ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
"وَأَصْلُ الْقَدَرِ سِرُّ اللَّهِ تَعَالَى فِي خَلْقِهِ، لَمْ يَطَّلِعْ عَلَى ذَلِكَ مَلَكٌ مُقَرَّبٌ، وَلَا نَبِيٌّ مُرْسَلٌ، وَالتَّعَمُّقُ وَالنَّظَرُ فِي ذَلِكَ ذَرِيعَةُ الْخِذْلَانِ، وَسُلَّمُ الْحِرْمَانِ، وَدَرَجَةُ الطُّغْيَانِ، فَالْحَذَرَ كُلَّ الْحَذَرِ مِنْ ذَلِكَ نَظَرًا وَفِكْرًا وَوَسْوَسَةً، فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى طَوَى عِلْمَ الْقَدَرِ عَنْ أَنَامِهِ، وَنَهَاهُمْ عَنْ مَرَامِهِ، كَمَا قَالَ تَعَالَى فِي كِتَابِهِ: (لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ) [الْأَنْبِيَاءِ: 23]. فَمَنْ سَأَلَ: لِمَ فَعَلَ؟ فَقَدْ رَدَّ حُكْمَ الْكِتَابِ، وَمَنْ رَدَّ حُكْمَ الْكِتَابِ، كَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ"
তাকদীর সম্পর্কে আসল কথা হলো, এটি সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে আল্লাহর একটি গোপন বিষয়; যা নৈকট্যপ্রাপ্ত কোনো ফেরেশতা কিংবা প্রেরিত কোনো নাবীও অবহিত নন। এ সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা অথবা অনুরূপ আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া ব্যর্থ হওয়ার কারণ, বঞ্চনার সিঁড়ি এবং সীমালংঘনের স্তর। অতএব সাবধান! এ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা এবং কুমন্ত্রণা হতে সতর্ক থাকুন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তাকদীর সম্পর্কিত জ্ঞান তার সৃষ্টিকুল থেকে গোপন রেখেছেন এবং তাদেরকে এর উদ্দেশ্যে অনুসন্ধান করতে নিষেধ করেছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ ‘‘তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হবে না; বরং তারা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সূরা আম্বিয়া: ২৩) অতএব, যে ব্যক্তি একথা জিজ্ঞাসা করবে তিনি কেন এ কাজ করলেন? সে আল্লাহর কিতাবের হুকুম অমান্য করল। আর যে ব্যক্তি কিতাবের হুকুম অমান্য করল, সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।
...................................................
ব্যাখ্যা: তাকদীর সম্পর্কে আসল কথা হলো, এটি সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে আল্লাহর একটি বিষয়। অর্থাৎ তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই ধ্বংস করেন, তিনিই কাউকে ফকীর বানান, তিনিই ধনী বানান, তিনিই মৃত্যু দান করেন, তিনিই জীবন দান করেন, তিনিই গোমরাহ করেন এবং তিনিই হেদায়াত দান করেন। আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাকদীর হলো আল্লাহর গোপন রহস্য। সুতরাং আমরা এটি উন্মুক্ত করার চেষ্টা করবো না। এ মাস‘আলা সম্পর্কে মানুষের মতভেদ খুবই প্রসিদ্ধ।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে সবকিছুই আল্লাহর ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুপাতেই হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলাই বান্দার কর্মের স্রষ্টা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ‘‘প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ’’। (সূরা কামার: ৪৯)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا ‘‘এবং তিনি প্রত্যেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তার একটি তাকদীর বা পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন’’। (সূরা ফুরকান: ২)
কাফের যেই কুফুরী করে তা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাতেই হয়; কিন্তু তিনি কুফুরীকে পছন্দ করেন না। তিনি সৃষ্টিগত দিক থেকে কুফুরী সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন। কিন্তু দ্বীন হিসাবে পছন্দ করেন না।
কাদারীয়া ও মুতাযেলা সম্প্রদায়ের লোকেরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধিতা করেছে।[1] তারা ধারণা করে যে, আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের থেকে ঈমান সংঘটিত হওয়ার ইচ্ছা করেন। কিন্তু কাফের কুফুরীর ইচ্ছা করে। তারা এমন ধারণা থেকে বাঁচার জন্য এ কথা বলেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা কুফুরী সৃষ্টির ইচ্ছা করেছেন এবং কুফুরী করার কারণেই শাস্তি দিয়ে থাকেন। আসলে তাদের অবস্থা হলো ঐ লোকের মতো যে উত্তপ্ত বালুর উপর দাড়িয়ে থাকার কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আগুনে ঝাপ দিয়েছে। কেননা তারা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর জিনিস থেকে পালিয়ে এসে তার চেয়ে বেশী ক্ষতিকর জিনিসের মধ্যে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ যদি বলা হয়, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কর্মের স্রষ্টা, আর বান্দার কর্মের মধ্যে যেহেতু ভালো-মন্দ উভয়ই রয়েছে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলার দিকে মন্দের সম্বন্ধ হয়ে যায়। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তারা বলেছে বান্দার কর্ম বান্দা নিজেই সৃষ্টি করে। এখন যেই সমস্যাটি হলো, তাদের পূর্বেরটির চেয়ে আরো বেশী ভয়াবহ। এতে করে আল্লাহর ইচ্ছার উপর কাফেরের ইচ্ছা জয়লাভ করা আবশ্যক হয়।
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেছেন যে, কাফের ঈমান আনয়ন করুক। এ ক্ষেত্রে কাফের যদি ঈমান না আনে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর কাফেরের ইচ্ছা জয়লাভ করেছে। নাউযুবিল্লাহ। কেননা তাদের মতেও আল্লাহ তা‘আলা কাফের থেকে ঈমান সংঘটিত হওয়ার ইচ্ছা করেছেন। আর কাফের কুফুরী করার ইচ্ছা করেছে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা বাস্তবায়ন না হয়ে কাফেরের ইচ্ছাই বাস্তবায়ন হয়েছে!! সে সঙ্গে এরূপ বিশ্বাস থেকে একাধিক স্রষ্টাও সাব্যস্ত হয়ে যায়!! এ আক্বীদাহ হচ্ছে সর্বাধিক নিকৃষ্ট আক্বীদাহ। এ কথার উপর কোনো দলীল নেই। বরং এটি কুরআন ও হাদীছের দলীলের সুস্পষ্ট বিপরীত।
বাকীয়া ইবনুল ওয়ালীদ রহিমাহুল্লাহর হাদীছ থেকে ইমাম আওযাঈর সনদে লালাকায়ী বর্ণনা করেন যে, আমাদের কাছে আলা ইবনুল হাজ্জাজ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ বিন উবাইদ আল-মক্কী, তিনি বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আমাদের কাছে একজন লোক এসেছে, যে তাকদীরকে অস্বীকার করে। জবাবে তিনি বললেন, আমাকে দেখিয়ে দাও। তখন তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তারা বললো, আপনি তাকে কী করবেন। ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে। আমি যদি সক্ষম হই, তাহলে আমি তার নাক কেটে ফেলবো। আমি যদি তার ঘাড় ধরতে পারি, তাহলে তার ঘাড় মটকিয়ে ফেলবো। কেননা আমি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
كَأَنِّي بِنِسَاءِ بَنِي فِهْرٍ يَطُفْنَ بِالْخَزْرَجِ تَصْطَفِقُ أَلْيَاتُهُنَّ مُشْرِكَاتٍ
‘‘আমি যেন বনী ফিহিরের মহিলাদেরকে দেখছি, তারা মুশরিক অবস্থায় তাদের নিতম্ব নাড়াতে নাড়াতে খাযরাজ গোত্রে বিচরণ করছে’’।
তারা এমনভাবে কোমড় নাড়াচ্ছে, যাতে তাদের একজনের নিতম্ব অন্যজনের নিতম্বে লেগে যাচ্ছে। এ হচ্ছে দ্বীন ইসলামের মধ্যে প্রথম শির্ক। আল্লাহর শপথ! তাদের এ নিকৃষ্ট মতবাদ তাদেরকে এ পর্যন্ত নিয়ে ঠেকাবে যে, তারা বলবে আল্লাহ তা‘আলা কল্যাণকর বিষয়গুলো সৃষ্টি করেননি, যেমন তারা আল্লাহ তা‘আলাকে মন্দের স্রষ্টা মনে করেনি’’।[2]
গ্রন্থকারের কথা, এ হচ্ছে দ্বীন ইসলামের মধ্যে প্রথম শির্ক, এখান থেকে শেষ পর্যন্ত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর বক্তব্য।
তাকদীরে বিশ্বাস করা তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসকে সুশৃঙ্খল করে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার একত্বে বিশ্বাস করবে, কিন্তু তাকদীরে অবিশ্বাস করবে তার এ মিথ্যারোপ তাওহীদকে ত্রুটিযুক্ত করে।[3] আমর বিন হায়ছাম বলেন, আমরা একদা নৌকায় আরোহন করলাম। নৌকাতে আমাদের সাথে একজন অগ্নিপূজক এবং একজন তাকদীরে অবিশ্বাসী মুসলিম ছিল। তাকদীরে অবিশ্বাসী লোকটি অগ্নিপূজককে বলল, ইসলাম কবুল করো। অগ্নিপূজক বলল, আল্লাহ তা‘আলা চাইলে ইসলাম গ্রহণ করবো। তাকদীরে অবিশ্বাসী মুসলিম বলল, আল্লাহ তা‘আলা তো চায় যে তুমি মুসলিম হয়ে যাও। কিন্তু শয়তান তা চায় না। অগ্নিপূজক বলল, তোমার কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে, আল্লাহ চান আমি মুসলিম হয়ে যাই, কিন্তু শয়তান তা চায় না। তাহলে তো শয়তানের ইচ্ছাই জয়লাভ করেছে। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে শয়তানই আল্লাহর চেয়ে বেশী শক্তিশালী! আমি অধিক শক্তিশালীর সাথেই থাকবো। নাউযুবিল্লাহ
আসল কথা হলো কাদারীয়া বা মুতাযেলারা বান্দার কর্মে বান্দাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন মনে করে। ভালো-মন্দ সবকিছু যে আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়, তাতে তারা বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে মন্দ কাজগুলো আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি নয়। এগুলো বান্দা নিজেই সৃষ্টি ও সম্পাদন করে। তাই তাদের মতে বান্দার কুফুরীতে আল্লাহর কোনো ইচ্ছা থাকে না। আল্লাহ তা‘আলা কাফের থেকে ঈমানের ইচ্ছা করলেও কাফের না চাইলে কাফেরের ইচ্ছাই জয়লাভ করে।
বর্ণিত আছে যে, তাকদীরে অবিশ্বাসী মুতাযেলী ইমাম আমর বিন উবাইদ একদা ছাত্রদেরকে পড়াচ্ছিল। তখন একজন গ্রাম্য লোক এসে বলল, হে লোক সকল! আমার উট চুরি হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে আপনারা দুআ করুন, তিনি যেন আমার উটটি আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। আমর বিন উবাইদ তখন বলল, হে আল্লাহ! তুমি চাওনি যে, তার উট চুরি হোক। তারপরও চুরি হয়েছে। এখন তুমি তার উটটি ফিরিয়ে দাও। এতে গ্রাম্য লোকটি বলল, আমার জন্য তোমার দু‘আর কোনো প্রয়োজন নেই। আমর বিন উবাইদ বলল, কেন? আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আল্লাহর ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও যেহেতু চুরি হয়েছে, তাই এখন তিনি ফিরিয়ে দিতে চাইলেও সম্ভবত ফিরিয়ে দিতে পারবেন না!!
জনৈক ব্যক্তি আবু ইসাম কুস্ত্তল্লানিকে বলল, আল্লাহ তা‘আলা যদি আমাকে হেদায়াত থেকে বঞ্চিত করে গোমরাহিতে নিক্ষেপ করেন, অতঃপর শাস্তি দেন, তাহলে আপনার অভিমত কী? এরপরও কি আল্লাহ তা‘আলা ইনসাফকারী হবেন? আবু ইসাম এতে বললেন, হেদায়াতের মালিক যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা, তাই তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করবেন। যাকে ইচ্ছা তা থেকে বঞ্চিত করবেন।
আর কুরআন ও সুন্নাহর একাধিক দলীল প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর তাকদীর নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَوْ شِئْنَا لَآتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَٰكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّي لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
‘‘আমি যদি চাইতাম তাহলে পূর্বাহ্নেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার হেদায়াত দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার সে কথা পূর্ণ হয়ে গেছে, যা আমি বলেছি যে, আমি জাহান্নাম জিন ও মানুষ দিয়ে ভরে দেবো’’। (সূরা সাজদা: ১৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَن فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّىٰ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ
‘‘যদি তোমার রবের ইচ্ছা হতো তাহলে সারা দুনিয়াবাসী ঈমান আনতো। তবে কি তুমি মুমিন হবার জন্য লোকদের উপর জবরদস্তি করবে?’’। (সূরা ইউনুস: ৯৯)
আল্লাহ তা‘আলা সূরা তাকবীরের ২৯ নং আয়াতে বলেন,
وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
‘‘তোমরা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার বাইরে কিছুই ইচ্ছা করতে পারো না’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা দাহারের ৩০ নং আয়াতে বলেন,
وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا
‘‘তোমাদের চাওয়ায় কিছুই হয় না যদি আল্লাহ না চান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনআমের ৩৯ নং আয়াতে বলেন,
مَن يَشَإِ اللَّهُ يُضْلِلْهُ وَمَن يَشَأْ يَجْعَلْهُ عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ
‘‘আল্লাহ যাকে চান বিপথগামী করেন আবার যাকে চান সত্য সরল পথে পরিচালিত করেন’’।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনআমের ১২৫ নং আয়াতে বলেন,
فَمَن يُرِدِ اللَّهُ أَن يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ وَمَن يُرِدْ أَن يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ كَذَٰلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ
‘‘আল্লাহ যাকে সত্যপথ দেখাবার ইচ্ছা করেন তার বক্ষদেশ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে তিনি গোমরাহীতে নিক্ষেপ করার ইচ্ছা করেন, তার বক্ষদেশ খুব সংকীর্ণ করে দেন। যাতে মনে হয় সে কষ্ট করে আকাশের দিকে উঠার চেষ্টা করছে’’।
অর্থাৎ জোর খাটিয়ে যেমন আকাশের দিকে উঠা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি আল্লাহ যার বক্ষকে সংকীর্ণ করে দেন তার মধ্যে ঈমান ও তাওহীদের আলো ঢুকানো সম্ভব হয়না। আল্লাহ তা‘আলা তার বক্ষকে ইসলামের জন্য খুলে না দেয়া পর্যন্ত তাতে ঈমান ও তাওহীদ প্রবেশ করে না। এমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা অবিশ্বাসীদের উপর অপবিত্রতা চাপিয়ে দেন’’।
যারা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা এবং ভালোবাসা ও পছন্দকে একই রকম মনে করে, তাদের থেকেই মূলতঃ গোমরাহির উৎপত্তি হয়েছে। জাবরীয়া ও মুতাযেলারা প্রথমত আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও ভালোবাসাকে এক সমান মনে করেছে। অতঃপর জাবরীয়ারা মুতাযেলাদের থেকে আলাদা হয়ে বলেছে, সৃষ্টিজগতের সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুযায়ী হয়ে থাকে। সুতরাং সৃষ্টিজগতে যা কিছু হয়, সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা ও পছন্দ অনুপাতেই হয়ে থাকে।[4]
আর তাকদীরে অবিশ্বাসী কাদারীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা বলেছে, আল্লাহ তা‘আলার কাছে পাপাচার প্রিয় নয়। তিনি তা পছন্দও করেন না। সুতরাং তিনি তা সৃষ্টি, নির্ধারণ ও পছন্দ করেননি। পাপাচার তার ইচ্ছা ও সৃষ্টির বাইরে।
কুরআন ও সুন্নাহর বহু দলীল-প্রমাণ এবং মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা সম্পর্কিত কিছু দলীল ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। এ পর্যায়ে আমরা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা সম্পর্কে কিছু দলীল উল্লেখ করবো।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ ‘‘আল্লাহ বিপর্যয় মোটেই পছন্দ করেন না’’। (সূরা আল বাকারা: ২০৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَلَا يَرْضَىٰ لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ ‘‘কিন্তু তিনি তার বান্দার জন্য কুফুরী পছন্দ করেন না’’। (সূরা যুমার: ৭)
আল্লাহ তা‘আলা শির্ক, যুলুম, অশ্লীলতা, অহঙ্কার এবং অন্যান্য পাপাচার থেকে নিষেধ করার পর বলেন, كُلُّ ذَلِكَ كَانَ سيِّئُهُ عِنْدَ رَبِّكَ مَكْرُوْهًا
‘‘এ বিষয়গুলোর মধ্য থেকে প্রত্যেকটির খারাপ দিক তোমার রবের কাছে অপছন্দনীয়’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৩৮)
ছহীহ বুখারীতে নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,
«إِنَّ اللَّهَ كره لَكُمْ ثلاثا قِيلَ وَقَالَ وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ»
‘‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য তিনটি বিষয় অপছন্দ করেছেন। তোমাদের জন্য অর্থহীন কথা বলা, বেশী বেশী প্রশ্ন করা এবং ধন-সম্পদ নষ্ট করা অপছন্দ করেছেন’’।[5]
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ أَنْ يُؤْخَذَ بِرُخَصِهِ، كَمَا يَكْرَهُ أَنْ تُؤْتَى مَعْصِيَتُهُ
আল্লাহ যেসব কাজের অনুমতি দিয়েছেন, তা গ্রহণ করাকে পছন্দ করেন। আর তিনি অপছন্দ করেন পাপাচারে লিপ্ত হওয়াকে।[6] নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু‘আতে বলেছেন,
«أللهم إني أَعُوذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ وَأَعُوذُ بِمُعَافَاتِكَ مِنْ عُقُوبَتِكَ وأعوذبك منك»
‘‘হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির উসীলায় তোমার ক্রোধ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তোমার ক্ষমার উসীলায় তোমার শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং তোমার আযাব থেকে তোমার কাছেই আশ্রয় চাচ্ছি।[7]
প্রিয় পাঠক! আপনি লক্ষ্য করুন! নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি সিফাতের মাধ্যমে তার ক্রোধ থেকে এবং তার ক্ষমা করে দেয়া সিফাতের মাধ্যমে শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। উপরোক্ত সিফাতগুলোর মধ্যে সন্তুষ্টি নামক সিফাতটির প্রভাব হলো ক্ষমা এবং ক্রোধ নামক সিফাতটির প্রভাব হলো শাস্তি দেয়া। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এখানে আল্লাহ তা‘আলার এক সিফাতের উসীলায় অন্য সিফাত থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথমটি হলো মূল সিফাত আর দ্বিতীয়টি হলো তার প্রভাব। দু‘আটির শেষে সবগুলো সিফাতকেই আল্লাহ তা‘আলার সত্তার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মূলতঃ সবকিছুই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে।
হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। আমি যা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তা তোমার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে এবং তোমার যেই সন্তুষ্টি ও ক্ষমার উসীলায় তোমার অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তাও তোমার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। তুমি যদি ইচ্ছা করো, তাহলে তোমার বান্দার উপর সন্তুষ্ট হবে এবং তাকে ক্ষমা করে দিবে। আর ইচ্ছা করলে তুমি তার উপর ক্রোধান্বিত হবে এবং তাকে শাস্তি দিবে।
সুতরাং আমি যা অপছন্দ করি, তা থেকে আমার আশ্রয় প্রার্থনা এবং উহা আমার উপর আপতিত হওয়াতে বাধা প্রদান করাও তোমার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। প্রিয়-অপ্রিয় সবই তোমার ফায়ছালা ও ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। তোমার শাস্তি থেকে তোমার কাছেই আমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তোমার শক্তি, ক্ষমতা ও রহমতের উসীলায় ঐ বিপদাপদ, অকল্যাণ ও ক্ষতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা তোমার শক্তি, ইনসাফ ও হিকমতের কারণে হয়ে থাকে।তুমি ব্যতীত অন্য কারো ক্ষতি থেকে অন্যের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি না এবং তোমার কাছে এমন কোনো ক্ষতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি না, যা তোমার অনিচ্ছায় প্রকাশিত হয়। বরং তা তোমার নিকট থেকেই আগমন করে। উপরোক্ত কথাগুলোতে তাওহীদের যে পরিমাণ মারেফত এবং আল্লাহ তা‘আলার উবুদীয়াত রয়েছে, তা কেবল আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী, তার মারেফত এবং প্রকৃত উবুদীয়াত সম্পর্কে অবগত আলেমগণ ব্যতীত অন্য কেউ জানে না।
[2]. হাদীছটি যঈফ। দেখুন ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহর টিকাসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২৪৪।
[3]. যঈফ।
[4]. তাদের এ কথা সম্পূর্ণ বাতিল। সৃষ্টিজগতে যা কিছু হয়, সবই আল্লাহর পছন্দ অনুপাতে হয় না। আল্লাহ তা‘আলা পাপাচার সৃষ্টি করেছেন এবং তা হতে নিষেধ করেছেন। পাপাচারী থেকে যে পাপাচার সংঘটিত হয়, তাও আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়; কিন্তু তিনি উহাকে পছন্দ করেন না। পক্ষান্তরে তিনি আনুগত্যের কাজসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং বান্দাদেরকে তা বাস্তবায়ন করার হুকুম করেছেন। আনুগত্যের কাজ বাস্তবায়ন হওয়াকে তিনি পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন।
[5]. ছহীহ বুখারী হা/১৪৭৭, ছহীহ মুসলিম হা/৫৯৩।
[6]. ছহীহ: মুসনাদে আহমাদ হা/৫৮৬৬।
[7]. ছহীহ: আবূ দাউদ ১৪২৭।