সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি গোপন ও প্রকাশ্য সম্পর্কে সর্বজ্ঞ, নিজ প্রতাপ ও প্রতিপত্তির মাধ্যমে নিপীড়কদের দমনকারী, নদীতে প্রবাহমাণ পানির ফোটার সংখ্যা গণনাকারী, রাতের অন্ধকার সৃষ্টিকারী যাকে ভোরের আলো মিটিয়ে দূরিভূত করে দেয়। ইবাদতকারীদের জন্য সাওয়াবে পরিপূর্ণতা প্রদানকারী এবং তাদের প্রতিদানে উৎকর্ষতা প্রদানকারী, চোখের খেয়ানত ও অন্তরের গোপন ইচ্ছা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানী, তাঁর রিযিক সকল সৃষ্টিকুলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, ফলে বালুতে অবস্থানরত কোনো পিপড়া কিংবা নীড়ে অবস্থানরত পাখীর বাচ্চাও বাদ যায় নি। ধনী করেন, দরিদ্র করেন আর তাঁরই প্রজ্ঞায় অনুষ্ঠিত হয় ধনাঢ্যতা কিংবা দারিদ্র্যতা। কোনো কোনো সৃষ্টিজীবকে অপর সৃষ্টিজীবের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন এমনকি সময়ের ক্ষেত্রেও, লাইলাতুল কদর, সম্মানিত রাত্রি, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আমি তার এমন প্রশংসা করছি যা কোনো সংখ্যায় শেষ হবার নয়, আর এমন শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি যা তার আরও সাহায্যকে টেনে আনে।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক্ব ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, একজন ঐকান্তিক বিশ্বাসীর সাক্ষ্য, আর আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল যাঁর আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল। আল্লাহ তাঁর উপর সালাত প্রেরণ করুন, অনুরূপ আবু বকরের ওপর, যিনি সুখে কিংবা দুঃখে তাঁর সাথী ছিলেন, অনুরূপ উমরের ওপর, যিনি ছিলেন ইসলামের কাঁধ ও বাজু, আর উসমানের উপর, যিনি ছিলেন কুরআনের বিন্যাস ও একত্রকারী। আর আলীর উপর যিনি একাই যুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনে যথেষ্ট নৈপূণ্যতা প্রদর্শনকারী, অনুরূপ রাসূলের সকল পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের ওপর, যাঁদের প্রত্যেকেই তাদের আমল ও উদ্দেশ্যে ছিলেন সৎ ও কল্যাণকামী। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালামও প্রেরণ করুন।
প্রিয় ভাইয়েরা! রমযানের শেষ দশদিনে রয়েছে বরকতময় ক্বদরের রাত। এ মাসকে আল্লাহ তা‘আলা অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক মর্যাদা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা উম্মতকে এ রাতে অফুরন্ত সাওয়াব ও কল্যাণ দান করে অনুগ্রহ করেছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সুস্পষ্ট কিতাব আল-কুরআনে এ রাতের মর্যাদা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেছেন:
﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةٖ مُّبَٰرَكَةٍۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ ٣ فِيهَا يُفۡرَقُ كُلُّ أَمۡرٍ حَكِيمٍ ٤ أَمۡرٗا مِّنۡ عِندِنَآۚ إِنَّا كُنَّا مُرۡسِلِينَ ٥ رَحۡمَةٗ مِّن رَّبِّكَۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٦ رَبِّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَمَا بَيۡنَهُمَآۖ إِن كُنتُم مُّوقِنِينَ ٧ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۖ رَبُّكُمۡ وَرَبُّ ءَابَآئِكُمُ ٱلۡأَوَّلِينَ ٨ ﴾ [الدخان: ٣، ٨]
“নিশ্চয় আমরা এটা নাযিল করেছি এক মুবারক রাতে; নিশ্চয় আমরা সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থিরকৃত হয়, আমাদের পক্ষ থেকে আদেশক্রমে, নিশ্চয় আমরা রাসূল প্রেরণকারী। আপনার রবের রহমতস্বরূপ; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ-- আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর রব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ্ নেই, তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান; তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পিতৃপুরুষদেরও রব।” (সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ৩-৮)
মহান আল্লাহ এ রাতকে মুবারক বলে গুণান্বিত করেছেন; কারণ এতে রয়েছে অত্যাধিক কল্যাণ, বরকত ও মর্যাদা।
এ রাতের বরকতের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, এ বরকতময় কুরআন ওই রাতেই নাযিল হয়েছে। এর গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন যে, এ রাতে প্রত্যেক চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থিরকৃত হয়, অর্থাৎ লাওহে মাহফূয থেকে লেখক ফেরেশতাদের কাছে স্থিরিকৃত হয়, এ বছর আল্লাহর নির্দেশে রিযিক, বয়স সীমা, ভাল ও মন্দ ইত্যাদি যত প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ রয়েছে সবই। এ সবই আল্লাহর প্রজ্ঞাপূর্ণ ও হিকমতপূর্ণ নির্দেশ যাতে নেই কোনো দোষ, কমতি, অবিবেচনাপ্রসূত কিংবা বাতিল কিছু; সর্বজ্ঞ, মহাসম্মানিতের কাছ থেকে সুনির্ধারিতরূপে।
* মহান আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥ ﴾ [القدر: ١، ٥]
“নিশ্চয় আমরা কুরআন নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে’; আর আপনাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী? ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সে রাতে ফিরিশ্তাগণ ও রূহ্ নাযিল হয় তাদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে। শান্তিময় সে রাত, ফজরের আবির্ভাব পর্যন্ত।’ (সূরা আল-ক্বদর, আয়াত: ১-৫)
ক্বদর শব্দটি সম্মান ও মর্যাদা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার এর অপর অর্থ হচ্ছে, তাকদীর ও ফয়সালা করা; কেননা ক্বদরের রাত অত্যাধিক সম্মানিত ও মহত্বপূর্ণ রাত, এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা এ বছর যা কিছু হবে তা নির্ধারণ করেন এবং প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন।
আর “কদরের রাত্রি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম” কথাটির অর্থ হলো: ফযিলত, সম্মান, অত্যাধিক সাওয়াব ও পুরস্কারের দিক থেকে তা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। তাই যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও সাওয়াবের আশা নিয়ে এ রাতের সালাত (কিয়ামুল-লাইল) আদায় করবে, তার পূর্বের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।
আর “ফেরেশতা নাযিল হওয়া” এর অর্থ হলো: ফেরেশতাগণের অবতরণ; তারা আল্লাহর এক প্রকার বান্দা; যারা দিন-রাত আল্লাহর ইবাদতে রত থাকে। “তারা অহংকার-বশে তাঁর ‘ইবাদাত করা হতে বিমুখ হয় না এবং বিরক্তি বোধ করে না। তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তারা ক্লান্তও হয় না।” (সূরা আল-আম্বিয়া: ১৯-২০) তারা লাইলাতুল ক্বদরের কল্যাণ, বরকত ও রহমত নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন।
আর “রূহ” বলতে জিব্রাঈল ‘আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। মর্যাদা ও সম্মানের কারণে তাঁকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর “শান্তি বর্ষণ” করার অর্থ হলো: লাইলাতুল ক্বদর মুমিনদের জন্য যাবতীয় ভীতিপ্রদ বস্তু হতে শান্তির রাত; কারণ আল্লাহ তা‘আলা বহু লোককে এ রাত্রিতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন, এর মাধ্যমে অনেকেই তাঁর আযাব থেকে মুক্তি নিরাপত্তা পায়।
আর “ফজর উদয় পর্যন্ত” এর অর্থ হলো: ক্বদরের রাতের পরিসমাপ্তি ঘটে ফজর উদয়ের মাধ্যমে; কারণ এর মাধ্যমে রাতের যাবতীয় কাজ শেষ হয়ে যায়।
এ সূরায় ক্বদরের রাতের বিবিধ মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে, যেমন:
প্রথম ফযীলত: আল্লাহ তা‘আলা এ রাতে কুরআন নাযিল করেছেন; যা মানুষের জন্য সঠিক পথ নির্দেশিকা এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য।
দ্বিতীয় ফযীলত: “আপনাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী?” এ প্রশ্নবোধক আয়াত এ রাতের বড় গুরুত্ব ও মহত্বের উপর প্রমাণবহ।
তৃতীয় ফযীলত: এটা এমন এক রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
চতুর্থ ফযীলত: এ রাতে ফেরেশতারা দুনিয়ার বুকে অবতরণ করে থাকেন; যারা কেবল কল্যাণ, বরকত ও রহমত বর্ষণ করতেই অবতরণ করে থাকেন।
পঞ্চম ফযীলত: এটা শান্তি ও নিরাপত্তাময়; কারণ বান্দা এ রাত আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতে কাটিয়ে দেয় ফলে আল্লাহ শাস্তি ও আযাব থেকে অধিক পরিমানে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদান করেন।
ষষ্ঠ ফযীলত: আল্লাহ তা‘আলা এ রাতের সম্মানে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা অবতীর্ণ করেছেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত তিলাওয়াত করা হবে।
এ রাতের ফযীলতের মধ্যে আরও রয়েছে:
* বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ»
‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় ক্বদরের রাতে দণ্ডায়মান থাকবে (ইবাদত করবে), তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’[1]
রাসূলের বাণী: “ঈমান ও সাওয়াবের আশায়” এর অর্থ হলো: আল্লাহর উপর এবং যারা এ রাত্রিতে কিয়াম করবে (সালাত আদায় করবে) তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা যে প্রতিদান তৈরী করে রেখেছেন সেটার উপর তার পূর্ণ ঈমান রয়েছে। আর সওয়াব ও প্রতিদানের আশাও তার থাকতে হবে।
এ ধরনের সাওয়াব প্রাপ্তির যারা জানে ও যারা জানে না সবার জন্যই সাব্যস্ত হবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সওয়াব প্রাপ্তির জন্য জানা থাকা শর্ত করেন নি।
আর লাইলাতুল কদর অবশ্যই রমযান মাসে; কারণ, আল্লাহ তা‘আলা এ রাতেই কুরআন অবতীর্ণ করেছেন; আর তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে তিনি কুরআনকে রমযান মাসে নাযিল করেছেন।
* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ ﴾ [القدر: ١]
“আর অবশ্যই আমরা এ কুরআনকে লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি”। (সূরা আল-কাদর: ১)
* আরও বলেন,
﴿ شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘রমযান এমন একটি মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
এর দ্বারা নির্ধারিত হয়ে গেল যে, পবিত্র ক্বদরের রাত রমযানের মধ্যেই রয়েছে। এটি সকল উম্মতের মধ্যে ছিল আর এ উম্মতের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। কারণ,
* এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ ও নাসাঈ রহ. আবূ যর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ক্বদরের রত সম্পর্কে সংবাদ দিন তা কি রমযানে না অন্য কোনো মাসে? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তা রমযানেই রয়েছে। এরপর আবূ যর আবার প্রশ্ন করলেন, তা কি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যত দিন জীবিত ততদিন অবশিষ্ট থাকবে, নাকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে? উত্তরে তিনি বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে।”[2]... আল-হাদীস।
কিন্তু এ রাতের এ মহান মর্যাদা ও বৃহৎ পুরস্কার এ উম্মতের জন্যই নির্দিষ্ট। যেমন এ উম্মতকে জুম‘আর ফযীলত ও এ জাতীয় অন্যান্য ফযীলত দ্বারা বিশেষিত করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহর জন্যই যাবতীয় প্রশংসা।
আর ক্বদরের রাত অবশ্যই রমযানের শেষ দশ রাতে রয়েছে। কারণ,
* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«تَحَرَّوْا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ»
‘তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষণ করো।’[3]
আর তা জোড় রাত্রিগুলোর চেয়ে বেজোড় রাত্রিগুলোর মধ্যে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
* কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«تَحَرَّوْا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي الوِتْرِ، مِنَ العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ»
‘তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লইলাতুল ক্বদর অম্বেষণ করো।’[4]
আর লাইলাতুল ক্বদর রমযানের শেষ সাত দিনের মধ্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা,
* ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমার হাদীসে এসেছে,
«أَنَّ رِجَالًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أُرُوا لَيْلَةَ القَدْرِ فِي المَنَامِ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَرَى رُؤْيَاكُمْ قَدْ تَوَاطَأَتْ فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ، فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيهَا فَلْيَتَحَرَّهَا فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ»
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কতিপয় সাহাবী রমযানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল ক্বদর স্বপ্নে দেখেছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি দেখতে পাচ্ছি যে তোমাদের সবার স্বপ্ন শেষ সাত দিনের ব্যাপারে এসে একাত্মতা ঘোষণা করছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ক্বদরের রাতকে নির্দিষ্ট করতে চায়, সে যেন শেষ সাত দিনের মধ্যে তা নির্ধারণ করে।’[5]
* অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«الْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ - يَعْنِي لَيْلَةَ الْقَدْرِ - فَإِنْ ضَعُفَ أَحَدُكُمْ أَوْ عَجَزَ، فَلَا يُغْلَبَنَّ عَلَى السَّبْعِ الْبَوَاقِي»
‘তোমরা রমযানের শেষ দশ রাতে লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষণ কর। যদি তোমাদের কেউ দুর্বল থাকে অথবা অক্ষম হয়, তাহলে সে যেন শেষ সাত রাতে সেটা খোঁজতে অপারগ না হয়।’[6]
আর শেষ সাতদিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে ২৭ তম রাত্রিটিই লাইলাতুল ক্বদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ,
* উবাই ইবন কা‘আব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
«وَاللهِ، إِنِّي لَأَعْلَمُهَا اللَّيْلَةُ الَّتِي أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقِيَامِهَا، هِيَ لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ»
আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই সে রাতটিকে জানি যে রাতটিতে কিয়াম করার (সালাত নিয়ে দাঁড়ানোর) কথা আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা হলো, রমযানের ২৭ তম রাত।’[7]
তবে প্রতি বছরেই ক্বদরের রাত ২৭ তারিখে হবে তা নির্ধারিত নয়; বরং সেটি স্থানচ্যুত হয়; কোনো বছর ২৭, আবার কোনো বছরে ২৫ হয়ে থাকে। এতে একমাত্র আল্লাহর হিকমত ও ইচ্ছা নিহিত।
এর প্রমাণ হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা। তিনি বলেছেন,
«التَمِسُوهَا فِي العَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ لَيْلَةَ القَدْرِ، فِي تَاسِعَةٍ تَبْقَى، فِي سَابِعَةٍ تَبْقَى، فِي خَامِسَةٍ تَبْقَى»
“তোমরা এ রাতটিকে রমযানের শেষ দশকে তালাশ কর; নয় রাত বাকী থাকতে তালাশ করো, সাত রাত বাকী থাকতে তালাশ করো, পাঁচ রাত বাকী থাকতে তালাশ করো”।[8]
ইমাম ইবন হাজার রহ. তার ফাতহুল বারীতে বলেন, “আমি প্রাধান্য দিচ্ছি যে, এটি রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে রয়েছে এবং এটি স্থানান্তর হয়ে থাকে।”[9]
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের ওপর অনুগ্রহস্বরূপ এ রাতকে গোপন রেখেছেন। যাতে প্রতেক বান্দা এ রাত অম্বেষণে বেশি করে আমল করতে পারে। এ মহিমাম্বিত রাতে সালাত, যিকির ও দু’আ করে আল্লাহর নৈকট্য ও অধিক সাওয়াব অর্জন করতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা এ রাত গোপন রেখেছেন বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে এ রাত অম্বেষণে অধিক সচেষ্ট হয়, আর কে অলস ঘুমায়। কেননা যে ব্যক্তি কোনো বস্তুর আকাঙ্খী হয় সে তা অর্জনে অধিক চেষ্টা-সাধনা চালায় এবং তা অর্জন করার জন্য সর্বশক্তি ব্যয় করে থাকে। এ পথে তা লাভ করতে ও সঠিক মঞ্জিলে মাকসূদে পৌঁছুতে যত কষ্টই হোক না কেন সেটা তার কাছে গৌণ হিসেবে পরিগণিত হয়। তবে কখনো কখনো আল্লাহ তা‘আলা কিছু কিছু বান্দার জন্য কিছু আলামত ও চিহ্ন দিয়ে এ রাতের জ্ঞানকে প্রকাশ করে থাকেন।
* সে কারণেই একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে রাতের আলামত হিসেবে দেখেছিলেন যে সে রাত্রির সকাল বেলা পানি ও মাটির মধ্যে ফজরের সালাত আদায় করছেন। অতঃপর সে রাত্রিতে বৃষ্টি বর্ষিত হলে সেদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত বৃষ্টি ও মাটির মাঝে আদায় করেন।[10]
সম্মানিত ভাই সকল! ক্বদরের রাতে আল্লাহর রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। প্রিয় বান্দাদের আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের সুযোগ করে দেয়া হয়। আর বান্দা যা কিছু আল্লাহর কাছে চায় আল্লাহ তা শ্রবণ করেন, বান্দার চাহিদা ও প্রার্থনার উত্তর দেন ও সৎ কর্মশীলদের জন্য মহা পুরস্কার নির্ধারণ করেন। কেননা ক্বদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।
তাই আপনারা ক্বদরের রাতের মর্যাদা লাভের অন্বেষণে যথাসাধ্য চেষ্টা করুন। আর গাফিলতি ও অলসতা থেকে সাবধান হোন, কারণ এ ধরনের গাফিলতিতে ধ্বংস অনিবার্য।
গত হয়ে গেছে পুরো জীবন ভুলে ও খেলা এবং ক্ষতিগ্রস্ততায়
আমার জীবনের যে সময়টুকু নষ্ট করেছি তার জন্য আফসোস
জীবনের যে সময়টুকু আমি নষ্ট করেছি তাতে আমার কোনো ওযর নেই
আমি প্রশংসা ও শুকরিয়ার কর্তব্য থেকে কত গাফেল হলাম!!
যেহেতু আল্লাহ আমাদেরকে একটি মাস দিয়েছেন, তা আবার এমন মাস
যে মাসে দয়াময় সবচেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির নাযিল করেছেন।
এ মাসের সাথে কী আর কোনো মাসের তুলনা চলে যেখানে আছে লাইলাতুল কদর?
কারণ, এ রাত্রির সংবাদ দিয়ে বহু সহীহ হাদীস রয়েছে।
গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারীদের থেকে আমাদের কাছে বর্ণিত হয়েছে যে তা খোঁজা হবে বেজোড় রাত্রিতে
সুতরাং সে ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ যে এটাকে এর শেষ দশকে তালাশ করে
এতে নাযিল হয় ফেরেশতারা যাবতীয় নূর ও সৎকাম নিয়ে
আর এজন্যই বলা হয়েছে, শান্তি আর শান্তি যতক্ষণ না উদিত হবে ফজর।
সাবধান! এটাকে গোপন মূলধন হিসেবে জমা করে রাখ, এটা তো সর্বোত্তম মূলধন।
কারণ, এতে রয়েছে বহু মানুষ যারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে অথচ সে জানে না। [11]
হে আল্লাহ! আমাদেরকে তাদের মধ্যে গণ্য করুন যারা এ মাসের সত্যিকারের সিয়াম পালন করেছে, লাইলাতুল ক্বদর লাভ করেছে, এবং এর মাধ্যমে ব্যাপক সাওয়াব ও প্রতিদান প্রাপ্ত হয়েছে।
হে আল্লাহ! আমাদের অন্তর্ভুক্ত করুন তাদের মধ্যে, যারা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করে, সকল অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে পলায়নকারী, জান্নাতের সুউচ্চ প্রসাদসমূহে নিরাপদ অবস্থানকারী, তাদের সাথে যাদের ওপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন ও গুনাহের কাজ থেকে হেফাযত করেছেন।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আশ্রয় দিন পথভ্রষ্টকারী ফিতনা থেকে, বাঁচিয়ে রাখুন অশ্লীলতা থেকে যা প্রকাশ পেয়েছে এবং যা গোপন রয়েছে।
হে আল্লাহ! আপনার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার এবং উত্তম ইবাদত করার তাওফীক দিন। আর আমাদেরকে আপনার আনুগত্যশীল ও ওলীদের কাতারে শামিল করুন। আর দুনিয়া ও আখিরাতে আমাদের কল্যাণ দান করুন ও জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমাদেরকে, আমাদের পিতা-মাতাদেরকে এবং সকল মুসলিমকে আপনার দয়ায় ক্ষমা করুন। হে দয়াময়।আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।
[2] মুসনাদে আহমাদ ৫/১৭১; নাসাঈ, তুহফাতুল আশরাফ অনুসারে ৯/১৮৩; মুস্তাদরাকে হাকেম ১/৪৩৭। তবে এর সনদ দুর্বল।
[3] বুখারী: ২০২০; মুসলিম: ১১৬৯।
[4] বুখারী: ২০১৭।
[5] বুখারী: ২০১৫; মুসলিম: ১১৬৫।
[6] মুসলিম: ১১৯৫।
[7] মুসলিম: ৭৬২।
[8] বুখারী: ২০২১।
[9] ফাতহুল বারী: ৪/২৬৬।
[10] বুখারী: ২০২৭; মুসলিম: ১১৬৭।
[11] এ কবিতাগুলো ইবনে রাজাবের লাতায়েফুল মা‘আরিফে রয়েছে, পৃ. ৩৫১, ৩৫২।