সন্দেহ নেই তাওহীদের কালেমার রয়েছে মহান ফযীলত, অনেক মর্যাদা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা কারো পক্ষেই অনুসন্ধান করে শেষ করা সম্ভব নয়। কারণ, এ কালেমা সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মহান। এ কালেমার জন্যই মখলুক সৃষ্টি, রাসূলদের প্রেরণ ও কিতাব নাযিল করা। এ কালেমার জন্য মানুষ কাফির ও মুমিন দু’ভাগে বিভক্ত, কেউ সৌভাগ্যবান জান্নাতি, কেউ হতভাগা জাহান্নামি। এটাই মজবুত রশি ও তাকওয়ার কালেমা, দীনের মহান রুকন ও ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এ কালেমার দ্বারা জান্নাত লাভ হয় ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি মিলে। এ কালেমা জান্নাতের চাবি, দীনের মূল শিক্ষা, মৌলিক স্তম্ভ ও প্রধান শিরোনাম। এ কালেমার ফযীলত ও মর্যাদা যেভাবে মূল্যায়ন করা হোক, জ্ঞানীরা তা থেকে যত জ্ঞান আহরণ করুক, কারো পক্ষেই তা পূর্ণরূপে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨﴾ [ال عمران: ١٨]
“আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, আর মালায়েকা ও জ্ঞানীগণও (সাক্ষ্য দেন) ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮]
তাওহীদের কালেমা, তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’কে আল্লাহ তা‘আলা সকল নবীর দাওয়াতের নির্যাস ও তাদের রিসালাতের সারাংশ বলেছেন, যা তার বিশেষ ফযীলত সন্দেহ নেই। যেমন, তিনি বলেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥﴾ [الانبياء: ٢٥]
“আর তোমার পূর্বে আমরা যে রাসূলই পাঠিয়েছি, তার প্রতি আমরা এ ওহী নাযিল করি যে, ‘আমি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই’। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ٣٦﴾ [النحل: ٣٦]
“আর আমরা অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগুতকে”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]
সূরা আন-নাহালের শুরুতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يُنَزِّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ بِٱلرُّوحِ مِنۡ أَمۡرِهِۦ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦٓ أَنۡ أَنذِرُوٓاْ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱتَّقُونِ ٢ ﴾ [النحل: ٢]
“তিনি মালায়েকাদের আপন নির্দেশে রূহ দিয়ে নাযিল করেন তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তার প্রতি, যেন তোমরা সতর্ক কর যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নই। অতএব, তোমরা আমাকে ভয় কর”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ২]
অত্র সূরার শুরুতে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের ওপর একাধিক নিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন, তন্মধ্যে لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ (অর্থাৎ আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই) সংবলিত আয়াত সর্বপ্রথম। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাওহীদের কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সবচেয়ে বড় নি‘আমত। এ নি‘আমতই স্বীয় বান্দাদের ওপর পূর্ণরূপে দান করেছেন আল্লাহ, যেমন তিনি বলেছেন:
﴿وَأَسۡبَغَ عَلَيۡكُمۡ نِعَمَهُۥ ظَٰهِرَةٗ وَبَاطِنَةٗۗ ٢٠﴾ [لقمان: ٢٠]
“আর তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নি‘আমত পূর্ণরূপে দিয়েছেন”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ২০]
মুজাহিদ রহ. বলেন, এখানে নি‘আমত দ্বারা উদ্দেশ্য ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।[1]
সুফিয়ান ইবন ‘উইয়াইনাহ রহ. বলেন, আল্লাহ তার কোনো বান্দাকে এমন নি‘আমত দেন নি, যা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ-জ্ঞান থেকে বড়”![2]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: আল্লাহ তা‘আলা এ কালেমাকে কুরআনুল কারীমে তায়্যিবাহ বা পবিত্র বলে গুণান্বিত করেছেন। যেমন, তিনি বলেন,
﴿أَلَمۡ تَرَ كَيۡفَ ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلٗا كَلِمَةٗ طَيِّبَةٗ كَشَجَرَةٖ طَيِّبَةٍ أَصۡلُهَا ثَابِتٞ وَفَرۡعُهَا فِي ٱلسَّمَآءِ ٢٤ تُؤۡتِيٓ أُكُلَهَا كُلَّ حِينِۢ بِإِذۡنِ رَبِّهَاۗ وَيَضۡرِبُ ٱللَّهُ ٱلۡأَمۡثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَذَكَّرُونَ ٢٥﴾ [ابراهيم: ٢٤، ٢٥]
“তুমি কি দেখ না, আল্লাহ কীভাবে উপমা পেশ করেছেন? কালেমা তাইয়্যেবাহ, যা একটি ভালো বৃক্ষের ন্যায়, যার মূল সুস্থির আর শাখা-প্রশাখা আকাশে। সেটি তার রবের অনুমতিতে সব সময় ফল দান করে, আর আল্লাহ মানুষের জন্য নানা দৃষ্টান্ত প্রদান করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে”। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ২৪-২৫]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: আল্লাহ তা‘আলা এ কালেমাকে কুরআনুল কারীমে সুদৃঢ় বাণী বলেছেন। যেমন, তিনি বলেন,
﴿يُثَبِّتُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱلۡقَوۡلِ ٱلثَّابِتِ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِۖ وَيُضِلُّ ٱللَّهُ ٱلظَّٰلِمِينَۚ وَيَفۡعَلُ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ ٢٧﴾ [ابراهيم: ٢٧]
“আল্লাহ অবিচল রাখেন ইমানদারদেরকে সুদৃঢ় বাণী দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। আর আল্লাহ যালিমদের পথভ্রষ্ট করেন এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন”। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ২৭]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা সেই আদি ও পুরনো ওয়াদা, যার উল্লেখ করেছেন আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের নিম্নের আয়াতে:
﴿لَّا يَمۡلِكُونَ ٱلشَّفَٰعَةَ إِلَّا مَنِ ٱتَّخَذَ عِندَ ٱلرَّحۡمَٰنِ عَهۡدٗا ٨٧﴾ [مريم: ٨٧]
“যারা পরম করুণাময়ের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছে তারা ছাড়া অন্য কেউ সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখবে না”। [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৮৭]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “এখানে ‘আহদ’ বা প্রতিশ্রুতি অর্থ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষী প্রদান করা, আর সকল শক্তি ও সামর্থ্যের ওপর ভরসা ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করা, এটাই সকল তাকওয়ার মূল”।[3]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা মজবুত রশি, যে আঁকড়ে ধরবে নাজাত পাবে, আর যে আঁকড়ে ধরবে না ধ্বংস হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ ٢٥٦﴾ [البقرة: ٢٥٦]
“অতএব, যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৬]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَمَن يُسۡلِمۡ وَجۡهَهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰۗ ٢٢﴾ [لقمان: ٢٢]
“আর যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধ চিত্তে আল্লাহর কাছে নিজকে সমর্পণ করে, সে তো শক্ত রশি আঁকড়ে ধরে”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ২২]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা চিরন্তন বাক্য, যা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর রেখে গেছেন, যেন তারা শির্ক থেকে ফিরে আসে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوۡمِهِۦٓ إِنَّنِي بَرَآءٞ مِّمَّا تَعۡبُدُونَ ٢٦ إِلَّا ٱلَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُۥ سَيَهۡدِينِ ٢٧ وَجَعَلَهَا كَلِمَةَۢ بَاقِيَةٗ فِي عَقِبِهِۦ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٢٨﴾ [الزخرف: ٢٦، ٢٨]
“আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম স্বীয় পিতা ও তার কওমকে বলেছিল, ‘তোমরা যেগুলোর ইবাদাত কর, নিশ্চয় আমি তাদের থেকে সম্পর্কমুক্ত, তবে (তিনি ছাড়া) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর নিশ্চয় তিনি আমাকে শীঘ্রই হিদায়াত দিবেন। আর এটিকে সে তার উত্তরসূরিদের মধ্যে এক চিরন্তন বাণী বানিয়ে রেখে গেল, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করতে পারে”। [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ২৬-২৮]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এটা তাকওয়ার কালেমা। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীদের ওপর এ কালেমাই আল্লাহ অবধারিত করেছেন, তারাই এর অধিক হকদার ও উপযুক্ত ছিল, আল্লাহ বলেন,
﴿إِذۡ جَعَلَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ فَأَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ وَعَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَأَلۡزَمَهُمۡ كَلِمَةَ ٱلتَّقۡوَىٰ وَكَانُوٓاْ أَحَقَّ بِهَا وَأَهۡلَهَاۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٢٦﴾ [الفتح: ٢٦]
“যখন কাফিররা তাদের অন্তরে আত্ম-অহমিকা পোষণ করেছিল, জাহেলী যুগের অহমিকা। তখন আল্লাহ তার রাসূল ও মুমিনদের ওপর স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাকওয়ার বাণী তাদের জন্য অপরিহার্য করলেন, আর তারাই ছিল এর সর্বাধিক উপযুক্ত ও এর অধিকারী। আর আল্লাহ হলেন প্রত্যেক বিষয়ে সর্বজ্ঞ”। [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ২৬]
আবু ইসহাক সুবাই‘ঈ বর্ণনা করেন, আমর ইবন মায়মুন বলেছেন: “মানুষ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ থেকে উত্তম কোনো বাক্য উচ্চারণ করে নি। সা‘দ ইবন ইয়াদ বলেন, হে আবু আব্দুল্লাহ, জান এ কালেমা কী? আল্লাহর কসম, এটিই তাকওয়ার কালেমা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের ওপর আল্লাহ যা আবশ্যক করে দিয়েছেন, বস্তুত তারাই এর বেশি হকদার ও উপযুক্ত ছিল”।[4]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা চির সত্য ও চূড়ান্ত বাস্তব কথা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَوۡمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ صَفّٗاۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَقَالَ صَوَابٗا ٣٨﴾ [النبا: ٣٨]
“সেদিন রূহ ও মালায়েকাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে, যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দেবেন সে ছাড়া অন্যরা কোনো কথা বলবে না, আর সে ঠিক কথাই বলবে”। [সূরা আন-নাবা, আয়াত: ৩৮]
আলি ইবন আবু তালহা সাহাবী ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَقَالَ صَوَابٗا প্রসঙ্গে বলেন, “তবে আল্লাহ যাকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষী দিতে বলবেন, একমাত্র সে-ই কথা বলবে। এটাই চূড়ান্ত ও সর্বশেষ সত্য-কথা”।[5]
ইকরিমা রহ. বলেন, “চূড়ান্ত সত্য হচ্ছে: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”।[6]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা সত্যের দাওয়াত, নিম্নের বাণীতে আল্লাহ তা‘আলা সত্যের দাওয়াত বলে এটিই উদ্দেশ্য করেছেন:
﴿لَهُۥ دَعۡوَةُ ٱلۡحَقِّۚ وَٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ لَا يَسۡتَجِيبُونَ لَهُم بِشَيۡءٍ إِلَّا كَبَٰسِطِ كَفَّيۡهِ إِلَى ٱلۡمَآءِ لِيَبۡلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَٰلِغِهِۦۚ وَمَا دُعَآءُ ٱلۡكَٰفِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَٰلٖ ١٤﴾ [الرعد: ١٤]
“সত্যের আহ্বান তাঁরই, আর যারা তাকে ছাড়া অন্যদেরকে ডাকে, তারা তাদের ডাকে সামান্যও সাড়া দিতে পারে না, বরং (তাদের দৃষ্টান্ত) ঐ ব্যক্তির মত, যে পানির দিকে তার দু’হাত বাড়িয়ে দেয় যেন তার মুখে তা পৌঁছে অথচ তার কাছে তা পৌঁছোবার নয়, আর কাফেরদের ডাক তো শুধু ভ্রষ্টতায় পর্যবসিত হয়”। [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১৪]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা সত্যিকার বন্ধন, এর ভিত্তিতে ইসলামের অনুসারীরা এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ হয়। এ কালেমা তাদের নিকট বন্ধুত্ব ও শত্রুতা এবং মহব্বত ও বিদ্বেষের মানদণ্ড। এ কালেমার কারণে মুসলিম উম্মাহ এক শরীর ও শীশা-গালা প্রাচীরের ন্যায়, যার এক অংশ অপর অংশ দ্বারা শক্তিশালী হয়। শাইখ মুহাম্মাদ আমিন শানকিতী রহ. (আদওয়াউল বায়ান) গ্রন্থে বলেন, “মোদ্দাকথা: মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত বন্ধন, যা বিভিন্ন প্রকার মানুষকে এক করে এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে মহব্বত সৃষ্টি করে, সেটি হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর বন্ধন। তুমি কি লক্ষ্য কর নি, এ কালেমা মুসলিম উম্মাহকে এক শরীর ও এক দেয়ালের ন্যায় করে দিয়েছে, যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে। এ কালেমা আসমানের ধারক ও তার আশপাশে অবস্থানকারী মালায়েকাদের অন্তরসমূহকে জমিনে বসবাসকারী আদম সন্তানের ওপর হিতাকাঙ্ক্ষী করে দিয়েছে, অথচ আসমান ও জমিনের দূরত্ব অনেক, এসব তুমি ভেবে দেখ নি?!
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلَّذِينَ يَحۡمِلُونَ ٱلۡعَرۡشَ وَمَنۡ حَوۡلَهُۥ يُسَبِّحُونَ بِحَمۡدِ رَبِّهِمۡ وَيُؤۡمِنُونَ بِهِۦ وَيَسۡتَغۡفِرُونَ لِلَّذِينَ ءَامَنُواْۖ رَبَّنَا وَسِعۡتَ كُلَّ شَيۡءٖ رَّحۡمَةٗ وَعِلۡمٗا فَٱغۡفِرۡ لِلَّذِينَ تَابُواْ وَٱتَّبَعُواْ سَبِيلَكَ وَقِهِمۡ عَذَابَ ٱلۡجَحِيمِ ٧ رَبَّنَا وَأَدۡخِلۡهُمۡ جَنَّٰتِ عَدۡنٍ ٱلَّتِي وَعَدتَّهُمۡ وَمَن صَلَحَ مِنۡ ءَابَآئِهِمۡ وَأَزۡوَٰجِهِمۡ وَذُرِّيَّٰتِهِمۡۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٨ وَقِهِمُ ٱلسَّئَِّاتِۚ وَمَن تَقِ ٱلسَّئَِّاتِ يَوۡمَئِذٖ فَقَدۡ رَحِمۡتَهُۥۚ وَذَٰلِكَ هُوَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ٩﴾ [غافر: ٧، ٩]
“যারা আরশকে ধারণ করে এবং যারা তার চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তার প্রতি ঈমান রাখে, আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলে, ‘হে আমাদের রব, আপনি রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সব কিছুকে পরিব্যাপ্ত করে রয়েছেন। অতএব, যারা তাওবা করে এবং আপনার পথ অনুসরণ করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আর জাহান্নামের আযাব থেকে আপনি তাদেরকে রক্ষা করুন”। [সূরা গাফির, আয়াত: ৭-৯]
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইঙ্গিত করেছেন, আরশ বহনকারী ও তার পাশে যারা রয়েছে তাদের মাঝে ও জমিনে থাকা আদম সন্তানের মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছে আল্লাহর প্রতি ঈমান, যে কারণে তারা জমিনবাসীর জন্য মহান ও কল্যাণময় এরূপ দো‘আ করেছে”।
অতঃপর শানকিতী বলেন, “মোদ্দাকথা: এতে কোনো মুসলিমের দ্বিমত নেই যে, জমিনবাসীর পরস্পর সেতুবন্ধন এবং আসমান ও জমিনে অবস্থানকারীদের সেতুবন্ধন এক ও অভিন্ন কালেমা: ‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ। অতএব এ কালেমা ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো বস্তুকে (যেমন বংশ, ভাষা, স্থান, দেশ ও মতবাদ তথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ ইত্যাদিকে) সেতুবন্ধন বানিয়ে তার দিকে আহ্বান করা কিংবা তার আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হওয়া বৈধ নয়”।[7]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা সবচেয়ে বড় নেকী বা হাসানাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ خَيۡرٞ مِّنۡهَاۖ ٨٤﴾ [القصص: ٨٤]
“কেউ হাসানাহ নিয়ে আসলে তার জন্য থাকবে তা থেকে উত্তম প্রতিদান”। [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮৪]
ইবন মাসউদ, ইবন আব্বাস ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে বর্ণিত, আয়াতে হাসানাহ অর্থ: ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।[8]
ইকরিমাহ রহ. আল্লাহর বাণী (مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ خَيۡرٞ مِّنۡهَاۖ) প্রসঙ্গে বলেন, অর্থাৎ যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নিয়ে আসবে, সে তার কল্যাণ অর্জন করবে, কারণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ অপেক্ষা উত্তম কোনো কল্যাণ নেই।[9]মুসনাদ-এ আহমদ ও অন্যান্য গ্রন্থে এসেছে, আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে একটি আমল শিক্ষা দিন, যা আমাকে জান্নাতের কাছে ও জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে, তিনি বললেন: “যখন মন্দ কিছু কর, তার বিপরীতে ভালো কিছুও কর। কারণ, প্রত্যেক ভালো তার দশগুণ”। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ কি হাসানাহ বা নেকীর অন্তর্ভুক্ত? তিনি বললেন: “হ্যাঁ, সবচেয়ে বড় হাসানাহ এটিই”।[10]
[2] ‘কালিমাতুল ইখলাস’ গ্রন্থে ইবন রজব উল্লেখ করেছেন: (পৃ. ৫৩)
[3] তাবরানী, আদ-দো‘আ: (৩/১৫১৮)
[4] তাবরানী, ফিদ দো‘আ: (৩/১৫৩৩)
[5] তাবরানী, ফিদ দো‘আ: (৩/১৫২০)
[6] তাবরানী, ফিদ দো‘আ: (৩/১৫২০)
[7] আদওয়াউল বায়ান: (৩/৪৪৭) ও (৩/৪৪৮)
[8] আদ-দো‘আ লিত তাবরানী: (৩/১৪৯৭,১৪৯৮)
[9] ইবন আবিদ দুনিয়া রচিত: ‘ফাদলুত তাহলীল ওয়া সাওয়াবুহুল জালীল’: (পৃ. ৭৪)
[10] আল-মুসনাদ: (৫/১৬৯); আদ-দো‘আ লিত-তাবরানী: (১৪৯৮)