উক্ত রোগ তথা সমকামের নেশা থেকে বাঁচার উপায় অবশ্যই রয়েছে। তবে তা এ জাতীয় রোগীর পক্ষ থেকে সাদরে গ্রহণ করার অপেক্ষায় রয়েছে। আর তা হচ্ছে দু’ প্রকার:

১. রোগাক্রান্ত হওয়ার আগের চিকিৎসা:

তা আবার দু’ ধরনের:

ক. দৃষ্টিশক্তি হিফাযতের মাধ্যমে: কারণ, দৃষ্টিই হচ্ছে শয়তানের বিষাক্ত একটি তীর যা শুধু মানুষের আফসোসই বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং শ্মশ্রুবিহীন ছেলেদের প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে একেবারেই বিরত থাকতে হবে। তা হলেই সমকামের প্রতি অন্তরে আর উৎসাহ জন্ম নিবে না। এ ছাড়াও দৃষ্টিশক্তি নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো ফায়দা রয়েছে যা নিম্নরূপঃ

১. তাতে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ মানা হয়। যা ইবাদতেরই একাংশ এবং ইবাদাতের মধ্যেই সমূহ মানব কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

২. বিষাক্ত তীরের প্রভাব থেকে অন্তর বিমুক্ত থাকে। কারণ, দৃষ্টিই হচ্ছে শয়তানের একটি বিষাক্ত তীর।

৩. মন সর্বদা আল্লাহ অভিমুখী থাকে।

৪. মন সর্বদা সন্তুষ্ট ও শক্তিশালী থাকে।

৫. অন্তরে এক ধরনের নূর তথা আলো জন্ম নেয় যার দরুন সে উত্তরোত্তর ভালোর দিকেই ধাবিত হয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُل لِّلۡمُؤۡمِنِينَ يَغُضُّواْ مِنۡ أَبۡصَٰرِهِمۡ وَيَحۡفَظُواْ فُرُوجَهُمۡۚ﴾ [النور: ٣٠]

“(হে রাসূল!) আপনি মুমিনদেরকে বলে দিন যে, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং নিজ লজ্জাস্থান হিফাযত করে।” [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩০]

এর কয়েক আয়াত পরই আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱللَّهُ نُورُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ مَثَلُ نُورِهِۦ كَمِشۡكَوٰةٖ فِيهَا مِصۡبَاحٌ﴾ [النور: ٣٥]

“আল্লাহ তা‘আলাই আকাশ ও পৃথিবীর জ্যোতি। (সত্যিকার ঈমানদারের অন্তরে) তাঁর জ্যোতির উপমা যেন একটি দীপাধার। যার মধ্যে রয়েছে একটি প্রদীপ।” [সুরা আন-নূর, আয়াত: ৩৫]

৬. এরই মাধ্যমে হক্ব ও বাতিল এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে বিশেষ প্রভেদজ্ঞান সৃষ্টি হয় যার দরুন দৃষ্টি সংযতকারীর যে কোনো ধারণা অধিকাংশই সঠিক প্রমাণিত হয়। ঠিক এরই বিপরীতে আল্লাহ তা‘আলা লূত সম্প্রদায়ের সমকামীদেরকে অন্তর্দৃষ্টিশূন্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَعَمۡرُكَ إِنَّهُمۡ لَفِي سَكۡرَتِهِمۡ يَعۡمَهُونَ ٧٢﴾ [الحجر: ٧٢]

“আপনার জীবনের কসম! ওরা তো মত্ততায় বিমূঢ় হয়েছে তথা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৭২]

৭. এরই মাধ্যমে অন্তরে দৃঢ়তা, সাহসিকতা ও শক্তি জন্ম নেয় এবং মানুষ তাকে সম্মান করে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلِلَّهِ ٱلۡعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِۦ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَلَٰكِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ لَا يَعۡلَمُونَ﴾ [المنافقون: ٨]

“সম্মান ও ক্ষমতা তো আল্লাহ তা‘আলা, তদীয় রাসূল ও (সত্যিকার) ঈমানদারদের জন্য; কিন্তু মুনাফিকরা তো তা জানে না।” [সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত: ৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿ مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡعِزَّةَ فَلِلَّهِ ٱلۡعِزَّةُ جَمِيعًاۚ إِلَيۡهِ يَصۡعَدُ ٱلۡكَلِمُ ٱلطَّيِّبُ وَٱلۡعَمَلُ ٱلصَّٰلِحُ يَرۡفَعُهُ﴾ [فاطر: ١٠]

“কেউ ইজ্জত ও সম্মান চাইলে সে যেন জেনে রাখে, সকল সম্মানই তো আল্লাহ তা‘আলার। (অতএব, তাঁর কাছেই তা কামনা করতে হবে। অন্যের কাছে নয়) তাঁরই দিকে পবিত্র বাণীসমূহ তথা যিকির ইত্যাদি আরোহণ করে এবং নেক আমল তিনিই উন্নীত করেন। [সূরা আল-ফাতির, আয়াত: ১০]

সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য, যিকির ও নেক আমলের মাধ্যমেই তাঁরই নিকট সম্মান কামনা করতে হবে।

৮. তাতে করে মানব অন্তরে শয়তান ঢুকার সুগম পথটি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, সে তো দৃষ্টি পথেই মানব অন্তরে প্রবেশ করে খালিস্থানে বাতাস প্রবেশের চাইতেও অতি দ্রুত গতিতে। অতঃপর সে দেখা বস্তুটির সুন্দর দৃশ্যটুকু দৃষ্টি ক্ষেপণকারীর মানসপটে স্থাপন করে। সে দৃষ্ট বস্তুটির মূর্তি এমনভাবে তৈরি করে যে, অন্তর তখন তাকে নিয়েই ব্যস্ত হতে বাধ্য হয়। এরপর সে অন্তরকে অনেক ধরনের আশা ও অঙ্গীকার দিতে থাকে। সে অন্তরে উত্তরোত্তর কুপ্রবৃত্তির তাড়না জাগিয়ে তোলে। এমনকি সে মনের মাঝে উত্তেজনার আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তাতে বহু প্রকারের গুনাহের জ্বালানি ব্যবহার করে আরো উত্তপ্ত করতে থাকে। অতঃপর হৃদয়টি সেই উত্তপ্ত আগুনে লাগাতার পুড়তে থাকে। সে অন্তর্দাহ থেকেই বিরহের উত্তপ্ত ঊর্ধ্ব শ্বাসের সৃষ্টি।

৯. এরই মাধ্যমে অন্তর সর্বদা মঙ্গলজনক কর্ম সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ পায়। অবৈধ দৃষ্টি ক্ষেপণে মানুষ সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। অন্তর গাফিল হয়ে যায়। প্রবৃত্তি পুঁজায় ধাবিত হয় এবং সকল ব্যাপারে এক ধরনের গোলযোগ সৃষ্টি হয়।

এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ জাতীয় লোকদের আনুগত্য করতে নিষেধ করেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا تُطِعۡ مَنۡ أَغۡفَلۡنَا قَلۡبَهُۥ عَن ذِكۡرِنَا وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ وَكَانَ أَمۡرُهُۥ فُرُطٗا﴾ [الكهف: ٢٨]

“যার অন্তরকে আমরা আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি এবং যে তার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে এমনকি যার কার্যকলাপ সীমাতিক্রম করেছে আপনি তার আনুগত্য করবেন না।” [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ২৮]

১০. অন্তর ও দৃষ্টির মাঝে এমন এক সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে যে, একটি খারাপ হলে অন্যটি খারাপ হতে বাধ্য। তেমনিভাবে একটি সুস্থ থাকলে অন্যটিও সুস্থ থাকতে বাধ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করবে তার অন্তরও তারই নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

খ. তা থেকে দূরে রাখে এমন বস্তু নিয়ে ব্যস্ততার মাধ্যমে: আর তা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে অধিক ভয় বা অধিক ভালোবাসা। অর্থাৎ অন্যকে ভালোবাসার কারণে আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা না পাওয়ার আশঙ্কা করা অথবা আল্লাহ তা‘আলাকে এমনভাবে ভালোবাসা যে, তিনি ভিন্ন অন্যকে আর ভালোবাসার সুযোগ না পাওয়া যার ভালোবাসা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসার অধীন নয়। কারণ, এ কথা একেবারেই সত্য যে, আল্লাহ তা‘আলা মানব অন্তরে জন্মগতভাবেই এমন এক শূন্যতা রেখে দিয়েছেন যা একমাত্র তাঁরই ভালোবাসা পরিপূর্ণ করতে পারে। সূতরাং কারোর অন্তর উক্ত ভালোবাসা থেকে খালি হলে তিনি ভিন্ন অন্যদের ভালোবাসা তার অন্তরে অবশ্যই জায়গা করে নিতে চাইবে। তবে কারোর মধ্যে নিমোক্ত দু’টি গুণ থাকলেই সে উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, যা নিম্নরূপ:

১. বিশুদ্ধ অন্তর্দৃষ্টি। যার মাধ্যমে সে প্রিয়-অপ্রিয়ের স্তরসমূহের মাঝে পার্থক্য করতে পারে। তখনই সে মূল্যবান বন্ধুকে পাওয়ার জন্য নিম্নমানের বন্ধুকে ছাড়তে পারবে এবং বড় বিপদ থেকে বাঁচার জন্য ছোট বিপদ মাথা পেতে মেনে নিতে পারবে।

২. ধৈর্য ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। যার ওপর নির্ভর করে সে উক্ত কর্মসমূহ আঞ্জাম দিতে পারবে। কারণ, এমন লোকও আছে যাদের মধ্যে প্রথমোক্ত গুণ রয়েছে। তবে সে তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না তার মধ্যে দ্বিতীয় গুণটি না থাকার দরুন।

সুতরাং কারোর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা এবং যার ভালোবাসা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসার অধীন নয় তার ভালোবাসা একত্র হতে পারে না। অন্য কথায়, যার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা নেই সেই একমাত্র মহিলাদের অথবা শ্মশ্রুবিহীন ছেলেদের ভালোবাসায় মত্ত থাকতে পারে।

দুনিয়ার কোনো মানুষ যখন তাঁর ভালোবাসায় কারোর অংশীদারি সহ্য করতে পারে না তখন আল্লাহ তা‘আলা কেন তাঁর ভালোবাসায় অন্যের অংশীদারি সহ্য করবেন? আর এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ভালোবাসায় শির্ক কখনোই ক্ষমা করবেন না।

ভালোবাসার আবার কয়েকটি স্তর রয়েছে, যা নিম্নরূপ:

১. সাধারণ সম্পর্ক জাতীয় ভালোবাসা যার দরুন এক জনের মন অন্য জনের সঙ্গে লেগে যায়। আরবী ভাষায় এ সম্পর্ককে “আলাক্বাহ” বলা হয়।

২. ভালোবাসায় মন উপচে পড়া। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে “স্বাবাবাহ” বলা হয়।

৩. এমন ভালোবাসা যা মন থেকে কখনো ভিন্ন হয় না। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে “গারাম” বলা হয়।

৪. নিয়ন্ত্রণহীন ভালোবাসা। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে “ইশক” বলা হয়। এ জাতীয় ভালোবাসা আল্লাহ তা‘আলার শানে প্রযোজ্য নয়।

৫. এমন ভালোবাসা যার দরুন প্রিয়ের সঙ্গে মিলনের আকাঙ্খা সৃষ্টি হয়। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে “শাওক” বলা হয়। এমন ভালোবাসা আল্লাহ তা‘আলার শানে অবশ্যই প্রযোজ্য।

উবাদাহ ইবন সামিত, ‘আয়েশা, আবু হুরায়রা ও আবু মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে বর্ণিত তাঁরা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ أَحَبَّ لِقَاءَ اللهِ أَحَبَّ اللهُ لِقَاءَهُ ، وَمَنْ كَرِهَ لِقَاءَ اللهِ كَرِهَ اللهُ لِقَاءَهُ»

“যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাৎ চায় আল্লাহ তা‘আলাও তার সাক্ষাৎ চাইবেন এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাৎ চায় না আল্লাহ তা‘আলাও তার সাক্ষাৎ চাইবেন না”।[1]

৬. এমন ভালোবাসা যার দরুন কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকার একান্ত গোলাম হয়ে যায়। এ জাতীয় ভালোবাসাই শির্কের মূল। কারণ, ইবাদতের মূল কথাই তো হচ্ছে, প্রিয়ের একান্ত আনুগত্য ও অধীনতা। আর এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলার নিকট মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সম্মানজনক গুণ হচ্ছে তাঁর “আব্দ” বা সত্যিকার গোলাম হওয়া তথা বিনয় ও ভালোবাসা নিয়েই আল্লাহ তা‘আলার অধীনতা স্বীকার করা। আর এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা জিন্ন ও মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং যা ইসলামের মূল কথাও বটে। আর এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোতে “আব্দ” শব্দে উল্লেখ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা দাওয়াতী ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে “আব্দ” শব্দে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,

﴿وَأَنَّهُۥ لَمَّا قَامَ عَبۡدُ ٱللَّهِ يَدۡعُوهُ كَادُواْ يَكُونُونَ عَلَيۡهِ لِبَدٗا ١٩﴾ [الجن: ١٩]

“আর যখন আল্লাহর বান্দা (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে (আল্লাহ তা‘আলাকে) ডাকার (তাঁর ইবাদত করার) জন্য দন্ডায়মান হলো তখন তারা (জিন্নরা) সবাই তাঁর নিকট ভিড় জমালো।” [সূরা আল-জিন্ন, আয়াত: ১৯]

আল্লাহ তা‘আলা নবুওয়াতের চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে “আব্দ” শব্দে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,

﴿وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن مِّثۡلِهِ﴾ [البقرة: ٢٣]

“আমরা আমাদের বান্দার (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তোমরা যদি তাতে সন্দিহান হও তবে সেরূপ একটি সূরা নিয়ে আসো।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩]

আল্লাহ তা‘আলা ইসরার ক্ষেত্রেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে “আব্দ” শব্দে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,

﴿سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِۦ لَيۡلٗا مِّنَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِ إِلَى ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡأَقۡصَا﴾ [الاسراء: ١]

“পবিত্র সে সত্তা যিনি নিজ বান্দাকে (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) রাত্রিবেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় (বাইতুল মাকদিসে)”। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত:১]

সুপারিশের হাদীসের মধ্যেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে “আব্দ” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিয়ামতের দিবসে ঈসা আলাইহিস সালামের নিকট সুপারিশ চাওয়া হলে তিনি বলবেন:

«اِئْتُوْا مُحَمَّدًا، عَبْدًا غَفَرَ اللهُ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ»

“তোমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যাও। তিনি আল্লাহ তা‘আলার এমন এক বান্দা যার পূর্বাপর সকল গুনাহ আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দিয়েছেন।”[2]

উক্ত হাদীসে সুপারিশের উপযুক্ততার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে ক্ষমা প্রাপ্ত আল্লাহ তা‘আলার খাঁটি বান্দা হওয়ার দরুন।

উক্ত নিরেট ভালোবাসা বান্দার নিকট আল্লাহ তা‘আলার একান্ত প্রাপ্য হওয়ার দরুন আল্লাহ তা‘আলা তিনি ভিন্ন অন্য কাউকে বন্ধু বা সুপারিশকারী হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَا لَكُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَلِيّٖ وَلَا شَفِيعٍ﴾ [السجدة: ٤]

“তোমাদের জন্য তিনি ভিন্ন অন্য কোনো বন্ধু এবং সুপারিশকারী নেই”। [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ৪]

তিনি আরো বলেন,

﴿لَيۡسَ لَهُم مِّن دُونِهِۦ وَلِيّٞ وَلَا شَفِيعٞ﴾ [الانعام: ٥١]

“ওদের (মুমিনদের) জন্য তিনি (আল্লাহ তা‘আলা) ভিন্ন না আছে কোনো বন্ধু আর না আছে কোনো সুপারিশকারী”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫১]

তেমনিভাবে পরকালে তিনি ভিন্ন অন্য কোনো বন্ধু কারোর কোনো কাজেও আসবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا يُغۡنِي عَنۡهُم مَّا كَسَبُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا مَا ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَوۡلِيَآءَۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٌ﴾ [الجاثية: ١٠]

“তাদের ধন-সম্পদ এবং আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোনো বন্ধু সে দিন তাদের কোনো কাজেই আসবে না। উপরন্তু তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি”। [সূরা আল-জাসিয়াহ, আয়াত: ১০]

মূলকথা, ভালোবাসায় আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে কাউকে শরীক করে সত্যিকার ইবাদত করা যায় না। তবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য কাউকে ভালোবাসা এর বিপরীত নয়। বরং তা আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসার পরিপূরকও বটে।

আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الْإِيْمَانَ»

“যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসলো, আল্লাহর জন্য কারোর সাথে শত্রুতা পোষণ করলো, আল্লাহর জন্য কাউকে দিলো এবং আল্লাহর জন্য কাউকে বঞ্চিত করলো সে যেন নিজ ঈমানকে পরিপূর্ণ করে নিলো”।[3]

এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসাকে অন্য সবার ভালোবাসার ওপর প্রধান্য না দিলে সে ব্যক্তি কখনো পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না।

অতএব, আল্লাহ তা‘আলার জন্য কাউকে ভালোবাসা যতই কঠিন হবে ততই আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা কঠিন হবে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে ভালোবাসা আবার চার প্রকার। যে গুলোর মাঝে ব্যবধান না জানার দরুনই অনেকে এ ক্ষেত্রে পথভ্রষ্ট হয়। আর তা নিম্নরূপ:

ক. আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসা, তবে তা নিরেট ভালোবাসা না হলে কখনো তা কারোর ফায়দায় আসবে না।

খ. আল্লাহ তা‘আলা যা ভালোবাসেন তাই ভালোবাসা। যে এ ভালোবাসায় যত অগ্রগামী সে আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসায় তত অগ্রগামী।

গ. আল্লাহ তা‘আলার জন্য ভালোবাসা। এ ভালোবাসা উক্ত ভালোবাসার পরিপূরক।

ঘ. আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য কাউকে তাঁর সমপর্যায়েই ভালোবাসা। আর এটিই হচ্ছে শির্ক।

আরো এক প্রকারের ভালোবাসা রয়েছে যা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। আর তা হচ্ছে স্বভাবগত ভালোবাসা। যেমন, স্ত্রী-সন্তানের ভালোবাসা।

৭. চূড়ান্ত ভালোবাসা। কাউকে এমন চরমভাবে ভালোবাসা যে, প্রেমিকের অন্তরে আর কাউকে ভালোবাসার কোনো জায়গাই থাকে না। আরবী ভাষায় এ জাতীয় ভালোবাসাকে “খুল্লাহ্” এবং এ জাতীয় প্রেমিককে “খালীল” বলা হয়। আর এ জাতীয় ভালোবাসা শুধুমাত্র দু’ জন নবীর জন্যই নির্দিষ্ট। যারা হচ্ছেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

জুন্দাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্বে এ কথা বলতে শুনেছি। তিনি বলেন,

«إِنِّيْ أَبْرَأُ إِلَى اللهِ أَنْ يَّكُوْنَ لِيْ مِنْكُمْ خَلِيْلٌ ، فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى قَدِ اتَّخَذَنِيْ خَلِيْلاً ، كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيْمَ خَلِيْلاً ، وَ لَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا مِنْ أُمَّتِيْ خَلِيْلاً لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيْلاً»

“তোমাদের মধ্য থেকে কেউ আমার খলীল হোক এ ব্যাপার থেকে আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট মুক্তি চাচ্ছি। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা আমাকে নিজ খলীল হিসেবে চয়ন করেছেন যেমনিভাবে চয়ন করেছেন ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে। আমি যদি আমার উম্মত থেকে কাউকে খলীল বানাতাম তা হলে আবু বকরকেই আমার খলীল বানাতাম”।[4]

খলীলের চাইতে হাবীবের মর্যাদা কখনোই উন্নত হতে পারে না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই কাউকে নিজ খলীল বানাননি। তবে হযরত ‘আয়েশা তার হাবীবাহ ছিলেন এবং আবু বকর, উমার ও অন্যান্যরা তাঁর হাবীব ছিলেন।

এ কথা সবার জানা থাকা প্রয়োজন যে, ভালোবাসার পাত্র আবার দু’ প্রকার, যা নিম্নরূপ:

ক. স্বকীয়ভাবে যাকে ভালোবাসতে হয়। অন্য কারোর জন্য তার ভালোবাসা নয়। আর তা এমন সত্তার ব্যাপারে হতে পারে যার গুণাবলী চূড়ান্ত পর্যায়ের ও চিরস্থায়ী এবং যা তার থেকে কখনো ভিন্ন হয় না। তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, মানুষ কাউকে দু’ কারণেই ভালোবাসে। আর তা হচ্ছে মহত্ত্ব ও পরম সৌন্দর্য। উক্ত দু’টি গুণ আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়েরই রয়েছে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব, একান্ত স্বকীয়ভাবে তাঁকেই ভালোবাসতে হবে। তিনি ভিন্ন অন্য কাউকে নয়।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সব কিছু দিচ্ছেন, সুস্থ রাখছেন, সীমাহীন করুণা করছেন, তাঁর শানে অনেক অনেক দোষ করার পরও তিনি তা লুকিয়ে রাখছেন এবং ক্ষমা করে দিচ্ছেন, তিনি আমাদের দো‘আ কবুল করছেন, আমাদের সকল বিপদাপদ কাটিয়ে দিচ্ছেন; অথচ আমাদের প্রতি তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই বরং তিনি বান্দাকে গুনাহ করার সুযোগ দিচ্ছেন, তাঁরই ছত্রছায়ায় বান্দা তার প্রবৃত্তির সকল চাহিদা মিটিয়ে নিচ্ছে যদিও তা তাঁর বিধান রিরুদ্ধ। সুতরাং আমরা তাঁকেই ভালো না বেসে আর কাকে ভালোবাসবো? বান্দার প্রতি তাঁর পক্ষ থেকে শুধু কল্যাণই কল্যাণ নেমে আসছে; অথচ তাঁর প্রতি বান্দার পক্ষ থেকে অধিকাংশ সময় খারাপ আমলই উঠে যাচ্ছে, তিনি অগণিত নিয়ামত দিয়ে বান্দার প্রিয় হতে চান; অথচ তিনি তার মুখাপেক্ষী নন। আর বান্দা গুনাহ’র মাধ্যমে তাঁর অপ্রিয় হতে চায়; অথচ সর্বদা সে তাঁর মুখাপেক্ষী। তারপরও আল্লাহর অনুগ্রহ কখনো বন্ধ হচ্ছে না। আর বান্দার গুনাহও কখনো কমছে না

দুনিয়ার কেউ কাউকে ভালোবাসলে সে তার স্বার্থের জন্যই ভালোবাসে কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে ভালোবাসেন একমাত্র তারই কল্যাণে। তাতে আল্লাহ তা‘আলার কোনো লাভ নেই।

দুনিয়ার কেউ কারোর সাথে কখনো লেনদেন করে লাভবান না হলে সে তার সাথে দ্বিতীয়বার আর লেনদেন করতে চায় না। লাভ ছাড়া সে সামনে এক কদমও বাড়াচ্ছে না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সাথে লেনদেন করছেন একমাত্র তারই লাভের জন্য। নেক আমল একে দশ, সাতশ’ পর্যন্ত। এমনকি আরো অনেক বেশি। আর গুনাহ একে এক এবং দ্রুত মার্জনীয়।

আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই জন্যে। আর দুনিয়া ও আখিরাতের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন একমাত্র বান্দার জন্যে।

বান্দার সকল চাওয়া-পাওয়া একমাত্র তাঁরই নিকটে। তিনিই সবচেয়ে বড় দাতা। বান্দাকে তিনি তাঁর নিকট চাওয়া ছাড়াই আশাতীত অনেক কিছু দিয়েছেন। তিনি বান্দার পক্ষ থেকে কম আমলে সন্তুষ্ট হয়েই তাঁর নিকট তা ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকেন এবং গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেন। তিনি তাঁর নিকট বার বার কোনো কিছু চাইলে বিরক্ত হন না। বরং এর বিপরীতে তিনি তাতে প্রচুর সন্তুষ্ট হন। তিনি তাঁর নিকট কেউ কিছু না চাইলে খুব রাগ করেন।

আমাদের সবার জানা থাকা উচিৎ যে, আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি রক্ষা করে চলার নামই বিলায়াত। যার মূলে রয়েছে তাঁর একান্ত ভালোবাসা। শুধু সালাত, সিয়াম কিংবা মুজাহাদার নামই বিলায়াত নয়। বান্দার খারাপ কাজে তিনি লজ্জা পান। কিন্তু বান্দা তাতে একটুও লজ্জা পায় না। তিনি বান্দার গোনাহসমূহ লুকিয়ে রাখেন; কিন্তু বান্দা তার গোনাহগুলো লুকিয়ে রাখতে রাজি নয়। তিনি বান্দাকে অগণিত নি‘আমত দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি কামনার প্রতি তাকে উদ্বুদ্ধ করেন; কিন্তু বান্দা তা করতে অস্বীকার করে। তাই তিনি এ উদ্দেশ্যে যুগে যুগে রাসূল ও তাদের নিকট কিতাব পাঠান। এরপরও তিনি এ উদ্দেশ্যে প্রতি শেষ রাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে এসে বলতে থাকেনঃ কে আছো আমার কাছে চাইবে আমি তাকে সবই দেবো। কে আছো আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো। তিনি বান্দার প্রতি এতো মেহেরবান যে মা-ও তার সন্তানের প্রতি এতো মেহেরবানী করে না। বান্দার তাওবা দেখে তিনি এতো বেশি খুশি হন যতটুকু খুশি হয় না সে ব্যক্তিও যে ধু ধু মরুভূমিতে খাদ্য-পানীয়সহ তার সওয়ারী হারিয়ে জীবনের আশা ছেড়ে দেওয়ার পর আবার তা ফিরে পেয়েছে। তাঁর আলোকে দুনিয়া আলোকিত। তিনি সর্বদা জাগ্রত। তাঁর জন্য কখনো ঘুম শোভা পায় না। তিনি সত্যিকার ইনসাফগার। তাঁর নিকট রাত্রের আমল উঠে যায় দিনের আমলের পূর্বে। দিনের আমল উঠে যায় রাতের আমলের পূর্বে। নূরই তাঁর আচ্ছাদন। সে আচ্ছাদন সরিয়ে ফেললে তাঁর চেহারার আলোকরশ্মি তাঁর দৃষ্টির দূরত্ব পর্যন্ত তাঁর সকল সৃষ্টিকে জ্বালিয়ে ফেলবে। সুতরাং একমাত্র তাঁকেই ভালোবাসতে হবে।

জান্নাতের সর্ববৃহৎ নি‘আমত হবে সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার সাক্ষাৎলাভ। আর আত্মার সর্বচূড়ান্ত স্বাদ তাতেই নিহিত রয়েছে। তা এখন থেকেই তাঁর ভালোবাসার মাধ্যমে অর্জন করতে হবে এবং তাঁর ভালোবাসার মধ্যেই দুনিয়াতে আত্মার সমূহ তৃপ্তি নিহিত। এটাই মু’মিনের জন্য দুনিয়ার জান্নাত। এ কারণেই আলিমগণ বলে থাকেন: দুনিয়ার জান্নাত যে পেয়েছে আখিরাতের জান্নাত সেই পাবে। তাই আল্লাহ প্রেমিকদের কারো কারোর কখনো কখনো এমন ভাব বা মজা অনুভব হয় যার দরুন সে বলতে বাধ্য হয় যে, এমন মজা যদি জান্নাতীরা পেয়ে থাকেন তা হলে নিশ্চই তাঁরা সুখে রয়েছেন।

খ. অন্যের জন্য যাকে ভালোবাসতে হয়। অর্থাৎ দুনিয়ার কাউকে ভালোবাসতে হলে তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই ভালোবাসতে হবে। স্বকীয়ভাবে নয়। তবে এ কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে ভালোবাসা কখনো মনের বিপরীতও হতে পারে। তবে তা তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই মেনে নিতে হবে যেমনিভাবে সুস্থতার জন্য অপছন্দ পথ্য খাওয়া মেনে নিতে হয়।

অতএব, সর্ব নিকৃষ্ট ভালোবাসা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে ভালোবাসা। আর সর্বোৎকৃষ্ট ভালোবাসা হচ্ছে এককভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসা এবং তাঁর ভালোবাসার বস্তুকে সর্বদা প্রাধান্য দেওয়া।

ভালোবাসাই সকল কাজের মূল। চাই সে কাজ ভালোই হোক বা খারাপ। কারণ, কোনো ব্যক্তিকে ভালোবাসলেই তার মর্জিমাফিক কাজ করতে ইচ্ছা হয় এবং কোনো বস্তুকে ভালোবাসলেই তা পাওয়ার জন্য মানুষ কর্মোদ্যোগী হয়। সুতরাং সকল ধর্মীয় কাজের মূল হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা যেমনিভাবে সকল ধর্মীয় কথার মূল হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের অপূর্ব স্বীকৃতি।

কোনো ভালোবাসা কারোর জন্য লাভজনক প্রমাণিত হলে তার প্রভাব তথা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও তার জন্য লাভজনক হতে বাধ্য। আর কোনো ভালোবাসা কারোর জন্য ক্ষতিকর হলে তার প্রভাব তথা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও তার জন্য ক্ষতিকর হতে বাধ্য। তাই আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবেসে তাঁকে পাওয়ার জন্য কান্না করলে বা তাঁকে না পাওয়ার দরুন হৃদয়ে ব্যথা অনুভূত হলে তা বান্দার কল্যাণেই আসবে। ঠিক এরই বিপরীতে কোনো সুন্দরী মেয়ে অথবা শ্মশ্রুবিহীন সুদর্শন কোনো ছেলেকে ভালোবেসে তাঁকে পাওয়ার জন্য কান্না করলে বা তাঁকে না পাওয়ার দরুন হৃদয়ে ব্যথা অনুভূত হলে তা কখনোই বান্দার কল্যাণে আসবে না। বরং তা তার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলেই প্রমাণিত হবে। সুন্দরী কোনো নারী অথবা শ্মশ্রুবিহীন সুদর্শন কোনো ছেলেকে এমনভাবে ভালোবাসা যে, তার সন্তুষ্টিকে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়, কখনো আল্লাহ তা‘আলার অধিকার ও তার অধিকার পরস্পর সাংঘর্ষিক হলে তার অধিকারকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, তার জন্য মূল্যবান সম্পদ ব্যয় করা হয়, অথচ আল্লাহ তা‘আলার জন্য মূল্যহীন সম্পদ, তার জন্য মূল্যবান সময় ব্যয় করা হয় যা আল্লাহ তা‘আলার জন্য করা হয় না, সর্বদা তার নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করা হয় ; অথচ আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের এতটুকুও চেষ্টা করা হয় না এমন ভালোবাসা বড় শির্ক যা ব্যভিচার চাইতেও অত্যন্ত মারাত্মক।

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৫০৭, ৬৫০৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬৮৩, ২৬৮৪, ২৬৮৫, ২৬৮৬

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৪৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৩

[3] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৬৮১; ত্বাবরানী/কাবীর, হাদীস নং ৭৬১৩, ৭৭৩৭, ৭৭৩৮

[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৩২

তাওহীদ বিরোধী উক্ত রোগে কেউ আক্রান্ত হলে তাকে সর্ব প্রথম এ কথা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, সে উক্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছে শুধু মূর্খতা এবং গাফিলতির দরুনই। অতএব, সর্ব প্রথম তাকে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ তথা একত্ববাদ, তাঁর সাধারণ নীতি ও নিদর্শন সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে। অতঃপর তাকে এমন কিছু প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ইবাদত করতে হবে যার দরুন সে উক্ত মত্ততা থেকে রক্ষা পেতে পারে। এরই পাশাপাশি সে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সবিনয়ে সর্বদা এ দো‘আ করবে যে, আল্লাহ তা‘আলা যেন তাকে উক্ত রোগ থেকে ত্বরিত মুক্তি দেন। বিশেষ করে সম্ভাবনাময় স্থান, সময় ও অবস্থায় দো‘আ করবে। যেমন, আযান ও ইক্বামতের মধ্যবর্তী সময়, রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশ, সাজদাহ এবং জুমু‘আর দিনের শেষ বেলা ইত্যাদি ইত্যাদি।

সংক্ষিপ্তাকারে প্রস্তাবিত চিকিৎসাসমূহঃ

১. প্রথমে আল্লাহ তা‘আলার নিকট উক্ত গুনাহ থেকে খাঁটি তাওবা করে নিন। কারণ, কেউ আল্লাহ তা‘আলা নিকট একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য অথবা তাঁরই কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য তাওবা করে নিলে আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তা কবুল করবেন এবং তাকে সেভাবেই চলার তাওফীক দিবেন।

২. আল্লাহ তা‘আলার প্রতি দৃঢ় একনিষ্ঠ হোন। আর এটিই হচ্ছে এর একান্ত মহৌষধ। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী ইউসুফ আলাইহিস সালামকে এ একনিষ্ঠতার কারণেই ’ইশ্ক্ব এবং প্রায় নিশ্চিত ব্যভিচার থেকে রক্ষা করেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿كَذَٰلِكَ لِنَصۡرِفَ عَنۡهُ ٱلسُّوٓءَ وَٱلۡفَحۡشَآءَۚ إِنَّهُۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُخۡلَصِينَ﴾ [يوسف: ٢٤]

“তাকে (ইউসুফ আলাইহিস সালামকে) মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখার জন্যই এভাবে আমি আমার নিদর্শন দেখালাম। কারণ, তিনি তো ছিলেন আমার একান্ত একনিষ্ঠ বান্দাহ্দের অন্যতম”। [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২৪]

৩. ধৈর্য ধরুন। কারণ, কোনো অভ্যাসগত কঠিন পাপ ছাড়ার জন্য ধৈর্যের একান্তই প্রয়োজন। সুতরাং ধৈর্য ধারণের বার বার কসরত করতে হবে। এমনিভাবেই ধীরে ধীরে এক সময় ধৈর্য ধারণ অভ্যাসে পরিণত হবে।

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَمَنْ يَّتَصَبَّرْ يُصَبِّرْهُ اللهُ ، وَمَا أُعْطِيَ أَحَدٌ عَطَاءً خَيْراً وَأَوْسَعَ مِنَ الصَّبْرِ»

“যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করার চেষ্টা করবে আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তাকে ধৈর্য ধারণ করার শক্তি দিবেন। আল্লাহ তা‘আলা কাউকে এমন কিছু দেন নি যা ধৈর্যের চাইতেও উত্তম এবং বিস্তর কল্যাণকর”।[1]

এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, মনের কোনো চাহিদা পূরণ করা থেকে ধৈর্য ধারণ করা যে কারোর জন্য অবশ্যই অনেক সহজ তা পূরণ করার পর যে কষ্ট, শাস্তি, লজ্জা, আফসোস, লাঞ্ছনা, ভয়, চিন্তা ও অস্থিরতা পেয়ে বসবে তা থেকে ধৈর্য ধারণ করার চাইতে। তাই একেবারে শুরুতেই ধৈর্য ধারণ করতে হবে।

৪. মনের বিরোধিতা করতে শিখুন। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মনের বিরোধিতা করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে অবশ্যই সঠিক পথে পরিচালিত করবেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُواْ فِينَا لَنَهۡدِيَنَّهُمۡ سُبُلَنَاۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٦٩﴾ [العنكبوت: ٦٩]

“যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করবো। আল্লাহ তা‘আলা নিশ্চয় সৎকর্মশীলদের সাথেই রয়েছেন”। [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৬৯]

৫. আল্লাহ তা‘আলা যে সর্বদা আপনার কর্মকাণ্ডের প্রতি দৃষ্টিপাত করেই আছেন তা অনুভব করতে শিখুন। সুতরাং উক্ত কাজ করার সময় মানুষ আপনাকে না দেখলেও আল্লাহ তা‘আলা যে আপনার প্রতি দেখেই আছেন তা ভাবতে হবে। এরপরও যদি আপনি উক্ত কাজে লিপ্ত থাকেন তখন অবশ্যই এ কথা ভাবতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলার সম্মান ও মর্যাদা আপনার অন্তরে নেই। তাই আল্লাহ তা‘আলা আপনার উক্ত কর্ম দেখলেও আপনার এতটুকুও লজ্জা হয় না। আর যদি আপনি এমন বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তা‘আলা আপনার কর্মকাণ্ড দেখছেনই না তা হলে তো আপনি নিশ্চয় কাফির।

৬. জামা‘আতে সালাত পড়ার প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হোন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ تَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِۗ﴾ [العنكبوت: ٤٥]

“নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে”। [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৪৫]

৭. বেশি বেশি নফল সাওম পালন করতে চেষ্টা করুন। কারণ, সাওমের মধ্যে বিশেষ ফযীলতের পাশাপাশি উত্তেজনা প্রশমনেরও এক বাস্তবমুখী ব্যবস্থা রয়েছে। তেমনিভাবে সাওম আল্লাহভীরুতা শিক্ষা দেওয়ার জন্যও এক বিশেষ সহযোগী।

আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«يَا مَعْشَرَ الشَّبَابِ! مَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمُ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ، وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ ، فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ»

“হে যুবকরা! তোমাদের কেউ স্ত্রী সঙ্গমে সক্ষম হলে সে যেন দ্রুত বিবাহ করে নেয়। কারণ, বিবাহ তার চোখকে নিম্নগামী করবে এবং তার লজ্জাস্থানকে হিফাযত করবে। আর যে বিবাহ করতে সক্ষম নয় সে যেন রোযা রাখে। কারণ, সাওম তার জন্য একান্ত যৌন উত্তেজনা প্রতিরোধক”।[2]

৮. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করুন। কারণ, কুরআন হচ্ছে সর্ব রোগের চিকিৎসা। তাতে নূর, হিদায়াত, মনের আনন্দ ও প্রশান্তি রয়েছে। সুতরাং উক্ত রোগে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির জন্য বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত, মুখস্থ ও তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা অবশ্যই কর্তব্য যাতে তার অন্তর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যায়।

৯. বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করুন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার যিকিরে অন্তরের বিরাট একটা প্রশান্তি রয়েছে এবং যে অন্তর সর্বদা আল্লাহর যিকিরে ব্যস্ত থাকে শয়তান সে অন্তর থেকে বহু দূরে অবস্থান করে। সুতরাং এ জাতীয় ব্যক্তির জন্য যিকির অত্যন্ত উপকারী।

১০. আল্লাহ তা‘আলার সকল বিধি-বিধানের প্রতি যত্নবান হোন। তা হলে আল্লাহ তা‘আলাও আপনার প্রতি যত্নবান হবেন। আপনাকে জিন্ন ও মানব শয়তান এবং অন্তরের কুপ্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করবেন ‘আলা আপনার ধার্মিকতা, সততা, মানবতা এবং সম্মানও রক্ষা করবেন।

১১. অতি তাড়াতাড়ি বিবাহ কার্য সম্পাদন করুন। তা হলে যৌন উত্তেজনা প্রশমনের জন্য সহজেই আপনি একটি হালাল ক্ষেত্র পেয়ে যাবেন।

১২. জান্নাতের হুরের কথা বেশি বেশি স্মরণ করুন। যাদের চোখ হবে বড় বড় এবং যারা হবে অতুলনীয়া সুন্দরী লুক্কায়িত মুক্তার ন্যায়। নেককার পুরুষদের জন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং তাদেরকে পেতে হলে দুনিয়ার এ ক্ষণিকের অবৈধ স্বাদ পরিত্যাগ করতেই হবে।

১৩. শ্মশ্রুবিহীন সে প্রিয় ছেলেটি থেকে খুব দূরে থাকুন যাকে দেখলে
আপনার অন্তরের সে লুক্কায়িত কামনা-বাসনা দ্রুত জাগ্রত হয়। এমন দূরে থাকবেন যে, সে যেন কখনো আপনার চোখে না পড়ে এবং তার কথাও যেন আপনি কখনো শুনতে না পান। কারণ, বাহ্যিক দূরত্ব অন্তরের দূরত্ব সৃষ্টি করতে অবশ্যই বাধ্য।

১৪. তেমনিভাবে উত্তেজনাকর সকল বস্তু থেকেও দূরে থাকুন যেগুলো আপনার লুক্কায়িত কামনা-বাসনাকে দ্রুত জাগ্রত করে। অতএব মহিলা ও শ্মশ্রুবিহীন ছেলেদের সাথে মেলামেশা করবেন না। বিশ্রী ছবি ও অশ্লীল গান শুনবেন না। আপনার নিকট যে অডিও ভিডিও ক্যাসেট, ছবি ও চিঠি রয়েছে সবগুলো দ্রুত নস্যাৎ করে দিন। উত্তেজনাকর খাদ্যদ্রব্য আপাতত বন্ধ রাখুন। তা কিছু দিনের জন্য গ্রহণ করবেন না। ইতিঃপূর্বে যেখানে উক্ত কাজ সম্পাদিত হয়েছে সেখানে আর যাবেন না।

১৫. লাভজনক কাজে ব্যস্ত থাকুন। কখনো একা ও অবসর থাকতে চেষ্টা করবেন না। পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারেন। আত্মীয়-স্বজনের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারেন। ইত্যবসরে ঘরের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করতে পারেন। কুর‘আন শরীফ মুখস্থ করতে পারেন অথবা অন্ততপক্ষে বেচাকেনা নিয়েও ব্যস্ত হতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

১৬. সর্বদা শয়তানের ওয়াসওয়াসা প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করুন। কোনো কুমন্ত্রণাকে এতটুকুর জন্যও অন্তরে স্থান দিবেন না।

১৭. নিজের মনকে দৃঢ় করুন। কখনো নিরাশ হবেন না। কারণ, এ ব্যাধি এমন নয় যে তার কোনো চিকিৎসা নেই। সুতরাং আপনি নিরাশ হবেন কেন?

১৮. উচ্চাকাঙ্খী হোন। উচ্চাভিলাসের চাহিদা হচ্ছে এই যে, আপনি সর্বদা উন্নত গুণে গুণান্বিত হতে চাইবেন। অরুচিকর অভ্যাস ছেড়ে দিবেন। লাঞ্ছনার স্থানসমূহে কখনো যাবেন না। সমাজের সম্মানি ব্যক্তি সেজে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব হাতে নিবেন।

১৯. অভিনব বিরল চিকিৎসাসমূহ থেকে দূরে থাকুন। যেমন, কেউ উক্ত কাজ ছাড়ার জন্য এভাবে মানত করলো যে, আমি যদি এমন কাজ আবারো করে ফেলি তা হলে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ছয় মাস সিয়াম পালন করা অথবা দশ হাজার রিয়াল সাদাকা করা আমার ওপর বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে। তেমনিভাবে এ বলে কসম খেলো যে, আল্লাহর কসম! আমি আর এমন কাজ করবো না। শুরুতে কসমের কাফফরার ভয়ে অথবা মানত ওয়াজিব হওয়ার ভয়ে উক্ত কাজ করা থেকে বেঁচে থাকলেও পরবর্তীতে তা কাজে নাও আসতে পারে।

কখনো কখনো কেউ কেউ কোনো অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই যৌন উত্তেজনা প্রশমনকারী কোনো কোনো ঔষুধ সেবন করে। তা একেবারেই ঠিক নয়। কারণ, তাতে হিতে বিপরীতও হতে পারে। ২০. নিজের মধ্যে প্রচুর লজ্জাবোধ জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করুন। কারণ, লজ্জাবোধ একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যা কল্যাণই কল্যাণ এবং তা ঈমানেরও একটি বিশেষ অঙ্গ বটে। লজ্জাবোধ মানুষকে ভালো কাজ করতে উৎসাহ যোগায় এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে।

>
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৬৯, ৬৪৭০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৫৩

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০৫, ৫০৬৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৪০০
নিম্নোক্ত কয়েকটি কাজ করলে যে কোনো ব্যক্তির মাঝে ধীরে ধীরে লজ্জাবোধ জন্ম নেয়:

১. বেশি বেশি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী পড়বেন।

২. সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম ও প্রসিদ্ধ লজ্জাশীল সালফে সালেহীনদের জীবনী পড়বেন।

৩. লজ্জাশীলতার ফলাফল সম্পর্কে ভালোভাবে চিন্তা করবেন। বিশেষ করে লজ্জাহীনতার ভীষণ কুফল সম্পর্কেও সর্বদা ভাববেন।

৪. এমন কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবেন যা বললে বা করলে লজ্জাবোধ কমে যায়।

৫. লজ্জাশীলদের সাথে বেশি বেশি উঠাবসা করবেন এবং লজ্জাহীনদের থেকে একেবারেই দূরে থাকবেন।

৬. বার বার লজ্জাশীলতার কসরত করবেন। তা হলে একদা আপনি অবশ্যই লজ্জাশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।

বিশেষ করে বাচ্চাদের মধ্যে এমন গুণ থাকা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। তখনই সে বড় হলে তা তার বিশেষ কাজে আসবে।

ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ. বলেন,

إِذَا كَانَ فِيْ الصَّبِيِّ خَصْلَتَانِ: الْـحَيَاءُ وَالرَّهْبَةُ رُجِيَ خَيْرُهُ

“কোনো বাচ্চার মধ্যে দু’টি গুণ থাকলেই তার কল্যাণের আশা করা যায়। তম্মধ্যে একটি হচ্ছে লজ্জা আর অপরটি হচ্ছে ভয়-ভীতি”।

ইমাম আসমা‘ঈ রহ. বলেন,

مَنْ كَسَاهُ الْـحَيَاءُ ثَوْبَهُ لَمْ يَرَ النَّاسُ عَيْبَهُ

“লজ্জা যার ভূষণ হবে মানুষ তার দোষ দেখতে পাবে না”

২১. যারা অন্য জন কর্তৃক এ জাতীয় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন (বিশেষ করে তা উঠতি বয়সের ছেলেদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য) তাদের একান্তই কর্তব্য হচ্ছে সর্বদা সতর খোলা রাখা থেকে সতর্ক থাকা। চাই তা খেলাধুলার সময় হোক বা অন্য কোনো সময়। কারণ, এরই মাধ্যমে সাধারণত অন্য জন তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে।

২২. সাজ-সজ্জায় স্বাভাবিকতা বজায় রাখবেন। উঠতি বয়সের ছেলেদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবেই প্রযোজ্য। সুতরাং এদের জন্য কখনোই উচিৎ নয় যে, এরা কড়া সুগন্ধি ব্যবহার করবে। ব্যতিক্রমধর্মী আঁটসাঁট পোশাক পরবে। সাজ-সজ্জার ব্যাপারে কাফির ও মহিলাদের অনুসরণ করবে। মাথা আঁচড়ানো বা চুলের ভাঁজের প্রতি গুরুত্ব দিবে। কারণ, তা অন্যের ফিৎনার কারণ।

২৩. উঠতি বয়সের ছেলেদের আরেকটি কর্তব্য হচ্ছে, তারা যে কারোর সঙ্গে মজা বা রঙ্গ-তামাশা করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ, অধিক কৌতুক মানুষের সম্মান বিনষ্ট করে দেয় এবং বোকাদেরকে তার ব্যাপারে অসভ্য আচরণ করতে সাহসী করে তোলে। তবে জায়িয কৌতুক একেবারেই নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু তা নেককারদের সঙ্গেই হওয়া উচিৎ এবং তা ভদ্রতা ও মধ্যপন্থা বজায় রেখেই করতে হবে।

২৪. আত্ম সমালোচনা করতে শিখবেন। সময় থাকতে এখনই নিজের মনের সঙ্গে ভালোভাবে বুঝাপড়া করে নিবেন। চাই আপনি ছোটই হোন অথবা বড়। সেই কর্মটি আপনিই করে থাকুন অথবা তা আপনার সাথেই করা হোক না কেন।

আপনি যদি বড় বা বয়স্ক হয়ে থাকেন তা হলে আপনি নিজ মনকে এ বলে প্রশ্ন করবেন যে, এখনো আমি কিসের অপেক্ষায় রয়েছি? এ রকম মারাত্মক কাজটি এখনো ছাড়ছিনে কেন? আমি কি সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির অপেক্ষা করছি? না কি মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছি?

আর যদি আপনি অল্প বয়স্ক বা ছোট হয়ে থাকেন তা হলে আপনি নিজ মনকে এ বলে প্রশ্ন করবেন যে, আমি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, আমি অনেক দিন বাঁচবো। না কি যে কোনো সময় আমার মৃত্যু আসতে পারে; অথচ আমি তখনো উক্ত গোনাহে লিপ্ত। আর যদি আমি বেঁচেই থাকি তা হলে এমন ঘৃণ্য কাজ নিয়েই কি বেঁচে থাকবো? আমার যৌবন কি এ কাজেই ব্যয় হতে থাকবে? আমি কি বিবাহ করবো না? তখন আমার স্ত্রী ও সন্তানের কী পরিণতি হবে? আমি কি কোনো এক দিন মানুষের কাছে লাঞ্ছিত হবো না? আমি কি কখনো কঠিন রোগে আক্রান্ত হবো না? আমার কারণেই কি এ পবিত্র সমাজ ধ্বংসের পথে এগুচ্ছে না? আমি কি আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি ও অভিশাপের কারণ হচ্ছি না? কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সামনে আমার অবস্থান কী হবে?

২৫. উক্ত কর্মের পরিণতি নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করবেন। কারণ, কিছুক্ষণের মজার পরই আসছে দীর্ঘ আপসোস, লজ্জা, অপমান ও শাস্তি।

২৬. মনে রাখবেন, এ জাতীয় মজার কোনো শেষ নেই। এ ব্যাধি হচ্ছে চুলকানির ন্যায়। যতই চুলকাবেন ততই চুলকানি বাড়বে। একটি শিকার মিললেই আরেকটি শিকারের ধান্ধায় থাকতে হবে। কখনোই আপনার এ চাহিদা মিটবে না।

২৭. নেককারদের সাথে উঠাবসা করবেন ও বদকারদের থেকে বহু দূরে থাকবেন। কারণ, নেককারদের সাথে উঠাবসা করলে অন্তর সজীব হয়, ব্রেইন আলোকিত হয়। আর বদকারদের থেকে দূরে থাকলে ধর্ম ও ইজ্জত রক্ষা পায়।

২৮. বেশি বেশি রুগ্ন ব্যক্তির শুশ্রূষা করবেন, বার বার মৃত ব্যক্তির লাশ দেখতে যাবেন, মৃত ব্যক্তিকে দাফন করবেন ও তার কবর যিয়ারত করবেন। তেমনিভাবে মৃত্যু ও মৃত্যুর পরের অবস্থা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করবেন। কারণ, তা যৌন উত্তেজনা প্রশমনের এক বিশেষ সহযোগী।

২৯. কারোর হুমকির সামনে কোনো ধরনের নতি স্বীকার করবেন না। বরং তা দ্রুত প্রশাসনকে জানাবেন। বিশেষ করে এ ব্যাপারটি ছোটদের ক্ষেত্রেই বেশি প্রযোজ্য। কারণ, এ কথাটি আপনি বিশেষভাবেই জেনে রাখবেন যে, এ জাতীয় ব্যক্তিরা যতই কাউকে ভয় দেখাক না কেন তারা এ ব্যাপারে উক্ত ব্যক্তির কঠিনতা বা সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা দেখলে অবশ্যই পিছপা হতে বাধ্য হবে।

কেউ এ ব্যাপারে নিজকে অক্ষম মনে করলে সে যেন দ্রুত তা নিজ পিতা, বড় ভাই, আস্থাভাজন শিক্ষক অথবা কোনো ধার্মিক ব্যক্তিকে জানায়, যাতে তাঁরা তাকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে পারে।

৩০. বেশি বেশি সাধুতা ও তাওবাকারীদের কাহিনী সম্ভার পড়বেন। কারণ, তাতে বহু ধরনের শিক্ষা, আত্মসম্মানের প্রতি উৎসাহ এবং বিশেষভাবে অসম্মানের প্রতি নিরুৎসাহ সৃষ্টি হবে।

৩১. বেশি বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ক্যাসেটসমূহ বিশেষ মনযোগ সহ শ্রবণ করবেন এবং গানের ক্যাসেটসমূহ শুনা থেকে একেবারেই বিরত থাকবেন।

৩২. সমাজের যে যে নেককার ব্যক্তিরা যুবকদের বিষয়সমূহ নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা-ভাবনা করছেন তাদের কারোর নিকট নিজের এ দুরবস্থা বিস্তারিত জানাবেন যাতে তাঁরা আপনাকে এ ব্যাপারে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নিকটও আপনার এ অবস্থার পূর্ণ বিবরণ দিতে পারেন যাতে তিনি আপনাকে উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে পারেন অথবা উত্তেজনা প্রশমনের কোনো পদ্ধতি বাতলিয়ে দিতে পারেন।

প্রত্যেক বিবেকবান মানুষেরই এ কথা জানা উচিত যে, শরী‘আত ও বিবেককে আশ্রয় করেই কোনো মানুষ তার সার্বিক কল্যাণ ও তার পরিপূর্ণতা এবং সকল অঘটন অথবা অন্ততপক্ষে তার কিয়দংশ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে থাকে।

সুতরাং বিবেকবানের সামনে যখন এমন কোনো ব্যাপার এসে পড়ে যার মধ্যে ভালো ও খারাপ উভয় দিকই রয়েছে তখন তার ওপর দু’টি কর্তব্য এসে পড়ে। তম্মধ্যে একটির সম্পর্ক জ্ঞানের সাথে এবং অপরটির সম্পর্ক কাজের সাথে। অর্থাৎ তাকে সর্ব প্রথম এ কথা জানতে হবে যে, উক্ত উভয় দিকের মধ্য থেকে কোনটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। অতএব সে সেটিকেই প্রাধান্য দিবে। আর এ কথা সবারই জানা যে, কোনো মেয়ে বা শ্মশ্রুবিহীন ছেলের প্রেমে পড়ার মধ্যে দুনিয়াবী বা ধর্মীয় কোনো ফায়েদা নেই। বরং তাতে দীন-দুনিয়ার অনেকগুলো গুরুতর ক্ষতি রয়েছে, যার কিয়দংশ নিম্নরূপ:

ক. আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা ও তাঁর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে তাঁর কোনো সৃষ্টির ভালোবাসা ও তার স্মরণে নিমগ্ন হওয়া। কারণ, উভয়টি একত্রে সমভাবে কারোর হৃদয়ে অবস্থান করতে পারে না।

খ. তার অন্তর আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যকে ভালোবাসার দরুন নিদারুণ কষ্ট ও শাস্তির সম্মুখীন হয়। কারণ, প্রেমিক কখনো চিন্তামুক্ত হতে পারে না। বরং তাকে সর্বদা চিন্তাযুক্তই থাকতে হয়। প্রিয় বা প্রিয়াকে না পেয়ে থাকলে তাকে পাওয়ার চিন্তা এবং পেয়ে থাকলে তাকে আবার কখনো হারানোর চিন্তা।

গ. প্রেমিকের অন্তর সর্বদা প্রিয় বা প্রিয়ার হাতেই থাকে। সে তাকে যেভাবেই চালাতে চায় সে সেভাবেই চলতে বাধ্য। তখন তার মধ্যে কোনো নিজস্ব ইচ্ছা অবশিষ্ট থাকে না। এর চাইতে আর বড় কোনো লাঞ্ছনা আছে কি?

ঘ. দীন-দুনিয়ার সকল কল্যাণ থেকে সে বঞ্চিত হয়। কারণ, ধর্মীয় কল্যাণের জন্য তো আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অন্তরের উন্মুখতা একান্ত প্রয়োজনীয়। আর তা প্রেমিকের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অন্য দিকে দুনিয়াবী কল্যাণ তো দীনি কল্যাণেরই অধীন। দীনি কল্যাণ যার হাত ছাড়া হয় দুনিয়ার কল্যাণ সুস্থভাবে কখনো তার হস্তগত হতে পারে না।

ঙ. দীন-দুনিয়ার সকল বিপদ তার প্রতি দ্রুত ধাবিত হয়। কারণ, মানুষ যখন আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর প্রেমে পড়ে যায় তখন তার
অন্তর আল্লাহ বিমুখ হয়ে পড়ে। আর কারোর অন্তর আল্লাহ বিমুখ হলে শয়তান তার অন্তরে হাঁটু গেড়ে বসে। তখনই সকল বিপদাপদ তার দিকে দ্রুত ধাবমান হয়। কারণ, শয়তান তো মানুষের আজন্ম শত্রু। আর কারোর কঠিন শত্রু যখন তার ওপর কাবু করতে পারে তখন কি সে তার যথাসাধ্য ক্ষতি না করে এমনিতেই বসে থাকবে?!

চ. শয়তান যখন প্রেমিকের অন্তরে অবস্থান নিয়ে নেয় তখন সে উহাকে বিক্ষিপ্ত করে ছাড়ে এবং তাতে প্রচুর ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) ঢেলে দেয়। কখনো কখনো এমন হয় যে, সে একান্ত বদ্ধ পাগলে পরিণত হয়। লাইলী প্রেমিক ঐতিহাসিক প্রেমপাগল মজনুর কথা তো আর কারোর অজানা নয়।

ছ. এমনকি প্রেমিক কখনো কখনো প্রেমের দরুন প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নিজের সকল অথবা কিছু বাহ্যেন্দ্রিয় হারিয়ে বসে। প্রত্যক্ষ তো এভাবে যে, প্রেমে পড়ে তো অনেকে নিজ শরীরই হারিয়ে বসে। ধীরে ধীরে তার শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন তার কোনো ইন্দ্রিয়ই আর সুস্থভাবে বাহ্যিক কোনো কাজ সমাধা করতে পারে না।

একদা জনৈক যুবককে ‘আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এর নিকট হাযির করা হলো। তখন তিনি “আরাফা” ময়দানে অবস্থানরত। যুবকটি একেবারেই দুর্বল হয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেলো। তখন ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা উপস্থিত জনতাকে জিজ্ঞাসা করলেন: যুবকটির কী হলো? লোকেরা বললো, সে প্রেমে পড়েছে। এ কথা শুনেই তিনি তখন থেকে পুরো দিন আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রেম থেকে আশ্রয় কামনা করেন।

পরোক্ষ বাহ্যেন্দ্রিয় লোপ তো এ ভাবেই যে, প্রেমের দরুন তার অন্তর যখন বিনষ্ট হয়ে যায় তখন তার বাহ্যেন্দ্রিয়গুলোও আর সঠিক কাজ করে না। তখন তার চোখ আর তার প্রিয়ের কোনো দোষ দেখে না। কান আর প্রিয়কে নিয়ে কোনো গাল শুনতে বিরক্তি বোধ করে না। মুখ আর প্রিয়ের অযথা প্রশংসা করতে লজ্জা পায় না।

জ. ইশকের পর্যায়ে যখন কেউ পৌঁছে যায় তখন তার প্রিয় পাত্রই তার চিন্তা-চেতনার একান্ত কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হয়। তখন তার সকল শারীরিক ও মানসিক শক্তিসমূহ অচল হয়ে পড়ে। তখন সে এমন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় যার চিকিৎসা একেবারেই দুষ্কর।

এ ছাড়াও প্রেমের আরো অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। যেমন, কোনো প্রেমিক যখন লোক সমাজে তার প্রেমের কথা প্রকাশ করে দেয় তখন তার প্রিয়ের ওপর সর্ব প্রথম বিশেষভাবে যুলুম করা হয়। কারণ, মানুষ তখন অনর্থকভাবে তাকে এ ব্যাপারে দোষারোপ করতে থাকে। এমনকি তার ব্যাপারে কোনো মানুষ কোনো কথা বানিয়ে বললেও অন্যরা তা বিশ্বাস করতে একটুও দেরি করে না। এমন কি শুধু প্রিয়ের ওপরই যুলুম সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং তা তার সমস্ত পরিবারবর্গের ওপরও বর্তায়। কারণ, এতে করে তাদেরও প্রচুর মানহানী হয়। অন্যদেরকেও মিথ্যারোপের গুনাহে নিমজ্জিত করা হয়। আর যদি প্রিয় বা প্রিয়াকে পাওয়ার জন্য অন্যের সহযোগিতা নেওয়া হয় তখন তারাও গুনাহ্গার হয়। এ পথে যারা বাধা সৃষ্টি করে তাদের অনেককে কখনো কখনো হত্যাও করা হয়। কতো কতো গভীর সম্পর্ক যে এ কারণে বিচ্ছিন্ন করা হয় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কতো প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের অধিকার যে এ ক্ষেত্রে বিনষ্ট হয় তার কোনো হিসেব নেই। আর যদি এ ক্ষেত্রে যাদুর সহযোগিতা নেওয়া হয় তা হলে একে তো শির্ক আবার এর ওপর কুফুরী। আর যদি প্রিয় বা প্রিয়া মিলেই যায় তখন একে অপরকে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যের ওপর যুলুম করতে সহযোগিতা করে এবং একে অপরের সন্তুষ্টির জন্য কতো মানুষের কতো মাল যে হরণ করে তার কোনো হিসেব নেই। আর যদি প্রিয় বা প্রিয়া অত্যন্ত চতুর হয়ে থাকে তখন সে প্রেমিককে আশা দিয়ে দিয়ে তার সকল সম্পদ বিনষ্ট করে দেয়। কখনো সে এমন কান্ড একই সঙ্গে অনেকের সাথেই করে বেড়ায়। তখন প্রেমিক রাগ করে কখনো তাকে হত্যা বা মারাত্মকভাবে আহত করে। আরো কতো কি?

সুতরাং কোনো বুদ্ধিমান এতো কিছু জানার পরও এ জাতীয় প্রেমে কখনো আবদ্ধ হতে পারে না।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে এ জাতীয় অবৈধ সম্পর্ক থেকে দূরে রাখুন। আমীন! সুম্মা আমীন। ইয়া রাব্বাল-আলামীন।

وَصَلَّى اللهُ عَلَى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ أَجْمَعِيْنَ

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সকলকে উক্ত রোগসমূহ থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন। আমীন, সুম্মা আমীন।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে