বর্তমানে আমরা যদি মুসলিম উম্মাহ ও জাতির তা‘লীম-তরবিয়তের গুরুত্বের প্রতি অবলোকন করি, তাহলে আমাদেরকে প্রথমেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। তারপর দ্বিতীয় স্তরে প্রচার মাধ্যমকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। আর তৃতীয় স্তরে রাখতে হবে পারিবারিক গুরুত্বকে। কারণ, বর্তমান সমাজে পারিবারিক ভূমিকা শুধুমাত্র শিশুদের আহার-বিহার পরিধান, ও বাসস্থানের আর চাহিদা পূরণেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। পারিবারিক তা‘লীম-তরবিয়তের গুরুত্ব নেই।
তেমনিভাবে আমরা যদি বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে, বর্তমান মুসলিম বিশ্বে শিশুদের তা‘লীম-তরবিয়ত ও শিক্ষা-দীক্ষার বেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রচার-মিডিয়া এবং পারিবারিক ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। পারিবারিক ভূমিকা শুধুমাত্র কিছু ওয়াজ নসিহত, উপদেশ আর বাণীর মাঝেই সীমাবদ্ধ। শিশুদের আত্মিক ও মানসিক বিকাশ এবং আল্লাহ প্রদত্ত ফিতরাত বা স্বভাবের প্রতি কোনোও লক্ষ্য নেই। তারা জানেই না কীভাবে তাদের আত্মিক এবং মানসিক বিকাশ সাধন করতে হয়। কীভাবে তাদের তা‘লীম-তরবিয়ত এবং শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। কীভাবে তাদের মধ্যে সভ্যতা-সংস্কৃতি আর মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এ সকল বিষয়ে তাদের কোনো লক্ষ্য নেই।
অত্যন্ত আফসোসের বিষয় যে, আজ পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের ওপর উপনিবেশ সৃষ্টি করছে, আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধে আগ্রাসন চালাচ্ছে। মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা-চেতনা ধ্বংস করে দিচ্ছে, তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি হ্রাস পাচ্ছে। মুসলিম উম্মাহ ও জাতি সার্বিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে। পশ্চিমা সভ্যতার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মুসলিম উম্মাহ জাতির ওপর মহামারীর আকার ধারণ করছে। এখন জাতির প্রত্যেকেই নিজ নিজ অর্থ নিয়েই ব্যস্ত। পার্থিব সম্পদ, আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি আর অহমিকা নিয়েই জীবন-যাপন করছে। সাধারণ সমাজে আজ হিংসা, বিদ্বেষ, যুলুম, নির্যাতন, অন্যায় অবিচার, আর দুর্নীতি বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সামাজিক নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান, সামাজিক কল্যাণ, জনসাধারণের সামাজিক নিরাপত্তা, ইসলাম ও মানবতার মূল্যবোধ, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়-ইনসাফ, আদালত ইত্যাদি বিষয়ের আজ কোনো গুরুত্ব নেই। এমন কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান অথবা সংগঠন পাওয়া যায় না, যারা এ সকল বিষয়ে সাধারণ সমাজ তথা মুসলিম উম্মাহ ও জাতিকে সচেতন করে তুলবে। তাদের শক্তি সামর্থ্য আর মনোবল দিয়ে এ কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করবে এবং অন্যায়ের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিবে।
আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল, মাদরাসা এবং প্রচার মাধ্যমগুলো এ বিষয়ে তাদের আশানুরূপ দায়িত্ব আদায় করছে না। মুসলিম উম্মাহ ও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৎ ও সঠিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে না।
তেমনিভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা একই ধরনের। এ সকল বিষয়ে তাদেরও ভূমিকা একেবারে নগণ্য। তারাও মুসলিম উম্মাহ ও জাতির জন্য যোগ্য শিক্ষক এবং মেধাবী নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না, তাদের জন্য সভা, সেমিনার-আলোচনা, পর্যালোচনার ব্যবস্থা করতে পারছে না। মুসলিম উম্মাহ ও জাতির এহেন পরিস্থিতির মোকাবেলায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
তেমনিভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা ও শিশুদের উন্নয়নে এবং তাদের মধ্যে লুকায়িত আত্মিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে পারছে না। জাতির সংস্কার ও পরিশোধনের জন্য তাদের কাজে স্পৃহা জাগাতে পারছে না।
আমরা যদি শিশুদের তা‘লীম-তরবিয়ত আর শিক্ষা-দীক্ষার বেলায় মুসলিম বিশ্বকে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী এবং সাধারণ বিশ্বের মাঝে তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, মুসলিম বিশ্বের ত্যাগ-তিতিক্ষা, দান-অনুদান অত্যন্ত নগণ্য। মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা, মক্তব, স্কুল এবং সামাজিক তা‘লীম-তরবিয়তী প্রতিষ্ঠানসমূহ সাধারণ জনগণের সাহায্য সহায়তায় অথবা গরীব-দিনমজুর অভিভাবকদের অনুদানে পরিচালিত হয়। যার কারণে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা-ব্যবস্থা, দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষকদের মান-মর্যাদার অবনতি ঘটেছে। তাদের অগ্রগতি উন্নতির মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে।
তেমনিভাবে আমরা যদি মুসলিম বিশ্বের শিক্ষার কারিকুলাম এবং উপকরণাদির প্রতি তাকাই, তাহলে একই অবস্থা দেখতে পাবো। সেখানে পাবো দীর্ঘকাল যাবত দুর্বল, রুগ্ন ও ব্যর্থ শিক্ষা-কারিকুলাম ও সিলেবাস এবং শিক্ষার উপকরণ, যার কারণে শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের আত্মিক, মানসিক ও জৈবিক বিকাশ হচ্ছে না। তাদের মধ্যে জাগরণের স্পৃহা আসছে না, বরং তাদের মধ্যে যুলুম, সন্ত্রাস, অসহায়তা আর হতাশা বিরাজ করছে। এজন্য মুসলিম বিশ্বকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি রক্ষায় দুর্বার চেষ্টা চালাতে হবে। তাহলে মুসলিম বিশ্ব তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারবে।
তেমনিভাবে আমরা যদি আমাদের পুর্বপুরুষদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো যে, তাদের একদিকে যেমন ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের সভ্যতা- সংস্কৃতি, অপর দিকে ছিল না তাদের তা‘লীম-তরবিয়তের আদব-শিষ্টাচারের অগ্রগতি-উন্নতি। অন্ধ অনুকরণের ভিত্তিতে যুলুম-নির্যাতন, সন্ত্রাস আর শারীরিক নির্যাতনের অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের তা‘লীম-তরবিয়তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। একইভাবে তাদের অজ্ঞতা আর মূর্খতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে তাদের পরিবার-ব্যবস্থা, যার কারণে তাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা গবেষণা হ্রাস পেয়েছে। শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা, তা‘লীম-তরবিয়তের রীতি-নীতি ও পদ্ধতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। শিশুদের আত্মিক ও মানসিক এবং জৈবিক বিকাশ কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিবন্ধকতা আর চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এজন্য আমাদের এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে তা‘লীম-তরবিয়ত আর সঠিক শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে সকল চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে আবারও আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারি।