মীক্বাত (ইবাদাতের স্থান ও সময়) দুই ভাগে বিভক্ত:
(১) মীক্বাত যামানী (কালগত মীক্বাত)
(২) মীক্বাত মাকানী (স্থানগত মীক্বাত)
মীক্বাত যামানী (কালগত মীক্বাত) একমাত্র হাজ্জের সাথে সংশিস্নষ্ট। পক্ষান্তরে উমরার জন্য কোন বিশেষ সময়কাল নির্ধারিত নেই। এর দলীল-প্রমাণ: আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন:
الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَّعْلُومَاتٌ
হাজ্জ হয় কয়েকটি নির্দিষ্ট মাসে।[1] আর তা হল শাওয়াল, যুলকা’দাহ এবং যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন।[2]
আর মীক্বাত মাকানী (স্থানগত মীক্বাত) হলো পাঁচটি, যা আল্লাহর রসূল (সা.) নির্ধারিত করেছেন।
যেমন আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) মীক্বাত নির্ধারিত করেছেন: মদীনাবাসীদের জন্য “যুলহুলাইফা” নামক স্থানকে (যার বর্তমান নাম আবয়ার আলী), শামবাসীদের জন্য “জুহফা” নামক স্থানকে, নজদবাসীদের জন্য “কারনুল মানাযিল” নামক স্থানকে (যার বর্তমান নাম আসসায়ল) এবং ইয়ামানবাসীদের জন্য “ইয়ালামলাম” নামক স্থানকে।[3]
এই মীক্বাতগুলি এই এলাকাবাসীদের জন্যে এবং ঐ সব লোকের জন্যে যারা অন্য এলাকা থেকে এই পথ হয়ে আগমন করবে, যদি তারা হাজ্জ বা উমরার নিয়্যাতে আসে। (তাই কেউ যদি এই দুই উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে মক্কা আসে তাহলে তার বিনা ইহরামে মক্কা প্রবেশে কোন বাধা নেই)। আর যে ব্যক্তি মীক্বাতের ভিতরে অবস্থান করে সে নিজ গৃহ হতেই ইহরাম করবে, এমন কি মক্কাবাসী মক্কা হতেই ইহরাম করবে।[4]
আরো আয়িশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, নাবী (সা.) ইরাক্ববাসীদের জন্যে “যাতু ইরক” নামক স্থানকে মীক্বাত নির্ধারিত করেন।[5]
১। প্রথম মীক্বাত: যুল হুলায়ফা, যাকে আব্য়ার আলীও বলা হয়। যা মদীনা থেকে প্রায় ১০ কি.মি. দূরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এবং মক্কা থেকে প্রায় চার শত পঞ্চাশ (৪৫০ কি. মি.) দূরে উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। ইহা মদীনাবাসী এবং যারা সেপথ হয়ে অতিক্রম করবে তাদের মীক্বাত।
২। দ্বিতীয় মীক্বাত: জুহ্ফা, ইহা একটি প্রাচীন গ্রাম, (যা মক্কা থেকে উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত) যেখান থেকে মক্কার দূরত্ব প্রায় এক শত পঁচাশী (১৮৫ কি. মি.)। এ গ্রামটি অনাবাদ হয়ে যাওয়ার কারণে লোকেরা বর্তমানে (জুহফার নিকটস্থ) রাবিগ শহর হতে ইহরাম বাঁধে। ইহা শাম বা সিরিয়া, মরোক্ক, মিসরের অধিবাসী এবং যারা সেই পথ হয়ে অতিক্রম করবে তাদের মীক্বাত। যদি তারা তার পূর্বে যুলহুলায়ফা হয়ে অতিক্রম না করে থাকে, কেননা যদি যুলহুলায়ফা হয়ে অতিক্রম করার পর যুহফা হয়ে আসে তাহলে যুলহুলায়ফা থেকেই ইহরাম করতে হবে।
৩। তৃতীয় মীক্বাত: কার্নুল মানাযিল, যার বর্তমান নাম “আস্সায়লুল কাবীর”। (যা মক্কা থেকে উত্তর-পূর্বে অবস্থিত) যেখান থেকে মক্কার দূরত্ব প্রায় পঁচাশি (৮৫ কি. মি.)। ইহা নাজদবাসী এবং যারা তাদের পথ হয়ে অতিক্রম করবে তাদের মীক্বাত।
৪। চতুর্থ মীক্বাত: ইয়ালামলাম্, যা তিহামা নামক এলাকার একটি পর্বত বা বিশেষ স্থানের নাম। (যা মক্কা থেকে দক্ষিনে অবস্থিত) যেখান থেকে মাক্কার দূরত্ব প্রায় বিরানব্বই (৯২ কি. মি.) যার বর্তমান নাম ‘সা’দিয়াহ’ ইহা ইয়মানবাসী এবং তাদের পথ হয়ে অতিক্রকারীদের মীক্বাত।
[বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে যে সব হাজীরা (জলপথে) জাহাজে ভারত মহাসাগর হয়ে হাজ্জের উদ্দেশ্যে আসতেন তাদেরও মীক্বাত ছিল ইয়ালামলাম্। কিন্তু বর্তমানে উড়োজাহাজে পূর্ব দিক থেকে আসার কারণে তাদের মীক্বাত হবে “কারনুল মানাযিল” যার বর্তমান নাম “আস্সায়লুল কাবীর”। সুতরাং উপমহাদেশ থেকে আগত হাজী সাহেবগণকে জেদ্দা অবতরণের পূর্বেই ইহরাম করে নিতে হবে]
৫। পঞ্চম মীক্বাত: যাতু ইর্ক, নাজদবাসীরা ইহাকে “যারীবাহ” বলে থাকে, (যা মক্কা থেকে পূর্ব উত্তরে অবস্থিত) যেখান থেকে মক্কার দূরত্ব প্রায় চুরানব্বই (৯৪ কি. মি.)। ইহা ইরাকবাসী এবং যারা এই পথ হয়ে অতিক্রম করবে তাদের মীক্বাত।
আর যে সকল লোকেরা এসমস্ত মীক্বাতের ভিতরে বসবাস করে তাদের মীক্বাত হচ্ছে নিজ নিজ গৃহ। সুতরাং তারা নিজ বাসস্থান থেকেই ইহরাম করবে। এমন কি মক্কাবাসীরা মক্কা থেকেই ইহরাম করবে, তবে উমরার ক্ষেত্রে হারাম এলাকায় বসবাসকারীরা ইহরাম বাঁধার উদ্দেশ্যে নিকটবর্তী হালাল এলাকায় গমন করবে।
কারণ, মা আয়িশা (রা.) যখন উমরা করার আকাঙ্খা প্রকাশ করলেন তখন প্রিয় নাবী (সা.) আব্দুর রাহমান বিন আবু বাকরকে বলেন: তোমার বোন আয়িশা (রা.)-কে হারাম এলাকা থেকে তানঈম নামক স্থানে (যা কা’বা ঘর থেকে নিকটবর্তী হালাল এলাকা, মাসজিদুল হারাম থেকে ৬ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত) নিয়ে যাও, সে যেন সেখান থেকে উমরার ইহরাম করে।[6]
আর যে সব লোকের রাস্তা এ মীক্বাতগুলি থেকে ডানে বা বামে অবস্থিত তারা নিকটবর্তী মীক্বাতের বরাবর এসে ইহরাম বাঁধবে। আর যদি তারা এমন এলাকার লোক হয় যা কোন মীক্বাত বরাবর পড়ছে না যেমন সুডানের সাওয়াকিন নামক স্থানের অধিবাসীরা এবং যারা তাদের পথ হয়ে অতিক্রম করবে তারা জেদ্দা হতে ইহরাম করবে।
আর যদি কোন ব্যক্তি হাজ্জ বা উমরার উদ্দেশ্যে এ মীক্বাতগুলি হয়ে অতিক্রম করে তাহলে বিনা ইহরামে মীক্বাত অতিক্রম করা জায়েয নয়। অতএব যদি কোন ব্যক্তি উড়োজাহাজে হাজ্জ বা উমরার উদ্দেশ্যে সফর করে তাহলে আকাশ পথে মীক্বাত বরাবর হলেই ইহরাম করা ওয়াজিব। তাই এরকম ব্যক্তি মীক্বাত বরাবর হওয়ার পূর্বেই ইহরামের কাপড় পরিধান করে প্রস্ত্তত থাকবে। অতঃপর মীক্বাত বরাবর হলেই দ্রুত ইহরামের নিয়ত করে ফেলবে, এরকম লোকের জন্য জেদ্দা বিমান বন্দরে নেমে বিলম্বে ইহরাম করা জায়েয নয়। কারণ, ইহা মহান আল্লাহর সীমানালঙ্ঘন করার অমর্ত্মভুক্ত। আর আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
(وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَقَدْ ظَلَمَ نَفْسَهُ)
এগুলো আল্লাহর সীমারেখা, আর যে কেউ আল্লাহর সীমারেখা লঙ্ঘন করে, সে নিজের উপরই যুলুম করে।[7]
(تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَعْتَدُوهَا وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ اللّهِ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ)
এগুলো আল্লাহর আইন, কাজেই তোমরা এগুলোকে লঙ্ঘন করো না, আর যারা আল্লাহর আইনসমূহ লঙ্ঘন করে তারাই যালিম।[8]
(وَمَن يَعْصِ اللّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَاراً خَالِداً فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِينٌ)
আর যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমানী করবে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন, সে তাতে চিরবাসী হবে এবং সে অবমাননাকর শাস্তি ভোগ করবে।[9]
আর কোন ব্যক্তি যদি মীক্বাত হয়ে অতিক্রম করার সময় হাজ্জ কিংবা উমরার কোন উদ্দেশ্য না রাখে, অতঃপর মীক্বাতের ভিতরে গিয়ে তার হাজ্জ বা উমরা করার ইচ্ছা হয়, তাহলে যেখানে সে সংকল্প করেছে সেখান থেকেই ইহরাম করবে।
এর প্রমাণ আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত মীক্বাত সম্পর্কীত হাদীস, নাবী (সা.) বলেন: যে ব্যক্তি মীক্বাতের ভিতরে অবস্থান করবে তার ইহরাম সেই স্থান থেকেই করবে যেখানে সে সংকল্প করেছে।[10]
আর যদি কেউ মীক্বাত হয়ে অতিক্রম করল, কিন্তু তার হাজ্জ বা উমরা করার কোন ইচ্ছা নেই বরং সে অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে মক্কায় যাচ্ছে, যেমন বিদ্যার্জনের জন্য বা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কিংবা রোগের চিকিৎসার জন্য অথবা ব্যবসা-বানিজ্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে, তাহলে তার প্রতি ইহরাম করা আবশ্যক নয় বিশেষ করে সে যদি এর পূর্বে তার ফরয হাজ্জ ও উমরা আদায় করে নিয়ে থাকে।
এর প্রমাণ ইবনু আব্বাস (রা.)-এর বর্ণিত উপরোল্লিখিত হাদীস, তাতে রয়েছে: এই মীক্বাতগুলি এই এলাকবাসীদের জন্যে এবং ঐ সব লোকের জন্যে যারা অন্য এলাকা থেকে এই পথ হয়ে আগমন করবে, যদি তারা হাজ্জ বা উমরার নিয়তে আসে। সুতরাং এই হাদীসের অর্থ ইহাই প্রকাশ পায় যে, কেউ যদি এই দুই উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে মক্কা আসে তাহলে তার প্রতি ইহরাম করা ওয়াজিব নয়।
আর মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি ফরয হাজ্জ ও উমরা আদায় করে ফেলেছে তার প্রতি হাজ্জ ও উমরার নিয়ত করে মক্কা আসা আবশ্যক নয়; কেননা হাজ্জ ও উমরা জীবনে মাত্র একবার ফরয।
যার দলীল নাবী (সা.) এর হাদীস, যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়; হাজ্জ কি প্রতি বছর ফরয? উত্তরে তিনি (সা.) বলেন:
اَلْحَجُّ مَرَّةٌ, فَمَا زَادَ فَهُوَ تَطَوُّعٌ
হাজ্জ জীবনে একবার ফরয, তার বেশী যা হবে তা নফল।[11] আর উমরাও হাজ্জের মতই জীবনে মাত্র একবার ফরয। তবে যে ব্যক্তি হাজ্জের মাসে মীক্বাত হয়ে অতিক্রম করবে তার জন্য উত্তম হচ্ছে হাজ্জ বা উমরার ইহরাম করে মক্কায় প্রবেশ করা, যদিও পূর্বে সে ফরয হাজ্জ আদায় করে ফেলেছে। যাতে করে হাজ্জ ও উমরার নেকী হাসিল হয়ে যায় এবং মক্কায় প্রবেশের ইহরাম করার আবশ্যকতা সম্পর্কে যে ইমাগণের মতভেদ রয়েছে তা থেকে মুক্ত হতে পারে।
>[2]. সহীহ বুখারী ১৫৬০ নং হাদীসের বাব দেখুন।
[3]. সহীহ বুখারী ১৫২৪, ১৫২৬, সহীহ মুসলিম ১১৮১, সুনানে দারিমী ১৮৩৩, নাসাঈ ২৬৫৩।
[4]. সহীহ বুখারী ১৫২৪, সহীহ মুসলিম ১১৮১, সুনানে দারিমী ১৮৩৩, নাসাঈ ২৬৫৩।
[5]. সুনান আবূ দাউদ ১৭৩৯ ও সুনান নাসঈ ২৬৫৩, সহীহ বুখারী ১৫৩১।
[6]. সহীহ বুখারী ১৫১৮ ও মুসলিম।
[7]. সূরাহ্ ত্বালাক্বঃ ১
[8]. সূরা আল-বাক্বারা: ২২৯
[9]. সূরাহ্ আন্-নিসাঃ ১৪
[10]. সহীহ বুখারী ১৫২৬, সহীহ মুসলিম।
[11]. সহীহ: মুসনাদে আহমাদ ২৩০৪, আবূ দাউদ ১৭২১ ও নাসাঈ ২৬২০।
হাজ্জ তিন ভাগে বিভক্ত:
(১) হাজ্জে তামাত্তু (২) হাজ্জে ক্বিরান ও ৩) হাজ্জে ইফরাদ।
প্রথম: হাজ্জে তামাত্তু অর্থাৎ হাজ্জের সঙ্গে উমরা পালনের মাধ্যমে লাভবান হওয়া। তার নিয়ম হলো, হাজ্জের মাসে শুধু মাত্র উমরার ইহরাম করবে, অতঃপর বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার সাঈ ও চুল ছোট করার মাধ্যমে তা সমাপ্ত করে ইহরাম হতে হালাল হয়ে যাবে। অতঃপর সেই বছরেই হাজ্জের সময়ে (তারবিয়াহর দিন অর্থাৎ আটই যিলহাজ্জ) হাজ্জের ইহরাম করবে।
দ্বিতীয়: হাজ্জে ক্বিরান। তার নিয়ম হলো, হাজ্জের মাসে উমরা ও হাজ্জের এক সঙ্গে নিয়ত করে ইহরাম করা, কিংবা প্রথমত উমরার ইহরাম করে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ আরম্ভ করার পূর্বেই তার সাথে হাজ্জে নিয়ত মিলিয়ে নেয়া। অতএব মক্কা পৌঁছালে তাওয়াফে কদূম করবে এবং উমরা ও হাজ্জের উদ্দেশ্যে সাফা ও মারওয়ার একটিমাত্র সাঈ করবে, তারপর ঈদের দিন পর্যন্ত নিজ ইহরামে অব্যাহত থাকবে। আর যদি কেউ তাওয়াফে কদূমের সাথে সাঈ না করে হাজ্জের তাওয়াফের (তাওয়াফে ইফাযা বা যিয়ারা) পর সাঈ করে তবুও জায়েয হবে। বিশেষ করে যদি সে ব্যক্তি মক্কায় বিলম্বে পৌঁছে থাকে এবং সাঈ করায় ব্যস্ত হয়ে গেলে হাজ্জ (আরাফায় অবস্থান) ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে সাঈ পরে সম্পাদন করবে।
তৃতীয়: হাজ্জে ইফরাদ। তার নিয়ম হলো, হাজ্জের মাসে শুধু মাত্র হাজ্জের ইহরাম করা। অতএব মক্কা পৌঁছালে তাওয়াফে কদূম করবে এবং হাজ্জের উদ্দেশ্যে সাফা ও মারওয়ার সাঈ করবে, তারপর ঈদের দিন পর্যন্ত নিজ ইহরামে অব্যাহত থাকবে। আর যদি কেউ তাওয়াফে কদূমের সাথে সাঈ না করে কিরান হাজ্জকারীর মতই হাজ্জের তাওয়াফের (তাওয়াফে ইফাযা বা যিয়ারা) পর সাঈ করে তবুও জায়েয হবে।
এ বাখ্যা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, ইফরাদ হাজ্জকারী এবং ক্বিরান হাজ্জকারীর কর্যাবলী একই রকম। শুধুমাত্র পার্থক্য হচ্ছে যে, ক্বিরানকারীর প্রতি হাদী (কুরবানী) যবহ করা ওয়াজিব, ইফরাদ হাজ্জকারীর উপর ওয়াজিব নয়। কেননা ক্বিরান হাজ্জকারী হাজ্জের মাসে উমরা ও হাজ্জ দুটোই ইবাদাত সম্পাদন করে, পক্ষান্তরে ইফরাদ হাজ্জকারী ব্যক্তি শুধুমাত্র হাজ্জ সম্পাদন করে।
এ তিন প্রকারের হাজ্জের মধ্যে উত্তম হল হাজ্জে তামাত্তু। কারণ, নাবী (সা.) নিজ সহচরগণকে হাজ্জে তামাত্তুর নির্দেশ প্রদান করেন ও তার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। শুধু তাই নয়, বরং তাঁদেরকে তামাত্তু হাজ্জের উদ্দেশ্যে হাজ্জের নিয়ত উমরার নিয়তে পরিবর্তন করার আদেশ প্রদান করেন।
যেমন ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তাঁকে হাজ্জে তামাত্তু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তখন তিনি বলেন, মুহাজির, আনসারীগণ এবং নাবী (সা.) এর বিবিগণ বিদায় হাজ্জে ইহরাম করেন এবং আমরাও ইহরাম করি। অতএব মক্কা পৌঁছিলে নবী (সা.) বলেন: তোমাদের হাজ্জের ইহরামকে উমরায় পরিবর্তন করে নাও, তবে যারা হাদীর (কুরবানী) পশু সঙ্গে নিয়ে এসেছে তারা ইহরাম অবস্থায় থেকে কুরবানীর দিন কুরবানী যবহ করে হালাল হবে। (তারা উমরাহ্ করে হালাল হয়ে হাজ্জে তামাত্তু করতে পারবে না।) সুতরাং আমরা বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করলাম, সাফা ও মারওয়ার সাঈ করলাম এবং নিজ নিজ স্ত্রীদের সঙ্গে মিলা-মেশা করলাম ও বিভিন্ন প্রকারের সিলাইকৃত কাপড় পরলাম।[1]
জাবির (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রসূল (সা.) এর সঙ্গে হাজ্জের (হাজ্জে ইফরাদ) ইহরাম করে বের হয়েছিলাম, আমাদের সঙ্গে মহিলারা ছিল এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরাও ছিল। সুতরাং মক্কায় পদার্পণ করে বায়তুল্লার তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়ার সাঈ করলাম। অতঃপর আল্লাহর রসূল (সা.) আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন: যার কাছে হাদী (কুরবানীর পশু) নেই সে যেন হালাল হয়ে যায়। জাবির (রা.) বলেন, আমরা বললাম, কোন ধরণের হালাল হবো? তিনি (সা.) উত্তরে বললেন: সম্পূর্ণরূপে হালাল হয়ে যাও। জাবির (রা.) বলেন, সুতরাং আমরা নিজ নিজ স্ত্রীদের সঙ্গে মিলা-মেশা করলাম, বিভিন্ন প্রকারের সিলাইকৃত কাপড় পরলাম এবং সুগন্ধী ব্যবহার করলাম। তারপর তারবিয়ার দিন (আটই যিলহাজ্জ) হলে আমরা হাজ্জের ইহরাম করি।[2]
মুসলিমের অপর একটি বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাদের মাঝে বক্তব্যের জন্য দাঁড়ালেন, অতঃপর বললেন:
قَدْ عَلِمْتُمْ أَنِّي أَتْقَاكُمْ لِلَّهِ وَأَصْدَقُكُمْ وَأَبَرُّكُمْ وَلَوْلَا هَدْيِي لَحَلَلْتُ كَمَا تَحِلُّونَ وَلَوْ اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِي مَا اسْتَدْبَرْتُ لَمْ أَسُقْ الْهَدْيَ فَحِلُّوا فَحَلَلْنَا وَسَمِعْنَا وَأَطَعْنَا
তোমরা ভাল করে জানো যে, আমি সর্বাপেক্ষা বেশী আল্লাহকে ভয় করি, সর্বাপেক্ষা সত্য কথা বলি এবং সর্বাধিক নেক কর্ম করি। আমার নিকট যদি হাদী (কুরবানীর পশু) না থাকত তাহলে তোমাদের মতই (উমরা করে) হালাল হয়ে যেতাম আর যদি আমি পূর্বে জানতে পারতাম যা পরে জানলাম (যে, হাজ্জে তামাত্তু করা যাবে) তাহলে আমি হাদীর পশু সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম না। অতএব তোমরা হালাল হয়ে যাও। তাই আমরা নাবী (সা.) এর কথা শুনে তা মেনে (উমরা করে) হালাল হয়ে গেলাম।[3]
ইহা তামাত্তু হাজ্জের উত্তম হওয়ার স্পষ্ট দলীল। কারণ নাবী (সা.) বলেছেন:
لَوْ أَنِّي اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِي مَا اسْتَدْبَرْتُ لَمْ أَسُقْ الْهَدْيَ وَجَعَلْتُهَا عُمْرَةً فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ لَيْسَ مَعَهُ هَدْيٌ فَلْيَحِلَّ وَلْيَجْعَلْهَا عُمْرَة
যদি আমি পূর্বে জানতে পারতাম যা পরে জানলাম (যে, হাজ্জের মাসে উমরাহ্ পালনের মাধ্যমে হাজ্জে তামাত্তু করা যাবে) তাহলে আমি হাদীর (কুরবানীর) পশু সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম না এবং ইহাকে উমরাহ করে নিতাম। অতএব তোমাদের মধ্যে কারো সঙ্গে যদি হাদীর (কুরবানীর) পশু না থাকে তাহলে যেন সে উমরাহ করে হালাল হয়ে যায়।[4]
তাহলে রসূল (সা.) এর উমরা করে হালাল হওয়াই বাধা ছিল একমাত্র হাদী (কুরবানীর পশু) সঙ্গে নিয়ে আসা। আর হাজীর জন্য তামাত্তু করাই হচ্ছে সহজতর, কেননা তাতে হাজ্জ ও উমরার মাঝখানে হালাল হয়ে সম্ভোগ করতে পারে। আর ইহাই মহান আল্লাহর এই বাণীর উদ্দেশ্যের অনুকুলে, তাই ইরশাদ হচ্ছে:
(يُرِيدُ اللّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ )البقرة185
আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, যা কষ্টদায়ক তা চান না।[5]
নাবী (সা.) বলেন: আমাকে সহজ-সরল ধর্মাদর্শ দিয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।[6]
কখনো হাজ্জে তামাত্তুর নিয়তে ইহরামকারী আরফায় অবস্থানের পূর্বে উমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হয় না। যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে উমরার তাওয়াফ শুরু করার পূর্বে উমরার মধ্যে হাজ্জকে ঢুকিয়ে নিয়ে ক্বিরান করে নিবে। এর দুটি দৃষ্টান্ত রয়েছে:
প্রথম দৃষ্টান্ত: কোন মহিলা তামাত্তুর নিয়তে উমরার ইহরাম করল, অতঃপর তাওয়াফ সম্পাদন করার পূর্বেই হায়য (মাসিক ঋতু) বা নিফাস (সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরে রক্তস্রাব) আরম্ভ হয়ে গেল। এমন কি আরাফায় অবস্থানের সময়ের পূর্বে সে পবিত্রতা অর্জন করতে পারল না, তাহলে সে হাজ্জের ইহরাম করে নিবে এবং নিজ হাজ্জকে হাজ্জে ক্বিরানে রূপান্তরিত করে ফেলবে। আর হাজীগণ যে সমস্ত কাজ করে তাই করবে একমাত্র বায়তুল্লাহর তাওয়াফ এবং সাফা ও মারওয়ার সাঈ ছাড়া, পবিত্রতা অর্জন এবং গোসলের পরে তাওয়াফ করবে। (আর সাঈ তাওয়াফের পরে হওয়াই শরিয়াত সম্মত বিধান)।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত: কোন ব্যক্তি যদি তামাত্তুর নিয়তে উমরার ইহরাম করল, অতঃপর যদি আরাফায় অবস্থানের সময়ের পূর্বে সে মক্কায় প্রবেশ করতে সক্ষম না হয়, তাহলে হাজ্জকে উমরায় ঢুকিয়ে নিয়ে হাজ্জে ক্বিরান করে নিবে। কেননা সে উমরাহ সম্পাদন করার মত যথেষ্ট সময় পেল না।
[2]. সহীহ মুসলিম ১২১৩।
[3]. সহীহ মুসলিম ১২১৬।
[4]. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম ১২১৮।
[5] সূরা আল-বাক্বারা ২ঃ ১৮৫
[6]. আহমাদ, হাদীসটিকে ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, দেখুন সিলসিলা সহীহা হাঃ নঃ ২৯২৪