শোকর অর্থ কৃতজ্ঞতা, রিদা অর্থ সন্তুষ্টি এবং কানা‘আত অর্থ স্বল্পে তুষ্টি। এই তিনটি কর্মে মুমিনের মনকে অনুশীলন করতে হবে। এগুলি দুনিয়া ও আখিরাতের অনন্ত নিয়ামতের উৎস। আল্লাহ বলেন: “যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর তবে আমি আরো বাড়িয়ে দেব। আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও তবে আমার শাস্তি বড় কঠিন।”[1]
আমাদের প্রত্যেকের জীবনে অগণিত নেয়ামত রয়েছে। আবার অনেক কষ্টও রয়েছে। মানুষের একটি বড় দুর্বলতা আনন্দের কথা তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া ও কষ্ট বেদনার কথা বারংবার স্মরণ করা। এই দুর্বলতা কাটাতে হবে। জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই ইতিবাচক হতে হবে। আমরা কখনোই কষ্ট ও অসুবিধাগুলিকে বড় করে দেখব না। কষ্টের কথা বারংবার মনে করে জাবর কাটব না। বরং আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত, শান্তি, সুখ বারংবার স্মরণ করে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব। এই ইতিবাচক ও কৃতজ্ঞতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা মানব জীবনের শ্রেষ্টতম সম্পদ। এই দৃষ্টিভঙ্গি যে কোনো মানুষের জীবনকে অনন্ত শান্তি ও পরিতৃপ্তিতে ভরে দেয়।
কষ্টের অনুভুতিকে ক্রমান্বয়ে কৃতজ্ঞতার অনুভুতিতে রূপান্তরিত করতে হবে। আল্লাহর অগনিত নিয়ামতের মধ্যে কিছু কষ্টের কারণে যদি গোনাহ ক্ষমা হয় ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায় তাহলে অসুবিধা কী? দুনিয়ায় প্রতিটি মানুষের জীবনেই বিপদাপদ ও অসুবিধা আসে। কাজেই আমার জীবনে তো কিছু অসুবিধা থাকবেই। বিপদ ও সমস্যা তো আরো কঠিন হতে পারত। অনেকের জীবনেই তো আমার চেয়েও অধিক কষ্ট আছে। কাজেই আমার হতাশ হওয়ার কিছু নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
إذا نظر أحدكم إلى من فضل عليه في المال والخلق (والرزق) فلينظر إلى من هو أسفل منه ... فإنه أجدر أن لايزدر نعمه الله عليه
“সম্পদে, শক্তিতে বা রিযকে তোমাদের চেয়ে উত্তম কারো দিকে যখন তোমাদের কারো দৃষ্টি পড়বে, তখন যেন সে তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় যারা আছে তাদের দিকেও দৃষ্টি করে। তাকে আল্লাহ যে নিয়ামতে দিয়েছেন তার প্রতি অবজ্ঞা ও অবমূল্যায়ন থেকে আত্মরক্ষার উপায় এটি।”[2]
অতি সামান্য নেয়ামতেরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অভ্যাস তৈরি করতে হবে। সামান্যতম আনন্দ, তৃপ্তি, ভাললাগা, চারিপার্শের কারো সামান্যতম সুন্দর আচরণ সব কিছুর জন্য হৃদয়ভরে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। আমার প্রতিপালকের দেওয়া সামান্যতম নেয়মতও যে আমার জন্য অনেক বড়। ছোট্ট নেয়ামতকে বড় করে অনুভব করলে আল্লাহ আরো বড় নেয়ামত প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ
من لم يشكر القليل لم يشكر الكثير
যে ব্যক্তি অল্পের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে বেশিরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।[3]
জীবনের সকল আনন্দ, সুখ, খুশি, লাভ, পুরস্কার ইত্যাদি সকল নিয়ামতের কথা প্রসঙ্গ ও সুযোগ পেলে অন্যদেরকে বলতে হবে। আমরা সাধারণত সুখের বা আনন্দের কথার চেয়ে দুঃখের কথা বলতে বেশি আগ্রহী। আমাদেরকে এর বিপরীত বলার অভ্যাস আয়ত্ব করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ
التحدث بنعمة الله شكر وتركها كفر
“আল্লাহর নিয়ামতের কথা বলা কৃতজ্ঞতা এবং তা না বলা অকৃতজ্ঞতা।”[4]
আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার দাবি, বান্দার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। যদি কোনো ব্যক্তি আমাদের প্রতি সামান্যতম সহযোগিতা করেন তবে আমাদের দায়িত্ব, তার প্রতি পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। সম্ভব হলে তাকে প্রতিদান দেওয়া। না হলে তার জন্য দু‘আ করা এবং তার উপকারের কথা অকপটে সকলের কাছে স্বীকার করা ও বলা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
لا يشكر الله من لا يشكر الناس
“যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতিও অকৃতজ্ঞ।”[5]
অন্য হাদীসে তিনি বলেনঃ
من أتى إليكم معروفا فكافئوه ، فإن لم تجدوا ما تكافئونه فادعوا له حتى تعلموا أن قد كافأتموه
“যদি তোমাদের কাউকে কেউ কোনোভাবে উপকার করে তবে তোমরা তার প্রতিদান দেবে। যদি তোমরা প্রতিদান দিতে না পার তবে তার জন্য বেশি বেশি দোয়া করবে যাতে অনুভব করতে পার যে, তোমরা তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পেরেছ।”[6]
[2] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৩৮০; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২২৭৫; তিরমিযী, আস-সুনান ৪/২৪৫।
[3] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৪/২৭৮, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/২১৭। হাদিসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।
[4] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৪/২৭৮, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৫/২১৭। হাদিসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।
[5] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৩৩৯। তিনি হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
[6] আবু দাউদ, আস-সুনান ২/১২৮, ৩২৮; আলবানী, সহীহুত তারগীব ২/১০৩১। হাদিসটি সহীহ।