ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
مَا زَالَ بِصِفَاتِهِ قَدِيمًا قَبْلَ خَلِقِهِ لَمْ يَزْدَدْ بِكَوْنِهِمْ شَيْئًا لَمْ يَكُنْ قَبْلَهُمْ مِنْ صِفَتِهِ كَمَا كَانَ بِصِفَاتِهِ أَزَلِيًّا، كَذَلِكَ لَا يَزَالُ عَلَيْهَا أَبَدِيًّا
সৃষ্টি করার বহু পূর্ব থেকেই তিনি তার অনাদি গুণাবলীসহ চিরন্তন-অবিনশ্বর সত্তা হিসাবে বিদ্যমান রয়েছেন, আর সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করার কারণে তার এমন কোনো নতুন গুণের সংযোজন ঘটেনি, যা সৃষ্টি করার পূর্বে ছিল না। তিনি তার গুণাবলীসহ যেমন অনাদি ছিলেন, তেমনি তিনি স্বীয় গুণাবলীসহ অনন্ত, চিরন্তন ও চিরঞ্জীব থাকবেন।
ব্যাখ্যা: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সর্বদাই পূর্ণতার বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত। তার সিফাত-গুণগুলো দু’প্রকার। সিফাতে যাতীয়া বা সত্তাগত সিফাত এবং সিফাতে ফে’লীয়া বা তার কর্মগত বিশেষণসমূহ।
এ কথা বিশ্বাস করা বৈধ নয় যে, এক সময় আল্লাহ তা‘আলার কোনো সিফাত ছিল না। অতঃপর তিনি তা দ্বারা বিশেষিত হয়েছেন। কেননা তার সিফাতগুলো পরিপূর্ণ। কখনো তা না থাকা ত্রুটির অন্তর্ভুক্ত। তার জন্য এমনটি শোভনীয় নয় যে, তিনি পূর্ণতার গুণাবলী অর্জন করেছেন। অথচ তিনি এক সময় পূর্ণতার বিপরীত বিশেষণে বিশেষিত ছিলেন।
আল্লাহ তা‘আলার সিফাতে ফে’লীয়া, বাছাইকৃত গুণাবলী কিংবা অন্যান্য সিফাতের ক্ষেত্রে এ কথা শোভনীয় নয়। যেমন সৃষ্টি করা, রূপদান করা, মৃত্যু ঘটানো, জীবন দান করা, সঙ্কোচিত করা, সম্প্রসারণ করা, ভাজ করা, সমুন্নত হওয়া, আগমন করা, নেমে আসা, ক্রোধান্বিত হওয়া, সন্তুষ্ট হওয়া এবং অনুরূপ অন্যান্য যেসব বিশেষণ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে বিশেষিত করেছেন কিংবা তার রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুর যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তার ক্ষেত্রেও একই কথা। যদিও আমরা আল্লাহর সিফাতগুলোর এমন কোনো প্রকৃত অবস্থা ও স্বরূপ সম্পর্কে অবগত নই, যাকে তাবীল-অপব্যাখ্যা বলা হয়ে থাকে। আল্লাহর সিফাতগুলোর ক্ষেত্রে আমরা আমাদের রায় দ্বারা কথা বলি না এবং প্রবৃত্তির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ধারণার উপর নির্ভর করেও কিছু বলি না। তবে সিফাতগুলোর মূল অর্থ আমাদের জানা রয়েছে। যেমন ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহকে যখন
(ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ) [سورة الْأَعْرَافِ: 54]
‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত’’ (সূরা আরাফ: ৫৪) -আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী এবং অন্যান্য সিফাতের ধরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, كيف استوى আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন? জবাবে ইমাম মালেক (র.) বললেন,
الاستواء معلوم والكيف مجهول والإيمان به واجب والسؤال عنه بدعة
‘‘আরশের উপরে আল্লাহর সমুন্নত হওয়া জানা বিষয়। এর পদ্ধতি কেউ অবগত নয়।[1] তার উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। তবে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা বিদ‘আত’’।[2]
যদিও এ সিফাতগুলো দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা কোনো সময়কে বাদ দিয়ে অন্য সময় বিশেষিত হয়ে থাকেন। যেমন শাফা‘আতের হাদীছে এসেছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা আজ এমন রাগান্বিত হয়েছেন, যেমন রাগান্বিত অতীতে আর কখনো হননি। আজকের পরে আর কখনো অনুরূপ রাগান্বিত হবেন না। এভাবে কোনো সময়কে বাদ দিয়ে অন্য সময় এগুলো দ্বারা বিশেষিত হওয়া অসম্ভব নয়। তবে আল্লাহ তা‘আলার শানে এ কথা বলা যাবে না যে, এগুলো এক সময় আল্লাহ তা‘আলার জন্য ছিল না; বরং পরবর্তীতে তিনি তা অর্জন করেছেন।
আপনি কি জানেন না, যে ব্যক্তি আজ কথা বলেছে, গতকালও কথা বলেছে, তার ব্যাপারে এটি বলা ঠিক নয় যে, আজ তার জন্য কথা বলার বিশেষণ অর্জিত হয়েছে। তবে যদি কোনো ত্রুটির কারণে যেমন ছোট্ট শিশু অথবা বোবা লোক যেদিন কথা শুরু করে সেদিন বলা হয়,حدث له الكلام ‘‘আজ তার জন্য কথা বলার বিশেষণ অর্জিত হয়েছে’’।
সুতরাং বাকশক্তি সম্পন্ন যে লোক বিনা কারণে চুপ থাকে, তার ব্যাপারে বলা হয় যে, সে কথা বলার শক্তি রাখে। অর্থাৎ সে যখন ইচ্ছা কথা বলে। আর যখন সে বাস্তবেই কথা বলতে থাকে তখন তাকে متكلم (বক্তা) বলা হয়। এমনি যে লোক লেখালেখি করে তার ক্ষেত্রেও একই রকম কথা বলা হয়। সে যখন বাস্তবেই লিখতে থাকে, তখন তাকে كاتب (লেখক) বলা হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে সে লিখার কাজে ব্যস্ত থাকে না, তখনও তাকে লেখক বলা হয়। উক্ত ব্যক্তি লেখক বলে সম্বোধন করা হয় লিখার যোগ্যতা থাকার কারণে। চাই সে বর্তমানে লিখুক বা না লিখুক।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সত্তার মধ্যে حلول الحوادث তথা সিফাত ও ক্রিয়া-কর্ম প্রবেশ করা কালামশাস্ত্রবিদদের নিকৃষ্ট মাযহাব অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের কথা হলো, আল্লাহর সত্তার মধ্যে সিফাত ও ক্রিয়া-কর্ম প্রবেশ করা বা না করার বিষয়টি কুরআন ও সুন্নাহ্য় বর্ণিত হয়নি।
حلول الحوادث কথাটির মধ্যে যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে। এ কথার মাধ্যমে যা নাকচ করা হয়েছে, তা দ্বারা যদি এটি নাকচ করা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র সত্তার মধ্যে সৃষ্টির কোনো বিশেষণ প্রবেশ করে না অথবা যদি এটি নাকচ করা উদ্দেশ্য হয় যে, তার জন্য এমন নতুন নতুন সিফাত তৈরী হয়, যা পূর্বে ছিল না, তাহলে এ ধরণের কিছু নাকচ করা করা সঠিক। কিন্তু যদি আল্লাহ তা‘আলার বাছাইকৃত গুণাবলী নাকচ করা হয় অর্থাৎ যদি নাকচ করা হয় যে, তিনি নিজের জন্য ক্রিয়া-কর্ম বাছাই করে যখন ইচ্ছা তা করেন না, যখন যা ইচ্ছা তা বলেন না, তিনি রাগান্বিত হন না, সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য ছাড়াই সন্তুষ্ট হন না এবং নেমে আসা, সমুন্নত হওয়া, আগমন করা ইত্যাদি আরো যেসব বিশেষণ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে যে শোভনীয় পদ্ধতিতে বিশেষিত করেছেন, তা নাকচ করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা বাতিল।
নিকৃষ্ট মাযহাবের অনুসারী কালাম শাস্ত্রবিদরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সত্তার মধ্যে حلول الحوادث তথা সিফাত ও ক্রিয়া-কর্ম প্রবেশ করাকে নাকোচ করে থাকে। সুন্নীরা কালাম শাস্ত্রবিদদের কথাকে যখন এ ভেবে সমর্থন করেন যে, তার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পবিত্র সত্তা থেকে ঐসব বিষয় নাকচ করা উদ্দেশ্য, যা তার জন্য শোভনীয় নয়, তখন বিদ‘আতীরা সুন্নীদের উপর বাছাইকৃত গুণাবলী এবং কর্মগত বিশেষণগুলো নাকচ করার বিষয়টিও চাপিয়ে দিতে চায়। অথচ আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে حوادث বা নশ্বর বস্তুর অনুপ্রবেশ নাকোচ করার মাধ্যমে তার বাছাইকৃত গুণাবলী ও ক্রিয়া-কর্ম নাকচ করা আবশ্যক নয়। সুন্নীরা কেবল ভালো ধারণার বশবতী হয়েই কখনো কখনো বিদআতীর সংক্ষিপ্ত নফীকে সমর্থন করে থাকে। কিন্তু সুন্নী যখন সংক্ষিপ্ত কথার ব্যাখ্যা চাইবে, তখন বিরোধীর বাতিল ব্যাখ্যায় সুন্নী কখনো সম্মতি দিবে না।[3]
আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের ক্ষেত্রেও একই কথা। সিফাত কি তার সত্তার উপর অতিরিক্ত কোনো জিনিস? না কি সেরকম নয়? এটি একটি সংক্ষিপ্ত কথা। অনুরূপ এ কথা বলা যে, আল্লাহর সিফাত কি তার সত্তা থেকে আলাদা কোনো বিষয়? না কি আলাদা নয়? এ কথার মধ্যেও যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে। এর মাধ্যমে কখনো আল্লাহ তা‘আলার সত্তা উদ্দেশ্য না হয়ে তার সিফাত উদ্দেশ্য হতে পারে। আবার কখনো এও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, আল্লাহর সত্তা থেকে তার সিফাত সম্পূর্ণরূপে আলাদা স্বতন্ত্র একটি বিষয়।[4]
আহলে সুন্নাতের ইমামগণ আল্লাহর সিফাত বা তার কালামের ব্যাপারে কখনো এ কথা বলতেন না যে, আল্লাহ তা‘আলার সিফাত তার সত্তা ব্যতীত অন্য জিনিস এবং এ কথাও বলতেন না যে, তার সিফাত তার সত্তা ব্যতীত অন্য বিষয় নয়। কেননা যদি সাব্যস্ত করা হয় যে তার সত্তা এক জিনিস এবং সিফাত আরেক জিনিস, তাহলে এ ধারণা আসতে পারে যে, আল্লাহর সিফাত তার সত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আর যদি এ রকম অস্পষ্ট বিষয়কে নাকচ করা হয়, তাহলে এ ধারণা আসতে পারে যে, আল্লাহর সত্তা ও সিফাত একই বিষয়। কেননা غير (অন্য) কথাটির মধ্যে সংক্ষিপ্ততা রয়েছে। বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশেস্নষণ ছাড়া এ কথা আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
এ কথার দ্বারা যদি উদ্দেশ্য হয়, আল্লাহর শুধু স্বনির্ভর স্বতন্ত্র একটি সত্তা রয়েছে এবং তার কোনো সিফাত-গুণ নেই, তাহলে এ কথা সম্পূর্ণ বাতিল। আর যদি এ কথার উদ্দেশ্য এমন হয় যে, আল্লাহর সিফাতসমূহ তার ঐ সত্তার উপর অতিরিক্ত একটি বিষয়, যা তার সিফাত থেকে বোধগম্য অর্থ থেকে ভিন্ন, তাহলে ঠিকই আছে। তবে এ কথা সঠিক যে, বাস্তবে সিফাতশূণ্য কোনো সত্তা নেই। বরং আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র সত্তার জন্য সাব্যস্ত পূর্ণতার বিশেষণগুলো তা থেকে বিচ্ছিন্ন ও আলাদা কোনো জিনিস নয়। শুধু মাথার মধ্যেই এ কল্পনা জাগতে পারে যে, সত্তা এক জিনিস এবং সিফাত আলাদা জিনিস। প্রত্যেকটিই পরস্পর বিচ্ছিন্ন। শুধু তাই নয়; বরং বাস্তবে এমন কোনো সত্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা সিফাত বা বিশেষণ দ্বারা বিশেষিত নয়। এটি সম্পূর্ণ অসম্ভব।
যদিও তর্কের স্বার্থে এ কথা মেনে নেয়া হয়, আল্লাহর শুধু অস্তিত্ব রয়েছে, তারপরও এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, এ অস্তিত্ব কখনো অস্তিত্বশীল থেকে আলাদা হয় না। যদিও মস্তিস্কের মধ্যে আলাদা এক সত্তা এবং আলাদা এক অস্তিত্বের ধারণা জাগ্রত হয়। মস্তিস্ক একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা হিসাবে কল্পনা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে উভয়ের একটি অন্যটি থেকে আলাদা হিসাবে পাওয়া যাবে না।
এখন কেউ যদি বলে, সিফাত দ্বারা বিশেষিত মূল সত্তা উদ্দেশ্য নয় এবং অন্য কিছুও নয়, তাহলে এ কথার একটি সঠিক অর্থ রয়েছে। এ সঠিক অর্থটি হলো, সিফাত হুবহু সে মাওসুফের সত্তা নয়, যাকে মস্তিস্ক এককভাবে কল্পনা করে; বরং সেটি অবশ্যই মূল সত্তা ছাড়াও আরেকটি অতিরিক্ত বিষয়। তবে তা বিশেষিত সত্তা ছাড়া অন্য কোনো আলাদা জিনিসও নয়; বরং বিশেষিত সত্তা তার বিশেষণগুলোসহ একই জিনিস, একাধিক বিষয় নয়। আপনি যখন বলেন, أعوذ بالله ‘‘আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি’’, তখন আপনি পূর্ণতার সেসব বিশেষণে বিশেষিত পবিত্র সত্তার আশ্রয়ই গ্রহণ করলেন, যা তার জন্য সাব্যস্ত এবং তা তার সত্তা থেকে কোন অবস্থাতেই তা আলাদা হয় না।
আর যখন আপনি বলবেন, أَعُوذُ بِعِزَّةِ اللَّهِ ‘‘আমি আল্লাহর ইজ্জতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি’’, তখন আপনি আল্লাহ তা‘আলার কোনো একটি সিফাতের আশ্রয় গ্রহণকারী গণ্য হবেন। আপনি আল্লাহ ছাড়া অন্যের আশ্রয় গ্রহণকারী হিসাবে গণ্য হবেন না। যাত বা সত্তা শব্দ থেকে এ অর্থ বুঝা যায়। কেননা ذات শব্দটি মুযাফ হিসাবেই ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয়ে থাকে ذات وجود অস্তিত্বশীল, ذات قدرة ক্ষমতার অধিকারী, ذات عز সম্মানের অধিকারী, ذات علم ইলমের অধিকারী, ذات كرم দানশীল। এমনি আরো অনেক সিফাতের দিকে যাত শব্দটিকে সম্বোধন করা হয়। সুতরাং ذات كذا অর্থ হলো ইহার অধিকারী। ذات শব্দটি ذو -এর مؤنث। শব্দটির মূল অর্থ হলো অধিকারী।
সুতরাং জানা গেল যে, কোনোভাবেই যাত থেকে সিফাতকে আলাদা হিসাবে কল্পনা করা সম্ভব নয়। যদিও মানুষের মাথায় সিফাত ছাড়া যাতের অস্তিত্বের ধারণা জাগ্রত হয়। এমনি অসম্ভব জিনিসের কল্পনাও মানুষের মাথায় কল্পিত হয়।[5]
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু‘আয় বলেছেন,
«أَعُوذُ بِاللَّهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ»
‘‘আমি নিজের মধ্যে যে ব্যথা অনুভব করছি এবং অন্যান্য যেসব রোগ-ব্যাধির আশঙ্কা করছি, তার ক্ষতি থেকে আমি আল্লাহর ইজ্জত ও ক্ষমতার আশ্রয় কামনা করছি’’। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,
«أعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ ما خَلَقَ»
‘‘আশ্রয় প্রার্থনা করছি আল্লাহর পরিপূর্ণ বাণীসমূহের মাধ্যমে। তার সৃষ্টির সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে’’।
সুতরাং নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো আল্লাহ ছাড়া অন্যের আশ্রয় প্রার্থনা করেননি। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু‘আয় আরো বলেছেন,
«اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذ بِرِضَاك مِنْ سَخَطك وَبِمُعَافَاتِك مِنْ عُقُوبَتك وأعوذبك منك»
‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার সন্তুষ্টির উসীলায় তোমার ক্রোধ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তোমার ক্ষমা গুণের উসীলায় তোমার শাস্তি থেকে মুক্তি কামনা করছি এবং তোমার শাস্তি থেকে তোমার নিকটই আশ্রয় চাচ্ছি’’।[6]
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,
وَنعُوذُ بِعَظَمَتِكَ أنْ نغْتاَلَ مِنْ تَحْتِنَا
‘‘হে আল্লাহ! আমরা তোমার বড়ত্বের উসিলা দিয়ে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি নিমণ দিক থেকে মাটি ধ্বসে আমাদের হঠাৎ মৃত্যু বরণ করা হতে’’।
أَعُوذُ بِنُورِ وَجْهِكَ الَّذِى أَشْرَقَتْ لَهُ الظُّلُمَاتُ
‘‘আমি তোমার সে চেহারার আলোর আশ্রয় চাই, যা দ্বারা অন্ধকার দূরিভূত হয়ে যায়’’।[7]
কালামশাস্ত্রবিদরা অনুরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে, আল্লাহর নামগুলো দ্বারা কি আল্লাহর সত্তা উদ্দেশ্য? না কি তার নামগুলো দ্বারা সত্তা ছাড়া অন্য কিছু বুঝায়? এ মাস‘আলায় যেহেতু অনেকেই ভুল করেছে এবং তাতে সঠিক সিদ্বামেত্ম পৌঁছতে পারেনি, তাই আমরা বলবো যে, কখনো কখনো নাম দ্বারা নামকরণকৃত সত্তা উদ্দেশ্য হয় এবং কখনো কখনো নাম দ্বারা এমন শব্দ বুঝায়, যা দ্বারা অন্য কিছু উদ্দেশ্য হয়।
সুতরাং আপনি যখন বলবেন, আল্লাহ তা‘আলা এরূপ বলেছেন অথবা যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করে, আল্লাহ তার প্রশংসা শুনেন অথবা আপনি যখন অনুরূপ অন্যান্য কথা বলে থাকেন, এখানে আল্লাহ নাম দ্বারা তার সত্তা উদ্দেশ্য। আর আপনি যখন বলবেন, আল্লাহ শব্দটি একটি আরবী নাম, আর্ রাহমান নামটি একটি আরবী নাম অথবা আর্ রাহমান আল্লাহর নামসমূহের অন্তর্ভুক্ত, অথবা অনুরূপ অন্য কোনো কথা বলবেন, তখন এখানে এ শব্দগুলো দ্বারা কেবল নাম উদ্দেশ্য হবে, নামকরণকৃত সত্তা উদ্দেশ্য হবে না। এ কথাও বলা হবে না যে, নাম দ্বারা অন্য কিছু উদ্দেশ্য। কেননা ‘অন্য কিছু’ শব্দটির মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। যদি অন্য কিছু দ্বারা উদ্দেশ্য হয় যে, শব্দ এক জিনিস এবং অর্থ অন্য জিনিস, তাহলে ঠিক আছে। আর যদি উদ্দেশ্য হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ছিলেন, তখন তার কোনো নাম ছিল না। অতঃপর তিনি তার নিজের জন্য অনেক নাম সৃষ্টি করেছেন অথবা সৃষ্টিরা তাদের কাজ-কর্মের অনুপাতে তাকে বিভিন্ন নামে নামকরণ করেছে, তাহলে এটি হবে তাদের বিরাট মুর্খতা এবং আল্লাহর নামের মধ্যে ইলহাদের অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘‘সৃষ্টি করার অনেক পূর্ব থেকেই তিনি তার অনাদি-অনন্ত ও চিরন্তন গুণাবলীসহ বিদ্যমান রয়েছেন, আর সৃষ্টিজগৎ অস্তিত্বে আসার কারণে তার এমন কোনো নতুন গুণের সংযোজন ঘটেনি, যা সৃষ্টি করার পূর্বে ছিল না। তিনি তার গুণাবলীসহ যেমন অনাদি, তেমনি তিনি স্বীয় গুণাবলীসহ অনন্ত’’।
শাইখ এ কথা দ্বারা মুতাযেলা, জাহমিয়া এবং তাদের অনুসারী শিয়াদের প্রতিবাদ করেছেন। তারা বলেছে, আল্লাহ তা‘আলা এক সময় কর্ম সম্পাদনে এবং কথা বলতে সক্ষম ছিলেন না। অতঃপর সক্ষম হয়েছেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলার জন্য ক্রিয়া-কর্ম সম্পাদন করা এবং কথা বলা অসম্ভব থাকার পর সম্ভব হয়েছে। মূলত তিনি অসম্ভাব্য সত্তা থেকে সম্ভাব্য সত্তায় পরিণত হয়েছেন![8] ইবনে কুল্লাব, আবুল হাসান আল-আশআরী এবং তাদের অনুসারীরা বলেছে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য ক্রিয়া-কর্ম সম্পাদন করা অসম্ভব থাকার পর সম্ভব হয়েছে। আর তার কথা বলা বিশেষণ সম্পর্কে তারা বলে যে, কথা বলা আল্লাহ তা‘আলার কুদরত ও ইচ্ছার অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ তিনি ইচ্ছা করে এবং স্বীয় ক্ষমতার মাধ্যমে কথা বলেন না; বরং কথা বলার বিশেষণ আল্লাহর সত্তার জন্য একটি আবশ্যিক জিনিস মাত্র। এমন নয় যে, তিনি কথা বলেছেন। নাউযুবিল্লাহ।
[2] . অতঃপর সে বিদ‘আতী লোককে ইমাম মালেক (রহি.) এর মজলিস থেকে বের করে দেয়া হলো। কেননা এটি এমন প্রশ্ন, যা সালাফে সালেহীনদের কোনো লোক নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে করেননি।
[3]. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্যতম মূলনীতি হলো, আল্লাহ তাআলার গুণ সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে বিদ‘আতীরা যখন এমন সংক্ষিপ্ত কথা বলবে, যা সত্য-মিথ্যা উভয়েরই সম্ভাবনা রাখে, তখন তার সে সংক্ষিপ্ত কথা সমর্থন কিংবা বর্জন কোনোটিই করা যাবে না; বরং তার কথার ব্যাখ্যা চাইতে হবে এবং জিজ্ঞেস করতে হবে যে, তার কথার উদ্দেশ্য কী? তাতে যদি সত্য কিছু থাকে, তাহলে উহাকে শরীয়াত সম্মত শব্দ ব্যবহার করে আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করতে হবে। আর তাতে বাতিল কিছু থাকলে তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে।
[4]. ছাহাবী, তাবেঈ এবং তাদের পরবর্তীতে আগমনকারী আহলে সুন্নাতের লোকদের মাথায় এ ধরণের দার্শনিক প্রশ্ন জাগ্রত হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা তাদের মন-মস্তিস্ককে এ ধরণের অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন থেকে পবিত্র করেছেন। পরবর্তীতে গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুতাযেলা এবং অন্যান্য বাতিল ফির্কার লোকেরা এ ধরণের অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন মুসলিম সমাজে আমদানী করেছে। সঠিক কথা হলো সিফাত-গুণ ছাড়া কোনো জিনিসের অস্তিত্বই বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
[5]. যেমন দশহাত ও তিন মাথা বিশিষ্ট মাথা ওয়ালা মানুষের অস্তিত্ব মানুষের মস্তিস্ক কল্পনা করতে পারে। পানিতে সাগরের বউ আছে, খিযির আলাইহিস সালাম পানিতেই থাকেন, ইত্যাদি কাল্পনিক ধারণা ও কাহিনীর শেষ নেই। বাস্তবে এ জাতীয় কোনো মাখলুক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুতরাং মানুষের মাথা অসম্ভব বস্তু কল্পনা করতে পারে, কিন্তু তার মানে এ নয় যে, বাস্তবেও উহার অস্তিত্ব রয়েছে। এমনি জাহমিয়া এবং তাদের অনুসারীরা সিফাত বিহীন আল্লাহর সত্তার অস্তিত্ব কল্পনা করেছে। কিন্তু বাস্তবে যেখানে সিফাত ছাড়া কোনো মাখলুকই খুঁজে পাওয়া যায় না, সেখানে গুণাবলী ও বিশেষণ ছাড়া স্রষ্টার অস্তিত্ব কল্পনা করা বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
[6]. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৭৫১।
[7]. সীরাতে ইবনে হিশাম। ইমাম আলবানী (রহি.) এ বর্ণনাটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ ফিকহুস্ সীরাতঃ (১/১২৫)।
[8]. ইসলামের স্বর্ণযুগে এ জাতীয় অযথা তর্ক-বিতর্কের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তারা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া দ্বীনের অনুসরণ করতেন, কুরআন ও সুন্নাহর ইলম অর্জন করতেন এবং সে অনুযায়ী আমল করার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। অযথা ও অর্থহীন কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতেন। কিন্তু পরবর্তীতে আববাসীয় খেলাফতকালে যখন গ্রীক দর্শনের কিতাবগুলো আরবীতে অনুবাদ হলো, তখন থেকেই মুসলিমদের একদল মেধাবী আলেম স্রষ্টার অস্তিত্ব, স্বরূপ ও গুণাবলী সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে যুক্তি ও বোধশক্তির আশ্রয় নিতে লাগলেন। আরেক শ্রেণীর আলেম কালামী পদ্ধতিতে তাদের জবাব দেয়া শুরু করলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের নির্ভেজাল ও স্বচ্ছ জ্ঞান অর্জনের বদলে তারা মরিচিকার পিছনে ছুটে বেড়ায়। এতে করে মুসলিমদের লাইব্রেরীগুলো কিতাবাদিতে ভরপুর হয়েছে ঠিকই; কিন্তু জাতির ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয়নি।