ড. দাঈর প্রতিবন্ধকতা (عوائق الداعي إلى الله)

প্রত্যেক দাঈরই কিছু না কিছু প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে, যেগুলিতার দা‘ওয়াতী কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করে বা হতোদ্যম করে ফেলে বা বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে। তাই সেসব প্রতিবন্ধকতা এবং সেগুলি থেকে মুক্তি ও সতর্কতা লাভের উপায় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এ অন্তরায় শয়তানের অপচেষ্টা, যার মাধ্যমে সে হক্ব থেকে সৃষ্টিকে পথভ্রষ্টতার দিকে পরিচালিত করে এবং দ্বীন থেকে বিচ্যুত করে।

১। যখন কোন মুসলিম দা‘ওয়াতী কাজ করে, তখন চির শত্রু শয়তান তার কাছে আসে এবং কুফরী ও ফাসাদের বিস্তার আর অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারীদের সংখ্যা বেশি দেখিয়ে তার স্পৃহাকে টুকরা টুকরা করে ফেলে। শয়তানের এ পদক্ষেপের চিকিৎসা নিতে হবে নিম্নোক্ত আয়াতে কারীমা থেকেঃ

(اعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يُحْيِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ (17)) ... [الحديد: 17].

‘তোমরা জেনে রাখ যে, আল্লাহ যমীনকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। আমি নিদর্শনসমূহ তোমাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি, আশা করা যায় তোমরা বুঝতে পারবে’ (সূরা আল-হাদীদ: ১৭)।

২। যশ-খ্যাতির ভালোবাসা কখনও দাঈকে আক্রমণ করতে পারে। আর এর মাধ্যমে মূলতঃ তার স্পৃহার মাথায় আঘাত করা হয়। ফলে, তার স্পৃহা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে এবং ইখলাছ হারিয়ে ফেলার কারণে তার আমল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা এর চিকিৎসা নিতে হবেঃ

(يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ) ... [المائدة: 8]

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষদানকারী হিসাবে সদা দণ্ডায়মান হও (সূরা আল-মায়েদা: ৮)।

৩। এরপর দা‘ওয়াতী ময়দানে আমল বিনষ্টকারী ও ভিত্তি ধ্বংসকারী বিষয় ‘তাড়াহুড়া নামক রোগ’ আসতে পারে। ফলে, আমলের সমন্বয়ের অভাবে এবং তা তার যথাযোগ্য স্থানে না রাখার কারণে তা অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী থেকে শিক্ষা নিতে হবেঃ

(يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ) [آل عمران: 200]

‘হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ধর ও ধৈর্যে অটল থাক এবং পাহারায় নিয়োজিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও’ (সূরা আলে ইমরান: ২০০)।

৪। অতঃপর দা‘ওয়াতী কাজে পরামর্শ না করে ব্যক্তিগত মতামতকে অগ্রাধিকার দিলে তা দা‘ওয়াতী কর্ম বিনষ্ট করে এবং আল্লাহর সাহায্য উঠিয়ে দেওয়ার কারণে পরিণত হয়। অবশেষে তা মুসলিমদের পরাজিত করে শত্রুদের রাজত্ব ও কর্তৃত্ব ক্বায়েম করে। এজন্য আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিতঃ

(وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ) ... [الشورى: 38]

‘তাদের কার্যাবলী হয় তাদের মধ্যে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে’ (সূরা আশ-শুরা: ৩৮)।

৫। অতঃপর শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে চিন্তাভাবনার বিষয়টি সামনে আসতে পারে। ফলে, দাঈ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে এবং অন্যের কথা অবজ্ঞা করে। এতে কিন্তু দা‘ওয়াতী কাজের ভিত্তি মজবুত হয় না, ভাল ফলাফলও আশা করা যায় না। মনে রাখতে হবে, মানুষের মধ্যে উত্তম তারাই, যারা অন্যের কল্যাণে অধিক অগ্রগামী। আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী থেকে শিক্ষা নিতে হবেঃ

(وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ (2)) ... [المائدة: 2].

‘সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। আর মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর’ (সূরা আল-মায়েদা: ২)।

৬। অতঃপর দা‘ওয়াতী ময়দানে প্রতারক আরেক শত্রুর উদ্ভব ঘটতে পারে। আর তা হচ্ছে, ‘তাক্বলীদ’। এই তাক্বলীদ অলস ও অকর্মা লোকদের তাক্বলীদে ঢুকিয়ে দেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে। এর ফলে দাঈর স্পৃহার পিঠ ভেঙ্গে যায়, অলস ও অজ্ঞদের সংখ্যা বেড়ে যায়, বিদ‘আত সৃষ্টি হয় এবং সুন্নাত বিদায় নেয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিতঃ

(انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (41)) [التوبة: 41]

‘তোমরা হালকা ও ভারী উভয় অবস্থায় যুদ্ধে বের হও এবং তোমাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে’ (সূরা আত-তাওবা: ৪১)।

৭। অতঃপর ধোঁকাবাজ আরেক শত্রু মাথাচাড়া দিতে পারে। আর তা হচ্ছে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে সৃষ্ট ‘গড়িমসি’। এর ফলে, দাঈ আজকের কাজ কালকের জন্য রেখে দেয় এবং এক পর্যায়ে শয়তান তা ভুলিয়ে দিয়ে অন্য কিছুতে তাকে ব্যস্ত করে দেয়। নিম্নোক্ত আয়াত থেকে এর চিকিৎসা গ্রহণ করা যেতে পারেঃ

(وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ ) [آل عمران: 133]

‘আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্ত্তত করা হয়েছে’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩৩)।

৮। অতঃপর দা‘ওয়াতী ময়দানে প্রবেশ করতে পারে নাস্তিক্যবাদী শত্রু। যা শুধুমাত্র আল্লাহর দিকে ন্যস্ত, তদ্বিষয়ে নাক গলানোই হচ্ছে ঐ শত্রুর পরিচয়। এর ফলে দা‘ওয়াতী কাজের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যায়, উপর ভেঙ্গে নীচে পড়ে এবং গোলাম তার মনীবের উপর কর্তৃত্ব করে। এ থেকে মুক্তি লাভের উপায় খুঁজে বের করতে হবে এই আয়াত থেকেঃ

(فَلِذَلِكَ فَادْعُ وَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَقُلْ آمَنْتُ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنْ كِتَابٍ وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ اللَّهُ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ لَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ لَا حُجَّةَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ اللَّهُ يَجْمَعُ بَيْنَنَا وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ (15)) [الشورى: 15]

‘এ কারণে তুমি আহবান কর এবং দৃঢ় থাক যেমন তুমি আদিষ্ট হয়েছ আর তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। আরবল, ‘আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, আমি তাতে ঈমান এনেছি এবং তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ আমাদের রব এবং তোমাদের রব। আমাদের কর্ম আমাদের এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের; আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোন বিবাদ-বিসম্বাদ নেই; আল্লাহ আমাদেরকে একত্র করবেন এবং প্রত্যাবর্তন তাঁরই কাছে’ (সূরা আশ-শূরা: ১৫)।

৯। এরপর আগমন করতে পারে ‘বিশ্রাম গ্রহণের ভালোবাসা’ নামক রোগ, যা হচ্ছে মূল মুছীবত এবং মারাত্মক ক্ষতিকর। এ থেকে মুক্তি লাভের উপায়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

(وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى (39) وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى (40) ثُمَّ يُجْزَاهُ الْجَزَاءَ الْأَوْفَى (41)) ... [النجم: 39 - 41]

‘আর মানুষ যা চেষ্টা করে, তা-ই সে পায়। (৩৯)এবং তার প্রচেষ্টার ফল অচিরেই তাকে দেখানো হবে। (৪০) তারপর তাকে পূর্ণ প্রতিফল প্রদান করা হবে’ (সূরা আন-নাজম: ৩৯-৪১)।

১০। অতঃপর আত্মপ্রকাশ করতে পারে ‘অহংকার ও আল্লাহ বিমুখতা’ নামীয় রোগ, যার দ্বারা মানুষ নিজেকে দ্বীন থেকে তাড়িয়ে দেয় এবং ধ্বংসাত্মক কাবীরা গোনাহ তাকে ঘিরে ধরে। এ থেকে মুক্তি লাভের উপায় খুঁজে ফিরতে হবে নীচের আয়াতটিতেঃ

(أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (16)) [الحديد: 16]

‘যারা ঈমান এনেছে, তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য নাযিল হয়েছে তার কারণে বিগলিত হওয়ার সময় হয়নি? আর তারা যেন তাদের মত না হয়, যাদেরকে ইতিপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারপর তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, অতঃপর তাদের অন্তরসমূহ কঠিন হয়ে গেল। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক’ (সূরা আল-হাদীদ: ১৬)।