এক্ষেত্রেও অনেকে সুন্নাতের বিরোধিতা করেন। জানাযার সালাতের মধ্যে যে সময়ে মৃতের জন্য দু‘আ করতে রাসূলুল্লাহ (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন ও যে সময়কে দু‘আর জন্য নির্ধারণ করেছেন সে সময়ে মনদিয়ে মুনাজাত না করে, অনেকে জানাযার সালাতের সালাম ফেরানোর পরে সেখানে দাঁড়িয়ে আবারো দু‘আ-মুনাজাত করি। জানাযার সালাতের সালামের পরের মুনাজাতের এই রেওয়াজটি আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলেই ছিল না। কিন্তু এখন এই সুন্নাত বিরোধী কর্মীট ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। যারা একটির প্রচলন করছেন তারা এর পক্ষে অনেক যুক্তি প্রদান করেন।
তাঁরা বলেন, মৃতের জন্য সাওয়াব রেসানীর নিয়্যাতে আমরা তা করি, জানাযার পরে একটি দেরি করা নিষিদ্ধ নয়... ইত্যাদি। অনেক হাদীস থেকে দলিল পেশ করেন। উপরে উল্লিখিত হাদীসে আমরা দেখেছি, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যখন তোমরা মৃতের উপর (জানাযার) সালাত আদায় করবে তখন তার জন্য আন্তরিকতার সাথে দু‘আ করবে।” তাঁরা বলেন যে, এ হাদীস থেকে মৃতের জানাযার পরে দু‘আ করার নির্দেশ প্রমাণিত হয়। তাঁরা ভুলে যান অথব মনে করতে চান না যে, দু‘আর ক্ষেত্রে ও সাওয়াব রেসানীর ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং সাহাবীগণের সুন্নাতই সর্বোত্তম। তাঁরা কখনোই জানাযার সালাত আদায়ের পরে এভাবে সাওয়াব রেসানী করেন নি। একটি যয়ীফ বা মিথ্যা হাদীসও নেই যে, রাসূলুল্লাহ (সা.), তাঁর সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ বা পরবর্তী ইমামগণ কখনো একবারও জানাযার সালাতের সালাম ফেরানোর পরে আবার মৃতের জন্য মুনাজাত করেছেন। কখনোই তাঁরা জানাযার সালাম ফেরানোর পরে কাতার ভেঙ্গে বা কাতার ঠিক রেখে, অথবা কোনোভাবে দু‘আ- মুনাজাত করেন নি। তাঁরা জানাযার সালাতের মধ্যে- সালামের পূর্বে- আন্তরিকতার সাথে মৃতের জন্য দু‘আ করেছেন।
এ কারণে প্রাচীন যুগ থেকেই মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ বারংবার বলেছেন যে, হাদীস নির্দেশিত এই দু‘আর সময় জানাযার সালাতের মধ্যে তৃতীয় তাকবীরের পরে এবং জানাযার সালামের পরে আর কোনো দু‘আ করা যাবে না।[1] কারণ এতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো দু’আ-পদ্ধতির সাথে বৃদ্ধি ও সংযোগ করা হবে এবং তাঁর পদ্ধতি অসম্পূর্ণ বলে মনে হবে। তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আবূ বাকর ইবনু হামিদ বলেন:
إن الدعاء بعد صلاة الجنازة مكروه
“সালাতুল জানাযার পরে দু‘আ করা মাকরূহ’[2]
অনরূপভাবে হানাফী মাযহাবের অনেক প্রসিদ্ধ ফকীহ ও ইমাম জানাযার সালাতের পরে দু‘আ-মুনাজাত করা নিষেধ করেছেন এবং বিদ‘আত বলে উল্লেখ করেছেন। দশম-একাদশ হিজরী শতাব্দীর প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মুল্লা আলী কারী (১০১৪ হি) তার প্রসিদ্ধ ‘মিরকাত’ গ্রন্থে বলেন:
لا يدعو للميت بعد صلاة الجنازة لأنه يشبه الزيادة على صلاة الجنازة
“সালাতুল জানাযার পরে মৃতব্যক্তির জন্য দু‘আ করবে না; কারণ তা সালাতুল জানাযার সাথে অতিরিক্ত সংযোগ বলে গণ্য হবে।”[3] বস্তুত, আমরা অনারব। আরবী ভাষায় সালাতুল জানাযার মধ্যে যে দু’আ আমরা পাঠ করি তাতে নিজেদের মনের আবেগ আসে না এবং মৃতের জন্য কী চাইলাম তা বুঝতে পারি না। আমাদের মনের মধ্যে আবেগ থাকে অন্তর দিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার জন্য। এজন্য আমরা এই খেলাফে সুন্নাত রীতিটি আমরা সহজেই গ্রহণ করি। একে হালাল করার জন্য অনেকে জানাযার কাতার ভেঙ্গে দেন, যেন জানাযার সাথে অতিরিক্ত সংযোগ বলে মনে না হয়। কিন্তু যেভাবেই আমরা তা করি না কেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের সাথে অতিরিক্ত সংযোজন হবেই। সালাতুল জানাযার সালামের পরেই রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের সুন্নাত ছিল মৃতদেহ তুলে দাফনের জন্য অগ্রসর হওয়া। আর আমাদের সুন্নাত, মৃতদেহ রেখে দিয়ে কিছু সময় দু‘আ করা। এখন অবিকল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পদ্ধতিতে কেউ জানাযার সালাত শেষে মৃতদেহ উঠিয়ে কবরের দিকে রাওয়ানা হলে আমাদের মনে হবে মৃতের জন্য দু‘আ পুর্ণ হলো না। আর এভাবেই সকল বিদ‘আতের উৎপত্তি।
এজন্য আমাদের দায়িত্ব হলো সুন্নাতের মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখা। জানাযার মধ্যে যথাসম্ভব বুঝে ও মনোযোগের সাথে মৃতের জন্য দু‘আ করা। যদি না বুঝতে পারি তবুও মনে করতে হবে যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো ভাষায় মৃতের জন্য দু‘আ করেছি। তার নাজাতের জন্য এই যথেষ্ট। এরপর মনের আবেগ দিয়ে দু‘আ করার জন্য সারাটি জীবন আমাদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
[2] মাওলানা মুহাম্মাদ সারফারায খানসাহেব সাফদার, রাহে সুন্নাত, পৃ. ২০৬।
[3] মুল্লা আলী কারী, মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৭০।