রমযান মাসের ৩০ আসর একবিংশ আসর শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ৩ টি

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি মাহাত্ম্য, চিরস্থায়িত্ব, মহত্ব ও গর্বে একক, এমন সম্মানের অধিকারী যার ইচ্ছা কেউ করতে পারে না, এক ও একক, অনন্য ও অমুখাপেক্ষী, এমন বাদশাহ যিনি কারও প্রয়োজন বোধ করেন না, চিন্তায় যে সব নিকৃষ্টতা আসে তা থেকে তিনি বহু উর্ধ্বে, তিনি এমন মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী যে কোনো বিবেক ও বুঝ তাকে আয়ত্ব করতে পারে না, তাঁর সকল সৃষ্টি থেকে তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ; কারণ যমীনের বুকে যা-ই রয়েছে সবাই তার প্রতি স্থায়ীভাবে মুখাপেক্ষী, তিনি যাকে ইচ্ছা তাওফীক দিয়েছেন ফলে সে তাঁর উপর ঈমান এনেছে এবং তাতে সুদৃঢ় রয়েছে; তারপর তাকে তার প্রভুর সাথে গোপনে আলাপ করার স্বাদ দিয়েছে ফলে সে আরামের ঘুম ত্যাগ করেছে এবং এমন বন্ধুদের সাথী হয়েছে যাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে দূরে থাকে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে মহান প্রভুর সামনে দাঁড়ানো। আপনি যদি তাদের দেখতেন যখন তাদের কাফেলা নিশ্চিদ্র অন্ধকারে চলতে শুরু করেছে, তাদের কেউ তার পদস্খলন থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছে, অপর কেউ বেদনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, আবার কেউ তার যিকিরে ব্যস্ত থাকার কারণে কিছু চাওয়া থেকে বিরত থাকছে, সুতরাং ঐ সত্ত্বা কতই পবিত্র! যিনি এদের জাগিয়ে দিয়েছেন অথচ অন্য মানুষরা সবাই ঘুমে বিভোর, আর ঐ সত্ত্বা কতই বরকতময়! যিনি ক্ষমা করেন ও অপরাধ মিটিয়ে দেন, দোষ-ত্রুটি গোপন করেন ও যথেষ্ট করেন, সবার উপর সব রকমের নেয়ামত ঢেলে দিয়েছেন। আমি তার প্রশংসা করি তার বড় বড় নেয়ামতসমূহের উপর আর তার শুকরিয়া জ্ঞাপন করি এবং তাঁর কাছে ইসলাম নামক নেয়ামতটি হেফাযত করার বিনীত প্রার্থনা করি।

আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোনো হক ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, যে তাঁর দ্বারা প্রতিপত্তি অর্জন করতে চায় সে হয় সম্মানিত ফলে তার উপর কেউ যুলুম করতে পারে না। যে তাঁর আনুগত্য করতে অহঙ্কার করে ও গুনাহে লিপ্ত থাকে সে হয় অপমানিত। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি হালাল ও হারাম বর্ণনা করেছেন।

আর আল্লাহ সালাত পেশ করুন তাঁর উপর, অনুরূপ তাঁর সাথী আবু বকর আস-সিদ্দীক তথা মহাসত্যবাদীর উপর, যিনি সাওর গিরি গুহায় তাঁর উত্তম সহচর হিসেবে ছিলেন, আর ‘উমার ইবনুল খাত্তাবের উপর, যিনি সঠিক কথা কাজের ছিলেন তাওফীকপ্রাপ্ত, আর ‘উসমানের উপর, যিনি বিপদে ধৈয্যধারণ করেছিলেন এবং শত্রুদের হাতে মহান শাহাদাতের মর্যাদা অর্জন করতে পেরেছিলেন, আর তাঁর চাচাতো ভাই আলী ইবন আবী তালেবের উপর, অনুরূপ সকল সাহাবী ও তাঁদের সুন্দর অনুসারীদের উপর, যতদিন আকাশের দিগন্তে নক্ষত্র লুকাতে থাকবে। আর আল্লাহ তাঁদের উপর যথাযথ সালামও পেশ করুন।


প্রিয় ভাইসকল! আল্লাহ আপনাদের রমযানের শেষ দশ দিনে পৌছিয়েছেন। এ দশ দিনের রয়েছে অনেক কল্যাণ ও অধিক সওয়াব; অনেক ফযীলত ও তাৎপর্য। তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য সময়ের চেয়ে এতে বেশি আমল করতেন।

* সহীহ মুসলিমে ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:

«كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، مَا لَا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهِ»

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকে যে পরিমাণ আমল করতেন অন্য কোনো সময় এত বেশি আমল করতেন না।’[1]

* বুখারী ও মুসলিমে উম্মুল মুমিনীন ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:

«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ العَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ»

‘যখন রমযানের শেষ দশদিন আসত, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিধেয় বস্ত্রকে শক্ত করে বাঁধতেন, রাত জেগে ইবাদত করতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।’[2]

* মুসনাদে ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে আরও বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:

«كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْلِطُ الْعِشْرِينَ بِصَلَاةٍ وَنَوْمٍ، فَإِذَا كَانَ الْعَشْرُ شَمَّرَ وَشَدَّ الْمِئْزَرَ »

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম বিশ দিন সালাত আদায় করতেন ও ঘুমাতেন। কিন্তু শেষ দশ দিন ঘুমাতেন না, বরং পরিধেয় বস্ত্রকে মজবুত করে বেঁধে সালাতে মনোনিবেশ করতেন।’[3]

এ সকল হাদীস এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, রমযানের শেষ দশদিনের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা,

* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সময়ের চেয়ে এ দশদিন অধিক আমল করতেন। এ দশদিনে সকল প্রকার ইবাদত তথা সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ও সদাকাহ ইত্যাদি বেশি করতেন।

* অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘পরিধেয় বস্ত্র খুব মজবুত করে বাঁধতেন।’ এর অর্থ হলো, তিনি স্ত্রীদের থেকে দূরে অবস্থান করতেন, যেন সালাত ও যিকিরে অধিক মগ্ন হতে পারেন।

* তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতগুলোতে সারা রাত জাগ্রত থেকে মন, জিহ্বা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দ্বারা যিকির, কুরআন তিলাওয়াত ও সালাতে অতিবাহিত করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা করতেন রাতগুলোর সম্মানার্থে এবং লাইলাতুল কদরের খোঁজে, কারণ, লাইলাতুল কদর এমন এক রাত, যে রাতে ঈমান ও সাওয়াবের আশায় কেউ সালাত আদায় করলে, আল্লাহ তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।

এ হাদীসের স্পষ্ট ভাষ্য থেকে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারা রাত তাঁর রবের ইবাদত তথা সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ও শেষ রাতে সাহরী খাওয়ার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত করতেন।

* এ বক্তব্যের মাধ্যমে উপরোক্ত হাদীস ও সহীহ মুসলিমে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে যা বর্ণিত হয়েছে যে তিনি বলেছেন,

«ما أعلمه صلى الله عليه وسلم قام ليلةً حتى الصباح»

“আমি জানি না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো রাত সকাল পর্যন্ত দাঁড়িয়েছেন।”[4] এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান হয়েছে। কারণ; রমযানের শেষ দশ দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়াম তথা সালাতের জন্য দাঁড়ানোর সাথে সাথে অন্যান্য ইবাদতও করতেন, পক্ষান্তরে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা যা নিষেধ করেছেন তা হচ্ছে শুধু কিয়াম তথা সালাতে দণ্ডায়মান হয়ে সারা রাত নিঃশেষ করা। ‘আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানেন’।

এ হাদীস থেকে শেষ দশকের আরও যে ফযীলত জানা যাচ্ছে তা হলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত ও যিকিরের জন্য নিজ পরিবারবর্গকেও জাগ্রত রাখতেন এ আশায় যেন তারা শেষ ১০ রাতের উপযোগী ইবাদতের মাধ্যমে বরকত লাভ করতে পারেন।

নিঃসন্দেহে প্রতিটি মানুষের জীবনে এটা একটি সুবর্ণ সুযোগ। যাকে আল্লাহ তাওফীক দান করেন সে-ই এ অমূল্য নেয়ামত লাভ করতে পারে। সুতরাং বুদ্ধিমান মু’মিন ও তার পরিবার-পরিজনের জন্য এ মূল্যবান সময় অবহেলায় কাটানো উচিৎ হবে না। বস্তুত এ মূল্যবান সময় খুব হাতেগোনা নির্দিষ্ট কয়েকটি রাত; হতে পারে কোনো লোক এ মূল্যবান রাতে আল্লাহর রহমতের একটু পরশ পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। ফলে সেটা তার জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে যাবে।

তবে কেউ কেউ এ মহান রাত অবহেলায় কাটিয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভুত কল্যাণ থেকে মাহরূম ও বঞ্চিত হয়। কোনো কোনো মুসলিমকে দেখা যায়, তারা এ মূল্যবান সময় অবহেলায় কাটায়। রাতের বেশির ভাগ সময় হাসি-ঠাট্টা ও অনর্থক খেলাধুলায় কাটিয়ে দেয়। অতঃপর সালাতের সময় ঘুমিয়ে থাকে। এভাবে ইবাদতবিহীন রাত কাটিয়ে নিজেরা অনেক কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। তারা এ মূল্যবান রাত আর নাও পেতে পারে।

আর এসব হচ্ছে শয়তানের কর্মকাণ্ড ও প্রতারণা, যা আল্লাহর রাস্তা হতে ফিরিয়ে রাখার ও পথভ্রষ্ট করার এক অশুভ পরিকল্পনা।

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِنَّ عِبَادِي لَيۡسَ لَكَ عَلَيۡهِمۡ سُلۡطَٰنٌ إِلَّا مَنِ ٱتَّبَعَكَ مِنَ ٱلۡغَاوِينَ٤٢﴾ [الحجر: ٤٢]

‘নিশ্চয় আমার বান্দাদের ওপর তোমার সামান্যতম আধিপত্য নেই; তবে বিপথগামীদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে চলে, তারা ছাড়া।’ (সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৪২)

বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া শয়তানকে কখনোই বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে পারে না। কেননা এটা জ্ঞান ও ঈমানের বিপরীত কাজ।

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿أَفَتَتَّخِذُونَهُۥ وَذُرِّيَّتَهُۥٓ أَوۡلِيَآءَ مِن دُونِي وَهُمۡ لَكُمۡ عَدُوُّۢ ۚ بِئۡسَ لِلظَّٰلِمِينَ بَدَلٗا﴾ [الكهف: ٥٠]

‘তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে (শয়তানকে) ও তার বংশধরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? তারা তো তোমাদের শত্রু, এটা কতই না নিকৃষ্ট বিকল্প।’ (সূরা আল-কাহফ, আয়াত: ৫০)

* আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِنَّ ٱلشَّيۡطَٰنَ لَكُمۡ عَدُوّٞ فَٱتَّخِذُوهُ عَدُوًّاۚ إِنَّمَا يَدۡعُواْ حِزۡبَهُۥ لِيَكُونُواْ مِنۡ أَصۡحَٰبِ ٱلسَّعِيرِ ٦ ﴾ [فاطر: ٦]

‘নিশ্চই শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবেই গণ্য কর, সে তো তার দলবলকে জাহান্নামী হওয়ার জন্যই আহ্বান করে।’ (সূরা ফাতির, আয়াত: ৬)

[1] মুসলিম: ১১৭৫।

[2] বুখারী: ২০২৪; মুসলিম: ১১৭৪।

[3] আহমাদ ৬/৬৮, ১৪৬।

[4] মুসলিম: ৭৪৬।
ই‘তিকাফ রমযানের শেষ ১০ দিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ১০ দিনে মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন।

আর ই‘তিকাফ হলো, আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য পার্থিব কাজ থেকে অবসর হয়ে মসজিদে অবস্থান করা। ই‘তিকাফ করা সুন্নাত, যা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]

‘তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফ অবস্থায় তোমাদের স্ত্রীদের সাথে মেলা-মেশা করো না।’ (সূরা আল-বাকারাহ্‌, আয়াত: ১৮৭)

তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই‘তিকাফ করতেন সাহাবাগণও ই‘তিকাফ করতেন।

* আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের প্রথম ১০ দিন ই‘তিকাফ করলেন, এরপর দ্বিতীয় ১০ দিন ই‘তিকাফ করলেন, এরপর বললেন,

« إِنِّى اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ ثُمَّ أُتِيتُ فَقِيلَ لِى إِنَّهَا فِى الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ ».

‘আমি প্রথম ১০ দিন ই‘তিকাফ করে এ মহান রাতটি খুঁজলাম, এরপর দ্বিতীয় ১০ দিন ই‘তিকাফ করলাম, কিন্তু তাতে কদর নামক রাতটি পেলাম না। এরপর আমাকে বলা হলো, এ রাতটি শেষ ১০ দিনের মাঝে নিহেত রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই ই‘তিকাফ করতে চায়, সে যেন শেষ দশকে ই‘তিকাফ করে।’[1]

* সহীহ বুখারী ও মুসলিমে ‘আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত,

كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِه.

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রমযানের শেষ ১০ দিনে ই‘তিকাফ করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীগণও ই‘তিকাফ করতেন।’[2]

* সহীহ বুখারীতে ‘আয়েশা ছিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে আরও বর্ণিত,

كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَعْتَكِفُ فِي كُلِّ رَمَضَانَ عَشْرَةَ أَيَّامٍ فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الَّذِي قُبِضَ فِيهِ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ يَوْمًا.

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমযানে ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন। আর তিনি যে বছর মারা যান, সে বছর ২০ দিন ই‘তিকাফ করেছেন।’[3]

* আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত,

كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ فَلَمْ يَعْتَكِفْ عَامًا فَلَمَّا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ اعْتَكَفَ عِشْرِينَ لَيْلَةً.

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ ১০ দিন ই‘তিকাফ করতেন, পুরো বছর আর কোনো ই‘তিকাফ করতেন না। পরবর্তী বছর রমযানে ২০ দিন ই‘তিকাফ করেছেন।’[4]

* ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ই‘তিকাফ করতেন, ফজরের সালাত আদায় করতেন তারপর ই‘তিকাফের জন্য নির্ধারিত স্থানে প্রবেশ করতেন। একবার আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তার কাছে অনুমতি চাইলেন, তিনি তাকে অনুমতি দিলেন, অতঃপর তার জন্যও তাঁবু টাঙ্গানো হলো। এরপর হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা আয়েশার কাছে তার জন্য রাসূলের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার অনুরোধ জানালেন, তিনি তাই করলেন, ফলে তার জন্যও তাঁবু টাঙ্গানো হলো, অতঃপর যখন যায়নার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা সেটা দেখলেন, তিনি তার জন্য তাঁবু টাঙ্গানোর নির্দেশ দিলেন, ফলে তাই করা হলো। অতঃপর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকগুলো তাঁবু দেখলেন তখন বললেন, এটা কি? তারা বলল, এ হচ্ছে আয়েশা, হাফসা ও যাইনাবের তাঁবু। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তারা কী এর মাধ্যমে সাওয়াব পাওয়ার ইচ্ছা করছে? তোমরা এগুলোকে খুলে ফেল, আমি এগুলোকে দেখতে চাই না। ফলে এগুলো খুলে ফেলা হলো, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের ই‘তিকাফ পরিত্যাগ করলেন; শেষপর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাওয়ালে প্রথম দশক ই‘তিকাফ করলেন।” (বুখারী ও মুসলিমের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে সংগৃহীত।[5]* ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. বলেন, “আমি জানি না কোনো আলেম দ্বিমত করেছেন কি না যে: ই‘তিকাফ সুন্নাত।”

[1] মুসলিম: ১১৬৭।

[2] বুখারী: ২০২৬; মুসলিম: ১১৭২।

[3] বুখারী: ২০৪৪।

[4] তিরমিযী: ৮০৩; ইবন মাজাহ: ১৭৭০; ইবন খুযাইমাহ: ৩/৩৪৬।

[5] বুখারী: ২০৩৩, ২০৩৪, ২০৪৫; মুসলিম: ১১৭১।
ই’তিকাফের উদ্দেশ্য ও ই‘তিকাফকারী মসজিদ থেকে সারা শরীর নিয়ে বের হওয়া

ই’তিকাফের উদ্দেশ্য

“কোনো মানুষ সাধারণ মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহের কোনো মসজিদে বসে তাঁর অনুগ্রহ, সাওয়াব এবং লাইলাতুল কদর লাভের আশায় একান্তভাবে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করা। এ জন্য প্রত্যেক ই‘তিকাফকারীর উচিৎ আল্লাহর যিকির, কুরআন তিলাওয়াত, সালাত ও অন্যান্য ইবাদতে ব্যস্ত থাকা এবং দুনিয়াবী অনর্থক কথা-বার্তা থেকে বেঁচে থাকা।

তবে পরিবার বা অন্য কারও সাথে কোনো বৈধ বিষয়ে অল্প কথা-বার্তায় কোনো দোষ নেই। কারণ,

* উম্মুল মুমিনীন সাফিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مُعْتَكِفًا فَأَتَيْتُهُ أَزُورُهُ لَيْلاً فَحَدَّثْتُهُ ثُمَّ قُمْتُ لأنْقَلِبَ، أي: لأنصرف إلى بيتي، فَقَامَ النبي صلى الله عليه وسلم مَعِي» ... الحديث. متفق عليه.

আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ই‘তিকাফ অবস্থায় রাতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম এবং কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললাম, আলোচনা শেষে যখন বাড়িতে ফিরে আসতে চাইলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বিদায় দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।’[1]

ই‘তিকাফকারীর জন্য স্ত্রী সহবাস ও তার পূর্বক্রিয়া যেমন- চুম্বন করা, পূর্ণ উত্তেজনার সঙ্গে স্পর্শ করা নিষেধ। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]

‘তোমরা মসজিদে ই‘তিকাফ অবস্থায় সহবাস ও তাদের সঙ্গে অন্যান্য যৌনকর্ম করবে না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭)

আর ই‘তিকাফকারীর মসজিদ হতে বের হওয়ার ব্যপারে বিধান হলো, যদি শরীরের কিছু অংশ বাইরে বের করে তবে কোনো দোষ নেই। কারণ,

* ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«كَانَ النبي صلى الله عليه وسلم يُخْرِجُ رَأْسَهُ مِنَ الْمَسْجِدِ وَهْوَ مُعْتَكِفٌ فَأَغْسِلُهُ وَأَنَا حَائِضٌ».

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ই‘তিকাফ অবস্থায় মসজিদ হতে মাথা বের করতেন আর আমি ঋতু অবস্থায় তাঁর মাথা ধৌত করতাম।’[2]

* অন্য বর্ণনায় এসে,

كَانَتْ تُرَجِّلُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم وَهِيَ حَائِضٌ وَهْوَ مُعْتَكِفٌ فِي الْمَسْجِدِ وَهْيَ فِي حُجْرَتِهَا يُنَاوِلُهَا رَأْسَهُ

‘‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ঋতু অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুল আঁচড়ে দিতেন। তখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা তার কক্ষেই থাকতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মাথা বের করে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার দিকে দিতেন।’[3]

ই‘তিকাফকারী মসজিদ থেকে সারা শরীর নিয়ে বের হওয়ার তিন অবস্থা:

প্রথম: কোনো প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে যাওয়া। তা স্বভাবগত হোক বা শরীয়তসম্মত হোক। যেমন পেশাব-পায়খানা, উযু, ফরয গোসল, ইত্যাদি ও পানাহার হয়, আর ওই কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা মসজিদে না থাকে বা সমজিদে সম্ভব না হয়, তা হলে ই‘তিকাফকারীর জন্য বাইরে যাওয়া জায়েয হবে। আর যদি ওই কাজগুলো মসজিদে করা সম্ভব হয় বা তার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে ই‘তিকাফকারীর মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয হবে না। গেলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।

দ্বিতীয়: কোনো ইবাদত জাতীয় কাজের জন্য বের হওয়া, যা তার ওপর ওয়াজিব নয়। যেমন- অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখার জন্য যাওয়া ও জানাযায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। এসব অবস্থায় বের হওয়া জায়েয নেই; তবে যদি ই‘তিকাফের প্রথমেই শর্ত করে নেয় যে, তবে বের হওয়াতে ক্ষতি নেই। যেমন, ই‘তিকাফকারীর কোনো রোগী থাকে; যাকে সে দেখা-শোনা করতে চায়, অথবা যদি তাঁর মৃত্যুর আশংকা থাকে আর ই‘তিকাফ শুরুর পূর্বেই তাকে দেখতে যাওয়ার শর্ত করে থাকে তবে সমস্যা নেই।

তৃতীয়: ই‘তিকাফকারী এমন কোনো কাজের জন্য বের হওয়া যা ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য বিরোধী। যেমন, যেমন ক্রয়-বিক্রয়, স্ত্রী সহবাস অথবা তাদের সাথে মেলা-মেশা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া। ই‘তিকাফকারী এগুলো করতে পারে না। এর জন্য শর্ত করলেও কোনো লাভ নেই। শর্ত করা না করা সমান। কারণ, এগুলো ই‘তিকাফ নষ্ট করে দেয় এবং তার মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি।

রমযানের এই শেষ দশ দিনের আরও অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এ ১০ দিনের মধ্যে রয়েছে লাইলাতুল কদর, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সুতরাং আল্লাহ তোমাদেরকে রহমত করুন, তোমরা এ ১০ দিনের ফযীলত সম্পর্কে জান, সাবধান! এ মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করবে না; কেননা এ সময়গুলো অতীব মূল্যবান, এর কল্যাণ স্পষ্ট ও প্রকাশ্য।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এমন কর্মের তৌফিক দিন যাতে আমাদের দ্বীন ও দুনিয়ার মঙ্গল নিহিত রয়েছে। আর আমাদের শেষ পরিণাম সুন্দর করুন এবং সম্মান জনক ঠিকানা দান করুন। আর আমাদেরকে এবং আমাদের পিতা-মাতা ও সকল মুসলিমদেরকে আপনার কৃপায় ক্ষমা করে দিন।আর আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।

[1] বুখারী: ২০৩৮; মুসলিম: ২১৭৫।

[2] বুখারী: ৩০১, ২০৩১; মুসলিম: ২৯৭।

[3] বুখারী: ২০২৮; মুসলিম: ২৯৭।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৩ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে