রাহে বেলায়াত দ্বিতীয় অধ্যায় - বেলায়াতের পথে যিকরের সাথে ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
ঘ. আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ - (৫) হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা

অহঙ্কারের পাশাপশি মানব হৃদয়ে সবচেয়ে নোংরা ও ক্ষতিকারক কর্ম হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অমঙ্গল কামনা, পারস্পারিক শত্রুতা, ইত্যাদি। হৃদয়ে এগুলির উপস্থিতি হৃদয়কে কলুষিত করে, ভারাক্রান্ত করে, আল্লাহর যিকর থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সর্বোপরি অন্যান্য নেক আমল নষ্ট করে দেয়। হাদীসের আলোকে মুসলমান মুসলমানে হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতার দুটি ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা জানতে পারি।

প্রথমত, আল্লাহর বিশেষ ক্ষমা লাভ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

تعرض أعمال الناس فى كل جمعة مرتين يوم الاثنين ويوم الخميس فيغفر لكل عبد مؤمن إلا عبدا بينه وبين أخيه شخناء فيقال اتركوا أو اركعوا هذين حتي يفيئ


“প্রতি সপ্তাহে দুইবার - সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দাদের কর্ম (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। তখন সকল মুমিন বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়, শুধুমাত্র ঐ ব্যক্তি বাদে যার ও তার অন্য ভাইয়ের মধ্যে বিদ্বেষ ও শত্রুতা (hatred) আছে। এদের বিষয়ে বলা হয়, এদের বিষয় স্থগিত রাখ, যতক্ষণ না এরা ফিরে আসে।”[1]

অন্য হাদীসে মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

يطلع الله إلي جميع خلقه ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن (لأخيه)


“শা’বান মাসের মধ্যবর্তী রাত্রে (১৪ই শা’বানের দিবাগত রাত্রে) আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং তাঁর সকল বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, শুধুমাত্র শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি এবং যে ব্যক্তির সাথে অন্য ভাইয়ের বিদ্বেষ (hatred) রয়েছে তাদেরকে বাদে।” হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বিভিন্ন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি সনদ হাসান বা গ্রহণযোগ্য। সার্বিকভাবে হাদীসটি সহীহ।[2]

দ্বিতীয়ত, সকল নেক কর্ম ও ধর্ম ধ্বংস করে দেয়। যুবাইর ইবুনল আউআম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

دب إليكم داء الأمم الحسد والبغضاء هى الحالقة لا أقول تحلق الشعر ولكن تحلق الدين والذى نفسي بيده لا تدخلوا الجنة حتي حتي تؤمنوا حتي تحابوا أفلا أنبئكم بما يثبت ذاكم لكم أفشوا السلام بينكم


“পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির ব্যাধি তোমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে : হিংসা ও বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ মুন্ডন করে দেয়। আমি বলি না যে তা চুল মুন্ডন করে, বরং তা দ্বীন বা ধর্মকে মুন্ডন ও ধ্বংস করে দেয়। আমার প্রাণ যাঁর হাতে তাঁর শপথ করে বলছি, বিশ্বাসী না হলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর পরস্পরে একে অপরকে ভালো না বাসলে তোমরা বিশ্বাসী বা মুমিন হতে পারবে না। এই ভালবাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম আমি শিখিয়ে দিচ্ছি, সর্বত্র ও সবর্দা পরস্পরে সালাম প্রদানের রেওয়াজ প্রচলিত রাখবে।” হাদীসটি গ্রহণযোগ্য।[3]

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে যয়ীফ সনদে বর্ণিত অন্য হাদীসে বলা হয়েছে:

إياكم والحسد فإن الحسد يأكل الحسنات كما تأكل النار الحطب أو قال العشب


“খবরদার! হিংসা থেকে আত্মরক্ষা করবে; কারণ হিংসা এমনভাবে নেককর্ম ধ্বংস করে ফেলে, যেমনভাবে আগুন খড়ি বা খড়কুটো পুড়িয়ে ফেলে।” হাদীসটির সনদে দুর্বলতা আছে, তবে উপরের হাদীসের অর্থ তা সমর্থন করে।[4]


অন্যায়ের ঘৃণা করা বনাম হিংসা ও অহংকার

আরেকটি বিষয় আমাদেরকে সমস্যায় ফেলে দেয়। আমরা জানি যে, শিরক, কুফর, বিদ‘আত, হারাম, পাপ ইত্যাদিকে ঘৃণা করা ও যারা এগুলিতে লিপ্ত বা এগুলির প্রচার প্রসারে লিপ্ত তাদেরকে ঘৃণা করা আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ঈমানী দায়িত্ব। আমরা এই দায়িত্ব ও হৃদয়কে মুক্ত রাখার মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সাধন করব?

এই বিষয়টিকে শয়তান অন্যতম ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করে, যা দিয়ে সে অগণিত ধার্মিক মুসলিমকে হিংসা, হানাহানি, আত্মতৃপ্তি ও অহংকারের মত জঘন্যতম কবীরা গোনাহের মধ্যে নিপতিত করছে। এই ফাঁদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য সংক্ষেপে নিম্নের বিষয়গুলি স্মরণ রাখতে হবে।

প্রথমত, পাপ অন্যায়, জুলুম অত্যাচার, শিরক, কুফর, বিদ‘আত বা নিফাককে অপছন্দ বা ঘৃণা করতে হবে রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর অনুসরণে ও তাঁর প্রদত্ত গুরুত্ব অনুসারে। তিনি যে পাপকে যতটুকু ঘৃণা করেছেন, নিন্দা করেছেন বা যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন ততটুকু গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর পদ্ধতি বা সুন্নাতের বাইরে মনগড়াভাবে ঘৃণা করলে তা হবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইসলামের নামে নিজের ব্যক্তি আক্রোশ বা অহংকারকে প্রতিষ্ঠা করা ও শয়তানের আনুগত্য করা।

এক্ষেত্রে বর্তমানে অধিকাংশ ধার্মিক মানুষ কঠিন ভুলের মধ্যে নিপতিত হন। কুরআন ও সুন্নাহে বর্ণিত কঠিন পাপগুলিকে আমরা ঘৃণা করি না বা বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করি না, কিন্তু যেগুলি কোন পাপ নয়, কম ভয়ঙ্কর পাপ বা যেগুলির বিষয়ে কুরআন- হাদীসে স্পষ্ট নির্দেশ না থাকায় আলিমগণ মতভেদ করেছেন সেগুলি নিয়ে হিংসা-বিদ্বেষে নিপতিত হই। ইতঃপূর্বে আমি ইসলামের কর্মগুলির পর্যায় আলোচনা করেছি। আমাদের সমাজের ধার্মিক মুসলিমদের দলাদলি, গীবতনিন্দা ও অহঙ্কারের ভিত্তি শেষ দুইতিন পর্যায়ের সুন্নাত-নফল ইবাদত। আমরা কুফর, শিরক, হারাম উপার্জন, মানুষের ক্ষতি, সৃষ্টির অধিকার নষ্ট, ফরয ইবাদত ত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোন আলোচনা, আপত্তি, বিরোধিতা বা ঘৃণা করি না। অথচ নফল নিয়ে কি ভয়ঙ্কর হিংসা ঘৃণার সয়লাব। অনেক সময় এসকল নফল, ইখতিলাফী বিষয়, অথবা মনগড়া কিছু ‘আকীদা’কে ঈমানের মানদন্ড বানিয়ে ফেলি।

ফরয সালাত যে মোটে পড়ে না, তার বিষয়ে আমরা বেশি চিন্তা করি না, কিন্তু যে সুন্নাত সালাত আদায় করল না, বা সালাতের মধ্যে টুপি বা পাগড়ী পরল না, অথবা সালাতের শেষে মুনাজাত করল বা করল না, অথবা সালাতের মধ্যে হাত উঠালো বা উঠালো না ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমরা হানাহানি ও অহঙ্কারে লিপ্ত রয়েছি।


দ্বিতীয়ত, এই ঘৃণা একান্তই আদর্শিক ও ঈমানী। ব্যক্তিগত জেদাজেদি, আক্রোশ বা শত্রুতার পর্যায়ে যাবে না। আমি পাপটিকে ঘৃণা করি। পাপে লিপ্ত মানুষটিকে আমি খারাপে লিপ্ত বলে জানি। আমি তার জন্য দু‘আ করি যে, আল্লাহ তাকে পাপ পরিত্যাগের তাওফীক দিন।


তৃতীয়ত, ঘৃণা অর্থ হিংসা নয়। ভালবাসার সাথে এই ঘৃণা একত্রিত থাকে। মা তার মলমূত্র জড়ানো শিশুকে দেখে নাক সিটকায় ও তাকে ঘৃণা করে। আপন ভাই তার অপরাধে লিপ্ত ভাইকে ঘৃণা করে। কিন্তু এই ঘৃণার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে ভালবাসা। মূলত ব্যক্তি শিশু বা ব্যক্তি ভাইকে ঘিরে থাকে তার সীমাহীন ভালবাসা, আর তার গায়ে জড়ানো ময়লা বা অপরাধকে ঘিরে থাকে ঘৃণা। সাথে থাকে তাকে ঘৃণিত বিষয় থেকে মুক্ত করার আকুতি। মুমিনের পাপের প্রতি ঘৃণাও অনুরূপ। পাপের প্রতি ঘৃণা যেমন দায়িত্ব ঈমানের প্রতি ভালবাসাও অনুরূপ দায়িত্ব। মুমিনের পাপের দিকে নয়, বরং তার ঈমানের দিকে আগে দৃষ্টি দিতে হবে। ঈমান ও অন্যান্য নেক আমলের জন্য মুমিনকে ভালবাসা ফরয। পাশাপাশি পাপের প্রতি আমাদের ঘৃণা থাকবে, এই ঘৃণা কখনোই মুমিনকে হিংসা করতে শেখায় না, বরং মুমিন ভাইয়ের জন্য দরদভর দু‘আ করতে প্রেরণা দেয়, যেন তিনি পাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন।


চতুর্থত, ঘৃণা ও অহংকার এক নয়। আমি পাপকে ঘৃণা করি। পাপীকে অন্যায়কারী মনে করি। পাপের প্রসারে লিপ্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা করি। কিন্তু এগুলির অর্থ এই নয় যে, আমি আমার নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে অমুক পাপীর চেয়ে উন্নত, মুত্তাকী বা ভাল মনে করি। নিজেকে কারো চেয়ে ভাল মনে করা তো দূরের কথা নিজের কাজে তৃপ্ত হওয়াও কঠিন কবীরা গোনাহ ও ধ্বংসের কারণ। আমি জানি না, আমার ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হচেছ কিনা, আমি জানি না আমার পরিণতি কী আর উক্ত পাপীর পরিণতি কী, কিভাবে আমি নিজেকে অন্যের চেয়ে ভাল মনে করব?


পঞ্চমত, সবচেয়ে বড় কথা, মুমিনকে নিজের গোনাহের চিন্তায় ও আল্লাহর যিকরে ব্যস্ত থাকতে হবে। অন্যের কথা চিন্তা করা থেকে যথা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। আমরা অধিকাংশ সময় অন্যের শিরক, কুফর, বিদ‘আত, পাপ, অন্যায় ইত্যাদির চিন্তায় ব্যস্ত থাকি। মনে হয় আমাদের বেলায়াত, কামালাত, জান্নাত, নাজাত সবকিছু নিশ্চিত। এখন শুধু দুনিয়ার মানুষের সমালোচনা করাই আমার একমাত্র কাজ।

বাঁচতে হলে এগুলি পরিহার করতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া পাপ বা পাপীর চিন্তায় নিজের হৃদয়কে ব্যস্ত রাখা খুবই অন্যায়। এই চিন্তা আমাদের কঠিন ও আখেরাত বিধ্বংসী পাপের মধ্যে ফেলে দেয়। এ আত্মতৃপ্তি ও অহঙ্কার। যখনই আমি পাপীর চিন্তা করি তখনই আমার মনে তৃপ্তি চলে আসে, আমি তো তার চেয়ে ভাল আছি। তখন নিজের পাপ ছোট মনে হয় ও নিজের কর্মে তৃপ্তি লাগে। আর এই ধ্বংসের অন্যতম পথ।এজন্য সাধ্যমত সর্বদা নিজের দ্বীনী বা দুনিয়াবী প্রয়োজন বা আল্লাহর যিকর ও নিজের পাপের চিন্তায় নিজেকে রত রাখুন। হৃদয় পবিত্র থাকবে এবং আপনি লাভবান হবেন। আল্লাহ আমাদের তাওফীক প্রদান করুন।

[1] সহীহ মুসলিম ৪/১৯৮৮, নং ২৫৬৫।

[2] মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৬৫, সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ ৩/১৩৫-১৩৯, নং ১১৪৪, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ১/১৯৫, নং ৭৭১, ১/৩৮৫, নং ১৮৯৮, মাওয়ারিদুয যামআন ৬/২৭৮-২৮০।

[3] সুনানুত তিরমিযী ৪/৬৬৪, নং ২৫১০, মুসনাদ আহমাদ ১/১৬৪, মুসতাদরাক হাকিম ৪/১৮৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৩০, ইরওয়াউল গালীল ৩/২৩৭-২৪২, নং ৭৭৭।

[4] সুনানু আবী দাউদ ৪/২৭৬, নং ৪৯০৩, যয়ীফুল জামিয়িস সাগীর, পৃ. ৩২৩, নং ২১৯৭।