কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি কোন দন্ডযোগ্য অপরাধ করে ফেলে আর তারপর যদি তার এই অপরাধের যথাযথ বিচার হয় এবং বিচারের রায় অনুযায়ী তার ওপর দন্ড বা শাস্তি বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে তার এই শাস্তি প্রাপ্তিই তার অপরাধের কারণে যে গুনাহ হয়েছে তা মাফ করিয়ে দেবে। যেমন, ‘উবাদাহ্ ইবনুস্ সামিত হতে বর্ণিত বায়‘আত সম্পর্কিত বিখ্যাত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ أَصَابَ مِنْ ذٰلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَه
‘‘আর কেউ এর কোন একটিতে লিপ্ত হয়ে পড়লে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি পেয়ে গেলে, তবে তা হবে তার জন্য কাফ্ফারাহ্।’’[1]
প্রায় একই অর্থে কিছুটা বিস্তারিতভাবে অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
مَنْ أَصَابَ مِنْ ذٰلِكَ شَيْئًا فَأُخِذَ بِه# فِي الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَه
‘‘আর যে এগুলো থেকে কিছু করে ফেলবে আর সে জন্য দুনিয়াতে যদি তার শাস্তি হয়ে যায়, তাহলে এটি হবে তার জন্য গুনাহর কাফফারাহ্।’’[2]
এই সুযোগ শুধু যারা মুসলিম বা মু’মিন তাদের জন্য, কাফিরদের জন্য নয়।
কোন কাফিরের ওপর যখন শাস্তি আসে তখন সে তার অপরাধের কর্মফল হিসেবে সেই শাস্তি ভোগ করে। যেমন, নূহ (আ.)-এর্ জাতি, ‘আদ, সামূদ জাতির শাস্তি, মুরতাদ (ইসলামধর্ম ত্যাগকারী)-এর শাস্তি ইত্যাদি। এসব কাফিরের ওপর শাস্তি আসায় এবং তারা তা ভোগ করায় তাদের অপরাধের গুনাহ মাফ হবে না।
যখন কোন মুসলিম এমন কোন অপরাধ করে ফেলে যার জন্য তার উপর হদ্দ (শরী’আহ নির্ধারিত নির্দিষ্ট কিছু দন্ড) বা ক্বিসাস কিংবা তা’যীর প্রযোজ্য হয় তখন ঐ অপরাধীর উপর যখন ঐ নির্দিষ্ট শাস্তি বাস্তবায়ন করা হবে তখন তা তার জন্য গুনাহ মাফের উপায় হবে। দন্ড ভোগ করার কারণে সে তার গুনাহ থেকে মাফ পাবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَكَتَبْنَا عَلَيْهِمْ فِيهَا أَنَّ النَّفْسَ بِالنَّفْسِ وَالْعَيْنَ بِالْعَيْنِ وَالْأَنْفَ بِالْأَنْفِ وَالْأُذُنَ بِالْأُذُنِ وَالسِّنَّ بِالسِّنِّ وَالْجُرُوحَ قِصَاصٌ فَمَنْ تَصَدَّقَ بِه فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَه وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ فَأُولٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾
‘‘আর আমি এতে তাদের উপর অবধারিত করেছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান ও দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং জখমের বিনিময়ে সমপরিমাণ জখম। অতঃপর যে তা ক্ষমা করে দেবে, তার জন্য তা কাফ্ফারা হবে। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা বিচার-ফায়সালা করবে না, তারাই যালিম।’’[3]
হাদীসে এসেছে,
أَنَّ عُبَادَةَ بْنَ الصَّامِتِ مِنْ الَّذِينَ شَهِدُوا بَدْرًا مَعَ رَسُولِ اللهِ ﷺ وَمِنْ أَصْحَابِه لَيْلَةَ الْعَقَبَةِ أَخْبَرَه أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ وَحَوْلَهُ عِصَابَةٌ مِنْ أَصْحَابِه تَعَالَوْا بَايِعُونِي عَلٰى أَنْ لَّا تُشْرِكُوا بِاللهِ شَيْئًا وَلَا تَسْرِقُوا وَلَا تَزْنُوا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ وَلَا تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَه بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلَا تَعْصُونِي فِي مَعْرُوفٍ فَمَنْ وَفٰى مِنْكُمْ فَأَجْرُه عَلَى اللهِ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذٰلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ بِه فِي الدُّنْيَا فَهُوَ لَه كَفَّارَةٌ وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذٰلِكَ شَيْئًا فَسَتَرَهُ اللهُ فَأَمْرُه إِلَى اللهِ إِنْ شَاءَ عَاقَبَه وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ
‘উবাদাহ্ ইবনুত্ সামিত (রাঃ) যিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বদর যুদ্ধে এবং আকাবার রাতে উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে ছিলেন- তিনি আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীদের একটি দলকে লক্ষ্য করে বললেন, এসো তোমরা আমার কাছে এ কথার উপর বায়‘আত কর যে, তোমরা আল্লাহ তা‘আলার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না, তোমরা চুরি করবে না, তোমরা ব্যভিচার করবে না; তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তোমরা (কারো প্রতি) অপবাদ আরোপ করবে না যা তোমরা নিজে থেকে বানিয়ে নাও, তোমরা নেক কাজ করতে আমার নাফরমানী করবেনা, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এসব শর্ত পূরণ করে চলবে সে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার প্রতিদান অবশ্যই পাবে। আর যে এসবের কোন কিছুতে লিপ্ত হয় এবং তাকে এ কারণে দুনিয়াতে আইনানুগ শাস্তি দেয়া হবে, তবে এ শাস্তি তার কাফ্ফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি এ সবের কোনটিতে লিপ্ত হল আর আল্লাহ তা গোপন রাখেলেন, তবে তার ব্যাপারটি আল্লাহ তা‘আলার যিম্মায় থাকলো। তিনি ইচ্ছে করলে শাস্তি দিবেন আর ইচ্ছে করলে মাফ করবেন।[4]
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ قَالَ أَخَذَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللهِ ﷺ كَمَا أَخَذَ عَلَى النِّسَاءِ أَنْ لَّا نُشْرِكَ بِاللهِ شَيْئًا وَلَا نَسْرِقَ وَلَا نَزْنِىَ وَلَا نَقْتُلَ أَوْلَادَنَا وَلَا يَعْضَهَ بَعْضُنَا بَعْضًا فَمَنْ وَفٰى مِنْكُمْ فَأَجْرُه” عَلَى اللهِ وَمَنْ أَتٰى مِنْكُمْ حَدًّا فَأُقِيمَ عَلَيْهِ فَهُوَ كَفَّارَتُه وَمَنْ سَتَرَهُ اللهُ عَلَيْهِ فَأَمْرُه إِلَى اللهِ إِنْ شَاءَ عَذَّبَه وَإِنْ شَاءَ غَفَرَ لَه
‘উবাদাহ্ ইবনুস্ সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের থেকে অনুরূপ অঙ্গীকার (বায়‘আত) নিলেন, যেরূপ অঙ্গীকার নিয়েছেন মহিলাদের থেকে যেন আমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করি, চুরি না করি, ব্যভিচার না করি, আমাদের সন্তানদেরকে হত্যা না করি এবং একে অপরের বিরুদ্ধে অপবাদ না দেই। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তা পূর্ণ করবে তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাবে। আর তোমাদের মধ্যে যদি কেউ এমন কোন অপরাধ করে যাতে (হদ্দ) শরীয়তের শাস্তি অত্যাবশ্যকীয় হয়, অতঃপর তার উপর সেই শাস্তি কার্যকর করা হয়, তবে তা তার অপরাধের কাফফারাহ্ (বদলা) হয়ে যাবে। আর যাকে (যে ব্যক্তির পাপ) আল্লাহ গোপন রাখলেন, তার বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারে। যদি তিনি ইচ্ছা করেন তবে তাকে শাস্তি দিবেন। আর যদি ইচ্ছে করেন তবে তাকে ক্ষমা করে দিবেন।[5]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
أَيَّمَا عَبْدٍ أَصَابَ شَيْئًا مِمَّا نَهَى اللهُ عَنْهُ ثُمَّ أُقِيْمَ عَلَيْهِ حَدُّه كُفِّرَ عَنْهُ ذٰلِكَ الذَّنْبُ
‘‘কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর নিষেধকৃত কোন অপরাধ করে ফেলে তারপর (শার‘ঈ আদালতে বিচারের মাধ্যমে প্রদত্ত রায় অনুযায়ী) তার ওপরে দন্ড প্রয়োগ করা হয় তাহলে (এই শাস্তির কারণে) তার কৃত অপরাধজনিত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’’[6] উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, কোন মুসলিম যদি এমন কোন অপরাধ করে ফেলে যে অপরাধের কারণে তাকে দন্ড ভোগ করতে হয় তাহলে তার এই শাস্তি ভোগ করাটাই তার গুনাহ মাফের উপায় হবে। তবে এটি শুধু ঐ গুনাহ মাফের উপায় হবে যে গুনাহের জন্য সে শাস্তি ভোগ করেছে। যেমন, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে তারপর হত্যাকারীকে আদালত মৃত্যুদন্ড দেয় এবং কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে তাহলে মানুষ হত্যার কারণে মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়া ব্যক্তির যে গুনাহ হয়েছিল তা তার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের মাধ্যমে মাফ হয়ে যাবে।
>[2]. সহীহুল বুখারী : ৬৮০১, ৭৪৬৮।
[3] সূরা আল মায়িদাহ্ ০৫ : ৪৫।
[4]. সহীহুল বুখারী : ৩৮৯২।
[5]. সহীহ মুসলিম : ৪৫৬০।
[6]. আল মুসতাদরাক ‘আলাস্ সহীহায়ন : ৮১৬৭, হাদীসটির সদন সহীহ।