرَهُۥ ١٥﴾ [القيامة: ١٤، ١٥]
“বরং মানুষ নিজেই তার সম্পর্কে চক্ষুষ্মান যদিও সে তার অজুহাত পেশ করতে চাইবে।” [সূরা আল-কিয়ামাহ, আয়াত: ১৪-১৫]
হালাল হারাম পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা ততক্ষণ পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেন না; যতক্ষণ না তার ওপর অকাট্য প্রমাণ পেশ করে তাকে ঠিকমত বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও আল্লাহর হুকুম পরিষ্কার। তিনি বলেন,
﴿أَفَمَن كَانَ مُؤۡمِنٗا كَمَن كَانَ فَاسِقٗاۚ لَّا يَسۡتَوُۥنَ ١٨﴾ [السجدة: ١٨]
“মুমিন ও ফাসিক কখনো সমকক্ষ হতে পারে না।” [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ১৮]
এখন আপনি নিজের দিকে ফিরে দেখুন এবং আমলসমূহ মেপে দেখুন, যদি অনুগ্রহ ও আনুগত্যের প্রতি অগ্রসর এবং ধ্বংসের দিকে শীথিলতা পান; তবে আল্লাহর সমত্তষ্টি ও নাজাতের আশা করে ভালো ভালো কাজ করে যান। পক্ষান্তরে যদি বিভিন্ন প্রকার খারাপ কাজে নিজেকে লিপ্ত পান এবং ভালো কাজে কমতি ও ওয়াজিব পালনে ব্যর্থতা পান; তাহলে আপনি বিপদের সম্মুখীন, সুতরাং তাওবা করে অতি শীঘ্রই আল্লাহর দিকে ফিরে যান এবং ওযর পেশ করে তাঁর দিকে অগ্রসর হোন। যদি তা পালনে সক্ষম হন তবে আল্লাহর অঙ্গিকারের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। তিনি বলেন:
﴿فَأُوْلَٰٓئِكَ يُبَدِّلُ ٱللَّهُ سَئَِّاتِهِمۡ حَسَنَٰتٖۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا﴾ [الفرقان: ٦٩]
“আল্লাহ তাদের পাপকে পুণ্যের দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম করুণাময়।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৬৯]আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা এই, তিনি যেন আমাদেরকে ভালো কাজ করার এবং মন্দ কাজ পরিত্যাগ করার তাওফীক দান করেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে যেন আমাদের সম্মান দান করেন।