ইমাম মুসলিম ও তিরমিযী ওয়াছেলা বিন আসকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা ইসমাঈলের বংশধর থেকে বনী কেনানাকে নির্বাচন করেছেন। বনী কেনানা থেকে বাছাই করেছেন কুরাইশকে। কুরাইশ থেকে নির্বাচন করেছেন হাশেমকে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমাকে বনী হাশেম থেকে বাছাই করেছেন।
কেউ যদি প্রশ্ন করে, উপরোক্ত কথা তো রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কথার বিরোধী যেখানে তিনি বলেছেন,
لَا تُفَضِّلُونِي عَلَى مُوسَى، فَإِنَّ النَّاسَ يُصْعَقُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَأَكُونُ أَوَّلَ مَنْ يُفِيقُ، فَأَجِدُ مُوسَى بَاطِشًا بِسَاقِ الْعَرْشِ، فَلَا أَدْرِي هَلْ أَفَاقَ قَبْلِي، أَوْ كَانَ مِمَّنِ اسْتَثْنَى اللَّهُ؟
‘‘তোমরা আমাকে মুসার উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করো না। কেননা কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে। আমি সর্বপ্রথম জ্ঞান ফিরে পাবো। জ্ঞান ফিরে পেয়ে আমি দেখতে পাবো, মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর আরশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানি না, তিনি কি আমার পূর্বে জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন? না কি আল্লাহ তা‘আলা তাকে ঐসব সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যারা সংজ্ঞাহীন হবে না?’’[1] সুতরাং এ হাদীছ এবং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী, আমি আদম সন্তানের নেতা। তবে এটি কোন অহংকারের বিষয় নয়’ এর মধ্যে কিভাবে সমন্বয় করা হবে?
এর জবাব হলো একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অন্য নাবীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করতে নিষেধ করেছেন। ঘটনার বিস্তারিত ব্বিরণ হলো, দু’ব্যক্তি পরস্পর গালাগালিতে লিপ্ত হল। তাদের একজন ছিল মুসলিম এবং অপরজন ছিল ইহুদী। মুসলিম বলল, ঐ সত্তার শপথ! যিনি মুহাম্মাদকে সৃষ্টিজগতের জন্য নির্বাচন করেছেন। ইহুদী বলল, ঐ সত্ত্বার শপথ! যিনি মুসাকে সৃষ্টিজগতের জন্য নির্বাচন করেছেন। এতে মুসলিম হাত উঠিয়ে ইহুদীর চেহারায় চপেটাঘাত করল এবং বলল, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মধ্যে জীবিত থাকতেই তুমি এ কথা বলছো? ইহুদী তখন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে গিয়ে ঐ মুসলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তোমরা আমাকে মুসার উপর প্রাধান্য দিও না। কেননা লোকেরা কিয়ামতের দিন বেহুশ হয়ে পড়বে। আমিও তাদের সাথে বেহুশ হয়ে পড়ব। এরপর আমি সবার আগে চেতনা ফিরে পাবো। আমি তখন দেখতে পাবো যে মুসা আরশের এক পাশ ধরে আছেন। আমি জানি না, তিনি বেহুঁশ হয়ে আমার পূর্বেই চেতনা ফিরে পেয়েছেন? না তিনি তাদের একজন যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা বেহুশ হওয়া থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন।[2]
অহমিকা ও গোঁড়ামি করে এবং নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে যদি নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অন্যান্য নাবী-রাসূলের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়, তাহলে তা নিন্দনীয়। ঠিক এমনি কোনো মানুষ ক্রোধান্বিত হয়ে এবং গোত্রপ্রীতির কারণে জিহাদের ময়দানে যখন অহমিকা প্রদর্শন করবে, তখন সে বীরত্ব প্রদর্শন প্রশংসনীয় হবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এহেন অহমিকা প্রদর্শন করা হারাম করেছেন। মূলতঃ আল্লাহ তা‘আলা নাবীদের পরস্পরকে পরস্পরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَقَدْ فَضَّلْنَا بَعْضَ النَّبِيِّينَ عَلَىٰ بَعْضٍ وَآتَيْنَا دَاوُودَ زَبُورًا
‘‘আমি কতক নাবীকে কতক নাবীর উপর মর্যাদা দিয়েছি এবং আমি দাউদকে যাবুর দিয়েছিলাম’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৫৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۘ مِّنْهُم مَّن كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ
‘‘এ রসূলদের একজনকে আরেকজনের উপর আমি অধিক মর্যাদাশালী করেছি। তাদের কারোর সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন, কাউকে তিনি অন্য দিক দিয়ে উন্নত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন’’। (সূরা আল বাকারা: ২৫৩)
সুতরাং জানা গেল, অহংকার করে অথবা কারো মর্যাদা কমানোর জন্য একজন নাবীকে অন্যজনের উপর প্রাধান্য দেয়া নিন্দনীয়। এ অর্থেই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণীও এসেছে, যেখানে তিনি বলেছেন,
لَا تُفَضِّلُوا بَيْنَ الْأَنْبِيَاءِ
‘‘তোমরা নাবীদের কাউকে অন্য কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করো না’’।
তবে প্রশ্ন হলো এ হাদীছটি ছহীহ কি না?[3] যে হাদীছে মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা এসেছে, সেখানেও এ কথাটি এসেছে। আর তা বুখারী এবং অন্যান্য কিতাবেও রয়েছে। কিন্তু কোনো কোনো মুহাদ্দিছ বলেছেন, হাদীছটির মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। তবে মুসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছেও এ অংশটি রয়েছে। সে হাদীছটি ছহীহ । সকল মুহাদ্দিছের ঐক্যমতে তা ছহীহ।
অন্যান্য আলেমগণ উভয় হাদীছের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে অন্য একটি জবাব দিয়েছেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে বলেছেন,
لَا تُفَضِّلُونِي عَلَى مُوسَى
‘‘তোমরা আমাকে মুসার উপর প্রাধান্য দিও না’’ এবং যেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘তোমরা নাবীদের একজনকে অন্যজনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করো না’’ সেখানে নির্দিষ্টভাবে কোনো নাবীকে অন্য কোনো নাবীর উপর প্রাধান্য দিতে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং খাসভাবে কতক রসূলকে অন্য কতকের উপর প্রাধান্য দেয়া যাবে না।
আর রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী:
أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ وَلاَ فَخْرَ وأول شافع وأول مشفع
‘‘আমি আদম সন্তানের নেতা। তবে এটি কোন অহংকারের বিষয় নয়। আমি সর্বপ্রথম শাফা‘আতকারী এবং আমার শাফা‘আতই সর্বপ্রথম গৃহীত হবে’’ এতে সকল নাবী-রাসূলের উপর মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাধান্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। এভাবে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাধান্য বর্ণনা করাতে কোনো দোষ নেই। যদি বলা হয়, অমুক ব্যক্তি শহরের মধ্যে সর্বোত্তম, তাহলে এতে নির্দিষ্ট করে কারো উপর তার শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা হয় না। কিন্তু এটি ঐ কথার বিপরীত যখন শহরের কাউকে নির্দিষ্ট করে বলা হবে, অমুক তোমার চেয়ে উত্তম। শাইখ ইবনে আবীল ইয রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি দেখেছি ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ শারহু মাআনীল আছারে উভয় হাদীছের মধ্যে এভাবেই সমন্বয় করেছেন।
আর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, «لَا تُفَضِّلُونِي عَلَى يُونُسَ بْنِ مَتَّى» ‘‘তোমরা আমাকে ইউনূস বিন মাত্তার উপর প্রাধান্য দিও না’’।
কোনো কোনো আলেমের কাছে যখন এ হাদীছের ব্যাখ্যা চাওয়া হলো, তখন তিনি বলেছেন, প্রচুর মাল না দিলে তাদের জন্য এর ব্যাখ্যা করা হবে না। যখন তাকে প্রচুর মাল দেয়া হলো, তখন তিনি বললেন, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কেউ যেন তাকে ইউনুস বিন মাত্তার উপর প্রাধান্য না দেয়, কারণ মাছের পেটে থাকা অবস্থায় তিনি আল্লাহর ততটুকু নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলেন, যেমন তিনি মিরাজের রাতে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছিলেন। লোকেরা এ ব্যাখ্যাকে একটি বিরাট ব্যাখ্যা হিসাবে গণ্য করেছে।
যারা এটিকে হাদীছ মনে করেছে এবং এর ব্যাখ্যাকে বিরাট কিছু মনে করেছে, তারা আল্লাহর কালাম এবং রাসূলের কালামের শব্দ ও অর্থ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এ হাদীছটি উপরোক্ত শব্দে নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহের কোনো লেখক উল্লেখ করেন নি। এ বিষয়ে ছহীহ বুখারীর হাদীছের শব্দ হলো,
لَا يَنْبَغِي لِعَبْدٍ أَنْ يَقُولَ أَنَا خَيْرٌ مِنْ يُونُسَ بْنِ مَتَّى
‘‘কোনো বান্দা যেন এ কথা না বলে, আমি ইউনুস বিন মাত্তা থেকে উত্তম’’।
অন্য বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি বলল, আমি ইউনুস বিন মাত্তা থেকে উত্তম সে মিথ্যা কথা বলল’’। এটি সকল মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং কোনো মানুষের জন্য এটি বৈধ নয় যে, সে নিজেকে ইউনুস বিন মাত্তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করবে। তবে হাদীছের মধ্যে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইউনুস বিন মাত্তার উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করতে নিষেধ করা হয়নি। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ইউনুস আলাইহিস সালাম সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন যে, একটি মাছ তাকে গিলেছিল, তখন তিনি নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলেন। অর্থাৎ এমন কাজ করেছিলেন, যার কারণে তাকে দোষারোপ করা যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَذَا النُّونِ إِذ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَن لَّن نَّقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَىٰ فِي الظُّلُمَاتِ أَن لَّا إِلَٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
‘‘আর মাছ ওয়ালাকেও আমি অনুগ্রহ করেছিলাম। স্মরণ করো যখন সে রাগান্বিত হয়ে চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল আমি তাকে পাকড়াও করবো না। শেষে সে অন্ধকারের মধ্য থেকে ডেকে উঠলো তুমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, পবিত্র তোমার সত্তা, অবশ্যই আমি অপরাধ করেছি’’। (সূরা আম্বীয়া: ৮৭)
কারো মনে এমন ধারণা হতে পারে যে, সে ইউনুস বিন মাত্তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সুতরাং ইউনুস আলাইহি ওয়া সাল্লামের দু‘আর প্রতি তার কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা সে এমন কাজ করে না, যার কারণে তাকে দোষারোপ করা যায়। যে ব্যক্তি এরূপ ধারণা করবে, সে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলার প্রত্যেক বান্দাই ইউনুস আলাইহিস সালামের দু‘আ করে থাকে। তারা সকলেই (لَّا إِلَٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ) বলে থাকে। সর্বপ্রথম নাবী এবং সর্বশেষ নাবীও অনুরূপ দু‘আ করেছেন। সর্বপ্রথম নাবী আদম আলাইহিস সালাম বলেছেন,
قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘‘হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। এখন যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি রহম না করো, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো’’। (সূরা আরাফ: ২৩)
সর্বশেষ নাবী, সর্বোত্তম নাবী এবং নাবীদের নেতা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছহীহ হাদীছে বলেছেন,
وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِى فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ إِنَّ صَلاَتِى وَنُسُكِى وَمَحْيَاىَ وَمَمَاتِى لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ اللَّهُمَّ أَنْتَ الْمَلِكُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ. أَنْتَ رَبِّى وَأَنَا عَبْدُكَ ظَلَمْتُ نَفْسِى وَاعْتَرَفْتُ بِذَنْبِى فَاغْفِرْ لِى ذُنُوبِى جَمِيعًا إِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ وَاهْدِنِى لأَحْسَنِ الأَخْلاَقِ لاَ يَهْدِى لأَحْسَنِهَا إِلاَّ أَنْتَ وَاصْرِفْ عَنِّى سَيِّئَهَا لاَ يَصْرِفُ عَنِّى سَيِّئَهَا إِلاَّ أَنْتَ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ كُلُّهُ فِى يَدَيْكَ وَالشَّرُّ لَيْسَ إِلَيْكَ أَنَا بِكَ وَإِلَيْكَ تَبَارَكْتَ وَتَعَالَيْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ
‘‘আমি একমুখী হয়ে স্বীয় মুখমণ্ডল ঐ সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরেকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমার ছ্বলাত, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য। তার কোন অংশীদার নেই। আমি তাই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল। হে আল্লাহ! তুমি এমন বাদশাহ যিনি ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই। তুমি আমার প্রভু। আমি তোমার বান্দা। আমি আমার নিজের উপর যুলুম করেছি। আমি আমার পাপ স্বীকার করছি। সুতরাং তুমি আমার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দাও। তুমি ব্যতীত গুনাহসমূহ ক্ষমা করার কেউ নেই। তুমি আমাকে সর্বোত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করো। তুমি ব্যতীত আর কেউ উত্তম চরিত্রের দিকে পরিচালিত করতে পারে না। তুমি আমার থেকে খারাপ চরিত্রগুলো দূর করে দাও। তুমি ছাড়া আর কেউ আমার থেকে খারাপ চরিত্রগুলো দূর করতে সক্ষম নয়। হে আমার প্রভু! আমি তোমার হুকুম পালন করতে প্রস্ত্তত ও উপস্থিত আছি। আমি তোমার আনুগত্যের জন্য সদা প্রস্ত্তত রয়েছি। সমস্ত কল্যাণ তোমার উভয় হস্তেই নিহিত। অকল্যাণকে তোমার দিকে সম্বোধিত করা শোভনীয় নয়। আমি সম্পূর্ণরূপে তোমার দিকে মুখাপেক্ষী ও নিজেকে তোমার উপর সোপর্দকারী এবং তোমার দিকেই আমি প্রত্যাবর্তনকারী। তুমি বরকমতময় ও মহিমান্বিত। তোমার কাছেই আমি ক্ষমা চাচ্ছি এবং তোমার নিকটই তাওবা করছি।[4]
আলী বিন আবু তালেব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং অন্যান্য ছাহাবী থেকে এ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। ছ্বলাত শুরু করার সময় নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দু‘আ পাঠ করতেন। মুসা আলাইহিস সালাম তার দু‘আয় বলেছেন,
رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
‘‘হে আমার রব! আমি নিজের উপর যুলুম করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি ক্ষমাশীল মেহেরবান’’। (সূরা কাসাস: ১৬)
ইউনুস আলাইহিস সালামের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تَكُن كَصَاحِبِ الْحُوتِ
‘‘অতএব তোমার রবের চূড়ান্ত ফায়ছালা পর্যন্ত ধৈর্যসহ অপেক্ষা করো এবং মাছ ওয়ালার মতো হয়ো না’’। (সূরা কালাম: ৪৮)
এখানে আমাদের নাবীকে ইউনুস আলাইহিস সালামের সাদৃশ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং তাকে উলুল আযম রসূলদের অনুসরণ করার আদেশ প্রদান করা হয়েছে। সূরা আহকাফের ৩৫ নং আয়াতে তিনি বলেন,
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ
‘‘অতএব, তুমি সবর করো, যেমন সুদৃঢ় মনোবলের অধিকারী রসূলগণ সবর করেছেন এবং ওদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবে না’’।
সুতরাং কেউ বলতে পারে যে, আমি ইউনুসের চেয়ে ভালো। তবে তার জেনে রাখা আবশ্যক যে, উত্তম ব্যক্তির জন্য এটি জায়েয নয় যে, সে তার চেয়ে কম মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির উপর অহংকার করবে। আর সে যদি প্রকৃতপক্ষে উত্তম না হয়ে থাকে, তাহলে কিভাবে তার জন্য অহমিকা প্রদর্শন করা বৈধ হবে? কেননা যারা নিজেরা নিজেদের বড় মনে করে এবং অহংকার করে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পছন্দ করেন না।
ছহীহ মুসলিমে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন,
أُوحِيَ إِلَيَّ أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لَا يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلَا يَبْغِيَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ
‘‘আমার নিকট অহী প্রেরণ করা হয়েছে যে, তোমরা বিনয়ী হও। কেউ যেন অন্য কারো উপর গর্ব না করে এবং তাদের কেউ যেন অন্যের উপর যুলুম না করে’’। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু সাধারণ মুমিনদের উপর অহংকার করতে নিষেধ করেছেন, তাই একজন মর্যাদাবান নাবীর উপর অহংকার করা কিভাবে নিষেধ হবে না? নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«لَا يَنْبَغِي لِعَبْدٍ أَنْ يَقُولَ أَنَا خَيْرٌ مِنْ يُونُسَ بْنِ مَتَّى» ‘‘কোনো বান্দা যেন এ কথা না বলে, আমি ইউনুস বিন মাত্তা থেকে উত্তম’’। এ নিষেধাজ্ঞা সকলের জন্য। কেউ যেন নিজেকে ইউনুস আলাইহিস সালামের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে না করে এবং তার উপর যেন অহংকার না করে। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
«مَنْ قَالَ إِنِّي خَيْرٌ مِنْ يُونُسَ بْنِ مَتَّى فَقَدْ كَذَبَ»
যে ব্যক্তি বলল, আমি ইউনুস বিন মাত্তা থেকে শ্রেষ্ঠ, সে মিথ্যা বলল’’। সুতরাং যদি ধরেও নেয়া হয় সে ইউনুস আলাইহিস সালাম থেকে উত্তম, তাহলে তার এ কথার মাধ্যমে একজন মর্যাদাবান নাবীর মর্যাদা কমানো হবে। তাই সে মিথ্যাবাদী হিসাবে গণ্য হবে।[5]
কোনো নাবী এ কথা বলতে পারে না। কোনো ব্যক্তি এ কথা বলেছে, এখানে তা উদ্দেশ্য নয়; বরং এখানে সাধারণভাবে এটি বলা হয়েছে যে, কেউ যদি বলে। যদিও কোনো নাবীর পক্ষে এ ধরণের কথা বলা অসম্ভব। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করো, তবে তোমার কর্ম নিস্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’। (সূরা যুমার: ৬৫)
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দ্বারা শির্ক হওয়া অসম্ভব হওয়া সত্ত্বেও এ কথা বলা হয়েছে। কুরআন ও হাদীছে আমলগুলো নির্ধারণ ও বর্ণনা করার সাথে সাথে সৎ আমলের বিনিময়ে ছাওয়াবের ওয়াদা ও পাপ কাজ করলে শাস্তির ভয় দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে। আসমানী কিতাবসমূহে নাবী-রসূলদেরকে সম্বোধন করে বেশ কিছু কথা বলা হলেও তা দ্বারা মূলত তাদের উম্মত উদ্দেশ্য।
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি সমস্ত আদম সন্তানের নেতা। তিনি যদি এ সংবাদ না দিতেন, তাহলে আমরা এ কথা জানতে পারতাম না। কেননা তার পরে আর এমন কোনো নাবী নেই, যিনি আমাদেরকে আল্লাহর নিকট তার মর্যাদা সম্পর্কে সংবাদ দিবেন। অনুরূপ তিনি তার পূর্বের নাবীদের ফযীলত সম্পর্কেও আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলের উপর রহমত নাযিল করুন। এ জন্যই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বলেছেন, আমি আদম সন্তানের নেতা, তার পরেই তিনি এক বর্ণনায় বলেছেন, এতে আমার অহংকার করার কিছুই নেই।
সুতরাং আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী কোনো মুসলিম কি এ কথা বলতে পারে, যাকে মিরাজের রাত্রিতে তার রবের সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যিনি আল্লাহর নৈকট্যশীল সম্মানিত বান্দা হিসাবে স্বীকৃত তার মর্যাদা ঐ বান্দার মতই, যাকে মাছ গিলে ফেলেছিল ও যার কাজের কারণে দোষারোপ করা হয়েছিল? সম্মানিত নৈকট্যশীল বান্দার মর্যাদা আর পরীক্ষায় নিপতিত দোষারোপকৃত বান্দার মর্যাদা সমান হয় কিভাবে? মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করা হয়েছে ও তাকে উর্ধ্বাকাশে নিয়ে নৈকট্য প্রদান করা হয়েছে এবং ইউনুস আলাইহিস সাল্লামকে আদব শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং পানির নিচে মাছের পেটে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
সুতরাং হে পাঠক আপনি এ বানোয়াট হাদীছটির প্রতি খেয়াল করুন, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে সম্বন্ধ করে বলা হয়েছে যে, তিনি বলেছেন,
«لَا تُفَضِّلُونِي عَلَى يُونُسَ بْنِ مَتَّى» ‘‘তোমরা আমাকে ইউনূস বিন মাত্তার উপর প্রাধান্য দিও না’’। যেই বিকৃত অর্থে এ হাদীছের শব্দগুলো রচনা করা হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তা বলেননি। এর ব্যাখ্যায় এক শ্রেণীর লোক বলেছে, এখানে ইউনুস আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করতে নিষেধ করার কারণ হলো, ইউনুস আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাছের পেটে ঢুকে আল্লাহ তা‘আলার সে পরিমাণ নিকটে চলে গেছেন, যে পরিমাণ নৈকট্য লাভ করেছিলেন মিরাজের রাতে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহন করে স্বয়ং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাদের এ ব্যাখ্যা বাতিল। এ ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সুস্পষ্ট অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত সকল সৃষ্টির উপর আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়ার বিষয়টি নাকোচ করার চেষ্টা করা হয়েছে।[6]
আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির উপরে। এ অর্থে আলেমগণ একহাজারেরও বেশী দলীল উল্লেখ করেছেন।ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ এর উক্তি: مُحِيطٌ بِكُلِّ شَيْءٍ وَفَوْقَهُ ‘‘তিনি সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন এবং তিনি সবকিছুর উপরে’’ এ কথার ব্যাখ্যা করার সময় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ।
[2]. সহীহ বুখারী, হা/২৪১১।
[3]. ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন: শাইখের তাখরীজসহ শারহুল আকীদাহ, আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ১২৮।
[4]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: রাতের ছবলাতের দু‘আ।
[5]. এখন প্রশ্ন হলো কেউ কি এই কথা বলেছে যে, সে নাবীদের থেকে উত্তম? এর জবাব হলো এ রকম মানুষ রয়েছে, যারা নাবীদের চেয়ে তাদের অলীদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। তারা বলে অলীগণ এমন সাগরে সাতার কাটেন, যার কিনারায় স্বয়ং নাবীগণ দাঁড়িয়ে থাকেন। শিয়া-রাফেযীরা বলে থাকে, তাদের ইমামদের এমন মর্যাদা রয়েছে, যে পর্যন্ত কোনো কোনো নৈকট্যশীল ফেরেশতা কিংবা প্রেরিত নাবী-রসূলগণও পৌঁছতে পারে না।
[6]. আশায়েরাদের ইমাম জুওয়াইনী উপরোক্ত বানোয়াট হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ করে বলার চেষ্টা করেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সকল সৃষ্টির উপরে নন এবং তিনি তার বান্দাদেরও উপরে নন। তিনি হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, ইউনুস আলাইহি ওয়া সাল্লাম গভীর সমুদ্রের পানির নীচে থাকা এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজের রাতে সাত আসমানের উপরে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে যাওয়া একই রকম। অর্থাৎ উভয় অবস্থার মাধ্যমে তারা উভয়েই আল্লাহর একই রকম নৈকট্য লাভ করেছেন। তাই তিনি বলেছেন, তোমরা আমাকে ইউনুস আলাইহিস সালামের উপর প্রাধান্য দিও না। সুতরাং যে সৃষ্টি গভীর সমুদ্রের পানির নীচে অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে আর যে সৃষ্টি সাত আসমানের উপরে রয়েছে, আল্লাহর নৈকট্য লাভের দিক দিয়ে কিংবা তার নিকটে থাকার দিক দিয়ে তারা উভয়ে সমান। জুওয়াইনীর এ ব্যাখ্যা সঠিক নয়। কারণ বিবেক-বুদ্ধির দলীল দাবি করে যে, উর্ধ্বজগতের সৃষ্টি এবং নিমণজগতের সৃষ্টি আল্লাহর নৈকট্য লাভের দিক দিয়ে সমান নয়, মাটির নীচের এবং সমুদ্রের গভীর পানির নীচের সৃষ্টি আর উর্ধ্বাকাশের নৈকট্যশীল ফেরেশতাগণ একই রকম মর্যাদার অধিকারী নয়। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উর্ধ্ব আকাশে উঠিয়ে আল্লাহ তাআলা মিরাজের রাতে বিরাট নৈকট্য ও সম্মান দান করেছেন। ঐদিকে আল্লাহ তাআলা ইউনুস আলাইহিস সালামকে দোষারোপ করে মাছের পেটে ঢুকিয়ে সাগরের গভীর পানির নীচে নামিয়েছেন। ইউনুস আলাইহিস সালাম সেখানে অবস্থানকালে ভুল স্বীকার করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করলেও উভয়ের নৈকট্য এক সমান নয়। মোটকথা, জুওয়াইনী বলতে চেয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে নন, সাত আসমানের উপরেও নন; বরং إن الله في كل مكان ‘‘আল্লাহ তা‘আলা সর্বত্র বিরাজমান’’। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার বহু উর্ধ্বে।
ইমাম ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ উপরোক্ত হাদীছ রচনাকারী এবং হাদীছটি ব্যাখ্যায় সুফীরা যে বাতিল ব্যাখ্যা করেছে, তার কড়া প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন, «لَا تُفَضِّلُونِي عَلَى يُونُسَ بْنِ مَتَّى» ‘‘তোমরা আমাকে ইউনূস বিন মাত্তার উপর প্রাধান্য দিও না’’। এ শব্দে হাদীছটি সঠিক নয়। এ বিষয়ে সহীহ বুখারীর হাদীছের শব্দ হলো,«لَا يَنْبَغِي لِعَبْدٍ أَنْ يَقُولَ أَنَا خَيْرٌ مِنْ يُونُسَ بْنِ مَتَّى» ‘‘কোনো বান্দা যেন এ কথা না বলে, আমি ইউনুস বিন মাত্তা থেকে উত্তম’’। এ শেষোক্ত সহীহ হাদীছটি বলার কারণ হলো, কেউ বলতে পারে আমি ইউনুস বিন মাত্তা থেকে উত্তম। কারণ তিনি রাগ করে পালিয়ে গেছেন। আল্লাহর অনুমতি নেননি। তিনি মনে করেছিলেন, আল্লাহ তাকে ধরবেন না কিংবা দুনিয়াকে তার জন্য সংকীর্ণ করে দিবেন না। পরিশেষে তাকে ময়দানে নিক্ষেপ করা হলো। এর আগে তাকে একটি মাছ গিলেছিল। তাই আমি তার চেয়ে উত্তম। কেননা আমি এ রকম কিছু করিনি। কেউ এ রকম ধারণা পোষণ করতে পারে। তাই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ধারণা পোষণ করতে নিষেধ করেছেন। ইউনুস আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার নাবীদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তার মাধ্যমে বিরাট নিদর্শন ও মুজেযা প্রকাশ করেছেন। মাছ তাকে নিজের পেটে নিয়ে গভীর পানির অন্ধকারে চলে যাওয়ার পরও তিনি মারা যাননি। মাছ তাকে হজমও করতে পারেনি। নির্দিষ্ট একটি মেয়াদ পর্যন্ত তিনি মাছের পেটেই থাকলেন। পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলার আদেশে মাছ তাকে সমুদ্র সৈকতে নিক্ষেপ করল। তিনি তার উপর একটি লাউ গাছ উদ্গত করলেন। অতঃপর তিনি সুস্থ হলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার সম্প্রদায়ের নিকট পাঠালেন। তাদের সংখ্যা ছিল এক লাখ বা তার চেয়ে বেশী। তারা এবার ঈমান আনল। সুতরাং ইউনুস আলাইহিস সালামের যথেষ্ট ফযীলত রয়েছে। যদিও তিনি ভুল করেছেন। এ ভুল তার মর্যাদাকে কমিয়ে দেয়নি। কারণ তিনি ভুল স্বীকার করেছেন। আদম আলাইহিস সালাম ভুল করার পর নিজের ভুল স্বীকার করেছেন এবং আল্লাহর কাছে মাফ চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ﴿رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لنكون من الخاسرين﴾ ‘‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নফসের উপর যুলুম করেছি। তুমি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করো এবং আমাদের উপর রহম না করো, তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো। আমাদের নাবীও একাধিকবার নিজের ভুল স্বীকার করেছেন। এতে তার মর্যাদা কমে যায়নি।
সুতরাং সৃষ্টির উপর আল্লাহ তা‘আলার সমুন্নত হওয়াকে নাকোচ করার জন্য জুওয়াইনী মাওযু হাদীছের যে ব্যাখ্যা করেছে তা বাতিল। আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে নন, -এ কথা বুঝানোর জন্য নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইউনুস আলাইহিস সালামের উপর প্রাধান্য দিতে নিষেধ করা হয়নি। কী কারণে নিষেধ করা হয়েছে, তা উপরে বলা হয়েছে। আলেমগণ উল্লেখ করেছেন যে, জুওয়াইনী বলেছেন, ইউনুস আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজেযার মধ্যে দলীল পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে সমুন্নত নন; তিনি সকল সৃষ্টির উপরেও নন। কথিত আছে যে, জুওয়াইনী বলেছিল, আমাকে প্রচুর মাল না দিলে এ হাদীছের ব্যাখ্যা করবো না। লোকেরা যখন তাকে প্রচুর মাল দিল, তখন তিনি তাদেরকে এ বানোয়াট ব্যাখ্যা শুনালেন। এটিকে মূর্খরা বিরাট ব্যাখ্যা মনে করলো। অথচ তা সম্পূর্ণ বাতিল। (আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)