রাহে বেলায়াত দ্বিতীয় অধ্যায় - বেলায়াতের পথে যিকরের সাথে ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ৩৩ টি

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা বেলায়াতের পরিচয়, যিকরের অর্থ, গুরুত্ব মর্যাদা, ফযীলত ও প্রকারভেদ আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, আল্লাহর বেলায়াত অর্জন মুমিনের অন্যতম কাম্য ও মুমিন জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্য অর্জনে যিকর অন্যতম অবলম্বন। তবে নফল পর্যায়ের যিকরের মাধ্যমে বেলায়াত অর্জনের পূর্বে মুমিনকে আরো অনেক কর্ম করতে হয়। যেগুলির অবর্তমানে সকল যিকর অর্থহীন ও ভন্ডামিতে পরিণত হতে পারে। এ অধ্যায়ে আমরা এ জাতীয় কিছু বিষয় আলোচনা করব। এছাড়া যিকরের ন্যূনতম বা পরিপূর্ণ ফযীলত অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ও আলোচনা করতে চাই। মহান আল্লাহর নিকট তাওফীক ও কবুলিয়্যত প্রার্থনা করি।


ক. ইবাদত কবুলের শর্ত পূরণ

কুরআন কারীম ও সুন্নাতের আলোকে যিকরসহ সকল ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল বা গৃহীত হওয়ার জন্য তিনটি মৌলিক শর্ত রয়েছেঃ


(১) বিশুদ্ধ ঈমান ও ইখলাস: শির্ক, কুফর ও নিফাক-মুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান সকল ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত। শুধু তাই নয়। উপরন্তু ইবাদতটি পরিপূর্ণ ইখলাসের সাথে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো রকম উদ্দেশ্যর সামান্যতম সংমিশ্রণ থাকলে সে ইবাদত আল্লাহ কবুল করবেন না।


(২) সুন্নাতের অনুসরণ : কর্মটি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত, রীতি ও তাঁর শিক্ষা অনুসারে পালিত হতে হবে। যদি কোনো ইবাদত তাঁর শেখানো ও আচরিত পদ্ধতিতে পালিত না হয়, তাহলে যত ইখলাস, আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতাই থাক না কেন, তা আল্লাহর দরবারে কোনো অবস্থাতেই গৃহীত বা কবুল হবে না।


(৩) হালাল ভক্ষণ : ইবাদত পালনকারীকে অবশ্যই হালাল-জীবিকা-নির্ভর হতে হবে। হারাম ভক্ষণকারীর কোনো ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।


দ্বিতীয় ও তৃতীয় শর্তটির বিষয়ে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে কিছু আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম শর্তটির বিষয়ে ‘কুরআন-সুন্নাহের আলোকে ইসলামী আকীদা’ গ্রন্থে ও ‘মুসলমানী নেসাব’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি করবে। আবার এ বিষয়ের প্রতি সার্বক্ষণিক সচেতনতা ছাড়া সকল ইবাদতই অর্থহীন। এজন্য এখানে অত্যন্ত সংক্ষেপে এ বিষয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই।

আল্লাহর একত্ব ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর রিসালাতের সাক্ষ্য দেওয়া বা এই দুটি বিষয়ে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করাই ইসলামের মূল ভিত্তি। ঈমানের প্রথম অংশ (আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য বা মা’বুদ নেই) এই সাক্ষ্য প্রদান করা। দ্বিতীয় অংশ (মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল) এই সাক্ষ্য প্রদান করা। প্রথম অংশকে সংক্ষেপে “তাওহীদ” ও দ্বিতীয় অংশকে সংক্ষেপে “রিসালাত” বলা হয়।


কুরআন-হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, তাওহীদের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। প্রথমত, জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ। এই পর্যায়ে মহান আল্লাহকে তাঁর গুণাবলী ও কর্মে এক ও অদ্বিতীয় বলে বিশ্বাস করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, আল্লাহই এই মাহবিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, পরিচালক, সংহারক, রিযিকদাতা ও পালনকর্তা। এ সকল কর্মে তাঁর কোনো শরীক বা সমকক্ষ নেই।


দ্বিতীয়ত, কর্ম পর্যায়ের একত্ব বা ইবাদতের একত্ব। এ পর্যায়ে বান্দার কর্মে আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা হয়। অর্থাৎ বান্দার সকল প্রকার ইবাদাত বা উপাসনা আরাধনা মূলক কর্ম যেমন প্রার্থনা, সাজদা, জবাই উৎসর্গ, মানত, তাওয়াক্কুল, ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহর জন্য করা ও আল্লাহরই প্রাপ্য বলে বিশ্বাস করা এই পর্যায়ের তাওহীদ।


তাওহীদের এই দুইটি পর্যায় একে অপরের সম্পূরক ও পরস্পরে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়কে পৃথক করা যায় না বা একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির উপর ঈমান এনে মুসলিম হওয়া যায় না। তবে এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, ঈমানের প্রথম অংশ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ )-তে মূলত দ্বিতীয় পর্যায় বা “তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ্”-র বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়নি যে (লা খালিকা ইল্লাল্লাহ ) অর্থাৎ (আল্লাহ ছাড়া কোন স্রষ্টা নেই,), বা (লা রাযিকা ইল্লাল্লাহু) অর্থাৎ (আল্লাহ ছাড়া কোন রিজিকদাতা নেই)। অনুরূপভাবে আল্লাহ ছাড়া কোন জীবনদাতা নেই, মৃত্যুদাতা নেই, পালনকর্তা নেই ইত্যাদি বিষয়ে সাক্ষ্য দানের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বরং আমাদের এই ঘোষণা দিতে হবে, এই বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য বা মাবুদ নেই।


এর কারণ কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা অনুসারে মক্কার কাফিরগণ এবং সকল যুগের কাফির-মুশরিকগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ের তাওহীদ বিশ্বাস করত। তারা একবাক্যে স্বীকার করত যে, আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা, তিনিই সর্বশক্তিমান এবং সকল কিছুর একমাত্র মালিক তিনিই।[1]

মহান আল্লাহর একত্ব বা তাওহীদের এই বিশ্বাস নিয়ে তারা মহান আল্লাহর ইবাদাত বা উপাসনা করতো। তাঁকে সাজদা করত, তাঁর নামে মানত করত, তাঁর কাছে প্রার্থনা করত, সাহায্য চাইত। তবে তারা এর পাশাপাশি অন্যান্য দেবদেবী, নবী, ফিরিশতা, ওলী, পাথর, গাছগাছালি ইত্যাদির পূজা উপাসনা করত। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত, উপাসনা বা পূজা করা যাবে না এই কথাটি তারা মানতো না। তাদের দাবি ছিল যে, কিছু মানুষ ও ফিরিশতা আছেন যারা মহান আল্লাহর খুবই প্রিয়। এদের ডাকলে, এদের পূজা-উপাসনা করলে আল্লাহ খুশি হন ও তাঁর নৈকট্য, প্রেম ও সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। এছাড়া তারা বিশ্বাস করত যে, এ সকল প্রিয় সৃষ্টির সুপারিশ আল্লাহ শুনেন। কাজেই এদের কাছে প্রার্থনা করলে এরা আল্লাহর নিকট থেকে সুপারিশ করে ভক্তের মনোবাঞ্চনা পূর্ণ করে দেন। এজন্য তারা এ সকল ফিরিশতা, জিন, মানুষ, নবী, ওলী বা কল্পিত ব্যক্তিত্বের মুর্তি, সমাধি, স্মৃতিবিজড়িত স্থান বা স্মৃতিবিজড়িত দ্রব্যকে সম্মান করত এবং সেখানে তাদের উদ্দেশ্যে সাজদা, মানত, কুরবানী ইত্যাদি করত।[2]

এজন্য ইসলামে ইবাদতের তাওহীদের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মূলত এর মাধ্যমেই ঈমান ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়।

আল্লাহর একত্বে বা তাওহীদের বিশ্বাসের ৬টি দিক রয়েছে, যেগুলিকে আরকানুল ঈমান বা ঈমানের স্তম্ভ বলা হয়। (১) আল্লাহর উপর বিশ্বাস, (২) আল্লাহর মালাইকা বা ফিরিশতাগণের উপর বিশ্বাস, (৩) আল্লাহর গ্রন্থসমূহের উপর বিশ্বাস, (৪) আল্লাহর প্রেরিত নবী- রাসূলগণের উপর বিশ্বাস, (৫) আখেরাতের উপর বিশ্বাস, (৬) আল্লাহর জ্ঞান ও নির্ধারণ বা তাকদীরে বিশ্বাস।


ঈমানের দ্বিতীয় অংশ মুহাম্মাদ (সা.)-কে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করা। এ কথা বিশ্বাস করা যে, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর মনোনীত নবী ও রাসূল। মানবজাতির মুক্তির পথের নির্দেশনা দানের জন্য তাদের কল্যাণ ও অকল্যাণের পথ শিক্ষা দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাকে মনোনীত করেছেন। মানবজাতির মুক্তির পথ, কল্যাণ ও অকল্যাণের সকল বিষয় আল্লাহ তাকে জানিয়েছেন এবং তা মানুষদেরকে শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁকে দান করেছেন। তিনি আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তার পরে আর কোনো ওহী নাযিল হবে না, কোন নবী বা রাসূল আসবেন না। তিনি বিশ্বের সকল দেশের সকল জাতির সব মানুষের জন্য আল্লাহর মনোনীত রাসূল। তার আগমনের দ্বারা পূর্ববর্তী সকল ধর্ম রহিত হয়ে গিয়েছে। তার রিসালাতে বিশ্বাস করা ছাড়া কোন মানুষই মুক্তির দিশা পাবে না। তিনি পরিপূর্ণ বিশবস্ততার সাথে আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বজনীন নবী ও রাসূল হিসাবে তার নবুয়তের ও রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহর সকল বাণী, শিক্ষা ও নির্দেশ তিনি পরিপূর্ণভাবে তার উম্মতকে শিখিয়ে গিয়েছেন, কোন কিছুই তিনি গোপন করেননি। তিনি যা কিছু উম্মতকে শিখিয়েছেন, জানিয়েছেন সবকিছুই তিনি সত্য বলেছেন। তার সকল শিক্ষা, সকল কথা সনেদহাতীতভাবে সত্য। আল্লাহকে ডাকতে হলে, তাঁকে পেতে হলে, তার ইবাদত করতে বা তার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে অবশ্যই তাঁর শিক্ষা অনুসারে আল্লাহকে ডাকতে হবে বা ইবাদত করতে হবে। তার শিক্ষার বাইরে ইবাদত করলে তা কখনো আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের মুক্তির একমাত্র পথ। তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। তাঁকে সর্বোচ্চসম্মান করতে হবে এবং সকলের চেয়ে বেশি ভালবাসতে হবে। তাঁর ভালবাসার অংশ হিসেবে তাঁর সাহাবীগণ ও বংশধরকে ভালবাসতে হবে। ভালবাসা, ভক্তি ও মর্যাদা ক্ষেত্রে অবশ্যই মুমিনকে কুরআন কারীম ও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত তাঁর বাণীর উপর নির্ভর করতে হবে। মনগড়াভাবে কিছুই বলা যাবে না। নিজের পছন্দ-অপছন্দ অবশ্যই তাঁর শিক্ষার অধীন করতে হবে।

[1] সূরা ইউনুসঃ ৩১, সূরা মু’মিনুন ৮৪-৮৯, সূরা আনকাবুতঃ ৬১-৬৩, সূরা লুকমানঃ ২৫, সূরা যুখরুফঃ ৯।

[2] সূরা যুমার ২-৩, সূরা ইউনুস ১৮।

খ. ফরয ও নফল পালন


পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, বেলায়াতের পথে চলার ক্ষেত্রে কর্ম দুই প্রকার : (১) ফরয বা অত্যাবশ্যকীয় কর্ম, ও (২) ফরযের অতিরিক্ত নফল বা সুন্নাত ইবাদত। ফরয ইবাদত পালনই আল্লাহর বেলায়েত, নৈকট্য, সাওয়াব ও সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম কর্ম। ফরযের পরে অনবরত নফল ইবাদত পালন বান্দাকে আল্লাহর বন্ধুত্ব বা বেলায়েতের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।

অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় যিকরেরও দুটি পর্যায় আছে : (১) ফরয যিকর, যেমন, সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর যিকর ও (২) নফল যিকর, যা মূলত আমাদের আলোচনার বিষয়। যদি কোনো মুমিন অন্যান্য ফরয ইবাদত আদায় করার পরে নফল যিকর আদায় করেন তাহলে তার যিকর হবে অত্যন্ত ফলদায়ক। কিন্তু তিনি যদি ফরয যিকর ও অন্যান্য ফরয ইবাদতে অবহেলা করেন, অথচ নফল যিকর বেশি বেশি করেন তাহলে তা নিঃসন্দেহে বাতুলতা।

অনেকে ফরয ইবাদত পালন করেন না। ফরয ইলম, আকীদা, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্ব, হালাল উপার্জন, সাংসারিক দায়িত্ব, পিতা-মাতা, সন্তান ও স্ত্রীর দায়িত্ব, সামাজিক দায়িত্ব, সৎকাজে আদেশ, অসৎকাজ থেকে নিষেধ ইত্যাদি সকল ফরয ইবাদত (যার ক্ষেত্রে যতটুকু প্রযোজ্য) পালন না করে নফল ইবাদত পালন করা, নফল যিকর ইত্যাদি পালন বিশেষ কোনো উপকারে লাগবে না। অবস্থা বিশেষে হয়ত নফল ইবাদত কোনো কোনো ফরয ইবাদতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। কিন্তু কোনো অস্থাতেই তা আল্লাহর

নৈকট্য বা বেলায়েতের মাধ্যম নয়। ফরয পরিত্যাগ করলে হারামের গোনাহ হয়। হারামের গোনাহে রত অবস্থায় নফল ইবাদতের অর্থ হলে সর্বাঙ্গে মলমূত্র লাগানো অবস্থায় নাকে আতর মাখা।

এছাড়া, ফরয ইবাদতের মধ্যে যে সকল নফল ইবাদত থাকে তাও ফরযের বাইরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। সালাতের মধ্যে অসংখ্য ফরয, সুন্নাত ও নফল যিকর আযকার রয়েছে। এগুলি বিশুদ্ধভাবে পালন করা সালাতের বাইরে সারাদিন বিশুদ্ধ মাসনূন যিকরের চেয়ে অনেক উত্তম। এর অর্থ এই নয় যে, বিশুদ্ধ সালাত আদায় করলেই চলবে। এর অর্থ, নফল যিকর আযকারে রত হওয়ার আগে সালাত ইত্যাদি ফরয যিকর ও তৎসংশ্লিষ্ট নফল যিকর বিশুদ্ধ ও সুনদরভাবে আদায় করতে হবে। তা না হলে আমাদের যিকর আযকার পন্ডশ্রম ও সুন্নাত বিরোধী হয়ে যাবে। এ বিষয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানীর বক্তব্য আমরা পুস্তকের শুরুতে উল্লেখ করেছি।


ফরয ও নফলের দু’টি শ্রেণী রয়েছে, পালন ও বর্জন। কোনো কাজ করা যেরূপ ফরয, তেমনি কিছু কাজ বর্জন করা ফরয। এসকল কাজ করাকে হারাম বলা হয়। অনুরূপভাবে কিছু কর্ম করা নফল-মুসতাহাব বা সুন্নাত। আবার কিছু কাজ বর্জন করাও নফল- মুসতাহাব বা সুন্নাত। এ ধরনের কাজ করা মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। মাকরূহ কখনো হারামের নিকটবর্তী হয়, যাকে মাকরূহ তাহরীমি বলা হয়। কখনো তা মাকরূহ তানযিহী বা অনুচিত পর্যায়ের হয়, যা বর্জন করা উত্তম তবে করলে গোনাহ হবে না।


আল্লাহর নৈকট্যের পথে কর্মের চেয়ে বর্জনের গুরুত্ব বেশি। যা করা ফরয তা করতেই হবে। আর যা বর্জন করা ফরয তা বর্জন করতেই হবে। যে ব্যক্তি তার উপরে ফরয এরূপ কোনো কর্ম পালন করছেন না, বা তার জন্য হারাম এরূপ কোনো কার্যে রত রয়েছেন, অথচ বিভিন্ন নফল মুসতাহাব কর্ম পালন করছেন তার কাজকে আমরা ইসলামের শিক্ষা বিরুদ্ধ বলতে বাধ্য। তিনি জেনে অথবা না জেনে ভন্ডামীতে রত রয়েছেন।

দ্বিতীয় স্তরে নফল পর্যায়ে বর্জনীয় নফলের গুরুত্ব করণীয় নফলের থেকে অনেক বেশি। সাজানোর পূর্বে পরিচ্ছন্নতা। নিজেকে নোংরা, অপরিচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করে এরপর যতটুকু সম্ভব সাজগোজ করতে হবে। এজন্য সকল প্রকার মাকরূহ বর্জন করা নফল ইবাদতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَا نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ فَاجْتَنِبُوهُ وَمَا أَمَرْتُكُمْ بِهِ فَافْعَلُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ


“আমি তোমাদেরকে কোনো কিছু নিষেধ করলে তা সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করবে। আর তোমাদেরকে যা করতে নির্দেশ প্রদান করব তা সাধ্যমত করবে।”[1]
আমরা এই গ্রন্থে মূলত নফল যিকর সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ সকল নফল যিকর পালনের চেয়ে মাকরূহ বর্জন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য যাকিরকে এ সকল যিকর পালনের পাশাপশি সকল প্রকার মাকরূহ বর্জনের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করতে হবে। কখনো কোনো মাকরূহ করে ফেললে বেশি বেশি তাওবা করতে হবে। ইচ্ছাপূর্বক নিজেকে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন মাকরুহের মধ্যে নিয়োজিত রেখে পাশাপাশি এ সকল যিকর আযকারে রত থাকা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর শিক্ষা, সুন্নাত ও রীতির ঘোর বিরোধী ও বিপরীত।

[1] সহীহ মুসলিম ৪/১৮৩০, নং ১৩৩৭, (সহীহ বুখারী ৬/২৬৫৮, নং ৬৮৫৮, সহীহ মুসলিম ২/৯৭৫, নং ১৩৩৭, আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে)।

গ. কবীরা গোনাহ বর্জন

এভাবে মুমিন সর্বদা মাকরূহ বা অপছন্দনীয় কর্ম পরিহার করতে চেষ্টা করবেন। আর হারাম ও কবীরা গোনাহ-সমূহ থেকে শত যোজন দূরে থাকতে সদা সচেষ্ট থাকবেন। আমরা জানি যে, সকল চেষ্টা সত্ত্বেও কিছু অপরাধ হবেই। তবে ছোটখাট পাপ ও ভুলভ্রান্তি আল্লাহ নেক কর্মের কারণে ক্ষমা করে দেন। এজন্য কঠিন পাপগুলি থেকে দূরে থাকার জন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।


কবীরা গুনাহের সংজ্ঞা, সংখ্যা ও পরিচয় সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম অনেক কথা লিখেছেন। যে সকল পাপের বিষয়ে কুরআন কারীম বা হাদীস শরীফে কঠিন গজব, শাস্তি বা অভিশাপের উল্লেখ করা হয়েছে বা যে সকল কর্মকে কুরআন বা হাদীসে কঠিন পাপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলিকে কবীরা গুনাহ হিসাবে গণ্য করা হয়। এছাড়াও অনেক পাপকে কবীরা বলা হয়েছে। এছাড়া যে কোনো সাধারণ পাপও সর্বদা করলে তা বড় পাপে পরিণত হয়।

ইমাম যাহাবী “আল-কাবাইর” গ্রন্থে কবীরা গুনাহ বিষয়ক আয়াত ও হাদীস সমূহ সংকলিত করেছেন। যে সকল পাপকে কুরআন কারীম বা হাদীস শরীফে বড় পাপ বা কঠিন শাস্তি, গজব বা অভিষাপের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি সেগুলির তালিকা প্রদান করেছেন। আমি এখানে সেগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। পরে এগুলির মধ্য থেকে বিশেষ কতগুলি পাপ যা আমাদের নেক কাজগুলিকে বিনষ্ট করে দেয় সেগুলির বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

এ সকল পাপ বা অপরাধকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি : ব্যক্তিগত বা হক্কুল্লাহ বিষয়ক ও সামাজিক বা হক্কুল ইবাদ বিষয়ক। যদিও উভয় প্রকার পাপই আল্লাহর অবাধ্যতা ও পরস্পরে সম্পৃক্ত, তবুও সংক্ষেপে বুঝার জন্য দুইভাগ করে আলোচনা করছি:


প্রথমত, হক্কুল্লাহ বিষয়ক বা ব্যক্তিগত কবীরা গুনাহসমূহ


১. ঈমান বিষয়ক : শিরক, কুফর, নিফাক, বিদ‘আত, আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপত্তা বোধ করা, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া, তকদীরে অবিশ্বাস করা, গনক বা জ্যোতিষীর কথা সত্য মনে করা, অশুভ, অমঙ্গল বা অযাত্রায় বিশ্বাস করা, মক্কার হারামে যে কোনো প্রকার অন্যায় করার ইচ্ছা, যাদু শিক্ষা বা ব্যবহার, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য জবাই করা, নিজের জীবন, সম্পদ, ও সকল মানুষের চেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বেশি ভালবাসায় ত্রুটি থাকা, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামে মিথ্যা হাদীস বলা, নিজের পছন্দ-অপছন্দ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত ও শরীয়তের অনুগত না হওয়া, বিদ‘আতে লিপ্ত হওয়া, আত্মহত্যা করা।


২. ফরয ইবাদত পরিত্যাগ বিষয়ক : সালাত পরিত্যাগ, যাকাত প্রদান থেকে বিরত থাকা, ওজর ছাড়া রমযানের সিয়াম পালনে অবহেলা, জুম‘আর সালাত পরিত্যাগ করা, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হজ্ব আদায় না করা, ধর্ম পালনে অতিশয়তা বা সুন্নাতের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ইবাদত করা, সালাতরত ব্যক্তি সামনে দিয়ে গমন করা।


৩. হারাম খাদ্য ও পানীয় : মদপান, মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের মাংস ভক্ষণ করা, স্বর্ণ বা রৌপ্যের পাত্রে পান করা।


৪. পবিত্রতা ও অন্যান্য অভ্যাস বিষয়ক : পেশাব থেকে পবিত্র না হওয়া, মিথ্যা বলার অভ্যাস, প্রাণীর ছবি তোলা বা আঁকা, কৃত্রিম চুল লাগান, শরীরে খোদাই করে উল্কি লাগান। পুরুষের জন্য মেয়েলী পোশাক বা চাল চলন, টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পোশাক পরা, সোনা ও রেশমের ব্যবহার, গোফ বেশি বড় করা, দাড়ি না রাখা। মেয়েদের জন্য পুরষালী পোশাক বা আচরণ, সৌন্দর্য প্রকাশক পোশাক পরিধান করে, মাথা, মাথার চুল বা শরীরের কোনো অংশ অনাবৃত রেখে বা সুগন্ধি মেখে বাইরে যাওয়া।


৫. অন্তরের বা মনের পাপ : অহংকার, গর্ব করা, নিজেকে বড় ভাবা, নিজের মতামত বা কর্মের প্রতি পরিতৃপ্ত থাকা, রিয়া, হিংসা, কোনো মুসলিমকে হেয় বা ছোট ভাবা, ক্রোধ, প্রশংসা ও সম্মানের লোভ, সম্পদের লোভ, কৃপণতা, নিষ্ঠুরতা, দ্বীনী ইলম পার্থিব উদ্দেশ্যে শিক্ষা করা, ইলম গোপন করা।


এগুলির মধ্যে কিছু পাপের সাথে মানুষের অধিকার জড়িত। মিথ্যা হাদীস বলা এমনিতেই ভয়ঙ্করতম পাপ। সাথে সাথে এই মিথ্যা দ্বারা যারা প্রভাবিত হয়, বিপথগামী হয় তাদের সকলের পাপের ভাগ পেতে হয় মিথ্যাবাদীকে। যাকাত প্রদানে অবহেলা করলে একদিকে আল্লাহর অবাধ্যতা ও ইসলামের রুকন নষ্ট করা হয়। সাথে সাথে সমাজের দরিদ্রদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ইলম গোপন করলে সাধারণত সমাজের মানুষেরা অজ্ঞতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং এই আলিম তাদের অপরাধের জন্য দায়ী থাকেন। যাদু ও মিথ্যা বলার অভ্যাস যদি কারো কোনো ক্ষতি না করে তাহলেও কবীরা গোনাহ। পক্ষান্তরে কারো কোনো প্রকার

ক্ষতি করলে তা দ্বিতীয় একটি কবীরা গুনাহে পরিণত হয়। অনুরূপভাবে অহংকার, হিংসা, কাউকে হেয় ভাবা ইত্যাদি ব্যক্তিগত কবীরা গোনাহ হলেও সাধারণত এগুলির অভিব্যক্তি ব্যক্তির বাইরে প্রকাশিত হয়ে অন্যদের কষ্ট দেয়। তখন তা আরো অনেক হক্কুল ইবাদ সংশ্লিষ্ট কবীরা গোনাহের মধ্যে ব্যক্তিকে নিপতিত করে। কৃপণতা যদিও মানসিক পাপ ও ব্যাধি, কিন্তু সাধারণত এই ব্যধি মানুষকে বান্দার হক নষ্ট বা ক্ষতি করার অনেক পাপের দিকে প্ররোচিত করে।


দ্বিতীয়ত, সৃষ্টির অধিকার সংক্রান্ত কবীরা গোনাহসমূহ

কুরআন-হাদীস থেকে প্রতিভাত হয় যে, মানুষের মূল দায়িত্ব দুটি ও পাপের সূত্রও দুটি। প্রথম দায়িত্ব, মানুষ তার মহান প্রভুর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস, অগাধ ভালবাসা ও আস্থা পোষণ করবে এবং এই আস্থা, বিশ্বাস ও ভালবাসা বৃদ্ধিপায় এমন সকল কর্ম আল্লাহর মনোনীত রাসূলের শিক্ষা অনুসারে পালন করবে। আর এই দায়িত্বে অবহেলা সৃষ্টি করে এমন সকল কর্ম বা চিন্তচেতনাই প্রথম পর্যায়ের পাপ।

মানুষের দ্বিতীয় দায়িত্ব, এই পৃথিবীকে সুন্দর বসবাসযোগ্য করতে তার আশেপাশে সকল মানুষ ও জীবকে তারই মতো ভালোভাবে বাঁচতে সাহায্য করা। আর এই দায়িত্বের অবহেলা জনিত কর্মই দ্বিতীয় পর্যায়ের পাপ। আল্লাহর সৃষ্টির কষ্ট প্রদান, ক্ষতি করা, শান্তি বিনষ্ট করা বা অধিকার নষ্ট করাই মূলত সবচেয়ে কঠিন অপরাধ। এ জাতীয় পাপগুলিকে কুরআন বা হাদীসে বেশি আলোচনা করা হয়েছে, বেশি বিশ্লেষণ ও ভাগ করা হয়েছে। একই জাতীয় পাপের শাখা প্রশাখাকে বিশেষভাবে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে এর তালিকাও অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।


১. ইসলাম নির্ধারিত শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধীর (চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি) শাস্তি মওকুফের জন্য সুপারিশ বা চেষ্টা করা।

২. আইনের মাধ্যমে বিচার ছাড়া কোনো মানুষকে খুন বা হত্যা করা। এমনকি ডাকাতী, খুন, ধর্মদ্রোহিতা ইত্যাদি ইসলামী বিধানে যে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড বলে নির্ধারিত সেই অপরাধে লিপ্ত ব্যক্তিকেও কোনো ব্যক্তি নিজের হাতে শাস্তি দিলে তা হবে খুন বা হত্যা। একমাত্র উপযক্তু আদালতের বিচারের মাধ্যমেই অপরাধীর অপরাধ, তার মাত্রা ও তার শাস্তি নির্ধারিত হবে। যথাযথ বিচারে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে অপরাধী মনে করা বা শাস্তি দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে সৃষ্টির অধিকার নষ্টকারী কঠিন অপরাধ।

৩. রাষ্ট্রপ্রধান, প্রশাসক বা বিচারক কর্তৃক জনগণের দায়িত্ব, সম্পদ বা আমানত আদায়ে অবহেল বা ফাঁকি দেওয়া।

৪. নাগরিক কর্তৃক রাষ্ট্রপ্রধান, শাসক, প্রশাসক বা প্রধানকে ধোকা দেওয়া বা রাষ্ট্রের ক্ষতিকর কিছু করা।

৫. রাষ্ট্র বা সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা সশস্ত্র বিদ্রোহ।

৬. অন্যায় দেখেও সাধ্যমতো প্রতিকার বা প্রতিবাদ না করা।

৭. রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের বাইরে থেকে মৃত্যুবরণ করা।

৮. রাষ্ট্র প্রশাসনের অন্যায় বা জুলুম সমর্থন বা সহযোগিতা করা।

৯. সমাজের মানুষদেরকে কবীরা গোনাহের কারণে কাফির বলা বা মনে করা।

১০. বিচারকের জন্য ন্যায় বিচারে একনিষ্ট না হওয়া বা বিচার্য বিষয়ের বাইরে কোনো কিছু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিচার করা।

১১. আইন প্রয়োগকারীর জন্য আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করা ও আপনজনদের জন্য হালকাভাবে শাস্তি প্রয়োগ করা।

১২. মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান বা প্রয়োজনের সময় সত্য সাক্ষ্য প্রদান থেকে বিরত থাকা।

১৩. রাষ্ট্রীয় সম্পদ অবৈধভাবে ভক্ষণ, দখল বা ভোগ করা, তা যত সামান্যই হোক।

১৪. মুনাফিককে নেতা বলা।

১৫. জিহাদের মাঠ থেকে পালিয়ে আসা।

১৬. মুসলিমগণকে কষ্ট প্রদান ও গালি দেওয়া।

১৭. জুলুম, যবরদস্তি, মিথ্যা মামলা বা অবৈধভাবে কোনো মানুষ থেকে কিছু গ্রহণ করা।

১৮. হাটবাজার, রাস্তাঘাটে টোল আদায় করা বা চাঁদাবাজী করা।

১৯. মুসলিম সমাজে বসবাসরত অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট প্রদান বা তার অধিকার নষ্ট। যে কোনো মানুষকে কষ্ট দেওয়াই কঠিন পাপ। তবে হাদীস শরীফে বিশেষ করে সমাজের দুর্বল শ্রেণীগুলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সাধারণ নির্দেশনা তো আছেই।

২০. কোনো মহিলা বা এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা। যে কোনো মানুষের সামান্যতম সম্পদ অবৈধভাবে গ্রহণ অন্যতম কবীর গোনাহ। তবে মহিলা ও এতিম যেহেতু দুর্বল এজন্য হাদীস শরীফে তাদের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে তাদের সম্পদ অবৈধ দখল বা

ভোগকারীর জন্য কঠিনতম শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

২১. আল্লাহর প্রিয় ধার্মিক বান্দাগণকে কষ্ট প্রদান বা তাদের সাথে শত্রুতা করা।

২২. প্রতিবেশীর কষ্ট প্রদান।

২৩. কোনো মাজলিসে এসে খালি জায়গা দেখে না বসে ঠেলাঠেলি করে অন্যদের কষ্ট দিয়ে মাজলিসের মাঝে এসে বসে পড়া বা এমনভাবে মাঝে বসা যাতে অন্য মানুষদের অসুবিধা হয়।

২৪. কারো স্ত্রী বা চাকর বাকর ফুসলিয়ে সরিয়ে দেওয়া।

২৫. কর্কশ ব্যবহার ও অশলীল- অশ্রাব্য কথা বলা।

২৬. অভিশাপ বা গালি দানে অভ্যস্ত হওয়া।

২৭. কোনো মুসলিমের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে কিছু অর্থলাভ করা।

২৮. তিন দিনের অধিক কোনো মুসলিমের সাথে কথাবার্তা বন্ধ রাখা।

২৯. মুসলিমগণের একে অপরকে ভালো না বাসা, বা তাদের মধ্যে ভালবাসার অভাব থাকা।

৩০. মুসলিমদের গোপন দোষ খোঁজা, জানা ও বলে দেওয়া।

৩১. নিজের জন্য যা পছন্দ করে অন্যের জন্য তা পছন্দ না করা।

৩২. কোনো ব্যক্তিকে তার বংশের বিষয়ে অপবাদ দেওয়া।

৩৩. পিতামাতার অবাধ্য হওয়া বা তাঁদের কষ্ট প্রদান করা।

৩৪. সুদ গ্রহণ করা, প্রদান করা, সুদ লেখা বা সুদের সাক্ষী হওয়া।

৩৫. ঘুষ গ্রহণ করা, প্রদান করা ও ঘুষ আদান প্রদানের মধ্যস্থতা করা।

৩৬. মিথ্যা শপথ করা।

৩৭. হীলা বিবাহ করা বা করানো।

৩৮. আমানতের খেয়ানত করা।

৩৯. কোনো মানুষের উপকার করে পরে খোটা দেওয়া।

৪০. মানুষের গোপন কথা শোনা বা জানার চেষ্টা করা।

৪১. স্ত্রীর জন্য স্বামীর অবাধ্য হওয়া।

৪২. স্বামীর জন্য স্ত্রীর টাকা বা সম্পদ তার ইচ্ছার বাইরে ভোগ বা দখল করা।

৪৩. চোগলখুরী করা বা একজন মানুষের কাছে অন্য মানুষের নিন্দামন্দ ও শত্রুতামূলক কথা বলে উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক নষ্ট করা।

৪৪. গীবত বা পরচর্চা করা। অর্থাৎ কারো অনুপস্থিতিতে তার মধ্যে বিরাজমান বাস্তব ও সত্য দোষগুলি উল্লেখ করা।

৪৫. অসত্য দোষারোপ করা। অর্থাৎ কারো মধ্যে যে দোষ বিরাজমান নেই অনুমানে বা লোকমুখে শুনে সেই তার সম্পর্কে সেই দোষের কথা উল্লেখ করা।

৪৬. জমির সীমানা পরিবর্তন করা।

৪৭. মহান সাহাবীগণকে গালি দেওয়া।

৪৮. আনসারগণকে গালি দেওয়া।

৪৯. পাপ বা বিভ্রান্তির দিকে বা খারাপ রীতির দিকে আহবান করা।

৫০. কারো প্রতি অস্ত্র জাতীয় কিছু উঠান বা হুমকি প্রদান।

৫১. নিজের পিতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলা।

৫২. জেদাজেদি ঝগড়া, বিতর্ক কলহ বা কোন্দল।

৫৩. ওজন, মাপ বা দ্রব্যে কম দেওয়া বা ভেজাল দেওয়া।

৫৪. কোনো উপকারীর উপকার অস্বীকার করা বা অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

৫৫. নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি অন্যকে প্রদান থেকে বিরত থাকা।

৫৬. কোনো প্রাণীর মুখে আগুণে পুড়িয়ে বা কেঁটে দাগ বা মার্কা দেওয়া।

৫৭. জুয়া খেলা।

৫৮. অবৈধ ঝগড়া বা গোলযোগে সহযোগিতা করা।

৫৯. কথাবার্তায় সংযত না হওয়া।

৬০. ওয়াদা ভঙ্গ করা।

৬১. উত্তরাধিকারীকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা।

৬২. স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক তাদের একান্ত গোপনীয় কথা অন্য কাউকে বলা।

৬৩. কারো বাড়ি বা ঘরের মধ্যে অনুমতি ছাড়া দৃষ্টি করা।

৬৪. কেউ আল্লাহর নামে শপথ করে সাহায্য বা ক্ষমা চাইলে আর তার প্রতি বিরক্ত থাকা অথবা তাকে ক্ষমা বা সাহায্য না করা।

৬৫. যা কিছু শোনা হয় বিচার বিশ্লেষণ ও সত্যাসত্য নির্ধারণ না করে তা বলা।

৬৬. বঞ্চিত ও দরিদ্রদেরকে খাদ্য প্রদানে ও সাহায্য দানে উৎসাহ না দেওয়া।

৬৭. ব্যভিচার, সমকামিতা বা যৌন অনাচার ও অশলীলতা।

৬৮. নিরপরাধ মানুষকে, বিশেষত মহিলাকে ৪ জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর স্পষ্ট সাক্ষ্য ছাড়া ব্যভিচার বা অনৈতিকতার অপবাদ দেওয়া।

৬৯. মুসলিম সমাজে অশলীলতা প্রসার করতে পারে এমন কোনো গল্পগুজব বা কথাবার্তা বলা বা প্রচার করা। এর মধ্যে সকল পর্নো গ্রাফি ছবি, অশ্লীল উপন্যাস ও গল্প অন্তভর্ক্তু। এগুলির প্রচার, বিক্রয়, আদান পদান সবই কবীরা গোনাহ।


উপরের সকল পাপই অত্যন্ত ক্ষতিকর। কুরআন ও হাদীসে এগুলির ভয়ঙ্কর শাস্তি ও খারাপ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোনো কোনো পাপ নেক আমলের ফলে আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন। আবার কোনো কোনো পাপ সকল নেক আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। এ সকল ইবাদত বিনষ্টকারী পাপের অন্যতম শিরক, কুফর, অহঙ্কার, হিংসা, অপরের অধিকার নষ্ট করা, গীবত করা ইত্যাদি।

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আল্লাহর পথে চলতে সচেষ্ট ও ধর্ম-সচেতন অনেক মানুষ অনেক সময় এসব ইবাদত বিধ্বংসী পাপের মধ্যে লিপ্ত হয়ে যান। অনেক সচেতন মুসলিম ব্যভিচার, মিথ্যা, মদপান, সালাত বা সিয়াম পরিত্যাগ ইত্যাদি পাপে কখনোই লিপ্ত হন না। কখনো এরূপ কিছু করলে সকাতরে তাওবা-ইসতিগফার করতে থাকেন। কিন্তু জেনে অথবা না জেনে তাঁরা শির্ক, কুফর, বিদ‘আত, হিংসা, অহঙ্কার, লোভ, আত্মতুষ্টি, গীবত ইত্যাদি পাপের মধ্যে লিপ্ত হচ্ছেন।

এর কারণ, কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই শয়তান কখনো নিরাশ হয় না। প্রত্যেক মানুষকেই কোনো না কোনোভাবে বিভ্রান্ত করতে ও পাপে লিপ্ত করতে সে সদা সচেষ্ট। সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য তার নিজস্ব পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচী রয়েছে। সবাইকেই সে পরিপূর্ণ ধর্মহীন অবিশ্বাসী করতে চায়। যাদের ক্ষেত্রে সে তা করতে সক্ষম না হয় তাদেরকে সে ‘ধর্মের আবরণে’ পাপের মধ্যে লিপ্ত করে। অথবা বিভিন্ন প্রকার ‘অন্তরের পাপে’ লিপ্ত করে, যেগুলি নেককার মানুষের নেক-আমল নষ্ট করে দেয়, অথচ সেগুলিকে অনুধাবন করা অনেক সময় ধার্মিক মানুষের জন্যও কষ্টকর হয়ে যায়। আমরা এখানে এ জাতীয় কিছু পাপের কথা আলোচনা করতে চাই।


(১) শিরক

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা থেকে আমরা জানতে পারি যে, কিছু কর্ম আছে যা আমাদের অর্জিত পুণ্য, সাওয়াব ও সকল নেক কর্ম ধ্বংস করে দেয়। এ ধরনের কর্ম থেকে বিরত হতে না পারলে আমাদের যিকর-আযকার সবই ব্যর্থ হবে। এ সকল পাপের অন্যতম শিরক। শিরক মানব জীবনের ভয়ঙ্করতম পাপ। শিরক অর্থ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা। আল্লাহর কর্মে বা তাঁর গুণাবলীতে বা ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্য কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার বলে মনে করাই শিরক।

শিরকের ব্যাখ্যা ও বিবরণ প্রদান এখানে সম্ভব নয়। প্রত্যেক মুমিনের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব শিরক সম্পর্কে বিস্তারিত জানা এবং তা থেকে আত্মরক্ষা করা। এখানে সামান্য কিছু আলোচনা করা অতীব প্রয়োজনীয় মনে করছি।

কুরআন কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে: “তাদের (মানুষদের) অধিকাংশ আল্লাহে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর সাথে শরীক করে।”[1] এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, বিশ্বাসী ও ধার্মিক মানুষই শির্ক করে। আর যেনতেন কোনো সৃষ্টিকে সে আল্লাহ সাথে শরীক করে না, বরং আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক আছে মনে করেই কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহর সাথে সে শরীক করে। শিরকের মূল নবী, ওলী, ফিরিশতা, জিন বা প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে ‘ঐশবরিক ক্ষমতা’ বা ‘আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্ক’ কল্পনা করা। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তার কাছে বা তার মুর্তি, সমাধি বা স্মৃতি বিজড়িত স্থানে তার সাহায্য-সহানুভুতি কামনা করে প্রার্থনা, উৎসর্গ ইত্যাদি কর্ম সম্পাদন করা।


আল্লাহর কর্ম ও গুণাবলীতে শিরক করা

এই বিশ্বের স্রষ্টা ও পরিচালক একমাত্র আল্লাহ। অন্য কোনো সৃষ্টি, প্রাণী, মানুষ, নবী, ওলী, ফিরিশতা বা কোনো কিছু সৃষ্টি, পরিচালনা, অদৃশ্য জ্ঞান, অদৃশ্য সাহায্য, রিযিক দান, জীবন দান, সুস্থতা বা রোগব্যধি দান, বৃষ্টি দান, বরকত দান, অনাবৃষ্টি প্রদান, অমঙ্গল প্রদান ইত্যাদি কোনো প্রকার কল্যাণ বা অকল্যাণের কোনো ক্ষমতা রাখেন বা আল্লাহ কাউকে অনুরূপ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন বলে বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ ফিরিশতাদেরকে অনেক বিষয়ের দায়িত্ব প্রদান করেছেন, কিন্তু ক্ষমতা প্রদান করেন নি। ফিরিশতা ছাড়া কোনো নবী, ওলী বা কাউকে কোনোরূপ দায়িত্ব বা ক্ষমতা কিছুই প্রদান করেন নি। আল্লাহ কাউকে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেছেন বলে বিশ্বাস করা শিরক।

এই জাতীয় একটি অতি প্রচলিত শিরক অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা। কোনো বস্ত, প্রাণী, কর্ম, বার, তিথি, মাস ইত্যাদিকে অশুভ, অমঙ্গল বা অযাত্রা বলে মনে করা স্পষ্ট শিরক। আমাদের দেশে অনেক মুসলিমও ‘কী করলে কী হয়’ জাতীয় অনেক বিষয় লিখেন বা বিশ্বাস করেন। এগুলি সবই শিরক। জন্মদিনে নখ বা চুল কাটা, ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখা, রাতে নখ কাটা, পিছন থেকে ডাকা, কাক ডাকা ইত্যাদি অগণিত বিষয়কে অমঙ্গল বা অশুভ মনে করা হয়, যা নিতান্তই কুসংস্কার, মিথ্যা ও শিরকী বিশ্বাস। পাপে অমঙ্গল ও পুণ্যে কল্যাণ; এছাড়া অমঙ্গল বা অশুভ বলে কিছুই নেই।


আল্লাহর ইবাদতে শিরক করা

ইবাদত অর্থ উপাসনা, পূজা বা আরাধনা। সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর পাওনা। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, “আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই”ইসলামের ভিত্তি ও মুমিনের অন্যতম যিকর। দুঃখজনক বিষয়, প্রতিদিন কয়েক হাজার বার “আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বদু নেই” যিকর করেও অনেক যাকির আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর ইবাদত, পূজা, উপাসনা বা আরাধনা করে থাকেন। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট প্রার্থনা বিষয়ক আলোচনায় কিছু কথা উল্লেখ করেছি। সাজদা করা, দু‘আ করা, মানত করা, কুরবানী বা উৎসর্গ (sacrifice) করা এগুলি সবই ইবাদত। আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য জীবিত বা মৃত, বিমূর্ত, মূর্ত, প্রস্তরায়িত বা সমাধিস্থ, নবী, ওলী, ফিরিশতা বা যে কোনো নামে বা প্রকারে কারো জন্য এগুলি করা হলে তা শিরক হবে। এছাড়া মূর্তিতে ফুলদান, মূর্তির সামনে নীবরে বিনয়ে দাঁড়ানো ইত্যাদি কর্মও এই পর্যায়ের।


শিরক মানব জীবনের কঠিনতম পাপ। অন্যান্য পাপের সাথে এর মৌলিক পার্থক্য তিনটি: (১). শিরক ও কুফর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও কঠিনতম পাপ, এর উপরে কোনো পাপ নেই। (২). অন্যান্য সকল পাপ আল্লাহ বিভিন্ন নেক কর্মের কারণে বা দয়া করে তাওবাসহ বা তাওবা ছাড়া ক্ষমা করতে পারেন, কিন্তু শিরক-কুফরী পরিত্যাগ করে তাওবা না করলে আল্লাহ কখনোই ক্ষমা করেন না। (৩). শিরক ও কুফরীর কারণে অন্য সকল নেক কর্ম বিনষ্ট হয়।

কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ কুরআন করীমে ইরশাদ করেছেনঃ “তোমার কাছে এবং তোমার পূর্বের নবী-রাসূলগণের কাছে এই মর্মে ওহী প্রেরণ করা হয়েছে যে, যদি তুমি শিরক কর তবে তোমার সকল কর্ম বিনষ্ট হবে এবং তুমি অবশ্যই ধ্বংসগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”[2]

[1] সূরা ইউসুফঃ ১০৬।

[2] সূরা যুমারঃ ৬৫।
ঘ. আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ - (২) কুফর বা অবিশ্বাস

(২) কুফর বা অবিশ্বাস

কুফর অর্থ অবিশ্বাস বা অস্বীকার করা। আল্লাহ, তাঁর রাসূল বা তাঁর দ্বীনের মৌলিক কোনো বিষয় অস্বীকার করা, অবিশ্বাস করা, অবজ্ঞা করা বা অপছনদ করা কুফরী। আমাদের মুসলিম সমাজের প্রচলিত কুফরীর মধ্যে অন্যতম আল্লাহর বিভিন্ন বিধান, যেমন - সালাত, পর্দা, বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি, ইসলামী আইন ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ বা এগুলিকে বর্তমানে অচল মনে করা। ইসলামকে শুধুমাত্র ব্যক্তি জীবনে পালন করতে হবে এবং সমাজ, বিচার, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসলাম চলবে না বলে মনে করা, ইসলামের কোনো বিধান বা রাসূলুল্লাহর (সা.) কোনো সুন্নাতের প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণা প্রকাশ করা, ওয়ায, মাহফিল, যিকর, তিলাওয়াত, সালাত, মাদ্রাসা, মসজিদ, বোরকা, পর্দা ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণা অনুভব করা, রাসূলুল্লাহ (সা.) বা পূর্ববর্তী অন্য কোনো নবী-রাসূলের প্রতি সামান্যতম অবজ্ঞা প্রকাশ করা, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সর্বশেষ নবী হওয়ার বিষয়ে সামান্যতম সন্দেহ পোষণ করা, তাঁর পরে কারো কাছে কোনো প্রকার ওহী এসেছে বলে বিশ্বাস করা ইত্যাদি সবই কুফরী।


সুস্পষ্ট কুফরীর প্রতি সন্তুষ্ট থাকাও কুফরী। তাওহীদ বা রিসালাত অস্বীকার করে, মুহাম্মাদ (সা.)-এর পরে কোনো ওহী নাযিল হতে পারে বা কোনো নবী আসতে পারে বলে বিশ্বাস করে এমন ব্যক্তির বিশ্বাসের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করা, তাকে মুসলিম মনে করা বা তার বিশ্বাসও সঠিক বলে মনে করা কুফরী। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মকে পারলৌকিক মুক্তির মাধ্যম বলে মনে করা, অন্যান্য ধর্মের শিরক বা কুফরীমূলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা, সেগুলির প্রতি মনের মধ্যে ঘৃণাবোধ না থাকা, তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অনুকরণ করা, ক্রিসমাস (বড়দিন), পূজা ইত্যাদিতে আনন্দ করা বা উদ্যাপন করা ইত্যাদি বর্তমান যুগে অতি প্রচলিত কুফরী কর্ম ও বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত।


গণক, জ্যোতিষী, রাশি, হাত, জটা ফকির ইত্যাদি সকল প্রকার ভাগ্য, গোপন বিষয় বা ভবিষ্যৎ গণনা করা, অথবা এসকল মানুষের কথায় বিশ্বাস করা কুফরী। এরূপ কোনো কোনো কর্ম ইসলামের নামেও করা হয়। যেমন, ‘এলেম দ্বারা চোর ধরা’ ইত্যাদি। যে নামে বা যে পদ্ধতিতেই করা হোক গোপন তথ্য, গায়েব, অদৃশ্য, ভবিষ্যৎ বা ভাগ্য গণনা বা বলা জাতীয় সকল কর্মই আরবী (কাহানা)-র অন্তর্ভুক্ত ও কুফরী কর্ম।

শিরকের ন্যায় কুফরীও মানুষের জীবনের সকল কর্ম বিনষ্ট করে দেয়। এবিষয়েও অগণিত আয়াত ও হাদীস রয়েছে। কুরআন কারীমে বলা হয়েছেঃ “আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে কুফরী (অবিশ্বাস) করবে, তার কর্ম বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং আখেরাতে সে ক্ষতিগ্র্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।[1]

[1] সূরা মায়িদাঃ ৫।
ঘ. আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ - (৩) বিদ‘আত বা ধর্মের মধ্যে নব উদ্ভাবন

যে কর্ম, বিশ্বাস, রীতি বা আচার রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ ধর্মীয় কর্ম হিসাবে, সাওয়াব, আল্লাহর নৈকট্য বা ইবাদত হিসাবে পালন করেননি, এরূপ কোনো কর্ম, বিশ্বাস, রীতি বা আচারকে ধর্মের অংশ বা সাওয়াবের কর্ম বলে মনে করা বিদ‘আত। বিদ‘আতে লিপ্ত ব্যক্তির ইবাদত, বন্দেগি আল্লাহ কবুল করবেন না বলে বিভিন্ন হাদীসে বারংবার বলা হয়েছে। শিরকের ন্যায় বিদ‘আতের পাপেও ধার্মিক মানুষেরাই লিপ্ত হন। ধার্মিক মানুষদেরকে পাপে লিপ্ত করার জন্য শয়তানের অন্যতম মাধ্যম বিদ‘আত। এই পুস্তকের বিভিন্ন স্থানে সুন্নাত, সুন্নাতের অনুসরণ, সুন্নাতের খেলাফ চলা, উদ্ভাবন ও বিদ‘আত সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে আমি “এহ্ইয়াউস সুনান” গ্রন্থে বিস্তারিত লিখেছি। এজন্য এখানে এ বিষয়ে আলোচনা পরিত্যাগ করছি।

ঘ. আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ - (৪) অহঙ্কার বা তাকাব্বুর

নিজেকে অন্য কোনো মানুষ থেকে কোনো দিক থেকে উন্নত, ভালো, উত্তম বা বড় মনে করা, অথবা কাউকে কোনোভাবে নিজের চেয়ে হেয় মনে করাই কিবর, তাকাব্বুর বা অহঙ্কার। এটি মূলত একটি মানসিক অনুভূতি, তবে কর্মের মধ্যে অনেকসময় তার কিছু প্রভাব থাকে। অহঙ্কার একমাত্র মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহর অধিকার। কোনো মানুষের অহঙ্কার করাটা মূলত আল্লাহর অধিকারে হস্তক্ষেপ। কারণ, অহঙ্কারের বিষয় সর্বদা আল্লাহর নিয়ামতেই হয়।

পৃথিবীর সকল নিয়ামত আল্লাহ সবাইকে সমানভাবে প্রদান করেন না। কাউকে দেন, কাউকে দেন না অথবা কমবেশি প্রদান করেন। যিনি নিয়ামত পেয়েছেন তার দায়িত্ব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কিন্তু যদি তিনি এই নিয়ামতকে আল্লাহর দয়ার দান বা ভিক্ষা হিসাবে গ্রহণ না করে নিজের নিজস্ব উপার্জন ও সম্পদ মনে করেন তখনই অহঙ্কারের শুরু হয়। এতে প্রথমেই আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।

পাঠক হয়ত প্রশ্ন করবেন - বাস্তবে আমরা দুনিয়াতে বড় ছোট রয়েছি। কাজেই তা অস্বীকার করব কিভাবে? কেউ বেশি জ্ঞানী, ডিগ্রিধারী, সম্পদশালী, শক্তিশালী, ... কেউ কম। কাজেই যার বেশি আছে তিনি কিভাবে যার কম আছে তাকে সমান ভাববেন? বিষয়টি এখানে নয়। আপনার জ্ঞান, সম্পদ, সৌন্দর্য, প্রভাব, শক্তি, বাকপটুতা, ডিগ্রি, পদমর্যাদা, ইত্যাদি হয়ত আপনার আরেক ভাই থেকে বেশি। এখন প্রশ্ন, আপনার নিকট যে সম্পদটি বেশি আছে তা আপনার নিজস্ব উপার্জন না আল্লাহর দয়ার দান? যদি আল্লাহর দয়ার দান বলে আপনি বিশ্বাস করেন তাহলে আপনি কখনই নিজেকে তার চেয়ে বড় বলে বা তাকে আপনার চেয়ে হেয় বলে ভাবতে পারবেন না। আপনি ভাববেন - আল্লাহর কত দয়া! আমাকে দয়া করে এই নিয়ামতটি দিয়েছেন অথচ তাকে দেননি। ইচ্ছা করলে তিনি এর উল্টো করতে পারতেন। একান্ত দয়া করেই তিনি আমাকে নিয়ামত দিয়েছেন। আমার কাজ, বেশি বেশি শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে নিয়ামতের স্থায়িত্বের জন্য আল্লাহর দরবারে আকুতি জানানো। এই অনুভূতি মুমিনের। অনুভূতি থাকলে কোনো মানুষ নিজেকে কারো চেয়ে বড় ভাবতে পারে না। বড়জোর নিজেকে ‘বেশি নিয়ামতপ্রাপ্ত’ বা ‘বেশি দয়াপ্রাপ্ত’ বলে মনে করতে পারে। এই মানুষটি কখনোই অন্য কাউকে তার চেয়ে হেয় বলে অবজ্ঞা করার কথা চিন্তা করে না। সে কখনো আল্লাহর দয়ার দানকে নিয়ে মনের মধ্যে গোপনে বা মুখে প্রকাশ্যে বড়াই করতে পারে না।


অহঙ্কার ও মুমিনের কৃতজ্ঞতার অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য দেখুন। আপনি একজন মানুষকে দেখলেন সে কথাবার্তায়, ভদ্রতায়, ডিগ্রিতে, অর্থে, শিক্ষায়, সৌন্দর্যে বা অন্য কোনো দিক থেকে আপনার চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থানে রয়েছেন। তাকে দেখে আপনার মনে বা অনেকের মনে হাসি, অবজ্ঞা বা উপহাস উৎপন্ন হচ্ছে। অথচ আপনাকে দেখে আপনার মনে বা অন্যদের মনে ভক্তি ও শ্রদ্ধা বোধ জাগছে। আপনি কি করবেন? অবজ্ঞা ও অবহেলা ভরে তার দিকে তাকাবেন? - এটিই তো অহঙ্কার। আপনি আল্লাহর দেয়া সকল নিয়ামতকে অস্বীকার করে আল্লাহর সাথে অবিশ্বাসীর মতো ব্যবহার করলেন।

মুমিনের মনে এই পরিস্থিতিতে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যাবে। অপরদিকে ঐ ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ একটুও কমবে না। তিনিও আমার মতোই আল্লাহর বান্দা। তাকে আল্লাহ যতটুকু দিয়েছেন তা নিয়েই তিনি রয়েছেন। তাকে সম্মান করতে হবে। তার জন্য দু‘আ করতে হবে। কোনো অবস্থায় তার প্রতি অবজ্ঞার প্রশ্নই আসে না।


সবচেয়ে বড় কথা, আমি তো জানি না, এই কমজ্ঞানী, অভদ্র, দুর্বল বা অবজ্ঞাপ্রাপ্ত মানুষটি আল্লাহর কাছে কতটুকু প্রিয়। আমি জানি না, কিয়ামতের দিন আমার অবস্থা কী হবে আর তার অবস্থা কী হবে। হয়ত এই অবহেলিত দুর্বল মানুষটি কিয়ামতের দিন আল্লাহর রহমত বেশি লাভ করবে। হয়ত আমার চেয়ে অনেক সম্মান প্রাপ্ত হবে। হয়ত আমাকে আল্লাহর নিয়ামতের অকৃতজ্ঞতার অপরাধে ধরা পড়তে হবে। তাহলে আমার জন্য অহঙ্কারের সুযোগটা কোথায় ?

অহঙ্কার সকল ক্ষেত্রেই ধবংসাত্মক অনুভূতি। তবে তা যদি আল্লাহর ইবাদত কেনিদ্রক হয় তাহলে তা আরো বেশি ক্ষতিকারক। নিজেকে ভালো দ্বীনদার মনে করা শয়তানের অন্যতম চক্রান্ত। সাথে সাথে যদি নিজেকে অন্য কোনো মুসলমানের চেয়ে বেশি দ্বীনদার মনে করা হয় তাহলে ধ্বংসের ষোলকলা পূর্ণ হয়।


পাঠক হয়ত আবারো প্রশ্ন করবেন, ধর্ম পালনে তো কম-বেশি আছেই। আমি দাড়ি রেখেছি, আরেকজন রাখেনি। আমি যিকর করি অথচ সে করে না। আমি বিদ‘আতমুক্ত, অথচ অমুক বিদ‘আতে জড়িত। আমি সুন্নাত পালন করি কিন্তু অমুক করে না। আমি ইসলামের দাওয়াত, প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছি অথচ আমার আরেক ভাই শুধুমাত্র সালাত-সিয়াম পালন করেই আরামে সংসার করছেন। এখন কি আমি ভাবব যে, আমি ও সে সমান বা আমি তার চেয়ে খারাপ? তাহলে আমার এত কষ্টের প্রয়োজন কি ?


প্রিয় পাঠক, বিষয়টি আবারো ভুল খাতে চলে গেছে। প্রথমত, আমি যা কিছু করেছি সবই আল্লাহর দয়া, রহমত ও তাওফীক হিসাবে তাঁর দরবারে শুকরিয়া জানাতে হবে এবং এই নিয়ামতের স্থায়িত্বের জন্য সকাতরে দু‘আ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে ভাই এ সকল নিয়ামত পাননি তার জন্য আন্তরিকতার সাথে দু‘আ করতে হবে, যেন আল্লাহ তাকেও এ সকল নিয়ামত প্রদান করেন এবং আমরা একত্রে আল্লাহর জান্নাতে ও রহমতের মধ্যে থাকতে পারি। তৃতীয়ত, আমাকে খুব বেশি করে বুঝতে হবে যে, আমি যা কিছু করছি তা আমার প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের তুলনায় খুবই কম। আমি কখনোই আল্লহর দেয়া দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারিনি। কাজেই, আমার তৃপ্ত হওয়ার মতো কিছুই নেই। চতুর্থত, আমাকে বারবার সজাগ হতে হবে যে, আমি জানি না আমার ইবাদত আল্লাহর দরবারে গ্রহণ হচ্ছে কি না? হয়ত আমার এ সকল ইবাদত বিভিন্ন ভুল ও অন্যায়ের কারণে কবুল হচ্ছে না, অথচ যাকে আমি আমার চেয়ে ছোট ভাবছি তার অল্প আমলই আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন, কাজেই কিভাবে আমি নিজেকে বড় ভাবব? পঞ্চমত, আমি জানি না, আমার কী পরিণতি ও তার কী পরিণতি? হয়ত মৃত্যুর আগে সে আমার চেয়ে ভালো কাজ করে আমার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদা নিয়ে আল্লাহ দরবারে হাজিরা দেবে।


মুহতারাম পাঠক, কিয়ামতের হিসাব নিকাশ শেষে জান্নাতে প্রবেশের আগে কখনো কোনো মুমিন নিশ্চিত হতে পারে না, নিজেকে অন্য কারো চেয়ে উত্তম বা বেশি ধার্মিক ভাবা তো দূরের কথা! সাহাবী, তাবেয়ীগণ ও পূর্ববর্তী যুগের শ্রেষ্ঠতম বুজুর্গ ও নেককার মানুষেরা নিজেদেরেকে জীবজানোয়ারের চেয়ে উত্তম ভাবতে পারতেন না। তাঁরা বলতেন, কিয়ামতের বিচার পার হওয়ার পরেই বুঝতে পারব, আমি জানোয়ারের অধম না তাদের চেয়ে উত্তম। অহঙ্কার আমাদের নেক কর্ম বিনষ্ট করে দেয়। যার অন্তরে অহঙ্কার থাকবে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে। ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) বলেন, নবীজী (সা.) বলেছেনঃ

لا يدخل الجنة من كان في قلبه مثقال ذرة من كبر


“যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”[1]


সুপ্রিয় পাঠক, অহঙ্কার অন্তরের কর্ম হওয়ার কারণে আমরা সহজে তা ধরতে পারি না। আমরা মনে করি যে, আমার মধ্যে অহঙ্কার নেই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমার মধ্যে অহঙ্কার বিদ্যমান। বিভিন্নভাবে তা যাচাই করা যায়। অতি সাধারণ পোশাক পরিহিত অবস্থায় মানুষের মধ্যে বেরোতে কি আপনার লজ্জা বোধ হয়? এরূপ পোশাক পরিহিত অবস্থায় যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আপনাকে দেখে ফেলেন তবে কি খুব সংকোচ বোধ হয়? যদি হয় তবে বুঝতে হবে যে, মনের মধ্যে অহঙ্কার বিদ্যমান।


কোনো সমাবেশ বা মাজলিসে পিছনে বা নিচে বসতে হলে কি আপনার খারাপ লাগে? মনের মধ্যে কি আশা হয় যে, কেউ আপনাকে ডেকে সম্মান করুক, আগে সালাম দিক? যদি হয় তবে বুঝবেন যে, অহঙ্কার অন্তরে লুকিয়ে রয়েছে।

অন্তরের মধ্যে অহঙ্কারের অনুপ্রবেশ রোধের জন্য মুমিনকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু হানযালা বলেন, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম মাথায় এক বোঝা খড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে বলা হলো, আপনি কেন এ কাজ করছেন? আল্লাহ তো আপনাকে সচ্চলতা দিয়েছেন, যাতে এমন না করলেও আপনার চলে? তিনি বলেন, আমি অন্তরের অহঙ্কার ও অহংবোধকে আহত করতে চাচিছ। আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যার অন্তরে শরিষা পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” হাদীসটি হাসান।[2]

[1] সহীহ মুসলিম, ১/৯৩, নং ৯১।

[2] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৪৭০, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৯৯।
ঘ. আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ - (৫) হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা

অহঙ্কারের পাশাপশি মানব হৃদয়ে সবচেয়ে নোংরা ও ক্ষতিকারক কর্ম হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অমঙ্গল কামনা, পারস্পারিক শত্রুতা, ইত্যাদি। হৃদয়ে এগুলির উপস্থিতি হৃদয়কে কলুষিত করে, ভারাক্রান্ত করে, আল্লাহর যিকর থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সর্বোপরি অন্যান্য নেক আমল নষ্ট করে দেয়। হাদীসের আলোকে মুসলমান মুসলমানে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতার দুটি ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা জানতে পারি।

প্রথমত, আল্লাহর বিশেষ ক্ষমা লাভ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

تعرض أعمال الناس فى كل جمعة مرتين يوم الاثنين ويوم الخميس فيغفر لكل عبد مؤمن إلا عبدا بينه وبين أخيه شخناء فيقال اتركوا أو اركعوا هذين حتي يفيئ


“প্রতি সপ্তাহে দুইবার - সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দাদের কর্ম (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। তখন সকল মুমিন বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, শুধুমাত্র ঐ ব্যক্তি বাদে যার ও তার অন্য ভাইয়ের মধ্যে বিদ্বেষ ও শত্রুতা (hatred) আছে। এদের বিষয়ে বলা হয়, এদের বিষয় স্থগিত রাখ, যতক্ষণ না এরা ফিরে আসে।”[1]

অন্য হাদীসে মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

يطلع الله إلي جميع خلقه ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن (لأخيه)


“শা’বান মাসের মধ্যবর্তী রাত্রে (১৪ই শা’বানের দিবাগত রাত্রে) আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং তাঁর সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, শুধুমাত্র শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি এবং যে ব্যক্তির সাথে অন্য ভাইয়ের বিদ্বেষ (hatred) রয়েছে তাদেরকে বাদে।” হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বিভিন্ন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি সনদ হাসান বা গ্রহণযোগ্য। সার্বিকভাবে হাদীসটি সহীহ।[2]

দ্বিতীয়ত, সকল নেক কর্ম ও ধর্ম ধ্বংস করে দেয়। যুবাইর ইবুনল আউআম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

دب إليكم داء الأمم الحسد والبغضاء هى الحالقة لا أقول تحلق الشعر ولكن تحلق الدين والذى نفسي بيده لا تدخلوا الجنة حتي حتي تؤمنوا حتي تحابوا أفلا أنبئكم بما يثبت ذاكم لكم أفشوا السلام بينكم


“পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির ব্যাধি তোমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে : হিংসা ও বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ মুন্ডন করে দেয়। আমি বলি না যে তা চুল মুন্ডন করে, বরং তা দ্বীন বা ধর্মকে মুন্ডন ও ধ্বংস করে দেয়। আমার প্রাণ যাঁর হাতে তাঁর শপথ করে বলছি, বিশ্বাসী না হলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর পরস্পরে একে অপরকে ভালো না বাসলে তোমরা বিশ্বাসী বা মুমিন হতে পারবে না। এই ভালবাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম আমি শিখিয়ে দিচ্ছি, সর্বত্র ও সবর্দা পরস্পরে সালাম প্রদানের রেওয়াজ প্রচলিত রাখবে।” হাদীসটি গ্রহণযোগ্য।[3]

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে যয়ীফ সনদে বর্ণিত অন্য হাদীসে বলা হয়েছে:

إياكم والحسد فإن الحسد يأكل الحسنات كما تأكل النار الحطب أو قال العشب


“খবরদার! হিংসা থেকে আত্মরক্ষা করবে; কারণ হিংসা এমনভাবে নেককর্ম ধ্বংস করে ফেলে, যেমনভাবে আগুন খড়ি বা খড়কুটো পুড়িয়ে ফেলে।” হাদীসটির সনদে দুর্বলতা আছে, তবে উপরের হাদীসের অর্থ তা সমর্থন করে।[4]


অন্যায়ের ঘৃণা করা বনাম হিংসা ও অহংকার

আরেকটি বিষয় আমাদেরকে সমস্যায় ফেলে দেয়। আমরা জানি যে, শিরক, কুফর, বিদ‘আত, হারাম, পাপ ইত্যাদিকে ঘৃণা করা ও যারা এগুলিতে লিপ্ত বা এগুলির প্রচার প্রসারে লিপ্ত তাদেরকে ঘৃণা করা আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ঈমানী দায়িত্ব। আমরা এই দায়িত্ব ও হৃদয়কে মুক্ত রাখার মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সাধন করব?

এই বিষয়টিকে শয়তান অন্যতম ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করে, যা দিয়ে সে অগণিত ধার্মিক মুসলিমকে হিংসা, হানাহানি, আত্মতৃপ্তি ও অহংকারের মত জঘন্যতম কবীরা গোনাহের মধ্যে নিপতিত করছে। এই ফাঁদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলি স্মরণ রাখতে হবে।

প্রথমত, পাপ অন্যায়, জুলুম অত্যাচার, শিরক, কুফর, বিদ‘আত বা নিফাককে অপছন্দ বা ঘৃণা করতে হবে রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর অনুসরণে ও তাঁর প্রদত্ত গুরুত্ব অনুসারে। তিনি যে পাপকে যতটুকু ঘৃণা করেছেন, নিন্দা করেছেন বা যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন ততটুকু গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর পদ্ধতি বা সুন্নাতের বাইরে মনগড়াভাবে ঘৃণা করলে তা হবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইসলামের নামে নিজের ব্যক্তি আক্রোশ বা অহংকারকে প্রতিষ্ঠা করা ও শয়তানের আনুগত্য করা।

এক্ষেত্রে বর্তমানে অধিকাংশ ধার্মিক মানুষ কঠিন ভুলের মধ্যে নিপতিত হন। কুরআন ও সুন্নাহে বর্ণিত কঠিন পাপগুলিকে আমরা ঘৃণা করি না বা বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করি না, কিন্তু যেগুলি কোন পাপ নয়, কম ভয়ঙ্কর পাপ বা যেগুলির বিষয়ে কুরআন- হাদীসে স্পষ্ট নির্দেশ না থাকায় আলিমগণ মতভেদ করেছেন সেগুলি নিয়ে হিংসা-বিদ্বেষে নিপতিত হই। ইতঃপূর্বে আমি ইসলামের কর্মগুলির পর্যায় আলোচনা করেছি। আমাদের সমাজের ধার্মিক মুসলিমদের দলাদলি, গীবতনিন্দা ও অহঙ্কারের ভিত্তি শেষ দুইতিন পর্যায়ের সুন্নাত-নফল ইবাদত। আমরা কুফর, শিরক, হারাম উপার্জন, মানুষের ক্ষতি, সৃষ্টির অধিকার নষ্ট, ফরয ইবাদত ত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোন আলোচনা, আপত্তি, বিরোধিতা বা ঘৃণা করি না। অথচ নফল নিয়ে কি ভয়ঙ্কর হিংসা ঘৃণার সয়লাব। অনেক সময় এসকল নফল, ইখতিলাফী বিষয়, অথবা মনগড়া কিছু ‘আকীদা’কে ঈমানের মানদন্ড বানিয়ে ফেলি।

ফরয সালাত যে মোটে পড়ে না, তার বিষয়ে আমরা বেশি চিন্তা করি না, কিন্তু যে সুন্নাত সালাত আদায় করল না, বা সালাতের মধ্যে টুপি বা পাগড়ী পরল না, অথবা সালাতের শেষে মুনাজাত করল বা করল না, অথবা সালাতের মধ্যে হাত উঠালো বা উঠালো না ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমরা হানাহানি ও অহঙ্কারে লিপ্ত রয়েছি।


দ্বিতীয়ত, এই ঘৃণা একান্তই আদর্শিক ও ঈমানী। ব্যক্তিগত জেদাজেদি, আক্রোশ বা শত্রুতার পর্যায়ে যাবে না। আমি পাপটিকে ঘৃণা করি। পাপে লিপ্ত মানুষটিকে আমি খারাপে লিপ্ত বলে জানি। আমি তার জন্য দু‘আ করি যে, আল্লাহ তাকে পাপ পরিত্যাগের তাওফীক দিন।


তৃতীয়ত, ঘৃণা অর্থ হিংসা নয়। ভালবাসার সাথে এই ঘৃণা একত্রিত থাকে। মা তার মলমূত্র জড়ানো শিশুকে দেখে নাক সিটকায় ও তাকে ঘৃণা করে। আপন ভাই তার অপরাধে লিপ্ত ভাইকে ঘৃণা করে। কিন্তু এই ঘৃণার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে ভালবাসা। মূলত ব্যক্তি শিশু বা ব্যক্তি ভাইকে ঘিরে থাকে তার সীমাহীন ভালবাসা, আর তার গায়ে জড়ানো ময়লা বা অপরাধকে ঘিরে থাকে ঘৃণা। সাথে থাকে তাকে ঘৃণিত বিষয় থেকে মুক্ত করার আকুতি। মুমিনের পাপের প্রতি ঘৃণাও অনুরূপ। পাপের প্রতি ঘৃণা যেমন দায়িত্ব ঈমানের প্রতি ভালবাসাও অনুরূপ দায়িত্ব। মুমিনের পাপের দিকে নয়, বরং তার ঈমানের দিকে আগে দৃষ্টি দিতে হবে। ঈমান ও অন্যান্য নেক আমলের জন্য মুমিনকে ভালবাসা ফরয। পাশাপাশি পাপের প্রতি আমাদের ঘৃণা থাকবে, এই ঘৃণা কখনোই মুমিনকে হিংসা করতে শেখায় না, বরং মুমিন ভাইয়ের জন্য দরদভর দু‘আ করতে প্রেরণা দেয়, যেন তিনি পাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন।


চতুর্থত, ঘৃণা ও অহংকার এক নয়। আমি পাপকে ঘৃণা করি। পাপীকে অন্যায়কারী মনে করি। পাপের প্রসারে লিপ্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা করি। কিন্তু এগুলির অর্থ এই নয় যে, আমি আমার নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে অমুক পাপীর চেয়ে উন্নত, মুত্তাকী বা ভাল মনে করি। নিজেকে কারো চেয়ে ভাল মনে করা তো দূরের কথা নিজের কাজে তৃপ্ত হওয়াও কঠিন কবীরা গোনাহ ও ধ্বংসের কারণ। আমি জানি না, আমার ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হচেছ কিনা, আমি জানি না আমার পরিণতি কী আর উক্ত পাপীর পরিণতি কী, কিভাবে আমি নিজেকে অন্যের চেয়ে ভাল মনে করব?


পঞ্চমত, সবচেয়ে বড় কথা, মুমিনকে নিজের গোনাহের চিন্তায় ও আল্লাহর যিকরে ব্যস্ত থাকতে হবে। অন্যের কথা চিন্তা করা থেকে যথা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। আমরা অধিকাংশ সময় অন্যের শিরক, কুফর, বিদ‘আত, পাপ, অন্যায় ইত্যাদির চিন্তায় ব্যস্ত থাকি। মনে হয় আমাদের বেলায়াত, কামালাত, জান্নাত, নাজাত সবকিছু নিশ্চিত। এখন শুধু দুনিয়ার মানুষের সমালোচনা করাই আমার একমাত্র কাজ।

বাঁচতে হলে এগুলি পরিহার করতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া পাপ বা পাপীর চিন্তায় নিজের হৃদয়কে ব্যস্ত রাখা খুবই অন্যায়। এই চিন্তা আমাদের কঠিন ও আখেরাত বিধ্বংসী পাপের মধ্যে ফেলে দেয়। এ আত্মতৃপ্তি ও অহঙ্কার। যখনই আমি পাপীর চিন্তা করি তখনই আমার মনে তৃপ্তি চলে আসে, আমি তো তার চেয়ে ভাল আছি। তখন নিজের পাপ ছোট মনে হয় ও নিজের কর্মে তৃপ্তি লাগে। আর এই ধ্বংসের অন্যতম পথ।এজন্য সাধ্যমত সর্বদা নিজের দ্বীনী বা দুনিয়াবী প্রয়োজন বা আল্লাহর যিকর ও নিজের পাপের চিন্তায় নিজেকে রত রাখুন। হৃদয় পবিত্র থাকবে এবং আপনি লাভবান হবেন। আল্লাহ আমাদের তাওফীক প্রদান করুন।

[1] সহীহ মুসলিম ৪/১৯৮৮, নং ২৫৬৫।

[2] মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৬৫, সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ ৩/১৩৫-১৩৯, নং ১১৪৪, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ১/১৯৫, নং ৭৭১, ১/৩৮৫, নং ১৮৯৮, মাওয়ারিদুয যামআন ৬/২৭৮-২৮০।

[3] সুনানুত তিরমিযী ৪/৬৬৪, নং ২৫১০, মুসনাদ আহমাদ ১/১৬৪, মুসতাদরাক হাকিম ৪/১৮৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৩০, ইরওয়াউল গালীল ৩/২৩৭-২৪২, নং ৭৭৭।

[4] সুনানু আবী দাউদ ৪/২৭৬, নং ৪৯০৩, যয়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ. ৩২৩, নং ২১৯৭।
ঘ. আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ - (৬) সৃষ্টির অধিকার বা পাওনা নষ্ট করা

আমরা ইতোপূর্বে কবীর গোনাহের আলোচনার সময় কুরআন ও হাদীসে এজাতীয় গোনাহের মধ্যে যে সকল গোনাহকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তার সংক্ষেপ তালিকা পেশ করেছি। সেখানে এ জাতীয় ৬৯ টি পাপের উল্লেখ রয়েছে। মহান প্রভু আল্লাহ মানুষকে ভালবাসেন ও মানুষকে করুণা করতে চান। সাথে সাথে তিনি ন্যয়বিচারক মহাবিচারের প্রভু। তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে ন্যয় প্রতিষ্ঠা করবেন তিনি। কোনো মানুষ যদি অন্য কোনো মানুষ, সৃষ্টি বা জীব জানোয়ারের অধিকার বা প্রাপ্য নষ্ট করে বা কম দেয় এবং জীবদ্দশায় তার অধিকার বুঝিয়ে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে না পারে মহাবিচারের দিনে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত সৃষ্টির অধিকার পরিপূর্ণভাবে আদায় করে দেবেন। সেদিন কোনো টাকাপয়সা বা সম্পদ দিয়ে ক্ষতিপূরণ দানের সুযোগ থাকবে না। তখন যালিম, ক্ষতিকারী বা অধিকার হরণকারী ব্যক্তির নেককর্ম বা সাওয়াব নিয়ে মাযলূমকে প্রদান করা হবে। যদি যাকির এ বিষয়ে সতর্ক না থাকেন তাহলে তার কষ্টার্জিত সাওয়াব ও নেক কর্ম অন্য মানুষ ভোগ করবেন, আর তিনি বঞ্চিত হয়ে শাস্তি ভোগ করবেন।


কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে সমাজের পরস্পরের অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এগুলি শিক্ষা করা ও পালন করা যাকিরের জন্য বিশেষ জরুরি। আমাদের সমাজে অনেক ধার্মিক ব্যক্তিই স্ত্রীর অধিকার, সন্তানগণের অধিকার, প্রতিবেশীর অধিকার, সহকর্মীর অধিকার, কর্মদাতার অধিকার, কর্মী বা কর্মচারীর অধিকার আত্মীয়স্বজনের অধিকার, বিধবা, এতিম, দরিদ্র ও সমাজের অন্যান্য দুর্বল শ্রেণীর অধিকার, সমাজের অমুসলিম নাগরিকগণের অধিকার, পলিত পশু ও জীব জানোয়ারের অধিকার সম্পর্কে খুবই অসচেতন। আমরা অত্যন্ত বেদনার সাথে লক্ষ্য করি যে, অধিকাংশ ধার্মিক মানুষ অন্যের অধিকার নষ্ট করার কঠিন পাপে লিপ্ত থাকেন। হয়ত তাহাজ্জুদ, যিকর, নফল সিয়াম, দ্বীন প্রতিষ্ঠায় ও প্রচারে রত রয়েছেন; কিন্ত স্ত্রী, সন্তান, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, কর্মস্থল, সেবা গ্রহণে আগত ব্যক্তি, কর্মদাতা ও অন্য অনেকের অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন ও নষ্ট করেন। এগুলিকে অনেকে খুবই হালকা ভাবেন বা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তাদের কঠিন অন্যায়কে যুক্তিসঙ্গত করতে চেষ্টা করেন। যাকিরকে এসকল বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

ঘ. আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ - (৭) গীবত বা পরনিন্দা করা বা শোনা

অন্য মানুষের অধিকার নষ্টের একটি বিশেষ দিক গীবত বা পরনিন্দা করা। কোনো মানুষের অনুপস্থিতিতে তার কোনো সত্যিকারের দোষত্রুটি বলাই ইসলামের পরিভাষায় গীবত। যেমন,- একজন মানুষ বেটে, রগচটা, অহঙ্কারী, তোতলা, বিলাসী, অল্প শিক্ষিত, জামাত কাযা করে, ধুমপান করে, স্ত্রী পর্দা করে না, দ্বীনের অমুক কাজে অবহেলা করে ..., ইত্যাদি কোনো দোষ বা দৃষ্টিকটু বিষয় সত্যিই তার মধ্যে রয়েছে। তার অনুপস্থিতিতে তার এই দোষ উল্লেখ করা গীবত ও কঠিন পাপ।

মুমিনের পুণ্য বিনষ্ট করার অন্যতম কারণ গীবত। কুরআনে গীবতকে ‘মৃতভাইয়ের মাংস খাওয়া’-এর সাথে তুলনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই পাপের ভয়ঙ্কর পরিণতি সম্পর্কে অগণিত হাদীসে উম্মতকে সাবধান করেছেন। সবচেয়ে কঠিন বিষয় গীবত করা বান্দার হক্ক সংশিলষ্ট পাপ। সংশিলষ্ট ব্যক্তি ক্ষমা না করলে এই অপরাধের কারণে আমাদের পুণ্য তাকে প্রদান করতে হবে।

মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ


“হে মুমিনগণ তোমরা অধিকাংশ অনুমান-ধারণা পরিত্যাগ কর; কারণ কোনো কোনো অনুমান-ধারণা পাপ। এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অপরের অনুপস্থিতিতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মতৃ ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করতে চাইবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।”[1]


রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ وَلَا تَحَسَّسُوا وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا تَحَاسَدُوا وَلَا تَدَابَرُوا وَلَا تَبَاغَضُوا وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا


“খবরদার! তোমরা অবশ্যই অনুমান-ধারণা থেকে বহুদূরে থাকবে। কারণ অনুমান ধারণাই সবচেয়ে বড় মিথ্যা। এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় জানার চেষ্টা করবে না, গোপন দোষ সন্ধান করবে না, পরস্পরে হিংসা করবে না, পরস্পরে বিদ্বেষে লিপ্ত হবে না এবং পরস্পরে শত্রুতা ও সম্পর্কচেছদ করবে না। তোমরা পরস্পরে ভাইভাই আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও।”[2]


এভাবে আমরা জানতে পারছি যে, অনুমানে কথা বলা এবং অন্যের দোষ অনুসন্ধান করা হারাম। শুধু তাই নয়, অনুসন্ধান ছাড়াও যদি অন্যের কোনো দোষত্রুটি মানুষ জানতে পারে তা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করা গীবত ও হারাম।

গীবত ১০০% সত্য কথা। কোনো ব্যক্তির ১০০% সত্য দোষত্রুটির কথা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করার নামই গীবত। আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন,

ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال أتدرون ما الغِيبة قالوا الله ورسوله أعلم قال ذكرك أخاك بما يكره قيل أفرأيت إن كان في أخي ما أقول قال إن كان فيه ما تقول فقد اغتبته وإن لم يكن فيه فقد بهَتَّه


রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা কি জান গীবত বা অনুপস্থিতের নিন্দা কী? সাহাবীগণ বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (সা.) ভাল জানেন। তিনি বলেন, তোমার ভাইকে তার অনুপস্থিতিতে এমনভাবে উল্লেখ করা যা সে অপছন্দ করে। তখন প্রশ্ন করা হলো, বলুন তো, আমি যা বলছি তা যদি সত্যই আমার ভাইয়ের মধ্যে বিরাজমান হয় তাহলে কি হবে? তিনি বলেন, তুমি যা বলছ তা যদি সত্যই তার মধ্যে বিরাজমান থাকে তাহলে তুমি তার গীবত করলে। আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে তাহলে তুমি তার মিথ্যা অপবাদ করলে।”[3]


আমরা ভাবি, সত্য কথা বলব তাতে অসুবিধা কি? আমরা হয়ত বুঝি না বা প্রবৃত্তির কুমন্ত্রনায় বুঝতে চাই না যে, সব সত্য কথা জায়েয নয়। অনেক সত্য কথা মিথ্যার মত বা মিথ্যার চেয়েও বেশি হারাম। আবার কখনো বলি, আমি এ কথা তার সামনেও বলতে পারি। আর সামানে যা বলতে পারেন তা পিছনে বলাই তো গীবত।

গীবতের নিন্দায় এবং এর কঠোরতম শাস্তির বর্ণনায় অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এখানে সেগুলির বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। এখানে আমরা কয়েকটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই :


ধার্মিক মানুষদের পতনের অন্যতম কারণ গীবত। সমাজের অধিকাংশ ধার্মিক, আলিম, যাকির, আবিদ, ইসলামের দাওয়াত, তাবলীগ, আন্দোলন ইত্যাদিতে নিয়োজিত ধর্মপ্রাণ মুসলিম সকলেই এই কঠিন বিধ্বংসী পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ি। সাধারণত আমরা নিজেদের সহকর্মী, সঙ্গী অথবা অন্য কোনো দলের বা মতের কোনো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির গীবত করে মজা পাই। এছাড়া সমাজের ব্যবসায়ী, নেতৃস্থানীয় মানুষ সকলেরই ব্যক্তিগত সমালোচনা ও গীবত করে আমরা তৃপ্তি পাই। অনেক সময় আমরা গীবতকে যুক্তিসঙ্গত বলে প্রমাণিত করতে গিয়ে বলি- ‘আমি এ সকল কথা তার সামনেও বলতে পারি’। সামনে যে কথা বলা যায় সে কথা অগোচরে বললে গীবত হবে। অনেক সময় আমরা গীবতকে ইসলামী বা ধর্মীয় রূপদান করি। লোকটি অন্যায় করে, পাপ করে তা বলব না? এখানে আমাদেরকে কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে:


প্রথমত, কোনো ব্যক্তির অন্যায় দেখলে বা জানলে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করা মুমিনের দায়িত্ব। কিন্ত তার অন্যায়ের কথা তার অনুপস্থিতিতে অন্য মানুষের সামনে আলোচনার নামই গীবত, যা কঠিনভাবে হারাম। গীবতের মাধ্যমে কোনোদিনই কাউকে সংশোধন করা যায় না। শুধুমাত্র নিজের শয়তানী প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো হয়।


দ্বিতীয়ত, কোনো ব্যক্তির দোষত্রুটির কথা তার অনুপস্থিতিতে বলার একটিই শরীয়ত সম্মত কারণ আছে, অন্য কাউকে অধিকতর ক্ষতি থেকে রক্ষা করা। এক্ষেত্রেও মুমিনকে বুঝতে হবে যে, এই কাজটি একটি ঘৃণিত কাজ। একান্তই বাধ্য হয়ে তিনি তা করছেন। কাজেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছুই না বলা।


তৃতীয়ত, গীবত কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে হারাম করা হয়েছে। কুরআন কারীমে বা সহীহ হাদীসে স্পষ্টভাবে গীবতকে কোনো অবস্থায় হালাল বলা হয় নি। শুধু কোনো মানুষ বা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করার একান্ত প্রয়োজনে তা বৈধ হতে পারে বলে আলিমগণ মত প্রকাশ করেছেন। এখন মুমিনের কাজ কুরআন ও হাদীস যা নিষেধ করেছে তা ঘৃণাভরে পরিহার করবেন। এমনকি সেই কর্মটি কখনো জায়েয হলেও তিনি তা সর্বদা পরিহার করার চেষ্টা করবেন। শূকরের মাংস, মদ, রক্ত ইত্যাদি আল্লাহ হারাম করেছেন এবং প্রয়োজনে জায়েয বলে ঘোষণা করেছেন। এখন মুমিনের দয়িত্ব কী? বিভিন্ন অজুহাতে প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে এগুলি ভক্ষণ করা? না যত কষ্ট বা প্রয়োজনই হোক তা পরিহার করার চেষ্টা করা?

গীবতও ঠিক অনুরূপ একটি হারাম কর্ম যা একান্ত প্রয়োজনে বৈধ হতে পারে। গীবত ও শূকরের মাংসের মধ্যে দুটি পার্থক্য। প্রথম পার্থক্য শূকরের মাংস যে প্রয়োজনে খাওয়া যেতে পারে তা কুরআনেই বলা হয়েছে, পক্ষান্তরে গীবতের ক্ষেত্রে অনুরূপ কিছু কুরআন বা সহীহ হাদীসে বলা হয়নি। দ্বিতীয় পার্থক্য, সাধারণভাবে শূকরের মাংস ভক্ষণ করা শুধুমাত্র আল্লাহর হক্ক জনিত পাপ। সহজেই তাওবার মাধ্যমে তা ক্ষমা হতে পারে। পক্ষান্তরে গীবত বান্দার হক্ক জনিত পাপ। এর ক্ষমার জন্য সংশিলষ্ট ব্যক্তির ক্ষমা প্রয়োজন। এজন্য মুমিনের দায়িত্ব বিভিন্ন অজুহাতে বা যয়ীফ-মাউযূ হাদীসের বরাত দিয়ে এই পাপে লিপ্ত না হয়ে যথাসাধ্য একে বর্জন করা।


চতুর্থত, ইসলামে অন্যের দোষ তার অনুপস্থিতিতে বলতে যেমন নিষেধ করা হয়েছে, অপরদিকে তা গোপন করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يُسْلِمُهُ وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ


“মুসলিম মুসলিমের ভাই। একজন আরেকজনকে জুলুম করে না এবং বিপদে পরিত্যাগ করে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত থাকবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মেটাতে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের কষ্ট-বিপদ দূর করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন।”[4]


মিশরের গভর্নর সাহাবী উকবা ইবনু আমির (রাঃ) এর সেক্রেটারী ‘আবুল হাইসাম দুখাইন’ বলেন, আমি উকবা (রাঃ) কে বললামঃ, আমাদের কয়েকজন প্রতিবেশী মদপান করছে। আমি এখনি যেয়ে পুলিশ ডাকছি যেন তাদের ধরে নিয়ে যায়। উকবা বলেন, তুমি তা করো না। বরং তুমি তাদেরকে উপদেশ দাও এবং ভয় দেখাও।.... আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বলতে শুনেছি,

من ستر عورة مؤمن فكأنما استحيا موءودة في قبرها


“যে ব্যক্তি কোনো মুমিন ব্যক্তির দোষ গোপন করল, সে যেন জীবন্ত প্রেথিত একটি কন্যাকে তার কবর থেকে উঠিয়ে জীবন দান করল।” হাদিসটি সহীহ।[5]

পঞ্চমত, মুমিনের দায়িত্ব যথাসম্ভব নিজের অন্তরকে নিজের ভুলত্রুটি ও পাপের স্মরণে, তাওবায় ও দু‘আয় ব্যস্ত রাখা। অন্যের ভুল, অন্যায়, পাপ ইত্যাদির চিন্তা মুমিনের অন্তরকে নোংরা করে এবং অগণিত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করে। গীবতের ফলে মুমিনের মনে অহংকার জন্ম নেয়, যা আখেরাতের ধ্বংসের অন্যতম কারণ।

প্রিয় পাঠক, নাজাতের উপায় কারো অনুপস্থিতে তার কথা আলোচনা বা চিন্তা করা সর্বোতবাবে পরিহার করা। সর্বদা নিজের দোষত্রুটির কথা চিন্তা করা। নিজের নাজাতের পথ খুঁজতে থাকা। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন; আমীন।

[1] সূরা হুজরাতঃ ১২।

[2] সহীহুল বুখারী ৩/১০০৯, ৫/১৯৭৬, ২২৫৩, ৬/২৪৭৪; সহীহ মুসলিম ৪/১৯৮৫।

[3] সহীহ মুসলিম ৪/২০০১।

[4] বুখারী আস-সহীহ ২/৮৬২; মুসলিম আস-সহীহ ৪/১৯৯৬, ২০৭৪।

[5] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৪২৬; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ২/২৭৫; হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ৫/৩৫।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 পরের পাতা »