পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলি আমরা দেখেছি যে, তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি অধিকাংশ যিকর উন্মুক্তভাবে সদা সর্বদা পালন করা যায়। এছাড়া বিশেষ কিছু সময় নিরপেক্ষ যিকর, সালাত বা দু‘আ হাদীস শরীফে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যা যে-কোন সময়ে পালন করা যায়। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতকে বিভিন্ন কর্ম ও ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্ন রকম বিশেষ যিকর শিক্ষা দিয়েছেন। এ অধ্যায়ে এরূপ কিছু যিকর, দু‘আ ও সালাতের আলোচনা করতে চাই। আল্লাহই তাওফীক-দাতা।
প্রথমত, অতিরিক্ত কিছু নফল সালাত :
(ক). সালাতুত তাসবীহ :
আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, যিকরের মূল চারটি বাক্য হলে তাসবীহ ‘সুবহানাল্লাহ’ , তাহমীদ ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ , তাহলীল ‘লা- ইলাহা ইল্লল্লাহ’ এবং তাকবীর ‘আল্লাহু আকবার’। যাকির এই বাক্যগুলি জপ করে বা যিকর করে মহান প্রভুর নামের পবিত্রতা, প্রশংসা, একত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করে। সালাতের মধ্যে এই যিকরগুলি বিশেষ পদ্ধতিতে পালন করা হয় “সালাতুত তাসবীহ” নামাক সালাতে। চার রাক’আত সালাতে প্রতি রাক’আতে ৭৫ বার করে চার রাক’আতে মোট ৩০০ বার উক্ত যিকরগুলি আদায় করতে হবে। এ বিষয়ে সহীহ ও যয়ীফ অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
সহীহ হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর চাচা আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবকে (রাঃ) বলেনঃ ”চাচাজি, আমি আপনাকে একটি বিশেষ উপহার ও বিশেষ অনুদান প্রদান করব, যা পালন করলে আল্লাহ আপনার ছোট, বড়, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত, প্রকাশ্য, গোপন সকল গোনাহ ক্ষমা করবেন। - তা এই যে, আপনি চার রাক’আত সালাত আদায় করবেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহা ও অন্য যে কোনো একটি সূরা পাঠ করবেন। প্রথম রাক’আতে সূরা ফাতিহা ও অন্য যে কোনো সূরা পাঠের পর দাঁড়ানো অবস্থায় ১৫ বার বলবেন:
سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر
উচ্চারণঃ ‘সুব‘হা-নাল্লাহ, ওয়াল‘হামদুলিল্লাহ, ওয়ালা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লা-হু আকবার।’ (পূর্বে উল্লেখিত ৪, ৯, ১ ও ১০ নং যিকর একত্রে)।
এরপর রুকুতে যেয়ে রুকু অবস্থায় উপরের যিকরগুলি ১০ বার, রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় ১০ বার, সাজদা রত অবস্থায় ১০ বার, প্রথম সাজদা থেকে উঠে বসা অবস্থায় ১০ বার, দ্বিতীয় সাজদায় ১০ বার এবং দ্বিতীয় সাজদা থেকে উঠে (বসা অবস্থায়) ১০ বার। এই মোট এক রাক’আতে ৭৫ বার (চার রাক’আতে মোট ৩০০ বার)। সম্ভব হলে আপনি প্রতিদিন একবার এই সালাত আদায় করবেন, না হলে প্রতি সপ্তাহে একবার, না হলে প্রতি মাসে একবার, না হলে প্রতি বৎসর একবার, না হলে অন্তত সারা জীবনে একবার এই সালাত আপনি আদায় করবেন।”
“সালাতুস তাসবীহ” সংক্রান্ত অধিকাংশ হাদীসই অত্যন্ত যয়ীফ সনদে বর্ণিত। একমাত্র এই হাদীসটিকে মুহাদ্দিসগণ সহীহ হিসাবে গ্রহণ করেছেন।[1]
ইমাম তিরমিযী প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারাক (১৮১ হি) থেকে “সালাতুত তাসবীহ” আদায়ের আরেকটি নিয়ম উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারকের মতে এই অতিরিক্ত যিকর আদায়ের নিয়ম: নাময শুরু করে শুরুর দু‘আ বা সানা পাঠের পরে ১৫ বার, সূরা ফাতেহা ও অন্য কোনো সূরা শেষ করার পরে ১০ বার, রুকুতে ১০ বার, রুকু থেকে উঠে ১০ বার, প্রথম সাজদায় ১০ বার, দুই সাজাদার মাঝে ১০ বার ও দ্বিতীয় সাজদায় ১০ বার মোট ৭৫ বার প্রতি রাক’আতে।
অর্থাৎ, এই নিয়মে কিরাআতের পূর্বে ও পরে দাঁড়ানো অবস্থায় ২৫ বার তাসবীহ পাঠ করা হয় আর দ্বিতীয় সাজাদার পরে বসা অবস্থায় কোনো তাসবীহ পড়া হয় না। পূর্বের হাদীসে বর্ণিত নিয়মে কিরাআতের পূর্বে কোনো তাসবীহ নেই। দাঁড়ানো অবস্থায় শুধু কিরাআতের পরে ১৫ বার তাসবীহ পড়তে হবে। প্রত্যেক রাক’আতে দ্বিতীয় সাজদার পরে বসে ১০ বার তাসবীহ পড়তে হবে।
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক বলেন, যদি এই সালাত রাত্রে আদায় করে তাহলে দুই রাক’আত করে পৃথকভাবে তা আদায় করবে। অর্থাৎ, দুই রাক’আত শেষে সালাম ফিরিয়ে আবার দুই রাক’আত পৃথকভাবে আদায় করবে। আর দিনের বেলায় এই সালাত পালন করতে ইচ্ছা করলে একত্রে চার রাক’আত আদায় করতে পারে, অথবা ইচ্ছা করলে পৃথকভাবে দুই রাক’আত করেও আদায় করতে পারে।
“সালাতুত তাসবীহ” আদায়ের সময় রুকু ও সাজদায় প্রথমে রুকু ও সাজদার মাসনূন তাসবীহ ‘সুবহানার রাব্বিয়্যাল আযীম’ ও ‘সুবহানা রাব্বিয়্যাল আ’লা’ নূন্যতম তিন বার করে পাঠ করার পরে অতিরিক্ত তাসবীহগুলি পাঠ করতে হবে।[2]
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ২/৩৪৭।
আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে কোনো বান্দা যদি কোনো গোনাহের কর্ম করে সাথে সাথে সুন্দর করে ওযু করে দুই রাক’আত সালাত আদায় করে, এরপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে আল্লাহ তাঁকে অবশ্যই ক্ষমা করে দিবেন।”[1]
ইস্তিখারার অর্থ কারো কাছে সঠিক বিষয় বেছে দেওয়ার প্রার্থনা করা। যে ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা একাধিক বিষয়ের মধ্য থেকে একটি বেছে নেওয়ার অবকাশ আছে সেখানে আল্লাহর সাথে পরামর্শ না করে কোনো কিছু বেছে নেওয়া বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মুমিনের উচিত নয়। ছোট, বড়, গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আল্লাহর সাথে পরামর্শ করা, অর্থাৎ তাঁর মহান দরবারে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাওফীক চাওয়া মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব।
যিকর নং ১৪১ : ইস্তিখারার (সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের) দু‘আ
জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সকল বিষয়ে ‘ইস্তিখারা’ করতে শিক্ষা দিতেন, যেমন গুরুত্বের সাথে তিনি আমাদেরকে কুরআন কারীমের সূরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, যখন তোমাদের কেউ কোনো কাজের ব্যাপারে মনের মধ্যে চিন্তা করবে তখন (সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে) ফরয নয় এরূপ, অর্থাৎ নফল দুই রাক’আত সালাত আদায় করবে অতঃপর বলবেঃ
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ (يسمي حاجته) خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي (أَوْ قَالَ عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ) فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ اللَّهُمَّ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الْأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي (أَوْ قَالَ فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ) فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي بهِ
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, ইন্নী আসতাখীরুকা বি‘ইলমিকা, ওয়া আসতাক্বদিরুকা বিক্বুদরাতিকা, ওয়া আসআলুকা মিন ফাদ্বলিকাল ‘আযীম। ফাইন্নাকা তাক্বদিরু, ওয়ালা- আক্বদিরু, ওয়া তা‘অ্লামু ওয়ালা- আ‘অ্লামু, ওয়া আনতা ‘আল্লা-মুল গ্বুইঊব। আল্লা-হুম্মা, ইন কুনতা তা‘অ্লামু আন্না হা-যাল আমরা (উদ্দিষ্ট বিষয়ের নাম বলবে) খাইরুল লী ফী দীনী ওয়ামা‘আ-শী ওয়া ‘আ-ক্বিবাতি আমরী ফাক্বদুরহু লী, ওয়া ইয়াসসিরহু লী, সুম্মা বা-রিক লী ফীহি। আল্লা-হুম্মা, ওয়া ইন কুনতা তা‘অ্লামু আন্না হা-যাল আমরা শাররুল লী ফী দীনী ওয়ামা‘আ-শী ওয়া ‘আ-কিবাতি আমরী ফাস্বরিফহূ ‘আন্নী, ওয়াস্বরিফনী ‘আনহু ওয়াক্ব দুর লিয়াল খাইরা হাইসু কা-না, সুম্মা আরদ্বিনী বিহী।
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করি যে, আপনি আপনার জ্ঞান থেকে আমার জন্য সঠিক বিষয় নির্বাচন করবেন, আমি আপনার নিকট ক্ষমতা চাই আপনার ক্ষমতা থেকে এবং আমি আপনার নিকট চাই আপনার মহান করুণা ও বরকত থেকে। কারণ আপনি ক্ষমতাবান আর আমি অক্ষম, আপনি জানেন আর আমি জানি না, আর আপনি সকল গাইবের মহাজ্ঞানী। হে আল্লাহ, যদি আপনি জানেন যে, এই বিষয়টি (নির্দিষ্ট বিষয়টির উল্লেখ করবে) কল্যাণ ও মঙ্গলময় আমার জন্য, আমার ধর্ম, আমার পার্থিব জীবন এবং আমার পরিণতির জন্য (অথবা বলেন : আমার নিকটবর্তী ও দূবরর্তী পরিণতির জন্য), তাহলে আপনি একে আমার জন্য নির্ধারণ করে দিন, সহজ করে দিন এবং আমার জন্য এতে বরকত প্রদান করুন। হে আল্লাহ, আর আপনি যদি জানেন যে, এই কর্মটি অমঙ্গলকর বা অকল্যাণকর আমার জন্য, আমার ধর্ম, জাগতিক জীবন ও আমার ভবিষ্যৎ পরিণতির জন্য (অথবা তিনি বলেন : আমার নিকটবর্তী ও দূরবর্তী পরিণতির জন্য) তাহলে একে আমার নিকট থেকে সরিয়ে নিন এবং আমাকে এর নিকট থেকে সরিয়ে নিন। আর যেখানেই কল্যাণ ও মঙ্গল থাকুক তাকে আমার জন্য নির্ধারণ করে দিন এবং আমাকে তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দিন।”[1]
পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের পরেই অন্যতম ফরয ইবাদত জানাযার সালাত। আমাদের সমাজের অনেক ধার্মিক মুসলিমই এই ইবাদতের ক্ষেত্রে অবহেলা করেন। অনেকে মনে করেন, যেহেতু ফরযে কেফায়া সেহেতু কেউ পালন করলেই তো হলো। এ পলায়নী মনোবৃত্তি। মুমিনের এই দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। মুমিন দেখবেন, এই কর্মে আল্লাহ কত খুশি হবেন এবং কত সাওয়াব ও বরকত আমি লাভ করব।
জানাযার সালাতের জন্য অচিন্তনীয় সাওয়াব ও বরকতের কথা বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এর একটি কারণ এই ইবাদতটি সৃষ্টির সেবা কেন্দ্রিক, আর আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন তাঁর সৃষ্টির সেবাতে।
এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
من تبع جنازة فصلى عليها فله قيراط فإن شهد دفنها فله قيراطان القيراط أعظم من أحد
“কেউ যদি কারো জানাযার অনুগমন করে ও সালাতে অংশ গ্রহণ করে তবে সে এক ‘কীরাত’ সাওয়াব অর্জন করবে। আর যদি সে তার দাফনে (কবরস্থ করায়) উপস্থিত থাকে তাহলে সে দুই কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে। এক কীরাত উহদ পাহাড়ের চেয়েও বড়।” হাদীসটি সহীহ।[1]
অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একদিন বলেনঃ
مَنْ أَصْبَحَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ صَائِمًا ؟ ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، قَالَ : فَمَنْ تَبِعَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ جَنَازَةً ؟ ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، قَالَ : فَمَنْ أَطْعَمَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مِسْكِينًا ؟ ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، قَالَ : فَمَنْ عَادَ مِنْكُمُ الْيَوْمَ مَرِيضًا ؟ ، قَالَ أَبُو بَكْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ : أَنَا ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَا اجْتَمَعْنَ فِي امْرِئٍ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ
“তোমাদের মধ্যে আজ কে সিয়ামরত ছিলে? আবু বকর (রাঃ) বলেন: আমি। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রশ্ন করেন: তোমাদের মধ্যে কে আজ কোনো জানাযায় শরীক হয়েছ? আবু বকর (রাঃ) বলেন: আমি। তিনি প্রশ্ন করেন: তোমাদের মধ্যে কে আজ দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করেছ ? আবু বকর (রাঃ) বলেন: আমি। তিনি আবার প্রশ্ন করেন: আজ তোমাদের কে অসুস্থ কোনো মানুষকে দেখতে গিয়েছ ? আবু বকর বলেন: আমি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ এই কর্মগুলি যদি কোনো মানুষের মধ্যে একত্রিত হয় তাহলে সেই ব্যক্তি অবশই জান্নাতী হবেন।”[2]
পাঠক দেখতে পাচ্ছেন যে, এখানে চারটি ইবাদতের তিনটিই সৃষ্টির সেবা বিষয়ক। আল্লাহ আমাদেরকে এই গুণগুলি একত্রিত করার তাওফীক দান করেন।
অনেক ধার্মিক মুসলিম জানাযার সালাতের নিয়ম জানেন না বা ভয় পান। বস্তুত জানাযার সালাত অত্যন্ত সহজ ইবাদত। এর একমাত্র উদ্দেশ্য মৃতব্যক্তির জন্য দু‘আ করা। মৃতের জন্য কিছু দু‘আ ছাড়া অতিরিক্ত কোনো কিছু এতে নেই। আমাদের দেশে বানোয়াট একটি দীর্ঘ “নিয়্যাত” প্রচলিত আছে, যা একেবারেই ভিত্তিহীন ও খেলাফে সুন্নাত। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাওয়াবের উদ্দেশ্যে মৃতব্যক্তির জন্য জানাযার সালাত আদায় করছি, এই কথাটুকু মনের মধ্যে থাকাই যথেষ্ট।
৪টি তাকবীর ও সালামের মাধ্যমে এই সালাত আদায় করা হয়। ইমাম ও মুক্তাদীগণ সকলেই এই তাকবীরগুলি ও সালাম মুখে উচ্চারণ করবেন। প্রথমে মৃতের জন্য দু‘আ করার আন্তরিক আবেগ ও নিয়্যাতসহ তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে সালাত শুরু করবেন। তাকবীরে তাহরীমার পরে আমাদের দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে সালাতের সানা (পূর্বোক্ত ৪৬ নং যিকর) পাঠ করবেন। হাদীস শরীফে এ সময়ে সূরা ফাতিহা পড়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এরপর দ্বিতীয় তাকবীরের পরে দরুদে ইবরাহীমী (পূর্বোক্ত ৩১ ও ৩২ নং যিকর) পাঠ করবেন। এরপর তৃতীয় তাকবীরের পরে মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আ করবেন। এরপর ৪র্থ তাকবীর বলে সালামের মাধ্যমে সালাত শেষ করবেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, জানাযার সালাত মূলত মৃতের জন্য দু‘আ। বিভিন্ন হাদীসে জানাযার সালাতে মৃতের জন্য বেশি করে দু‘আ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
إذا صليتم على الميت فأخلصوا له الدعاء
“যখন তোমরা মৃতের উপর (জানাযার) সালাত আদায় করবে তখন তার জন্য আন্তরিকতার সাথে দু‘আ করবে।”[3]
জানাযার সালাতের তৃতীয় তাকবীরের পরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দু‘আ পাঠ করতেন। তিনি মৃতের জন্য এত দু‘আ করতেন যে, পিছনের জীবিত সাহাবীগণ কামনা করতেন যে, আমরা যদি এই মাইয়েত হতে পারতাম তাহলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এই দু‘আ আমরা পেতাম।
যে কোনো দু‘আ পাঠ করলে, বা শুধুমাত্র (ﻟـﻪ ﺍﻏﻔـﺮ ﺍﻟﻠـﻬﻢ) “আল্লাহ তাকে মাফ করে দিন” ইত্যাদি বাক্যের মাধ্যমে দু‘আ করলেই দু‘আর ন্যূনতম দায়িত্ব পলিত হবে। তবে মুমিনের উচিত একাধিক মাসনূন দু‘আ মুখস্থ করে তা এই সময়ে পাঠ করা।
যিকর নং ১৪২ : জানাযার দু‘আ-১
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ وَعَافِهِ وَاعْفُ عَنْهُ وَأَكْرِمْ نُزُلَهُ وَوَسِّعْ مُدْخَلَهُ وَاغْسِلْهُ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ وَنَقِّهِ مِنْ الْخَطَايَا كَمَا نَقَّيْتَ الثَّوْبَ الْأَبْيَضَ مِنْ الدَّنَسِ وَأَبْدِلْهُ دَارًا خَيْرًا مِنْ دَارِهِ وَأَهْلًا خَيْرًا مِنْ أَهْلِهِ وَزَوْجًا خَيْرًا مِنْ زَوْجِهِ وَأَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ وَأَعِذْهُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ أَوْ مِنْ عَذَابِ النَّارِ
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মাগফির লাহূ, ওয়ার‘হামহূ, ওয়া‘আ-ফিহী, ওয়া‘অ্ফু ‘আনহু, ওয়া আকরিম নুযুলাহূ, ওয়া ওয়াসসি‘য় মুদখালাহূ, ওয়াগসিলহু বিলমা-ই ওয়াসসালজি ওয়াল বারাদি। ওয়া নাক্বক্বিহী মিনাল খাতা-ইয়া- কামা- নাক্বক্বাইতাস সাওবাল আবইয়াদ্বা মিনাদ দানাস। ওয়া আবদিলহূ দা-রান খাইরাম মিন দা-রিহী, ওয়া আহলান খাইরাম মিন আহলিহী, ওয়া যাওজান খাইরাম মিন যাওজিহী, ওয়া আদখিলহুল জান্নাতা ওয়া আ‘ইযহু মিন আযাবিল ক্বাবরি (আযাবিন না-র)।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি তাকে ক্ষমা করুন, রহমত করুন, নিরাপত্তা দান করুন, তাকে মাফ করে দিন, তাকে সম্মানের সাথে আপনার কাছে স্থান দান করুন, তার প্রবেশস্থান (আবাসস্থান) প্রশস্থ করুন, তাকে পানি, বরফ ও শীল দিয়ে ধৌত করুন, তাকে পাপরাশি থেকে এমনভাবে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করুন যেভাবে সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে করেছেন। তাকে দান করুন তার (ফেলে যাওয়া) বাড়ির চেয়ে উত্তম বাড়ি, তার পরিজনের চেয়ে উত্তম পরিজন, তার দাম্পত্য সঙ্গীর চেয়ে উত্তম সঙ্গী। তাকে আপনি জান্নাত প্রদান করুন এবং কবরের বা জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।”[4]
যিকর নং ১৪৩ : জানাযার দু‘আ-২
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيرِنَا وَكَبِيرِنَا وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا ، فَأَحْيِهِ عَلَى الإِسْلامِ ، وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الإِيمَانِ اللَّهُمَّ لاَ تَحْرِمْنَا أجْرَهُ وَلاَ تَفْتِنَا بَعْدَهُ
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মাগফিরলি ‘হাইয়িনা- ওয়ামাইয়িতিনা- ওয়া শা-হিদিনা- ওয়াগা-ইবিনা- ওয়া স্বাগীরিনা- ওয়া কাবীরিনা-ওয়া যাকারিনা ওয়া উনসা-না। আল্লা-হুম্মা, মান আ’হইয়াইতাহূ মিন্না- ফাআ’হয়িহী ‘আলাল ইসলা-ম। ওয়ামান তাওয়াফফাইতাহূ মিন্না- ফাতাওয়াফফাহু ‘আলাল ঈমা-ন। আল্লাহুম্মা লা তাহরিমনা আজরাহু ওয়ালা তাফতিন্না বা’দাহু।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমা করুন আমাদের মৃতকে এবং জীবিতকে, উপস্থিতকে এবং অনুপস্থিতকে, ছোটকে এবং বড়কে, পুরুষকে এবং নারীকে। হে আল্লাহ, আমাদের মধ্য থেকে যাকে আপনি জীবিত রাখবেন, তাকে ইসলামের উপর জীবিত রাখুন এবং যাকে আপনি মৃত্যু দান করবেন, তাকে আপনি ঈমানের উপর মৃত্যু দান করুন। হে আল্লাহ তার (তার জন্য দু‘আ করার বা সবর করার) পুরস্কার থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করবেন না এবং তার পরে আমাদেরকে ফিতনায় (পরীক্ষায় বা বিপদে) ফেলবেন না।”[5]
যিকর নং ১৪৪ : জানাযার দু‘আ-৩
اللَّهُمَّ إنَّ فُلانَ ابْنَ فُلان في ذِمَّتِكَ وَحَبْلِ جِوَارِكَ، فَقِهِ فِتْنَةَ القَبْر، وَعَذَابَ النَّارِ، وَأَنْتَ أَهْلُ الوَفاءِ والحَمْدِ، اللَّهُمَّ فاغفِرْ لهُ وَارْحَمْهُ، إنكَ أَنْتَ الغَفُور الرَّحيمُ
অর্থ: “হে আল্লাহ, অমুকের সন্তান অমুক (মৃত ব্যক্তি ও তার পিতার নাম) আপনার যিম্মায় ও আপনার নৈকট্যের রশির মধ্যে। আপনি তাকে কবরের ও জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন। আপনি ওয়াদা পালন ও প্রশংসার অধিকারী। অতএব আপনি তাকে ক্ষমা করে দিন এবং রহমত করুন। নিশ্চয় আপনিই ক্ষমাশীল করুণাময়।”[6]
যিকর নং ১৪৫: জানাযার দু‘আ-৪
اللهم (أنت ربها و) أنت خلقتها وأنت هديتها (للإسلام) وأنت قبضت روحها تعلم سرها وعلانيتها جئنا شفعاء فاغفر لها
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, আনতা রাব্বুহা-, ওয়া আনতা খালাক্বতাহা-, ওয়া আনতা হাদাইতাহা- লিল ইসলা-ম, ওয়া আনতা ক্বাবাদ্বতা রূহাহা-, তা‘অ্লামু সিররাহা ওয়া ‘আলা-নিয়্যাতাহা-, জিয়না শুফা‘আ-আ ফাগফির লাহা-।
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনি তার প্রভু, আপনিই তাকে সৃষ্টি করেছেন, আপনিই তাকে ইসলামের পথ প্রদর্শন করেছেন, আপনিই তার রূহ গ্রহণ করেছেন, আপনি তার গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু জানেন। আমরা তার জন্য সুপারিশ (শাফা‘আত) করতে এসেছি, অতএব আপনি তাকে ক্ষমা করে দেন।”[7]
যিকর নং ১৪৬: জানাযার দু‘আ-৫
প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হাসান বসরী (রহঃ) অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুর জানাযায় সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন এবং নিম্নের দু‘আটি পাঠ করতেনঃ
اللهم اجعله لنا فرطا وسلفا واجراً
উচ্চারণঃ “আল্লা-হুম্মাজ‘আলহূ লানা- ফারাত্বাও ওয়া সালাফাও ওয়া আজরান।”
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনি একে আমাদের জন্য (জান্নাতের দিকে) অগ্রবর্তী, অগ্রগামী ও পুরস্কার হিসাবে সংরক্ষিত করুন।”[8]
[2] সহীহ মুসলিম ২/৭১৩, নং ১০২৮।
[3] হাদিসটি হাসান। সুনানু আবী দাউদ ৩/২১, নং ৩১৯৯, সুনানু ইবনু মাজাহ ১/৪৮০, নং ১৪৯৭।
[4] সহীহ মুসলিম ২/৬৬২-৬৬৩, নং ৯৬৩।
[5] হাদিসটি হাসান। সুনানুত তিরমিযী ৩/৩৪৩, নং ১০২৪, সুনানু আবু দাউদ ৩/২১১, নং ৩২০১, সুনানুন নাসাঈ ৪/৭৪, ১৯৮৬, সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৪৮০, নং ১৪৯৮, মুসতাদরাক হাকিম ১/৫১২।
[6] হাদিসটি হাসান। সুনানু আবু দাউদ ৩/২১১, নং ৩২০২, সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৪৮০, নং ১৪৯৯।
[7] হাদিসটি হাসান। নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৬/২৬৫-২৬৬, মুসনাদ আহমাদ ২/২৫৬, ৩৪৫, ৩৬৩, ৪৫৮, মুসান্নাফু ইবনি আবী শাইবা ২/৪৮৯, বাইহাকী, কুবরা ৪/৪২।
[8] সহীহ বুখারী (তা’লীক) ১/৪৪৮।
এক্ষেত্রেও অনেকে সুন্নাতের বিরোধিতা করেন। জানাযার সালাতের মধ্যে যে সময়ে মৃতের জন্য দু‘আ করতে রাসূলুল্লাহ (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন ও যে সময়কে দু‘আর জন্য নির্ধারণ করেছেন সে সময়ে মনদিয়ে মুনাজাত না করে, অনেকে জানাযার সালাতের সালাম ফেরানোর পরে সেখানে দাঁড়িয়ে আবারো দু‘আ-মুনাজাত করি। জানাযার সালাতের সালামের পরের মুনাজাতের এই রেওয়াজটি আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলেই ছিল না। কিন্তু এখন এই সুন্নাত বিরোধী কর্মীট ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। যারা একটির প্রচলন করছেন তারা এর পক্ষে অনেক যুক্তি প্রদান করেন।
তাঁরা বলেন, মৃতের জন্য সাওয়াব রেসানীর নিয়্যাতে আমরা তা করি, জানাযার পরে একটি দেরি করা নিষিদ্ধ নয়... ইত্যাদি। অনেক হাদীস থেকে দলিল পেশ করেন। উপরে উল্লিখিত হাদীসে আমরা দেখেছি, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যখন তোমরা মৃতের উপর (জানাযার) সালাত আদায় করবে তখন তার জন্য আন্তরিকতার সাথে দু‘আ করবে।” তাঁরা বলেন যে, এ হাদীস থেকে মৃতের জানাযার পরে দু‘আ করার নির্দেশ প্রমাণিত হয়। তাঁরা ভুলে যান অথব মনে করতে চান না যে, দু‘আর ক্ষেত্রে ও সাওয়াব রেসানীর ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবীগণের সুন্নাতই সর্বোত্তম। তাঁরা কখনোই জানাযার সালাত আদায়ের পরে এভাবে সাওয়াব রেসানী করেন নি। একটি যয়ীফ বা মিথ্যা হাদীসও নেই যে, রাসূলুল্লাহ (সা.), তাঁর সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ বা পরবর্তী ইমামগণ কখনো একবারও জানাযার সালাতের সালাম ফেরানোর পরে আবার মৃতের জন্য মুনাজাত করেছেন। কখনোই তাঁরা জানাযার সালাম ফেরানোর পরে কাতার ভেঙ্গে বা কাতার ঠিক রেখে, অথবা কোনোভাবে দু‘আ- মুনাজাত করেন নি। তাঁরা জানাযার সালাতের মধ্যে- সালামের পূর্বে- আন্তরিকতার সাথে মৃতের জন্য দু‘আ করেছেন।
এ কারণে প্রাচীন যুগ থেকেই মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ বারংবার বলেছেন যে, হাদীস নির্দেশিত এই দু‘আর সময় জানাযার সালাতের মধ্যে তৃতীয় তাকবীরের পরে এবং জানাযার সালামের পরে আর কোনো দু‘আ করা যাবে না।[1] কারণ এতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো দু’আ-পদ্ধতির সাথে বৃদ্ধি ও সংযোগ করা হবে এবং তাঁর পদ্ধতি অসম্পূর্ণ বলে মনে হবে। তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আবূ বাকর ইবনু হামিদ বলেন:
إن الدعاء بعد صلاة الجنازة مكروه
“সালাতুল জানাযার পরে দু‘আ করা মাকরূহ’[2]
অনরূপভাবে হানাফী মাযহাবের অনেক প্রসিদ্ধ ফকীহ ও ইমাম জানাযার সালাতের পরে দু‘আ-মুনাজাত করা নিষেধ করেছেন এবং বিদ‘আত বলে উল্লেখ করেছেন। দশম-একাদশ হিজরী শতাব্দীর প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মুল্লা আলী কারী (১০১৪ হি) তার প্রসিদ্ধ ‘মিরকাত’ গ্রন্থে বলেন:
لا يدعو للميت بعد صلاة الجنازة لأنه يشبه الزيادة على صلاة الجنازة
“সালাতুল জানাযার পরে মৃতব্যক্তির জন্য দু‘আ করবে না; কারণ তা সালাতুল জানাযার সাথে অতিরিক্ত সংযোগ বলে গণ্য হবে।”[3] বস্তুত, আমরা অনারব। আরবী ভাষায় সালাতুল জানাযার মধ্যে যে দু’আ আমরা পাঠ করি তাতে নিজেদের মনের আবেগ আসে না এবং মৃতের জন্য কী চাইলাম তা বুঝতে পারি না। আমাদের মনের মধ্যে আবেগ থাকে অন্তর দিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার জন্য। এজন্য আমরা এই খেলাফে সুন্নাত রীতিটি আমরা সহজেই গ্রহণ করি। একে হালাল করার জন্য অনেকে জানাযার কাতার ভেঙ্গে দেন, যেন জানাযার সাথে অতিরিক্ত সংযোগ বলে মনে না হয়। কিন্তু যেভাবেই আমরা তা করি না কেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের সাথে অতিরিক্ত সংযোজন হবেই। সালাতুল জানাযার সালামের পরেই রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের সুন্নাত ছিল মৃতদেহ তুলে দাফনের জন্য অগ্রসর হওয়া। আর আমাদের সুন্নাত, মৃতদেহ রেখে দিয়ে কিছু সময় দু‘আ করা। এখন অবিকল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পদ্ধতিতে কেউ জানাযার সালাত শেষে মৃতদেহ উঠিয়ে কবরের দিকে রাওয়ানা হলে আমাদের মনে হবে মৃতের জন্য দু‘আ পুর্ণ হলো না। আর এভাবেই সকল বিদ‘আতের উৎপত্তি।
এজন্য আমাদের দায়িত্ব হলো সুন্নাতের মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখা। জানাযার মধ্যে যথাসম্ভব বুঝে ও মনোযোগের সাথে মৃতের জন্য দু‘আ করা। যদি না বুঝতে পারি তবুও মনে করতে হবে যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো ভাষায় মৃতের জন্য দু‘আ করেছি। তার নাজাতের জন্য এই যথেষ্ট। এরপর মনের আবেগ দিয়ে দু‘আ করার জন্য সারাটি জীবন আমাদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
[2] মাওলানা মুহাম্মাদ সারফারায খানসাহেব সাফদার, রাহে সুন্নাত, পৃ. ২০৬।
[3] মুল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৭০।
জানাযার সালাতের পরে মৃতদেহের সাথে কবর পর্যন্ত গমন করা ও দাফন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা মাসনূন ইবাদত। আমাদের দেশে অনেকে মৃতদেহ বহনের সময় মুখে শব্দ করে বিভিন্ন যিকর করেন যা সুন্নাতের খেলাফ। আল্লামা কাসানী লিখেছেনঃ
وَيُطِيلُ الصَّمْتَ إذَا اتَّبَعَ الْجِنَازَةَ وَيُكْرَهُ رَفْعُ الصَّوْتِ بِالذِّكْرِ لِمَا رُوِيَ عَنْ قَيْسِ بْنِ عُبَادَةَ أَنَّهُ قَالَ : كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَكْرَهُونَ رَفْعَ الصَّوْتِ عِنْدَ ثَلَاثَةٍ : عِنْدَ الْقِتَالِ ، وَعِنْدَ الْجِنَازَةِ ، وَالذِّكْرِ ; وَلِأَنَّهُ تَشَبُّهٌ بِأَهْلِ الْكِتَابِ فَكَانَ مَكْرُوهًا
জানাযার অনুসরণের সময় নীরবতাকে প্রলম্বিত করবে (পরিপূর্ণ নীরবতা পালণ করবে)। এ সময়ে সশব্দে যিকর করা মাকরূহ। কারণ কাইস ইবনু উবাদাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবীগণ তিন সময়ে শব্দ করা মাকরূহ জানতেন: যুদ্ধের সময়, জানাযার সময় ও যিকরের সময়। এছাড়া এতে ইহুদী নাসারাদের অনুকরণ করা হয়, কাজেই তা মাকরূহ হবে।”[1]
আমরা পূবের্র কোনো কোনো হাদীসে অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়া, সান্ত্বনা প্রদান ও সেবা করার অফুরন্ত সাওয়াবের কথা জানতে পেরেছি। এ বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.)বলেছেনঃ যদি কোনো মুসলিম তার কোনো অসুস্থ ভাইকে দেখার জন্য পথ চলে তাহলে যতক্ষণ সে পথ চলে ততক্ষণ সে জান্নাতের বাগানের মধ্যে বিচরণ করতে থাকে। যখন সে উক্ত অসুস্থ মানুষের পাশে বসে তখন সে আল্লাহর রহমতের মধ্যে ডুবে যায়। যদি সে সকালে অসুস্থকে দেখতে যায় তাহলে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরিশতা তার জন্য দু‘আ করতে থাকেন। আর যদি সে সন্ধ্যায় বের হয় তাহলে সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরিশতা তার জন্য দু‘আ করতে থাকে।” হাদীসটি সহীহ।[1]
যিকর নং ১৫৭ : রোগী দেখার দু’আ-১
لا بأس طهور إن شاء الله
উচ্চারণঃ লা- বা'সা, ত্বাহূরুন ইন শা- আল্লা-হ।
অর্থঃ “কোনো অসুবিধা নেই, আল্লাহর মর্যিতে এই অসুস্থতা পাবিত্রতা (এর কারণে আল্লাহ আপনার পাপরাশি ক্ষমা করে আপনাকে পবিত্র করবেন)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো অসুস্থকে দেখতে গেলে এই কথাগুলি বলতেন।[2]
যিকর নং ১৫৭ : রোগী দেখার দ‘আ-২ (৭ বার)
أَسْأَلُ اللَّهَ الْعَظِيمَ رَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ أَنْ يَشْفِيَكَ
উচ্চারণ: আসআলুল্লা-হাল ‘আযীম, রাব্বাল ‘আরশিল ‘আযীম আইঁ ইয়াশফিইয়াকা
অর্থ: আমি প্রার্থনা করছি মহামর্যাদাময় আল্লাহর নিকট, যিনি মহামর্যাদাময় আরশের প্রভু, তিনি যেন তোমাকে সুস্থতা প্রদান করেন।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যদি কোনো মুসলিম কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যেয়ে এই কথাগুলি ৭ বার বলেন তাহলে তার মৃত্যু উপস্থিত না হলে সে সুস্থতা লাভ করবেই।” হাদীসটি হাসান।[3]
[2] সহীহ বুখারী ৩/১৩২২, ৫/২১৪১, ২১৪৩, ৬/২৭১৭, নং ৩৪২০, ৫৩৩২, ৫৩৩৮, ৭০৩২।
[3] সুনানুত তিরমিযী ৪/৪১০, নং ২০৮৩।
যিকর নং : ১৫৮ নতুন চাঁদ দেখার যিকর :
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ (باليمن) وَالْإِيمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَالْإِسْلَامِ وَالتَّوْفِيقِ لِمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى رَبُّنَا (ربي) وَرَبُّكَ اللَّهُ
উচ্চারণ : আল্লা-হু আকবার। আল্লা-হুম্মা, আহিল্লাহু ‘আলাইনা- বিলআমনি ওয়াল ঈমান, ওয়াস সালা-মাতি ওয়াল ইসলা-ম। (ওয়াততাওফীক্বি লিমা- ইউ’হিব্বু রাববুনা- ওয়া ইয়ারদ্বা-) রাব্বুনা- ওয়া রাববুকাল্লা-হু।
অর্থঃ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। হে আল্লাহ, আপনি এই নতুন চাঁদের (নতুন মাসের) সূচনা করুন কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ঈমানের সাথে, শান্তি ও ইসলামরে সাথে (এবং আমাদের প্রভু যা ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন তা পালনের তাওফীকসহ।) আমাদের ও তোমার হে নতুন চাঁদ প্রভু আল্লাহ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) হেলাল বা নতুন চাঁদ দেখলে (প্রথম ২/৩ দিনের চাঁদকে হেলাল বলা হয়) এই কথাগুলি বলতেন।[1] রমযান ও সকল মাসের নতুন চাঁদ দেখে এই দু‘আ পাঠ করা মাসনূন। অনেকে চাঁদকে সালাম করে। কাজটি উদ্ভট ও বানোয়াট।
মুখে সিয়ামের নিয়্যাত পাঠ সুন্নাত বিরোধী
সিয়ামের শুরুতে কোনো মাসনূন যিকর নেই। মুখে সিয়ামের নিয়্যাত পাঠ করা সুন্নাত বিরোধী কর্ম। “নাওয়াইতুআন” বলে যত প্রকার নিয়েত প্রচলিত সবই বানোয়াট কথা। রাসূলুল্লাহ (সা.), তাঁর সাহাবীগণ, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণ ও চার ইমামসহ কোনো ইমাম এগুলি বলেননি বা শেখাননি। সিয়াম পালনকারী সিয়াম অবস্থায় বেশি বেশি দু‘আ করবেন ; কারণ সিয়াম অবস্থার দু‘আ কবুল হয়, বিশেষত ইফতারের সময়। ইফতারের ২/১ টি মাসনূন যিকরঃ
যিকর নং ১৫৯ : ইফতারের দু‘আ-১
ذَهَبَ الظَّمَأُ، وَابْتَلَّتِ الْعُرُوقُ، وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ
উচ্চারণঃ যাহাবায যামাউ, ওয়াবতাল্লাতিল ‘উরূক্বু, ওয়া সাবাতাল আজরু, ইন শা-আল্লা-হ।
অর্থঃ পিপাসা চলে গেল, শিরা উপশিরা আর্দ্র হলো এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কার নিশ্চিত (পাওনা) হলো।”[2]
যিকর নং ১৬০ : ইফতারের দু‘আ-২
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) ইফতারের সময় বলতেন :
اللهم إني أسألك برحمتك التي وسعت كل شيء أن تغفر لي
উচ্চারণ : “আল্লা-হুম্মা, ইন্নী আসআলূকা বিরা‘হমাতিকাল্লাতী ওয়াসি‘আত কুল্লা শাইয়িন আন তাগফিরালী।
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনার সর্বব্যপী রহমতের ওসীলা দিয়ে আমি আপনার কাছে চাইছি যে, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।”[3]
যিকর নং ১৬১ : ইফতারের দু’আ-৩
একটি যয়ীফ বা অনির্ভরযোগ্য হাদীসে নিম্নের দু’আটি বর্ণিত হয়েছেঃ
اللهم لك صمت وعلى رزقك أفطرت - فتقبل مني إنك أنت السميع العليم
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনার জন্যই আমি সিয়াম পালন করেছি এবং আপনার রিযক দ্বারা ইফতার করেছি। অতএব আপনি আমার নিকট থেকে (আমার এই কর্ম) কবুল করে নিন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।” হাদীসটি যয়ীফ।[4]
যিকর নং ১৬২ : খাবারের পূর্বের যিকর
بسم الله بسم الله في أوله واخره
রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন, খাদ্যগ্রহণের পূর্বে (বিসমিল্লা-হ), অর্থাৎ “আল্লাহর নামে” বলতে। যদি কেহ খাবারের শুরুতে আল্লাহর নাম বলতে ভুলে যায়, তাহলে বলবে : (বিসমিল্লা-হি ফী আউআলিহী ওয়া আ-খিরিহী), অর্থাৎ “আল্লাহর নামে এর প্রথমে এবং এর শেষে”।[5]
যিকর নং ১৬৩ : খাবারের পরের যিকর
الحمد لله الذي أطعمني هذا الطعامَ ورزَقنيه من غير حولٍ مني ولا قوة
উচ্চারণ: আল‘হামদু লিল্লা-হিল্লাযী আত‘আমানী হা-যাত্ব ত্বা‘আ-মা ওয়া রাযাক্বানীহি মিন গাইরি ‘হাওলিম মিন্নী ওয়ালা- ক্বুওয়াহ।
অর্থঃ সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে এই খাদ্য খাইয়েছেন এবং আমাকে তা প্রদান করেছেন, আমার কোনো অবলম্বন ও ক্ষমতা ছাড়াই।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যদি কেউ খাদ্য গ্রহণ করে এই কথাগুলি বলে তাহলে তার পূর্বাপর সকল (সাধারণ সগীরা) গোনাহ ক্ষমা করা হবে।”[6]
যিকর নং ১৬৪ : গৃহকর্তার জন্য অতিথির দু‘আ-১
اللهم أطعم من أطعمني وأسق من أسقاني
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, আত্ব‘ইম মান আত্ব‘আমানী, ওয়াসক্বি মান আসক্বা-নী।
অর্থঃ হে আল্লাহ, যে আমাকে খাইয়েছে তাকে আপনি খাদ্য প্রদান করুন এবং যে আমাকে পান করিয়েছে তাকে আপনি পানীয় প্রদান করুন।[7]
যিকর নং ১৬৫ : গৃহকর্তার জন্য অতিথির দু‘আ-২
أفطر عندكم الصائمون، وأكل طعامكم الأبرار، وصلّت عليكم الملائكة
উচ্চারণ: আফত্বারা ‘ইনদাকুমুস স্বা-ইমূন, ওয়া আকালা ত্ব‘আ-মাকুমুল আবরা-র, ওয়া স্বাল্লাত ‘আলাইকুমুল মালা-ইকাহ।
অর্থঃ তোমাদের কাছে রোযাদারগণ ইফতার করুন, তোমাদের খাদ্য নেককার মানুষেরা ভক্ষণ করুন এবং তোমাদের জন্য ফিরিশতাগণ দু‘আ করুন।
কেউ রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে ইফতার করালে বা সিয়াম ছাড়া অন্য সময়ে কোনো খাদ্য খাওয়ালে তিনি এ কথা বলে তার জন্য দু‘আ করতেন।[8]
যিকর নং ১৬৬ : গৃহকর্তার জন্য অতিথির দু‘আ-৩
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِيمَا رَزَقْتَهُمْ، واغْفِرْ لَهُمْ، وارْحَمْهُمْ
“হে আল্লাহ, আপনি এদের যে রিযক প্রদান করেছেন তাতে বরকত প্রদান করুন, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদেরকে রহমত করুন।”
আব্দুল্লাহ্ বিনু বিশর বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার পিতার বাড়িতে আগমন করেন। তিনি তার সামনে কিছু খাদ্য পেশ করেন। তিনি তা থেকে কিছু খাদ্য গ্রহণ করেন। আমার পিতা তাঁর নিকট দু’আ চান। তখন তিনি এ কথাগুলি বলেন।[9]
[2] হাদিসটি গ্রহনযোগ্য। সুনানু আবী দাউদ ২/৩০৬, নং ২৩৫৭।
[3] হাদিসটি গ্রহনযোগ্য। সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৫৫৭, নং ১৭৫৩, মিসবাহুয যুজাজাহ ২/৮১।
[4] সুনানু আবী দাউদ ২/৩০৬, নং ২৩৫৮, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৫৬, যাকারিয়্যা, আল-ইখবার ১১০।
[5] সুনানুত তিরমিযী ৪/২৮৮, নং ১৮৫৮, সুনানু ইবনি মাজাহ ২/১০৮৬, নং ৩২৬৪। হাদিসটি সহীহ।
[6] সুনানুত তিরমিযী ৫/৫০৮, ৩৪৫৮, আবু দাউদ ৪/৪২, নং ৪০২৩, ইবনু মাজাহ ২/১০৩৯, নং ৩২৮৫।
[7] সহীহ মুসলিম ৩/১৬২৫, নং ২০৫৫।
[8] সহীহ ইবনু হিব্বান ১২/১০৭, সুনানু আবী দাউদ ৩/৩৬৭, সুনানি ইবনি মাজাহ ১/৫৫৬, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৩৪।
[9] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬১৫।
যিকর নং ১৬৭ : ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের যিকর
أعوذ بالله من الشيطان الرجيم
উচ্চারণঃ আ’ঊযু বিল্লা-হি মিনাশ শাইত্বা-নির রাজীম।
অর্থঃ আমি আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি বিতাড়িত শয়তান থেকে।
সুলাইমান ইবনু সুরাদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, এই কথাগুলি বললে ক্রোধান্বিত ব্যক্তির ক্রোধ দূরীভূত হবে।[1]
ইতোপূর্বে আমরা ক্রোধের ক্ষতি এবং ক্রোধ দমনের পুরস্কারের বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, ক্রোধের সময় ক্রোধ দমন করা এবং যার উপরে রাগ হয়েছে তাকে ক্ষমা করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং আল্লাহর রহমত, ক্ষমা ও জান্নাত লাভের অন্যতম পথ। কাজেই মুমিনের উচিত ক্রোধ অনুভব করলে অর্থের দিকে লক্ষ্য করে এই বাক্যটি বারবার বলা। আল্লাহ আমাদেরকে শয়তানের অশুভ প্ররোচনা থেকে রক্ষা করেন।
ইতোপূর্বে দুশ্চিন্তা ও বিপদ থেকে মুক্তির বিভিন্ন দু‘আ আলোচিত হয়েছে: (১৯, ২৯ ও ৩০ নং যিকর)। যে কোনো বিপদে, উৎকণ্ঠায় মুমিনের উচিত এগুলি বেশি বেশি করে পাঠ করা।
যিকর নং ১৯: আল্লাহর নামসমূহের ওসীলায় দুশ্চিন্তা মুক্তির দু‘আ
اللَّهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ ابْنُ عَبْدِكَ ابْنُ أَمَتِكَ نَاصِيَتِي بِيَدِكَ مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي وَنُورَ بَصرى (في روايات نُورَ صَدْرِي) وَجَلَاءَ حُزْنِي وَذَهَابَ هَمِّي
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আবদুকা, ওয়া ইবনু আবদিকা ওয়াবনু আমাতিকা, না-সিয়্যাতি বিইয়াদিকা, মা-দিন ফিইয়্যা হুকমুকা, ‘আদলুন ফিইয়্যা ‘কাদাউকা, আসআলুকা বিকুল্লি ইসমিন হুআ লাকা, সাম্মাইতা বিহী নাফসাকা, আউ আনযালতাহু ফী কিতা-বিকা, আউ ‘আল্লামতাহু আহাদাম মিন খালকিকা, আউ ইসতা-সারতা বিহী ফী ‘ইলমিল ‘গাইবি ‘ইনদাকা আন তাজ’আলাল কুরআ-না রাবী’আ কালবী, ওয়া নূরা বাসারী [সাদরী] , ওয়া জালা-আ হুযনী, ওয়া যাহা-বা হাম্মী।
অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমি আপনার বান্দা, আপনার (একজন) বান্দার পুত্র, (একজন) বান্দীর পুত্র। আমার কপাল আপনার হাতে। আমার বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত কার্যকর। আমার বিষয়ে আপনার বিধান ন্যায়ানুগ। আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আপনার সকল নাম ধরে বা নামের ওসীলা দিয়ে, যে নামে আপনি নিজেকে ভূষিত করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কোনো সৃষ্টিকে শিখিয়েছেন, অথবা যে নাম আপনি গাইবী জ্ঞানে আপনার একান্ত নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন (সকল নামের ওসীলায় আমি আপনার কাছে চাচ্ছি যে,) আপনি কুরআন কারীমকে আমার অন্তরের বসন্ত, চোখের আলো, বেদনার অপসারণ ও দুশ্চিন্তার অপসারণ বানিয়ে দিন। (কুরআনের ওসীলায় আমাকে এগুলি দান করুন)।”
যিকর নং ২৯ : দুশ্চিন্তা বা বিপদগ্রস্তের দু‘আ-১
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বিপদ বা কষ্টের সময় বলতেনঃ
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ الْعَظِيمُ الْحَلِيمُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ
উচ্চারণঃ লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হুল আযীমুল হালীম, লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু রাব্বুল আরশিল আযীম, লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা- হু রাব্বুস সামাওয়া-তি ওয়া রাব্বুল আরদি ওয়া রাব্বুল আরশিল কারীম।
অর্থঃ “নেই কোনো মা’বুদ আল্লাহ ছাড়া, যিনি মহান, মহাধৈর্যময় মহা বিচক্ষণ, নেই কোনো মা’বুদ আল্লাহ ছাড়া, যিনি মহান আরশের প্রভু, নেই কোনো মা’বুদ আল্লাহ ছাড়া, যিনি আসমানসমূহের, জমিনের ও সম্মানিত আরশের প্রভু।
যিকর নং ৩০ : দুশ্চিন্তা বা বিপদগ্রস্তের দু‘আ-২
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারের সবাইকে একত্রিত করে বলতেন: “তোমাদের কেউ কখনো দুশ্চিন্তা বা বিপদের মধ্যে নিপতিত হলে বলবেঃ
اللَّهُ، اللَّهُ رَبِّى لاَ أُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، اللَّهُ اللَّهُ رَبِّى لاَ أُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا
উচ্চারণঃ আল্লা-হু, আল্লা-হু রাব্বী, লা- উশরিকু বিহী শাইআন। আল্লা-হু, আল্লা-হু রাব্বী, লা- উশরিকু বিহী শাইআন।
অর্থঃ “আল্লাহ, আল্লাহ, আমার রব, তার সাথে কাউকে শরীক করি না, আল্লাহ, আল্লাহ, আমার রব, তার সাথে কাউকে শরীক করি না।”
হাদীসটির সনদ কিছুটা দুর্বল হলেও অন্যান্য কয়েকটি সনদে একই দু’আ বর্ণিত হয়েছে। এজন্য হাদীসটি হাসান।