৭৯. বালা-মুসীবাতে পতিত হলে গুনাহ মাফ হয় :
বালা-মুসীবাত মানবজীবনের অপরিহার্য অংশ। কোন বিপদে পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে যত বেশি নাবী-রাসূলগণের অনুসরণ করতে চেষ্টা করবে তার বিপদ-আপদ বেশি হবে। তবে এগুলো ইতিবাচক পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বান্দার গুনাহ মাফ হয়। যদিও বান্দা প্রাথমিকভাবে বুঝতে পারে না যে, তার জন্য বিপদে কী করা উচিত। তার উচিত ধৈর্যধারণ করা ও বিপদ থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা এবং বিপদ থেকে বের হওয়ার সাধ্য মোতাবেক চেষ্টা করা। আমরা কোন পরীক্ষার সম্মুখিন হলে শয়তানের ওয়াসওয়াসায় বিভ্রান্ত হই। হতে পারে এই পরীক্ষার মধ্যে আমাদের জন্য কল্যাণ আছে আর যা আমরা চাচ্ছি তার মধ্যে অকল্যাণ আছে। কিতালের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَعَسٰى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسٰى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘‘হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।’’[1]
মু’মিন কখনো বিপদে পড়লে তাতে যে সে কষ্ট অনুভব করে তার জন্য তার কিছু গুনাহ মাফ করা হয়। উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَا مِنْ مُصِيبَةٍ تُصِيبُ الْمُسْلِمَ إِلَّا كَفَّرَ اللهُ بِهَا عَنْهُ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا
‘‘মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে সকল বিপদাআপদ আপতিত হয় এর দ্বারা আল্লাহ তার পাপ মোচন করে দেন। এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিদ্ধ হয় এর দ্বারাও (গুনাহ মাফ হয়)।’’[2]
সহীহুল বুখারীরই অন্য এক বর্ণনায় আছে, আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী (সা.) বলেছেন :
مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلَا وَصَبٍ وَلَا هَمٍّ وَلَا حُزْنٍ وَلَا أَذًى وَلَا غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا إِلَّا كَفَّرَ اللهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ
‘‘মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে সকল ক্লান্তি, যাতনা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, কষ্ট, কঠিন দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী আপতিত হয়, এমন কি যে কাঁটা তার দেহে বিদ্ধ হয়, এ সবের দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।’’[3]
আবূ হুরায়রাহ্ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُشَاكُ شَوْكَةً فِي الدُّنْيَا يَحْتَسِبُهَا إِلَّا قُصَّ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘‘যে কোন মুসলিমের গায়ে এই দুনিয়ায় একটি কাঁটা বিঁধে এবং সে এর বিনিময়ে সাওয়াবের আশা রাখে, তার জন্য ক্বিয়ামাতের দিন তার গুনাহরাশি মার্জনা করা হবে।’’[4]
‘আয়িশাহ্ (রা.) বলেন যে, নাবী (সা.) প্রায়ই বলতেন,
مَا أَصَابَ الْمُؤْمِنَ مِنْ شَوْكَةٍ فَمَا فَوْقَهَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ
‘‘মু’মিন বান্দার গায়ে কোন কাঁটা বিঁধা হতে শুরু করে যত বিপদই আপতিত হয় তা তার গুনাহের কাফ্ফারাহ্ হয়ে যায়।’’[5]
হাদীসে এসেছে,
عَنْ مُصْعَبِ بْنِ سَعْدٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَيُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلَاءً قَالَ الْأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الْأَمْثَلُ فَالْأَمْثَلُ فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلٰى حَسَبِ دِينِه فَإِنْ كَانَ دِينُه صُلْبًا اشْتَدَّ بَلَاؤُه وَإِنْ كَانَ فِي دِينِه رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلٰى حَسَبِ دِينِه فَمَا يَبْرَحُ الْبَلَاءُ بِالْعَبْدِ حَتّٰى يَتْرُكَه يَمْشِي عَلَى الْأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ
মুস্‘আব ইবনু সা‘দ (রহিমাহুল্লাহ) হতে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি (সা‘দ) বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মাঝে কার বিপদের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন হয়? তিনি বললেন : ‘‘নাবীদের বিপদের পরীক্ষা, তারপর যারা উৎকৃষ্ট তাদের, এরপর যারা উৎকৃষ্ট তাদের বিপদের পরীক্ষা। মানুষকে তার দীনের উপর দৃঢ়তার অনুপাতে অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। তুলনামূলকভাবে যে লোক বেশি ধার্মিক তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে কঠিন হয়ে থাকে। আর যদি কেউ তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে তাহলে তাকে সে মোতাবেক পরীক্ষা করা হয়। অতএব, এ জাতীয় বান্দার উপর বিপদাপদ লেগেই থাকে, অবশেষে তা তাকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেয় যে, সে যমীনে চলাফেরা করে অথচ তার কোন গুনাহই থাকে না।’’[6]
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
إِذَا ابْتَلَى اللهُ الْعَبْدَ الْمُسْلِمَ بِبَلَاءٍ فِي جَسَدِه قَالَ لِلْمَلَكِ اكْتُبْ لَه صَالِحَ عَمَلِهِ الَّذِي كَانَ يَعْمَلُ فَإِنْ شَفَاهُ غَسَلَه وَطَهَّرَه وَإِنْ قَبَضَه غَفَرَ لَه وَرَحِمَه
‘‘আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো মুসলিম বান্দাকে শারীরিক অসুস্থতা দিয়ে পরীক্ষা করেন তখন তিনি ফেরেশতাকে আদেশ করেন, তুমি তার ‘আমলনামায় সেই ভালো ‘আমলগুলো (‘আমলের সাওয়াবগুলো) লেখ যা সে (সুস্থাবস্থায়) করতো। যদি তাকে সুস্থতা দান করেন তাহলে তার পাপ ধুয়ে দেন ও তাকে পবিত্র করে ফেলেন। আর যদি তিনি তার মৃত্যু দেন তাহলে তাকে মাফ করে দেন এবং তাকে রহম করেন।’’[7]
আবূ হুরায়রাহ্ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَا يَزَالُ الْبَلَاءُ بِالْمُؤْمِنِ وَالْمُؤْمِنَةِ فِي نَفْسِه وَوَلَدِه وَمَالِه حَتّٰى يَلْقَى اللهَ وَمَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ
‘‘মু’মিন পুরুষ ও নারীর জীবন, সন্তান-সন্ততি ও তার সম্পদে (বিপদ-আপদ দ্বারা) পরীক্ষা হতে থাকে। পরিশেষে সে আল্লাহ তা‘আলার সাথে নিষ্পাপ হয়ে সাক্ষাৎ করে।’’[8]
আবূ হুরায়রাহ্ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
لَمَّا نَزَلَتْ ﴿مَنْ يَعْمَلْ سُوءًا يُجْزَ بِه﴾ بَلَغَتْ مِنَ الْمُسْلِمِينَ مَبْلَغًا شَدِيدًا فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺۤ قَارِبُوا وَسَدِّدُوا فَفِى كُلِّ مَا يُصَابُ بِهِ الْمُسْلِمُ كَفَّارَةٌ حَتَّى النَّكْبَةِ يُنْكَبُهَا أَوِ الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا
যখন এ আয়াত مَنْ يَعْمَلْ سُوْءًا يُجْزَ بِه (যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করে, তাকে তার শাস্তি দেয়া হবে) অবতীর্ণ হল তখন কতক মুসলিম ভয়ানক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : তোমরা মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর এবং সঠিক পন্থায় চলমান থাক। একজন মুসলিম তার প্রত্যেকটি বিপদের বিনিময়ে এমনকি সে আছাড় খেলে কিংবা তার শরীরে কোন কাঁটা বিদ্ধ হলেও তাতে তার (গুনাহের) কাফ্ফারাহ্ হয়ে যায়।[9]
আল আসওয়াদ (রহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
اعْتَلَجَ نَاسٌ فَأَصَابَ طُنُبُ الْفُسْطَاطِ عَيْنَ رَجُلٍ مِنْهُمْ فَضَحِكُوا فَقَالَتْ عَائِشَةُ سَمِعْتُ رَسُول اللهِ ﷺ يَقُولُ مَا مِنْ مُؤْمِنٍ تَشُوكُه شَوْكَةٌ فَمَا فَوْقَهَا إِلَّا حَطَّ اللهُ عَنْهُ خَطِيئَةً وَرَفَعَ لَه بِهَا دَرَجَةً
লোকেরা ধস্তা-ধস্তি বা কুস্তি করছিল, এমতাবস্থায় তাবুর রশি তাদের একজনের চোখে বিঁধলো বা আঘাত করলো। এতে অন্য সবাই হেসে উঠলো। অতঃপর ‘আয়িশাহ্ (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘‘যে কোন মু’মিনের গায়ে এই দুনিয়ায় একটি কাঁটা বিঁধে বা এর চেয়ে বেশি কিছু ভোগ করে (কষ্ট পায়) তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার একটি গুনাহ মাফ করেন এবং এর বিনিময়ে তার একটি মর্যাদা উন্নীত করা হয়।’’[10]
[2]. সহীহুল বুখারী : ৫৬৪০, সহীহ মুসলিম : ৬৭৩০, শব্দ বুখারীর।
[3]. সহীহুল বুখারী : ৫৬৪১-৬৫৪২।
[4]. আল আদাবুল মুফরাদ : ৫০৭, হাদীসটি সহীহ। আলাবানী আস্ সহীহাহ্ গ্রন্থে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, হাদীস নং ২৫০৩।
[5]. আল আদাবুল মুফরাদ : ৫০৬, হাদীসটি সহীহ।
[6]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ২৩৯৮, হাদীসটি হাসান সহীহ।
[7]. মুসনাদে আহমাদ : ১৩৭১২, হাদীসটি হাসান।
[8]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ২৩৯৯, হাদীসটি হাসান সহীহ।
[9]. সহীহ মুসলিম : ৬৭৩৪; জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩০৩৪।
[10]. মুসনাদে আহমাদ : ২৬১৭৫, হাদীসটির সনদ সহীহ।