১- সালাতের শাব্দিক ও শর‘ঈ পরিচিতি:

সালাতের শাব্দিক অর্থ দো‘আ। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَصَلِّ عَلَيۡهِمۡۖ إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٞ لَّهُمۡۗ٠٣﴾ [التوبة: ١٠٣]

“আর তাদের জন্য দো‘আ করুন, নিশ্চয় আপনার দো‘আ তাদের জন্য প্রশান্তিকর।”[1]

শর‘ঈ পরিভাষায় সালাত হলো, সুনির্দিষ্ট শর্তাবলীতে নির্দিষ্ট কিছু কথা ও কাজ, যা তাকবীরে তাহরীমা দ্বারা শুরু হয় এবং সালাম ফিরানোর দ্বারা শেষ হয়।

২- সালাত কখন ফরয হয়?

হিজরতের পূর্বে ইসরা তথা মি‘রাজের রাতে সালাত ফরয হয়। ইসলামে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাক্ষ্য প্রদানের পরের রুকন হলো সালাত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওহীদের পরে সালাতের শর্ত দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«رَأْسُ الأَمْرِ الإِسْلَامُ، وَعَمُودُهُ الصَّلَاةُ، وَذِرْوَةُ سَنَامِهِ الجِهَادُ في سبيل اللّه »

“সব কিছুর মাথা হলো ইসলাম, বুনিয়াদ হলো সালাত আর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হলো আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ”।[2]

৩- শরী‘আতে সালাত বিধিবদ্ধ হওয়ার হিকমত:

আল্লাহ তাঁর বান্দাহর ওপর অসংখ্য যেসব নি‘আমত দান করেছেন সালাত হলো সেসব নি‘আমতের শুকরিয়া। এছাড়া সালাত আল্লাহর দাসত্বের উৎকৃষ্ট নমুনা। যেহেতু সালাতে বান্দা আল্লাহর প্রতি মনোযোগ দেয়, নতশির হয়, একনিষ্ঠ হয়ে তারই কাছে তিলাওয়াত, যিকর ও দো‘আর মাধ্যমে মুনাজাত করে। এমনিভাবে এতে রয়েছে এমন সম্পর্ক যা বান্দা ও তার রবের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে এবং পার্থিব জগতের উর্ধ্বে উঠে পরিচ্ছন্ন অন্তর ও প্রশান্তির জগতে নিয়ে যায়। মানুষ যখনই পার্থিব জীবনের মোহে ডুবে যায় তখন সালাত সেসব মায়া মুক্ত করে এবং তাকে বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায় যার সম্পর্কে সে উদাসীন। সালাত তাকে স্মরণ করে দেয় যে, সে বাস্তবতা অনেক বড়। এ জীবন এত দৃঢ়ভাবে সৃষ্টি ও মানুষের জন্য সব কিছু অধিন্যস্ত করে দেওয়া শুধু জীবন যাপনের জন্য নয়; বরং এ জীবন থেকে অন্য জীবনের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি।

৪- সালাতের হুকুম ও এর সংখ্যা:

সালাত দু’ধরণের: ফরয ও নফল সালাত। ফরয সালাত আবার দু’প্রকার: ফরযে আইন ও ফরযে কিফায়া। ফরযে আইন সালাত প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়ষ্ক মুসলিম নর-নারীর পর ফরয। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরযে আইন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ كَانَتۡ عَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ كِتَٰبٗا مَّوۡقُوتٗا ١٠٣﴾ [النساء : ١٠٣]

“নিশ্চয় সালাত মুমিনদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০৩]

﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ٥﴾ [البينة: ٥]

“আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয়; আর এটিই হলো সঠিক দীন।” [সূরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত: ৫]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ».

“ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপর। আল্লাহ ব্যতীত কোনো (সত্য) ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, এ কথার সাক্ষ্য দান, সালাত কায়েম করা, যাকাত দেওয়া”।[3]

নাফে‘ ইবন আযরাক ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত কুরআনে পেয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, পেয়েছি। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করলেন,

﴿فَسُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ حِينَ تُمۡسُونَ وَحِينَ تُصۡبِحُونَ ١٧ وَلَهُ ٱلۡحَمۡدُ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَعَشِيّٗا وَحِينَ تُظۡهِرُونَ ١٨﴾ [الروم: ١٧، ١٨]

“অতএব, তোমরা আল্লাহর তাসবীহ কর, যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে এবং সকালে উঠবে। আর অপরাহ্নে ও জোহরের সময়ে। আর আসমান ও যমীনে সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁরই। [সূরা আর-রূম, আয়াত: ১৭-১৮]

«جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ أَهْلِ نَجْدٍ ثَائِرَ الرَّأْسِ، يُسْمَعُ دَوِيُّ صَوْتِهِ وَلاَ يُفْقَهُ مَا يَقُولُ، حَتَّى دَنَا، فَإِذَا هُوَ يَسْأَلُ عَنِ الإِسْلاَمِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «خَمْسُ صَلَوَاتٍ فِي اليَوْمِ وَاللَّيْلَةِ» . فَقَالَ: هَلْ عَلَيَّ غَيْرُهَا؟ قَالَ: «لاَ، إِلَّا أَنْ تَطَوَّعَ»

“নজদবাসী এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলো। তার মাথার চুল ছিল এলোমেলো। আমরা তার কথার মৃদু আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু সে কী বলছিল, আমরা তা বুঝতে পারছিলাম না। এভাবে সে কাছে এসে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। সে বলল, আমার ওপর এ ছাড়া আরও সালাত আছে?’ তিনি বললেন, না; তবে নফল আদায় করতে পার।”[4]

৫- বাচ্চাদের সালাতের নির্দেশ:

বাচ্চাদের সাত বছর বয়স হলে সালাতের আদেশ দিতে হবে। দশ বছর হলে সালাত আদায় না করলে মৃদু প্রহার করতে হবে। কেননা হাদীসে এসেছে,

«مُرُوا أَبْنَاءَكُمْ بِالصَّلَاةِ لِسَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا لِعَشْرِ سِنِينَ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ».

“তোমাদের সন্তানদের বয়স যখন সাত বছর হয়, তখন তাদেরকে সালাত পড়ার নির্দেশ দাও, যখন তাদের বয়স দশ বছর হবে তখন সালাত না পড়লে এ জন্য তাদের শাস্তি দাও এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও”।[5]

৬- সালাত অস্বীকারকারীর হুকুম:

কেউ জেনেশুনে সালাত ফরয হওয়া অস্বীকার করলে সে কাফির, যদিও সে সালাত আদায় করে। কেননা সে আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও উম্মতের ইজমায় মিথ্যারোপ করল। এমনিভাবে যে ব্যক্তি অবজ্ঞা, অলসতা ও অবহেলা করে সালাত ত্যাগ করে, যদিও সে সালাত ফরয হওয়া স্বীকার করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿فَٱقۡتُلُواْ ٱلۡمُشۡرِكِينَ حَيۡثُ وَجَدتُّمُوهُمۡ وَخُذُوهُمۡ وَٱحۡصُرُوهُمۡ وَٱقۡعُدُواْ لَهُمۡ كُلَّ مَرۡصَدٖۚ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ ٱلزَّكَوٰةَ فَخَلُّواْ سَبِيلَهُمۡۚ٥﴾ [التوبة: ٥]

“তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর এবং তাদেরকে পাকড়াও কর, তাদেরকে অবরোধ কর এবং তাদের জন্য প্রতিটি ঘাঁটিতে বসে থাক। তবে যদি তারা তাওবা করে এবং সালাত কায়েম করে, আর যাকাত দেয়, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৫]

জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ».

“বান্দা এবং শির্ক-কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত পরিত্যাগ করা”।[6]

৭- সালাতের রুকনসমূহ:

সালাতে চৌদ্দটি রুকন বা ফরয রয়েছে। এগুলো ইচ্ছাকৃত হোক বা ভুলে হোক বা অজ্ঞতাবশত হোক কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না। এগুলো নিম্নরূপ:

১- দাঁড়িয়ে সালাত আদায়ের সামর্থ থাকলে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা।

২- আল্লাহু আকবর বলে সালাতে প্রবেশ করা। এ তাকবীর ব্যতীত অন্য কিছু বললে সালাত হবে না।

৩- সূরা আল-ফাতিহা পাঠ করা।

৪- রুকু করা।

৫- রুকু থেকে সোজা হয়ে উঠা।

৬- সাজদাহ করা।

৭- সাজদাহ থেকে উঠে বসা।

৮- দু’সাজদাহর মাঝে বসা।

৯- ধীর স্থিরভাবে কাজ করা।

১০- শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়া।

১১- শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের জন্য বসা।

১২- তাশাহহুদের পরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ ও সালাম পাঠ করা।

১৩- সালাম ফিরানো। আর তা হলো السلام عليكم ورحمة اللّه বলা। وبركاته শব্দ বৃদ্ধি না করা উত্তম। কেননা ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডান দিকে সালাম ফিরিয়ে বলেছেন,

السلام عليكم ورحمة اللّه

আবার বাম দিকেও সালাম ফিরিয়ে বলতেন,

السلام عليكم ورحمة اللّه

১৪- রুকনসমূহের মাঝে তারতীব তথা ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।

সালাতের ওয়াজিবসমূহ:

সালাতে আটটি ওয়াজিব রয়েছে। ইচ্ছাকৃত ছেড়ে দিলে সালাত বাতিল হয়ে যাবে, তবে ভুল ও অজ্ঞতাবশতঃ ছুটে গেলে এ ওয়াজিব রহিত হয়ে যাবে। এগুলো হলো,

১- তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া প্রত্যেক উঠা, নামা, বসা, ও দাঁড়ানোর সময় তাকবীর বলা।

২- ইমাম ও একাকী সালাত আদায়কারী রুকু থেকে উঠার সময় «سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ» ‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ’ বলা।

৩- রুকু থেকে উঠে দাঁড়িয়ে «رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدَُ» ‘রাব্বানা ওয়ালাকাল হামদ’ পড়া।

৪- রুকুতে কমপক্ষে একবার «سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيمِ» ‘সুবহানা রাব্বিয়াল ‘আযীম’ বলা।

৫- সাজদাহয় «سُبْحَانَ رَبِّيَ الْأَعْلَى» ‘সুবাহানা রাব্বিয়াল ‘আ‘লা’ কমপক্ষে একবার পড়া।

৬- দু’সাজদাহর মাঝে দো‘আ পড়া

«رَبِّ اغْفِرْ لِي، رَبِّ اغْفِرْ لِي»

‘‘রাব্বিগ ফিরলী, রাব্বিগ ফিরলী’’ (হে আমার রব! আমায় ক্ষমা করুন, হে আমার রব! আমায় ক্ষমা করুন)।[7]

৭- প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদ পড়া।

৮- প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ার জন্য বসা।

৯- সালাতের শর্তাবলী:

শর্তের শাব্দিক অর্থ নিদর্শন।

পরিভাষায়: শর্তকৃত বিষয়টি উক্ত শর্ত ছাড়া পাওয়া যাবে না, তবে শর্তটি পাওয়া গেলেই মাশরূত তথা শর্তকৃত জিনিসটি পাওয়া যাওয়া অত্যাবশ্যকীয় নয়।

সালাতের শর্তাবলী হলো: নিয়ত, ইসলাম, আকল বা জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, ভালো-মন্দ পার্থক্য করার মতো বয়স হওয়া, সালাতের ওয়াক্ত হওয়া, পবিত্র হওয়া, কিবলামুখী হওয়া, সতর ঢাকা ও নাজাসাত থেকে মুক্ত হওয়া।

১০- পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা:

ওয়াক্ত শব্দটি التوقيت তাওকীত থেকে নেওয়া হয়েছে, এর অর্থ নির্ধারিত। ওয়াক্ত হলো সালাত ফরয হওয়ার কারণ ও সালাত শুদ্ধ হওয়ার অন্যতম শর্ত।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাধিক হাদীসে সালাতের ওয়াক্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«أَمَّنِي جِبْرِيلُ عِنْدَ البَيْتِ مَرَّتَيْنِ».

“জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম কা‘বার চত্বরে দু’বার আমার সালাতের ইমামতি করেছেন।”[8] অতঃপর তিনি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা উল্লেখ করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«ثُمَّ التَفَتَ إِلَيَّ جِبْرِيلُ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ، هَذَا وَقْتُ الأَنْبِيَاءِ مِنْ قَبْلِكَ، وَالوَقْتُ فِيمَا بَيْنَ هَذَيْنِ الوَقْتَيْنِ».

“অতঃপর জিবরীল (‘আলাইহিস সালাম) আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হে মুহাম্মাদ! এটাই হলো আপনার পূর্ববর্তী নবীদের (সালাতের) ওয়াক্ত। সালাতের ওয়াক্ত এ দুই সীমার মাঝখানে।”[9]

পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা দিন রাতে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কেননা মানুষ যখন রাতে ঘুমাবে তার বিশ্রাম শেষ হবে, প্রভাত ঘনিয়ে আসবে, পরিশ্রম ও কাজের সময় হবে তখন ফজরের সালাতের ওয়াক্ত হয়, তখন মানুষ অন্যান্য মাখলুক থেকে নিজেকে আলাদা হিসেবে ভাবতে থাকে, সালাতের মাধ্যমে সে দিনকে স্বাগত জানায় এবং এতে তার ঈমান বৃদ্ধি পায়।

আবার দিনের মধ্যভাগে যোহর সালাতে তার রবের সামনে দাড়িয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করে এবং তার দিনের কাজগুলো বিশুদ্ধ করে নেয়। অতঃপর আসে আসরের সময়। তখন দিনের বাকী অংশকে অভ্যর্থনা জানাতে আসরের সালাত আদায় করে। অতঃপর রাতকে অভ্যর্থনা জানাতে মাগরিবের সালাত ও ইশার সালাত, আর এ দু’টি তার মধ্যে বহন করে রহস্যের আধার, নূর ও হিদায়েতের পথের ভাণ্ডার। এছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সালাত আদায় আল্লাহর সৃষ্টি ও সম্রাজ্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা ও রাত দিনে মানুষের সমস্ত কাজ সঠিকভাবে পরিচালনা করার বিরাট সুযোগ।

যোহর সালাতের ওয়াক্ত:

সূর্য ঢলে পড়লে যোহর সালাতের ওয়াক্ত শুরু হয়। অর্থাৎ আকাশের মাঝামাঝি থেকে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লে যোহর সালাতের ওয়াক্ত আরম্ভ হয় এবং যোহর সালাতের ওয়াক্ত শেষ সময় হলো প্রতিটি জিনিসের ঢলে পড়া মূল ছায়া বাদে উক্ত জিনিসের ছায়া তার সমপরিমাণ হলে।[10]

আসর সালাতের ওয়াক্ত:

প্রতিটি জিনিসের ঢলে পড়া ছায়া বাদে উক্ত জিনিসের ছায়া তার সমপরিমাণ হলে আসরের ওয়াক্ত আরম্ভ হয়। অর্থাৎ যোহরের সময় শেষ হলে আসরের সময় শুরু হয়। আর নির্ভরযোগ্য মতে আসরের শেষ সময় হলো, ঢলে পড়ার পরে প্রতিটি জিনিসের ছায়া তার দ্বিগুণ পরিমাণ হলে। বিশেষ প্রয়োজনে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় বাকী থাকে।

মাগরিব সালাতের ওয়াক্ত:

সূর্যাস্তের সাথে সাথেই মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হয় এবং মাগরিবের শেষ ওয়াক্ত হলো আকাশে যখন তারকা স্পষ্ট হয়। আর মাকরূহসহ মাগরিবের শেষ সময় হলো, পশ্চিমাকাশে লালিমা যখন দূরীভূত হয়।

ইশা সালাতের ওয়াক্ত:

পশ্চিমাকাশে লালিমা দূরীভূত হলে ইশার ওয়াক্ত শুরু হয়। আর ইশার শেষ সময় হলো মধ্যরাত।

ফজর সালাতের ওয়াক্ত:

পূর্বাকাশে ফজরে সানী (সুবহে সাদিক তথা শুভ্র আভা) উদিত হলে ফজরের সালাতের সময় শুরু হয়। আর ফজরের শেষ সময় হলো সূর্যোদয়।

১১- উচ্চ অক্ষরেখার দেশসমূহে সালাতের সময় নির্ধারণ:

উচ্চ অক্ষরেখার দেশসমূহকে তিনভাগে ভাগ করা যায়:

১- যেসব দেশ ৪৫ ও ৪৮ ডিগ্রী উত্তর-দক্ষিণ অক্ষাংশ রেখায় অবস্থিত সেসব দেশে রাত-দিন যতই দীর্ঘ বা ছোট হোক দিন-রাতের সময়ের বিভাজনকারী ভৌগলিক রেখা স্পষ্ট বুঝা যায়।

২- আর যেসব দেশ ৪৮ ও ৬৬ ডিগ্রী উত্তর-দক্ষিণ অক্ষাংশ রেখায় অবস্থিত সেসব দেশে বছরের কিছুদিন দিন-রাতের সময়ের বিভাজনকারী ভৌগলিক রেখা বুঝা যায় না। যেমন লালিমা দূরীভূত হতে না হতেই ফজরের সময় এসে যায়।

৩- অন্যদিকে যেসব দেশ ৬৬ ডিগ্রীরও বেশি উত্তর-দক্ষিণ অক্ষাংশ রেখায় অবস্থিত সেসব দেশে বছরের দীর্ঘ সময় ধরে দিন-রাতের সময়ের বিভাজনকারী ভৌগলিক রেখা স্পষ্ট বুঝা যায় না।

প্রত্যেক প্রকারের হুকুম:

প্রথম প্রকারের অঞ্চলের লোকেরা পূর্বোল্লিখিত সময় অনুযায়ী সালাত আদায় করবে।

আর তৃতীয় প্রকারের অঞ্চলের বাসীন্দারা সালাতের সময় নির্ধারণ করে নিবে। এতে কোনো মতানৈক্য নেই। দাজ্জাল সম্পর্কিত হাদীস থেকে এ ধরণের স্থানে সালাতের সময় নির্ধারণ করে নিতে বলা হয়েছে। এ হাদীসে এসেছে,

«قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ وَمَا لَبْثُهُ فِي الْأَرْضِ؟ قَالَ: «أَرْبَعُونَ يَوْمًا، يَوْمٌ كَسَنَةٍ، وَيَوْمٌ كَشَهْرٍ، وَيَوْمٌ كَجُمُعَةٍ، وَسَائِرُ أَيَّامِهِ كَأَيَّامِكُمْ» قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ فَذَلِكَ الْيَوْمُ الَّذِي كَسَنَةٍ، أَتَكْفِينَا فِيهِ صَلَاةُ يَوْمٍ؟ قَالَ: «لَا، اقْدُرُوا لَهُ قَدْرَهُ».

“সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, দাজ্জাল পৃথিবীতে কত দিন অবস্থান করবে? তিনি বললেন, চল্লিশ দিন। প্রথম দিনটি হবে এক বছরের সমান। দ্বিতীয় দিনটি হবে এক মাসের সমান। তৃতীয় দিনটি হবে এক সপ্তাহের সমান। আর বাকী দিনগুলো হবে তোমাদের এদিনগুলোর মতো। তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যে দিনটি এক বছরের সমান হবে তাতে একদিনের সালাত পড়া কি আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে? তিনি বললেন, না। এদিনটিকে সাধারণ দিনের সমান অনুমান করে নিও।”[11]

সেসব স্থানের সময় কীভাবে নির্ধারিত করতে হবে সে ব্যাপারে আলেমগণ কয়েকটি মত ব্যক্ত করেছেন। কতিপয় আলেমের অভিমত হলো: ঐ স্থানে নিকটতম দেশে যেখানে দিন-রাত পার্থক্য করা যায় এবং শরী‘আত নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সালাতের সময় নির্ধারণ করা যায় সে স্থানের সময় অনুযায়ী সালাতের সময় নির্ধারণ করতে হবে। এ উক্তিটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য।

আবার কেউ কেউ বলেছেন, স্বাভাবিক সময় হিসেবে সালাতের সময় নির্ধারণ করতে হবে। বার ঘন্টা দিন ধরতে হবে। তেমনিভাবে বার ঘন্টা রাত ধরতে হবে। কেউ কেউ আবার মক্কা বা মদীনার সময় অনুযায়ী সালাতের সময় নির্ধারণ করার পক্ষে মত দিয়েছেন। দ্বিতীয় প্রকারের অঞ্চলে ইশা ও ফজরের সময় ব্যতীত অন্যান্য ওয়াক্তের সময় প্রথম প্রকারের সময় অনুযায়ী হবে। আর ফজর ও ইশা তৃতীয় প্রকার অঞ্চলের মতো নির্ধারণ করে নিতে হবে।

>
[1] সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১০৩।

[2] তিরমিযী, ঈমান, হাদীস নং ২৬১৬। ইমাম তিরমিযী রহ. হাদীসটিকে হাসান সহীহ। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইবন মাজাহ, আল-ফিতান, হাদীস নং ৩৯৭৩; মুসনাদ আহমদ, ৫/২৩১।

[3] সহীহ বুখারী, ঈমান, হাদীস নং ৮; সহীহ মুসলিম, ঈমান, হাদীস নং ১৬; তিরমিযী, ঈমান, হাদীস নং ২৬০৯; নাসাঈ, ঈমান ও এর শারায়ে‘, হাদীস নং ৫০০১; আহমদ, ২/৯৩।

[4] সহীহ বুখারী, সাওম, হাদীস নং ১৭৯২; সহীহ মুসলিম, ঈমান, হাদীস নং ১১; নাসাঈ, সিয়াম, হাদীস নং ২০৩০; আবু দাউদ, সালাত, হাদীস নং ৩৯১; আহমদ, ১/১৬২; মালিক, আন-নিদা লিসসালাত, হাদীস নং ৪২৫; দারেমী, সালাত, হাদীস নং ১৫৭৮।

[5] আবু দাউদ, সালাত, হাদীস নং ৪৯৪; আহমদ, ২/১৮৭। আলবানী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।

[6] সহীহ মুসলিম, ঈমান, হাদীস নং ৮২; তিরমিযী, ঈমান, হাদীস নং ২৬২০; আবু দাউদ, ইস-সুন্নাহ, হাদীস নং ৪৬৭৮; ইবন মাজাহ, ইকামতুস সালাহ ওয়াসসুন্নাতু ফিহা, হাদীস নং ১০৭৮; আহমদ, ৩/৩৭০; দারেমী, সালাত, হাদীস নং ১২৩৩।

[7] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৮৯৭। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[8] তিরমিযী, সালাত, হাদীস নং ১৪৯; আবু দাউদ, সালাত, হাদীস নং ৩৯৩; আহমদ, ১/৩৩৩।

[9] তিরমিযী, সালাত, হাদীস নং ১৪৯; আবু দাউদ, সালাত, হাদীস নং ৩৯৩; আহমদ, ১/৩৩৩।

[10] এটা চিনার উপায় হলো, সূর্য যখন ঢলে পড়ে তখন তার ছায়ার অতিরিক্ত অংশের দিকে তাকাবে, ছায়া যখন ব্যক্তির সমপরিমাণ হবে তখন যোহর সালাতের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাবে।

[11] সহীহ মুসলিম, ফিতান ওয়াআশরাতস সা‘আ, হাদীস নং ২৯৩৭; তিরমিযী, ফিতান, হাদীস নং ২২৪০; আবু দাউদ, আল-মালাহিম, হাদীস নং ৪৩২১; ইবন মাজাহ, ফিতান, হাদীস নং ৪০৭৬; আহমদ, ৪/১৮২।