আমি পূর্বের অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি যে, ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’-কে স্পর্শ করা সুন্নাত। আর তা হবে শুধু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করার জন্য; কেননা এ দু’টি এমন রুকন, যা ইবরাহীম আ. এর ভিত্তির ওপর বহাল রয়েছে।
আর বাকি দু’টি রুকন: ‘রুকনে শামী’ ও ‘রুকনে ইরাকী’ এবং কা‘বার প্রাচীরের ব্যাপারে কোনো দলীল বর্ণিত হয় নি, আর এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, “কা‘বার দেওয়ালকে চুম্বন করাটা বিদ‘আতের মধ্যে শামিল হবে।”[1] আর যে মুসলিম ব্যক্তি সঠিক দৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে আল্লাহর ইবাদত করতে চায়, তার ওপর কর্তব্য হলো- সে কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্য ও দলীলের নিকট অবস্থান করবে এবং তার সীমা অতিক্রম করবে না।
তাছাড়া আরও এমন কিছু দলীল ও আছার বর্ণিত হয়েছে, যেগুলো তাগিদ দেয় যে, মুসলিম ব্যক্তির জন্য শরী‘য়তের বিধান হলো— স্পর্শ করার কাজটি ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা; আর বাকি দু’টি রুকন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। আর এসব দলীল ও আছার থেকে কিছু যেমন,
আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন,
« لَمْ أَرَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَمْسَحُ مِنْ الْبَيْتِ إِلَّا الرُّكْنَيْنِ الْيَمَانِيَيْنِ»
“আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কা‘বা ঘরের কেবল ইয়ামানী দুই রুকনকে (‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’-কে) স্পর্শ ও চুম্বন করতে দেখেছি।”[2]
তিনি আরও বলেন,
«مَا أُرَى رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم تَرَكَ اسْتِلاَمَ الرُّكْنَيْنِ اللَّذَيْنِ يَلِيَانِ الْحِجْرَ، إِلاَّ أَنَّ الْبَيْتَ لَمْ يُتَمَّمْ عَلَى قَوَاعِدِ إِبْرَاهِيمَ، [ وَلاَ طَافَ النَّاسُ وَرَاءَ الْحِجْرِ إِلاَّ لِذَلِكَ]».
“আমার মনে হয় যে, বায়তুল্লাহ হাতীমের দিক দিয়ে সম্পূর্ণভাবে ইবরাহিমী ভিত্তির ওপর নির্মিত না হওয়ার কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তাওয়াফের সময়) হাতীম সংলগ্ন দু’টি কোণ স্পর্শ করতেন না। (আর এ জন্যেই জনগণ হাতীমের বাইরে দিয়ে তাওয়াফ করেন)।”[3]
সুতরাং প্রথম ‘নস’ বা বক্তব্যটি প্রমাণ করে যে, স্পর্শ করার কাজটি কা‘বার শুধু দু’টি রুকনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, আর এটাই অধিকাংশ সাহাবী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের উপলব্ধি।[4]
আর দ্বিতীয় ‘নস’ বা বক্তব্যটি প্রমাণ করে যে, ‘রুকনে শামী’ ও ‘রুকনে ইরাকী’ ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালামের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, ফলে এ দু’টি প্রকৃতপক্ষে রুকনই নয়।
ইবনু কুদামা রহ. বলেন, (হাতীম সংলগ্ন রুকন বা কোণ দু’টি স্পর্শ করা অধিকাংশ আলিমের মতে সুন্নাত নয়)।[5]
আর ইমাম নববী রহ. বলেন, [(রুকন দু’টি) ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’ ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং ‘আশ-শামিয়্যান’ (الشاميان) তথা ‘রুকনে শামী’ ও ‘রুকনে ইরাকী’ তাঁর ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং উভয়টি পরিবর্তিত। কেননা হাতীম এ রুকন দু’টির সংলগ্ন এবং যার সবটুকু অথবা অংশবিশেষ বায়তুল্লার অন্তর্ভুক্ত।
‘হাজরে আসওয়াদ’ নামের রুকনটির দু’টি ফযীলত: একটি হলো তাতে ‘হাজরে আসওয়াদ’ রয়েছে; আর অপরটি হলো তা ইবরাহীম ‘আলাইহিস্ সালামের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আর ‘রুকনে ইয়ামানী’-এর রয়েছে একটি ফযীলত, আর তা হলো: এটা ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, আর ‘আশ-শামিয়্যান’ (الشاميان) তথা ‘রুকনে শামী’ ও ‘রুকনে ইরাকী’-এর জন্য দু’টি ফযীলতের কোনো কিছুই নেই।
সুতরাং যখন আপনি এটা জানতে পারলেন, তখন ‘হাজরে আসওয়াদ’-এর বেলায় সুন্নাত হলো তাকে স্পর্শ করা এবং চুম্বন করা; আর ‘রুকনে ইয়ামানী’-এর ক্ষেত্রে সুন্নাত হলো তাকে স্পর্শ করা এবং চুম্বন না করা। আর সুন্নাত হলো ‘আশ-শামিয়্যান’ (الشاميان) তথা ‘রুকনে শামী’ ও ‘রুকনে ইরাকী’-কে চুম্বন ও স্পর্শ না করা; সুতরাং ‘হাজরে আসওয়াদ’ বিশেষিত হয়েছে স্পর্শ করার সাথে সাথে চুম্বন করার দ্বারা। কারণ, তাতে দু’টি ফযীলত রয়েছে, আর ‘রুকনে ইয়ামানী’ বিশেষিত হয়েছে শুধু স্পর্শ করার দ্বারা; কারণ, তাতে শুধু একটি ফযীলত রয়েছে। আর (الشاميان) তথা ‘রুকনে শামী’ ও ‘রুকনে ইরাকী’-তে দু’টি ফযীলতের কোনোটিই নেই]।[6] আর তার উপর ভিত্তি করে ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও ‘রুকনে ইয়ামানী’ ছাড়া অন্য কিছুকে স্পর্শ করাটা শরী‘য়তের বিধিভুক্ত নয়; আর যে ব্যক্তি বরকতের প্রার্থী হয়ে তা করবে, তাহলে সে হারামের দ্বারা বরকত হাসিলের আওতাভুক্ত হবে; আর তা হবে শির্কের উপায়-উপকরণসমূহের অন্যতম একটি।
>--------
[1] ফাতাওয়া ইবন ইবরাহীম: (১/১০২-১০৩)। আরও দেখুন: মাজমূ‘উ আল-ফাতাওয়া: (২৬/৯৭); মানসাকু শাইখুল ইসলাম , সাবেক ফাতওয়া সমগ্র এর আওতায় মুদ্রিত: (২৬/১২১); আস-সুনান ওয়াল মুবতাদা‘আত আল-মুতা‘আল্লাকা বিল আযকার ওয়াস সালাওয়াত: (পৃ. ১৫২)।
[2] সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৫৩১; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১২৬৭; ইবন মাজাহ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৯৪৬; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ১৮৭৪; নাসাঈ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৯৪৯।
[3] সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৫০৬; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৩৩৩; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ১৮৭৫। প্রায় সহীহ বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনার মতো এবং তার চেয়ে আরও কিছু বেশি।
[4] খুব শীঘ্রই ইমাম নববী রহ. এর বক্তব্য আসছে, যেখানে তিনি বলেছেন: এটাই অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমের অভিমত।
[5] আল-মুগনী: (৫/২২৭)।
[6] আল-মাজমূ‘উ শরহু ‘আল-মুহায্যাব’: (৮/৪৭); আরও দেখুন: শরহুল ‘উমদা: (১/৪৩০)।