আরবী শব্দ ‘ইস্তিগফার’ (الإستغفار) শব্দের অর্থ ক্ষমা চাওয়া। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় দু‘আ ও তাওবাহ্ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করাকে ‘ইস্তিগফার’ বলা হয়। পাপ মোচনের প্রথম মাধ্যম হলো ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা।
মহান আল্লাহ নূহ (আ.)-এর কথা উল্লেখ করে বলেছেন,
فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوْا رَبَّكُمْ إِنَّه كَانَ غَفَّارًا
‘‘(নূহ (আ.) বললেন) অতঃপর আমি বলেছি, ‘তোমরা তোমাদের রব-এর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় তিনি মহাক্ষমাশীল’।’’[1]
পাপের পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার নাম ইস্তিগফার। কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আদেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন,
وَاسْتَغْفِرِ اللهَ إِنَّ اللهَ كَانَ غَفُورًا رَّحِيمًا
‘‘আল্লাহর কাছে তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’[2]
অন্য আয়াতে তিনি বলেন,
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّه كَانَ تَوَّابًا
‘‘তুমি তোমার রব-এর প্রশংসার সাথে পবিত্রতা জ্ঞাপন কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি অধিক তাওবাহ্ গ্রহণকারী।’’[3]
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
أَنَّمَا إِلٰهُكُمْ إِلٰهٌ وَّاحِدٌ فَاسْتَقِيمُوا إِلَيْهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ وَوَيْلٌ لِلْمُشْرِكِينَ
‘‘তোমাদের ইলাহ একমাত্র ইলাহ। অতএব তাঁরই পথ অবলম্বন কর এবং তাঁরই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর দুর্ভোগ মুশরিকদের জন্য।’’[4]
আল্লাহ তা‘আলা সৎকর্মশীল বান্দাদের প্রশংসা করে বা তাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেছেন,
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلٰى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ-أُولٰئِكَ جَزَاؤُهُمْ مَغْفِرَةٌ مِنْ رَّبِّهِمْ وَجَنَّاتٌ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ
‘‘আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজেদের প্রতি যুল্ম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না বা এর উপরে তারা অটল থাকে না। এরাই তারা, যাদের প্রতিদান তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং জান্নাতসমূহ যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর ‘আমলকারীদের প্রতিদান কতই না উত্তম!’’[5]
কিছু পাপের শাস্তি আল্লাহ দুনিয়াতেও দিয়ে থাকেন। কিন্তু পাপ করার পর তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকলে তিনি পাপীকে শাস্তি দেন না। তিনি বলেন,
وَمَا كَانَ اللهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنْتَ فِيهِمْ وَمَا كَانَ اللهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
‘‘আর আল্লাহ কখনো এমন নন যে, তাদেরকে ‘আযাব দেবেন এ অবস্থায় যে, তুমি তাদের মাঝে বিদ্যমান এবং আল্লাহ তাদেরকে কখনো ‘আযাবদানকারী নন এমতাবস্থায় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করছে।’’[6]
কেউ যদি কোন পাপ করে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। তিনি বলেছেন,
وَمَنْ يَّعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَه ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللهَ يَجِدِ اللهَ غَفُورًا رَّحِيمًا
‘‘আর যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করবে কিংবা নিজের প্রতি যুল্ম করবে অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে, সে আল্লাহকে পাবে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’[7]
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেছেন :
يَا عِبَادِى إِنَّكُمْ تُخْطِئُونَ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَأَنَا أَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا فَاسْتَغْفِرُونِى أَغْفِرْ لَكُمْ
‘‘হে আমার বান্দারা! তোমরা রাত-দিন পাপ করে থাকো, আর আমি সমস্ত পাপ ক্ষমা করে থাকি। সুতরাং তোমরা আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিব।’’[8]
নাবী (সা.) বলেছেন :
إِنَّ الشَّيْطَانَ قَالَ وَعِزَّتِكَ يَا رَبِّ لَا أَبْرَحُ أُغْوِىْ عِبَادَكَ مَا دَامَتْ أَرْوَاحُهُمْ فِىْ أَجْسَادِهِمْ قَالَ الرَّبُّ وَعِزَّتِىْ وَجَلَالِىْ لَا أَزَالُ أَغْفِرُ لَهُمْ مَا اسْتَغْفَرُونِىْ
‘‘নিশ্চয় শয়তান বলেছে, ‘হে আমার রব! আপনার ইয্যতের ক্বসম! আমি আপনার বান্দাদেরকে অবিরামভাবে পথভ্রষ্ট করতে থাকব, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের দেহে প্রাণ থাকবে।’ (শয়তানের এই কথার উত্তরে) রব বলেছেন, ‘আর আমার ইয্যত ও উচ্চ মর্যাদার ক্বসম! আমি অবিরামভাবে তাদেরকে ক্ষমা করতে থাকব, যতক্ষণ তারা আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে।’’[9]
আনাস ইবনু মালিক বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلٰى مَا كَانَ فِيكَ وَلَا أُبَالِي يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ وَلَا أُبَالِي يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الْأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِي لَا تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لَأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً
‘হে আদম সন্তান! যতক্ষণ তুমি আমাকে ডাকবে এবং ক্ষমার আশা রাখবে, ততক্ষণ আমি তোমাকে ক্ষমা করব। তোমার অবস্থা যাই হোক না কেন, আমি কোন পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! তোমার গুনাহ যদি আকাশের যে পর্যন্ত দৃষ্টি যায়/প্রকাশ পায় সে পর্যন্ত পৌঁছে থাকে অতঃপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, আমি কোন পরোয়া করি না। হে আদম সন্তান! তুমি যদি জমিন ভরা গুনাহ নিয়ে আমার কাছে উপস্থিত হও এবং আমার সাথে কাউকে শরীক না করে থাক, তাহলে আমি জমিন ভরা ক্ষমা নিয়ে তোমার নিকট উপস্থিত হব।’’[10]
আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالٰى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقٰى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ فَيَقُولُ مَنْ يَدْعُونِى فَأَسْتَجِيبَ لَه وَمَنْ يَسْأَلُنِى فَأُعْطِيَه وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ لَه
‘‘আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক রাতের শেষ এক-তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আমাকে ডাকে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার নিকট প্রার্থনা করে? আমি তাকে দান করব। এবং কে আমার নিকট ক্ষমা চায়? আমি তাকে ক্ষমা করব।’’[11]
নাবী (সা.) (সামান্য অন্যমনস্কতার জন্য) প্রতিদিন ১০০ বার ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। তিনি বলেছেন,
إِنَّه لَيُغَانُ عَلٰى قَلْبِىْ وَإِنِّىْ لِأَسْتَغْفِرُ اللهَ فِى الْيَوْمِ مِائَةَ مَرَّةٍ
‘‘আমার অন্তর ক্ষণিক বাধাপ্রাপ্ত হয়। আর আমি দিনে ১০০ বার আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই।’’[12]
তিনি আরও বলেছেন,
وَاللهِ إِنِّىْ لَأَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ فِي الْيَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِيْنَ مَرَّةً
‘‘আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে ৭০ বারেরও বেশি ইস্তিগফার (ক্ষমাপ্রার্থনা) ও তাওবাহ্ করে থাকি।’’[13]
ইবন ‘উমার বলেন, একই মজলিসে বসে নাবী (সা.)-এর (এই ইস্তিগফারটি) পাঠ করা অবস্থায় ১০০ বার পর্যন্ত গুণতাম,
رَبِّ اغْفِرْ لِىْ وَتُبْ عَلَىَّ إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
‘‘হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা কর, আমার তাওবাহ্ কবূল কর, নিশ্চয় তুমি অতিশয় তাওবাহ কবূলকারী, পরম দয়াময়।’’[14]
নাবী (সা.)-এর জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়ার পরও অর্থাৎ তিনি নিষ্পাপ হওয়ার পরও যদি প্রতিদিন ৭০ থেকে ১০০ বার মহান রব-এর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তাওবাহ্ করেন তাহলে আমার-আপনার মতো পাপীদের কী করা উচিত? প্রতিদিন কতবার ইস্তিগফার ও তাওবাহ করা উচিত?
ইস্তিগফারের কিছু ইতিবাচক প্রভাব আছে। যেমন প্রতিদিন ১০০ বার ইস্তিগফার পড়লে মন-মস্তিষ্কে তার বিশেষ প্রভাব পড়ে। কারণ বারবার উচ্চারিত কথা মনে-ব্রেনের নির্দিষ্ট জায়গায় স্থান করে নেয় এবং সেই অনুযায়ী মানুষের চরিত্র ও আচরণে বিশেষ প্রভাব পড়ে। সুতরাং পাপ থেকে বারবার ক্ষমা চাইলে পাপ করার প্রবণতা ধীরে ধীরে কমে যায়।
শাস্তির দিন এসে পড়ার আগে পাপীর উচিত পাপ বর্জন করে মহান আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। নাবী (সা.) একদিন মহিলাদের উদ্দেশে বললেন,
يَا مَعْشَرَ النِّسَاءِ تَصَدَّقْنَ وَأَكْثِرْنَ الاِسْتِغْفَارَ فَإِنِّى رَأَيْتُكُنَّ أَكْثَرَ أَهْلِ النَّارِ
‘‘হে নারীসমাজ! তোমরা দান-সাদকাহ করতে থাক ও বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা কর। কারণ আমি তোমাদেরকে জাহান্নামের অধিবাসীদের অধিকাংশই তোমাদেরকে দেখলাম।’’[15]
পরকালে যার ‘আমলনামায় বেশি বেশি ইস্তিগফার পাওয়া যাবে তার জন্য সুসংবাদ। ‘আবদুল্লাহ ইবন বুস্র বলেন, নাবী (সা.) বলেছেন :
طُوبٰى لِمَنْ وَجَدَ فِي صَحِيفَتِهِ اسْتِغْفَارًا كَثِيرًا
‘‘যে ব্যক্তি তার ‘আমলনামায় অধিক পরিমাণে ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ যোগ করতে পেরেছে, তার জন্য সুসংবাদ, আনন্দবার্তা।’’[16]
[2]. সূরা আন্ নিসা ০৪ : ১০৬।
[3]. সূরা আন্ নাস্র ১১০ : ৩।
[4]. সূরা হা-মীম আস্ সাজদাহ্ ৪১ : ৬।
[5]. সূরা আ-লি ‘ইমরা-ন ০৩ : ১৩৫-৩৬।
[6]. সূরা আল আনফাল ০৮ : ৩৩।
[7]. সূরা আন্ নিসা ০৪ : ১১০
[8]. সহীহ মুসলিম : ৬৭৩।
[9]. মুসনাদ আহমাদ : ১১২৩৭; মুসতাদরাক হাকীম : ৭৬৭২, হাদীসটি সহীহ, আস-সিলসিলা আস্ সহীহাহ্ : ১০৪।
[10]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ২৮০৫, হাদীসটি সহীহ।
[11]. সহীহুল বুখারী : ১১৪৫, ৭৪৯৫; সহীহ মুসলিম : ১৮০৮।
[12]. সহীহ মুসলিম : ৭০৩৩।
[13]. সহীহুল বুখারী : ৬৩০৭।
[14]. সুনান আবূ দাঊদ : ১৫১৮; জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৩৪৩৪, হাদীসটি সহীহ।
[15]. সহীহুল বুখারী : ২০৪, সহীহ মুসলিম : ২৫০।
[16]. সুনান ইবনু মাজাহ : ৩৮১৮, হাদীসটি সহীহ।