ক্বিয়াস দু’প্রকারে বিভক্ত। যথা:
১. الجل (সুস্পষ্ট ক্বিয়াস)।
২. الخفي (অস্পষ্ট ক্বিয়াস)।
১. الجلي (সুস্পষ্ট ক্বিয়াস) যে ক্বিয়াসের ক্ষেত্রে علة (কারণ) نص (কুরআন-হাদীছের স্পষ্ট ভাষ্য) অথবা ইজমার মাধ্যমে জানা যায় অথবা যে কিয়াসে أصل ও فرع এর মাঝে অকাট্ট ভাবে পার্থক্য না থাকে, তাকে ক্বিয়াসে الجلي বা সুস্পষ্ট ক্বিয়াস বলে।
علة (কারণ) نص (কুরআন-হাদীছের স্পষ্ট ভাষ্য) দ্বারা সাব্যস্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত হলো
গোবর দ্বারা কুলুখ নেয়া নিষেধের উপর শুকনা-নাপাক রক্ত দ্বারা কুলুখ নেয়া নিষেধের ক্বিয়াস। কেননা, এখানে أصل এর হুকুমের ইল্লত বা কারণ নিম্নোক্ত نص দ্বারা সাব্যস্ত। نص হলো আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট দু’টি পাথর ও একটি গোবর (কুলুখ নেওয়ার জন্য) এনেছিলেন। অতঃপর তিনি পাথর দু’টি গ্রহণ করেন আর গোবর ফেলে দেন এবং বলেন, এটা ركس অর্থাৎ নাপাক।[1]
ইল্লত ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত হলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিচারককে রাগান্বিত অবস্থায় বিচার-ফয়সালা করতে নিষেধ করেছেন।[2] রাগান্বিত ব্যক্তির বিচার-ফয়সালা করা নিষেধের উপর ক্বিয়াস করে পেশাব-পায়খানার বেগ প্রাপ্ত ব্যক্তির বিচার-ফয়সালা করা নিষেধের ক্বিয়াস, قياس جلي এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ أصل এর ইল্লত ইজমার মাধ্যমে সাব্যস্ত। আর তা হলো অন্তর ও চিন্তার অস্থিরতা।[3]
أصل ও فرع এর মাঝে অকাট্যভাবে পার্থক্য না থাকার দৃষ্টান্ত হলো ইয়াতিমের সম্পদ খেয়ে ধ্বংস করা হারাম হওয়ার উপর কিয়াস করে তার সম্পদ ব্যবহার করে ধ্বংস করা হারাম। কারণ উভয়ের মাঝে অকাট্যভাবে কোন পার্থক্য নেই।
২. الخفي (অস্পষ্ট ক্বিয়াস): যে ক্বিয়াস ইল্লত অনুসন্ধানের মাধ্যমে সাব্যস্ত করতে হয় এবং أصل ও فرع এর মাঝে পার্থক্য না থাকার বিষয়টি অকাট্ট ভাবে বলা যায় না, তাকে قياس خفي বলে। এর উদাহরণ হলো সুদ হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে গমের উপর যবক্ষার ক্বিয়াস করা। ‘পরিমাপ যোগ্য’ হওয়ার কারণে উভয়টির সমন্বিত ইল্লত। এখানে ‘পরিমাপ যোগ্য’ কে ইল্লত বানানো نص বা ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত নয় এবং أصل ও فرع এর মাঝে পার্থক্য না থাকার ব্যাপারে অকাট্ট ভাবে বলা যায় না। কেননা, উভয়ের মাঝে এভাবে পার্থক্য করা যায় যে, গম খাদ্য দ্রব্য পক্ষান্তরে যবক্ষার খাদ্য দ্রব্য নয়।[4]
قياس الشبه (সাদৃশ্যমূলক কিয়াস): ক্বিয়াসের মাঝে আরেকটি হলো قياس الشبه। এটি হলো, যে ক্বিয়াসের فرع ভিন্ন ভিন্ন হুকুম সম্পন্ন দুটি أصل এর মাঝে দোদুল্যমান থাকে। উভয় أصل এর সাথে উক্ত فرع এর সাদৃশ্যতা রয়েছে। তাই উক্ত فرع কে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ أصل এর সাথে যুক্ত করা হবে। এর দৃষ্টান্ত হলো দাসকে স্বাধীন ব্যক্তির উপর ক্বিয়াস করে কোন জিনিসের মালিক বানিয়ে দিলে সে মালিক হবে? নাকি চতুষ্পদ প্রাণীর উপর ক্বিয়াস করে মালিক বানিয়ে দিলেও মালিক হবে না?
যখন আমরা স্বাধীন ব্যক্তি ও চতুষ্পদ জন্তু এ দু’টি أصل এর দিকে লক্ষ্য করবো, আমরা দেখতে পাবো যে, দাস শব্দটি فرع ও أصل উভয় এর মাঝে দোদুল্যমান। দাস জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, সে তার কর্মের শাস্তি ও ছাওয়াব পায়, সে বিবাহ করে, তালাক দেয় এ সব দিক দিয়ে স্বাধীন ব্যক্তির সাথে তার সাদৃশ্যতা রয়েছে। আবার তাকে বিক্রয় করা যায়, বন্ধক রাখা যায়, ওয়াকফ্ করা যায়, দান করা যায় এবং উত্তরাধিকার পণ্য বিবেচিত হয়। সে নিজে কারো ওয়ারিশ হতে পারে না, মূল্যের মাধ্যমে তার ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়,[5] তাকে ব্যবসার পণ্য বানানো যায়,[6] এ সব ক্ষেত্রে সে চতুষ্পদ প্রাণীর সাথে সাদৃশ্য রাখে। সুতরাং আমরা দেখতে পেলাম যে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে চতুষ্পদ প্রাণীর সাথেই তার সাদৃশ্যতা বেশী। সুতরাং এ ক্ষেত্রে তাকে চতুষ্পদ প্রাণীর হুকুমের সাথেই যুক্ত করা হবে।
এ প্রকারের ক্বিয়াস দুর্বল। কেননা, এখানে দাসের সাথে أصل এর অধিকাংশ হুকুমের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রাখা ছাড়া উপযুক্ত কোন ইল্লত নেই। উপরন্তু ভিন্ন হুকুমের আরো একটি أصل তার সাথে সাংঘর্ষিক রয়েছে।
قياس العكس : ক্বিয়াসের মধ্যে আরো এক ধরণের ক্বিয়াস রয়েছে। যাকে قياس العكس বা বিপরীতধর্মী ক্বিয়াস বলে। এটি হল أصل এর হুকুমের যে ইল্লত রয়েছে, তার বিপরীত ইল্লত فرع এর মাঝে বিদ্যমান থাকার কারণে أصل এর হুকুমের বিপরীত হুকুম فرع এর জন্য সাব্যস্ত করা।
উসুলবিদগণ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এর নিম্নোক্ত বাণীর মাধ্যমে এর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।
وفي بضع أحدكم صدقة.. قالوا يا رسول الله! أياتي أحدنا شهوته ويكون له فيها أجر؟ قال: أرأيتم لو وضعها في حرام أكان عليه وزر؟ فكذالك اذا وضعها في الحلال كان له أجر
‘‘স্ত্রীর সাথে তোমাদের মেলা-মেশা করাতেও তোমাদের জন্য ছাওয়াব রয়েছে। ছাহাবীরা বললেন, আমাদের কোন ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করবে, আর তাতেও তার জন্য সাওয়াব হবে? তিনি বললেন, তোমাদের কি অভিমত, যদি সে এটি হারাম স্থানে ব্যবহার করতো, তবে কি তার পাপ হতো না? (নিশ্চয়ই হতো)। অনুরূপ ভাবে যখন সে এটাকে হালাল পন্থায় ব্যবহার করবে, তবে তার জন্য ছাওয়াব নির্ধারিত হবে।’’[7]
أصل এর হুকুমের ইল্লতের বিপরীত ইল্লত فرع এর মাঝে পাওয়ার কারণে فرع (অর্থাৎ বৈধ মিলন) এর জন্য أصل (অবৈধ মিলন) এর বিপরীত হুকুম সাব্যস্ত করেছেন। فرع এর জন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাওয়াব সাব্যস্ত করেছেন। যেহেতু এটি বৈধ মিলন। যেমনিভাবে أصل এর জন্য পাপ সাব্যস্ত করেছেন। কেননা, এটি অবৈধ মিলন।
[2]. ছ্বহীহ বুখারী হা/৭১৫৮
[3]. রাগান্বিত অবস্থায় বিচার ফায়ছালা করা নিষেধ। কারণ এ সময় মানুষের চিন্তা-চেতনা অস্থির থাকে। এর উপর ক্বিয়াস করে পেশাব-পায়খানার চাপ থাকা অবস্থায়ও বিচার ফায়ছালা করবে না। কেননা, এ অবস্থাতেও মানুষের চিন্তা-চেতনা অস্থির থাকে।
[4]. الأشنان (যবক্ষার) হলো বালুময় জায়গায় উৎপন্ন এক প্রকার উদ্ভিদ, যেগুলিকে কাপড়, হাত প্রভৃতি ধোয়ার জন্য ক্ষার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
[5]. অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি কোন দাসকে হত্যা করে, তবে হত্যাকারী দাসের মালিককে দাসের মূল্য পরিশোধ করবে, যে মূল্য দিয়ে মালিক দাসটি ক্রয় করেছিলেন।
[6]. কিন্তু স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করলে, হত্যার বিনিময়ে হত্যা অথবা রক্তমূল্য (একশত উটের সমপরিমাণ মূল্য) পরিশোধ করতে হবে।
অর্থাৎ তাকে বেচা-কেনা করা যায়।
[7]. ছ্বহীহ মুসলিম হা/১০০৬