যে কোন মু’মিন ব্যক্তি নিজে নিজে দু‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা তা যেমন কবূল করেন তেমনি কোন মু’মিন অপর কোন মু’মিনের জন্য যদি ক্ষমা প্রার্থনা করে বা দু‘আ করে তাহলে তাও আল্লাহ কবূল করেন। নাবীগণের মধ্য থেকে আমরা দেখতে পাই ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি চরম অবিচার করে তার ভাইয়েরা যে অন্যায় করেছিলেন তার জন্য অনুতপ্ত হয়ে তারা তাদের পিতা ইয়া‘কূব (আ.)-কে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছিলেন এবং তাদের অনুরোধ শুনে তিনি আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাদের কথপোকথন উল্লেখ করেছেন এভাবে,
قَالُوا يَا أَبَانَا اسْتَغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا إِنَّا كُنَّا خَاطِئِينَ - قَالَ سَوْفَ أَسْتَغْفِرُ لَكُمْ رَبِّي إِنَّه هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
‘‘তারা বলল, ‘হে আমাদের পিতা, আপনি আমাদের গুনাহ মাফের জন্য ক্ষমা চান। নিশ্চয় আমরা ছিলাম গুনাহকারী’। তিনি বললেন, ‘অচিরেই আমি তোমাদের জন্য আমার রব-এর নিকট ক্ষমা চাইব, নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’।’’[1]
আল্লাহ তা‘আলা সর্বশেষ নাবী মুহাম্মাদ (সা.)-কেও একাধিকবার আদেশ করেছেন মু’মিন নর-নারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে। যেমন আল্লাহ বলেন :
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ
‘‘অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে তুমি তাদের জন্য নম্র হয়েছিলে। আর যদি তুমি রূঢ়ভাষী (কঠোর স্বভাবের), কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতে, তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তাদেরকে মাফ করে দাও এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরার্মশ কর। অতঃপর যখন সংকল্প করবে তখন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা) করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারীদেরকে ভালোবাসেন।’’[2]
অন্য আয়াতে তিনি বলেন,
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرَسُولِه وَإِذَا كَانُوا مَعَه عَلٰى أَمْرٍ جَامِعٍ لَمْ يَذْهَبُوا حَتّٰى يَسْتَأْذِنُوهُ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ أُولٰئِكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَرَسُولِه فَإِذَا اسْتَأْذَنُوكَ لِبَعْضِ شَأْنِهِمْ فَأْذَنْ لِمَنْ شِئْتَ مِنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمُ اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
‘‘মু’মিন শুধু তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর ঈমান আনে এবং তাঁর সাথে কোন সমষ্টিগত কাজে থাকলে অনুমতি না নিয়ে চলে যায় না। নিশ্চয় তোমার কাছে যারা অনুমতি চায় তারাই কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনে; সুতরাং কোন প্রয়োজনে তারা তোমার কাছে বাইরে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তাদের মধ্যে তোমার যাকে ইচ্ছা তুমি অনুমতি দেবে এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’’[3]
নাবী (সা.)-কে মু’মিন নারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আদেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন,
يٰۤاَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلٰى أَنْ لَا يُشْرِكْنَ بِاللهِ شَيْئًا وَّلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِينَ بِبُهْتَانٍ يَفْتَرِينَه بَيْنَ أَيْدِيهِنَّ وَأَرْجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِينَكَ فِي مَعْرُوفٍ فَبَايِعْهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللهَ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
‘‘হে নাবী! যখন মু’মিন নারীরা তোমার কাছে এসে এই মর্মে বাই‘আত করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তারা জেনে শুনে কোন অপবাদ রচনা করে রটাবে না এবং সৎকাজে তারা তোমার অবাধ্য হবে না। তখন তুমি তাদের বাই‘আত গ্রহণ করো এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’[4]
রাসূলুল্লাহ (সা.) কারো জন্য প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা কবূল করতেন এবং যার জন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তাকে তিনি মাফ করে দিতেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَّسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللهِ وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللهَ تَوَّابًا رَّحِيمًا
‘‘আর আমি যে কোন রাসূল প্রেরণ করেছি তা কেবল এ জন্য, যেন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের আনুগত্য করা হয়। আর যদি তারা যখন নিজেদের প্রতি যুল্ম করেছিল তখন তোমার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইত এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইতেন তাহলে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তাওবাহ্ কবূলকারী, দয়ালু হিসেবে পেত।’’[5]
নাবী (সা.) সাধারণভাবে পৃথিবীর সকল মু’মিন নর-নারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। নিম্নের আয়াতের বাস্তবায়ন তিনি করতেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ
‘‘হে নাবী! তুমি নিজের জন্য এবং মু’মিন নর-নারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো।’’[6]
সহীহ মুসলিম-এর ৬২৩৪ নং হাদীসে এ আয়াতের বাস্তবায়নের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) কারো খাবার খেলে তার জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। একদিন তিনি এক বাড়িতে দা‘ওয়াত খেয়ে তাদের জন্য দু‘আ করেছেন এভাবে,
اَللّٰهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِىْ مَا رَزَقْتَهُمْ وَاغْفِرْ لَهُمْ وَارْحَمْهُمْ
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা বা-রিক লাহুম ফী মা- রযাকতাহুম ওয়াগফির লাহুম ওয়ারহামহুম।
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি তাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছেন তাতে বরকত দান করুন এবং তাদেরকে মাফ করুন আর তাদের ওপর রহম করুন।[7]
নাবী (সা.) অন্য এক ঘটনায় আল্লাহর প্রিয় বান্দার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করতে আদেশ দিয়েছেন।[8] তিনি মুসলিমদের মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের জন্য নিজে ক্ষমা চাইতেন এবং সাহাবীদেরকে তাদের জন্য ক্ষমা চাইতে আদেশ দিতেন।
মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার জন্য মাফ চাওয়ার আদেশ দিয়ে তিনি বলেছেন,
اَسْتَغْفِرُوْا لِأَخِيكُمْ وَسَلُوْا لَهُ التَّثْبِيتَ فَإِنَّهُ الآنَ يُسْأَلُ
‘‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তার জন্য দৃঢ়তার দু‘আ করো। কেননা তাকে এখনই প্রশ্ন করা হবে।’’[9]
তবে কোন অমুসলিম বা মুনাফিকের জন্য ক্ষমা চাওয়া বৈধ নয়। এরূপ কোন দু‘আ আল্লাহ কবূল করবেন না। তাই ইস্তিগফার করতে হবে মু’মিন-মুসলিমদের জন্য। মু’মিনদের জন্য কখন কিভাবে ইস্তিগফার করতে হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আমাদের উচিত সাধারণভাবে পৃথিবীর সকল মু’মিন-মুসলিমের জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং নির্দিষ্টভাবে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশী, ছাত্র-শিক্ষক, অফিসের বস-সহকর্মী-কর্মচারী, জীবিত-মৃত ইত্যাদি ব্যক্তিদের জন্য নাম ধরে ক্ষমা চাওয়া।
[2]. সূরা আ-লি ‘ইমরা-ন ০৩ : ১৫৯।
[3]. সূরা আন্ নূর ২৪ : ৬২।
[4]. সূরা আল মুমতাহিনাহ্ ৬০ : ১২।
[5]. সূরা আন্ নিসা ০৪ : ৬৪।
[6]. সূরা মুহাম্মাদ ৪৭ : ১৯।
[7]. সহীহ মুসলিম : ৫৪৪৯, সুনান আবূ দাঊদ : ৩৭৩১, জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩৫৭৬।
[8]. সহীহ মুসলিম : ৬৬৫৪-৬৬৫৬।
[9]. সুনান আবূ দাঊদ : ৩২২৩, হাদীসটি সহীহ।