খ. ফরয ও নফল পালন
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, বেলায়াতের পথে চলার ক্ষেত্রে কর্ম দুই প্রকার : (১) ফরয বা অত্যাবশ্যকীয় কর্ম, ও (২) ফরযের অতিরিক্ত নফল বা সুন্নাত ইবাদত। ফরয ইবাদত পালনই আল্লাহর বেলায়েত, নৈকট্য, সাওয়াব ও সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম কর্ম। ফরযের পরে অনবরত নফল ইবাদত পালন বান্দাকে আল্লাহর বন্ধুত্ব বা বেলায়েতের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।
অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় যিকরেরও দুটি পর্যায় আছে : (১) ফরয যিকর, যেমন, সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর যিকর ও (২) নফল যিকর, যা মূলত আমাদের আলোচনার বিষয়। যদি কোনো মুমিন অন্যান্য ফরয ইবাদত আদায় করার পরে নফল যিকর আদায় করেন তাহলে তার যিকর হবে অত্যন্ত ফলদায়ক। কিন্তু তিনি যদি ফরয যিকর ও অন্যান্য ফরয ইবাদতে অবহেলা করেন, অথচ নফল যিকর বেশি বেশি করেন তাহলে তা নিঃসন্দেহে বাতুলতা।
অনেকে ফরয ইবাদত পালন করেন না। ফরয ইলম, আকীদা, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্ব, হালাল উপার্জন, সাংসারিক দায়িত্ব, পিতা-মাতা, সন্তান ও স্ত্রীর দায়িত্ব, সামাজিক দায়িত্ব, সৎকাজে আদেশ, অসৎকাজ থেকে নিষেধ ইত্যাদি সকল ফরয ইবাদত (যার ক্ষেত্রে যতটুকু প্রযোজ্য) পালন না করে নফল ইবাদত পালন করা, নফল যিকর ইত্যাদি পালন বিশেষ কোনো উপকারে লাগবে না। অবস্থা বিশেষে হয়ত নফল ইবাদত কোনো কোনো ফরয ইবাদতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। কিন্তু কোনো অস্থাতেই তা আল্লাহর
নৈকট্য বা বেলায়েতের মাধ্যম নয়। ফরয পরিত্যাগ করলে হারামের গোনাহ হয়। হারামের গোনাহে রত অবস্থায় নফল ইবাদতের অর্থ হলে সর্বাঙ্গে মলমূত্র লাগানো অবস্থায় নাকে আতর মাখা।
এছাড়া, ফরয ইবাদতের মধ্যে যে সকল নফল ইবাদত থাকে তাও ফরযের বাইরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। সালাতের মধ্যে অসংখ্য ফরয, সুন্নাত ও নফল যিকর আযকার রয়েছে। এগুলি বিশুদ্ধভাবে পালন করা সালাতের বাইরে সারাদিন বিশুদ্ধ মাসনূন যিকরের চেয়ে অনেক উত্তম। এর অর্থ এই নয় যে, বিশুদ্ধ সালাত আদায় করলেই চলবে। এর অর্থ, নফল যিকর আযকারে রত হওয়ার আগে সালাত ইত্যাদি ফরয যিকর ও তৎসংশ্লিষ্ট নফল যিকর বিশুদ্ধ ও সুনদরভাবে আদায় করতে হবে। তা না হলে আমাদের যিকর আযকার পন্ডশ্রম ও সুন্নাত বিরোধী হয়ে যাবে। এ বিষয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানীর বক্তব্য আমরা পুস্তকের শুরুতে উল্লেখ করেছি।
ফরয ও নফলের দু’টি শ্রেণী রয়েছে, পালন ও বর্জন। কোনো কাজ করা যেরূপ ফরয, তেমনি কিছু কাজ বর্জন করা ফরয। এসকল কাজ করাকে হারাম বলা হয়। অনুরূপভাবে কিছু কর্ম করা নফল-মুসতাহাব বা সুন্নাত। আবার কিছু কাজ বর্জন করাও নফল- মুসতাহাব বা সুন্নাত। এ ধরনের কাজ করা মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। মাকরূহ কখনো হারামের নিকটবর্তী হয়, যাকে মাকরূহ তাহরীমি বলা হয়। কখনো তা মাকরূহ তানযিহী বা অনুচিত পর্যায়ের হয়, যা বর্জন করা উত্তম তবে করলে গোনাহ হবে না।
আল্লাহর নৈকট্যের পথে কর্মের চেয়ে বর্জনের গুরুত্ব বেশি। যা করা ফরয তা করতেই হবে। আর যা বর্জন করা ফরয তা বর্জন করতেই হবে। যে ব্যক্তি তার উপরে ফরয এরূপ কোনো কর্ম পালন করছেন না, বা তার জন্য হারাম এরূপ কোনো কার্যে রত রয়েছেন, অথচ বিভিন্ন নফল মুসতাহাব কর্ম পালন করছেন তার কাজকে আমরা ইসলামের শিক্ষা বিরুদ্ধ বলতে বাধ্য। তিনি জেনে অথবা না জেনে ভন্ডামীতে রত রয়েছেন।
দ্বিতীয় স্তরে নফল পর্যায়ে বর্জনীয় নফলের গুরুত্ব করণীয় নফলের থেকে অনেক বেশি। সাজানোর পূর্বে পরিচ্ছন্নতা। নিজেকে নোংরা, অপরিচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করে এরপর যতটুকু সম্ভব সাজগোজ করতে হবে। এজন্য সকল প্রকার মাকরূহ বর্জন করা নফল ইবাদতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
مَا نَهَيْتُكُمْ عَنْهُ فَاجْتَنِبُوهُ وَمَا أَمَرْتُكُمْ بِهِ فَافْعَلُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ
“আমি তোমাদেরকে কোনো কিছু নিষেধ করলে তা সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করবে। আর তোমাদেরকে যা করতে নির্দেশ প্রদান করব তা সাধ্যমত করবে।”[1]
আমরা এই গ্রন্থে মূলত নফল যিকর সম্পর্কে আলোচনা করছি। এ সকল নফল যিকর পালনের চেয়ে মাকরূহ বর্জন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য যাকিরকে এ সকল যিকর পালনের পাশাপশি সকল প্রকার মাকরূহ বর্জনের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করতে হবে। কখনো কোনো মাকরূহ করে ফেললে বেশি বেশি তাওবা করতে হবে। ইচ্ছাপূর্বক নিজেকে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন মাকরুহের মধ্যে নিয়োজিত রেখে পাশাপাশি এ সকল যিকর আযকারে রত থাকা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর শিক্ষা, সুন্নাত ও রীতির ঘোর বিরোধী ও বিপরীত।