ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَالْحَوْضُ الَّذِي أَكْرَمَهُ اللَّهُ تَعَالَى بِهِ غِيَاثًا لِأُمَّتِهِ حَقٌّ
আর হাউয যা আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তার উম্মতের পিপাসা নিবারণার্থে প্রদান করে সম্মানিত করেছেন, তা অবশ্যই সত্য।
.................................................................
ব্যাখ্যা: হাওযে কাউছারের ব্যাপারে বর্ণিত হাদীছগুলো মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পৌঁছেছে। ত্রিশের অধিক ছাহাবী থেকে হাদীছগুলো বর্ণিত হয়েছে। আমাদের সম্মানিত শাইখ ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর রহিমাহুল্লাহ হাদীছের সনদগুলো তার রচিত ‘বেদায়া ওয়ান নেহায়া’ নামক বিশাল ইতিহাস গ্রন্থে একত্র করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে স্বীয় রহমত দ্বারা আচ্ছাদিত করে নিন। এসব হাদীছ থেকে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ কিছু হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আনাস বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّ قَدْرَ حَوْضِي كَمَا بَيْنَ أَيْلَةَ وَصَنْعَاءَ مِنَ الْيَمَنِ، وَإِنَّ فِيهِ مِنَ الأَبَارِيقِ كَعَدَدِ نُجُومِ السَّمَاءِ
‘‘আমার হাওযের প্রশস্ততা হচ্ছে ইয়ামানের আয়লা এবং সানআর মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। এর পান পাত্রের সংখ্যা হবে আকাশের তারকার সমপরিমাণ’’।[1]
আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ نَاسٌ مِنْ أَصْحَابِي حَتَّى إِذَا عَرَفْتُهُمُ اخْتَلَجُوا دُونِي، فَأَقُولُ: أُصَيْحَابِي، فَيَقُولُ: لَا تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ»
‘‘কিয়ামতের দিন আমার নিকট আমার সাথীদের কিছু লোক উপস্থিত হবে। আমি তাদেরকে চিনতে পারবো। অতঃপর তাদেরকে আমার নিকট থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হবে। আমি তখন বলবো, এরা তো আমার সাথী। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, তুমি জানো না, এরা তোমার মৃত্যুর পর কী পরিমাণ নতুন নতুন বিধান তৈরী করেছে?[2] ইমাম মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল রহিমাহুল্লাহ আনাস বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহু ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে মসজিদে নববীতে বসেছিলেন। হঠাৎ তার মধ্যে তন্দ্রা বা এক প্রকার অচেতন ভাব দেখা দিল। তারপর তিনি হাসিমুখে মস্তক উত্তোলন করলেন। আমরা প্রশ্ন করলাম, আপনার হাসির কারণ কী হে আল্লাহর রসূল? তিনি বললেন, এ মুহূর্তে আমার উপর একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। তারপর তিনি পাঠ করলেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম,
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ (1) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (2) إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ (3)
‘‘নিশ্চয় আমি তোমাকে হাওযে কাওছার প্রদান করেছি। তাই তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও কুরবানী করো। নিশ্চয়ই তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীই লেজকাটা নির্বংশ’’ (সূরা কাওছার: ১-৩)।
অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা কি জানো কাওছার কী? আমরা বললাম, আল্লাহ্ এবং তার রসূল অধিক জানেন। তিনি বললেন, এটি জান্নাতের একটি নহর। আমার রব আমাকে তা প্রদান করবেন বলে ওয়াদা করেছেন। এতে প্রচুর কল্যাণ রয়েছে। এটি একটি হাওয, যেখানে কিয়ামতের দিন আমার উম্মত পানি পান করতে যাবে। এর পান পাত্রের সংখ্যা হবে আকাশের তারকাসম। তখন কতক লোককে ফেরেস্তাগণ হাওয থেকে তাড়িয়ে দিবেন। আমি বলবো, হে আমার রব! এরা তো আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ বলবেন, তুমি জানো না, তোমার পরে এরা কী পরিমাণ নতুন নতুন পথ ও মত অবলম্বন করেছিল’’।[3] ইমাম মুসলিমও এ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
মুসলিমের শব্দগুলো নিমণরূপ,
«هُوَ نَهْرٌ وَعَدَنِيهِ رَبِّي عَلَيْهِ خَيْرٌ كَثِيرٌ هُوَ حَوْضٌ تَرِدُ عَلَيْهِ أُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ»
এটি হলো একটি নদী। আমার রব এটি আমাকে দিবেন বলে ওয়াদা করেছেন। এতে রয়েছে প্রচুর কল্যাণ। এটি এমন একটি জলাশয়, যাতে কিয়ামতের দিন আমার উম্মত পানি পান করতে আসবে’’।
হাদীছের বাকী শব্দগুলো মুসনাদে আহমাদের শব্দের মতই। হাউযে কাউছার হলো হাশরের মাঠের এমন একটি জলাশয়ের নাম যাতে জান্নাতের কাউছার নামক নদী থেকে দু’টি নালা বের হয়ে তাতে পতিত হবে। হাওয হবে হাশরের মাঠে পুলসিরাত পার হওয়ার পূর্বে। কেননা হাওযে কাউছারের নিকট থেকে এমন এক শ্রেণীর লোককে তাড়িয়ে দেয়া হবে, যারা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল। এ শ্রেণীর লোক পুলসিরাত পার হতে পারবে না।
ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে জুন্দুব বিন আব্দুল্লাহ আলবাজালী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন, আমি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
«أَنَا فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ»
‘‘তোমাদের আগেই আমি হাওযে কাউছারের নিকট উপস্থিত থাকবো।[4] ফারাত বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে যিনি কাফেলার আগেই পানির ঘাটে পৌঁছে যান এবং সহযাত্রীদের পানির ব্যবস্থা করেন।
ছহীহ বুখারীতে সাহল বিন সা’দ বিন আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِنِّي فَرَطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ مَنْ مَرَّ عَلَيَّ شَرِبَ وَمَنْ شَرِبَ لَمْ يَظْمَأْ أَبَدًا لَيَرِدَنَّ عَلَيَّ أَقْوَامٌ أَعْرِفُهُمْ وَيَعْرِفُونِي ثُمَّ يُحَالُ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ»
‘‘কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের জন্য হাউযে কাউছারের নিকট উপস্থিত থাকবো। যে ব্যক্তি আমার কাছে আসবে আমি তাকে তা থেকে পান করাবো। আমার হাউজ থেকে যে একবার পানি পান করবে সে আর কখনো পিপাসিত হবে না। এমন সময় আমার কাছে একদল লোক আগমন করবে। আমি তাদেরকে চিনতে পারবো। তারাও আমাকে চিনতে পারবে। অতঃপর আমার ও তাদের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে।[5]
হাদীছের অন্যতম বর্ণনাকারী আবু হাযেম বলেন, আমার এ বর্ণনা শুনে নুমান বিন আবু আয়াশ বললেন, তুমি হাদীছটি এভাবেই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছো? আবু হাযেম বলেন, আমি বললাম, হ্যাঁ এভাবেই শুনেছি। নুমান বিন আবু আয়াশ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি হাওযে কাউছারের বিষয়ে আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে জোর দিয়ে বলতে পারি যে, তিনি আরো বাড়িয়ে বলেছেন,
«فَأَقُولُ إِنَّهُمْ مِنِّي فَقَالُ إِنَّكَ لَا تَدْرِي مَا أَحْدَثُوا بَعْدَكَ فَأَقُولُ سُحْقًا سُحْقًا لِمَنْ غَيَّرَ بَعْدِي»
‘‘আমি বলবো, এরা আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না তারা আপনার পরে কত বিদ‘আত তৈরী করেছিল। আমি বলবো, আমার রেখে আসা দ্বীনের মধ্যে যারা পরিবর্তন করেছো তারা এখান থেকে সরে যাও। অতঃপর তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হবে’’।[6] এখানে سحقا অর্থ হলো بعدا অর্থাৎ দূরে চলে যাও।
হাওযে কাউছারের গুণাগুণ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীছগুলো থেকে সংক্ষিপ্তভাবে আমরা যা জানতে পারি, তা হলো, হাওযে কাউছার হবে অত্যন্ত বিশাল এবং বরকতময় জলাশয়। জান্নাতের নদী আল কাউছার হতে এটি সম্প্রসারিত করা হবে। যার পানি হবে দুধের চেয়ে সাদা, বরফের চেয়ে শীতল, মধুর চেয়ে মিষ্টি এবং তার সুঘ্রাণ হবে কসত্মুরীর সুঘ্রাণের চেয়েও পবিত্র। এটি হবে অত্যন্ত প্রশস্ত এবং তার দৈর্ঘ ও প্রস্থ সমান। এর প্রত্যেক পার্শ্বের দূরত্ব হবে একমাসের পথ।
কতিপয় হাদীছে এসেছে, এখান থেকে যতই পান করা হবে, এর পানি ততই বৃদ্ধি হতে থাকবে এবং এর প্রশস্ততাও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কস্ত্তরীর মত সুঘ্রাণময় কাদা, মুক্তার ছোট ছোট পাথর এবং স্বর্ণের ছোট ছোট গাছ-পালার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে। তা থেকে মণি-মুক্ত সদৃশ উজ্জ্বল ফল-ফলাদি উৎপন্ন হবে। আমি সেই মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, যাকে কোনো কিছুই অক্ষম করতে পারে না। অন্যান্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে,
إِنَّ لِكُلِّ نَبِيٍّ حَوْضًا، وَإِنَّ حَوْضَ نَبِيِّنَا صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَعْظَمُهَا وَأَحْلَاهَا وَأَكْثَرُهَا وَارِدًا
প্রত্যেক নাবীরই হাওয থাকবে। আর আমাদের নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাউয হবে সবচেয়ে বড়, এর পানি হবে সর্বাধিক মিষ্টি এবং এখান থেকে পানি পানকারীর সংখ্যাও হবে সবচেয়ে বেশী।[7] আল্লাহ তা‘আলা যেন তার অনুগ্রহ ও দয়ার মাধ্যমে আমাদেরকে তাদের কাতারে শামিল করেন।
আল্লামা ইমাম আবু আব্দুল্লাহ কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ التذكرة নামক গ্রন্থে বলেন, মীযান (দাঁড়িপাল্লা) এবং হাওযে কাউছারের ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। এ দু’টি থেকে আগে কোন্টি হবে? কেউ কেউ বলেছেন, মীযান আগে স্থাপন করা হবে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, আগে হবে, হাউযে কাউছার। আবুল হাসান আল-কাবেসী রহিমাহুল্লাহ বলেন, সঠিক কথা হলো হাউয হবে মীযানের প্রথমে।
ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, পরিস্থিতি ও অবস্থা বিচারে এ কথাই অধিক যুক্তিযুক্ত। কেননা কিয়ামতের দিন লোকেরা পিপাসিত হয়ে কবর থেকে বের হবে। তাই এটি মীযান ও সীরাতের আগে হওয়াই শ্রেয়। যেমনটি ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। আবু হামেদ ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ তার অন্যতম কিতাব كشف علم الآخرة -এ বলেন, সালাফদের কিছু কিছু লেখক বর্ণনা করেছেন যে, লোকেরা পুলসিরাত পার হওয়ার পর হাওযে কাউছারের নিকট উপস্থিত হবে। এ কথা যিনি বলেছেন, তিনি ভুল করেছেন। ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইমাম আবু হামেদ গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহর কথাই সঠিক।
অতঃপর ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, তোমার মনে যেন এ কথা না জাগে যে, বর্তমান এ পৃথিবীতে পুলসিরাত, হাউযে কাউছার ইত্যাদি স্থাপন করা হবে। বরং এ পৃথিবীকে অন্য যমীনে পরিবর্তন করে হাশরের মাঠ তৈরী করা হবে। রোপার মত চকচকে সাদা হবে সে যমীন। এমন যমীন যাতে কোনো রক্তপাত করা হয়নি এবং তাতে কেউ কারো উপর কোনো যুলুম করেনি। মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ বিচার-ফায়ছালার জন্য অবতরণ করার সময় এ যমীন উদ্ভাসিত হবে। ইমাম কুরতুবীর কথা এখানেই শেষ।
আল্লাহ তা‘আলা হাউযে কাউছার অস্বীকারকারীদের অমঙ্গল করুন। মহা পিপাসার দিন তারা হাউযে কাউছার থেকে বিতাড়িত হওয়ারই উপযুক্ত।
[2]. ছহীহ মুসলিম ২২৯৫।
[3]. ছহীহ: মুসনাদে আহমাদ।
[4]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী হা/৬৫৭৫, ছহীহ মুসলিম হা/২২৮৯।
[5]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী হা/৬৫৮৩, ছহীহ মুসলিম হা/২২৯০।
[6]. ছহীহ বুখারী ৬৫৮৪, অধ্যায়: কিতাবুর্ রিকাক।
[7]. হাসান: তিরমিযী ২৪৪৩।